ফারুকীর টেলিভিশন, দূর-দর্শনের মিডিয়া এবং ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’
এই লেখাটা ‘যোগাযোগ’ পত্রিকার জুলাই ১২, ২০১৬’তেও ছাপা হইছে।
——————–
i“…every people in whose soul an inferiority complex has been created by the death and burial of its local cultural originality—finds itself face to face with the language of the civilizing nation”. ফ্রান্স ফানো (১৯৬৭: ৯)
[১]
এ লেখার উসকানি এসেছে মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর টেলিভিশন সিনেমা থেকে, এবং এসেছে গুরুতর এক প্রশ্নের আকারে। টেলিভিশন সিনেমা যে দুইভাবে সপ্রশ্ন কৌতুহল জাগিয়ে তুলেছে সতর্ক পাঠক শিরোনাম দেখে নিশ্চয়তা আন্দাজ করতে পারবেন। সেই কৌতুহল মেটাতেই, ফারুকীর টেলিভিশন সিনেমার বিচার এ লেখায় থাকবে, তবে লেখাটি পল্লবিত হয়ে উঠবে অন্য এক লক্ষ্য পূরণের তাগিদে। ফিল্ম রিভিউ বা চলচ্চিত্র সমালোচনা বলে যে বর্গকে আমরা সাধারণভাবে চিনি এ লেখা তার অন্তর্ভুক্ত হবার নয়, সেরকম কোনো উদ্দেশ্যে লিখছিও না আমি।
[২]
পরিপ্রেক্ষিত
টেলিভিশন নিয়ে লেখার একটা গুরুতর তাগিদ আছে বটে। ৯/১১ পরবর্তী পরিস্থিতিতে ইসলাম ও মুসলমান, ‘ধর্মীয়’ সন্ত্রাস ও রক্ষণশীলতা নিয়ে জগৎ জুড়ে এমনই এক প্রতাপশালী‘ ডিসকার্সিভ ফর্মেশান’ ঘটেছে যে তার অভিঘাতে, আবশ্যিকভাবেই, টেলিভিস্যুয়াল জগৎও সরব হয়ে উঠেছে। এরকম সময় আগে কখনো দেখা যায়নি। বাংলাদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতরে ‘ধর্মীয়’ জঙ্গিপনা, ‘ধর্মীয়’ কুসংস্কার ও ‘ধর্মীয়’ রক্ষণশীলতার প্রসঙ্গ ধরে মাত্র দুই-আড়াই বছরের মধ্যেই (২০১০-২০১২) বাংলা ভাষায় চারটি ফিচার ফিল্ম এবং দুইটি টেলিভিশন নাটক তৈরি হয়েছে। কতগুলো ডক্যুমেন্টারি তৈরি হয়েছে তা অবশ্য আমি জানি না,তবে অডিও-ভিস্যুয়াল-মূদ্রণ মাধ্যমগুলোতে নিউজ-রিপোর্ট ও বিশ্লেষণধর্মী লেখা এবং একাডেমিক গবেষণা, নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, বেশুমার। যা হোক, ফিচার ফিল্মগুলো হলো: অপেক্ষা (আবু সাইয়ীদ ২০১০), রানওয়ে (তারেক মাসুদ ২০১০), জ্বী হুজুর (জাকির হোসেন রাজু ২০১২) টেলিভিশন (মোস্তফা সরোয়ার ফারুকী ২০১২)। দুইটা টেলিভিশন নাটক: মায়া ম্যাডাম (সৈয়দ আওলাদ ২০১০), ফেরার পথ নাই, থাকে না কোনো কালে (মেজবাউর রহমান সুমন ২০১০)।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
বাংলাদেশের বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পরিসরে সেকুলারবাদ ও ধর্মীয়চর্চার রাজনীতি বুঝতে বিশেষভাবে আগ্রহী বিধায় আমি তিনটা সিনেমা – অপেক্ষা, রানওয়ে এবং জী হুজুরের একটা বিচার হাজির করেছিলাম ‘বোমা-জঙ্গি-মাদ্রাসা-ইসলাম এবং বাংলাদেশ’ (যোগাযোগ, ২০১৩) প্রবন্ধে। তখন দেখতে পেয়েছিলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে‘ইসলামী’ জঙ্গিপনার যে ন্যারেটিভ সর্বজনমান্য হয়ে উঠেছে, এবং আমাদের দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থাও যে ন্যারেটিভের উৎসাহী গ্রহক হয়ে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অনন্ত যুদ্ধে’ সামিল, সেই একই ন্যারেটিভ এই সিনেমাগুলোর পাটাতন হিসেবে কাজ করেছে। এনলাইটেনমেন্টের ‘মহান’ সকল অঙ্গীকার নিয়ে গড়ে-ওঠা বর্তমানের রাষ্ট্রব্যবস্থা, আধুনিকতা এবং যুক্তিবাদিতা চর্চায় কোনো সমস্যা আছে কিনা; কিংবা বর্তমান উদারবাদী অর্থনৈতিক বিশ্বব্যবস্থায় ক্ষমতাবিস্তার এবং অস্ত্র ও অন্যান্য ব্যবসার স্বার্থ এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী কিনা তা সিনেমাগুলোতে পুরোপুরিই অনুপস্থিত। প্রতিটি সিনেমাতেই সমস্যা খোঁজা হয়েছে ধর্মের ভিতরেই – যেন স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ শাশ্বত কোনো বিধানমাত্র হলো ধর্ম; এবং দায়ীও করা হয়েছে কেবলই এই ধর্মাচারী মানুষগুলোকেই – এই মানুষগুলোও যেন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটশূন্য চিন্তাশূন্য অন্ধ অনুসরণকারী এবং জন্মগতভাবেই উন্মত্ত সন্ত্রাসপ্রবণ। আর আবশ্যিকভাবেই এই মানুষগুলো রাজনৈতিক সত্ত্বাশূন্যও বটে – ‘অপরাধ’ গল্পের আড়ালে হারিয়ে যায় তাদের সকল রাজনৈতিকতা। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো, যে কোনো মনোযোগী দর্শক এই তিনটা সিনেমায়, বিশেষভাবে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, এবং মৃত্যুদন্ডে নিহত এর প্রধান দুই সিপাহসালার শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভায়ের স্পষ্ট ছায়া দেখতে পাবেন। তবে, আমি দেখতে পেয়েছিলাম আরও ইন্টারেস্টিং একটা ডাইমেনশান: তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গল্প, তিনটি ভিন্ন কাহিনী নিয়ে স্বতন্ত্র তিনজন পরিচালক কাছাকাছি সময়ে সিনেমা বানিয়েছেন। অথচ, নাড়ি বুঝে সময়ের ক্রমানুসারে এই তিনটি কাহিনীর মূলকথা বা মাস্টার ন্যারেটিভ একই সুতায় গাঁথলে একটা অতি-কাহিনী, একটা মিথ বা পুরানকথা দাঁড়িয়ে যায় – যাকে আধুনিক রাষ্ট্রীয় মিথ বলাই শ্রেয়।
আধিপত্যকারী ডিসকোর্সের অধীনে থাকার করণেই মূলত,স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও, অন্তর্নিহিত বিধানগুলোর সুবাদে এই তিনটি গল্প একসাথে যুক্ত হয়ে একটা মহা-গল্প তৈরি করে ফেলে। মহাগল্পের অবয়ব সবসময়ই মিথিক্যাল। আর এও বোধহয় বলাই বাহুল্য যে পুঁজিবাদের নিষ্ঠুর সর্ববিনাশী অভিযাত্রায় রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগের (ভায়োলেন্স) ন্যায্যতা তৈরি করতেই অহরহ এরকম মিথের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন একান্ত আবশ্যক হয়ে পড়ে।
তিনটা সিনেমা মিলে গড়ে ওঠা মিথের কাঠামো একটু খোলসা করি: ধর্মের ‘ভুল ব্যাখ্যা’র বিভ্রান্তিতে বিপথগামী ও ভয়ানক জঙ্গি হয়ে-ওঠা সন্তানের জন্য অপেক্ষা চলে সাইয়ীদের অপেক্ষা জুড়ে। কিন্তু তারেক মাসুদের রানওয়ে সেই সন্তানকে সমাজে ফিরে আসবারই নিশানা দেখায়, ফলত অপেক্ষার অবসান ঘটে। আবু সাইয়ীদ যখন ব্যাখ্যাহীনভাবে ভুল পথের বয়ান হাজির করেন, তখন তারেক মাসুদ ধর্মের ‘ভুল ব্যাখ্যা’র কারণ অনুসন্ধান করেন। কোন পরিস্থিতিতে, কোন বাস্তবতায় আমাদের সমাজে ধর্মের ‘ভুল ব্যাখ্যা’ তৈয়ার হয় এবং মাদ্রাসা-পড়ুয়া যুবকরা মোহাচ্ছন্ন হন তার ইশতেহার হাজির করেন।ফলে, ধর্মের ভুল-সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবন করে আমাদের সন্তানেরা তখন রানওয়ে ধরে ঘরে ফিরে আসে।কিন্তু ঘরে ফিরে তো সেইসন্তান বসে থাকতে পারে না। এবার সঠিক পথের নিশানা ধরে সে হাঁটবে – জীবনযাপনে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দেশের সকলকে সেই পথে আহ্বান করবে। তাই, জাকির হোসেন রাজু ধর্মের‘সঠিক ব্যাখ্যা’ বা ‘সহি’ রাস্তা মেলে ধরেন আমাদের সামনে – যে রাস্তা রাষ্ট্র-অনুমোদিত, রাষ্ট্র আরাধ্যও বটে। জ্বী হুজুর-এর পুরো পর্দা জুড়ে সফেদ পাজামা-পাঞ্জাবী-টুপি আর দাড়ি সমেত মাদ্রাসা বয় আবদুর রহমানের দাপুটে উপিস্থিতি যেভাবে ধার্মিকতার মহত্ব জাহির করে সেরকম আর কোথাও আগে দেখা যায়নি। আমাদের চেনা হিরোদের জগতে সিনেমার রূপালী পর্দা আর জাতীয় রাজনীতির মঞ্চ – আবদুর রহমান একটা মূর্তিমান বিশৃঙ্খলা হিসেবে হাজির হয়। কিন্তু একটু পিছনে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাবো জ্বী হুজুরের আবদুর রহমান বস্তুত আমাদের ইমেজ জগতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতেই নিয়োজিত।যে আবদুর রহমানকে ২০০৭-এ ফাঁসিতে চড়ানো হয়েছিল সে এই রাষ্ট্রব্যবস্থার আইন-কানুন মানতো না, এগুলোকে বলতো ‘তাগুতি’ মানে শয়তানের আইন। ফাঁসি হবে জেনেও আদালতে দাঁড়িয়ে সে স্পর্ধিত উচ্চকণ্ঠে বলেছিল, “আমি বিচারকদেরকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছি, কারণ তারা আল্লাহর আইন মেনে বিচার করে না। মানুষের তৈরি আইনে আমি হয়তো অপরাধী গণ্য হবো, আল্লাহর আইনে নয়।” কিন্তু এর বিপরীতে জী হুজুরের আবদুর রহমান আল্লাহর রাহে জীবন উৎসর্গ করলেও মানুষের তৈরি রাষ্ট্র ও আইন-কানুনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, সত্যনিষ্ঠ, এবং সর্বোপরি অন্য যে কোনো জাতীয়তাবাদী রঙের দেশেপ্রেমিকের মতোই একজন প্রকৃষ্ট দেশপ্রেমিক। ফলে, ঘৃণ্য ধর্মোন্মাদ হিসেবে শায়খ আবদুর রহমানের নেতিবাচকতাদুষ্ট ইমেজ আমাদের ‘দেশপ্রেম’ (রাষ্ট্রভক্তি হিসেবে পাঠ করতে হবে) অনুভূতিতে যে বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিল তা প্রতিরোধে অনুকরণীয় ধার্মিকতার ইমেজ হিসেবে দাঁড়িয়ে যায় জ্বী হুজুরের আবদুর রহমান। শায়খ আব্দুুর রহমান ও অন্যান্য জেএমবি নেতাদের ফাঁসির রায় ঘোষণাকালে বাংলাদেশের উচ্চ আদালত যে সিদ্ধান্ত জারি করে, আবু সাইয়ীদের অপেক্ষা, তারেক মাসুদের রানওয়ে এবং জাকির হোসেন রাজুর জ্বী হুজুর সেই সিদ্ধান্তকেই তামিল করে। ফলে দেখা যায়, রাষ্ট্রের কানুন এবং সিনেমার ক্যামেরা একই ভাষায় কথা বলতে শুরু করেছে: অপেক্ষা ধর্মের ‘ভুল ব্যাখ্যা’র দৃশ্যকল্প হাজির করে, রানওয়ে ধর্মের ভুল পথ থেকে ফিরে আসার প্রাকৃতিক/রাষ্ট্রীয় কৃৎকানুন শিখিয়ে দেয় সম্ভাব্য জঙ্গিদেরকে; এবং অবশেষে জ্বী হুজুর রাষ্ট্রের মতাদর্শিক খুপরিতে বশীকৃত ইসলামী জীবন যাপনের ‘সহি রাস্তা’ বাৎলে দেয়।
পরিচালকদের আন্তরিকতা নিয়ে কোনো সন্দেহেরঅবকাশ নাই- দেশের সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে তারা স্বতস্ফুর্তভাবেই সাড়া দিয়েছেন। তবে, এই সিনেমাগুলো বিশেষ প্রেসক্রিপশান অনুসরণ করে বানানো হয়েছে না বললেও এটুকু বলতেই হবে, কালো সায়েবরা যেন অচেতনভাবেই ‘সাহেবী’ নজরে আমাদের সমস্যাগুলোদেখবার জ্ঞান রপ্ত করে নিয়েছেন। কনসপিরেসি থিওরির মতো শুনালেও এটা স্বীকার করতে হবে। ফ্রান্স ফানো তার অল্প বয়সে লেখা কম আলোচিত ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক (১৯৬৭) গ্রন্থে সমাজ মনঃস্তত্ত্ব বিচার করে দেখিয়েছেন ঔপনিবেশিকতার প্রভাবে কালো মানুষদের ভিতরে কীভাবে হীনমন্যতা গড়ে ওঠে এবং বর্ণবাদের কলাকৌশলে সেই হীনমন্য মানুষগুলো অবশেষে সাদা চামড়ার নিপীড়কদেরকেই অনুকরণ করতে থাকে। তাই ফানো দাবি করে বসেন, ‘সচরাচর সকলে যেটাকে কৃষ্ণাঙ্গ সত্ত্বা হিসেবে জাহির করেন তা বস্তুত সাদা মানুষের তৈরি কুটুমকাটাম’ (১৯৬৭: ৬)। অনুকরণশীল শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ এক পর্যায়ে অনুভব করে তার স্বজাতি তাকে আর বুঝতে পারছে না, কিংবা সে নিজেই তার স্বজাতিকে আর বুঝতে পারছে না (১৯৬৭: ৭)! এদেশেও অবস্থাও তদ্রুপ। জঙ্গিবাদের সুলুক সন্ধানে যে মটিফগুলোর ব্যবহার হচ্ছে (দারিদ্র, মাদ্রাসা, মধ্যপ্রাচ্য, জঙ্গি-এজেন্ট যে-কিনা ‘নিরীহ’ যুবকদের বিভ্রান্ত করে) তা মুলধারা ব্যাখ্যা থেকে এক পা নড়ে না। জঙ্গিবাদের কারণ ও সুরাহার এই মসৃণ ফিল্মিক পথ কেবল চলচ্চিত্রকাররাই বাতলে দিচ্ছেন না, সাংবাদিকগণ, ঔপন্যাসিক, গল্পিয়ে, নাট্যকার, পন্ডিত সক্কলেই এই ধারায় কাজ করে ও কথা বলে চলেছেন। গত দুই-তিন শত বছর ধরে ‘আধুনিক’ রাষ্ট্র, উন্নয়ন ও পশ্চিমি প্রগতিশীলতার জ্ঞান/চর্চার সহিংস প্রয়োগের সাথে আমাদের মতো দেশে এ্যগ্রেসিভ মুসলিম সাবজেক্টিভিটি গড়ে উঠবার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা তা তারা আমলেই আনতে পারেননি। বলা যায়, ডমিন্যান্ট ডিসকোর্স অব ইসলামিক মিলিট্যান্সি ইন বাংলাদেশ- এর ভিতরে থেকেই তারা ভাবনা ও কর্মপন্থা নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। অথচ, মাহমুদ মামদানি (গুড মুসলিম, ব্যাড মুসলিম ২০০৫), এ. সাইয়িদ (এ ফান্ডামেন্টাল ফিয়ার: ইউরোসেন্ট্রিজম এন্ড ইমারজেন্স অব ইসলামিজম ২০০৪) বা অলিভিয়ার রয়ের (দ্য ফেইলিওর অব পোলিটিক্যাল ইসলাম ১৯৯৪) মতো বহু গবেষকই দেখতে পান, পোলিটিক্যাল ইসলাম বা ইসলামিজম নামের সকল ফেকরাই গড়ে উঠেছে মুসলিম প্রধান সমাজগুলোতে ‘পশ্চিমি’ আধুনিকতার অভিঘাতে ও সাপেক্ষে।
আর বলতেই হবে,বাংলাদেশের সেকুলার জাতীয়তাবাদী এস্টাবলিশমেন্ট উপরোক্ত বয়ানের অত্যুৎসাহী গ্রাহক। ‘ম্যান ইজ পোলিটিক্যাল এনিম্যাল’ – এরিস্টটলের এই কথাটি আপ্তবাক্য হিসেবে মানলে মানুষের ধর্মীয় প্রথা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিকতাও মানতে হয়। কারণ মানুষই সেগুলোর চর্চা করে, মানুষই সেগুলো বানায়। অথচ এরা মনে করে ধর্ম প্রাইভেট পরিসরে বন্দি থাকবার কথা। রাজনৈতিক পরিসরে ধর্মের কোনোরূপ উপস্থিতি এরা সহ্য করে না। ইউরোপীয় এই নীতির প্রতি অন্ধ বিশ্বাস, ঔপনিবেশিত মন এবং বাংলাদেশের নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক বাস্তবতার কারণেও এরাইসলামপন্থী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন তো বটেই, ধর্মনৈতিকতায় জীবনযাপনকারী সাধারণ মানুষদেরকেও উপযুক্ত তাচ্ছিল্য ও ঘৃণাসহ সম্ভাষণ করে।
কিন্তু ফরুকীর টেলিভিশন সিনেমা বশীকৃত ইসলামের রাষ্ট্রমার্কা ‘সহী রাস্তা’র ii বয়ান নিয়ে হাজির হয় না। তার তরিকা আলাদা, জঙ্গি প্রসঙ্গই একেবারে অনুপস্থিত। উপস্থিতি বনাম অনুপস্থিতি কিংবা সত্য বনাম মিথ্যা ইত্যাদি বাইনারিবিনাশী উত্তরকাঠামোবাদী মুহূর্ত মনে রাখলে আমরা দেখতে পাবো, এই অনুপস্থিতিই বরং বর্তমান বাংলাদেশের ‘ইসলাম’ ও ‘মুসলমান সমাজের’ অভ্যন্তরীণ গুরুতর সমস্যা নিয়ে বানানো টেলিভিশনকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে সকলের কাছে।ফরুকী সেকুলার ন্যাশনালিস্টদের বয়ানের বিকল্প হাজির করতে চান।ধর্ম তার কাছে বহিরঙ্গের লেবাস নয়, অন্তর্গত বস্তু। সেকুলার বয়ানের বাইরে এসে তিনি ধর্মকে ইহজাগতিক চর্চা হিসেবে দেখেন। তাই, তিনি নিরাপদ পাকা রাস্তা ছেড়ে আলপথে হাঁটা দিয়েছেন- বিকল্প পথের সন্ধান করেছেন। তিনি ইমেজ-বিরুদ্ধতার অবসান ঘটিয়ে কল্পনাকে মুক্তি দিতে চান, ইমাজিনেশান দিয়ে অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলতে চান। আর তাই, এ লেখার শেষ দিকে,ইমাজিনেশান-এর ভেতরে সুপ্ত ‘নেশান’ কল্পনা ফারুকীর দূর দর্শনে (টেলি-ভিশনে) কী রূপ পায় সেটা নিয়ে কিঞ্চিত আলাপ তুলতে চাইব।
[৩]
পর্যালোচনা
টেলিভিশনের গল্পটা দারুণ ইন্টারেস্টিং। অনেকেই অবশ্য এরকম অভিযোগ করেছেন, যে গ্রামে অনায়াসেই মোবাইল-ইন্টারনেটে বাতচিৎ করা যায়, এমনকি স্কাইপে কথাও বলা যায় সেরকম গ্রামে টেলিভিশন দেখার সুযোগ নাই- কাহিনীর এমন প্রস্তাব বাস্তবসম্মত কিনা? কাহিনী বাস্তরসম্মত কিনা সেই প্রশ্ন আমি করি না। এরকম প্রশ্ন সত্যিই অবান্তর। কারণ, নির্জলা বাস্তব বলেই কোনো চিজ জগতে নাই। বাস্তব সবসময়ই মিডিয়েটেড। তাই, কাহিনী হবার জন্য, সেই কাহিনী শিল্পসম্মত হবার জন্য তাকে কোনো এক বাস্তবের অনুগত হতে হবে এরকম জবরদস্তি বা দায় নাই। বরং একটা আপাত বিচ্ছিন্ন গ্রামে ইমেজ বিরুদ্ধতার ধর্মীয় সংস্কার এবং তা অবসানের অবলম্বন হিসেবে টেলিভিশন মিডিয়ার অধিষ্ঠানের বিষয়টিকে কেন্দ্রীয় করে তোলার মাধ্যমে সিনেমা জুড়ে কোন বাস্তব নির্মিত হচ্ছে তাই আমার বিবেচনায় মূখ্য মনোযোগের বিষয় হওয়া দরকার। বানিয়ে তোলা বাস্তবকেই বিচারে নেয়া দরকার।
সিনেমাটি পাঠ করতে হবে আমিন চেয়ারম্যানের নিশানা বরাবর। আইকোনোক্লাস্টার হিসেবে মুসলমানের কুখ্যাতি অতি-প্রাচীন। সেই অবস্থান থেকেই আমিন চেয়ারম্যানের ইমেজ-বিরুদ্ধতাকে, যা টেলিভিশন বিরুদ্ধতা এবং অবশেষে টেলিভিশনের বিজয়ের গল্প হিসেবে দানা বাঁধে, পাঠ করতে হবে।
মিঠানুপুর গ্রামে তার একচ্ছত্র আধিপত্য। তবে এ আধিপত্য কায়েম করতে বলপ্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। তার আধিপত্যের ভিত্তি গ্রাম সংলগ্নতা এবং ধর্মনৈতিক জীবনবোধ। ছবি তোলা থেকে শুরু করে সকল রকমের ইমেজ নির্মাণেরই বিরুদ্ধে তিনি। সে কারণে এই গ্রামে টেলিভিশনও নিষিদ্ধ। আর, ধর্মীয় নৈতিকতার যুক্তিতেই ‘ইয়াং পুলাপাইনদের’ মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেন না তারা নষ্ট হয়ে যাবে বলে, ‘হেজবুক’ নামের কী একখান বই পড়ে পড়ে শহরের ছেলেমেয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি তারও বিরুদ্ধে। কাহিনী একসময় মোড় নেয় যখন হিন্দু স্কুলমাস্টার কুমার বাবুর মারফতে গ্রামে আমদানি ঘটে টেলিভিশনের। কুমার বাবু আস্ত একটা টেলিভিশন বাইসাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে বাড়ির পথে হাঁটছেন। পথিমধ্যে দেখা হয়ে যায় চেয়ারম্যান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে। তার কথার অবাধ্য হয়ে কেউ গ্রামে টেলিভিশন এনেছে – এ যেন বিশ্বাসই হতে চায় না প্রবল প্রতাপশালী চেয়ারম্যানের। ক্যামেরার কারুকাজ চেয়ারম্যানের কর্তৃত্ব এবং হিন্দু হিসেবে কুমার বাবুর অধঃস্তনতা তুলে ধরে। “তুমি জানো না, আমগো গ্রামে প্রাণহীন প্রাণীর ছবি তোলা আর দেহা নিষেধ”। কুমারবাবুকাঁচুমাচু হয়ে জবাব দেন: “আমগো ধর্মে তো টেলিভিশন দেখলে গুনাহ হয় না। আঁই হিন্দু ন’নি।” এও যেন একখন্ড বাংলাদেশ। তবে, চেয়ারম্যান বলপ্রয়োগ করেন না কুমারবাবুর ওপর, সচরাচর যেমন দেখা যায় দাপুটে ধর্মীনৈতিক চরিত্রগুলোর বেলায়। চেয়ারম্যান বরং ধন্দে পড়ে যান, কেননা, ঠিকই তো, হিন্দু ধর্মে টেলিভিশন দেখায় কোনো নিষেধ নাই। কুমার বাবুর টেলিভিশন গ্রামে থাকবে কিনা সে ব্যাপারে ঠান্ডা মাথায় নির্জনে ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে তিনি মসজিদে চলে যান। ধ্যানমগ্ন বসে থাকেন। নিজের পূর্ব সিদ্ধান্ত নিয়েই অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট হয় তার মনে এবং ধর্ম নৈতিকতা সম্মত ন্যায্য সিদ্ধান্ত নিতে পারা এক ‘কঠিন পরীক্ষা’রূপে হাজির হয়। কারণ, তার নিজস্ব বিশ্বাসমতে, টেলিভিশন রাখতে দিলে তার ‘নিজের ধর্ম’ নষ্ট হয়ে যায়, আর যদি টেলিভিশন নদীতে ফেলে দেন তো বিধর্মীর অধিকার ক্ষুন্ন হয়। অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় গ্রামে টেলিভিশন থাকবে, তবে কোনো মুসলমান সেটা দেখতে পারবে না।
কিন্তু তা কি আর হয়! দুষ্টু পুলাপাইন ঠিকই খোলা জানালায় উঁকিঝুঁকি মেরে টেলিভিশন দেখতে শুরু করে দেয়। এমনকি কুমার বাবুর টিউশনির শিক্ষার্থী সংখ্যাও হুহু করে বাড়তে থাকে টেলিভিশন দেখবার বাসনায়। শুধু কি তাই, আমিন চেয়ারম্যানের ছেলে সোলাইমানের প্রেমিকা কোহিনূরও দেখনেওয়ালাদের দলে সামিল হয়ে পড়ে। এসব কথা কানে গেলে আমিন চেয়ারম্যান দলবল নিয়ে হাজির হন কুমার বাবুর ডেঁরায়। প্রমাণিত হয় মুসলমানেরাও দেখছে। চেয়ারম্যানের ন্যায়বোধ প্রখর। ৮ হাজার টাকার টেলিভিশনের জন্য ৯ হাজার টাকা কুমার বাবুকে পরিশোধ করে সে টেলিভিশন নদীতে ফেলে দেয়ার নির্দেশ জারি করলেন তিনি। কিন্তু স্বাভাব নষ্ট ইয়াং পুলাপাইন এবার গঞ্জে গিয়ে টেলিভিশন দেখতে শুরু করলো। তাদের বিচার করা হলো, গঞ্জের পথে নজরদারির আয়োজন হলো। তবে, তাদের বিনোদন প্রদানে আমিন চেয়ারম্যান আন্তরিকও বটে। ‘হালাল’ টেলিভিশনেরও বন্দোবস্ত হলো: বিশাল মাঠের একপাশে বিপুলায়তন টেলিভিশন সেটের আদলে মঞ্চ প্রস্তুত হয়েছে। আর সেই টেলিভিশন-মঞ্চে আনারকলি যাত্রাপালা চলছে। আমিন চেয়ারম্যান এসে দেখলেন, এই গ্রামেরই ছত্তর সেজেছে সম্রাট আকবর। অর্থাৎ, তার বিচারে, ‘ছত্তর মিছা কথা কইতেছে’ এবং ‘ইসলাম তো মিছা কথা সমর্থন করে ন। হিয়াল্লায় আমরা নাটক নভেল সিনামা সমর্থন করি ন। …কোনো কল্পনা চইলত ন, কল্পনা বহুত খারাপ জিনিস। কল্পনায় মানুষ বহুত খারাপ খারাপ জায়গায় ছলি যাতি পারে।’ সেহেতু ‘হালাল’ টেলিভিশন আর হালাল রইল না, বিনোদনের আয়োজন বন্ধ হলো।
অন্যদিকে ‘বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা’ দেখা যাচ্ছিল, কারণ কোহিনূরের চোখের জল। কুমার বাবুর বাড়িতে টেলিভিশন দেখতে গিয়ে সে লজ্জাজনক শাস্তি পেয়েছে। তাই সোলায়মানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তাই শর্ত দিয়েছে যখন সোলাইমান টেলিভিশন কিনে এনে তার অপমানের জ্বালা মেটাবে তখনই সে সোলাইমানকে বিয়ে করবে, তার আগে নয়। ফলত, পিতার বিরুদ্ধে পুত্র সোলাইমানকে ক্ষুদ্র একটা বিদ্রোহেরও আয়োজন করতে হয় এই টেলিভিশন দেখার স্বাধীনতার জন্য। তবে পুত্রের এহেন অবাধ্যতারও আগে চেয়ারম্যানের বিশ্বাসেরজগতে ফাটল ধরেছে। তিনি মনস্থ করেছেন, হজ্জে যাবেন। কিন্তু তার জন্য দরকার পাসপোর্ট, আর পাসপোর্টের জন্য দরকার ছবি। কিন্তু তিনি তো যে কোনো ইমেজের বিরুদ্ধে। ফলে, হজ্জে যাওয়াটাই বানচাল হবার দশা। দুই দিন না-খেয়ে নির্বাক মগ্ন বসে থেকে অবশেষে তিনি কম্প্রোমাইজ করলেন, অবনত মস্তকে ছবি তুলতে গেলেন, পাসপোর্ট করতে দিলেন, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে: ‘ছবি তোলনের কথা কেউ জানি না জানে’। ভঙ্গুর মানসিক অবস্থায় তিনি যাত্রা করলেন হজ্জের উদ্দেশ্যে। সদরঘাটে নেমেই হাজারো পোস্টার বিলবোর্ড পুতুলের বিরুদ্ধ জগত পেরিয়ে আশ্রয় নিলেন এক হোটেলে। কিন্তু পরদিন বিমানবন্দরে গিয়ে দেখলেন হজ্জ এজেন্সি তার সাথে প্রতারণা করেছে। এই মুখ তিনি গ্রামের মানুষকে কীভাবে দেখাবেন! গ্রামের মানুষ হয়তো ভাববে তার হজ্জ আল্লাহ কবুল করে নাই। আশ্রয় নিলেন হোটেলের নির্জনতায়। আবার সেই যন্ত্রণাকাতর মগ্ন মৌনতা। দিন যায়, রাত যায়। যতোবার দরোজা ঠেলে একটু বাইরে বারান্দায় যান দেখতে পান সদ্যস্নাত এক নারী দুলে দুলে এলায়িত চুল ঝাড়ছেন রাস্তার উল্টোপাশের দালানে। কিন্তু শেষবার বারান্দায় গিয়ে শুনলেন ওই এলায়িত চুলের নারীর ঘর থেকেই ভেসে আসছে ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ ধ্বনি। যেন কেবল লিপ্সা নয়, টেলিভিশন ধর্মের কথাও কয়।নিজে কক্ষে ঢুকে তিনি প্রথমবারের মতো টেলিভিশনের মুখোমুখি হলেন। চূড়ান্ত অবসান ঘটলো ইমেজবিরুদ্ধতার। টেলিভিশন এবং ইমেজের মধ্যস্ততায় হজ্জের দৃশ্যে একাত্ম হয়ে দুহাত তুলে মোনাজাত করতে করতে অশ্রুধারায় তিনি আপন মনের কোনা থেকে পৌঁছে গেলেন আল্লাহর দরবারে: ‘ইয়া আল্লাহ, আমি ঢাকা থাহি বা মক্কায় থাহি বা যেহানেই থাহি, আমি তুমার কাছে পৌঁছায়া গেছি আল্লাহ।’
নিঃসন্দেহে টেলিভিশন ফারুকীর দুর্দান্ত একটা কাজ – সমাজের ভিতর থেকেই তিনি রূপান্তরকে দেখতে পেয়েছেন। আঞ্চলিক ভাষায় এরকম একটা ঠাসবুনোট গল্প বলে ফেলা, তাও আবার সিনেমা-মাধ্যমে, সহজ কম্ম নয়। তার আগের সিনেমাগুলো নয়, টেলিভিশন থেকেই বস্তুত আমার মুগ্ধতা শুরু হয়েছে। আমার মতো, আরও কেউ কেউ, যারা সবসময় অন্যের কাজে খুঁত ধরতে কুস্বভাব কুৎসাকারীর মতো খুঁতখুঁত করে ঘুরতে থাকেন তারাও নিশ্চয় মুগ্ধ হয়েছেন। অথচ,মুগ্ধতার যে কথাগুলো আমি বলতে পারতাম কিংবা বলতে চাইতাম তা দেখতে পাচ্ছি ‘ফারুকীর টেলিভিশন নিয়ে লেখা দরকার’ প্রবন্ধে অত্যন্ত মুন্সিয়ানায় ‘চাউর’ করে দিয়েছেন মোহাম্মদ আজম (২০১৪)!আজমের দুর্ধর্ষ লেখাটি পড়ে বারবার অবাক হয়ে ভাবতে থাকলাম, এইরকম ইনসাইটফুল ও নিবিড় পাঠই তো দরকার ছিল, এই কথাগুলোই তো বলা দরকার ছিল টেলিভিশন নিয়ে। অথচ, টেলিভিশন রিলিজ হবার প্রায় তিন বছর বাদেও এইসব কথা আজমের আগে কেউ বলেননি, হয়তো খেয়ালই করেননি টেলিভিশন ন্যারেটিভের সাথে আমাদের গত অন্তত ষাট বছরের চলচ্চিত্র, উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি কাহিনীগুলোর যুগপৎ বিচ্ছেদএবংএক নতুন উদ্বোধনের জায়গাটি। কিন্তু আজম ঠিকই ধরতে পেরেছেন যে ফারুকী এই সিনেমায় কঠিন ধরনের এক হুজুরের গল্প বলেছেন। ধর্ম-নৈতিকতার নিজস্ব বিশ্বাস-গন্ডীর বাইরে তিনি এক কদমও হাঁটেন না। চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি দাপুটে হুজুর বটে, ক্ষমতা প্রয়োগেও দ্বিধা করেন না। তবে এ হুজুরের নির্মাণ খলনায়কসূলভ নয় – গত কয়েক দশক ধরে যেমনটি প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে দেখা যায় শিল্প-সাহিত্যের সকল অঙ্গনে: “ধর্মকর্মে ‘সিরিয়াস’ আর মানুষ হিসেবে বদমাশ” হুজুরের সংখ্যা বেশুমার, যারা নামাজ-কালাম ধর্মকর্ম সবই করে, আবার অবলীলায় কোনোরকম নৈতিকতার চাপে না-থেকে খুনখারাবি, ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদিও করে চলে। সেহেতু আজম দাবি করেছেন, বাংলাদেশের সিনেমা বা সাহিত্যে কিংবা অন্য কোনো ফর্মে ধর্মীয় মূল্যবোধে পরিচালিত মানুষজনের ওই মূল্যবোধজাত দ্বিধাদ্বন্দ্বটা দেখানোর দায়িত্ব নেয়া হয় না; এবং এ ধরনের ধর্মীয় নৈতিকতাসম্পন্ন ‘ভালো’ মানুষ আমাদের কল্পনা/সৃজনশীল-সাহিত্যে বিরল। সুতরাং, ফারুকীর কৃতিত্ব এখানেই যে তিনি আমিন চেয়ারম্যানের মতো একটা ‘বিরল’ চরিত্র তৈরি করতে পেরেছেন। আজমের এই দাবিকে আমি কেবল কিঞ্চিত সীমায়িত করবো এই বলে যে, আমাদের ‘কল্পনা/সৃজনশীল সাহিত্যে’ এবং ঢাকায় সিনেমায় এধরনের ধর্মীয় নৈতিকতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় চরিত্র বিরল বটে, কিন্তু খলনায়কদের বিপরীতে ধর্মীয় শুভবোধসম্পন্ন জনপ্রিয় পার্শ্বচরিত্র একেবারেই বিরল নয়, তাদের দেখা হামেশাই পাওয়া যায়। সে যা হোক,আমিন চেয়ারম্যানের মতো শক্তিশালী চরিত্র নির্মাণের কৃতিত্ব ফারুকীর যথার্থই প্রাপ্য। আজমের এই দাবিও আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে যে, ‘বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক-বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে ধর্মকে একটি ইহলৌকিক বাস্তবতা হিসেবে দেখার রেওয়াজ গড়ে ওঠেনি। ধর্ম ভালো না খারাপ, প্রগতিশীল না প্রতিক্রিয়াশীল তার বিচার এখানে অবান্তর। বাস্তবতা হল, মানুষ ধর্ম পালন করে এবং তার প্রাত্যহিক বাস্তবতার সকল স্তরে – ব্যক্তিগত থেকে ক্ষমতা-সম্পর্ক পর্যন্ত -ধর্মের অব্যাহত প্রতাপ। এ এক ইহজাগতিক বাস্তবতা। অথচ ব্যাপারটিকে যুতসইভাবে সম্বোধন কারার ভাষা গড়ে ওঠেনি।’ সুতরাং ফারুকীর কৃতিত্ব এখানেও যে, ধর্মকে কেবলই প্রাইভেট পরিসরের, কিতাববদ্ধ কিংবা পারলৌকিক ব্যাপার-স্যাপার হিসেবে না দেখে বরং ইহজাগতিক চর্চা হিসেবে দেখতে পেরেছেন।
[৪]
প্রস্থান
সিনেমাটি বারবার দেখা এবং যুগপৎ আজমের প্রবন্ধটি পড়ার মুগ্ধতা একটু কাটিয়ে আবার ভাবি, প্রশ্ন নিয়ে নাড়াচারা করি: তারপরে কী? আজম গল্পের যে পাঠ উদ্ধার করেছেন তার মানে কি? কেন মুসলমান সমাজের আমিন চেয়ারম্যানের মতো চরিত্রের গল্প বলতে হলো, বিশেষত ‘নাইন-ইলেভেন’ পরবর্তী এই বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে? আর কেনই বা সেজন্য একটা আপাত বিচ্ছিন্ন গ্রাম, সেখানে টেলিভিশন নামের মিডিয়ার স্বরাট প্রতিষ্ঠা এবং ধর্মনৈতিক সংস্কারের বিপরীতে ইমেজ ও ইমাজিনেশান বা কল্পনার বিজয়গাথা রচিত হলো? কল্পনার রাজনীতি কি? কল্পনা কি নিরীহ নিপাট বস্তু নাকি যাপিত বাস্তবের মতোই এক যুদ্ধের ময়দান? টেলিভিশন মিডিয়ায়যে কল্পনার উন্মোচন ঘটে তারই বা স্বরূপ কী? উপরন্তু, যখন গ্রামগঞ্জের ঘরে ঘরে টেলিভিশন, মোবাইল ফোন এমনকি ইন্টারনেটে চ্যাট করবার সুযোগ দোড়গোড়ায় হাজির আছে, এবং ছবি তোলা কিংবা টেলিভিশন না-দেখা কট্টর মোল্লা খুঁজে পাওয়া নিতান্তই এক পন্ডশ্রম গণ্য হবে তখন এক কল্পিত গ্রামে টেলিভিশন দেখা নিয়ে এক কল্পিত দ্বন্দ্বের কল্পিত কাহিনী কি মানে নিয়ে হাজির হয়? ধর্মকে ইহজাতিক চর্চা হিসেবে দেখবার এ গল্প তাহলে কোন কোন গল্পের সাথে যুক্ত হয়ে (ইন্টারটেক্সুয়ালিটি) অর্থময় হয়ে ওঠে?
আজম ঠিকই লক্ষ্য করেছেন যে পরিচালক টেলিভিশনকে নানাভাবে কাহিনীর কেন্দ্রীয় করে তুলেছেন। আর, গল্পটি বলার জন্য একটা স্বতন্ত্র পরিসর নির্মাণ করেছেন – মিঠানুপুর গ্রামটিকে কার্যকরভাবে আলাদা করে নিয়েছেন, অন্তত প্রাকৃতিকভাবে তো বটেই। তিনি এও লক্ষ্য করেছেন যে পুরো সিনেমায় নানা উসিলায় কল্পনার লাগামহীন ঘোড়া ছুটাবার বন্দোবস্ত রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন এই তিনটি উপাদানের – বিচ্ছিন্ন/অটনমাস গ্রাম, টেলিভিশন এবং কল্পনা – এতো সমারোহপূর্ণ আয়োজন তা বুঝতে আমাদের সেহেতু দ্বিতীয় স্তরের সিগনিফিকেশান নিয়ে ভাবতে হবে। আজম তার কাজ সম্পন্ন করেছেন প্রথম স্তরের সিগনিফিকেশান বিচার করে, এবং সেটা করেছেন দুর্দান্ত মুন্সিয়ানায়। আমার যৎসামান্য আলোচনা এখান থেকেই শুরু – আজমের কাজ অনুসরণ করে এবং অতিক্রম করে। কারণ, দ্বিতীয় স্তরের সিগনিফিকেশানের সম্ভাবনাগুলো বিচারের কাজ শুরু হয় বস্তুত প্রথম স্তরের সিগনিফিকেশানের ওপরে দাঁড়িয়ে – রোঁলা বার্থ সেরকমটাই বলতেন (দেখুন ‘মিথ টুডে’ প্রবন্ধটি ১৯৭২: ১০৭-১৪৭)। তিনি অর্থবোধকতা বা সিগনিফিকেশানের এই স্তরকে বলেছেন ‘মিথের স্তর’। আধুনিক জাতি-কল্পনা ও জাতীয়তাবাদ তো মিথেরই কায়কারবার বটে, এবং টেলিভিশন জাতীয়তাবাদী মিথ নির্মাণের উৎকৃষ্ট মাধ্যমও বটে!
আর, এইসব এন্তেজাম দেখেশুনে এটুকু বোঝা যায় যে সেকুলার ন্যাশনালিস্ট বয়ানের, যেখানে পাবলিক পরিসরে ধর্মের ভূমিকা নিতান্তই নৈতিককতা শিক্ষার, ‘বিকল্প’ দেশ-কল্পনা নিয়ে দাঁড়িয়েছেন ফারুকী। বাস্তবের সকল বিধি লঙ্ঘন করে অন্যতর এক বাস্তব নির্মাণের প্রচেষ্ঠা বা কল্পনাকে যথার্থ অর্থেই জাতীয়তাবাদী প্রকল্প হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কেমন সেই ‘জাতীয়’ কল্পনা? আমরা এবার তার সুলুক সন্ধানে যাবো- ‘সম্প্রদায়’ ‘টেলিভিশন’ ও ‘কল্পনা’র কায়কারবার নিয়ে নিবিষ্ট হতে পারলে এবং এই বর্তমানে প্রত্যয় তিনটি নির্দেশিত ধারণা ও চর্চার ডিসকার্সিভ পরিসর বুঝে পারলে সেই কল্পনার বিচার সম্ভব বলে মনে হয়।
[৫]
টেলিভিশন মাধ্যম এবং কল্পনার কাজ
ফারুকী টেলিভিশন সিনেমায় যে গ্রাম (মিঠানুপুর) এবং কাহিনী রচনা করেছেন তার অটনমি (সর্বভৌমত্ব) কেবল আমিন চেয়ারম্যানের একচ্ছত্র ধর্মনৈতিক দাপটেই নির্দেশিত হয় না; প্রাকৃতিক বিচ্ছিন্নতা সূত্রেও গ্রামটির অটনমি নির্দেশিত – ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে দীর্ঘ নদী পারাপারের সূত্রেই কেবল গ্রামটি মূল ভূখন্ডের সাথে লেনাদেনায় লিপ্ত থাকে। নদীর সাথে গ্রামটির সম্পর্ক ওতপ্রোত। সিনেমার একেবারে শুরুতেই সাক্ষাৎকারপর্বে চেয়ারম্যানের ধর্মনৈতিক সংস্কার ও দাপুটে কর্তৃত্বপনা এবং সাক্ষাৎকারী নারী সাংবাদিকের নদী পারাপারের লম্বা দৃশ্যটির মাধ্যমে পরিচালক দর্শকমনে গ্রামটির অটনমি’র অনুভূতি সঞ্চারের সুযোগ হাতছাড়া করেন না। আর ওই সাংবাদিকও তখনই মিঠানুপুরকে একটা ‘আজব গ্রাম- পানিতে ঘেরা এক বিচ্ছিন্ন দেশ’ iii হিসেবে আমাদের চিনিয়ে দেন এবং আমিন চেয়ারম্যানের একগুঁয়েমির খেসারত হিসেবে ‘আধুনিকতার ছোঁয়াবঞ্চিত’ ‘বিচ্ছিন্ন দেশ’টির মানুষগুলোর ‘মুক্তি’র পথ সন্ধান করেন। সেইসাথে, এও বলা দরকার, সাবলীল আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের সুবাদেও পরিচালক এই অটনমি স্পষ্টভাবে নির্দেশের সুযোগ পান। ফলে, মিঠানুপুরকে অন্যান্য আর দশটা গ্রামের চেয়ে স্বতন্ত্র একটা বসতি হিসেবে পাঠের অবকাশ তৈরি হয়- যে স্বাতন্ত্র্য আবার গ্রামটিকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ‘দেশ’ হিসেবে কল্পনারও সম্ভাবনা হাজির করে। সাংবাদিকের প্রশ্নে আড়ালেও সেই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে: “… কোন আইনের বলে আপনি গ্রামে টেলিভিশন নিষিদ্ধ করেছেন। এখানে কি বাংলাদেশ সরকারের আইন চলে নাকি আপনার আইন চলে? আপনি কি বাংলাদেশের মধ্যে আরেকটি মিনি বাংলাদেশ বানিয়ে রাখতে চান?” অর্থাৎ, চাপে-তাপে ওই ‘মিনি বাংলাদেশ’ রূপান্তরিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে খাপ খাইয়ে নেবে, নাকি আমিন চেয়ারম্যানের ‘মিনি’ পরিসর বড় হতে হতে পুরো বাংলাদেশকেই পরিপ্লাবিত করবে নতুন সম্পর্কসূত্রে- তা একটা জিজ্ঞাসা আকারে হাজির থাকে তার প্রশ্নের ভিতরে। ‘মিনি বাংলাদেশের’ নমুনা আমরা পরেও দেখতে পাবো যখন নারকেলের বিনিময়ে টিভিতে সিনেমা দেখতে পুলাপাইন গঞ্জে যেতে শুরু করলো- তাদের কীভাবে আটকানো যায় তাই নিয়ে পরামর্শ সভা চলছে, নিকট সঙ্গী জব্বর পরামর্শ দিলেন, “চেয়ারম্যান সাব, গ্রামে ভিসা সিস্টেম চালু করেন” এবং সত্যিই দুষ্টু ছেলেদের টেলিভিশন দেখা নিয়ন্ত্রণ করতে ভিসা সিস্টেম চালু করাও হলো। ফলে শেষ পর্যন্ত দেশের কল্পনা আর বায়বীয় কিংবা অনুমাননির্ভর থাকে না টেলিভিশন সিনেমায়। বড় নদীর ওপারেই গঞ্জ, সেই গঞ্জে ইন্টারনেটে বাতচিৎ করা যায়, টেলিভিশনে হরদম হিন্দি নাচা-গানা চলে, ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বার্থে তা গ্রামটির সাথে সম্পর্কিতও থাকে। কুমার বাবু এ গ্রামে ‘এক ঘর পড়শি’ হিসেবে বাস করে – যেমন বাংলাদেশেও হিন্দুরা ভীষণ সংখ্যালঘু হিসেবে বাস করে। ‘নাদীমাতৃক বাংলা’র যে আদর্শায়ীত ইমেজ আমাদের শিক্ষিত মস্তিষ্কে ঘুরপাকা খায় তা বারবার নবায়িত হতে থাকে এই সিনেমা মারফতে। আমি বলবো, টেলিভিশন কাহিনীর উদ্দেশ্যমূলক স্বার্থেই সচেতনভাবে এরকম একটা আপাত বিচ্ছিন্ন ভূখন্ড ও জনসমষ্টি বাছাই করতে হয়েছে পরিচালককে।
এইরকম একটা কল্পিত সম্প্রদায়ের (ইমাজিনড কমিউনিটি) ভিতরে টেলিভিশন নামের একটি যন্ত্র কাহিনীর সূত্রপাত থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত প্রধান ঘটনাগুলোর ভিতরে যোজকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় এবং কাহিনিটি সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। টেলিভিশন যন্ত্র কাহিনীর প্রধান দ্বন্দ্বগুলোর কারণ, আবার দ্বন্দ্ব নিরসনেরও নিদান। যদিও পরিচালক স্মরণ করিয়ে দেন যে টেলিভিশন এই কাহিনীতে ‘উসিলা মাত্র’, কিন্তু সিনেমার নাম থেকে শুরু করে ঘটনার প্রবাহমানতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং সমাপ্তি পর্যন্ত একচোখা দৈত্য টেলিভিশন যন্ত্রটি এমনই এক উসিলা হয়ে ওঠে যা ছাড়া সিনেমার কাহিনীই দাঁড়াতে পারে না। কেন দাঁড়াতে পারে না তারকিছু নমুনা পেশ করা যাক।
টেলিভিশন গল্পের সূত্রপাতই ঘটে এক টেলিভিশন সাংবাদিকের সাথে আমিন চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। মাঝখানে পর্দা টানিয়ে সাক্ষাৎকারের আয়োজন করা হয়েছে, এবং পর্দার এপার থেকে সাক্ষাৎকারপ্রার্থীর প্রথম প্রশ্নটাই থাকে এইরকম: ‘আপনি আপনার গ্রামে কোনো ছবি এ্যলাউ করেন না, কাউকে টেলিভিশনও দেখতে দেন না। কেন? আপনি কি গ্রামের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার ক্ষুন্ন করছেন না? যেখানে সারা দেশের লোক টেলিভিশন দেখছে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আপনার গ্রামের লোকদেরকে আপনি অন্ধকারে আটকে রেখেছেন।” জ্ঞান-বিজ্ঞানের ‘আলো’র সাথে টেলিভিশনের এই সখ্যতা আমরা আবারও দেখতে পাবো পিতা-পুত্র দ্বৈরথে-যখন কুমার বাবুর টেলিভিশন নদীতে ফেলে দেয়া হয়েছে এবং টেলিভিশন দেখার দায়ে চৌকষ কোহিনুর চেয়ারম্যানের নির্দেশে কান ধরে উঠবস করতে বাধ্য হয়েছে। এ অপমানের জ্বালায় কোহিনুর সোলাইমানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে এবং শর্ত দিয়েছে, টেলিভিশন নিয়ে এলেই সোলাইমানকে সে বিয়ে করবে। প্রেমকাতর সোলাইমান বিদ্রোহ ঘনিয়ে তোলে। নিজেই কোহিনূরের সাথে বিয়ের দিন ধার্য্য করে এবং সেই দিন গ্রামে একটা টেলিভিশনও ঢুকবে বলে মাইকযোগে ঘোষণা করে। সেইসাথে, সোলাইমানএ বিদ্রোহের ইশতিহারও ঘোষণা করে: “বিদ্রোহ শুরু হয়া গেছে, এই বিদ্রোহ চইলবই চইলব – খালি একজনের কতায় এই গ্যারাম চইলত ন, করো চোখ রাঙানিতে এই গ্যারাম চইলত ন। এই গ্যারামের প্রত্যেকটা পোলা-মাইয়া, তারা শিক্ষিত হইব, তারা স্কুলে যাইব, তারা কলেজে যাইব, তারা ইনভার্সিটিত যাইব।” উপরন্তু, এ টেলিভিশন কেবল বিজ্ঞানের আলো নয়, ধর্মীয় জ্যোতির বিকিরণেও পারঙ্গম। শেষ দৃশ্যে আমরা দেখেছি, ইমেজবিরোধী আমিন পাটোয়ারী টেলিভিশন-ইমেজ মারফতেই আল্লাহর দিদার পেয়েছে বলে মনে করতে থাকেন। টেলিভিশন তাহলে বদ্ধ জীবন থেকে, কল্পনার বন্দিত্ব থেকে মুক্তিরও বাহন।
উপরন্তু, টেলিভিশন এখানে কেবল আধুনিক দৃশ্যশ্রাব্য যন্ত্রবিশেষ রূপে নয়, কল্পনা বা ইমাজিনেশানের প্রতিকল্প রূপেও হাজির হয়। “হোনো, তুমারে কিচ্চু করণ লাইগতন, তুমি শুধু ফোনডা না কাডি, ঘরের কুনায় কুনায় এমুন জাগায় রাখি দ্যাও, য্যান আমি তুমার হাঁটা, চলা-ফেরা, কথাবার্তা সব শব্দ শুনতি পাই। আঁর চোখ বন্ধ করলি তুমার ঘর-বাড়ি, সবকিছু আমার চোখের সামনে টেলিভিশনের মতো ভাসে – এইডা আমার খুব ভালা লাগে।” এই আলাপ শেষ হতেই প্রেমিকা ফোনসেট রেখে দেয় এক কর্ণারে। যে কল্পনার কাজ নিয়ে এতো আলাপ তুলেছি তা বুঝবার জন্য দৃশ্যটা দারুণ। লো এ্যংগেল ক্যামেরা পিছনের লাল রঙের মখমল কাপড়ে ঢাকা দেয়ালে মুখ বরাবর ফোকাস করা – কানে ফোন ধরে, চোখ বন্ধ করে বসে আছে প্রেমিক সোলাইমান। সেটা আবার মাছের আড়ৎ এবং পাশেই কয়েকজন বসে মাছ গণনা করছে। তবু,ফোন কানে চোখ বন্ধ করে সেই মাছ কেনাবেচার হট্টগোলের ভিতরেও গড়হাজির হয়ে যায় সোলাইমান। যেন সে অন্য কোথাও, যেন সে এ জগতে নাই- টেলিভিশন-রূপ কল্পনায় সে পৌঁছে গেছে প্রেমিকার ঘরে। আকুল প্রেমিকের [সোলাইমান] কল্পনা ‘মনের টেলিভিশনে’ দূর গৃহবাসী প্রেমিকার সপ্রাণ সঞ্চরণ উদ্ভাসিত করে তুলেছে।আবার ব্যর্থ প্রেমিকের [মজনু] কল্পনাযোগেই প্রেমপাত্রীর সাথে সন্তানাদিসহ ঘরসংসারের অচরিতার্থ বাসনা পূরণ হয়। মজনু চলে যেতে চায় গ্রাম ছেড়ে, তাই দেখা করতে আসে কোহিনূরের সাথে। তবে, কোহিনূর মুক্ত বা স্বাধীন হতে পারে না মজনু কাছে থেকে। মজনু সদ্যবিবাহিত কোহিনূরকে বলে “সারা জীবন আমার লগে সংসার করন লাইগব। আপনারে আমি সঙ্গে লই যাইয়ুম। ক্যামনে জানেননি? আঁর একটা মনের টেলিবিশন আছে, কল্পনার টেলিবিশন। ছোখ বন্ধ করলিই আপনারে আঁই হেই টেলিবিশনের মধ্যে দেহি। কেমনে ঠ্যাহাইবেন আপনে। আঁই আঁর টেলিভিশন লই ঢাহা চলি যাইয়ুম।” আবার টেলিভিশন যন্ত্রে হজ্জের দৃশ্য [আমিন চেয়ারম্যানের] ‘মনের কোনা থেকে আল্লাহর দরবারে’ পৌঁছে যাবার কল্পনাও বাস্তবায়ন করে। অর্থাৎ, সত্য-মিথ্যার কূটকাচালির বাইরে এসে কল্পনার বাহনে ‘কানামাছি মিথ্যা, কানামাছি সত্য, কানামাছি তুমি আমি যে যার মতো’ অভীষ্ট মঞ্জিলে পৌঁছে যাবার প্রস্তাব বারবার, এবং সমাপ্তিকালেও শেষবারের মতো, সিনেমাটিতে হাজির হয়েছে। অর্থাৎ,ইমেজ/টেলিভিশন ও কল্পনার মধ্যে একটা আবশ্যিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করেন ফারুকী, এবং এর বিপরীতে স্থাপন করেন আমিন চেয়রম্যানের ইমেজ ও কল্পনাবিরুদ্ধ ধর্মনৈতিক জীবনবিধানকে।
[youtube id=”faP56QH0hPQ”]
মিঠানুপুর গ্রামটির রূপকে এবং সে গ্রামের প্রতাপান্বিত আমিন চেয়ারম্যানের ব্যক্তিক রূপান্তরের ভিতর দিয়ে এমন এক দেশ-কল্পনা হাজির করা হয়েছে যেখানে ইমেজ বিরুদ্ধতার অবসান এবং ইমাজিনেশানের উদ্বোধন ঘটে। তার মানে এই নয় যে ইসলামেরও অবসান ঘটে। বরং টেলিভিশন ও ইমাজিনেশান এ ইসলামের সহায়ক শক্তি। এ ইসলাম ‘অপর’ বৈরী নয়, তবে ‘অপর’কেও মেনে চলতে হয় সম্প্রদায়ের নীতিনৈতিকতা। এরূপ ‘জাতীয়’ কল্পনাকে এক কথায় ‘ইসলামী আধুনিকতা’ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই ধারা একদিকে যেমন সমাজের কুসংস্কারের অবসান চায়, তেমনই ইসলামী নীতিনৈতিকতার সাথে পশ্চিমি আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটাতে চায়। উপনিবেশিক কালে মুসলমান-প্রধান দেশগুলোতে এর চর্চা শুরু এবং ১৯৭০’র দশক পর্যন্ত এই ধারার দাপুটে উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
[৬]
ইমেজ নির্ভর প্রদর্শনীর কাল
টেলিভিশন গল্পের পরিপ্রেক্ষিতকে আমরা এভাবেও বর্ণনা করতে পারি: সিনেমাটি যখন তৈরি হচ্ছে তখন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ডিসকোর্স পূর্ববর্তী এক যুগের চর্চায় আরও ধারালো ও রক্তক্ষয়ী হয়ে উঠেছে, যখন টেলিভিশনের প্রাইম-টাইম সংবাদ কাভারেজের হিসেব মাথায় রেখে কসোভোতে কিংবা ইরাকে কিংবা সিরিয়ায় মিত্রবাহিনী হামলা চালানো শিখে নিয়েছে, এমনকি বাংলাদেশেও প্রাইমটাইম টিভি নিউজের হিসেব কষে জাতীয় ঘটনা ঘটানো শুরু হয়েছে।
টেলিভিশন সিনেমার গল্পটি পাতা হয়েছে আদিযুগের টেলিভিশনের সময় না – যখন সারাদেশে উঁচু আকাশে এন্টেনা লাগিয়ে টেরিস্ট্রিয়াল বিটিভি সম্প্রচারের সিগন্যাল ধরতে হতো। সিনেমার গল্পটি স্যাটেলাইট ও কেব্যল টিভি যুগের। বলা ভালো, হাই ডেফিনিশান স্মার্ট টেলিভিশন যুগের, যে যুগকে তাত্ত্বিকরা ‘ভিস্যুয়াল টার্ন’ হিসেবে চিহ্নিত করেন- ইমেজের যুগ বা দেখনদারির যুগ। এ যুগে কেবল সাংস্কৃতিক পরিসর নয়, প্রদর্শনীর যুক্তি সমাজের অন্যান্য পরিসরেও ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে, সামাজিক রাজনৈতিক ইস্যুগুলো নির্ধারিত হচ্ছে মিডিয়া সংস্কৃতি মারফতে, কোনটা বাস্তব আর কোনটা জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ তাও শিখিয়ে দিচ্ছে এই সংস্কৃতি। এ এমন এক সময়ের টেলিভিশন যখন নতুন ধরনের সাবজেক্টিভিটি তৈরিতে ডিজিটাল ফরম্যাটের মিডিয়া কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে।
ইমেজ নির্মাণের প্রয়োজন অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু টেলিভিশন ইমেজ ও ইমাজিনেশান বা কল্পনার ভিতরে নির্ভেজাল সরলরৈখিক সম্পর্ক টানা বেশ বিপজ্জনক। ইমেজ-বিরুদ্ধতাকে কেবলই ধর্মীয় সংস্কার হিসেবেও বিচার করা যায় না। ইমেজ ধর্মকেও প্রদর্শনীর বিষয় হিসেবে হাজির করে। অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের তুলনায় চোখ সর্বত্র প্রধান্য পেতে থাকে। আর তা (জাতীয়) কল্পনাকেও বিশেষ প্রকারে আকৃতি প্রদান করে। ইমেজ যেমন দেখায়, তেমন লুকায়ও। বলা যায়, যতোখানি দেখায় তারচেয়েও বেশি লুকায়। তাহলে টেলিভিশন কোন ধরনের ইমাজিনেশানকে বা ‘জাতীয় কল্পনা’কে উসকায়? ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের কোন ভাষ্যকে টেলিভিশন আদরণীয় মনে করে? ফরাসী তাত্ত্বিক গাই ডিবোর্ড ‘সোসাইটি অব দ্য স্পেকটিক্যাল’ ধারণা গড়ে তোলেন ১৯৬০’র দশকে, যা সমাজ ও সংস্কৃতি সংক্রান্ত সাম্প্রতিককালের অসংখ্য তত্ত্বের প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে। তিনি বলেন, “যখন বাস্তব জগত সামান্য ইমেজে রূপান্তরিত হয়, তখন সামান্য ইমেজটি বাস্তব সত্তারূপ ধারণ করে এবং সম্মোহনী আচরণের প্রণোদনা দিতে থাকে।” (উদ্ধৃত, কেলনার ২০০৩: ২)। প্রদর্শনীর এই ধারণা নিবিড়ভাবে বিচ্ছিন্নতা ও নিষ্ক্রিয়তার ধারণার সাথে সম্পর্কিত। টেলিভিশন ও অন্যান্য মাধ্যমের ইমেজ গিলতে গিলতে আমরা সক্রিয় জীবন থেকেই বিচ্ছিন্ন হতে থাকি, বে-রাজনৈতিক হতে থাকি, এবং এমন এক জাতীয় সম্প্রদায়ের বাসিন্দা হতে থাকি যা পুঁজিবাদের চাষাবাদের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।
তথ্যসূত্র
ফ্রান্স ফানো। ১৯৬৭। ব্লাক স্কিন হোয়াইট মাস্ক। প্লুটো প্রেস।
দীপেশ চক্রবর্তী। ২০০০। প্রভিনশিয়ালাইজিং ইউরোপ: পোস্টকলোনিয়াল থট এন্ড হিস্টোরিক্যাল ডিফারেন্স। প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস।
ডগলাস কেলনার। ২০০৩। মিডিয়া স্পেটেক্যাল। রাউটলেজ।
মোহাম্মদ আজম। ২০১৪। “ফারুকীর টেলিভিশন নিয়ে লেখা দরকার”।
রোঁলা বার্থ। ১৯৭২। “মিথ টুডে”। মিথলজিস। কেপ, লন্ডন।
আ-আল মামুন
Latest posts by আ-আল মামুন (see all)
- ফারুকীর টেলিভিশন, দূর-দর্শনের মিডিয়া এবং ‘ইমাজিনড কমিউনিটি’ - নভেম্বর 3, 2016
- সিনেমা রেপ্রিজেন্টেশন: বোমা-জঙ্গি-মাদ্রাসা-ইসলাম এবং বাংলাদেশ - জুলাই 4, 2014
- তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (লাস্ট পার্ট) - মে 6, 2014