Main menu

তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (লাস্ট পার্ট)

This entry is part 5 of 5 in the series তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো

পার্ট ওয়ান।। পার্ট টু।। পার্ট থ্রি।। পার্ট ফোর।।

____________________

 

এল্ডার্স: আমি জানি না, তবে আপনি যেটা বললেন আমি সেটাকে আপনার নৃবৈজ্ঞানিক ধারণার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চেষ্টা করছিলাম। একটু আগেই আপনার নিজস্ব সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গে কথা বলতে আপনি অস্বীকার করেছেন, ঠিক কিনা? এর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা কী হতে পারে সেটা ভেবে আমি অবাক হচ্ছি?[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

ফুকো: [প্রতিবাদ করে] ঠিক আছে, আপনি এ-নিয়ে অবাক হতে পারেন কিন্তু আমি নাচার।

এল্ডার্স: আচ্ছা, আচ্ছা।

ফুকো: আমি কিন্তু অবাক হচ্ছি না।

এল্ডার্স: কিন্তু উপলব্ধি, জ্ঞান ও বিজ্ঞান সম্পর্কে আপনার ধারণার পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করার আসল কারণ কী? কোনো বিশেষ সমস্যার উত্তর দিতে হলে, ব্যক্তিগত প্রশ্নকে কোন্ যুক্তিতে আপনি অ-বিশেষ সমস্যা হিসেবে পাঠ করেন?

ফুকো: না, আমি ব্যক্তিগত বিশেষ প্রশ্নকে সমস্যা হিসেবে পাঠ করি না। ব্যক্তিগত প্রশ্নকে আমি সমস্যার অনুপস্থিতি হিসেবে বিবেচনা করি।

খুব সরল একটা উদাহরণ দিচ্ছি, তবে সেটা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করবো না: অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে, পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও পাশ্চাত্য জ্ঞানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো, মানুষের শবদেহ উন্মুক্ত করে যে-রোগে তাদের মৃত্যু হয়েছিল তার কারণ, উৎপত্তিস্থল ও শরীরবৃত্তীয় গতিবিধি সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা কীভাবে চিকিৎসকদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল?

এর ব্যাখ্যা আপাতদৃষ্টিতে খুবই সহজ। শবদেহ ব্যবচ্ছেদ করে রোগের কারণ অনুসন্ধানের ধারণাটি পাওয়ার জন্য পূর্ব-প্রস্ত্ততিস্বরূপ পাশ্চাত্য চিকিৎসাশাস্ত্রের চার থেকে পাঁচ হাজার বছরের বিকাশ দরকার হয়েছিল।

আপনি যদি বিশঁ’র ব্যক্তিত্ব বিশ্লেষণের মাধ্যমে একে ব্যাখ্যা করতে চান, আমি মনে করি, কোনো ফায়দা হবে না। কিন্তু উল্টোভাবে, আপনি যদি রোগ ও মৃত্যুকে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকের সমাজব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে চেষ্টা করেন এবং যদি দেখতে চেষ্টা করেন শিল্পায়িত সমাজ নিজের বিস্তার ও বিকাশ ঘটানোর উদ্দেশ্য পূরণে জনসংখ্যা চতুর্গুণ বাড়িয়ে তোলার মাধ্যমে মূলত কী স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিল, যার ফলস্বরূপ সমাজে স্বাস্থ্য-জরিপ করা হয়, বড় বড় হাসপাতাল গড়ে ওঠে ইত্যাদি; আপনি যদি অনুসন্ধান করতে চেষ্টা করেন এই সময়টাতে এসে চিকিৎসা-জ্ঞান কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়, কীভাবে এর সাথে অন্যান্য জ্ঞানকান্ড সমূহের সমন্বয় করা হয় তাহলেই কেবল আপনি রোগ, চিকিৎসাধীন, অসুস্থ ব্যক্তি, শবদেহ ও শব-ব্যবচ্ছেদবিদ্যার মধ্যে গড়ে-ওঠা বিশেষ সম্পর্কটি বুঝতে পারবেন।

আমার বিশ্বাস, এটা এমন একধরনের বিশ্লেষণপদ্ধতি যাকে আমি একেবারে নতুন বলবো না, তবে যেভাবেই হোক এ-যাবত খুবই উপেক্ষিত থেকেছে; এবং ব্যক্তিগত ঘটনাবলী এ-ক্ষেত্রে প্রায় পুরোপুরিই অর্থহীন। 

এল্ডার্স: হ্যাঁ; তবু এটা খারিজ করার পক্ষে আপনার যুক্তিগুলো আরেকটু বিস্তারিত শুনতে পেলে আমাদের কৌতুহল মিটতে পারতো।

জনাব চমস্কি, আপনি কি – আমার দিক থেকে বিতর্কের দর্শন-অংশের এটাই সর্বশেষ প্রশ্ন – যেমন ধরেন, আজকের সমাজবিজ্ঞান যেভাবে-যেপথে চলছে সে-সম্পর্কে আপনার চিন্তাভাবনা আমাদের জানাবেন? মূলত আচরণবাদের প্রতি আপনার তীব্র সমালোচনার কথা বিবেচনায় রেখেই আমি প্রশ্নটা করেছি। এবং আপনি হয়তোবা এর মাধ্যমে একটু ব্যাখ্যাও দিতে পারবেন কেন জনাব ফুকো এই মুহূর্তে কিছুটা আচরণবাদী কায়দায় বাহাস করছেন। [উভয় দার্শনিক হেসে উঠলেন]

চমস্কি: আপনার নির্দেশ পালনের পূর্বে আমি মুহূর্তের জন্য সরে গিয়ে জনাব ফুকোর এইমাত্র বলা কথাগুলো প্রসঙ্গে একটু বলতে চাই।

আমার মনে হয় তার কথাগুলো, শুরুতে আপনার দেয়া তুলনার মতো, খুব চমৎকারভাবে তুলে ধরতে পেরেছে আমরা কীভাবে পরস্পরের উল্টোদিক থেকে একই পাহাড় খুঁড়ে চলেছি। আমি মনে করি বৈজ্ঞানিক সৃজনের কোনো ঘটনা দুইটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে: প্রথমত, মনের অন্তর্গত কিছু বৈশিষ্ট্য এবং দ্বিতীয়ত, কিছু সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিস্থিতির উপস্থিতি। এর মধ্যে কোন্টাকে আমরা অনুসন্ধান করবো সে প্রশ্ন অবান্তর; বরং আমরা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে, এবং এরূপ অন্যান্য আবিষ্কারকে কেবল তখনই বুঝতে পারবো যদি জানতে পারি এই কারণগুলো কী এবং ব্যাখ্যাও করতে পারবো এই কারণগুলো কীভাবে পরস্পরের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে।

আমার বিশেষ আগ্রহ, অন্তঃত এই ক্ষেত্রে, মনের অভ্যন্তরীণ সক্ষমতাগুলো অনুসন্ধান; আর আপনার [ফুকো] ভাষ্য মোতাবেক আপনার আগ্রহ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য শর্তগুলোর বিশিষ্ট বিন্যাসের ধরন অনুসন্ধান।

ফুকো: কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে বিরোধ আমাদের চরিত্রগত- কারণ এই মুহূর্তে সেটা স্বীকার করার অর্থ হবে জনাব এল্ডার্সকে সঠিক বলে মেনে নেওয়া, এবং অবশ্যই তাঁর সঠিক হওয়া সঙ্গত হবে না।

চমস্কি: না, আমি একমত, এবং…

ফুকো: এটা, আমরা যে জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরে কাজ করছি তার বর্তমান হালঅবস্থা ও জানাশোনার রকমফেরের সাথে সম্পর্কিত। যে-ভাষাতত্ত্বের সাথে আপনি পরিচিত এবং বদলে দিতে সক্ষম হয়েছেন, সেই ভাষাতত্ত্ব সৃজনশীল কর্তাসত্তাকে বা বাকসম্পন্ন কর্তাসত্তাকে উপেক্ষা করেছিল; অন্যদিকে আমার প্রজন্মের মানুষরা যখন অধ্যয়ন করতে শুরু করলো, বিজ্ঞানের ইতিহাস ব্যক্তিক সৃজনশীলতাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছিল…

চমস্কি: হ্যাঁ।

ফুকো: … এবং দলগত বিধানগুলোকে উপেক্ষা করেছিল।

চমস্কি: ঠিক, ঠিক।

প্রশ্নকারী: আচ্ছা …

এল্ডার্স: প্লিজ থামবেন না, প্রশ্নটা বলুন।

প্রশ্নকারী: প্রশ্নটা আপনাদের আলোচনার কিছুটা পিছনের দিকের একটা বিষয়ে, তবে জনাব চমস্কি, আমি যেটা জানতে আগ্রহী সেটা হলো: আপনি একটা মৌল ব্যবস্থার কথা ধরে নিচ্ছেন, আপনার কথা অনুযায়ী, যা মানবপ্রকৃতির মধ্যে একভাবে আদি সীমা-বিধিরূপে হাজির থাকে; কী মাত্রায় এগুলো ঐতিহাসিক পরিবর্তনের অধীন বলে আপনি মনে করেন? আপনি কি মনে করেন সেগুলো, যেমন ধরেন, সপ্তদশ শতক থেকে যথেষ্ট মাত্রায় বদলে গেছে? এইভাবে দেখলে হয়তো আপনি আপনার ধরণাগুলোকে জনাব ফুকোর তত্ত্বের সাথে মেলাতে পারবেন?

চমস্কি: বেশ, আমার মতে নিঃসন্দেহে বলা যায়, প্রাণীবিদ্যাগত ও নৃবৈজ্ঞানিক তথ্যমোতাবেক মানব-প্রজ্ঞা যথেষ্টমাত্রায় বদলায়নি অন্তঃত সতেরো শতকের পরে, কিংবা সম্ভবত ক্রো-ম্যাগনন i মানুষের পরে। অর্থাৎ আমার মনে হয়, আমাদের প্রজ্ঞার মৌলিক বৈশিষ্ট্যসমূহ, যা আজ রাতে আমাদের আলোচ্য বিষয়ভুক্ত, নিশ্চিতভাবেই অতি প্রাচীন। আপনি যদি পাঁচ হাজার কিংবা বিশ হাজার বছর পূর্ববর্তী কোনো একজন মানুষকে নিয়ে এসে শিশুরূপে আজকের সমাজে স্থাপন করেন তাহলে দেখবেন সকলে যাকিছু শিখেছে সে-ও সেগুলো শিখেছে, এবং সে একজন প্রতিভাবান কিংবা একজন নিরেট মূর্খ বা কিছু একটা হয়ে উঠবে, কিন্তু কোনোক্রমেই মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র কিছু হবে না।

তবে অবশ্যই অর্জিত জ্ঞানস্তরের বদল ঘটেছে, সামাজিক পরিস্থিতির বদল ঘটেছে- যে-পরিস্থিতিসমূহ একজন ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার সুযোগ করে দিয়েছে এবং বলা যায়, অন্ধবিশ্বাসের সংকীর্ণতা ভেঙে বেরিয়ে আসতেও সহায়তা করেছে। আর, এইসব পরিস্থিতি বদলের সাথে সাযুজ্য রেখেই মানবপ্রজ্ঞা নতুন নতুন প্রকারের সৃজনের দিকে ধাবিত হয়। আসলে, জনাব এল্ডার্স উত্থাপিত সর্বশেষ প্রশ্নটির সাথে বিষয়টি নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত, অন্তঃত এটুকু বলতে পারি।

আচরণবাদের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এইসব পরিপ্রেক্ষিত থেকে চিন্তা করে দেখেন। আমার মনে হয়েছে আচরণবাদের – যে-জ্ঞানকান্ডকে কখনো কখনো আচরণবিজ্ঞান নামক উদ্ভট প্রত্যয়ের দ্বারাও শনাক্ত করা হয় – মৌল স্বত্ত্বসমূহ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণ-সম্ভাবনাকে প্রত্যাখ্যান করে। অর্থাৎ, যে-সব আজগুবি ও আত্মবিধ্বংসী ধারণা দ্বারা আচরণবাদ সংজ্ঞায়িত হয় সেগুলো মোতাবেক আপনাকে কোনো আগ্রহোদ্দীপক তত্ত্ব গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হবে না।

যেমন ধরেন, পদার্থবিদ্যায় যদি ধারণা পোষণ করা হতো যে আপনি কেবলই প্রপঞ্চসমূহ ও তাদের বিন্যাস এবং এরূপ বিষয়াদি পর্যবেক্ষণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আজও আমরা ব্যবিলনীয় জ্যোতির্বিদ্যার যুগেই পড়ে থাকতাম। আমাদের সৌভাগ্য যে পদার্থবিদেরা কস্মিনকালেও এরূপ উদ্ভট অপ্রাসঙ্গিক ধারণার বশবর্তী হননি। আচরণবাদ গড়ে ওঠার ঐতিহাসিক কারণ আছে এবং যে-ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে আচরণবাদ বিকশিত হয়েছিল সে-সময়ের উদ্ভট ঘটনাবলীর সাথেও এর নিবিড় সম্পর্ক ছিল।

সম্পূর্ণ বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে বিচার করলে দেখা যাবে আচরণবাদ হলো এক অযৌক্তিক জুলুমবিশেষ, যার ধারণা মোতাবেক, কেউ মানব-আচরণ সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব গড়ে তুলতে পারবেন না; বরঞ্চ তাকে অবশ্যই প্রত্যক্ষভাবে প্রপঞ্চগুলো ও তাদের আন্তসম্পর্ক বিচার করতে হবে এবং অন্যান্য পরিসরে, সেইসাথে আমার অনুমান মানবপ্রজ্ঞা ও মানব আচরণের পরিসরে, যেগুলো আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব মনে হয় সেগুলো নিয়ে একটুও মাথা ঘামানো চলবে না। সুতরাং, এই দিক থেকে আমি আচরণবাদকে কোনো বিজ্ঞানই মনে করি না। একটু আগেই আপনি যে-বিষয়টা উল্লেখ করলেন এবং জনাব ফুকো যে-কথা আলোচনা করছিলেন সেক্ষেত্রেও এটা প্রাসঙ্গিক: দৃষ্টান্তস্বরূপ, যে-বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে পরীক্ষণ-মনস্তত্ত্ব গড়ে উঠেছিল সেইসময় বিশেষ কিছু উদ্দেশ্যে – কারণগুলো বিস্তারিত আলোচনায় যাব না – কোন্ ধরনের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণ অনুমোদন করা হবে সেবিষয়ে কিছু কৌতুহলোদ্দীপক, এবং হয়তো তাৎপর্যপূর্ণও, অদ্ভুত বিধিবিধান আরোপ করার দরকার হয়েছিল, সেইসব অদ্ভুত বিধিনিষেধই আজ আচরণবাদ নামে পরিচিত। তাই, আমার মনে হয় বহু আগেই আচরণবাদের যুগ শেষ হয়েছে। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে ওই বিধিগুলোর যে-গুরুত্বই থাকুক না কেন, আজকের দিনে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান-প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত ও সীমাবদ্ধ করা ছাড়া সেগুলোর আর কোনো কার্যকারিতা নেই; এবং সেহেতু নির্দ্বিধায় আচরণবাদ বর্জন করা উচিত, ঠিক যেমন পরিহার করা উচিত সেইসব পদার্থবিদকে যদি তারা বলেন: প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ সম্পর্কে একটি সাধারণ তত্ত্ব গড়ে তোলা অনুমোদনযোগ্য নয়, আপনি কেবলই গ্রহগুলোর গতিবিধি শনাক্ত করার এবং একটার পর একটা গ্রহের গতি-চক্র তৈরি করার সুযোগ পাবেন। আপনি নিশ্চয় এরূপ বিধান মানবেন না এবং পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবেন। অনুরূপ, আচরণবাদ সংজ্ঞায়িতকারী খুবই উদ্ভট বাধানিষেধগুলোও বর্জন করা উচিত, যে-বাধানিষেধগুলো, আমি আগেও বলেছি, খোদ আচরণবিজ্ঞান প্রত্যয়টির মধ্যেই জারি আছে।

আমরা হয়তো একমত হতে পারি যে, বিস্তৃত অর্থে আচরণ হলো মানববিজ্ঞানের গাঠনিক উপাত্ত-সমষ্টি। কিন্তু একটি বিজ্ঞানকে কেবলই তার উপাত্তের ভিত্তিতে সংজ্ঞায়িত করার অর্থ হবে পদার্থবিদ্যাকে পদার্থ পাঠের (matter reading) তত্ত্ব বলার সামিল। এবং কোনো পদার্থবিদ যদি বলেন: হ্যাঁ, আমি পদার্থ-পাঠ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করি, তাহলে আমরা নিশ্চিত করেই বলতে পারি, তিনি বেশি দূর এগুতে পারবেন না। এধরনের পদার্থবিদরা পদার্থ ও সেগুলোর আন্তম্পর্ক এবং এরূপ বিষয়াদি কেবল দেখতেই থাকবেন, কস্মিনকালেও প্রকৃতি সম্পর্কে কোনো তত্ত্ব গড়ে-তুলতে পারবেন না।

খোদ আচরণবাদ প্রত্যয়টিই ব্যাধির আলামতবাহী। আমাদেরকে সেই ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতটি বুঝতে হবে যখন এই আজগুবি বিধিনিষেধগুলো বিকশিত হয়েছিল, এবং আমার বিশ্বাস, পরিস্থিতিটি অনুধাবনের পরে আমরা সেগুলো বর্জন করবো এবং অনুসন্ধানের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো করে মানব-বিজ্ঞান গড়ে তোলার পথে অগ্রসর হব। অর্থাৎ, এটা করতে হবে সম্পূর্ণরূপে আচরণবাদ, এবং আমার মতে, আচরণবাদের উৎসভূমি অভিজ্ঞতাবাদী ধারাটিকেও পুরোপুরি বর্জনের মাধ্যমে।

প্রশ্নকারী: তাহলে দেখা যাচ্ছে আপনার সহজাত সীমা-বিধি বিষয়ক তত্ত্বটিকে জনাব ফুকোর ‘‘ঘের’’-ব্যবস্থা তত্ত্বের সাথে সংযুক্ত করতে আপনি আগ্রহী নন। এই দুই তত্ত্বের মধ্যে একটা সম্পর্ক হয়তো থাকতেও পারে। আপনি জানেন, জনাব ফুকো বলেছেন, নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্যমুখি সৃজনশীলতার একটি জোয়ার স্বতঃক্রিয়ভাবেই ‘‘ঘের’’-ব্যবস্থার মাধ্যমে অন্য লক্ষ্যমুখি জ্ঞানের প্রবাহগুলোকে অপসারিত করে। তাই, আপনার তত্ত্বে সীমা-বিধিকে যদি পরিবর্তনশীল বিবেচনা করতেন তাহলে একটা সংযোগ স্থাপিত হতে পারতো।

চমস্কি: বেশ, আমার মনে হয় তাঁর বর্ণিত ওই তত্ত্বের পরিসর আলাদা। আবারও আমি অতি-সরলীকরণের আশ্রয় নিচ্ছি। আমাদের কাছে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে ধারণাযোগ্য বিজ্ঞান সংখ্যায় অনেক আছে। পরিবর্তনশীল ঘটমান বিশ্বে যদি আমরা এই বিজ্ঞানসমূহের বৌদ্ধিক নির্মাণ পরখ করতে যাই তাহলে কোনো ক্রমবর্ধমান বিকাশ দেখতে পাব না। আমরা বরং দেখতে পাব বিচিত্র সব উল্লম্ফন: নির্দিষ্ট পরিধিভুক্ত কিছু প্রপঞ্চ পেলাম, বিশেষ কোনো বিজ্ঞান তার সাথে চমৎকারভাবে খাপ খেয়ে গেল; এখন, প্রপঞ্চগুলোর সীমানা যেইমাত্র সামান্য বড় করা হলো, আমরা অন্য একটি বিজ্ঞান পেয়ে গেলাম, যা-কিনা পূর্বটির চেয়ে বহুলাংশে আলাদা, নতুন এই প্রপঞ্চগুলোর ক্ষেত্রে অবশ্য চমৎকারভাবে প্রয়োগ করা যায়, কিন্তু হয়তো আগের কিছু প্রপঞ্চকে বর্জন করে- ঠিক আছে? এই হলো বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ধরন এবং এর ফলে বিশেষ কোনো কোনো প্রপঞ্চ-পরিসর চাপা পড়ে যায় বা বিস্মৃত হয়ে যায়। তবে আমার মনে হয়, এর কারণ মূলত মনের অন্তর্গত সেই সীমা-বিধির সমগ্রকগুলো, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেগুলো সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। কিন্তু এই সীমা-বিধিগুলোই মূলত সমগ্র আলাপ-আলোচনাকে অনেকটা তত্ত্বীয় রূপ দান করে, আমাদের জন্য বৌদ্ধিক কাঠামো, কিংবা বলতে পারেন প্রগাঢ়-বিজ্ঞান কী হবে তা নির্ধারণ করে দেয়।

 

[২]

 

এল্ডার্স: বেশ, আসুন এখন আমরা, আজকের বিতর্কের দ্বিতীয় অংশ, রাজনীতি নিয়ে কথা বলি। সর্বপ্রথমে আমি জনাব ফুকোর কাছে জানতে চাইবো কেন তিনি রাজনীতি নিয়ে এতোটা আগ্রহী, কেননা তিনি আমাকে বলেছেন দর্শনের তুলনায় বরঞ্চ রাজনীতিতেই তার আগ্রহ বেশি।

ফুকো: আমি কখনোই, কোনোভাবেই নিজেকে দর্শনের সাথে সম্পৃক্ত করিনি। তবে সেটা কোনো সমস্যা নয়। [হাসলেন]

আপনার প্রশ্নটা হলো: কেন আমি রাজনীতি নিয়ে এতো বেশি আগ্রহী? এই প্রশ্নের সোজাসাপ্টা উত্তর দিতে হলে বলবো: কেন আমি আগ্রহী হবো না? অর্থাৎ, কোন্ অন্ধতা, কোন্ বধিরতা, কোন্ জড়-ভাবাদর্শের চাপ আমাকে প্রতিরূদ্ধ করবে সেই বিষয়টাতে আগ্রহী হতে যা-কিনা আমাদের অস্তিত্বের জন্য সম্ভবত সবচেয়ে জরুরি একটা প্রসঙ্গ; অর্থাৎ অন্যভাবে যদি বলি, যে সমাজে আমরা বাস করছি, যে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে সমাজটি চলে, এবং যে ক্ষমতা-ব্যবস্থা আমাদের প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের প্রকৃতি, আমাদের কর্মকান্ডের অনুমোদিত হওয়া বা নিষিদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটি নির্ধারণ করে দেয় সেই বিষয়ে আমার আগ্রহী হওয়াকে প্রতিরুদ্ধ করবে? আমাদের জীবনের মর্মবস্তু গঠিত হয় মূলত সমাজের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার দ্বারা, যার অভ্যন্তরে আমরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করি।

সুতরাং, কেন আমি রাজনীতিতে আগ্রহী হবো এরূপ প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অপারগ; এর জবাব কেবল এইভাবেই দিতে পারি: কেন আমি আগ্রহী হবো না?[youtube id=”7TUD4gfvtDY”]

এল্ডার্স: তার মানে রাজনীতিতে আগ্রহী হতে আপনি বাধ্য, তাই নয়কি?

ফুকো: হ্যাঁ, অন্তত তাই; এখানে প্রশ্ন করার মতো কিংবা উত্তর দেবার মতো কোনো জটিলতা তো দেখি না। রাজনীতিতে আগ্রহী না-হওয়াটা বরং প্রশ্নযোগ্য একটা সমস্যা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুতরাং, আমাকে জিজ্ঞাসা করার বদলে আপনার উচিত এমন কাউকে প্রশ্ন করা যিনি রাজনীতিতে আগ্রহী নন। আর, তখন আপনার এই প্রশ্ন করাটা যথোপযুক্তও হবে এবং আপনার বলার অধিকারও জন্মাবে ‘‘মূর্খ কোথাকার! কেন আপনি আগ্রহী নন?’’ [তারা হেসে উঠলেন, সেইসাথে দর্শক-শ্রোতারাও]

এল্ডার্স: ঠিকই বলেছেন, হয়তো। জনাব চমস্কি, আপনার রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে আমরা সকলেই অত্যন্ত আগ্রহী, বিশেষত আপনার সর্বজনবিদিত রাষ্ট্রহীন-শ্রমতন্ত্র (anarcho-syndicalism) ii বা আপনার আখ্যানুরূপ, মুক্তিমুখি সমাজবাদ-এর (liberterian socialism) অবস্থান থেকে বলুন। আপনার মুক্তিমুখি-সমাজবাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যগুলো কী কী?

চমস্কি: আপনার ইতোপূর্বে জিজ্ঞাসিত অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক প্রশ্নটি নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছে আমাকে দমন করতে হচ্ছে এখন এই প্রশ্নটির জবাব দিতে গিয়ে।

পূর্ব-আলোচিত একটা প্রসঙ্গ ধরেই বলি, আমার বিশ্বাসমতো, সত্যিই যদি মানবপ্রকৃতির একটা মৌলিক বৈশিষ্ট্য হয় সৃজনশীল কাজ করা, সৃজনশীল অনুসন্ধান চালানো এবং কোনো দমনমূলক প্রতিষ্ঠানের অযৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ-প্রভাবমুক্তভাবে সৃজন তৎপরতা চালানো, তাহলে একটি শিষ্ট সমাজের কর্তব্য হওয়া উচিত এই মৌলিক মানব-স্বভাবটির বিকাশ-সম্ভাবনা ফলপ্রসু করতে সর্বতো চেষ্টা করা। এর অর্থ দাঁড়ায়, আমাদের সমাজের মতো অন্য সমাজগুলোতেও নিপীড়ন, নির্যাতন, ধ্বংস ও দমনমূলক যে উপাদানগুলো ঐতিহাসিক অবশেষরূপে এখনও টিকে আছে সেগুলো উৎপাটনের চেষ্টা করতে হবে।

যেকোনো প্রকারের দমন বা পীড়ন, আমাদের অস্তিত্বের যে-কোনো পরিসরের ওপর জবরদস্তিমূলক নিয়ন্ত্রণ, যেমন ধরেন সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা বা মানবজীবনের কিছু দিকের ওপর রাষ্ট্রীক নিয়ন্ত্রণ … মানবপ্রচেষ্টাগুলোর ওপর এরূপ যে-কোনো জবরদস্তিমূলক বিধিনিষেধ আদৌ যদি ন্যায্যতা পায়, তা কেবলমাত্র জীবনধারণের স্বার্থে কিংবা ভয়ঙ্কর কোনো হুমকি বা ঐরূপ কোনো পরিস্থিতি থেকে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই পেতে পারে। অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যের খাতিরে এরূপ বিধিনিষেধ ন্যায্যতা পেতে পারে না। বরং সেগুলো অবশ্যই সমূলে উৎপাটন ও অতিক্রম করা কর্তব্য।

এবং আমার মতে, অন্ততপক্ষে পাশ্চাত্যের প্রযুক্তিনির্ভর অগ্রসর সমাজগুলোতে আমরা নিঃসন্দেহে এমন অবস্থায় পৌঁছাতে পেরেছি যেখানে ক্লেশকর শ্রমের বহুলাংশ বর্জন করা সম্ভব এবং অতি সমান্য যে-শ্রমটুকু তারপরও প্রয়োজন হবে সেটা পুরো জনগোষ্ঠী ভাগাভাগি করে নিতে পারে। কিন্তু তবু এই সমাজগুলোতে, বিশেষত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর – যার দ্বারা আমি ব্যক্তি-মালিকানাভিত্তিক পুঁজিবাদ থেকে শুরু করে সমগ্রতাবাদী রাষ্ট্রতন্ত্র বা বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান রাষ্ট্রীক পুঁজিবাদের হরেক কিসিমের মিশ্র ধরনকে বুঝাচ্ছি – কেন্দ্রীয় স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ অতীতের ধ্বংসাত্মক অবশেষরূপে এখনও টিকে আছে।

শ্রমিক পরিষদ বা অন্য কোনোরূপ স্বেচ্ছানুবর্তী সংঘের মাধ্যমে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ সম্ভব করে তুলতে হলে এ-সকল দমনমূলক অবশেষসমূহ উৎখাত করতে হবে, বর্জন করতে হবে। আর, এরূপ সংঘ ব্যক্তিবর্গ নিজেরাই গড়ে তুলবে নিজেদের সামাজিক অস্তিত্ব রক্ষা ও উৎপাদনমুখি শ্রম ব্যবহারের প্রয়োজনে।

বিকেন্দ্রীভূত স্বেচ্ছানুবর্তী সংঘসমূহের এধরনের জোট-ব্যবস্থাকেই বস্তুত – যে ব্যবস্থার মধ্যে অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য সামাজিক প্রতিষ্ঠানও সামিল হবে – আমি রাষ্ট্রহীন-শ্রমতন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করি। আমার মনে হয়, প্রযুক্তিনির্ভর একটি অগ্রসর সমাজে এইটাই হতে পারে সামাজিক সংগঠনের যথাযথ ধরন, কারণ সেখানে মানব-সত্তাকে যন্ত্রপাতি বা নাটবল্টুর অবস্থানে ঠেলে দেওয়া একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। সেখানকার উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মানব-সত্তাকে যান্ত্রিক উপাদান হিসেবে গণ্য করার সামাজিক আবশ্যকতা ফুরিয়েছে; বরং এরূপ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব এবং আমাদেরকে অবশ্যই স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছানুবর্তী সংঘভিত্তিক একটি সমাজ নির্মাণের মাধ্যমে এটা অতিক্রম করতে হবে যেখানে মানুষের সৃজন-আকাঙ্ক্ষা, আমার বিবেচনায় যা মানবপ্রকৃতির একবারে মর্মবস্তু, সাকার করে তোলা সম্ভব হবে।

এবং সেইসাথে, জনাব ফুকোর মতো আমিও ভাবতেই পারি না যে কোনো মানুষের পক্ষে এই প্রশ্নে আগ্রহী না-হওয়া সম্ভব। [ফুকো হাসলেন]

এল্ডার্স: জনাব চমস্কির এই বক্তব্য শোনার পরে, জনাব ফুকো আপনি কি বিশ্বাস করেন আমাদের সমাজকে কোনোভাবে গণতান্ত্রিক বলা চলে?

ফুকো: না, আমার তরফ থেকে বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস নেই যে আমাদের সমাজকে কেউ গণতান্ত্রিক বলতে পারেন। [হাসলেন]

গণতন্ত্র বলতে কেউ যদি, শ্রেণীবিভক্ত নয় কিংবা ক্রমতান্ত্রিকভাবে শ্রেণীবিন্যস্ত নয় এমন একটি জনসমষ্টির দ্বারা, ফলপ্রসূ ক্ষমতার চর্চা বলে মনে করেন তবে সুস্পষ্টভাবেই আমরা গণতন্ত্র থেকে বহু দূরে অবস্থান করছি। সেইসাথে এটাও সুস্পষ্ট যে আমরা বাস করছি একটি শ্রেণী-একনায়কতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর অধীনে ও শ্রেণী-ক্ষমতার অধীনে, যে-শ্রেণীটি সহিংসতার মাধ্যমে নিজেকে চাপিয়ে দেয়, যদিও হতে পারে যে তাদের এই সহিংসতার হাতিয়ারগুলো প্রাতিষ্ঠানিক ও সংবিধানসম্মত। আর, এই সহিংসতার মাত্রা অনুসারেই আমাদের জন্য গণতন্ত্রের মাত্রাও নির্ধারিত হয়।

বেশ, একটু আগেই আপনি যখন প্রশ্ন করেছিলেন কেন আমি রাজনীতিতে আগ্রহী, আমি জবাব দিতে অস্বীকার করেছিলাম কেননা আমার মনে হয়েছে আগ্রহের কারণ পরিষ্কার বোধগম্য; কিন্তু আপনি হয়তো জানতে চেয়েছিলেন: রাজনীতিতে আমার আগ্রহ কী প্রকারের?

এবং আপনি আমাকে এরূপ প্রশ্ন করলে, একভাবে যদিও বলা যায় আপনি এরূপ প্রশ্ন করেছিলেন, আপনাকে বলতাম যে আমি খুব বেশি পথ অতিক্রম করতে পারিনি; জনাব চমস্কির তুলনায় আমি খুব অল্প দূর এগিয়েছি। অর্থাৎ, আমি কবুল করে নিচ্ছি যে আমাদের বিজ্ঞানভিত্তিক বা প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের উপযোগী একটা কাম্য সামাজিক রূপকল্প (মডেল) নির্ধারণ করতে কিংবা সেই মডেলের সুদৃঢ় যৌক্তিকতা তুলে ধরতে এখনও সক্ষম হইনি।

কিন্তু সবার আগে যে কাজটি আমার আশু কর্তব্য বলে মনে হয় তা হলো: রাজনৈতিক ক্ষমতা-সম্পর্কের পুরো পরিসরটি, এমনকি সেটা লুকিয়ে থাকলেও, চিহ্নিত করা ও উদ্ঘাটিত করা। এই ক্ষমতা-সম্পর্কই প্রকৃতপক্ষে সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং পীড়ন করে বা দ-দান করে।

অর্থাৎ আমি বলতে চাই: প্রথাগতভাবেই মনে করা হয়, অন্তত ইউরোপীয় সমাজে, ক্ষমতা সরকারের হাতে কেন্দ্রীভূত এবং এর চর্চা করা হয় নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক প্রতিষ্ঠান যেমন প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের অন্যান্য অঙ্গ-সংগঠনের মাধ্যমে। আমরা জানি, এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয় জাতি বা রাষ্ট্রের দোহায় দিয়ে বিশেষ কিছু সিদ্ধান্তের সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়ন এবং যারা এ-সব সিদ্ধান্ত অমান্য করে তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সেইসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চিত হয় আপাতদৃষ্টিতে যেগুলোর সাথে রাজনৈতিক ক্ষমতার কোনোই যোগসূত্র নেই বলে মনে হয়, মনে হয় যেনবা তারা রাজনৈতিক ক্ষমতা-নিরপেক্ষ, কিন্তু বাস্তবে তারা তা নয়।

পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানটি থেকেই বিষয়টা বুঝে নেওয়া সম্ভব। বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাধারণভাবে সকল শিক্ষাব্যবস্থা, আপাতদৃষ্টিতে যেগুলো শুধুই জ্ঞান বিস্তার করে বলে মনে হয়, মূলত গড়ে তোলা হয় একটি বিশেষ সামাজিক শ্রেণীকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য এবং অন্যান্য সামাজিক শ্রেণীকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার জন্য।

জ্ঞানবিদ্যা, উপলব্ধি ও সেবার উদ্দেশ্যে গড়ে-ওঠা প্রতিষ্ঠানসমূহও, যেমন চিকিৎসাবিদ্যা, রাজনৈতিক ক্ষমতার মদদ জোগায়। মনোচিকিৎসাবিদ্যার ক্ষেত্রেও অনিবার্যরূপে জারি-থাকা এই তৎপরতা কিছু কিছু ক্ষেত্রে তো কলঙ্কজনক মাত্রায়ও চর্চিত হয়।

আমার মনে হয় আমাদের সমাজের মতো সমাজগুলোতে প্রকৃত রাজনৈতিক কাজ হলো, আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা-নিরপেক্ষ ও -স্বাধীন প্রতীয়মান এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মতৎপরতার সমালোচনাত্মক মূল্যায়ন হাজির করা; এমনভাবে বিশ্লেষণ ও আক্রমণ চালাতে হবে যেন সদাসর্বদা তাদের মাধ্যমে দুর্বোধ্য কায়দায় পরিচালিত রাজনৈতিক সহিংসতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়, এবং মানুষ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার পথ খুঁজে পায়।

আমার কাছে এ-ধরনের সমালোচনাত্মক মূল্যায়ন ও আক্রমণ পরিচালনা অপরিহার্য মনে হওয়ার কারণ বহুবিধ: প্রথমত, আমরা যতোটুকু আন্দাজ করি তার চেয়েও অনেক গভীর পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার রাজত্ব; এর কেন্দ্র আছে, আবার অদৃশ্য ও স্বল্পজ্ঞাত বিচ্ছুরণ-পরিসর আছে; এর প্রকৃত শক্তভিত্তি ও প্রতিরোধক্ষমতা সম্ভবত সেই পরিসরগুলোতে কেন্দ্রীভূত যেগুলোকে আমাদের একটুও সন্দেহ হয় না। কেবল এইটুকু বলাই যথেষ্ট নয় যে সরকারের পেছনে, রাষ্ট্রযন্ত্রের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থার পেছনে আধিপত্যকারী শ্রেণী অবস্থান করে; বরং যেসব কর্মকান্ডের মাধ্যমে, যে পরিসরগুলোতে এবং যে-সব কায়দায় রাজনৈতিক ক্ষমতার আধিপত্য চর্চিত হয় সেগুলো অবশ্যই শনাক্ত করতে হবে। দ্বিতীয়ত, এই আধিপত্য রাজনৈতিক বোলচাল মোতাবেক কেবল অর্থনৈতিক শোষণরূপে হাজির হয় না, বরং আধিপত্য হলো শোষণের হাতিয়ার এবং অনেকাংশেই শোষণকে সম্ভব করে তোলার শর্ত। তৃতীয় কারণ, এই আধিপত্যকে মোকাবিলা করা সম্ভব এ-সম্পর্কে অনুপুঙ্ক্ষ উপলব্ধি গঠনের মাধ্যমে। আমরা যদি শ্রেণী-ক্ষমতার মদদদাতা পরিসরগুলো চিনে নিতে এখন ব্যর্থ হই তবে এর অস্তিত্ব টিকে থাকার ঝুঁকি থেকে যায় এবং হয়তো দেখা যাবে, একটা দৃশ্যমান বৈপস্নবিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার পরও শ্রেণী-ক্ষমতা পুনর্গঠিত হচ্ছে।

চমস্কি: হ্যাঁ, অবশ্যই আমি আপনার বক্তব্যের সাথে একমত, কেবল তত্ত্বগতভাবে নয় সেইসাথে সক্রিয় তৎপরতাও থাকতে হবে। তার মানে, দুইটা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ আছে: প্রথমটা হলো, একটু আগেই যেকথা বলছিলাম, ভবিষ্যৎ ন্যায্য সমাজের একটা রূপকল্প তৈরি করতে চেষ্টা করা। অর্থাৎ বলতে পারেন মানবমুখি সামাজিক তত্ত্ব গড়ে তুলতে হবে, যে-তত্ত্বটি যথাসম্ভব মানব-ভাব (essence) বা মানবপ্রকৃতির কিছু দৃঢ় ও সুকুমার ধারণার ওপর ভিত্তিশীল হবে। এইটা গেলো একটা কাজ।

অন্য কাজটি হলো, আমাদের সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতার প্রকৃতি এবং নিপীড়ন, সন্ত্রাস-আতঙ্ক ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতার স্বরূপ সম্পর্কে পরিষ্কার উপলব্ধি তৈরি করতে হবে। এর মধ্যে আপনার উল্লেখিত প্রতিষ্ঠানগুলো অবশ্যই অন্তর্ভুক্ত হবে; সেইসাথে আরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যেকোনো শিল্পভিত্তিক সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ যেমন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষত আগামী দিনগুলোতে, বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোকে। আজ রাতে ওইরূপ প্রতিষ্ঠানের অবস্থান আমাদের থেকে খুব বেশি দূরেও নয়। [ইন্ডহোভেন শহরে ফিলিপস কোম্পানির অফিস]

এইগুলোই হলো নিপীড়ন, নির্যাতন ও স্বৈরাচারী ক্ষমতা চর্চার প্রধানতম প্রতিষ্ঠান, এদের তৎপরতা একপ্রকার অনাবৃত থাকার পরও এরা নিরপেক্ষ বিবেচিত হয়: আমরা একধরনের মুক্তবাজার গণতন্ত্রের অধীনস্থ হয়ে পড়েছি এবং আমাদেরকে অবশ্যই স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিত থেকে এর স্বরূপ বুঝে নিতে হবে, সেইসাথে একটা অসম সমাজে বাজারের ওপর আধিপত্যের ফলে যে-বিশেষ ধরনের স্বৈরতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ কায়েম হয় সেটাও বুঝতে হবে।

আমাদেরকে অতি অবশ্যই এই বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে এবং কেবল অনুধাবন করলেই চলবে না তাদেরকে প্রতিরূদ্ধও করতে হবে। বস্ত্তত, ব্যক্তিক রাজনৈতিক তৎপরতার পরিসর বিবেচনায়, অর্থাৎ ব্যক্তি তার বেশিরভাগ উদ্যম ও প্রচেষ্টা যে-ক্ষেত্রে নিয়োজিত করে, আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো সেই পরিসরের আওতাতেই পড়বে। কেউ ব্যক্তিগতভাবে নেবেন না, এগুলো আমার তৎপরতার পরিসরভুক্ত এবং আমার আন্দাজ অন্য সকলেরও তাই।

এছাড়াও আমার মনে হয়, আমাদের জন্য খুবই লজ্জাজনক হবে যদি আমরা স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা, সৃজনশীলতা এবং অন্যান্য মৌলিক মানবস্বভাবের পূর্ণতা প্রদানের উপযুক্ত মানবপ্রকৃতি ধারণার সাথে এই মানব-বৈশিষ্ট্যগুলোর পূর্ণতা দান ও অর্থপূর্ণ মানবজীবন বিকাশে সক্ষম কোনো একটি কাম্য সামাজ-কাঠামোর ধারণা সম্পৃক্ত করার অধিকতর বিমূর্ত ও দার্শনিক কাজটিকে সম্পূর্ণরূপে পাশ কাটিয়ে যাই।

বস্ত্তত, আমরা যদি কোনো সামাজিক রূপান্তর বা সামাজিক বিপ্লবের কথা ভাবতে চাই তাহলে, আমরা যে-লক্ষ্যে পৌঁছাতে চাচ্ছি তার অনুপুঙ্ক্ষ রূপরেখা এখনই এঁকে ফেলার চিন্তা যদিও অনেকটা অদ্ভুত ঠেকবে, কিন্তু তবু আমাদের অন্তত কিছুটা জানা থাকা দরকার আমরা কোন্ দিকে যাচ্ছি, এ-ধরনের তত্ত্ব সেক্ষেত্রে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারবে।

ফুকো: ঠিকই, কিন্তু সেক্ষেত্রে কি বিপদের ঝুঁকি থেকে যায় না? আপনি বলছেন যে বিশেষ একধরনের শাশ্বত মানবপ্রকৃতি বিদ্যমান, যে-মানবপ্রকৃতিকে আবার কিনা বাস্তব সমাজে সেই সুযোগ ও সম্ভাবনাগুলো ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হয়নি যা একে পরিপূর্ণতা দিতে পারতো … আমার বিশ্বাস আপনি এই কথাগুলোই বলেছেন।

চমস্কি: হ্যাঁ।

ফুকো: আপনি যদি এটা কবুল করে নেন তাহলে কি আপনি এই মানবপ্রকৃতি ধারণাটিকে – যা একইসাথে আদর্শ ও বিশুদ্ধ, আবার আজ অবধি চাপা থেকেছে ও নিপীড়িত হয়েছে – আমাদের নিজেদের সমাজ, নিজেদের সভ্যতা ও নিজেদের সংস্কৃতি থেকে ধার করা প্রত্যয়ের সাহায্যেই সংজ্ঞায়িত করার ঝুঁকি নিচ্ছেন না?

অত্যন্ত সরলীকরণের মাধ্যমে আমি একটা উদাহরণ দেব। উনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের শুরু তে একটা বিশেষ সময়কালে সমাজতন্ত্র বস্ত্তত দাবি করে যে পুঁজিবাদী সমাজগুলোতে ব্যক্তি পরিপূর্ণমাত্রায় তার বিকাশ-সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং আত্মোপলব্ধি অর্জন করতে পারেনি; পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানবপ্রকৃতি মূলত বিচ্ছিন্নতায় (alienated) ভোগে। সমাজতন্ত্রে সেকারণে চূড়ান্তরূপে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি মানবপ্রকৃতির স্বপ্ন দেখা হতো।

এই মুক্ত মানবপ্রকৃতি ধারণার অবয়ব গঠন, উপস্থাপন ও অর্জনের জন্য কোন্ মডেল ব্যবহার করা হয়েছিল? সেটা ছিল কিন্তু ওই বুর্জোয়া মডেলই।

এই মডেলে অনুমান করা হয়, একটা বিচ্ছিন্নতা-আক্রান্ত সমাজ হলো সেই সমাজ যেখানে, যেমন ধরেন সর্বজনীন কল্যানের লক্ষ্যে বুর্জোয়া-ভাবাদর্শের যৌনতা, বুর্জোয়া-ভাবাদর্শের পরিবার ব্যবস্থা, বুর্জোয়া-ভাবাদর্শের নান্দনিকতাকে সর্বোচ্চ আসন দেয়া হয়। তদুপরি, এটাও কিন্তু খুবই সত্যি যে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং অন্যান্য লোকপ্রিয় (popular) গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল: উনিশ শতকের বুর্জোয়া সমাজ থেকে গ্রহণ করা ধারণার ভিত্তিতেই সোভিয়েত সমাজের একপ্রকার পুনর্বিন্যাস ঘটানো হয়েছিল। বুর্জোয়া মডেলের সর্বজনীনত্বই ছিল সেই ইউটোপিয়া, যা সোভিয়েত সমাজ গড়ে তুলতে প্রণোদনা জুগিয়েছিল।

এর ফল কী হয়েছিল তা আপনিও জানেন; তাই আমার মনে হয় মানবপ্রকৃতি কী প্রকারের সেটা যথাযথভাবে বলতে পারা সত্যিই অত্যন্ত দুরূহ।

আমরা ভুল করতে পারি এরকম ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে না? মাও সে তুঙ কিন্তু বুর্জোয়া-ভাবের মানবপ্রকৃতি ও সর্বহারা-ভাবের মানবপ্রকৃতির কথা বলতেন, এবং তিনি মনে করতেন এই দুইটা এক জিনিস নয়।

চমস্কি: দেখেন, আমার মনে হয় রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে অর্থাৎ মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে কিছু ধারণার ভিত্তিতে ন্যায্য ও মুক্ত সমাজের একটি কল্পমূর্তি (vision) গড়ে তোলার ক্ষেত্রটিতেও, জরুরি রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে গিয়ে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় ঠিক সেইরকমের সমস্যারই মুখোমুখি হতে হয়। অর্থাৎ, বর্তমান সমাজে সমস্যাগুলো এতোই প্রকট যে কিছু একটা করতে আমরা বাধ্য হই, যদিও আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে আমরা যা-কিছু করি না কেন সেটা সামাজিক বাস্তবতা সম্পর্কে, এক্ষেত্রে মানব বাস্তবতা সম্পর্কে, মূলত খুবই খন্ডিত উপলব্ধির ভিত্তিতে করি।

উদাহরণস্বরূপ সুনির্দিষ্ট করে বলছি, আমার নিজের তৎপরতার একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাথে জড়িত এবং আমার যথেষ্ট কর্মশক্তি ব্যয়িত হয়েছে অসহযোগ আন্দোলনে (civil disobedience)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল এর পরিণতি সম্পর্কে বিস্তর অনিশ্চয়তার মুখে। যেমন, সামাজিক শৃঙ্খলা-ব্যবস্থাকে এই আন্দোলন এমন গুরুতররূপে সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল যে যে-কেউ চাইলে যুক্তি দেখাতে পারতেন, ফ্যাসিবাদের জন্ম হওয়ার আশঙ্কা ছিল এবং সেটা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, হল্যান্ড এবং বস্ত্তত সকলের জন্যই সমূহ বিপদ ঘটতো। আর জানেনই তো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মস্ত একটা লেভিয়াথান iii ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠলে অসংখ্য সমস্যা তৈরী হতো। সুতরাং এই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপটি নেওয়ার সময় এরকম একটা বিপদের ঝুঁকি ছিল।

অপরদিকে, কোনো পদক্ষেপ না-নেওয়াটা ছিল আরও বেশি বিপজ্জনক। অর্থাৎ আপনি যদি কোনো পদক্ষেপ না নিতেন তাহলে মার্কিন দমন-অভিযানের চাপে ইন্দো-চীন অঞ্চল ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতো। এইরূপ অনিশ্চয়তার মুখোমুখি থেকে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হয়েছিল।

অনুরূপভাবে, বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরেও যে অনিশ্চয়তা জারি থাকে আপনি সেকথা যথার্থই পেশ করেছেন। মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত সীমিত- কিছুটা সামাজিক পরিস্থিতিগত কারণে, কিছুটা কারণ আমাদের নিজেদের বৈশিষ্ট্যগত খুঁত, আর কিছুটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংস্কৃতির কারণে। তা সত্ত্বেও, কোন্ অসম্ভব লক্ষ্যগুলো আমরা অর্জন করতে যাচ্ছি সে-সম্পর্কে ধারণা থাকা অত্যন্ত প্রয়োজন, যদি কিনা আমরা অন্তঃত কিছু সম্ভবপর লক্ষ্য হাসিল করতে চাই। এর অর্থ, আমাদেরকে আংশিক জ্ঞানের ভিত্তিতেই সামাজিক তত্ত্ব সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট সাহসী হতে হবে, কিন্তু একইসাথে ভুল করার প্রবল সম্ভাবনাও মুক্তমনে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য প্রস্ত্তত থাকতে হবে, কারণ অন্তত কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবেই আমরা প্রমিতমানের তুলনায় অনেক পিছনে পড়ে আছি।

এল্ডার্স: বেশ, কর্মকৌশলের প্রসঙ্গটি নিয়ে আর একটু গভীর পর্যন্ত পর্যালোচনা করা আমাদের জন্য বোধহয় লাভজনক হবে। আমার মনে হচ্ছে আপনি যেটাকে অসহযোগ বলেন সেইটাকেই আমরা এখানে সংসদ-অতিরিক্ত (extra-parliamentary) তৎপরতা আখ্যায়িত করি।

চমস্কি: আমার মনে হয় সংসদ-অতিরিক্ত তৎপরতা অনেক বেশি বিস্মৃত।

পার্লামেন্ট-অতিরিক্ত তৎপরতার মধ্যে রয়েছে যেমন ধরেন আইনসম্মত বিক্ষোভ সমাবেশ, কিন্তু অসহযোগ হলো সবরকমের পার্লামেন্ট-অতিরিক্ত তৎপরতার তুলনায় বরং সীমিত প্রকৃতির। আমার মতে এর মানে হলো, রাষ্ট্রযন্ত্র ভুলভাবে যে-কাজকে আইনসম্মত বলে দাবি করে প্রত্যক্ষভাবে সেটার বিরুদ্ধতা করাই অসহযোগ।

এল্ডার্স: তাহলে বলা যায়, যেমন ধরেন হল্যান্ডে আদমশুমারী করা হয়। সরকারি ফর্মে লিখিতভাবে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া প্রতিটি নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক। এখন, কেউ যদি এই ফর্ম পূরণ করতে অস্বীকার করে তাহলে আপনি সেটাকে অসহযোগ বলবেন?

চমস্কি: ঠিক তাই। তবে কোনো তৎপরতাকে অসহযোগ আখ্যায়িত করার বেলায় কিছুটা সতর্ক থাকতে চাই। একটু আগে জনাব ফুকোর উল্লেখিত দিকটি বিবেচনায় রাখা জরুরি। কারণ বৈধ্যতা নির্ধারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণ নাও দিয়ে থাকতে পারে। তবু কোন্টা বৈধ আর কোন্টা অবৈধ সে-সম্পর্কে নির্দিষ্ট কিছু ধারণা চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের আছে, তাই বলে ক্ষমতা মানেই ন্যায্যতা বা যথার্থতা বোঝায় না, সুতরাং রাষ্ট্রযন্ত্র হয়তো কোনো বিশেষ তৎপরতাকে অসহযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারে, এবং প্রকৃতপক্ষে ভুলভাবে এটা করতে পারে।

যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভিয়েতনামগামী একটি অস্ত্রবোঝায় ট্রেন লাইনচ্যুত করার ঘটনাকে রাষ্ট্রযন্ত্র অসহযোগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল; যদিও রাষ্ট্র প্রকৃতপক্ষে ভুলভাবে এটাকে অসহযোগ আখ্যায়িত করেছিল। কারণ এটা ছিল বৈধ, সঙ্গত একটা কাজ এবং জনগণের পক্ষ থেকে এটাই করা উচিত ছিল। রাষ্ট্রের অন্যায়-অপরাধমূলক কর্মকা- প্রতিরূদ্ধ করতে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়াই উচিত, ঠিক যেমন কোনো হত্যাকা- ঠেকাতে গিয়ে ট্রাফিক আইন ভঙ্গ করাও অনুচিত নয়।

ধরেন, রাস্তায় লাল ট্রাফিক বাতি দেখে আমার গাড়িটি দাঁড় করালাম, কিন্তু তারপর একদল লোকের ওপর গুলিবর্ষণরত কাউকে প্রতিরুদ্ধ করতে লাল বাতি-জ্বলা অবস্থাতেই ছুটে গেলাম, তাহলে এই কাজটা নিশ্চয় কোনো অবৈধ কাজ হিসেবে গণ্য হবে না। এটা খুবই যথার্থ এবং সঙ্গত আচরণ। কোনো সুস্থমস্তিষ্কের বিচারক এরকম কাজের জন্য আপনাকে দোষী সাব্যস্ত করবেন না।

অনুরূপ, রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের দ্বারা অসহযোগ হিসেবে আখ্যায়িত বহু কিছু সত্যিকারার্থে কিন্তু অসহযোগ নয় বরং রাষ্ট্রের নির্দেশ লঙ্ঘন করে – যে নির্দেশটি বৈধও হতে পারে আবার অবৈধও হতে পারে – মানুষের পক্ষ থেকে গৃহীত খুবই সঙ্গত ও অবশ্যকরণীয় কাজ।

তাই আমার মতে কোনো কাজকে অবৈধ আখ্যায়িত করার বেলায় সতর্ক থাকা প্রয়োজন।

ফুকো: ঠিকই বলেছেন। আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আপনি যখন কোনো বেআইনী কাজ করেন তখন সেটার যৌক্তিকতা নির্মাণ করেন ন্যায়পরায়নতা বা উচ্চতর বৈধতার অবস্থান থেকে, নাকি শ্রেণী-সংগ্রামের অবশ্যকতার অবস্থান থেকে, কারণ বর্তমান সময়ে শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বহারা শ্রেণীর লড়াই চালাতে এরূপ কাজ করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে?

চমস্কি: বেশ, এক্ষেত্রে আমি মার্কিন উচ্চ-আদালতের মতো দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবো, অনুরূপ পরিস্থিতিতে অন্যান্য আদালতও সম্ভবত একই ধরনের অবস্থান নেয়; অর্থাৎ আমি যথাসম্ভব স্বল্পতম যুক্তিভিত্তিতে সমস্যাটা সুরাহা করে ফেলতে চাইব। আমি মনে করি, বহুক্ষেত্রেই বিশেষ কোনো সমাজের আইন-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করা বিশেষভাবে অর্থপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে যদি দেখা যায় ওইরকম কাজ করার মাধ্যমে আপনি ওই সমাজের ক্ষমতা ও দমন-পীড়নের উৎসমূলে আঘাত করছেন।

অবশ্য বিদ্যমান আইন-ব্যবস্থাগুলো বহুলাংশেই বিশেষ কিছু মানবিক মূল্যবোধ ধারণ করে, যা প্রকৃতপক্ষে শিষ্ট মানবিক মূল্যবোধ। বিদ্যমান আইনগুলো সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা হলে রাষ্ট্র কর্তৃক অ-অনুমোদিত বহু কিছু করার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে। তাই আমার মতে, এরূপ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পারাটা গুরুত্বপূর্ণ …

ফুকো: আচ্ছা …

চমস্কি: … আইন-ব্যবস্থার যথাযথভাবে-প্রণীত ক্ষেত্রগুলোর সুযোগ কাজে লাগানো গুরুত্বপূর্ণ এবং অতঃপর আইন-ব্যবস্থার সেই ক্ষেত্রগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়া যেতে পারে যেগুলো কেবলই কোনো ক্ষমতাব্যবস্থাকে সমর্থন যোগায়।

ফুকো: কিন্তু, কিন্তু, আমি, আমি…

চমস্কি: আমি একটা…

ফুকো: কিন্তু আমার প্রশ্নটা ছিল এরকম: আপনি যখন সুস্পষ্টভাবে কোনো অবৈধ কাজ করেন…

চমস্কি: …যে-কাজটাকে কেবল রাষ্ট্র নয় আমিও অবৈধ মনে করি?

ফুকো: না, না, রাষ্ট্র নিজে…

চমস্কি: … খোদ রাষ্ট্র অবৈধ মনে করে?

ফুকো: … রাষ্ট্র অবৈধ বিবেচনা করে।

চমস্কি: হ্যাঁ, বুঝতে পারছি।

ফুকো: আপনি কি এরকম কাজ করেন কোনো আদর্শ ন্যায়পরায়ণতার যুক্তিতে নাকি শ্রেণী-সংগ্রামের জন্য সেটা জরুরি ও আবশ্যক বলে? আপনি আদর্শ ন্যায়পরায়নতার দোহায় দেন কিনা সেইটাই আমার জিজ্ঞাস্য।

চমস্কি: সচরাচর আমি যে কাজগুলো করি সেগুলোকে রাষ্ট্রযন্ত্র অবৈধ বিবেচনা করলেও আমি কিন্তু বৈধ বিবেচনা করি। অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রকে আমি এরূপ ক্ষেত্রে অপরাধী সাব্যস্ত করি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমন ঘটে না। সুনির্দিষ্টভাবে এ-বিষয়টি বোঝার জন্য আসেন শ্রেণী-সংগ্রামের পরিসর থেকে সরে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদী লড়াইয়ের পরিসরে আলোচনা করি, সেক্ষেত্রে বিষয়টি বুঝতে পারা অনেক বেশি সহজ হবে।

আন্তর্জাতিক আইনের কথাই ধরেন, আমরা সকলেই জানি এটা খুবই দুর্বল একটা ব্যবস্থা। কিন্তু তথাপি, এই আইন-ব্যবস্থায় কিছু ভালো নীতিও সমন্বিত আছে। আন্তর্জাতিক আইন হলো, বহুলাংশেই ক্ষমতাবানদের হাতিয়ার স্বরূপ- রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার প্রতিনিধিদের সৃষ্টি। বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনব্যবস্থা প্রণয়নে কৃষিজীবীদের গণআন্দোলন-প্রতিনিধিদের কোনোরূপ অংশগ্রহণ ছিল না। আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামো এই সত্যতা স্পষ্টভাবে তুলে ধরে: অর্থাৎ, আমত্মর্জাতিক আইন বিদ্যমান ক্ষমতা-কাঠামোগুলোকে ব্যাপক পরিমাণে বলপ্রয়োগমূলক হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দেয়- বিরোধিতাকারী জনগোষ্ঠীর স্বার্থের বিপরীতে এই ক্ষমতা-কাঠামো অবশ্য নিজেকে রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করে।

এখন, এগুলো হলো আন্তর্জাতিক আইনের মৌলিক খুঁত। এবং আমি মনে করি আন্তর্জাতিক আইনের এই দিকগুলোর বিরুদ্ধতা করাই ন্যায্য কারণ এগুলোর কোনো বৈধতা নেই, যেমন সম্রাটের স্বর্গীয় অধিকারের কোনো বৈধতা নেই। এগুলো কেবলই ক্ষমতাবানদের দাপট টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, আন্তর্জাতিক আইনের সবটুকুই এই প্রকৃতির নয়। আন্তর্জাতিক আইনব্যবস্থায় কিছু হীতকর উপাদানও আছে। যেমন ধরেন, নুরেমবার্গ নীতি ও জাতিসংঘ সনদে এরূপ কিছু নীতি সমন্বিত আছে যেগুলো নাগরিকদেরকে সুযোগ করে দেয়, আমার মতে বলা যায়, কখনো কখনো নাগরিকদের জন্য আবশ্যক করে তোলে তাদের নিজ রাষ্ট্র-ব্যবস্থার বিরম্নদ্ধে এমনসব সক্রিয় তৎপরতা গ্রহণকে, যে-তৎপরতাকে রাষ্ট্র ভুলভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে। প্রকৃতপক্ষে সেই নাগরিকের তৎপরতাটা কিন্তু বৈধ, কারণ খুবই সীমিত কিছু পরিস্থিতি ব্যতিরেকে কোনো রাষ্ট্র কর্তৃক আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বলপ্রয়োগ বা হুমকি প্রদর্শনকে আন্তর্জাতিক আইনে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যেমন ভিয়েতনামে মার্কিন হামলা এরূপ ব্যতিক্রমের আওতায় পড়ে না। তার মানে বিশেষত ভিয়েতনাম যুদ্ধে, আমাকে যা সবচে বেশি কৌতুহলী করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অপরাধমূলকভাবে তৎপরতা চালাচ্ছিল। এবং সেহেতু, অপরাধীকে হত্যাকা- ঘটানো থেকে বিরত করার অধিকার জনসাধারণের ছিল। যদিও, আপনি থামাতে গেলেই যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র আপনার কাজকে অবৈধ সাব্যসত্ম করে, তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আপনার কাজটি অবৈধ।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এইরকম একটা কান্ড বর্তমানে ঘটে চলেছে পেন্টাগন পেপার্স iv মামলা নিয়ে। আমার মনে হয়, আপনি সেসম্পর্কে জানেন।

বৈধতার বিষয়টি আপাতত মুলতবি রেখে সংক্ষেপে বলা যায়, যা ঘটে চলেছে সেটা হলো: রাষ্ট্রযন্ত্র সেইসব লোকদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে যারা রাষ্ট্রের অপরাধ ফাঁস করে দিয়েছিল- মর্মার্থ এরকমই দাঁড়ায়।

অবশ্যই, এটা খুব অযৌক্তিক-উদ্ভট একটা ঘটনা, কিন্তু একটা যৌক্তিক বিচার প্রক্রিয়াকে এ-ধরনের বিকৃতির জন্য পুরোপুরি খারিজ করা নিস্প্রয়োজন। তদুপরি আমার মনে হয়, বিদ্যমান বিচার-ব্যবস্থাতেই এগুলোর অযৌক্তিকতার কারণও ব্যাখ্যা করা আছে। আর সেটা না-থাকলে আমাদের কর্তব্য সেই আইনব্যবস্থার বিরোধিতা করা।

ফুকো: তাহলে দেখা যাচ্ছে আপনি বিশুদ্ধতর ন্যায্যতার অবস্থান থেকে বিচারব্যবস্থাকে সমালোচনা করেন। এইখানে তাহলে আমাদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাস্য আছে। এটা ঠিক যে সকল রকমের সামাজিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রেই ‘ন্যায্যতার’ প্রশ্নটি জড়িত থাকে। আরও সুনির্দিষ্টভাবে যদি বলি, শ্রেণী-বিচারব্যবস্থার বিরুদ্ধে ও শ্রেণী-অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লড়াই চালানো সবসময়ই ছিল সামজিক সংগ্রামের অংশ: যখনই জনগণ কিঞ্চিত সহিংস হয়ে ওঠে তখনই কিন্তু বিচারকদের বহিষ্কার করা, আদালত-ব্যবস্থাকে বদলে দেয়া, দন্ডিতদের মুক্ত করে দেওয়া, কারাগার উন্মুক্ত করে দেওয়া সবসময়ই ছিল সামাজিক রূপামত্মরের অংশ। বর্তমান সময়ে ফ্রান্সের বিচারব্যবস্থা ও পুলিশের কর্মকান্ড বহু আক্রমণের শিকার হচ্ছে, আমরা যাদেরকে ‘গৌশিস্টে’ v অভিহিত করি তাদের দ্বারা। কোনো লড়াইয়ে কোনো বিচারব্যবস্থা যদি হুমকিগ্রস্ত হয় তবে সেটা হয় ক্ষমতার হাতিয়াররূপে কাজ করার করণে। জনগণ এরূপ আশা করে বসে থাকেনা যে শেষপর্যন্ত কোনো একদিন এই সমাজে বা অন্য কোনো সমাজে জনগণ তাদের গুণ অনুযায়ী পুরস্কৃত হবে বা দোষ অনুযায়ী শাস্তি পাবে। ‘ন্যায়পরায়ণতার’ অবস্থান থেকে সামাজিক লড়াইয়ের কথা না-ভেবে, আমাদের উচিত বরং সামাজিক লড়াইয়ের অবস্থান থেকে ন্যায়পরায়ণতার ওপর জোর দেওয়া।

চমস্কি: আচ্ছা, কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই এই লড়াইয়ে আপনার ভূমিকাটাকে ন্যায্য বলে বিশ্বাস করেন, বিশ্বাস করেন যে আপনি একটি ন্যায্য সংগ্রামে লড়ছেন অন্য কোনো একটি পরিসরের ধারণাসমূহ প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে। আর, আমি মনে করি এমন যৌক্তিকতা নির্মাণ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ আপনি যদি মনে করেন যে আপনি একটা অন্যায্য লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছেন তাহলে কিন্তু এই লড়াইয়ের কোনো যৌক্তিকতা আপনি দাঁড় করাতে পারবেন না।

আপনার বলা কথাগুলো কিঞ্চিত ভিন্নভাবে সূত্রবদ্ধ করতে চাই। আমার মনে হয়, এটা বৈধ্যতা বনাম আদর্শ ন্যায্যতার পার্থক্যের ব্যাপার নয়, বরং বৈধতা বনাম অধিকতর ন্যায্যতার পার্থক্যের বিষয়।

আমি আপনার সাথে একমত হব যদি বলেন, আমরা একটা আদর্শ বিচারব্যবস্থা তৈরি করার মতো কোনো অবস্থানে নেই, ঠিক যেমন আমাদের স্বপ্নে লালিত আদর্শ সমাজ নির্মাণের অবস্থানেও আসলে আমরা নেই। আমরা খুব বেশি কিছু জানি না, আমরা অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ও পক্ষপাতদুষ্ট এবং এরকম আরও বহুকিছু। কিন্তু আমরা একটা অবস্থানে তো আছি- এবং সেই অবস্থানে থেকে সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই একটা উন্নততর সমাজ ও সেইসাথে উন্নততর বিচারব্যবস্থা নির্মাণের উদ্দেশ্যে রূপকল্প গঠন করতে হবে এবং সামনে এগোনোর পথ তৈরি করতে হবে। এখন, এই উন্নততর ব্যবস্থাটাতেও নিশ্চিতভাবেই বিচ্যুতি থেকে যাবে। আমাদের এই উন্নততর ব্যবস্থাটিকে ভ্রমাত্মভাবে একটি আদর্শ ব্যবস্থা না-ভেবে যদি বিদ্যমান ব্যবস্থার সাথে তার তুলনা করি তাহলে আমরা বোধহয় নিম্নরূপ যৌক্তিকতা দাঁড় করাতে পারি:

বৈধতা ও ন্যায্যতার ধারণা সমার্থক নয়; ধারণা দুটি একেবারে স্বতন্ত্রও নয়। যতোক্ষণ পর্যন্ত বৈধত্বের (legality) আওতায় উন্নততর বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং উন্নততর সমাজের অবস্থান থেকে ন্যায্যতাকে সমন্বিত করা হয়, আমাদের উচিত সেই আইনগুলো মান্য করা এবং যদি আমাদের ক্ষমতা থাকে তাহলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে, অতিকায় কর্পোরেশনগুলোকে এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশবাহিনীকে সেই আইনগুলো মান্য করতে বাধ্য করা।

আর অবশ্যই আইনব্যবস্থার যে-সকল এলাকা কোনো উন্নততর ন্যায্যতার প্রতিনিধিত্ব না-করে বরং বিশেষ কোনো স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে কেবলই নিপীড়ন চালানোর কৌশল হিসেবে বিধিভুক্ত হয়, সেক্ষেত্রে সেই আইনগুলো অস্বীকার করা ও বিরোধিতা করা একজন যুক্তিশীল মানুষের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়, অমত্মত নীতিগতভাবে। কারণ, বাসত্মবে এটা করা তার পক্ষে সম্ভব নাও হতে পারে।

ফুকো: আমি আপনার প্রথম বাক্যটিরই কেবল প্রত্যুত্তর করতে চাই, যেখানে আপনি বললেন যে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো লড়াইকে যদি আপনি ন্যায্য না ভাবতেন তাহলে সেই লড়াই করতে পারতেন না।

স্পিনোজা।

স্পিনোজা।

আমি স্পিনোজার viবরাত দিয়ে বলতে চাই, শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে সর্বহারাশ্রেণী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয় এ-কারণে নয় যে তাদের বিবেচনায় এটা একটা ন্যায্য লড়াই। বরং সর্বহারাশ্রেণী শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, কারণ ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো, তারা ক্ষমতা দখল করতে চায়। এবং যেহেতু এই যুদ্ধ শাসকশ্রেণীর ক্ষমতা উৎখাত করবে, সেহেতু তারা এই লড়াইকে ন্যায্য বিবেচনা করে।

চমস্কি: আমি একমত হতে পারলাম না।

ফুকো: মানুষ যুদ্ধ করে জয়ী হওয়ার উদ্দেশ্যে, এইজন্য নয় যে যুদ্ধটা ন্যায়সঙ্গত।

চমস্কি: ব্যক্তিগতভাবে, আমি এর সাথে একমত নই। যেমন ধরেন, আমি যদি নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হই যে সর্বহারাদের ক্ষমতাদখল সন্ত্রাসবাদী পুলিশি রাষ্ট্র কায়েম করবে যেখানে স্বাধীনতা, আত্মমর্যাদা এবং শোভন মানবসম্পর্কগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে তাহলে আমি চাইবো না সর্বহারাশ্রেণী ক্ষমতা দখল করুক। আমার বিশ্বাস বস্ত্তত, কারো পক্ষ থেকে ক্ষমতা-দখল বা এরকম কিছু চাওয়ার একমাত্র কারণ হতে পারে, ভুল-ঠিক যাই হোক না কেন সে মনে করে, ক্ষমতা হস্তান্তরের ফলে কিছু মৌলিক মানব-মূল্যবোধ অর্জন করা সম্ভব হবে।

ফুকো: সর্বহারা যখন ক্ষমতা দখল করে তখন সেইমাত্র বিজিত শ্রেণীর ওপর হিংস্র, একনায়কসুলভ ও রক্তঝড়ানো ক্ষমতা প্রয়োগের ঘটনা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। এতে কারো আপত্তি থাকার মতো কিছু তো আমি দেখতে পাই না। কিন্তু আপনি যদি জিজ্ঞাসা করেন সর্বহারা যদি নিজ শ্রেণীর ওপরই রক্তঝড়ানো, জুলুমশাহী এবং অন্যায্য ক্ষমতা চাপিয়ে দেয় তখন কী হবে; তাহলে আমি বলবো যে এরকম ঘটনা কেবল তখনই ঘটা সম্ভব যদি যথার্থ অর্থে সর্বহারাশ্রেণীর দ্বারা ক্ষমতা দখলের বদলে তাদের বহির্ভূত কোনো শ্রেণী, সর্বহারাদের অভ্যন্তরের কোনো বিশেষ গোষ্ঠী, কোনো আমলাতন্ত্র বা পেটি-বুর্জোয়া গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে থাকে।

চমস্কি: বেশ, ঐতিহাসিক এবং অন্যান্য একগাদা কারণে আমি এরূপ বিপ্লবের তত্ত্বে একটুও সন্তুষ্ট নই। কিন্তু তবু তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই, দেখেন তারপরও কিন্তু এই তত্ত্বে বলা হচ্ছে যে সর্বহারাদের ক্ষমতা দখল করা এবং হিংস্র, রক্তঝড়ানো ও অন্যায্য কায়দায় সেই ক্ষমতা প্রয়োগ করাটা সঙ্গত কারণ, এই তত্ত্বমোতাবেক, আমার মতে ভ্রামত্মভাবে, দাবি করা হয় যে এর ফলে অধিকতর ন্যায্য একটা সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে, যে-সমাজে রাষ্ট্রযন্ত্র বিলুপ্ত হয়ে যাবে, শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। ভবিষ্যত ন্যায্যতার এই যুক্তিভিত্তি যদি না থাকতো তাহলে হিংস্র রক্তঝড়ানো সর্বহারা একনায়কতন্ত্র ধারণাটি অবশ্যই অন্যায্য বিবেচিত হতো। যাহোক সেটা অন্য প্রসঙ্গ, কিন্তু আমি হিংস্র রক্তঝড়ানো সর্বহারা একনায়কতন্ত্র ধারণায় অত্যন্ত সন্ধিগ্ধ, বিশেষত যখন কিনা এরূপ ধারণা উচ্চারিত হয় কোনো ভ্যানগার্ড পার্টির স্ব-নিয়োজিত মুখপাত্রদের দ্বারা। আমাদের অবগত হওয়ার মতো যথেষ্ট ঐতিহাসিক প্রমাণ আছে এবং আমরা আগে থেকেই বলে দিতে পারি যে, নবগঠিত এরূপ সমাজের এধরনের মুখপাত্ররাই কিন্তু পুরোদস্ত্তর নতুন শাসকগোষ্ঠী বনে যাবে।

ফুকো: হ্যাঁ ঠিকই বলেছেন। আমি কিন্তু সর্বহারাদের ক্ষমতা চর্চার কথা বলছিলাম না, যা প্রকৃতিগতভাবে অন্যায্য ক্ষমতা হয়ে উঠতেই পারে: আপনি ঠিকই বলেছেন যে এরূপ ঘটার রাস্তা খুবই সোজা। আমি মূলত বলতে চাচ্ছি যে, সর্বহারাদের ক্ষমতা একটা নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী কোনো বিশেষ সামাজিক শ্রেণীর বিরুদ্ধে হিংস্র ও দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের রূপ নিতে পারে, যে-শ্রেণীটির বিরুদ্ধে তাদের বিজয় তখনও সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়নি।

চমস্কি: দেখেন, আমি বলছি না যে নির্বিকল্পভাবে …। যেমন ধরেন, আমি কোনো কট্টর শান্তিপন্থী নই। যদিও কিছু বিবেচনায় যেকোনো কারণে সহিংসতার ব্যবহারই অন্যায্য, তবু আমি মনে করি আমাদেরকে তুলনামূলক ন্যায্যতার বিষয়টি আন্দাজ করে নিতে হয়।

সহিংসতার ব্যবহার ও কিছু পরিমাণে অন্যায় তৎপরতা চালানো কেবল তখনই ন্যায্যতা পেতে পারে যদি এইরূপ মূল্যায়ননির্ভর যুক্তিভিত্তি দাঁড় করানো যায় যে, এই সহিংসতার চর্চা অধিকতর ন্যায্য একটা লক্ষ্য অর্জন সম্ভব করে তুলবে। এরূপ মূল্যায়ন করতে হবে বস্ত্তত অত্যন্ত নিবিড় মনোযোগ ও যথেষ্ট পরিমাণে সংশয়ী দৃষ্টিভঙ্গিতে। সহিংসতার যদি এরকম মূল্যায়ননির্ভর যুক্তিভিত্তি না থাকে তবে, আমার মতে, সেটা সত্যিই সম্পূর্ণরূপে অন্যায্য গণ্য হবে।

ফুকো: আমার মনে হয় না, শ্রেণীসংগ্রাম চালানোর ক্ষেত্রে সর্বহারা নিজেদের জন্য যে-লক্ষ্য অর্জনের কথা বলে সেটাকে প্রকৃতিগতভাবে কেবল উচ্চতর ন্যায্যতা বলাই যথেষ্ট। বর্তমানে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণীকে উৎখাত ও ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে সর্বহারা যা অর্জন করতে চায় সেটা হলো, সাধারণভাবে বলা যায়, শ্রেণী-ক্ষমতার অবসান।

চমস্কি: ঠিক আছে, কিন্তু এইটাই তো বাড়তি ন্যায্যতার যুক্তিভিত্তি।

ফুকো: যৌক্তিকতা বটে, কিন্তু কেউ ন্যায্যতার পরিভাষায় কথা বলে না, কথা বলে ক্ষমতার পরিভাষায়।

চমস্কি: কিন্তু এটা করা হয় ন্যায্যতার বিচারে; কারণ চূড়ামত্মভাবে যা অর্জিত হবে সেইটাকে ন্যায্য বলে দাবি করা হয়।

কোনো লেনিনবাদী বা অন্য কেউ বলতে সাহস করবেন না যে ‘‘আমাদের, সর্বহারাদের, ক্ষমতা দখলের অধিকার আছে এবং তারপর অন্য সববাইকে শব-চুল্রীতে নিক্ষেপ করার অধিকার আছে’’। সর্বহারাদের ক্ষমতা দখলের পরিণাম যদি এরূপ কিছু হয়, তবে অবশ্যই সেটা হবে খুবই অসঙ্গত।

বিপ্লবের ধারণাটা এমন যে – ইতোপূর্বেই বলেছি একারণে আমি এই ধারণাটা নিয়ে সন্ধিগ্ধ – একটা নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী হিংস্র একনায়কতন্ত্র বা হয়তো রক্তঝড়ানো সহিংস একনায়কতন্ত্র পরিচালনা ন্যায্য কারণ এর দ্বারা শ্রেণীনিপীড়নের অবসান ঘটবে ও বানে ভেসে যাবে, যাকিনা মানব জীবনের যথার্থ অর্জনযোগ্য একটা লক্ষ্য: এই চূড়ান্ত যুক্তিভিত্তির কারণেই কেবলমাত্র পুরো প্রকল্পটি ন্যায্যতা পেতে পারে। এটা ঘটবে কী ঘটবে না সেটা আলাদা ব্যাপার।

নিটশে, সতেরো বছর বয়সে।

নিটশে, সতেরো বছর বয়সে।

ফুকো: যদি অনুমতি করেন তাহলে এ-ব্যাপারে কিছুটা নিৎসেপন্থা vii নিতে চাই: অন্যভাবে বললে আমি মনে করি, খোদ ন্যায়পরায়ণতা ধারণাটি বিভিন্ন প্রকারের সমাজে নির্মাণ করা হয়েছে ও সক্রিয়ভাবে কাজে লাগানো হয়েছে প্রকৃতপক্ষে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতাগোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসেবে কিংবা ওই ক্ষমতার বিরুদ্ধ পক্ষের অস্ত্র হিসেবে। আমার মনে হয় যেকোনো সমাজের অভ্যন্তরে খোদ ন্যায়পরায়ণতা ধারণাটি কাজ করে নিপীড়িত শ্রেণীর পক্ষ থেকে প্রাপ্তিযোগ্য একটা দাবি হিসেবে এবং সেই দাবির ন্যায্যতা রূপে।

চমস্কি: আমি একমত নই।

ফুকো: আর শ্রেণীহীন একটা সমাজে আমরা ন্যায়পরায়ণতার ধারণা আদৌ ব্যবহার করবো কিনা সে-ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই।

চমস্কি: এইখানে এসে আমি সত্যি সত্যিই দ্বিমত পোষণ করছি।

আমার মনে হয় [ন্যায্যতার] একটা পরম, নির্বিকল্প ভিত্তি আছে – সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য খুব বেশি পীড়াপীড়ি করলে আমি মুশকিলে পড়ে যাব, কারণ এখনো এর পুরো রূপরেখা আমি তৈরি করতে পারিনি – চূড়ান্তভাবে মৌলিক মানবস্বভাবের অভ্যন্তরে যার বসবাস, ন্যায়পরায়ণতার ‘‘প্রকৃত’’ ধারণা বস্ত্তত তারই ওপর ভিত্তিশীল।

আমাদের বিদ্যমান বিচার-ব্যবস্থাগুলোকে কেবলই শ্রেণী-পীড়নের একটা ব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করা কিছুটা তাড়াহুড়ো হয়ে যাবে: আমি এগুলোকে সেরকম মনে করি না। আমার মতে, এগুলোর মধ্যে শ্রেণী-পীড়ন এবং অন্য বহুরকমের পীড়নের উপাদান অন্তর্ভুক্ত আছে, কিন্তু একইসাথে এগুলোর মধ্যে সত্যিকারের মানবিক ন্যায্যতার ধারণাসমূহ এবং শিষ্টতা, সদয়তা ও সহানুভূতির মতো মূল্যবান অকৃত্রিম মানব-মূল্যবোধের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষাও অমত্মর্ভুক্ত আছে।

এবং আমি মনে করি অনাগত যেকোনো সমাজে, যে-সমাজটি কখনোই নিখুঁত হবে না, এই ধারণাগুলো বিচারব্যবস্থায় তখনও অমত্মর্ভুক্ত থাকবে। আমরা প্রত্যাশা করতে পারি, মানুষের মৌলিক চাহিদা সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং সেইসাথে সংহতি, সহানুভূতি বা এরকমের মূল্যবোধগুলো অনেক বেশি মাত্রায় জায়গা পাবে, কিন্তু তবু বর্তমান সমাজের অসাম্য ও নিপীড়নের উপাদানগুলোও কোনো না কোনো মাত্রায় জারি থাকবে।

সে যাই হোক, আমার মনে হয় আপনার কথাগুলো খুবই ভিন্নরকমের পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই কেবল প্রযোজ্য হতে পারে। যেমন ধরেন, জাতিগত সংঘাতের কথা। এক্ষেত্রে দুটো আলাদা সমাজ একে অপরকে ধ্বংস করতে সচেষ্ট হয়। এখানে ন্যায্যতার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। একমাত্র বিবেচ্য থাকে আপনি কোন্ পক্ষে আছেন? আপনি কি আপনার নিজ সমাজকে রক্ষা করতে এবং অন্য সমাজটিকে ধ্বংস করতে চাচ্ছেন?

অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, অসংখ্য ঐতিহাসিক সমস্যা থেকে আলাদা করে দেখলে একদিক থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সৈনিকরা অনেকটা এইরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে পরস্পর পরস্পরকে খুন করছিল। তারা লড়ছিল পরস্পর পরস্পরকে হত্যা করার অধিকার পাওয়ার জন্য। এই রকম পরিস্থিতিতে ন্যায্যতার প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর।

কিন্তু তখনও অবশ্যই যুক্তিশীল মানুষ ছিল, অধিকাংশই কারাগারে। যেমন ধরেন কার্ল লিইবনেশ্ট (Karl Liebknecht) এর কথা। তিনি এই অযৌক্তিকতার কথা বলেছিলেন এবং ফলত কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। কিংবা যেমন অন্যপক্ষের বাট্রান্ড রাসেলের কথা বলা যায়। এই মানুষেরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে এরূপ পারস্পরিক খুনোখুনির কোনো ন্যায্য যৌক্তিকতা নেই এবং অবশ্যই এই যুদ্ধ এখনই থামানো উচিত।

এই মানুষগুলোকে কিন্তু পাগল বা উন্মাদ ও অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছিল। যদিও সেই সময়ে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বলতে কেবল তারাই ছিলেন।

আপনার বর্ণিত এই ধরনের পরিস্থিতিতে ন্যায্যতার প্রশ্ন অবান্তর। একমাত্র বিবেচ্য বিষয় থাকে মরণপণ লড়াইয়ে কোন্ পক্ষ জয়ী হচ্ছে। আমার মতে এরূপ পরিস্থিতিতে যথার্থ মানব প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত: যুদ্ধ থামাও। কোনো পক্ষেরই জয়ী হওয়ার দরকার নেই; সক্রিয়ভাবে যুদ্ধ থামাতে সচেষ্ট হওয়া। আর আপনি যদি এরকম কথা বলেন তাহলে আপনাকে নিশ্চয়ই কারাগারে নিক্ষেপ করা হবে কিংবা খুন করা হবে কিংবা এরকমেরই কিছু একটা ঘটবে, বহু যুক্তিশীল মানুষের কপালে যে-রকম ঘটেছিল।

কিন্তু আমার মনে হয় না মানুষের দৈনন্দিন জীবনে এরূপ পরিস্থিতি সবসময় জারি থাকে এবং আমি মনে করি না যে শ্রেণীসংগ্রাম বা সামাজিক বিপ্লবের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি এই রকমের। বিপ্লবের জন্য অবশ্যই যৌক্তিকতা দাঁড় করানো সম্ভব এবং উচিতও। আর আপনি যদি কোনো যৌক্তিকতা না দেখাতে পারেন তাহলে আপনার উচিত হবে এই লড়াই থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া। যৌক্তিকতা তুলে ধরতে হবে যে আপনি সামাজিক বিপ্লব ঘটানোর চেষ্টা করছেন শেষবিচারে ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে, মানুষের মৌলিক চাহিদা পুরণের লক্ষ্যে; কেবলমাত্র ক্ষমতা-আকাঙ্ক্ষার যুক্তিতে অন্য আরেকটি গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার লক্ষ্য পূরণের জন্য নয়।

ফুকো: বেশ, আমি কি প্রত্যুত্তর দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পাব?

এল্ডার্স: হ্যাঁ, পাবেন।

ফুকো: কতটুকু? কারণ…

এল্ডার্স: দুই মিনিট। [ফুকো হাসলেন]

ফুকো: কিন্তু আমি বলবো এটা খুব অন্যায়। [সকলেই হেসে উঠলেন]

চমস্কি: অবশ্যই, অবশ্যই।

ফুকো: না, তবে আমি এতো অল্প সময়ে উত্তর দিতে চাই না। তাই শুধু এইটুকুই বলবো যে মানবপ্রকৃতি ধারণার স্বরূপের প্রশ্নটি কেবলমাত্র তত্ত্বীয়ভাবে বিচারের সময় আমাদের মধ্যে শেষপর্যন্ত কোনোরূপ মতানৈক্য সৃষ্টি হয়নি, ওইসব তত্ত্বীয় সমস্যার বেলায় আমরা পরস্পর সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছিলাম।

কিন্তু অন্যদিকে, আমরা যখনই মানবপ্রকৃতির প্রশ্নটি রাজনৈতিক পরিসরে আলোচনায় লিপ্ত হয়েছি তখনই আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। এবং আপনার ধারণার বিপরীতে, আপনি আমাকে এইরূপ বিশ্বাস করা থেকে নিরসত্ম করতে পারবেন না যে মানবপ্রকৃতি, ন্যায়পরায়ণতা, মানব-সত্তার মৌল স্বভাবপ্রাপ্তি ইত্যাদি ধারণাসমূহ নির্মিত হয়েছে আমাদের বর্গভুক্ত সভ্যতার পরিসরে, আমাদের বর্গভুক্ত জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরে, আমাদের দর্শন-চিন্তার অভ্যন্তরে এবং কিছুটা, আমাদের শ্রেণীব্যবস্থার সুবাদে। সেহেতু, যতোই বেদনাদায়ক হোক না কেন, আমাদের সমাজের মূল ভিত্তিসমূহ উৎখাত করার লড়াইকে কেউ এই একই ধারণার সাহায্যে বর্ণনা করতে বা যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারেন না। এটা জ্ঞাত জ্ঞানের ভিত্তিতে অন্ধকারে ঝাঁপ দেওয়ার সামিল, আমি এর কোনো যৌক্তিকতা দেখি না।

চমস্কি: বুঝতে পেরেছি।

এল্ডার্স: জনাব ফুকো, আপনাকে যদি রোগবিদ্যার পরিভাষায় আমাদের বাসত্মব সমাজকে বর্ণনা করতে অনুরোধ করা হয়, তাহলে কোন্ ধরনের পাগলামো আপনাকে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করবে?

ফুকো: আমাদের বর্তমান সমাজে?

এল্ডর্স: হ্যাঁ।

ফুকো: যদি বলতে হয় কোন্ অসুস্থতা দ্বারা বর্তমান সমাজ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত?

এল্ডার্স: হ্যাঁ।

ফুকো: আমাদের সমাজে রোগ-ব্যাধি ও উন্মাদকে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এবং এমনভাবে শ্রেণীকরণ করা হয়েছে যাতে বিশেষ কিছু ধরনের মানুষকে সমাজ-বহির্ভূত রাখা যায়। এই সমাজ যদি নিজেকে উন্মাদ হিসেবে বৈশিষ্ট্যায়িত করে তাহলে তো নিজেকেই বর্জন করা আবশ্যক হয়ে পড়তো! অবশ্য অভ্যমত্মরীণ সংস্কারের লক্ষ্যে সমাজ কখনো কখনো এরকম করার ভান করে। আর যেসব মানুষ আধুনিক বিশ্বকে স্নায়বিক-উত্তেজনা বা সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রামত্ম বলে আখ্যায়িত করে তাদেরকে যেকোনো মানুষের তুলনায় অধিক রক্ষণশীল বিবেচনা করা হয়। এসব ধারণার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে চতুর কায়দায় সমাজের বিশেষ কিছু ধরনের মানুষকে বা বিশেষ কিছু প্রকারের আচরণকে বর্জন করা হয়।

সুতরাং, আমার মনে হয় না অ-মনোবিদ্যাগত অর্থ আরোপ ব্যতিরেকে কেউ আমাদের সমাজকে সিজোফ্রেনিয়া ও মনোবিকলনে আক্রান্ত বলতে পারবেন, যদি কিনা তিনি রূপক অর্থে বা শ্লেষ প্রকাশের জন্য বলে থাকেন। কিন্তু যদি খুব চাপাচাপি করেন তাহলে আমি বলবো যে আমাদের সমাজ একটা ব্যাধিতে আক্রান্ত বটে; খুবই দুর্বোধ্য, খুবই উদ্ভট একটা ব্যাধি, যার কোনো নাম এখনও আমরা দিতে পারি নাই। তবে এই মানসিক ব্যাধির একটা বিস্ময়কর লক্ষণ আছে, আর খোদ লক্ষণটাই প্রকৃতপক্ষে বিভিন্ন প্রকার মানসিক রোগকে অস্তিত্ববান করে তোলে। ওইখানেই এটার বাস।

এল্ডার্স: চমৎকার। আমার মনে হয় এখন আমরা আলোচনা শুরু করতে পারি।

প্রশ্নকারী: জনাব চমস্কি, আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। আলোচনার সময় আপনি ‘সর্বহারা’ প্রত্যয়টি ব্যবহার করেছেন; অমত্মত অগ্রসর প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে ‘সর্বহারা’ বলতে আপনি কী বুঝাতে চান? আমরা জানি এটা একটা মার্কসবাদী ধারণা, যার যথাযথ সমাজতাত্ত্বিক ভিত্তি নেই।

চমস্কি: হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন, এটা একটা কারণ যেজন্য আমি ওই পুরো বিষয়টাই আলোচনা করতে দ্বিধান্বিত ছিলাম এবং বলেছিলাম যে পুরো প্রকল্পটা নিয়ে আমি সন্দিগ্ধ। কারণ আমার মনে হয় সর্বহারা ধারণাটিকে যদি আমরা এখনও ব্যবহার করতে চাই তাহলে আমাদের বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতির সাথে সাযুজ্য রেখে এর ওপর নতুন অর্থ আরোপ করতে হবে। সত্যিই, আমি এমনকি প্রত্যয়টি ঝেড়ে ফেলে দিতে পছন্দ করবো। কারণ প্রত্যয়টি বহুল পরিমাণে ঐতিহাসিক নিহিতার্থে ভারাক্রান্ত। তাই আমি এই শব্দটির বদলে বরং সমাজের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় প্রকারের উৎপাদনশীল কাজে জড়িত মানুষদের দিক থেকে ভাবতে আগ্রহী। আমার মনে হয় এধরনের মানুষদের এমন অবস্থানে থাকা উচিত যেন তারা নিজেদের কর্মক্ষেত্রের রূপকাঠামো এবং কাজের ফলাফল ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করতে পারেন। এবং মানবপ্রকৃতি সম্পর্কে আমার ধারণার ভিত্তিতে আমি সত্যিই মনে করি অংশত সব মানুষই এর আওতায় পড়ে। আমি মনে করি যেকোনো মানুষ শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী না-হলে উৎপাদনমুখী ও সৃজনশীল কাজ করতে কেবল সক্ষমই নন অত্যন্ত আগ্রহীও, যদি কিনা সুযোগ দেওয়া হয়- এবং এক্ষেত্রেও আমি অবশ্যই মশিঁয়ে ফুকোর সাথে দ্বিমত পোষণ করে আমার বিশ্বাস ব্যক্ত করবো যে অন্তত কিছুটা হলেও মানসিক অসুস্থতা ধারণাটির শর্তনিরপেক্ষ একটা ভিত্তি আছে।

আমি কখনোই এমন কোনো মানব-শিশু দেখিনি যে পাথর টুকরোগুলো জড়ো করে একটা কিছু বানাতে আগ্রহী না, বা নতুন কিছু শিখতে চায় না কিংবা একটা কাজ সম্পন্ন হলে তার পরেরটা করতে চেষ্টা করে না। এবং, কেন প্রাপ্তবয়স্করা এরকম নয়, আমার অনুমান, তার একমাত্র কারণ তাদেরকে পাঠশালা ও অন্যান্য পীড়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠানো হয়েছিল, যা তাদের মনের এই বস্ত্তটিকে বিদায় করে দিয়েছে।

পরিস্থিতি এইরকম হলে বলা যায় সর্বহারা শ্রেণী, বা যে নামেই ডাকুন না কেন, প্রকৃতপক্ষেই সর্বজনীন হয়ে ওঠে। অর্থাৎ এর আওতাভুক্ত হবে সেই সকল মানুষ যারা, আমার বিশ্বাসমতো মৌলিক মানবিক চাহিদাস্বরূপ আত্মোপলব্ধি অর্জনের আকাঙ্ক্ষাতাড়িত। অর্থাৎ অর্থপূর্ণ কিছু একটা করার জন্য সৃজনশীল হতে চায়, অনুসন্ধিৎসু হতে চায়, কৌতুহলী হতে চায়।

প্রশ্নকারী: আপনি যদি এধরনের একটা বর্গকে ব্যবহার করেন, মার্কসবাদে যার ভিন্ন একটা অর্থ আছে … আমাদেরকে হয়তো…

চমস্কি: সে কারণেই তো আমি বলি যে এই ধারণাটা বাদ দিতে হবে।

প্রশ্নকারী: অন্য কোনো প্রত্যয় ব্যবহার করা কি ভালো নয়? এইখানে আমি আরেকটা প্রশ্ন করতে চাই: সমাজের কোন্ গোষ্ঠীগুলো বিপস্নব ঘটাবে বলে আপনি মনে করেন?

চমস্কি: আচ্ছা, এটা তো ভিন্ন একটা প্রশ্ন।

প্রশ্নকারী: ইতিহাসের পরিহাস হলো, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণী থেকে আসা তরুণ বুদ্ধিজীবীরা আজকাল নিজেদেরকে সর্বহারা আখ্যায়িত করেন এবং আহবান জানান যে আমাদের অবশ্যই সর্বহারাদের সাথে যোগ দেওয়া উচিত। কিন্তু আমি তো কোনো শ্রেণী-সচেতন সর্বহারা দেখি না, এটা খুব বড় একটা সঙ্কট।

চমস্কি: ঠিক আছে। আমার মনে হয় আপনি এখন একটি সুনির্দিষ্ট ও সংহত প্রশ্ন তুলেছেন, যৌক্তিক প্রশ্নও বটে। আমাদের আজকের সমাজে সকলেই যে দরকারি, অর্থপূর্ণ বা আত্মতুষ্টিকর কাজ করছে এমন কথা ঠিক নয়- এরূপ কথা বস্ত্তত আদৌ সত্য নয়। কিন্তু যদি স্বাধীন পরিবেশে তারা সাধারণত যে-ধরনের কাজ করে সেইরূপ কাজই তাদেরকে করতে দেওয়া হতো তাহলে কাজটি উৎপাদনশীল ও তুষ্টিকর হতে পারতো।

বস্ত্তত, বেশিরভাগ মানুষ অন্য ধরনের কাজের সাথে যুক্ত। যেমন ধরেন শাসন-শোষণের ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ, কিংবা কৃত্রিম ভোগের আকাঙ্ক্ষা তৈরির কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা নিপীড়ন ও ধ্বংসের কায়দা-কৌশল উদ্ভাবনের কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ কিংবা সেই ব্যক্তিবর্গ যাদেরকে স্থবির-হতে-থাকা শিল্প-অর্থনীতিতে একেবারে কোনো স্থানই দেওয়া হয়নি। অসংখ্য মানুষকে অর্থপূর্ণ শ্রমের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

এবং আমি মনে করি, বিপস্নব হওয়া উচিত সকল মানুষের নামে; তবে বিপস্নব সংঘটিত হতে হয় বিশেষ কিছু বর্গের মানুষের তত্ত্বাবধানে। আমার মতে, তারা হবেন সেইসব মানুষ যারা সত্যিকারার্থেই সমাজের জন্য দরকারি কাজের সাথে জড়িত। সমাজভেদে অবশ্য এই বর্গগুলোর প্রকৃতি আলাদা আলাদা হতে পারে। আমাদের সমাজে, আমার মতে এই বর্গভুক্ত হবেন বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মীরা: বেশ বিস্তৃত একটা পরিসরের ব্যক্তিরা এর অন্তর্ভুক্ত হবেন, যার মধ্যে আছে কায়িক শ্রমিক থেকে শুরু করে দক্ষ কর্মী, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানীরা, বিশাল আকারের পেশাজীবী শ্রেণী, তথাকথিত সেবামূলক পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের একটা বড় অংশ- সব মিলিয়ে এটা সুবিশাল এক জনগোষ্ঠী, অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আমার অনুমান এদেশেও আগামীতে এরূপ একটা বিশাল জনগোষ্ঠী তৈরি হবে।

একইসাথে, আমি মনে করি ছাত্রবিপ্লবীদেরও একাজে একটা হিস্যা আছে, যদিও আংশিক: অর্থাৎ এর অর্থ হলো, আধুনিক অগ্রসর শিল্পভিত্তিক সমাজে প্রশিক্ষিত বিদ্যাজীবী সম্প্রদায় কাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে সেটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তারা সামাজিক ব্যবস্থাপক হিসেবে বা শিল্প-পরিচালক হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রাইভেট ক্ষমতার সাথে সেবক হিসেবে একাত্ম হচ্ছে; নাকি উল্টোভাবে, তারা বর্তমান কালখন্ডে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে নিয়োজিত শ্রমিক শ্রেণীর অংশ হিসেবে একাত্ম হচ্ছে সেটা বিচার করা জরুরি।

তারা যদি উল্লেখিত পরবর্তী গোষ্ঠীটির সাথে একাত্ম হয় তাহলে তাদের কর্তব্য হলো প্রগতিশীল সামাজিক বিপ্লবে একটি শোভন ভূমিকা পালন করা। আর তারা যদি প্রথমোক্ত দলের সাথে একাত্ম হয় তবে তারা নিশ্চিতভাবেই পীড়নকারী শ্রেণীর অংশ।

প্রশ্নকারী: আপনাকে ধন্যবাদ।

এল্ডার্স: হ্যাঁ, প্রশ্নটা বলুন।

প্রশ্নকারী: জনাব চমস্কি, আপনি সমাজের নতুন মডেল সৃজনের যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রয়োজনের কথা বললেন আমাকে সেটা নাড়া দিয়েছে। কিন্তু এখানে, উত্রেস-এ, ছাত্র গ্রুপগুলো সাথে নিয়ে ওইরূপ চেষ্টা করতে গিয়ে আমরা যে সমস্যায় পড়েছি সেটা হলো, আমরা কেবলই সঙ্গতিপূর্ণ মূল্যচেতনার সঙ্কট বোধ করছি। একটা মূল্যচেতনার কথা আপনি কিছুটা হলেও বলেছেন বটে- ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের আবশ্যকতা। সিদ্ধান্ত প্রণয়ন-প্রক্রিয়ায় তৃণমূল পর্যায়ের ব্যক্তিদের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকতে হবে।

এটা বস্ত্তত বিকেন্দ্রীকরণ ও অংশগ্রহণের মূল্যচেতনা। কিন্তু অন্যদিক দিয়ে দেখলে, আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যা বৈশ্বিক পরিসরে সিদ্ধান্ত গ্রহণকে অধিক থেকে অধিকতর আবশ্যক করে তুলেছে, কিংবা বলা যায় আগামীতে আবশ্যক করে তুলবে। যেমন ধরেন, সেবাসমূহের অধিকতর সমতাপূর্ণ বণ্টনের জন্য আরও বেশি কেন্দ্রীকরণের প্রয়োজন হতে পারে। এই সমস্যাসমূহ উচ্চতর পর্যায় থেকে সমাধান করা আবশ্যক হয়ে পড়ে। আপনার মডেলের সমাজ তৈরি করতে গিয়ে আমরা এরকম একটা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি, এ-প্রসঙ্গে আপনার কাছ থেকে আরও কিছু শুনতে চাই।

আমার আরেকটা অতিরিক্ত প্রশ্ন আছে… বা বলা যায় কেবলই একটা মন্তব্য করতে চাই। সেটা হলো: ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে আপনার প্রবল সাহসী মনোভাব সত্তেও কীভাবে আপনি এমআইটি’র (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) মতো প্রতিষ্ঠানে টিকে থাকতে পারছেন, যে-প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা যুদ্ধের একটা বড় ঠিকাদার ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাতা হিসেবে জানি?

চমস্কি: বেশ, আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নটির জবাব আগে দিচ্ছি। আশা করি ততোক্ষণে প্রথম প্রশ্নটা ভুলে যাব না। না, না, প্রথমে প্রথম প্রশ্নটারই জবাব দিতে চেষ্টা করি; এবং তারপর আমি ভুলে গেলে দ্বিতীয় প্রশ্নটা স্মরণ করিয়ে দেবেন।

সাধারণভাবে আমি বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে। আমি এটাকে কোনো নির্বিকল্প নীতি বানাতে চাই না। যদিও বিস্তর কল্পনার ওপর নির্ভর করতে হবে তবু আমি যে-কারণে বিকেন্দ্রীকরণের পক্ষে থাকতে চাইবো তা হলো, আমার অনুমান সাধারণভাবে একটি কেন্দ্রীকৃত ক্ষমতা-ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থার অধীনসত্ম সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গের স্বার্থে দক্ষতার সাথে কাজ করবে।

তবে, বিকেন্দ্রীকৃত ক্ষমতা ও স্বেচ্ছানুবর্তী সংঘসমূহের একটা ব্যবস্থাও নিশ্চয় সমস্যামুক্ত হবে না। যেমন একটা সমস্যার কথা তো আপনি বললেন, এছাড়াও অসমতা থাকবে, এক অঞ্চল অন্য অঞ্চল থেকে অধিকতর ধনবান হবে ইত্যাদি। কিন্তু আমার নিজের আন্দাজ এরকম যে আমরা অনেক বেশি আস্থা রাখতে পারি সহমর্মিতা ও ন্যায়বিচার-আকাঙ্ক্ষার মতো মৌলিক মানবিক আবেগগুলোর ওপর, যা একটি স্বেচ্ছানুবর্তী সংঘব্যবস্থার মধ্যে বিকশিত হবে বলে আশা করা যায়।

আমার মনে হয়, মানুষের সজ্ঞা-জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করা আমাদের জন্য অনেক বেশি নিরাপদ কেন্দ্রীয় ক্ষমতানির্ভর প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করার তুলনায়, যা প্রায় অনিবার্যভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতার সবচেয়ে শক্তিধর উপাদানগুলোর স্বার্থে কাজ করবে।

কিছুটা বিমূর্ত ও অতিসরলীকৃতভাবে বলা হয়ে গেল বটে এবং আমি দাবি করতেও চাই না যে সকল পরিস্থিতির জন্যই এই নীতি সুফল বয়ে আনবে, কিন্তু আমার মনে হয় বহুক্ষেত্রেই এই নীতি কার্যকর সুফল বয়ে আনতে পারে।

সুতরাং যেমন ধরেন, আমি মনে করি একটি গণতান্ত্রিক সমাজবাদী মুক্তিমুখি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তানী শরণার্থীদের viii জন্য পর্যাপ্ত সহায়তা দেওয়ার সম্ভাবনা একটি কেন্দ্রীকৃত মার্কিন ক্ষমতাব্যবস্থার তুলনায় অনেক বেশি, যা মূলত বহুজাতিক কর্পোরেশনের স্বার্থে কাজ করে যাচ্ছে। আমার মতে, অন্য বহুক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য। তাই আমি মনে করি, এই নীতি অন্তত কিছুটা ভাবনা-চিন্তার দাবি করতে পারে।

আপনার উত্থাপিত প্রশ্নের ভিতর যে ধারণাটি গুপ্ত আছে, এবং যে-ধারণাটি সচরাচর প্রকাশ্যেই ব্যক্ত করা হয়, সেটা হলো: কিছু প্রাযুক্তিক বাধ্যবাধকতা আছে, অগ্রসর প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের কিছু বৈশিষ্ট্যর কারণে কেন্দ্রীকৃত ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ আবশ্যক- রবার্ট ম্যাকনামারা থেকে শুরু করে তার নিম্নবর্তী অনেকেই এরূপ ধারণা ব্যক্ত করেন। কিন্তু আমি যতোটুকু বুঝি, এরূপ ভাবনা পুরোপুরি অর্থহীন। আমি কখনোই এরূপ ভাবনার পক্ষে কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি।

আমার কাছে বরং মনে হয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন উপাত্ত প্রক্রিয়াকরণ বা যোগাযোগ প্রযুক্তি ইত্যাদি, সম্পূর্ণ উল্টো তাৎপর্য বহন করে। তাৎপর্যটা হলো, তথ্য এবং প্রাসঙ্গিক উপলব্ধিসমূহ সবার কাছে খুব দ্রুত পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। এগুলোকে সেই ক্ষুদ্র একটি ব্যবস্থাপক গোষ্ঠীর হাতে আর কেন্দ্রীভূত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই যারা কিনা সকল প্রকার জ্ঞান, সকল প্রকার তথ্য এবং সবরকমের সিদ্ধান্ত প্রণয়নকে নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং, আমি মনে করি প্রযুক্তি বন্ধন-মুক্তিদায়ী হতে পারে, এর মধ্যে বন্ধন-মুক্তির বৈশিষ্ট্যসমূহ বিদ্যমান: কিন্তু প্রযুক্তির ভূমিকাকে উল্টো করে দেওয়া হয়েছে অন্য সবকিছুর মতো করে, বিচার ব্যবস্থার মতো করে- মূলত এটাকে রূপান্তরিত করা হয়েছে নিপীড়নের হাতিয়ার রূপে। এর কারণ আমাদের সমাজে ক্ষমতা খুবই খারাপভাবে বণ্টিত। আমার মনে হয় না যে, আধুনিক প্রযুক্তির বা আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের এমন কোনো বৈশিষ্ট্য আছে যার কারণে আমাদেরকে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নীতি থেকে সরে আসতে হবে, বরং উল্টোটাই সত্য।

আপনার দ্বিতীয় প্রশ্নের দু’টো দিক আছে: প্রথমটা হলো এমআইটি কীভাবে আমাকে সহ্য করে, আর অন্য দিকটা হলো আমি কীভাবে এমআইটিকে সহ্য করতে পারি। [সবাই হেসে উঠলেন]

প্রথমত কীভাবে এমআইটি আমাকে সহ্য করে… সেই প্রসঙ্গে বলবো, অতি বেশি ছক-মাফিক ভাবা ঠিক হবে না। সত্যি যে এমআইটি যুদ্ধ-গবেষণার একটি প্রধান প্রতিষ্ঠান। কিন্তু সেই সাথে এটাও সত্যি যে এখানে অত্যন্ত মুক্তিমুখি মূল্যবোধও সমন্বিত আছে, যা আমার মতে মার্কিন সমাজেও গভীরভাবে প্রথিত; বিশ্বের জন্য নিদেনপক্ষে মঙ্গলজনক একটা ব্যাপারই বলতে হবে। তবে এই মূল্যবোধ ভিয়েতনামী সমাজকে রক্ষা করার মতো গভীরে প্রথিত নেই, কিন্তু এর চেয়েও গুরুতর বিপর্যয় রোধের উপযুক্ত গভীরভাবে প্রথিত বটে।

এইখানে, আমার মতে একটু সীমা টানা প্রয়োজন। এখানে সাম্রাজ্যবাদী দস্যুতা ও আগ্রাসন আছে, শোষণ আছে, বর্ণবাদ আছে এবং এরকম আরও বহু কিছু আছে। কিন্তু একইসাথে সত্যিকারের উদ্বেগও আছে, একসাথে সহাবস্থান করছে। যেমন ধরেন, ব্যক্তির অধিকারের বিষয়টি বিল অব রাইটস-এ ix অন্তর্ভুক্ত আছে, যে-বিলটি কোনোক্রমেই শ্রেণী-পীড়নের দলিল মাত্র নয়; রাষ্ট্রক্ষমতার বিপরীতে ব্যক্তিকে রক্ষা করার আবশ্যকতারও দলিল।

এখন, এই বিষয়গুলো সহাবস্থান করে। বিষয়টা সরলরৈখিক নয়, সবটুকু ভালো বা সবটুকু মন্দ এমনও নয়। এই বিশেষ ভারসাম্যর মধ্যেই এগুলো বিরাজ করে যা যুদ্ধের অস্ত্র উৎপাদনকারী একটি প্রতিষ্ঠানকে আমার মতো যুদ্ধবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে জড়িত একজন ব্যক্তিকে সহ্য করতে আগ্রহী করে, এমনকি উৎসাহীও করে।

এখন, আমি কীভাবে এমআইটিকে সহ্য করি সেটা ভিন্ন একটা প্রশ্নরূপে হাজির হয়। এমন অনেক লোক আছে যারা যুক্তি দেখান, যদিও আমি কখনো তাদের যুক্তির কোনো ভিত্তি দেখি না, একজন র‌্যাডিক্যাল কর্মীকে অবশ্যই নিজেকে নির্যাতনবাদী প্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্রব ত্যাগ করতে হবে। এরূপ যুক্তির অর্থ দাঁড়ায়, কার্ল মার্কসের উচিত হয়নি বৃটিশ মিউজিয়ামে বসে অধ্যায়ন করা, যা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ানক সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক, যেখানে উপনিবেশগুলো ধর্ষণের মাধ্যমে কেড়ে নেওয়া সকল মূল্যবান সম্পদ জড়ো করা হয়েছে।

কিন্তু আমি মনে করি বৃটিশ মিউজিয়ামে অধ্যয়ন করে কার্ল মার্কস সঠিক কাজটিই করেছিলেন। যে-সভ্যতাটিকে তিনি অতিক্রম করতে চাচ্ছিলেন সেই সভ্যতার সম্পদসমূহ ও উদার মূল্যবোধের সুযোগটুকু ব্যবহার করে তিনি সঠিক কাজটিই করেছিলেন। এবং আমার বেলায়ও এই একই কথা খাটে বলে আমার মনে হয়।

প্রশ্নকারী: কিন্তু আপনার ভয় হয় না যে এমআইটিতে আপনার উপস্থিতি তাদেরকে সুস্পষ্ট বৈধতা দেয়?

চমস্কি: আমি সত্যিই বুঝি না কীভাবে সেটা হতে পারে। অর্থাৎ, আমার মতে এমআইটিতে আমার উপস্থিতি তাদের জন্য সামান্যই সহায়ক হতে পারে, তবে ঠিক কতোটুকু আমি সেটা জানি না। সেইসাথে, প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমআইটি যা করে তার বিরুদ্ধে ছাত্র-আন্দোলন বৃদ্ধিতে আমার ভূমিকাও এক্ষত্রে বিবেচ্য।

এল্ডার্স: আর প্রশ্ন আছে কি?

প্রশ্নকারী: আমি কেন্দ্রীকরণের প্রশ্নটিতে ফিরে যেতে চাই। আপনি বললেন যে প্রযুক্তি বিকেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু সমস্যা হলো খোদ প্রযুক্তি কি নিজেকে, এর প্রভাবকে বা এর অন্য দিকগুলোকে সমালোচনা করতে পারে? আপনার কি মনে হয় না যে পুরো বিশ্বে প্রযুক্তির প্রভাবকে মূল্যায়নের জন্য একটা কেন্দ্রীয় সংগঠনের প্রয়োজন হতে পারে? এবং আমি বুঝি না কীভাবে একটা ক্ষুদ্র প্রাযুক্তিক প্রতিষ্ঠানে এরূপ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব?

চমস্কি: বেশ, স্বেচ্ছানুবর্তী সংঘসমূহের জোটের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আমার তো কোনো আপত্তি নেই: এবং এই অর্থে সংঘসমূহের কেন্দ্রীকরণ, পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া, যোগাযোগ, মতানৈক্য, তর্ক-বিতর্ক ঘটতে পারে, সেইসাথে আরও বহুকিছু, যদি মনে করেন, সমালোচনাও। আমি কথা বলছিলাম বস্ত্তত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের বিষয়ে।

প্রশ্নকারী: কিন্তু ক্ষমতা তো অবশ্যই জরুরি; যেমন ধরেন, আমরা যদি প্রাযুক্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেবলই কর্পোরেশনগুলোর স্বার্থে কাজ করাকে বাধা দিতে চাই।

চমস্কি: হ্যাঁ, কিন্তু আমি যে অভিমত পেশ করছিলাম তা হলো: সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে কেন্দ্রীকৃত ক্ষমতাব্যবস্থাকে বিশ্বাস করা, কিংবা তার বিকল্প হিসেবে স্বেচ্ছানুবর্তী মুক্তিমুখি সংঘসমূহের জোটকে বিশ্বাস করার সুযোগ থাকলে আমি পরবর্তী ব্যবস্থাটিকেই বিশ্বাস করতাম। এবং তার কারণ, এরূপ একটি ব্যবস্থা শিষ্ট মানব-সজ্ঞা-জ্ঞানের সর্বোচ্চ বিকাশে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে কেন্দ্রীকৃত ক্ষমতাব্যবস্থা সাধারণত নিকৃষ্টতর মানব-বৈশিষ্ট্যগুলোর সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটানোর প্রবণতাসম্পন্ন, যেমন হিংস্র লোলুপতার প্রবৃত্তি, ধ্বংসের প্রবৃত্তি, নিজের কাছে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ও অপরকে ধ্বংস করার আকঙ্ক্ষা ইত্যাদি। এগুলো এমন সব আকাঙ্ক্ষা বিশেষ ঐতিহাসিক পরিবেশে এগুলোর বিকাশ ঘটে ও সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং আমি মনে করি আমরা এমন ধরনের সমাজ নির্মাণ করতে চাই যেখানে এরূপ আকাঙ্ক্ষাগুলো দমন করা হবে এবং অন্যসব অধিকতর সুস্থ প্রবৃত্তির দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হবে।

প্রশ্নকারী: আশা করি ঠিকই বলেছেন।

এল্ডার্স: ভদ্রমহোদয়গণ, আমার মনে হয় এখানেই বিতর্কের ইতি টানা উচিত। জনাব চমস্কি, জনাব ফুকো, বিতর্কের দার্শনিক ও তত্ত্বীয় অংশ এবং সেইসাথে রাজনৈতিক অংশে আপনাদের সুগভীর আলোচনার জন্য আমার পক্ষ থেকে, এখানে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের পক্ষ থেকে এবং বাসায় টেলিভিশন সেটের সামনে বসা দর্শক-শ্রোতাদের পক্ষ থেকে অসংখ্য ধন্যবাদ।

Series Navigation<< তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (পার্ট ফোর)
The following two tabs change content below.
Avatar photo

আ-আল মামুন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →