Main menu

বাংলা ক্ল্যাসিক। দ্বিজ কানাইয়ের মহুয়া।

This entry is part 1 of 9 in the series বাংলাদেশি ফিকশন

এইটা কাহিনিটার পাঁচ নাম্বার ভার্সন।

দ্বিজ কানাই ১৫০০/১৬০০ সালের দিকে এই কাহিনিটা বান্ধেন। গ্রেটার মৈমনসিংহ এলাকায় এইটা গাওয়া হইতো। নেত্রকোণা জেলার সান্দিকোনার মসকা গ্রামের সেখ আসক আলী আর উমেশচন্দ্র দে’র এইটা জানা ছিল। তাদের কাছ থিকা এই কাহিনি সংগ্রহ করছিলেন চন্দ্রকুমার দে, ১৯০০ সালের দিকে। তারপরে এইটা এডিট করছিলেন শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন। ছাপাইছিলেন এবং অনেক প্রচার প্রচারণা করছিলেন। উনার ‘প্রাচীন পল্লীগীতিকা’রে  এখন কাহিনির আকারে লিখতেছি আমি।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন ২৪টা অধ্যায়ে ভাগ কইরা আলাদা আলাদা নাম দিছিলেন। আমি নামগুলা চেইঞ্জ করছি, আলাদা কইরা নাম না দিয়া, কাহিনির ভিতর থিকাই নামগুলা নিছি। অধ্যায় বা পার্টগুলাও অল্প একটু বদলাইছি। অনেকগুলা ফুটনোট দিছিলেন উনি, শব্দগুলার কি মানে, সেইগুলা বুঝানোর লাইগা, সেইগুলার অনেক কমাইছি, বেশিরভাগই অদরকারি মনে হইছে আমার। বানানে অনেক যফলা ইউজ করা হইছিল উচ্চারণের কাছাকাছি থাকার লাইগা, তো সেইগুলাও কিছু জায়গায় অদরকারি মনে হইছে আমার। উচ্চারণের কাছাকাছি থাকতে পারাটা লিখিত ফর্মে একটু ঝামেলার জিনিসই, অনেক ক্যারিকেচার করলেও মৈমনসিংহা উচ্চারণ অ্যাচিভ করাটা মেবি টাইফই হবে যারা ধরেন কানাডা আম্রিকায় জন্মানোর পরে বাংলাভাষা শিখছেন।… শব্দের বানানরে উচ্চারণের কাছাকাছি রাখার পরে পরিচিত লিখিত বানানের ব্যাপারে যতোটা কম চেইঞ্জ করা যায়, সেই চেষ্টা করছি।

আর দীনেশচন্দ্র সেন তো একটা অরিজিনাল ফরম্যাটে রাখার ট্রাই করছেন, সেইখানে আমি ফর্মটারেই চেইঞ্জ করছি গ্রসলি। কিন্তু ফর্মের দোহাই দিয়া নতুন শব্দ না ঢুকায়া পুরান যত শব্দ আছিল, বেশিরভাগ সময় সেইগুলাই রাখার ট্রাই করছি। কারণ আমার মনে হইছে, বলা বা পারফর্ম করা যেমন একটা ঘটনা, লেখা বা পড়া একইরকমের ঘটনা না। সুর কইরা পড়াটা বেশিরভাগ সময়ই আরামের। কিন্তু অনেক সময় মনেহয় অভ্যাসের কারণেই বেশি কনসানট্রেশন দিতে হয় সুরটাতে, বা সুরটা মেইন ঘটনা হয়া উঠে, তখন পড়াটা ঝামেলারই হয় কিছুটা। তো, পড়ার জন্য সুরটারে কিছুটা আলগা কইরা কাহিনির মতন বলাটা বেটার না ঠিক, বরং স্মুথ ও রিলেটিভলি সহজ একটা এক্সপেরিয়েন্স দিতে পারে হয়তো। এইভাবে ভাবছি। মানে, একটা জিনিস যখন একটা মিডিয়াম থিকা আরেকটা মিডিয়ামে আসে তখন এমনিতেই ফর্মের কিছুটা চেইঞ্জ হওয়ার কথা। যেই জিনিস আমি বলবো, লেখার সময় হয়তো একইভাবে লিখবো না। তো, বলার জিনিসটারে লিখলে কি রকম হইতে পারে, সেইরকম একটা এক্সপেক্টশন থিকা লেখার জিনিসটারে সাজাইতে চাইছি আমি। 

তবে মোস্টলি যেই ঘটনাটা ঘটছে, শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন এইটারে একটা ‘আঞ্চলিক সাহিত্য’ হিসাবে রিড করছেন, যারে তিনি রক্ষা করতেছেন বা উদ্ধার করছেন, যেইটা আমাদের বাংলা সাহিত্যে স্থান পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু আমি এইরকম মার্জিনাল জায়গা থিকা দেখি নাই। এইটা গ্রাম্য, আঞ্চলিক কোন জিনিস না, বরং এইটাই বাংলা সাহিত্য, মেইনস্ট্রিম ঘটনা। এইটারে বাংলা ভাষা, বাংলা ক্ল্যাসিক হিসাবে আমি পড়ছি আর পড়ার সাজেশন দিতেছি।

 

ই.হা.
ডিসেম্বর, ২০১৯ – জানুয়ারি, ২০২০

 

…………………………………………………………

নমশুদ্রের বাহ্মণ দ্বিজ কানাই নামক কবি ৩০০ বৎসর পূর্বে এই গান রচনা করেন। প্রবাদ এই, দ্বিজ কানাই নমশূদ্র-সমাজের অতিহীনকূল-জাতা এক সুন্দরীর প্রেমে মত্ত হইয়া বহু কষ্ট সহিয়াছিলেন, এজন্যই ‘নদের চাদ’ ও ‘মহুয়া’র কাহিনীতে তিনি এস প্রাণঢালা সরলতা প্রদান করিতে পারিয়াছিলেন। নদের চাদ ও মহুয়ার গান একসময় পূর্ব-মৈমনসিংহের ঘরে ঘরে গীত ও অভিনীত হইত। কিন্তু উত্তরকালে ব্রাহ্মণ্য-ধৰ্ম্মের কঠোর শাসনে এই গীতিবর্ণিত প্রেম দুর্নীতি বালয়া প্রচারিত হয়, এবং হিন্দুরা এই গানের উৎসাহ দিতে বিরত হন।…

গীতিবর্ণিত ঘটনার স্থান নেত্রকোণার নিকটবর্তী। খালিয়াজুরি থানার নিকট-রহমৎপুর হইতে ১৫ মাইল উত্তরে। “তলার হাওর” নামক বিস্তৃত হাওর’–ইহারই পূৰ্বে বামনকান্দি, বাইদার দীঘি, ঠাকুরবাড়ীর ভিটা, উলুয়াকান্দি প্রভৃতি স্থান এখন জনমানবশূন্য হইয়া রাজকুমার ও মহুয়ার স্মৃতি বহন করিতেছে। এখন তথায় কতকগুলি ভিটামাত্র পড়িয়া আছে। কিন্তু নিকটবর্তী গ্রামসমূহে এই প্রণয়িযুগ্মের বিষয় লইয়া নানা কিংবদন্তী এখনও লোকের মুখে মুখে চলিয়া আসিতেছে। যে কাঞ্চনপুর হইতে “হোমরা” বেদে মহুয়াকে চুরি করিয়া লইয়া যায়—তাহা ধনু নদীর তীরে অবস্থিত ছিল।

নেত্রকোণার অন্তর্গত সান্দিকোনা পোষ্টাফিসের অধীন মসকা ও গোরালী নামক দুইটি গ্রাম আছে—মসকা গ্রামের সেক আসক আলী ও উমেশচন্দ্র দে এবং গোরালীর নসুসেকের নিকট হইতে এই গানের অনেকাংশ সংগৃহীত হয়। ১৯১২ খৃষ্টাব্দের ৯ই মার্চ আমি চন্দ্রকুমারের নিকট হইতে এই গাথা। পাইয়াছি। চন্দ্রকুমার দে যেভাবে গীতিটি পাঠাইয়াছিলেন, তাহাতে… গোড়ার গান শেষ আর শেষের গান গোড়ায় এই ভাবে গীতিকাটি উলট-পালট ছিল, আমি যথাসাধ্য এই কবিতাগুলি পুনঃ পুনঃ পড়িয়া পাঠ ঠিক করিয়া লইয়াছি।

এই গানের মোট ৭৫৫ ছত্র পাওয়া গিয়াছে, আমি তাহা ২৪টি অধ্যায়ে বিভক্ত করিয়া লইয়াছি।

 

শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন
১৯২৩

 

…………………………………………………………

 

কিবা গান গাইবাম আমি

পূবেতে বন্দনা করলাম পূবের ভানুশ্বর।
এক দিকে উদয়রে ভানু চৌদিকে পশরৎ|

দক্ষিণে বন্দনা গো করলাম ক্ষীর নদী সাগর।
যেখানে বানিজজি করে চান্দ সদাগর॥

উত্তরে বন্দনা গো করলাম কৈলাস পর্বত।
যেখানে পড়িয়া গো আছে আলীর মালামের পাথুথর॥

পশ্চিমে বন্দনা গো করলাম মক্কা এন স্থান।
উরদিশে বাড়ায় ছেলাম মমিন মুসলমান ॥

সভা কইরা বইছ ভাইরে ইন্দু মুসলমান।
সভার চরণে আমি জানাইলাম ছেলাম ॥

চাইর কুনান্ট পিরথিমি গো বইন্ধ্যা মন করলাম স্থির।
সুন্দর বন মুকামে বন্দলাম গাজী জিন্দাপীর॥

আসমানে জমিনে বন্দলাম চান্দে আর সুরুয।
আলাম-কালাম বন্দুম কিতাব আর কুরাণ॥

কিবা গান গাইবাম আমি বন্দনা করলাম ইতি।
উস্তাদের চরণ বন্দলাম করিয়া মিন্নতি॥

 

. মহুয়া সুন্দরী

এইখান থিকা উত্তরের পথে যাইতে থাকলে ছয় মাস পরে পড়বো গারো পাহাড়। তারও উত্তরে আছে হিমানী পরবত। সেই পরবতের পারে আছে সাত সমুদ্দুর। সেইখানে এক বন, যেইখানে চান্দ নাই, সুরুয় নাই। কিছুই দেখা যায় না। বাঘ ভালুক বাস করে। মাইন্‌সের কোন লরাচরা নাই।

সেই বনে থাকতো হুমরা বাইদ্দা। এই কাহিনি হুমরা বাইদ্দার।

বেটা আছিল ডাকাইত, ডাকাইতের সদ্দার। মাইনকা নামে তার এক ছুড ভাই আছিল। নানান দেশ ঘুরত অরা। ঘুরতে ঘুরতে একদিন ধনু নদীর পারে যাইয়া উপস্থিত হইল। গেরামের নাম কাঞ্চনপুর। সেইখান বসতি ছিল এক বরাম্মনের। তার ছিল ছয় মাসের শিশু কইন্যা। নিশাকালে হুমরা তারে করল চুরী। চুরী কইরা দেশ ছাইরা গেল।

ছয় মাসের শিশু কন্যা বচ্ছরের হৈল। পিঞ্জরে রাখিয়া পঙ্খী যেমনে পালে, সেইরকম যতন কইরা তারে পালতে লাগলো হুমরা বাইদ্দা। এক দুই তিন কইরা ১৬ বছর হৈল। অনেক যতন কইরা তারে সাপের খেলা শিখাইলো। সাপের মাথার মণি জ্বলা দেখলে যেমন মানুশ পাগল হয়, বাইদ্দার মেয়েরে দেখলে এইরকম পাগল হওয়ার দশা হয়।

বাইদ্দা বাইদ্দা করে লোকে বাইদ্দা কেমন জনা।
আন্দাইর ঘরে থুইলে কন্যা জ্বলে কাঞ্চা সোনা॥

হাটিয়া না যাইতে কইন্যার পায়ে পরে চুল।
মুখেতে ফুট্টা উঠে কনক চাম্পার ফুল॥

আগল ডাগল আখিরে আসমানের তারা।
তিলেক মাত্র দেখলে কইন্যা না যায় পাশুরা॥

বাইদ্দার কইন্যার রূপে ভাইরে মুনীর টলে মন।
এই কইন্যা লইয়া বাইদ্দা ভরমে তিরভুবন॥

পাইয়া সুন্দরী কইন্যা হুমরা বাইদ্দার নারী।
ভাবা চিন্তা নাম রাখল “মহুয়া সুন্দরী” ।

. বৈদেশেতে যাব আমরা

একদিন হুমরা বাইদ্দা ডাক দিয়া কইলো, মাইনকা ভাই, চল, খেলা দেখাইতে বৈদেশেতে যাই। মাইনকা কইলো, ঠিকাছে, শুক্কুরবারে চল যাই।

শুক্কুর বার দিন সকালে বাইদ্দার দলের লোক যত গাট্টিবুচকা আছে লইয়া রওনা দিল। আগে হুমরা বাইদ্দা, তার পাছে ভাই মাইনকা, আর তার পাছে দলের সব লোক। বাশ, তাম্বু, দড়ি, কাছি যা ছিল সব লইয়া বাইর হইল। পিঞ্জিরায় ভরিয়া লগে লইল ময়না, টিয়া, সোনামুখী দোয়েল। ঘোড়া লইল, গাধা লইল, লইল রাও চণ্ডালের হাড়। শিয়াল, হেজা ধরার লাইগা লইল শিকারী কুকুর। সবার লগে চলল মহুয়া সুন্দরীও। তার গলা ধরাধরি কইরা চলল সই পালঙ্ক।

এক দুই তিন করি মাস গুয়াইল। বামনকান্দা গ্রামে যাইয়া বাইদ্দারা উপস্থিত হইল।

 

. নদ্দার চান

রাতের বেলা, আসমানে যখন তারা ভরা আর পূর্ণ মাসীর চান। নদ্দার চান লোকজন নিয়া বইসা ছিল। তখন এক লেংরা ছেলাম জানাইয়া পরবেশ করল। কইল, গেরামে নতুন এক বাইদ্দা আইছে, তামসা দেখাইবো। বাইদ্দার দলে পরম এক সুন্দরী কইন্যা আছে, সারা দুনিয়ায় এইরকম সুন্দরী কইন্যা নাই।

এই কথা শুইনা নদ্দার চান মা’র কাছে গেল। গিয়া কইলো, মা গো নতুন এক বাইদ্দা আইছে তামসা করবার লাইগা, তোমার আদেশ পাইলে তামসা করাইতে চাই।  মা কইলো, বাইদ্দার তামসা করাইতে কয়শ টেকা লাগে? নদের চান কইলো, একশ টেকা লাগে। মা কইলো, ঠিকাছে, বাইর বাড়ীর মহলে করাও তাইলে।

 

. বাইদ্দার তাম্সা

হুমরা বাইদ্দা ডাক দিয়া মাইনকারে কইলো, ভাইরে চল, ধনু কাডি লইয়া চল তামসা করতে যাই।

হুমরা বাইদ্দা যখন ডুলে মারলো বাড়ী, নদ্যাপুরের মানুশজন দৌড়াদৌড়ি লাগায়া দিল। একজন একজন কইরা সবাই জানলো যে, ঠাকুর বাড়ী বাইদ্দার তামসা বসবো। চাইর দিক থিকা লোকজন আইলো। সবার মাঝখানে বইসা নদ্দার ঠাকুর উকি ঝুকি দিতে লাগলো।

বাইদ্দার ছেরি যখন খেলা দেখানি শুরু করলো, নদ্দার ঠাকুর তারে দেইখা বসা থিকা খাড়া হয়া গেল। বাঁশ নিয়া যখন দড়ি বাইতে গেল, নদ্দার ঠাকুর টেনশনে পইড়া গেল, পইড়া নি মরে সুন্দরী!

সব খেলা দেখানির পরে, মহুয়া নদ্দার চানের কাছে গিয়া ইনাম বকশিস চাইল। মনে মনে নদ্দার ঠাকুর ভাবে, যদি তাঁর মন পাইতাম আমি! নদ্দার চান খুশি হয়া হাজার টেকার শাল দিল মহুয়ারে, টেকা কড়ি দিল। ডাইল দিল চাইল দিল, রাইন্ধা খাওয়ার লাইগা।

হুমড়া বাইদ্দা তখন থাকার লাইগা একটা বাড়ী চাইল। নদ্দার চান বাইদ্দার দলরে উলুইয়াকান্দাতে বাড়ী বান্ধার পারমিশন দিল।

 

. নয়া বাড়ী

নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্দা বানলো জুইতের ঘর।
লীলুয়া বয়ারে কইন্যার গায়ে উঠলো জ্বর॥

নয়া বাড়ী লইয়া রে বাইদ্দা লাগাইল বাইঙ্গন।
সেই বাইঙ্গন তুলতে কইন্যা জুড়িল কান্দন॥

কাইন্দ না কাইন্দ না কইন্যা না কান্দিয়ো আর।
সেই বাইঙ্গন বেইচা দিয়াম তোমার গলায় হার॥

নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্দা লাগাইলো উরি।
তুমি কইন্যা না থাকলে আবার গলায় ছুরি॥

নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্দা লাগাইলো কচু।
সেই কচু বেইচা দিয়াম তোমার হাতের বাজু॥

নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্দা লাগাইলো কলা।
সেই কলা বেচ্যা দিয়াম তোমার গলার মালা॥

নয়া বাড়ী লইয়ারে বাইদ্দা বানলো চৌকারী।
চৌদিগে মালঞ্চের বেড়া আয়না সাড়ি সাড়ি৷৷

হাস মারলাম কইতর মারলাম বাইছা মারলাম টিয়া।
ভালা কইরা রাইন্দো বেনুন কালাজিরা দিয়া॥

 

[youtube id=”UA1cn83230Q”]

 

. নদ্দার চান ঘাটে গেল

নদ্দার ঠাকুর একদিন মেলা কইরা বাড়ী ফিরতেছিল, সন্ধ্যার বেলায়। আর বাদ্যার ছেড়ী তামসা কইরা বাড়ী যাইতেছিল। তারে পথে পাইয়া নদ্দার ঠাকুর কইলো, কালকা সইন্ধ্যা বেলায় তুমি একলা যাইও জলের ঘাটে, মনের কথা কইবাম আমি। তুমি আইসো।

পরের দিন, কলসী কাঙ্কে নিয়া মহুয়া গেল জলে। সেই না সইন্ধ্যা কালে নদ্দার চানও ঘাটে গেল। নদ্দার চান জিগাইলো,
“জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ মন।
কাইল যে কইছিলাম কথা আছে নি স্মরণ?”

মহুয়া কইলো, “কি কইছিলা কথা আমার মনে নাই।” নদ্দার চান কইলো, “নবীন যইবন তোমার। এক রাতিরে কথাটা ভুইলা গেলা!”

মহুয়া কইলো, “দেখো, তুমি ত ভিন দেশী পুরষ, আমি ভিন্ন নারী। তোমার সঙ্গে আমার কথা কওয়া তো শরমের ব্যাপার।” নদ্দার চান তারে অভয় দিয়া কইলো,
“জল ভর সুন্দরী কইন্যা জলে দিছ ঢেউ।
হাসি মুখে কওনা কথা সঙ্গে নাই মাের কেউ।”
আরো জিগাইলো, কেবা তোমার মাতা, পিতা, এই দেশে আসিবার আগে কোথায় ছিলা?

মহুয়া কইলো, আমার কোন মাতা, পিতা নাই। সুতের হেওলা অইয়া ভাইস্যা বেড়াই। বাইদ্দার সঙ্গে ফিরি। এইটা আমার কপালের ফের। আমার মনের বেথা তো কেউ বুঝবো না। তুমি ঠাকুর সুখে থাকো, সুন্দর নারী লইয়া। মায়েরেও সুখে রাখছো। ঠাকুর কয়, মিছা কথা কইছ তুমি, আমি বিয়া করি নাই।

এই কথা শুইনা বাইদ্দার ছেড়ী কয়, এমন যইবনে তুমি বিয়া করো নাই!
“কঠিন তোমার মাতাপিতা কঠিন তোমার হিয়া।
এমন যইবন কালে নাহি দিছে বিয়া।”

নদ্দার চান কয়,
“কঠিন আমার মাতাপিতা কঠিন আমার হিয়া।
তোমার মত নারী পাইলে করি আমি বিয়া॥”

মহুয়া কয়,
“লজ্জা নাই নির্লজ্জ ঠাকুর লজ্জা নাইরে তর।
গলায় কলসী বাইন্দা জলে ডুইবা মর।”

নদ্দার চান কয়,
“কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ি।
তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুইবা মরি।”

অদের পিরিতের কথা চলতেই থাকে…

 

. মনের আগুন নিবাই সখি বল কেমন কইরে

মহুয়া সইন্ধ্যা বেলা একলা জলের ঘাটে যায়, সারা নিশি কাইন্দা পার করে। এইসব দেইখা পালঙ্ক সই জিগায় তারে, কি হইছে তোমার? হাইম ফেইলা ক্যান চাইয়া থাকো ঠাকুরবাড়ীর পানে? নদ্দার ঠাকুর নাকি তোমার গান শুইনা পাগল অইছে?

এই কথা শুনিয়া মহুয়া বলে, “মনের আগুন নিবাই সখি বল কেমন কইরে! চল ভিন দেশেতে যাই গা। এই দেশে তো মন বসে না। পালঙ্ক সই কইলো, “সাত দিন ঘরে বইসা থাক, জলের ঘাটে যাইও না। নদ্দার ঠাকুর যদি আসে, তারে বইলা দিয়াম, সুন্দর নারী তোমার মইরে গেছে কাইল নিশিতে।

মহুয়া কয়, তারে না দেখিলে তো আমিই মইরা যামু। নদ্দার ঠাকুর হইল আমার প্রাণের সোয়ামী। বাইদ্দার সঙ্গে আমি থাকি, কিন্তু আমার মন বানধা তার লগে। বন্ধুরে লইয়া আমি দেশান্তরি অইবাম। তা নাইলে বিষ খাইয়া মরবাম, গলায় দড়ি দিয়াম।

 

. ঘরের বাইর হইল কইন্যা

এই কথা হুমরা বাইদ্দাও জানলো। মাইনকা ভাইরে কইলো, আমার কন্যা তো পাগল হইছে নদ্দার ঠাকুরের লাইগা। চল, এই দেশ ছাইড়া অন্য দেশে যাই। মাইনকা কইলো, এমন দেশ ছাইড়া চইলা যাবো কেমনে! সোনার বাড়ী জমি, সানে বান্ধা পুষ্করিণী, সাইলের ধান পাইকা আসছে। সেই ধান কুটিয়া সালি ধানের চিরা খাইয়াম। এইসব রাইখা না যাই আমরা।

এই কইরা ফাল্গুন মাস গিয়া চৈত্র মাস আইলো। সোনার কুইল গাছে বইসা কু ডাকে। সোনার সাইল ধান পাইকা উঠছে। এমন দিনে, মধ্য রাত্রে নদ্দার চান ঘুম থিকা উইঠা বাঁশি বাজাইলো। বাঁশির সুর শুইনা সুন্দর কইন্যার ঘুম ভাইঙ্গা গেল। সব বাইদ্দা যখন নয়া ঘরে শুইয়া ঘুমায়, কইন্যা পাগল হইয়া ঘরের বাইর হইল।

বাইর হয়া কইন্যা যখন নদীর ঘাটে আসলো, দেখে অইখানে নদ্দার ঠাকুর বইসা প্রেমের বাঁশি বাজাইতেছে। কুলাকুলি, গলাগলি করে দুইজনে। নদ্দার ঠাকুর কয়, তোমার লাইগা আমি মা, বাপ ছাড়বাম, ঘর বাড়ী ছাড়বাম। তোমার লইয়া দেশান্তরি অইয়াম।

এই কথা শুইনা বাইদ্দার ছেড়ী নদ্দার ঠাকুরের গলা ধইরা কান্দে। কয় আমি নারী পাগলিনী, তোমারে তিলেক মাত্র না দেখিয়া থাকতে পারি না। পিঞ্জিরায় পাগলা পাখির মতন তুমি আমারে বাইন্ধা রাখছো। তুমি যদি ফুল হইতা আমার কেশে বাইন্ধা রাখতাম তোমারে। আমি তো পাগল হইছি, তুমি আমার আশা ছাড়, তোমার ঘরে চইলা যাও।

দুইজনের এই দেখা হুমরা বাইদ্দাও দূরে থিকা দেখলো, পাছে থিকা।

যখন ভোর হইল, ঠাকুর নিজের বাড়ী চইলা গেল। কইন্যাও কলসী নিয়া গেল ঘাটে।

 

. আমার বাড়ীত যাইওরে বন্ধু

মহুয়া টের পাইলো যে, বাইদ্দার দল থাকবো না আর এই দেশে। নদ্দার ঠাকুররে কইলো শে, আজ নিশাকালে বাপ এই গেরাম ছাইড়া যাইবো। তারার লগে আমারও দেশান্তরী হওয়া লাগবো। তোমার সঙ্গে বন্ধু এইনা শেষ দেখা আমার। তোমার অদেখা হইয়া কেমনে থাকবাম আমি!

কিন্তু আমি তো অবলা নারী, বাপের লগে যদি না যাই, কুল মান তো থাকবো না। এই বাড়ী জমি পইড়া থাকলো, রইলা তুমি। কেমনে তোমারে আমি বাইন্ধা রাখবাম! তোমার গুণের বাঁশি তো শুনমু না আর, না ঘুমায়া, জাগিয়া বন্ধু পুয়াইম না আর নিশি।

যদি আমারে মনে লয়, দেখা করতে যাইও আমার লগে। উত্তরের দিকে কয়দিন গেলেই আমরারে পাইবা। দেখবা নল খাগড়ের বেড়া আছে দক্ষিণ দেয়ারিয়া ঘর। সেইখানে আমরা কয় মাস থাকবাম। সেইখানে যাইও তুমি।

আমার বাড়ীত যাইওরে বন্ধু বইতে দিয়াম পিরা।
জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা॥

সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরী কলা।
ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা ।।

আইজের দেখা শেষ দেখারে বন্ধু, আর দেখা হবে না।

 

১০. নদ্দার ঠাকুর পাগল হইল

নদ্দার ঠাকুর আর মহুয়ারে দেখার পরে হুমরা বাইদ্দার মনে আর কোন সন্দে থাকলো না। মাইনকা ভাই রে কইলো, এই দেশে থাকবাম না আর, চল যাইগা অন্য দেশে। বাড়ী ঘর পড়া থাকুক, থাকুক সাইলের চিরা। এই দেশে থাকা যাইবো না।

বাঁশ, দড়ি যা ছিল সবাই লগে লইয়া, আইন্ধারিয়া নিশিতে বাইদ্দার দল পলাইল।

ঘর দরজা বাড়ী জমীন সবই পইড়া রইল। গেরমারে সবাই এই দেইখা, অবাক হয়া গেল।

নদ্দার ঠাকুর যখন এই কথা শুনল, খাইতে বইয়া মুখের গরাস মাটিতে ফেইলা দিল। মার ডাক, বাপের ডাক, কারো কথা শুনলো না। নদ্দার ঠাকুর পাগল হইল।

 

১১. ঠাকুর বৈদেশি হইল

এই কইরা দিন যায়, মাস যায়। নদ্দার ঠাকুর তার মায়েরে কইলো, আমার ঘরের চালে ছানি নাই, আমার পিঞ্জিরার পঙ্খিনী নাই। এই না উঠানে বইসা কইন্যা বিনা সুতাতে আমার লাগিয়া মালা গাথত। তারে ছাড়া আমি তো আর থাকতে পারি না। বিদায় দেও মা জননী, আমি দেশান্তরী হই। ভাত রাইন্ধা তুমি ফেনা ফালাইও না। আমারে বৈদেশে যাইতে তুমি মানা কইরো না।

মায় বলে “পুত তুমি আমার আখির তারা। তোমারে তিলেক দণ্ড না দেখিলে আমি তো পাগল হয়া যামু। তুমি বিনা আমার বংশে বাতি দিবো কেডা! আমার উরের ধন তুমি, দরকার হইলে ভিক্ষা মাইগ্যা খাইয়াম, তোমারে তবু ছাড়িয়া দিব না।

মাঘ মাইস্যা শীতে, পিঠে গু মুত নিয়া তোমারে মানুশ করছি। বিদেশে বিবাসে যদি মারা যাও কেউ তো জানবো না। তোমারে বৈদেশে রাইখা ঘরে কেমনে থাকবাম, মনে তো পরবুধ মানে না। পুত রে, তুমি চইলা গেলে তো আমি মারা যাইবাম।

একদিন নিশাকালে মা যখন ঘুমাইছে, নদের চাঁদ চান্দ, সুরুয সাক্ষী রাইখা মায়ের পায়ে পন্নাম কইরা নিরুদ্দেশে যাত্রা করল। যাইবার সময় মনে মনে কইলো, মা রইলো, বাপ রইলো, ভাই রইলো, সকল থাকিতে আমার কেউ নাই।

বাইদ্দার নারীর লাইগা ঠাকুর বৈদেশি হইল।

 

১২. কাইন্দা বেড়ায় নদীয়ার ঠাকুর উঁচা নিচা পথে

গয়া, কাশী, বৃন্দাবন থুইয়া ঠাকুর ভরমে তিরভুবন, খুঁজে বাইদ্দার কন্যা। একমাস দুইমাস কইরা তিনমাস যায়। ঠাকুর খুঁইজা না পায়। কোথায় আছে জইতার পাহাড়, কোথায় গহীন বন? পন্থে যারে দেখে নদীয়ার চান তারে ডাক দিয়া পুছ করে, বিদেশী বাইদ্দার লাগাল পাইবাম কত দূরে গেলে? এই পন্থে যাইতে নি দেখছ মহুয়া সুন্দরীরে? বাঁশ বাইয়া যে বাজী করে, সুন্দর বাইদ্দার নারী?

মেঘের সমান কেশ তার তারার সম আঁখি।
এই দেশেনি উইড়া আইছে আমার তোতা পাখী।

চাঁচর চিকণ কেশ কন্যার, আন্ধাইর ঘরে থইলে কন্যা কাঞ্চা সোনার মতন জ্বলে। সেই কন্যার লাগিয়ারে আমি পাগল হইলাম। এই ঘাটে জল ভরিত শে, সেই ঘাটে কেন আমি ডুইবা মরলাম না। যেই পন্থে কলসী কাঙ্কে লইয়া কন্যা চলিত, সেই রূপ আমি দূর থিকা দেখতাম।

কোথায় গেলে পাব কন্যা আরে তোমার দরশন।
তিলেক আদেখা হইলে আছিল মরণ।

বনের পশুপাখী, তোমরা তো উইড়া যাও, তোমরার নজর বহুদূর। আমারে কও, এই না পন্থে বাইদ্দার দল কত দূর গেছে?

যেইখানে বসিয়া কন্যা রন্ধন করিত, সেই জায়গার দিশা পাইয়া নদীয়ার ঠাকুর বসিয়া কান্দন জুড়িল। দেইখা বুঝলো সে, এইখানে কন্যা ফাল্গুন-চইতের মাসে আছিল। এই মতে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠও পার হইল। কাইন্দা বেড়ায় নদীয়ার ঠাকর উঁচা নীচা পথে। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসও এইরূপে গেল। পুবের মেগ গরজিয়া পশ্চিমেতে গেল। ভাদ্র-আশ্বিন মাস আসলো আর গেল। দিন রাইত নদীয়ার ঠাকুর পন্থে পন্থে খুঁইজা গেল মহুয়ারে।

বাড়ীতে দুর্গার পূজা, নদীয়ার ঠাকুরের বাপ মায় কান্দে। পইড়া থাকে খালি মণ্ডপ। মা, বাপ রইল, রইল সোদ্দর ভাই। সবাইরে থুইয়া মেঘে ভিইজা, রইদে পুইড়া ঠাকুর রজনী পার করে। কার্তিক মাসে মাইয়ে কান্দিয়া কান্দিয়া পুত্রের লাগিয়া বর মানে।

শেষে, ফাগুন মাসে, কংসাই নদীর পাড়ে গিয়া নদীয়ার চান মহুয়া সুন্দরী লাগাল পাইল। যেমন, পিয়াসী পাইল জল, সাপে পাইল মণি, ভমরায় পাইল খাইতে পদ্মফুলের মধু, এইরকম কইরা দুইজন দুইজনরে পাইল।

 

১৩. ছয় মাইসা মরা যেন উইঠা হইল খাড়া

এইদিকে, নদীয়ার চানের কথা ভাবিতে ভাবিতে কন্যার যৌবন হইল কালী। নিদ্রা না যায় শে, না ছুঁয় ভাত পানি। বাইদ্দার দলের লোক বলাবলি করে, মহুয়া সুন্দরীর কি হইলো! মাথার বিষে কন্যা হইলো পাগলিনী।

সর্বাঙ্গে বাতের বেদনা, ছয় মাস কন্যা পার করলো কান্দিয়া কান্দিয়া। ভাত না সে রান্ধে,  খেলায় নাই তার মন। এই ছিল কন্যা জীবন। আর আজকে নদ্দার চানরে দেখিয়া, ছয় মাইস্যা মরা যেন উইঠা হইল খারা!

দেল ভরিয়া কন্যা রন্ধন করিল, কন্যার রান্ধন খাইয়া ঠাকুর জাত বিসর্জন দিল। হোমরা বাইদ্দা মাইনকারে বলে, চল ভিন দেশী অতিথি আজ পরখাই করি। হোমরা বাইদ্দার ঠাকুররে কইলো, আমরার লগে থাকো। দেশে দেশে দড়ি বাঁশ লইয়া ঘুরবা, ফিরবা। যত্ন কইরা তোমারে আমরার খেলা শিখায়া দিবো।

 

১৪. শিওরে বসিয়া দেখে কান্দিছে সুন্দরী

রাইত যখন অন্ধকার হইল, আসমানে জ্বলে তারা, হোমরা বাইদ্দা উইঠা কন্যার কাছে গেল। নদীর পারে হিজল গাছ, পাতার বিছানা। সেইখানে নদীয়ার ঠাকুর শুইয়া আছে। বাইদ্দার কন্যা ঘরে ঘুমাইতেছে। স্বপন দেখে সে ভিন দেশী অতিথির মুখ।

হোমরা বাইদ্দার তারে গিয়া দিল ডাক। স্বপন ভাইঙ্গা কন্যা দেখে কানের কাছে দেওয়ার গরজন। হোমরা বাইদ্দার কয়, উঠ কন্যা, আর কত নিদ্রা যাবা। আমি তোমার বাপ, তোমারে ডাকতেছি। ষোল বছর কত দুঃখ কইরা তোমারে পালিলাম। আমার কথা রাখ!

চমকিয়া উইঠা কন্যা দেখে, বাপের চোখে জ্বলন্ত আগুনি। বাপে কয়, এই ছুরি লইয়া তুমি যাও নদীর পারে। অইখানে নদীয়ার ঠাকুর শুইয়া আছে, তারে মাইরা আইস। ষোল বছর ধইরা পাল্লাম তোমারে আমি। আমার কথা রাখ, মহুয়া সুন্দরী। ভিন দেশী দুষমন যাদুমন্ত্র জানে। অর বইক্ষেতে ছুরি মাইরা পরাণে মারো! দুষমনে মারিয়া ছুরি সাওরে ভাসাও! তুমি যদি তা না কর, আমার মাথা খাও।

মহুয়া ঘরের বাইর হয়া দেখে আসমানের তারা ডুইবা গেছে, চান্দ দেখা যায় না। আবে ঢাকা পইড়া গেছে। বাপের হাতের ছুরি লইয়া সে ঠাকুরের কাছে গেল। মাথার চুল পায়ে পড়ল, চোখ থিকা বাইয়া বাইয়া পানি পড়ে। কি করবো শে, ভাইবা কন্যা উনমাদিনী হইল।

নদীয়ার ঠাকুর অচৈতন্য হইয়া নিদ্রা যাইতেছিল হিজল গাছের তলে। মহুয়া গিয়া তার শিওরে বসিল। আসমানের চান্দ যেন জমিনে পড়িয়া আছে। একবার দুইবার তিনবার কইরা কন্যা উঠাইল নামাইল বিষলক্ষের ছুরি। না পাইরা পরে ডাক দিল,

“উঠ উঠ নদ্দাঠাকুর কত নিদ্রা যাও।
অভাগী মহুয়া ডাকে আখি মেইলা চাও।”

তোমারে মারার লাইগা পাষাণ বাপে আমারে ছুরি দিল, কিন্তু কেমনে মারবো তোমারে! তোমারে মারিয়া কেমনে ফিইরা যাইবাম ঘরে। ঘরে ঘিয়ের বাতি জালাইয়া আবার ফুঁ দিয়া নিবাইলাম। তুমি বাদে আমার আর কোন লইক্ষ্য নাই। তোমারে মারিয়া আমি কেমনে ঘরে যাইবাম। তোমারে তো মারতে পারতাম না রে বন্ধু, এই বিষলক্ষ্যার ছুরি আমি আমার বুকেই মারি।

এই সময় কাঞ্চা ঘুম ভাইঙ্গা ঠাকুর জাইগা উঠল। দেখে, শিওরে বসিয়া দেখে কান্দিছে সুন্দরী। হাতে কন্যার বিষলক্ষের ছুরি। মহুয়া কয়, বাপে আমারে এই ছুরি দিছে তোমারে মারিবার লাইগা। এখন তোমারে ছাড়িয়া বন্ধু আমার বুকে মারি। তুমি মায়ের ধন, নিজের দেশে যাও। সুন্দরী নারী বিয়া কর। সুখে থাক। বরামণের পুত্র তুমি, রাজার ছাওয়াল। তোমার সুখের ঘরে কাল হইলাম আমি। আমার নিজের কোন দিশা নাই। কি করবাম আমি!

ঠাকুর কয়, তোমার লাইগা আমি বাপ মা ছাড়ছি, জাতিকুল বাদ দিছি। তোমার মতন বনের ফুলের লা্গি আমি ভ্রমর হইলাম। তোমার লাগিয়া দেশে বিদেশে ঘুইরা পাগল হইছি। তোমারে ছাড়িয়া কন্যা না যাইবাম দেশে। ঘরে ফিরা বাপ মা রে আমি কি কইবাম। জাতি নাশ করছি আমি তোমারে পাইবার তরে। তোমার হাত দিয়াই আমার গলায় ছুরি মারো তুমি।

 

১৫. তোমারে লইয়া বন্ধু যাইবাম দেশান্তর

এই না কথা শুইনা মহুয়া কয়, বাপ মা ঘরে পইড়া থাকুক। তোমারে লইয়া বন্ধু যাইবাম দেশান্তর। যেইদিকে দুই আঁখি যায়, সেইদিকে যাইবাম। আমার লগে চল, গহীন বনে যাই আমরা। নদীর পারে বাপের তাজি ঘোড়া রইছে, দুইজনে উইঠা চল দেশান্তরে যাই গা। বাপ মায় জানবো না। চন্দ্ৰসূৰ্য্য সাক্ষী কইরা দেশ ছাইড়া যাইবাম আমরা।

ঝিলিমিলি নদীর কুলে দিয়া দুইজনে তখন চলল ঘোড়ায় সুয়ার হইয়া। দুইজনরে দেইখা মনে হইলো চান্দ আর সুরুজ যেন ঘোড়ায় চড়ল। চাবুক খাইয়া ঘোড়াও শন শন কইরা উড়তে লাগল।

নদীর তীরে আইসা মহুয়া ঘোড়ারে ছাইড়া দিল। কইলো, যেই দেশেতে বাপ মা আছে, সেই দেশেতে যাও। গিয়া বাপ মায়েরে বলবা, তোমার কন্যা মহুয়ারে জংলার বাঘে খাইছে। লাগাম ছাড়া পাইয়া ঘোড়াও দৌড় লাগাইল।

এইদিকে সামনে পাহাড়ীয়া নদী। দেইখা দুইজনে ভাবে, কেমনে পারি দিবো! ভাবলো, দুই চার দন্ডের লাগি যদি চর পইড়া যাইত, আর আমরা পার হইয়া যাইতে পারতাম। কিন্তু মনের কথায় নদীতে না পড়ল চর, না গেল উজানে পানি।

 

১৬. সাধুর নাও

এই না সময় গাঙ্গে ভাইসা আইলো এক সাধুর নাও। পক্ষীর মতন উড়াইয়া পাল। ঠাকুর দেইখা ভাবল, এই না নৌকায় উইঠা যাব, যা থাকে কপালে। সাধুরে কইলো, কতো দেশে তো তুমি যাও। গইন গম্ভীরা নদী, আমরা তো সাঁতার জানি না। পার কইরা দিলে আমরা এই দুইটা পরাণ বাঁচি।

কন্যারে দেখিয়া সাধু তো পাগল হইল। মাঝিমাল্লারে ডাক দিয়া সদাগর কুলেতে নাও ভিরাইতে কইল। দুইজনরে নাওয়ে তুইলা লইল।

চলিল সাধুর নাও পবনগমন।

এইদিকে মহুয়ারে পাওয়ার লাইগা তো সাধু মনে মনে চিন্তা করে। কন্যার লাগি সে পাগল হইছে। মাঝিমাল্লারে ডাক দিয়া সে সল্লা করল। উজান পাকে সাধুর ডিঙ্গা উজাইয়া চলল। আর নদ্দার ঠাকুররে নাও থিকা ফালায়া দিল।

বানের পানির মতন কালা জলে নদ্দার ঠাকুর তলায়া গেল। তলায়া যাইতে যাইতে কইলো, বাপেও দেখলো না, মায়েও দেখলোও না, দুষ্মনের হাতে পড়িয়া আমার প্রাণ গেল। কন্যা, বিদায় দেও আমারে। এই দেখা তোমার আমার ইহ জন্মের শেষ দেখা ছিল।

 

১৭. কি কাম করিল দুষ্মন সদাগরে

এই দেইখা মহুয়াও জলে ঝম্প দিতে গেল। যে ঢেউয়ে আমার নদীয়ার চানরে ভাসাইয়া নিল, সেই ঢেউয়ে আমিও পরাণ তেজিবাম। তখন মাঝিমাল্লায় আইসা কন্যারে ধরল। হায়, কি কাম করিল দুষ্মন সদাগরে!

সদাগর মহুয়ারে কয়, তোমার মতন লম্বা মাথার চুল, ডাঙ্গর আঁখি আর তো কোথাও দেখি নাই। বিধি আইজ মিলাইল তোমার মতন মধুভরা ফুল। আমার মনের কথা রাখো। এমন সুন্দর যইবনের পানসী তোমার, কোন মাঝি নাই। তোমার যইবন চইলা গেলে কে ঠাঁই দিবো! আমার লগে চল। তোমারে পাইলে আমি বাঞ্ছা পূর্ণ করি। তোমার বসনভূষণ সব দিব, নীলাম্বরী দিব। নাকে, কানে সোনার জিনিস দিবো। গন্ধতৈল দিয়া তোমার কেশ বাইন্ধা দিবাম। ঘরে দাসীবান্দী আছে, তোমার কিছুই করা লাগবো না। অরা শয্যা পাইতা দিব, চরণ ধুইয়া দিব। তুমি কন্যা বইয়া থাকবা সুবৰ্ণ পালঙ্কে। শীতের রাইতে তুলাভরা লেপ থাকবো। তোমার মন যোগাইবার লাইগা দাসী সামনে থাকব খারা।

আমার ঘরে হাতীঘোড়া, লোকলস্কর সবই আছে। তুমি সবার ঠাকুরাইন হইয়া থাকবা। বাড়ীর পাছে শানে বান্ধা চারি কোনা পুষ্কনি আছে, সেই ঘাটেতে তুমি আর আমি সাঁতার দিবাম। অন্দর ময়ালে আমার ফুলের বাগানে সকাল আর বিয়ানে দুইজনে ফুল তুলব। রাত্রিকালে জোর মন্দির ঘরে দোয়ে শুইবো। শীতের রজনীতে কন্যা থাকবা আমার উরে। শয্যায় বেথা পাইলে আমার বুকে শুইবা। পানের খিলী বানাইয়া তোমার মুখে তুইলা দিবাম। আমি খাইবাম, তুমি খাইবা, আমরা দুইজনে দুইজনের থাকবাম। তোমারে লইয়া বাণিজ্যকরণে যাইবাম। ভালা বাইন্না দিয়া তোমারে লক্ষ টাকার হার গড়াইয়া দিবাম। আরো যে কতো কিছু দিবাম, কোন লেখা যোকা নাই। সোনা দিয়া কামরাঙ্গা শাখা বান্ধাইয়া দিবাম, লক্ষ টাকা মুলের উদয়তারা সাড়ী দিবাম, হীরামণি দিয়া তোমার চুল জুইরা দিবাম, নাকে নথ দিবাম, চন্দ্রহার গড়াইয়া দিবাম, নুপূরে শত শত ঝুনঝুনি দিবাম, কন্যা তোমারে।

 

১৮. সাধুর লাগিয়া কন্যা পান বানাইল

এইসব শুইন কন্যা চুপ কইরা থাকল। সাধুর লাগিয়া কন্যা পান বানাইল। বাইদ্দার কন্যার শিরে বান্ধা ছিল পাহাড়ীয়া তক্ষকের বিষ। সেই বিষ চুন খয়েরের লগে মিশাইল। হাসিয়া খেলিয়া কন্যা সাধুর মুখে সেই পান দিল।

রসের নাগর তো সুখে পান খাইল। পান খাইয়া সদাগর কয়, কি সুন্দর পান দিলা তুমি! তোমার বাহুতে শুইয়া এখন নিদ্রা যাইতে ইচ্ছা করতেছে আমার। কন্যার পান খাইয়া সব মাঝিমাল্লায় নাওয়ে ঢইলা পড়ল। নৌকার উপরে বইসা কন্যা খলখল কইরা হাসতে লাগল।

কন্যার কাকঁলে আছিল বিষলক্ষ্যার ছুরি। তা দিয়া ডিঙ্গার কাছি কাটিয়া ফেলল। সাধু অচৈতন্য হইয়া নায়ে পড়িয়া আছে। আর কন্যা ডিঙ্গার তলায় কুড়াল মারিল।

সাধুর নাও ডুবতে লাগল। আর কন্যা ঝম্প দিয়া পড়িল জলের উপর।

 

১৯. প্রাণের বন্ধু আমি কোথায় গেলে পাই

পারে পৌঁছায়া কন্যা আরো দুঃখি হইল। বিধাতা কেমনে তারে এতো জনমদুঃখিনী কইরা শিরজিল! বনের পক্ষী আর তরুলতারে জিগায় নদ্দার চানের কথা। ঢেউয়ের কুলে পইড়া বন্ধু এখন কই গেল! আরে বাঘ-ভালুক আমারে পরে খাও, আগে বন্ধুর কথা কও। কুম্ভীর, তুমি তো জলে থাক সবসময়, তুমি নি দেখছ বন্ধুরে আমার!

আমি তো আছিলাম বাইদ্দার নারী, ভরমিতাম নানান দেশ। পরদেশী বন্ধুরে লইয়া দেশ ছাড়িলাম। এই যে ডালে বসিয়া আছ ময়ুরাময়ুরী, তোমরা কি জান নাকি বন্ধুর কথা কোন! দরিয়ায় গলিয়া পড়ে কন্যার গলার হার। বিধাতা যারে করিল দুঃখী, তার দুষ আমি আরে কারে দিয়াম!

খিদায় অবশ হয়া কন্যা বন জঙ্গলে ঘুরে। গাছে না পায় ফল, নদীর পানি থাকে দূরে। অভাগা মহুয়ারে দেখিয়া বড় বড় বাঘভালুক দূরে সইরা যায়। আকাল মাকাল অজগর হরিণ ধইরা খায়, মহুয়ারে কিছু করে না। মহুয়া অচেতন হয়া ভাবে, জমিনে, গাছে, নদীতে কোথাও তো ঠাঁই নাই আমার। প্রাণের বন্ধুরে আমি কই গেলে পাইবাম!

আমার লাগি বন্ধে সুখের বাসা ছাড়ল, নদীর কূলে থাকল, দুশমন সাধু আমার লাইগা তারে জলেতে ডুবাইল। এখন আমি এই জলে ডুবিয়া মরব। বৃক্ষের ডালে ফাস নিব। এইসব যখন ভাবতেছে কন্যা, তখন শুনে জংলার ভিতর কে জানি কাতরায়!

গিয়া দেখে ভাঙ্গা মন্দিরের ভিতরে যেইখানে সাপের বাসা, সেইখানে মাংস শুকাইয়া হাড়ের মতন কে জানি পইড়া রইছে, আন্ধারে। কাছে গিয়া দেখে, এ তো আমার ঠাকুর, নদ্দার চান!

 

২০. আইল সন্ন্যাসী এক হাতে লইয়া খড়ি

এই সময় মন্দিরে আইল সন্ন্যাসী, এক হাতে খড়ি লইয়া, শিরে তার বান্দা জটা চুল আর লম্বা মুছ দাড়ি। কন্যারে দেখে সন্ন্যাসী তো খুশি মনে মনে। মহুয়ারে জিগায়, এমন দূরে কেমনে আইলা, কোন দেশ থিকা? কোন বা রাজার কন্যা তুমি? কে তুমারে বনবাসে দিল? তোমারে বনে পাঠায়া কেমনে বাঁইচা আছে তোমার মাতা পিতা?

এই কথা শুনিয়া কন্যা সন্ন্যাসীর পা ধইরা কান্দতে লাগল। আগগুড়ি যত কথা আছে, সন্ন্যাসীরে জানাইল। শুইনা সন্ন্যাসী কয়, বনে আছে গাছের পাতা, আমি তুইল্লা দিবাম। এই গাছে বাঁচবো তোমার পতির পরান। আকাইল্লা জ্বর হাড়ে লাইগা আছে তার। তার শ্বাস ধইরা পাতা আনো, নদীর পানি আনো, আমি মন্ত্র পইরা দিতেছি। এই মন্ত্রে তার পরাণ বাঁচবো।

এক দিন দুই দিন তিন কইরা চাইর দিনের দিন নদ্দার চান আঁখি মেইলা চাইল।

একদিন ভোরবেলা সন্ন্যাসী মহুয়ারে ডাক দিয়া কয়, আমার লাইগা ফুল তুইলা নিয়া আসো! দূর বনে গিয়া মহুয়া পূজার ফুল তুইলা নিয়া আসে সন্ন্যাসীর লাইগা। নদ্দার চান উইঠা বসে। মহুয়ার কাছে ভাত খাইতে চায়। মহুয়া কয়, এই গইন বনে ভাত কই পাইবাম আমি! দুঃখে মহুয়া একলা বইসা থাকে। ফুল তুলিতে আর যায় না।

এইদিকে কন্যার যইবন দেইখা মনির তো মন ভুলে। নিশি রাইতে আইসা মহুয়ারে ডাকে। “উঠ উঠ কন্যা, আর কত নিদ্রা যাও! আজ পূর্ণিমার নিশি, অষুধ তুলিতে চল কন্যা গহীন বনে যাই।” কন্যা ঘুম থিকা উইঠা মুনির লগে চলল। নদীর কিনার দিয়া যায় তারা, গহীন বনের পথ দিয়া। মাঝপথে গিয়া মুনি কয়, কন্যা তুমি আমার কথা শুন! তোমার যইবনে তো আমি হইছি পাগল। তোমার রূপে যোগীর যোগ ভাঙ্গছে। এমন ফুলের মধু আমারে খাইতে দেও। মুনি তো আইসা পড়ল মহুয়ার পায়ে।

সন্ন্যাসীর কথা শুইনা কন্যার শিরে পড়ে খাড়া। ভাবিয়া চিন্তিয়া সে সন্ন্যাসীরে বুঝায়া কইলো। আগে স্বামীরে বাঁচাও। স্বামী যদি বাঁচে তাইলে তুমি যা চাইবা, তা দিবো। এই কথা শুইনা তো মুনির মুখ হইল কালী। কইলো, তোমারে দুই দিন সময় দিলাম। নিজে বিষ খাওইয়া পতিরে মারবা।

কন্যা দেখে, রাইক্ষসের হাতে পড়লাম! মনে মনে চিন্তা করে, কেমনে পালাইবো!

একদিন নদের চান্দেরে নিয়া রওনা দিল। কিন্তু কেমনে যাইবো নদের চান! জ্বরে করছে সাড়া করছে তার দেহখানি। হাঁইটা যাইতে পারে না। তখন কন্যা কি করলো, আস্তে আস্তে নদ্দার চান্দরে কান্দে তুইলা লইল। নিশি কালে কন্যা পালাইল। আর ফিরা ফিরা দেখে, সন্ন্যাসী নি পিছে পিছে আসে।

 

২১. এইখানে থাকিয়া মোরা কা্টাইব দিন

এক দুই তিন করি ছয় মাস কাইটা গেল।

ভালা হইয়া নদ্দার ঠাকুর উইঠা বসল। ঠাকুরের লাইগা মহুয়া ঝরণার জল আনে, বনের ফল আনে। খাইয়া নদীয়ার চান্দ আগের মতন হইল। দুইজনে আরো দূরেতে চইলা গেল। বাড়ী ঘর নাই যথায়, তথায় থাকে তারা। যেমন থাকে বনের পশুপংখী। সামনে পাহাড়ীয়া নদী, দুইজনে সাঁতরায়। গাছের নিচে বইসা শুনে, বনের কোহিল পক্ষী ডালে বইসা গায়।

ঠাকুর কইল, চল মহুয়া, এইখানে আমরা বাসা বান্ধি। এইখানে থাকিয়া মোরা কাটাইব দিন। সামনে সুন্দর নদী, ঢেউয়ে খেলায় পানি। চৌদিকেতে রাঙ্গা ফুল ডালে পাকা ফল। মিঠা ঝরণার পানি আছে এইখানে। এইখানে চল আমরা থাকি।

মনের সুখে দুইজনে থাকতে লাগল তখন।

নদ্দার ঠাকুর খাইতে বইছে গলায় লাগল কাটা।
বাইদ্দার ছেরি মানত থুইছে কালাধলা পাঠা ।।

নদ্দার চান্দের জ্বর উঠছে মাথায় বেদনা তাত।
বাইদ্দার ছেরি কাছে বইসা শিরে বোলায় হাত ৷।

হাটে যায় রে নদ্দার চান কোনাকুনি পথ ।
বাইদ্দার ছেরি ডাকা বলে, কিইনা আইনো নথ।।

বনের ফল তুইলা আনে দুইজনে খায়।
মালাম পাথরে দুইয়ে শুয়ে নিদ্রা যায় ।।

রাত্রিতে থাকয়ে ঠাকুর কন্যা লইয়া বুকে।
দিনেতে উঠিয়া দোহে ভরমে নানান সুখে।।

দুইজনে হাত ধরাধরি কইরা বনে বনে ঘুরে। বনের ফল পাড়িয়া আইনা খায়। বাপ মায়, ঘর বাড়ী, দেশ বন্ধু স্বজন ভুলে দিন কাটাইতে থাকে। কিন্তু একদিন হঠাৎ শিরেতে বাজ পড়ে।

 

২২. কন্যা শুনে বংশীর ধ্বনি

একদিন সন্ধ্যাবেলা নদ্দার চান আর মহুয়া গলায় ধরাধরি গহীন বনে ঘুইরা বেড়াইতেছিল। মালাম পাথরের উপরে ঠাকুর বসল। ঠাকুরের কোলে বসল মহুয়া সুন্দরী। সামনে নদী আর ঢেউয়ে ঢেউয়ে পানি খেলতেছিল। এমন সময় কন্যা শুনে বংশীর ধ্বনি।

চমকিয়া উঠে কন্যা। ঠাকুর কয়, “কি কারণে কন্যা তুমি চঞ্চল অইলা? তুমি তো এতোদিন আমারে কও নাই, তোমার জন্ম-বিবরণ। কোথায় তোমার বাড়ী, কই ছিল তোমার বাস? বাইদ্দার সঙ্গে কেন তুমি দেশে দেশে ঘুরতা? জিজ্ঞাসা করলে তো তুমি খালি চক্ষের পানি মুছো, আজইকা বল, শুনি আমি তোমার কথা।”

মহুয়া সব কথা কয় নদ্দার চানরে। ছুডুকালে হুমরা বাইদ্দা তারে যে চুরি কইরা আনছিল। কয়, অই যে শোন, দূরে বাঁশি শুনা যায়। সন্ধ্যা তো হয়া আসলো। চল, আমরা বাসে যাই। আজইকা তো মাথা ব্যথা করতেছে। কাইলকা যদি বাঁইচা থাকি, কথা কমু নে আমরা। যেমনে গাছের লতা ঢইলা পড়ে, অইরকম কইরা মহুয়া নদ্দার চান্দের কান্ধে ঢইলা পইরা গেল। নদ্দার চান ভাবে, কোন সাপে না জানি দংশন করিল। আজ তোমার মন এমন কেন হইল!

পায়ের নিচে শুকনা পাতা মড়মড় কইরা ভাঙ্গে। মহুয়া সুন্দরী তাহার মধ্যে উইঠা বসে। আতঙ্কে কন্যার গায়ে কালাজ্বর আসে। দারুণ মাথার বিষে ঢলিয়া ঢলিয়া পড়ে। নদ্দার চান কয়, তুমি শুইয়া থাক, আমি জল নিয়া আসি। অবশ কন্যার শইলে নাই কোন বল। মহুয়া কান্দিয়া কয়, সাপে তো আমারে কাটে নাই। আমাদের সুখের দিন শেষ আজকে। দূর বনে যেই বাঁশি শুনতেছো, এইটা বাইদ্দার দলের আওয়াজ। আমার পালং সই ইশারায় সামাল করিতে বলতেছে।

আইজ নিশিতে বন্ধু আমার বুকে শুইয়া থাকো। পরভাতে তো এই মুখ আর দেখিব না। বনের খেলা শেষ হইল, এখন যমের দেশে যাওয়া লাগব। রজনী শেষ হইলে যেমন আশমানে মিলায় তারা, এইরকম আমাদের সুখের দিনও শেষ হইল।

 

২৩. কেমন করি যাইবাম দেশে বন্ধুরে মারিয়া

শিকারী কুকুর নিয়া চৌদিক থিকা হুমরা বাইদ্দার দল আইসা উপস্থিত হয়। হাতে বিষলক্ষ্যার ছুরি লইয়া মহুয়া সামনে খারা হইল। অক্ষিতে জলিছে বাইদ্দার জ্বলন্ত আগুনি। দেওয়ার ডাকের মতন তার নাকের নিশ্বাস পড়ে। মহুয়ারে কইল, প্রাণে যদি বাঁচতে চাস, আমার কথা রাখ। বিষলক্ষার ছুরি দিয়া দুষ্মনরে মার! আমার পালক পুত্র সুজন খোলেয়ার, তারে বিয়া কইরা আমরার লগে চল।

মহুয়া কয়ে, কেমন আমি আমার পতির গলার ছুরি মারব! হুমরা বাইদ্দা কয়, সুজন খেলোয়ার সুন্দর যোয়ান। এমন পতি পাইলে তোর এরে কি দরকার। কতোদিন হয়রান হয়া খুঁজলাম তোরে। এখন অর লগে তোরে বিয়া দিবাম।

মহুয়া কয়, কেমন করি যাইবাম দেশে বন্ধুরে মারিয়া! তোমার সুজনরে আমি বিয়া করতাম না। আমার বন্ধু কাঞ্চা সোনা, চান্দ সুরুজের লাহান জ্বলে। তার কাছে সুজন জোনি পোহার লাহান। আমার চক্ষু দিয়া তুমি নয়ন ভইরা দেখো।

এই শুইনা হুমরা বাইদ্দা গর্জিয়া উঠে। মহুয়ার হাতেতে দিল বিষলক্ষের ছুরি।

ছুরি হাতে নিয়া মহুয়া একবার পালং সইয়ের দিকে তাকাইলো। পালং সইরে কইলো, তুমি তো কিঞ্চিৎ বুঝবা আমার মনের বেথা। কার বুকের ধন যে তোমরা আইনাছিলা, কোন বাপ মায়ের কোল খালি কইরা। জন্মায়া বাপে মায়েরে কোনদিন দেখলাম না। এখন কর্ম্মদোষে প্রাণও দিতে চললাম।

মহুয়া বিষলক্ষ্যার ছুরি হাতে নিয়া নদ্দার চানের দিকে তাকাইলো, কইলো

“শুন শুন প্রাণপতি বলি যে তোমারে ।
জন্মের মতন বিদায় দেও এই মহুয়ারে ।।”

এই বইলা বিষলক্ষ্যার ছুরি মহুয়া নিজের বুকে বিন্ধাইলো। আর হুমরার আদেশে বাইদ্দার দল নদের চানরেও খুন করল।

 

২৪. দুইয়েই পাগল ছিল এই দুইয়ের লাগি

মহুয়ার লাশ দেইখা হুমরা বাইদ্দার হুঁশ ফিরল। কইল, ছয় মাসের শিশু কইন্যারে পাইলা এতো বড় করছিলাম। আইজ তারে ছাড়া, কি নিয়া ঘরে ফিরবাম! কন্যারে, তুমি একবার আঁখি মেইলা চাও! একবার কথা কইয়া আমার পরাণ জুড়াও!

মহুয়া নি শুনে আর কারো কথা!

হুমরা বাইদ্দা কয়, আর দেশে যাইতাম না আমি। আর ঘরে ফিরমু না। তোমরা সবে ঘরে যাও। আমি গেলাম বনে। মাইনকা ভাই রে ডাইকা কয়, দেশে ফিরিয়া তো আমার আর কোন কার্য্য নাই। এইখানে কয়বর কাটো। মহুয়ারে কয়বর দেও।

বাড়ীঘর ছাইড়া ঠাকুর মহুয়ার লাগিয়া আইল। দুইয়েই পাগল ছিল এই দুইয়ের লাগি।

হুমরার আদেশে মাটি কাটা হইল। একসঙ্গে দুইজনরে মাটি চাপা দিল।

বিদায় হইল সব যত বাইদ্দার দল।
যে যাহার স্থানে গেল শুন্য সেই স্থল ॥

সবাই চইলা যাওয়ার পরে পালং সই বইসা কান্দতে লাগল। অঞ্চল ভরিয়া বনের ফুল নিয়া আসল। কয়বরের উপরে দিল। চক্ষের জলেতে কয়বরের মাটি ভিজাইল। পালং সই ডাকিয়া কয়, সই রে কতো নিদ্রা যাও! বাইদ্দার দল তো ফিইরা গেছে। এখন তুমরা উইঠা আস। সুখতে বাধিয়া বাসা ঘর কর তুমরা। দুইজনে মিইলা ফুলের মালা গাঁথব গো সই। দুইজনে মিইলা তুমার নাগর কালারে সাজাইবাম আমরা।

কেউ কি আর শুনে কারো কথা!

পালং সইয়ের চক্ষের জলে ভিজে বসুমাতা।
এইখানে হইল সাঙ্গ নদীয়ার চান্দের কথা ।।

………………………………………………………………………

ভানুশ্বর – সুরুজ, চান্দ সদাগর – এপিক কারেক্টার, মনসা দেবীর কাহিনিতে আছে,  মালাম – পায়ের ছাপ, উরদিশে – উদ্দেশ্যে, গাজী জিন্দাপীর – এপিক কারেক্টার, দেবতা দক্ষিণরায়ের সাথে তার যুদ্ধের কথা অনেক কাহিনিতে পাওয়া যায়, অচরিত – খুবই সুন্দর, পাশুরা – ভুইলা যাওয়া, রাও চন্ডালের হাড় – বাইদ্দারা খেলা দেখায় যেই হাড় নিয়া, হেজা – শজারু, গুয়াইল – পার হইলো, নদ্দার চান – চৈতন্য দেবের আরেক নাম, লীলুয়া বয়ারে – হালকা বাতাসে, চৌকরী – চাইর চালার ঘর, হাইম – দীর্ঘশ্বাস, চাঁচর – কোঁকড়ানো, আবে – পাতলা মেঘে, অরদিশ – দিশাহারা, তেরলাঙ্গা – তিন ঠাঁই ভাঙ্গা, নড়বড়ে।

 

Series Navigationসুলতানার স্বপ্ন – রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন >>
The following two tabs change content below.
Avatar photo
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →