গল্প: শাহীন আপার সাথে আমার সম্পর্ক
গল্প তো অনেক রকমের হয়। কিন্তু যে কোন গল্পই একটা টাইম আর একটা স্পেইসরে ক্রিয়েট করতে থাকে। আমাদের মনে হইতে পারে যে, গুলশান শহর, মতিঝিল শহর, ধানমন্ডি শহর বা মিরপুর শহর হওয়ার আগে একটা ঢাকা শহর ছিল মনেহয়; ইন বিটুইন টাইমে ম্যাসেজ পার্লার বিউটি পার্লারের চাইতে বেশি না হইলেও ছিল এনাফ ভিজিবল; এমন ফিমেইল কারেক্টাররা ছিল, যাঁরা সুন্দরী বা ধনী না হইয়াও মেন্টালি স্ট্রং! বান্নার গল্পটা পড়লে মনেহয়, হইতেই পারে এইরকম, পসিবল।
ই..হা.।
—————————————————-
দোয়েল চত্বর থেকে শাহীন আপার কাছে বিদায় নেবার পর বিচিত্র ধরনের স্বরমিশ্রিত অনুভূতি মগজে নিয়ে সরাসরি চলে এসেছিলাম কমলাপুর এজিবি কলোনিতে আমাদের কৃষ্ণচূড়া চত্বরে।
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে জিন্সের ২ পকেটে দুহাত গুঁজে আজকে বিকালে যখন চারুকলার গেটের বিপরীত দিকের ফুটপাতে ধীর পায়ে হাঁটছিলাম – চারপাশটা টানা দুদিন বৃষ্টির পর এবং আজ সারাদিন বৃষ্টিহীন কড়া রোদের পর ঝকঝকে আসল সবুজে ভরা। ঢাকার অদূরে অন্য এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্মৃতি কম।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
৩ বছর আগে ছাত্রজীবন শেষ করলেও এখনও কোন একটা নির্দিষ্ট গতি করতে না পারার দৈনন্দিন অর্থহীন উদ্বেগ, দুঃচিন্তার নিয়মিত সেশন তখন আমার ধারে-কাছে নাই। আমার মাথায় তখন মাত্র দুপুরে পাওয়া মুদ্রার ক্ষমতার প্রয়োগের নকশা বিস্তার লাভ করছে মাকড়সার জালের দ্রুততায় বা সদ্য জেলের হাত থেকে ছুটে যাওয়া জালের মতো দ্রুত বর্ধনশীল; টাকাটা পাওয়ার পর থেকেই যে ইচ্ছাটা মনের গভীরে নড়াচড়া করছিল, দৃঢ় সংকল্পের গলিপথ থেকে বেড়িয়ে তা এখন বাস্তবায়নে উদ্যোগী রাজপথে। এদিকে এ কাজে আগেও এসেছি। আজ বন্ধু বাদলকে ধন্যবাদ জানাই আসল জিনিসের খোঁজ পাইয়ে দেয়ার জন্য, অথচ এতদিন কিনা হোটেলগুলাতে গিয়ে ‘সুন্দর’ মেয়েদের খুঁজতাম। বিকাল ৪টার পর থেকে ওরা আসতে শুরু করে। বাংলা একাডেমির গেটের বিপরীত থেকে শুরু করে দোয়েল চত্বর পর্যন্ত ফুটপাতের ও সরোয়ার্দী উদ্যানের কোণার গেটটার ভেতরে-বাইরে দাঁড়িয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হাঁটতে থাকে। অবশ্য আমি পার্কের ভেতর কিছু করি না। মগবাজারের এক পরিচিত হোটেলে নিয়ে যাই।
এছাড়া কিছু করার নাই। স্বভাবত অলস হওয়ায় পাশ করে বেরোবার পর থেকেই বাঁধা-ধরা সময়ের কোন চাকরির বদলে পত্রিকার লাইনে ঘোরাফেরা করছি বছর দুয়েক ধরে। ২ বছর ধরে কন্ট্রিবিউটর হিসাবে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করছি। আর শিক্ষানবীশ পর্যায়ের একটা পদে নিয়োগের জন্য ধর্ণা দিয়ে চলছি। সম্পাদক শালাও দারুণ পিচ্ছিল, গত দেড় বছর ধরে কী দক্ষতায়ই না ঝোলাচ্ছে আশার মূলাটা, সার্কাসে ছাড়া কোথাও পাওয়া যাবে না এমন নিখুঁত, ভুবনমোহিনী পেশাদারিত্ব। তবে বিলটা অবশ্য খারাপ দেয় না। চূড়ান্ত আলসেমির পর মাসশেষে যে কয়টা লেখা জমে তাতে বিলটা তেমন খারাপ হয় না। মেস জীবনের রুটিন খরচের পরও ২/১ হাজার টাকা থাকে। এতে গলা ভাসিয়ে ভেসে থাকা যায় শুধু, একজন নিম্নমধ্যবিত্ত যুবকের আবশ্যকীয় যাবতীয় নিয়ম ভণ্ডামির থুতু গিলে ফেলার মত মেনে নেওয়ার পরও। তবে, ভেসে থাকাই সার, তীরে পৌঁছনো যায় না তাতে; বলাবহুল্য, মহাসাগর না হোক অন্তত নদীর। অন্যান্য হিসাব মিটিয়ে, এমন অর্থনৈতিক ভিত্তির প্রেক্ষাপটে না পারি; দেশের বাড়িতে ফিরে চাচাত বোনের সাথে শোয়ার একটা সামাজিক বন্দোবস্ত করতে না পারি, টাকা না থাকার হীনমন্ম্য সাহসে নিয়ম-কানুন মেনে দায়হীন যৌন সম্পর্কের কোন বান্ধবী গোছের যোগাতে। আর গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত রয়েছে নিষ্ঠার অভাব বা আলস্য। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হয়ত চালু আছে এই বৃত্তি, আমাদের মত মানুষ এত বছর ছিল বলেই এই বৃত্তিও এতকাল টিকে আছে। সবাই জানে, আমরাই প্রথম না!
একটু আগে এসে পড়লেও কোন তাড়া ছিল না বলে চারপাশ দেখতে দেখতে, মূলত ক্যাম্পাসের ছেলে-মেয়েদের, ধীরে-সুস্থে হাঁটছিলাম। প্লান ছিল ওরা আসতে শুরু করার আগ পর্যন্ত এই ফুটপাত ধরেই এমাথা-ওমাথা হাঁটব। আর বিভিন্ন সব রাজ্যের ভাবনা ভাবব। কথা বলব মনে মনে, শুধু কথা, অনবরত কথার কথা, করব অর্থহীন আশা, যে আশা জীবনেও পূরণ হবে না। করবো এমন দৃঢ় সংকল্প, বল্গাহীন চিন্তার রাজ্যে দায়হীন সব কর্মের পরিকল্পনা করবো আজ; অন্ধকার মনের প্রদেশের কালো ফ্যান্টাসিতে হঠাৎ পড়া ঘোলা আলোয়; এইসব ভাবনা-কল্পনা-ফ্যান্টাসি নিয়ে হাঁটছিলাম নির্মল সবুজের ও মুখস্ত মানুষের ক্লেদাক্ত চেহারা দেখতে দেখতে। যেন শিল্পীর গভীর মনযোগ ও মমতায় আঁকা, যাত্রী ছাউনির নিচে বয়সহীন ময়লা নেশাখোরের ঝিমানি আর উচ্ছল হাসন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের যৌবনের বিকারের ডিটেলসে ভরা আশ্চর্য, সত্যি আশ্চর্য এক ক্যাম্পাস! সত্যি অদ্ভুত! মন এখানে বিছিন্ন আর একা আর স্বেছাচারী না হয়ে পারে না। কথাটা দুর্জনের সমাজের এই বানানো পরিবেশে ছল হলেও, ছলের মত শোনালেও না বলে পারলাম না। শেষ বিকালের আলোয় আমার ছায়া দীর্ঘ-দীর্ঘতর হতে হতে এখন রাস্তা পার হয়ে অপর পাশের ফুটপাত ইতোমধ্যে ছুঁয়ে ফেলেছে। কখন যে এত দূর চলে এলাম টেরও পাই নাই। একবার ভাবলাম এখন ঘুরে চারুকলার দিকে রওনা দেই, আবার ভাবলাম সামনের দোয়েল চত্বর পর্যন্ত পুরাটা যাই। একটা রাউন্ড কমপ্লিট হয় তাহলে, ভেবে আবার মোড়ের দিকে আগাতে থাকলাম। ৩ নেতার মাজারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বছর চারেক আগের এক স্মৃতি মনে পড়ল। ৪ বন্ধুকে একবার বাধ্যতামূলক রাত কাটাতে হয়েছিল মূল কবরের উঁচু বেদীতে। সে রাতের রোমন্থন শুরু করতে না করতে, ১৫/২০ গজ সামনে থামা একটা রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে থাকা মেয়েটার দিকে চোখ চলে যায়। মেয়ে না বলে মহিলা বলাই ভাল, তবে বয়স সম্ভবত ৩৫ এর বেশী হবে না, মুখের এক পাশটা দেখে তাই মনে হচ্ছে। রিকশা ভাড়া দিয়ে মেয়েটা ঘুরতেই হাত দশেক দূরে হাঁটতে হাঁটতে দাঁড়িয়ে পড়া আমার দিকে চেয়ে আর মুখ ফেরাতে পারে না। মুখ ফেরাতে গিয়ে ও কী ভেবে মুহূতের্, দ্রুত, আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকার ফলে আমিও তার দিকে ভালভাবে তাকাই। চোখাচোখি হলে, দীর্ঘ ১৪/১৫ বছর গ্যাপের জন্য প্রযোজ্য সময় তাকিয়ে থাকার পর, আমি প্রথম চিনতে পারি। আর শাহীন আপার তখনো ‘চেনা চেনা মনে হয়’ ভঙ্গীযুক্ত চোখ। আমি বলে উঠি, আ-রে-এ ‘শাহীন আপা! আপনে কেমন আছেন! আরে! সকালে কার মুখ দেখছিলাম?’
খুব একটা পাল্টায় নাই শাহীন আপা। আগের চেয়ে সামান্য, খুব সামান্য মোটা হয়েছে, এই যা। আগের সেই শীর্ণ শরীরের তুলনায় এত সামান্য যে এখনো শাহীন আপাকে চিকনই বলতে হয়। তবে আগের চেয়ে সুন্দর আর উজ্জ্বল, কৃষ্ণবর্ণ। তবে বেশবাসে আগের চেয়ে আরও ময়লা হয়ে গেছে। বাদলের পরিচয় করিয়ে দেয়া যেই মলিনতা, ময়লা চেনার পর থেকে ফ্ল্যাট বাড়ি বা হোটেলগুলার উপর আমার ভক্তি মূলত পুরা উঠা গেছে।
তবু, প্রথম দেখায় আমি সেই মলিনতাটুকু খেয়াল করি নাই। দীঘর্দিন পর দেখা হওয়ার ফলে হবে হয়ত। কত বছর হবে? ৯৩-এর দিকেই সম্ভবত শেষ দেখা – এরপর আমি সাভারে পড়তে চলে গেলে শ্যামলীর আাড্ডাটা ভেঙে যায়, অন্তত মার্কেটের আড্ডাটা, আশেপাশের হোটেলগুলাতে ধুঁকতে
খুশীর ঘোর আমার তখনো কাটে নাই, আমি এগিয়ে গিয়ে শাহীন আপার হাত ধরি; তার আগেই অবশ্য পুরাপুরি চিনতে পেরে সে বলতে শুরু করছে, ‘বান্না! স্বপ্ন দেখছি নাতো! এত শুকিয়ে গেছ, তুমি? কী অবস্থা তোমার? তোমার কী হৈছে! এত শুকায়া গেছ! খাওয়া-দাওয়া করো না?’ ‘এই, এমনি তেমন কোন কারণ নাই। আমি তো ছোট্ট থেকেই চিকন।’ ‘তাই বইলা …,’ কথা শেষ না করে শাহীন আপা কিছুক্ষণ থেমে স্বাভাবিক হয়ে বলে, ‘তুমি তো বাড়ায়া বললা,’ থেমে কী যেন ভেবে সামান্য হেসে আবার যোগ করে, ‘আমি আসলে আগের মতনই আছি। একটু চর্বি জমছে খালি, কিন্তু এটা কোন ব্যাপার না। এই হয়, এই কমে।’ দম নিয়ে আবার আমার হাত ধরে বলতে শুরু করে, ‘চল চল হাঁটতে হাঁটতে গল্প করি। আচ্ছা তোমার কোন কাজ নাই তো?’
‘নাহ্।’
রিকশা ভাড়া মিটিয়ে আবার আমার হাত ধরে সোহওয়াদীর্র ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। পাশপাশি আমি।
বিকালের যাবার সময় হয়ে গেছে। শেষ হেমন্তের সূর্যটায় আগুন লেগে আছে। তীব্র কমলা আর তীব্র সোনালীর একটা অদ্ভুত মায়াবী মিশ্রণ, যা চারপাশের প্রাকসন্ধ্যার পরিবেশকে রাঙিয়ে তুলছে। মমতা আর কামনার অদ্ভুত মিশ্রণে চারপাশের ক্যরেকটারগুলা আগের মতই, তবে সংখ্যায় ১০ কি ২০ আল্লায় জানে কতগুণ বেড়ে গেছে! বিশেষ করে ২০ থেকে ৩০, যদিও ৪৫-৫০ও আছে, বয়সীদের সংখ্যায় ক্রমাগত ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে চারপাশ। এদিকে কত যে প্রশ্ন করে চলছে শাহীন আপা, উওর দিতে গিয়ে হিম-সিম খাচ্ছিলাম আমি। ‘ইমরানের খবর কি? কেমন আছে ও? প্রিন্স? কী করে ও এখন? ও কিন্তু অনেক বুদ্ধিমান ছেলে ছিল। দেখো, ও একদিন অনেক উপরে উঠবে। আচ্ছা রাজু কি এখনো আগের মতই? নেশা ছাড়ে নাই? ইশ এত ভালো ছেলেটা!’ বলে কল কল করতে থাকা শাহীন আপা হঠাৎ থেমে যায়। আবার অজানা কোন বিযয় ভেবে চিন্তিত, বিষন্ন হয়ে পড়ে। আমি নেশার প্রসঙ্গ শুনে আমার মাথায় আসা প্রশ্নটা আপাতত না করে গভীরভাবে কাছ থেকে এতক্ষণে প্রথমবারের মত শাহীন আপাকে দেখি। আসলে একটুও বদলায় নাই বরং আরও শীর্ণ হয়েছে। আগের চেয়ে আরও বেশী করে জেগে ওঠা চিবুকের হাড় দেখে বুঝতে পারি আমি। অথচ প্রথমে কাপড় পরার কোন বিশেষ কায়দায় শীর্ণতাটুকু ধরতে পারি নাই – কণ্ঠের হারমোনিয়ামের রিডের মত হাড়গুলা আর কাঁধের ২ হাড়ের মাঝের গর্তের গভীরতা দেখে আমি অনুমান করি। মাঝারী সাইজের ঝুঁটি থেকে ইচ্ছাকৃত না অসর্তকতায় বেরিয়ে আসা কয়েকটা চুল ঝুলছে গালের উপর, কপালে লেপ্টে আছে ২/১ টা। মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ধরে, আবার ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে থাকে সে আমার হাত ধরে। অবশ্য মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হয় না এই নৈঃশব্দ। অল্পক্ষণেই আবার স্বরূপে ফিরে আসে উচ্ছ্বল, উৎফুল্ল সদা হাস্যময়ী শাহীন আপা। জীবন যাকে নিয়ে ধোপার কাপড়ের মত আছাড়ি-পাছাড়ি করার পরও যার মুখের হাসি মিলায় না।
শ্যামলী সিনেমা হলের বিপরীতের মাকের্টে শাহীন আপার সাথে পরিচয়। সে তো প্রায় ১৬/১৭ বছর আগের কথা, আমরা সবে এসএসসি দিচ্ছি। প্রিন্স আমার ক্লাসমেট। প্রিন্সের বন্ধু ইমরান আগারগাঁও থেকে আসত। রাজু শ্যামলীর ১ নম্বর রোডের রাস্তা থেকে, মার্কেটে নাহলে প্রিন্সের বাসায় আড্ডা দিতাম। তবে তা সামান্য। মার্কেটেই বেশি বসা হত। খিলজী রোড থেকে নোমান, সুদূর টিপু সুলতান রোড থেকে উজ্জ্বল, অপুর বান্ধবী সুরভী (কানাডায় শৈশব ও কৈশোর কাটিয়ে সদ্য দেশে ফিরেছে সে তখন) এছাড়া নিয়মিত-অনিয়মিত আরও কয়েকজন আসত সে আড্ডায়। লাগাতার আড্ডা ছিল সেগুলা। মাকের্টটা তখন অর্ধ-সমাপ্ত। নিচতলায় বাইরে এককোণে ছিল জাপান কালার ল্যাব, আরেক কোণে লিটন ভাইয়ার বই-বিচিত্রা। এছাড়া মাঝখানে আকিব ভাইয়ের জেনারেল ষ্টোর আর একটা কনফেকশনারী। কনফেকশনারীর পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, তখনো ব্যাংকটা হয় নাই। শুধু সামনের রাস্তার দিকের এক কোণে বই বিচিত্রার উপর রেইনবো ম্যাসেজ পার্লার, আজকাল ঢাকায় ম্যাসেজ পার্লার বেশ কমে গেছে, প্রায় চোখে পড়ে না। তখন একটা হুজুগ ছিল মোড়ে মোড়ে ম্যসেজ পার্লারের। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কিছু বলতেন না।
বেশ্যাপাড়ার এক ধরনের বিকল্প ছিল এই ম্যাসেজ পালার্রগুলা। পার্লারের ভেতরে ঢুকলে, প্রথমে ঢোকার সামনে টেবিলের উপর পত্র-পত্রিকাওলা ওয়েটিং রুম। রুমের বাকী অংশে থাকত চিকন প্যাসেজের দু‘পাশে থোক-থোক ছোট ছোট রুম। ম্যাসেজ করানোর উপযোগী ফোমঅলা ইজি চেয়ারে জামা-প্যান্টের জিপার খুলে ঢিলেঢালা হয়ে বসা কাস্টমারের পাশে দাঁড়িয়ে কোন একজন কর্মচারী মেয়ে তাকে ম্যসেজসহ হস্তমৈথুন করে দিত, এই হলো ম্যাসেজের মেসেজ। পেশাগত দায়িত্বকালীন মূহূর্তে প্রাকৃতিক কারণেই মেয়ে কর্মচারীদের নানারকম হ্যজার্ডের মুখোমুখি হতে হতো। ঠোঁটে দগদগে লাল দাগ নিয়ে, বা স্তনে কালসিটে নিয়ে ঘরে ফেরা, পেশাগত দায়িত্বের অংশ না হলেও, বাস্তবতা বা দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের কারণে তাদের তা মেনে নিতে হত। তো, শাহীন আপা কাজ করতো এই রেইনবো ম্যাসেজ পার্লারে। নেশাখোর স্বামী আর ২ সন্তানের সংসারের বোঝা টানার জন্য। মাকের্টের ভেতরের দোকান-পাট তখন কিছুই হয় নাই। ৩ আর ৪ তলায় গার্মেন্টস হলেও ১ ও ২ তলার কাজ অর্ধসমাপ্ত অবস্থায় দীর্ঘদিন যাবত বন্ধ ছিল। কাজের জন্য ইটগুলা স্তুপীকৃতভাবে সাজানো ছিল পিছনের দেয়ালের সাথে, কতগুলা বাঁশ পড়ে ছিল মার্কেটের পিছনে। ১৫ বছর আগের কথা না এসব! মোটামুটি দেড়শ থেকে দুইশ বর্গগজের একটা উঠানে, কোণায় মেয়েদের টয়লেট। ডান কোনায় আমরা ছেলেরা আড্ডা দিতাম বাঁশগুলার উপর বসে। আড্ডার মহিলা সদস্য সুরভিও ময়লা জিন্স পড়ে নির্দ্বিধায় আমাদের পাশে বসে সিগারেট খেতে খেতে আড্ডা দিত। আবার ২/১ সময় স্টিক চললে তাও খেত। চলতি ফ্যাশনের না, ও ছিল সত্যিকারের সুন্দর, কোমল মনের ডেসপারেট একটা মেয়ে। যে কিনা, আমি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করতাম, ভন্ডামি জানত না। লিটন ভাই কিন্তু আমাদের আড্ডার একজন নিয়মিত সদস্য ছিল, আমাদের ১০/১২ বছরের বড় হলেও অসম্ভব মুখ খারাপ করতে পারত সে। আমাদের পাশ দিয়েই পার্লারের অন্যান্য মেয়ের মত টয়লেটে যেতে যেতে, লজ্জায় মাথা নিচু করে যেত শাহীন আপা। আমার বলতে ইচ্ছা হত, ‘এতে তো লজ্বায় কিছুই নাই। সব বান্দা পায়খানা করে!’ কিন্তু আরও বেশী লজ্জা পাবে বলে বলতাম না। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কখনো আমাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করত না। কেমন যেন আড়ষ্ট হয়ে পার হয়ে যেত জায়গাটুকু শাহীন আপা। আমরা ভদ্রতাবশত মাথা নিচু করে রাখতাম, বা ঘুরিয়ে রাখতাম। কেমন যেন খারাপ লাগত, আসলে সবাই সবকিছু জানে। কিন্তু একদিন শাহীন আপা টয়লেট থেকে ফেরার পথে আমি তার দিকে চেয়েছিলাম। ৮/১০ সেকেন্ড লাগে আমাদের আমাদের পার হয়ে যেতে। প্রথমে লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলেও এই অল্প সময়ের মধ্যে আরও দুবার আমার দিকে তাকায় সে, এবং দ্বিতীয় বার চোখ নামায় না, কাছে এসে বলে ‘কেমন আছেন?’ আমি এতটা কেন, কিছুই আশা করি নাই। তাই প্রথমে হতবাক হয়ে থাকি বলে জবাব দিতে একটু দেরী হয়, ‘ভাল, আপনে? ভাল আছেন?’ ‘এই আর কি! চলছে! আমাদের আবার থাকা!’ দীর্ঘশ্বাস না ছেড়ে হাসিমুখে বলে শাহীন আপা। কোন কষ্টের ছাপ ছাড়াই। ‘না! না! তা হবে কেন পরিশ্রম করে…,’
আমাকে ইশারায় থামিয়ে দিয়ে সুরভি বলে, ‘বসেন না। আমাদের সাথে একটু গল্প করেন। প্রতিদিন দেখা হয়। আফটার অল, আমরাতো একরকম দিনের অর্ধেক সময় একই বিল্ডিংয়ে থাকি। বসেন না একটু! অবশ্য আপনার যদি কাজের চাপ না থাকে।’ ‘না কাজের চাপ নাই। ২টার সময় কে আসবে? এখন তো বউয়ের সাথে থাকার সময়,’ বলতে বলতে সুরভীর সাথে একটু দুরত্ব রেখে বসে। সুরভি আমাকে দুষ্টামির ইশারা করলে আমি যথেষ্ট খালি জায়গায় গিয়ে বসি। অবশ্য দু’পাশে কারে গায়ে গা না লাগিয়ে। ‘দেখছেন!’ শাহীন আপার দিকে ফিরে সুরভী বলে, ‘কত জায়গা ছিল, আরও একজন বসা গেল।’ আড্ডায় উপস্থিত সবার সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই আমি, সেও তার নাম বলে, ‘আমার নাম শাহীন।’ লিটন ভাই ঐদিন ছিল না আড্ডায়। বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তায় পর শাহীন আপা জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, লিটন নাই?’ ‘লিটন ভাইকে আপনি চিনেন কিভাবে?’ সে বলে, ‘বা তোমরা জান না? লিটন আমার কাস্টমার না?’ যেন একজন মুদি দোকানী বলছে, ঠিক সেরকম সুর তার কণ্ঠে। ‘ও তো প্রায় যায়। কী শয়তান দেখছো? তোমাদের বলে নাই? দাড়াও আসুক আজকে।’
আসলে আমি জানতাম, আমাকে একদিন নিয়ে গিয়েছিল। আমি ওয়েটিং রুমে বসে একটা ভারতীয় ম্যাগাজিন নিয়ে ‘মেঘে ঢাকা তারা’য় শ্যুটিংয়ের অভিক্ষতা নিয়ে সুপ্রিয়ার জমজমাট একটা সাক্ষাৎকার পড়লাম। দেখলাম ১০ মিনিটে হয়ে গেল লিটন ভাইয়ের। সেদিন শাহীন আপাকে দেখি নাই। অবশ্য মেয়েগুলাকে ওয়েটিং রুম থেকে দেখা যায়। তবু কিছু না বলে চুপচাপ থাকি আমি।
এই থেকে শুরু, এরপরে টয়লেটে যাওয়া আসার সময় আমাদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়া তার নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অনেক সময় ম্যনেজারকে ডেকে নিয়ে যেতে হত। সরল, অকপট শাহীন আপার কাছ থেকে তার পারিপারিক জীবন-বৃন্তান্ত শোনার পর জানা গেল, গতানুনিক গল্প। নেশাখোর স্বামীর জন্য দৈনিক ২০০ টাকা বরাদ্দ ছাড়া ২/৩ বছরের ছেলের লালন-পালনসহ পুরা সংসারের খরচ। প্রেম করে বিয়ে করছিলো। কিশোরীর চিত্তের অনভিজ্ঞ স্বপ্নে ভর করে আশা করেছিল ঠিক হয়ে যাবে। ১০ বছর এখনো হয়নি, প্রেমের ভস্মস্তুপ আর বাকি নাই, আমি ভাবি, আবার সত্যিই নাই? একদিন আমার ‘লাত্থি মাইরা ছাইরা আসেন না কেন’ প্রশ্নের জবাবে বিস্ময়ে, বিমূঢ় হয়ে যে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো তাতে ধরণীকে অনুরোধ করতে ইচ্ছে করছিলো দ্বিধা হ বাপ, চোখে পানি চলে এসেছিলো শাহীন আপার। শাহীন আপা আমাদের আড্ডার সদস্য হওয়ার ৪/৫ দিনের মাথায় সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেছিল, যে শাহীন আপা লিটন ভাইয়ের প্রেমে পড়েছে। আর লিটন প্রেমের ভান করছে। আমি বুঝি না, শাহীন আপা কিভাবে আশা করল যে তার মত সামাজিক অবস্থানের মেয়েকে পাঁচতলা বাড়ির মালিকের ২ ছেলের একজন ভাল ইনকামের একটা দোকানের পজেশনসহ বিয়ে করবে। মেয়েমানুষের অনুমান নাকি নিভর্রযোগ্য – এই কি তার নমুনা? মাঝেই মাঝেই দেখতাম স্কুটারে করে শাহীন আপা লিটন ভাইয়ের সাথে কোথায় যাচ্ছে। একদিন আমি আলাদা জিজ্ঞেস করলে বলল লিটনের বন্ধুর এক ফ্লাটে যায়।
‘আপনি এটা কী ভুল করতাছেন? আপনি লিটন ভাইরে চিনেন না।’ মাথা নিচু করে জবাবহীন অনড় দাঁড়িয়ে থাকে শাহীন আপা। তারপর যখন ছলছল চোখ নিয়ে মুখ তুলে বলে, ‘রাতে বাসায় ফির্যা দেখি মাল খাইতেছে সকালে ভাত রাইন্দা আসছি, খায় নাই’, তখন শাহীন আপার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে, একটু থেমে চোখের পানি মুছে বলে, ‘চোখ বন্ধ করে ঝিমায়। একসাথে খাইতে বসতে বললে বলে পরে খাবে, খায় সেই রাইত ৩ টা ৪ টায়। সকালে উইঠা যখন রান্দা-বান্দা-গোসল করি, রওনা দেই, তখন সে অঘোর ঘুমে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সকালে বালিশের নিচে দুইশ টাকা রাখা ছাড়া আর কোন সম্পর্ক নাই।’
‘কিন্তু আপনে তো তারে আর ছাড়াতে পারবেন না।’
এ কথায় মন খারাপ করে কিছুক্ষণ বসে আমার তোলা প্রসঙ্গ এড়িয়ে আবার শুরু করে, ‘আমিও তো মানুষ, বান্না, শরীরের কথা নাইলে বাদ দিলাম।
‘এইটুকু হইলে কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আপনি তো লিটন ভাইয়ের প্রেমে পড়তাছেন? কী সাংঘাতিক অবস্থার দিকে যাইতাছেন আপনে বোঝেন না?’ পর-পর দুবার চোখের পলক ফেলে শাহীন আপা। কথা শুরু করতে গিয়েও পারে না। গলা আটকে আসে তারপর কথা বলার চেষ্টা ত্যাগ করে গভীর যন্ত্রনা মাখা হৃদয়ে নিথর হয়ে বসে থাকে ও কিছুক্ষণ পর সর-সর করে কেদেঁ ফেলে, বলে, ‘বান্না আমি কি করব? তুমি যা বলবা। তা-ই করব! বান্না, তুমি জান তুমি আমার কাছে কি! তুমি বল আমি এখন কী করব।’
‘শোনেন লিটন ভাইয়ের সঙ্গে বাইরে যাওয়া আপনার ছাড়তে হবে। ওর কাজও করবেন না। অন্য মেয়েদের দিয়ে করাবেন। মোটকথা, লিটনের সাথে কোন যোগাযোগ রাখবেন না।’
‘এইটা সম্ভব না। বান্না, দেখ লিটন যেইসব মুলা দেখায় বাড়ির অধের্ক, গাড়ি এসব ভূয়া। এইসব আমি এক কান দিয়া ঢুকাইয়া আরেক কান দিয়া বাইর করে দেই। অনেক সময় ঢুকাইও না। কিন্তু সেটা কথা না। আমি যে ওকে ভালোবাসি। আমি লিটনকে ভালোবাসি এইটা সেও বোঝে, আর আমাকে ব্যবহার করে, তবু সেই ব্যবহৃত হওয়াতেই যে কী মধু! যদি সারাজীবন আমাকে ব্যবহারই শুধু করে, তাহলেও আমি ধন্য। বান্না, আমি এখন কী করব বান্না? বিয়ার পর থেকে এমন রাত নাই, যে রাতে আমি কাঁদি নাই। রাতের পর রাত কাঁদি। সবাই আমার হাসি শুধু দেখে, আমার কান্না কেউ দেখে না। ওকে যে আমি ভালোবাসি।’ হু-হু করে কাঁদতে কাঁদতে বলে শাহীন আপা।
‘তাইলে আপনের কপালে আর খারাপি আছে, কাইন্দেন না, চোখ মোছেন, মুখ ধুইয়া আসেন। ওরা আসতে পারে।’ আরো ৪/৫ ঘন্টা কথা বলেও শেষ হবে না, বুঝতে পেরে আলাপ শেষ করার চেষ্টা করি।
‘আগে ১টা ছিল এখন ২টা হৈছে। কী করব বান্না, এখন আমি? ওকে দেখলে সব ভুলে যাই, এই যে ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, স-ব, কিছু মনে থাকে না। বিশ্বাস কর বান্না, পৃথিবীতে নিজের চেয়ে সুখী আর কাউকে মনে হয় না। তুমি হাসতেছো? শোন লিটনের মনের খবর আমি জানি, কিন্তু তাতে কি? কিন্তু ও তো ২/১ ঘন্টার পর থাকবে না আমার পাশে, তবু এতক্ষণ তো পাশে থাকবে!’ প্রেমের স্বীকৃতির বাসনায় প্রশ্নাতুর চোখে চেয়ে থাকে শাহীন আপা। মলিন মুখ, চিন্তিত, বিষন্ন।
শাহীন আপাকে দেখতে দেখতে মুহূর্তে, পার দিতে থাকা ছুরির মত দ্রুততায়, শ্যামলীর আড্ডার দিনগুলা মানসপটে ভেসে উঠল। এরপরে ঘটনা আমার ধারণা মাফিকই হয়েছিল। মাস দুয়েকের মাথায় শাহীন আপা তাৎক্ষণিক নোটিশে ঢাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার একদিন আগে বানানো ঝগড়ায় লিটন ভাই শাহীন আপার সাথে তার সর্ম্পকের সমাপ্তি টানে।
বেশিক্ষণ বিষন্ন থাকে না শাহীন আপা, কী যেন স্মৃতিচারণ করে মাথা উঁচিয়ে হেসে আমাকে হাত টানতে টানতে বলে, ‘চল, চল রোড ক্রস করতে হবে।’ একটু থেমে যেন কৈফিয়ত দিচ্ছে, ‘চল ঐ পাশের চায়ের দোকানটায় বসি ঐখানে ভিড় কম, আমরা একপাশে বেঞ্চে বসতে পারবো।’
‘ভিড় কম’ এটাই কী পরিবর্তনটা এনেছিলো? যদিও শাহীন আপার কণ্ঠে এক ফোঁটা ইঙ্গিতও ছিল না। সে যাই হোক, এরপর পরবর্তী যে ৪৫ মিনিট আমি তার সাথে কাটাই তার পুরা সময় জুড়ে আমার মাথায় ‘ভিড় কম’ এর অনুরণন চলছিল। ঝর্ণার মত উচ্ছল কলকল করে কথা বলেই চলছিল শাহীন আপা, কত যে প্রশ্ন তার, আবার কত যে গল্প, ঘোলা বাল্বের আলোয় ভ্যানগাড়ির চায়ের দোকানের একপাশে রাখা একটিমাত্র বেঞ্চে বসে, চারপাশ ছিল আধা ঘোলা আলো, আধা অন্ধকারে ঢাকা। ফলে পরস্পরের চেহারা পুরাপুরি স্পষ্ট দেখতে পারছিলাম না। আর সেও কথা বলছিল দোকানের চাকার নিচের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে। অবিরল কথা। আমার প্রতিক্রিয়া, অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করার তার টাইম ছিল না। আর এদিকে কী যে হয়, মনের ভেতর কামনা জেগে উঠছিল আমার। যতই আড়চোখে শাহীন আপার দিকে তাকাচ্ছিলাম ততই একটা কেমন যেন ইচ্ছা আমাকে দখল করে বসছিল। কেন অসুবিধা কী? সেই কবে ১৫/১৬ বছর আগের শেষ দেখা। হঠাৎ অনেকক্ষণ ধরে মাথায় ঘুরতে থাকা প্রশ্নটা করে ফেলি, ‘এখানে কোথাও আসছেন নাকি?’ প্রশ্নটা অপ্রীতিকর বলে, আবার উওর জানা বলে এতক্ষণে করি নাই, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া, জবাব, জবাবের ধরণ, ভঙ্গি সবকিছু আমাকে চোখে আগুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়; আমি শাহীন আপাকে ভুলে গেছি।
আমার মনে পড়ে, এই মহিলাই শ্যামলীতে, ততদিনে তার সাথে আমাদের খাতির হয়ে গেছে, উওর জানলেও ইমরানের দুষ্টুমিমাখা ‘আচ্ছা আপনারা কি করেন? মানে, আপনাদের কাজটা কি?’ প্রশ্নের জবাবে খিল খিল হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে বলছিলো, ‘২০-৩০ জন’, বলে আবারো হাসতে থাকে, আবার ইমরান ‘মানে?’ জিগ্যেস করলে, ‘খবরদার আর একটা কথা বলবা না,’ বলে চাঁটি মারে ইমরানের মাথায়, হাসি তখনো থামে না। আমার প্রশ্নটা শুনে মাত্রই ২/১ সেকেন্ড চুপ থেকে একবার আমার দিকে, তারপর আবার চাকার দিকে ফিরে, শান্ত, ধীর সংক্ষেপিত কণ্ঠে বলে ‘বান্না, কত কিছু হৈয়া গেল এর মধ্যে, কতদিন পর দেখা, তুমি তো অনেক কিছুই জান না, এখন আর আমি অর্ধেক না, পুরা বেশ্যা। এদিকেই কাজ করি, অবশ্য বাগানে না। আমি এখান থেইকা কাষ্টোমার নিয়া নবাবপুর পরিচিত হোটেল আছে, সেখানে চলে যাই।’
‘আপনার হাজব্যান্ডের খবর কি?’ ‘আছে!’ দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে বলে। ‘সে বাচ্চা দুইটা? ছেলে না মেয়ে যেন?’ ‘দুইটা মেয়ে, ওরা ভালোই আছে,’ বলে আমার দিকে ফিরে হেসে বলে, ‘আমাদের আবার থাকা! এইসব বাদ দাও, তোমার খবর বল, তোমার অবস্থা কী? কী করতেছো?’ আমি সংক্ষেপে আমার বৃন্তান্ত জানাই যান্ত্রিকভাবে, কেননা মাথার ভেতরে তখন গুঞ্জন করছিলো অসংখ্যা মৌমাছি, রাণী মৌমাছির চেন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে সামলানোর অযোগ্য পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, হৃদয়ের দাসত্বের শূংখল ভেঙ্গে ক্রুদ্ধ ইচ্ছা বাস্তবায়নে শক্ত হয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে।
আমি বলি, ‘শাহীন আপা, কিছু মনে কইরেন না, আপনে আমার সাথে যাবেন?’
‘কোথায়?’
বলেই আমার কথার অর্থ বুঝতে পেরে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। বিমূঢ় হয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলে, ‘বাইরে না হলেও ভেতরে ভেতরে সত্যিই এত বড় হয়ে গেছ? বান্না, তুমি জান না, তুমি আমার কাছে কী এখনো।’ আমি তোমাকে ভুলি নাই।
‘হ্যাঁ, এখনো। গত ১৫/১৬ বছর তোমাকে আমার প্রায়ই মনে পড়ত। এতক্ষণ লজ্জায় বলি নাই, যদি তুমি ভুল বুঝ, এখন বললাম, কেন বললাম? এরপর যে অস্বস্তি নেমে আসে দুজনের মাঝে তাতে বেশিক্ষণ কথা চালানো যায় না। আমি উঠে বিল দিতে গেলে শাহীন আপা আমাকে জোর করে থামিয়ে নিজে বিল দেয়, কোন কথা বলে না। আমার তখন খারাপ লাগতে শুরু করেছে। বলব না, বলব না করে কেন যে বলতে গেলাম! আমার অবশ্য মন তখনো যুক্তির পর যুক্তি তৈরি করে চলেছে। আমার বলে ফেলা ইচ্ছার সমর্থনে দোয়েল চত্বর পযর্ন্ত আমাকে আগিয়ে দেয় শাহীন আপা। দুজনে হাঁটতে থাকি। এক সময় শাহীন আপা আমার হাতটা আবার ধরে, চাপ দেয়, যেন বলতে চায় এটা কোন ব্যাপার না, হতেই পারে। মন খারাপ করো না প্লিজ! এজিবি কলোনিতে রিকশা ঠিক করে ওঠার সময়, তখনো সে আমার হাত ছাড়ে নাই, আমি বলি, ‘শাহীন আপা, সরি।’
আবার সেই আগের পুরান বাঁধভাঙ্গা ভূবনমোহিনী হাসি। আমার মনে পড়ে, ‘তোমরা শুধু আমার হাসিই দেখ, আমার কান্না কেউ দেখে না।’
রচনাকাল ২০০৮
তারিক আল বান্না
Latest posts by তারিক আল বান্না (see all)
- গল্প: শাহীন আপার সাথে আমার সম্পর্ক - জুলাই 28, 2016
- রেখাপা: একটি স্কেচ - জুন 15, 2016