Main menu

তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (পার্ট ফোর)

This entry is part 4 of 5 in the series তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো

পার্ট ওয়ান ।। পার্ট টু ।। পার্ট থ্রি ।।

(মূল তর্কের প্রথম বারো মিনিট পার্ট থ্রি’তে ছিল। এর পর থিকা…)

__________________

 

এল্ডার্স: আপনাদের দু’জনের জবাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমি আরেকটি সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন উত্থাপনের চেষ্টা করে দেখতে পারি, কারণ আমার আশঙ্কা অন্যথায় বিতর্কটি অতিমাত্রায় কলাকৌশলনির্ভর (technical) হয়ে পড়বে। আমার ধারণা আপনাদের দু’জনের মধ্যে প্রধান প্রধান মতপার্থক্যের উৎস আপনাদের মনোভঙ্গিগত পার্থক্যের মধ্যে নিহিত। আপনি, জনাব ফুকো, বিশেষভাবে আগ্রহী একটা নির্দিষ্ট কালে বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীরা যেভাবে কর্মতৎপরতা চালিয়েছে তার প্রতি; অন্যদিকে জনাব চমস্কি অধিক আগ্রহী ‘‘কী-বাচক প্রশ্নে’’: কেন আমরা ভাষা-সম্পন্ন; কীভাবে ভাষা কাজ করে কেবল সে-বিষয় নয়, বরং আমাদের ভাষা-সম্পন্ন হওয়ার রহস্য কী সে-বিষয়টিতেও। আরও সাধারণীকরণের মাধ্যমে আমরা বিষয়টি ভালভাবে বুঝে নিতে চেষ্টা করতে পারি: জনাব ফুকো, আপনি আঠারো শতকের যুক্তিবাদকে খুপরিবদ্ধ (delimiting) করছেন; অন্যদিকে আপনি, জনাব চমস্কি, আঠারো শতকের যুক্তিবাদের সাথে স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার মতো ধারণা সম্পৃক্ত করছেন।

সতেরো এবং আঠারো শতকের সমাজ থেকে দৃষ্টান্ত হাজির করে আমরা হয়তো আরও বিস্তারিতভাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে পারি।

চমস্কি: প্রথমেই বলা উচিৎ হবে যে ধ্রুপদী যুক্তিবাদকে আমি বিজ্ঞান কিংবা দর্শনের ইতিহাসবিদের মতো করে পাঠ করি না, বরং এমন এক ব্যক্তি-দৃষ্টিকোণ থেকে তাকাই যে-ব্যক্তি একটি নির্দিষ্টমাত্রার বৈজ্ঞানিক ধারণার অধিকারী এবং সেইসাথে, কীভাবে পূর্ববর্তী সময়ের মানুষেরা এসব ধারণা হাতড়ে ফিরছিলেন সেটা অনুসন্ধানে আগ্রহী। অবশ্য তারা হয়তো তখন জানতেনও না যে এসব ধারণা তারা খুঁজে চলেছিলেন।[youtube id=”RXq90biAIdg”]

সুতরাং কেউ হয়তো বলতে পারেন, সপ্তদশ শতকে বিদ্যমান ভাবনা-চিন্তা অনুসন্ধান করতে এবং সেগুলোর নির্ভুল বিবরণ তুলে ধরতে আগ্রহী কোনো প্রত্নবিশারদের দৃষ্টিতে আমি ইতিহাসের দিকে তাকাচ্ছি না – আমি তাদের এই কাজকে খাটো করছি না, কেবল বলতে চাচ্ছি ওটাতে আমি আগ্রহী নই। বরং বলা যায় যে সপ্তদশ শতকের অভ্যন্তর থেকে বিশেষ মূল্যবান ধারণাসমূহ তুলে এনে নিজস্ব দৃষ্টিকোণ পোক্ত করার জন্য তাদের মূল্যবোধ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পেতে আগ্রহী একজন শিল্পপ্রেমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি তাকাই।

অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি অস্বীকার না-করে, আমি বলতে চাই আমার দৃষ্টিকোণটাও ন্যায়সঙ্গত: অর্থাৎ আমার মতে, আমাদের বর্তমান উপলব্ধির ওপর ভর করে পূর্ববর্তী সময়কালের বৈজ্ঞানিক ভাবনার দিকে ফিরে যাওয়া সত্যিই সম্ভব এবং অনুধাবন করা সম্ভব কেমনভাবে মহান চিন্তকরা তৎকালীন সীমাবদ্ধতার আওতায় থেকেও সেইসব ধারণা, আদর্শ ও উপলব্ধি অনুসন্ধান করে চলেছিলেন যেগুলো সম্পর্কে তাদের নিজেদের পুরোপুরি সচেতন থাকা সম্ভব ছিল না।

যেমন ধরেন, যে-কেউ তার নিজস্ব ভাবনা-পরম্পরার ক্ষেত্রেও এই কৌশল প্রয়োগ করে দেখতে পারেন- নিজেকে অতীতের কোনো মহৎ চিন্তকের সাথে তুলনার চেষ্টা না-করেও যে-কেউ এটা করতে পারেন…

এল্ডার্স: কেন নয়?

চমস্কি: …দেখুন…

এল্ডার্স: কেন নয়?

চমস্কি: ঠিক আছে [হাসি], যে-কেউই চাইলে তুলনা করে দেখতে পারেন এখন তিনি কতোটুকু জানেন এবং বিশ বছর আগে তিনি কতোটুকু জানতেন এই দুই পরিস্থিতির মধ্যে। তাহলে তিনি দেখতে পাবেন – যদি কিনা ভাগ্যবান হন – কিছু অজ্ঞাত কায়দায় এমন সব বিষয়ের দিকে তখন এগিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন যা কেবল বর্তমান কালে এসেই তিনি উপলদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছেন।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

আমি মনে করি অনুরূপভাবে, নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ধোঁয়াশাচ্ছন্ন না-করেও অতীতের দিকে ফিরে তাকানো সম্ভব এবং এইরূপ মনোভাব নিয়েই মূলত আমি সতেরো শতকের দিকে ফিরে তাকাতে চাই। আর, আমি যখন সতেরো এবং আঠারো শতকের দিকে ফিরে তাকাই, আমাকে বিশেষভাবে বিস্মিত করে যেমন ধরেন, দেকার্তে i ও তাঁর অনুসারীরা যেভাবে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে মন হলো শরীর-নিরপেক্ষ একটি চিন্তাকারী সত্তা। এই দ্বিতীয় সত্তা, মন বা চিন্তাকারী সত্তা-দাবির পক্ষে তাদের যুক্তিবিন্যাসের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন দেকার্তে নিজেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে – তা ভুল ঠিক যাই হোক এখন সেটা বিচার করা নিরর্থক – বস্ত্তজগতের ঘটনাবলী এবং এমনকি আচরণগত ও মনোজগতেরও অনেকখানি যেমন অধিকাংশ সংবেদ পদার্থবিদ্যার মাধ্যমে ব্যাখ্যাযোগ্য; অবশ্য আমরা এখন মনে করি যে তিনি ভুল ভেবেছিলেন। অর্থাৎ ভেবেছিলেন যে সেগুলো বস্ত্তগত ধারণার সাহায্যে ব্যাখ্যাযোগ্য; সংবেদগুলো বস্ত্তর মতো একে অন্যের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে এবং ঘুরপাক খাচ্ছে এবং সঞ্চরণ করছে ইত্যাদি। তিনি ভেবেছিলেন যে ওইসকল প্রত্যয়ের সাহায্যে, অর্থাৎ যান্ত্রিক নীতির পরিভাষায়, তিনি একটি নির্দিষ্ট পরিসরের প্রপঞ্চসমূহ ব্যাখ্যা করতে সক্ষম: এবং এরপরে তিনি লক্ষ করলেন, এমন কিছু প্রপঞ্চ আছে যেগুলো তিনি এসব প্রত্যয়ের সাহায্যে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। আর সেকারণেই তিনি ওই সকল প্রপঞ্চ ব্যাখ্যার উপযোগী একটা সৃজনশীলতার নীতি হাজির করলেন- মন ও তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যসমূহ। তার পরবর্তীকালের অনুসারীরা, অনেকেই যারা নিজেদেরকে কার্তেসীয় মনে করতেন না এবং অনেকেই নিজেদেরকে প্রবল অভিজ্ঞতাবাদবিরোধী বিবেচনা করতেন তারা নির্দিষ্ট বিধিবিধানের অধীন সৃজনশীলতার ধারণা গড়ে তোলেন।

আমি খুঁটিনাটি আলোচনায় যাবো না, তবে সৃজনশীলতা বিষয়ে আমার নিজস্ব অনুসন্ধান আমাকে শেষপর্যন্ত ভিলহেম ভন হামবোল্ট ii-এর সম্মুখীন করে। নিজেকে তিনি একবারেই কার্তেসীয় ভাবতেন না। কিন্তু তবু, একটি ভিন্নতর রূপকাঠামোর (framework) মধ্যে থেকে এবং ভিন্ন একটা ঐতিহাসিক কালে ও ভিন্নরকমের উপলব্ধি নিয়েও খুবই বিস্ময়কর সৃজনশীলভাবে, আমার মতে যার গুরুত্ব সীমাহীন, আত্মীকৃত-কাঠামো ধারণা গড়ে তোলেন- অর্থাৎ, তিনি নির্দিষ্ট বিধিবিধানের আওতাধীন মৌলিকভাবে স্বেচ্ছানুবর্তী সৃজনশীলতার নীতি গড়ে তোলেন, যাতে করে সেইসব সঙ্কট ও সমস্যা মোকাবিলা করা যায় যে-সমস্যাগুলো কার্তেসীয়রা তাদের মতো করে মোকাবিলার চেষ্টা করেছিলেন।

এখন আমার বিশ্বাস, এবং এক্ষেত্রে বহু সহকর্মীর সাথে আমি ভিন্নমত পোষণ করে বলবো যে, দেকার্তের পক্ষ থেকে দ্বিতীয় সত্তা বিষয়ক দাবিটি ছিল অত্যন্ত বৈজ্ঞানিক একটা পদক্ষেপ; কোনো আধ্যাত্মিক বা বিজ্ঞান-বিরোধী পদক্ষেপ ছিল না। বস্ত্তত, অনেক দিক থেকেই ওটা ছিল নিউটনের দূরবর্তী ক্রিয়া বিষয়ক বুদ্ধিবৃত্তিক পদক্ষেপের অনুরূপ। বলতে পারেন, ওই পদক্ষেপের মাধ্যমে নিউটন সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান থেকে বহু দূরবর্তী অতিপ্রাকৃত বিশ্বাসের এলাকায় ঢুকে পড়েছিলেন এবং চেষ্টা নিয়েছিলেন ওইসব বিষয় পরিষ্কার অনুধাবন ও ব্যাখ্যার উপযোগী একটি তত্ত্ব গঠনের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের সাথে সমন্বিত করার।

আমি মনে করি, দ্বিতীয় সত্তা ধারণা নির্মাণের ক্ষেত্রে দেকার্তেও অনুরূপ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যদিও তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন, কিন্তু নিউটন সফল হয়েছিলেন। অর্থাৎ, দেকার্তে মন সম্পর্কে একটি গাণিতিক তত্ত্বের পাটাতন নির্মাণ করতে সক্ষম হননি, অন্যদিকে নিউটন ও তার অনুসারীরা কিন্তু বস্তুগত সত্তা বিষয়ে একটি গাণিতিক তত্ত্বের পাটাতন গড়ে তুলতে পেরেছিলেন, যা দূরবর্তী ক্রিয়ার মতো অতীন্দ্রীয় ধারণা এবং পরবর্তীতে বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বল ও অন্যান্য বহুবিধ ধারণা আওতাভুক্ত করেছিল।

আমার মতে, এখন তাহলে আমাদের ওপর দেকার্তের কাজকে এগিয়ে নেওয়ার এবং, বলতে পারেন, মন সম্পর্কে একটি গাণিতিক তত্ত্ব খাড়া করার দায়িত্ব বর্তায়; তত্ত্ব বলতে আমি সুসংহতভাবে বর্ণিত ও সুস্পষ্টভাবে গড়ে-তোলা একটি বিমূর্ত তত্ত্বকে বোঝাতে চাচ্ছি, যা হবে প্রায়োগিক এবং আমাদেরকে জানার সুযোগ করে দেবে তত্ত্বটি ভুল নাকি নির্ভুল কিংবা আমরা ভুল পথে যাচ্ছি নাকি সঠিক পথে এগোচ্ছি। একইসাথে, বস্ত্তগত বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যের মতোই এর বৈশিষ্ট্যগুলোও বর্ণিত হতে হবে। অর্থাৎ, তত্ত্বটি দৃঢ়তা ও যথার্থ্যতার গুণসম্পন্ন হতে হবে এবং এর এমন একটি কাঠামো থাকবে, যা আমাদেরকে পূর্বানুমানের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে সক্ষম করবে।

আমি মূলত এইরূপ দৃষ্টিকোণ থেকে সতেরো ও আঠারো শতকের দিকে তাকাতে চেষ্টা করি এবং সেইসব ধারণা ছেঁকে আনতে চাই যেগুলো সত্যিই সেখানে হাজির ছিল, যদিও আমি অবশ্যই কবুল করবো এবং বস্ত্তত জোর দিয়েই বলবো যে, আমি এখন বিষয়গুলোকে যেভাবে দেখছি সেইভাবে হয়তো তারা নিজেরাও দেখতেন না।

এল্ডার্স: জনাব ফুকো, আমার অনুমান এ-বিষয়ে আপনি তীব্র সমালোচনা হাজির করবেন?

ফুকো: না…কেবল একটা বা দু’টো ক্ষুদ্র ঐতিহাসিক প্রসঙ্গের কথা বলবো। তাদের যৌক্তিকতা ও কর্মপ্রণালী সম্পর্কে আপনি [চমস্কি] যে ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ হাজির করলেন আমি সেখানে আপত্তি করার কিছু দেখি না। তবু একটা বিষয় যোগ করতেই হয়: আপনি যখন দেকার্তে-গঠিত সৃজনশীলতা ধারণার কথা আলাপ করছিলেন, আমার আশঙ্কা হয়, আপনি দেকার্তের ওপর এমন সব ধারণা চাপিয়ে দিচ্ছেন যা আসলে তার পরবর্তী কালের অনুসারীদের মধ্যে এবং তার সমসাময়িক অন্য কারো কারো মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়। দেকার্তের ধারণা মোতাবেক মন অতোটা সৃজনশীল নয়- মন দেখে, উপলব্ধি করে, তথ্য-প্রমাণের সংস্পর্শে উদ্ভাসিত হয়।

তাছাড়াও, যে-সমস্যাটি দেকার্তে কখনোই সমাধান করতে পারেননি কিংবা আয়ত্ত করতে পারেননি সেটা হলো: একটি স্পষ্ট ও অনন্য ধারণা বা একটি সজ্ঞা-জ্ঞান থেকে ব্যক্তি যে-উপলব্ধির মাধ্যমে অন্য একটা ধারণায় পৌঁছায় সেইটাকে কী বলা যায়, এবং এক ধারণা থেকে অন্য ধরণায় পৌঁছানোর এই সফরকেইবা কী আখ্যা দেয়া যায়। যে-মুহূর্তে মন সত্যকে উপলব্ধি করে সেইখানের প্রকৃত সৃজনশীলতার ব্যাপারটি দেকার্তের ধারণার মধ্যে আমি সত্যিই দেখতে পাই না, একইভাবে দেখতে পাইনা এক সত্য থেকে অন্য সত্যে পৌঁছানোর প্রকৃত সৃষ্টির ব্যাপারটির ক্ষেত্রেও।

আমার মনে হয়, প্যাসকাল iii এবং লাইবনিজের iv মধ্যে বরং আপনি যা খুঁজছিলেন তার কাছাকাছি একটা কিছু পেতে পারেন: অন্যভাবে বললে, প্যাসকাল এবং খ্রিষ্টীয় চিন্তাধারার অগাস্টিনপন্থীদের v মধ্যে আপনি প্রগাঢ় মনের ধারণাটি দেখতে পাবেন; যে-মন নিবিড়ভাবে নিজের গভীরে কুন্ডলী পাকিয়ে একপ্রকার অচৈতন্যের সংস্পর্শে অবস্থান করে এবং আত্ম-গভীরে মন্থনের মাধ্যমে নিজ সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। এবং এজন্যই আপনার উল্লেখিত পোর্ট রয়ালপন্থী vi ব্যাকরণকে আমি কার্তেসীয় নয় বরং অগাস্টিনপন্থী মনে করি।

আর এ-ছাড়াও, লাইবনিজের মধ্যে এমনকিছু বিষয় খুঁজে পাবেন যা আপনার নিশ্চয় পছন্দ হবে: মনের গভীর-গহন এলাকায় যৌক্তিক সম্পর্কের একটি পূর্ণাঙ্গ জাল বিসত্মৃত থাকে যা, কিছু বিবেচনায় বলা যায়, মানবচৈতন্যের যৌক্তিক অচেতনকে গড়ে তোলে; আর যুক্তিবুদ্ধির আপাত অস্পষ্ট ও অদৃশ্য এই রূপটিকে ধীরে ধীরে বিকশিত করে মোনাড vii কিংবা ব্যক্তি; এবং মূলত এর মাধ্যমেই ব্যক্তি চারপাশের বিশ্বকে বোঝার চেষ্টা করে।

এইখানটাতেই আমি অতি সামান্য একটু সমালোচনা করতে চাই।

এল্ডার্স: জনাব চমস্কি, প্লিজ আমাকে আগে একটু বলতে দিন।

আমার মনে হয়, ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ হাজির করার সময় এটা নয়, বরং এসব অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্নে আপনার নিজস্ব অভিমত তুলে ধরার ব্যাপার…

ফুকো: কিন্তু কারো মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি তো এই প্রকারের সংহত বিশ্লেষণের মাধ্যমেই প্রতিফলিত করা সম্ভব।

এল্ডার্স: হ্যাঁ, ঠিক আছে। কিন্তু আপনার হিস্ট্রি অব ম্যাডনেস  গ্রন্থের কিছু কিছু অংশ আমি এখন স্মরণ করতে পারছি যেখানে সতেরো ও আঠারো শতককে বর্ণনা করা হয়েছে দমন, পীড়ন ও বহিষ্কার-এর মতো ধারণার সাহায্যে; অন্যদিকে জনাব চমস্কির কাছে এই কালটি সৃজনশীলতা ও প্রাতিস্বিকতায় ভরপুর।

কেন এই কালে এসে আমরা, প্রথমবারের মতো, বদ্ধ পাগলাগারদ দেখতে পাই? আমার মনে হয় এটা খুবই মৌলিক একটা প্রশ্ন …

ফুকো: … সৃজনশীলতা প্রসঙ্গে? ভালই বলেছেন বটে!

কিন্তু আমি জানি না, জনাব চমস্কি হয়তো বলতে পারবেন…

এল্ডার্স: না, না, না, বলতেই হবে। প্লিজ, থামবেন না।

ফুকো: না, আমি বরং বলতে চাই: যে ঐতিহাসিক অনুসন্ধান আমি চালিয়েছি বা চালাতে চেষ্টা করেছি সেখানে, যেগুলোকে সাধারণত আপনারা ব্যক্তির সৃজনশীলতা, সৃজনকর্মে তাদের সামর্থ্য, তাদের স্বতঃপ্রণোদিত উদ্ভাবন-প্রবণতা, স্বতঃপ্রণোদিত ধারণা নির্মাণ, তত্ত্ব বা বৈজ্ঞানিক সত্য উদ্ভাবন ইত্যাদি আখ্যায়িত  করেন, সেগুলোকে খুব সামান্যই জায়গা দিয়েছি।

তবে আমি মনে করি, আমার সমস্যাটি জনাব চমস্কির থেকে স্বতন্ত্র। জনাব চমস্কি ভাষাতাত্ত্বিক আচরণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাচ্ছিলেন, যা বাকসম্পন্ন কর্তাসত্তাকে (speaking subject) একেবারেই পাত্তা দেয়নি- আচরণবাদে বাকসম্পন্ন কর্তাসত্তাকে মূলত একধরনের পাটাতনবিশেষ হিসেবে গণ করা হতো, যার ওপর তথ্য ধীরে ধীরে জমা হয় এবং পরে ব্যক্তি এগুলোকে কেবলমাত্র সমন্বিত করে।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে, কিংবা আরও সাধারণভাবে বলা যায় চিন্তার ইতিহাসে, সমস্যাটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্নরকমের।

জ্ঞানের ইতিহাস দীর্ঘকাল-যাবত দু’টো শর্ত মেনে চলতে চেয়েছে। একটা হলো স্বীকৃতিদানের শর্ত: প্রতিটি উদ্ভাবনের বেলাতেই, কেবল অবস্থান ও সন-তারিখ নির্ধারণ করলেই চলবে না, কোনো একজনের নামের ওপর উদ্ভাবনাটি অর্পণ করতে হবে; এর একজন আবিষ্কর্তা থাকতে হবে, কাউকে এর দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু সর্বসম্মিলিত বা দলগত বিষয়সমূহ যেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে কারো ওপর আরোপ করা যায় না, বিধায় সেগুলোকে অবমূল্যায়ন করা হয়। প্রথাগতভাবে সেগুলোকে এখনও ‘প্রচলিত’, ‘মানসজাত’, ‘অভ্যাসগত’ কিংবা এধরনের প্রত্যয়ের সাহায্যে বর্ণনা করা হয়; এবং উদ্ভাবকের ‘মৌলিকতা’র বিপরীতে প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ নেতিবাচক ভূমিকায় ব্যবহার করা হয়। সংক্ষেপে বলা যায়, জ্ঞানের ইতিহাসে কর্তাসত্তার সার্বভৌমত্ব নীতির প্রতিষ্ঠায় এগুলোকে ব্যবহার করা হয়। অন্য শর্তটি, যা কর্তাসত্তাকে রক্ষা করার আর কোনো সুযোগই দেয় না বরং সত্যকে উন্মোচিত করে, সেটা হলো: ইতিহাসে সত্য এড়িয়ে যাওয়া যাবে না, খোদ সত্য নিজগুণেই স্বয়ং নিজের উপস্থিতি ইতিহাসে জাহের করবে এমনটা জরুরি নয়, বরং ইতিহাসে সত্য নিজেকে শুধুমাত্র প্রকাশিত করবে; মানুষের দৃষ্টির আবডালে ইতোপূর্বে অগম্য অন্ধকারে তলিয়ে থেকে সত্য উন্মোচিত হওয়ার প্রতীক্ষা করতে থাকবে। ফলত, সত্যের ইতিহাস হয়ে ওঠে মূলত এর প্রতীক্ষা; এর পতন কিংবা প্রতিবন্ধকতার উৎখাত হিসেবে, যা এতোকাল এর (সত্য’র) উদ্ভাসন ব্যাহত করেছে। সত্যের সাথে সম্পর্কবিচারে জ্ঞানের ঐতিহাসিকতার মাত্রাটি সবসময়ই নেতিবাচক। এই দু’টো শর্ত’র একটাকে অপরটির সাথে কীভাবে খাপ খাওয়ানো হয়েছিল তা দেখতে পাওয়া দুঃসাধ্য নয়: সামষ্টিক বর্গের প্রপঞ্চ, ‘‘সর্বজনবোধ্য ধারণা,’’ একটা নির্দিষ্ট যুগের ‘‘মিথ’’-এর ‘‘সংস্কারসমূহ’’ মিলে তৈরি হয় এই প্রতিবন্ধকতা, যাকিনা জ্ঞানের কর্তা অতিক্রম করবেন বা ছাপিয়ে উঠবেন সত্যের নাগাল পাওয়ার উদ্দেশ্যে। ‘‘আবিষ্কার’’ করতে হলে তাকে হতে হবে ‘‘প্রচলবিমুখ’’ (eccentric)। এদিক থেকে দেখলে, বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়ে এটা একধরনের ‘‘রোমান্টিকতা’’ উস্কে দেয়: সত্যসন্ধানীর নিঃসঙ্গতা, তার মৌলিকতা অবশেষে মৌলিক উদ্ভাবনার ওপর নিজের উদ্ভাসন ঘটায়, ঐতিহাসিকতার পরিসরে এবং ইতিহাস ব্যতিরেকেও। আমার মনে হয়েছে, এর মাধ্যমে জ্ঞানের ইতিহাসের ওপর মূলত জ্ঞানের তত্ত্ব ও জ্ঞানের কর্তাসত্তাকে চাপিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু সত্য’র সাথে কর্তাসত্তার সম্পর্কের উপলব্ধিটা যদি কেবলই জ্ঞানের পরিণামমাত্র হতো, তাহলে কী ঘটতো? খোদ উপলব্ধি যদি জটিল, বহুমাত্রিক, অ-ব্যক্তিক একটা নির্মাণ হতো এবং সত্যের দাপট-দেখানো ‘‘কর্তাসত্তা সাপেক্ষ’’ না-হতো, তাহলে কী ঘটতো? এইখানে এসে তাহলে আমাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় বিজ্ঞানের ইতিহাসের দ্বারা নেতিবাচকতাপ্রাপ্ত পুরো পরিসরটিকে সুস্পষ্টভাবে সামনে নিয়ে আসা; জ্ঞান উৎপাদন-সামর্থ্যকে একটি সম্মিলিত চর্চা হিসেবে বিশ্লেষণ করা; এবং ফলাফলস্বরূপ অতঃপর, কোনো বিশেষ জ্ঞানের বিকাশে ব্যক্তিমানুষ ও তার ‘‘জ্ঞান’’গত অবদানকে প্রতিস্থাপন করা, যা প্রকৃতপক্ষে একটি বিশেষ কালে শনাক্তযোগ্য ও বর্ণনাযোগ্য নির্দিষ্ট কিছু বিধান মোতাবেক ভূমিকা রেখেছিল।

আপনি হয়তো বলতে পারেন, বিজ্ঞানের মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা দীর্ঘকালযাবত এই কাজই তো করছেন। কিন্তু কেউ যদি নজর দিয়ে দেখেন এ-সকল বিষয় নিয়ে তারা কীভাবে কাজ করেছেন এবং বিশেষত চৈতন্য ধারণাটি বা বিজ্ঞানের বিপরীতরূপে মতাদর্শ ধারণাটি তারা কীভাবে ব্যবহার করেছেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে তারা বস্ত্তত জ্ঞানের তত্ত্ব থেকে অনেকাংশেই বিচ্ছিন্ন।

সে-যাই হোক, আমার উদ্বেগ আসলে উপলব্ধির রূপান্তরকে জ্ঞান আবিষ্কারের [কর্তাসত্তানির্ভর] ইতিহাস দ্বারা প্রতিস্থাপন করার বিষয়টাতে। সুতরাং, সৃজনশীলতাকে জনাব চমস্কি যেভাবে দেখছেন আমার মনোভাব তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা; অন্তঃত দৃশ্যত তাই মনে হবে, কারণ আমার কাছে এটা উপলব্ধিসক্ষম কর্তাসত্তা-সংকট মুছে ফেলার প্রশ্ন, অন্যদিকে তার কাছে এটা বাকসম্পন্ন কর্তাসত্তার মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার ব্যাপার।[youtube id=”6EKGhm-Us9E”]

তিনি যদি কর্তাসত্তার পুনরাবির্ভাবের সুযোগ দিয়েই থাকেন, তিনি যদি এর কথা বলেই থাকেন, তবে তার কারণ তিনি সেটা করতে সক্ষম। ভাষাতাত্ত্বিকরা বহুকালযাবত ভাষাকে দলগত মূল্যবোধসম্পন্ন একটা ব্যবস্থা হিসেবে পাঠ করে আসছেন। কিন্তু উপলব্ধিকে নির্দিষ্ট কিছু বিধানের সম্মিলিত সমগ্রক হিসেবে – যা একটি নির্দিষ্ট কালে বিশেষ কিছু ধরনের জ্ঞান উৎপাদনের সুযোগ করে দেয় – এখন পর্যন্ত কদাচিৎ পাঠ করা হয়েছে। যদিও, পর্যবেক্ষণে আগ্রহী যে-কারো সামনে এরূপ পাঠের জন্য বেশকিছু বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টভাবেই নজরে আসে। উদাহরণস্বরূপ, আঠারো শতকের শেষের দিকের চিকিৎসাশাস্ত্রের কথাই ধরেন: বিশটা চিকিৎসাশাস্ত্রীর গবেষণাপত্র পাঠ করেন, ১৭৭০ থেকে ১৭৮০ সালের মধ্যকার যেকোনো বিশটি, এবং তারপরে ১৮২০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যকার অন্য যেকোনো বিশটি গবেষণাপত্র পাঠ করেন, এবং আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি আপনি দেখতে পাবেন এই চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে সবকিছুই বদলে গিয়েছিল; যে বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতো, যে-কায়দায় আলাপ-আলোচনা হতো এবং অবশ্যই কেবল প্রতিষেধক নয়, কেবল রোগসমূহ ও তাদের শ্রেণীবিভাগ নয়, বরং পুরো মনোভঙ্গিটাই বদলে গিয়েছিল। কে এজন্য দায়ী ছিল? এর সৃজনকর্তাই বা কে ছিল? আমার মনে হয়, খুবই অসঙ্গত ঠেকবে যদি বলি বিশঁ (Bichat) viii, কিংবা সীমানা আরেকটু বিস্তৃত করেও যদি বলি অঙ্গব্যবচ্ছেদশাস্ত্রীয় আদি চিকিৎসকরা এর জন্য দায়ী ছিল। বরং বলা যায়, এটা ছিল চিকিৎসাশাস্ত্রীয় উপলব্ধির চর্চা ও তার বিধানসমূহের সম্মিলিত ও জটিল এক রূপান্তরের ব্যাপার। অবশ্যই এই রূপান্তর নেতিবাচক কোনো ব্যাপার নয়: বরং এটা ছিলো একধরনের নেতিবাচকতা দমন, একধরনের প্রতিবন্ধকতা অপসারণ, পূর্বসংস্কারের অবসান, প্রাচীন মিথ পরিহার, অযৌক্তিক বিশ্বাসসমূহের পশ্চাদপসরণ এবং অবশেষে অভিজ্ঞতা ও যুক্তিশীলতার পথ উন্মুক্ত করার ব্যাপার। তবু এটা কিন্তু আবার নিজস্ব বাছবিচার ও বর্জনবিধিসম্পন্ন আনকোরা নতুন এক ঘের-ব্যবস্থা (grill) কায়েমেরও প্রতিনিধিত্ব করে। ফলে, তার নিজস্ব বিধিবিধানমাফিক, নিজস্ব সংকল্প ও সীমাবদ্ধতাসহ, নিজস্ব অভ্যন্তরীণ যৌক্তিকতা মোতাবেক, নিজস্ব বিশেষত্ব এবং কানাগলিসহ শুরু হয় এক নতুন খেলা আর এসবকিছু মিলে এই জ্ঞানকান্ডের ভিত্তিমূল বদলের পথ করে দেয়। মানব-উপলব্ধি বস্ত্তত বিরাজ করে এরূপ ক্রিয়াশীলতার সীমানা-গন্ডীতে। সুতরাং, কেউ জ্ঞানের ইতিহাস অধ্যয়নে লিপ্ত হলে দেখতে পাবেন বিশ্লেষণের দুটো প্রশস্ত রাস্তা আছে: একটা রাস্তা অনুসারে, কোনো খাঁটি ‘‘উদ্ভাবকের’’ ‘‘সত্য’’ আবিষ্কারের পথ একটুও না-মাড়িয়ে তাকে দেখাতে হবে কীভাবে, কোন্ পরিস্থিতিতে এবং কোন্ সব কারণে খোদ উপলব্ধি তার গঠনাত্মক ভূমিকার বদল ঘটায়; অপর রাস্তাটি অনুসারে তাকে দেখাতে হবে, কীভাবে উপলব্ধির বিধানগুলোর ক্রিয়াশীলতা ব্যক্তির মধ্যে আনকোরা ও ইতোপূর্বে অপ্রকাশিত জ্ঞান উৎপন্ন করে। এইখানে এসে আমার লক্ষ্য, কিছুটা ক্রুটিপূর্ণ কায়দায় ও মূলত নিম্নতররূপে হলেও, জনাব চমস্কির সংকল্পের সাথে পুনর্মিলিত হয়। অর্থাৎ ব্যাপরটা এরকম যে, গুটিকতক বিধান কিংবা নির্দিষ্ট কিছু উপাদানের সহায়তায় ব্যক্তির পক্ষে ইতোপূর্বে অজ্ঞাত ও অ-সৃজিত জ্ঞান-সমগ্রতা উদ্ভাসিত করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে। এই সমস্যাটি সুরাহা করতে গিয়ে জনাব চমস্কিকে ভাষার ব্যাকরণশাস্ত্রে কর্তাসত্তার পুনরাবির্ভাব ঘটাতে হয়েছে। আর, আমার অধ্যয়ন-এলাকা ইতিহাসবিদ্যায় এই একই রকমের সমস্যা সুরাহা করতে গিয়ে, বলতে পারেন ঠিক তার বিপরীত কাজটি করতে হয়: খোদ উপলব্ধির অবস্থানে দাঁড়িয়ে এর বিধানসমূহ, এর ব্যবস্থাসমূহ এবং এর সামগ্রিক রূপান্তরের বিষয়টাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ব্যক্তিক জ্ঞানের খেলায় বিধান ও ব্যবস্থাগুলোর লিপ্ততার ব্যাপারটা বিচার করতে হয়।

জ্ঞানের ইতিহাসে এবং ভাষাতত্ত্বে সৃজনশীলতার সমস্যাটি একই কায়দায় সুরাহা করা যায় না, কিংবা বলা যায়, শাস্ত্রগত ধরনের পার্থক্যের কারণে সমস্যাটি একই রকম কায়দায় সূত্রায়িতও করা যায় না ।

চমস্কি: আমার মনে হয়, সৃজনশীলতা প্রত্যয়টির ভিন্ন ভিন্ন প্রয়োগের কারণে আমরা কিছুটা পারস্পরিক ভুল-বোঝাবুঝির অবস্থান থেকে এতোক্ষণ তর্ক চালিয়ে যাচ্ছি। বস্তুত, আমার বলা উচিত হবে যে সৃজনশীলতা প্রত্যয়টিকে আমি ব্যবহার করেছি কিছুটা হলেও আমার ভাবাদর্শগত অবস্থান থেকে এবং সেকারণে এই ধারণাটি পরিষ্কার করার দায়ভার আমার কাঁধেই চাপে, আপনার ওপর নয়। আমি যখন সৃজনশীলতার কথা বলি তখন, সাধারণত আমরা সৃজনশীলতা ধারণার ওপর যে-মূল্যচেতনা আরোপ করে থাকি সেরূপ কোনো মূল্যচেতনাগত অবস্থান থেকে বলি না। অর্থাৎ, আপনি যখন বৈজ্ঞানিক সৃজনশীলতার কথা বলছিলেন, আপনি তখন যথার্থই বলেছেন একজন নিউটনের কৃতিত্বের কথা। কিন্তু আমি যে-পরিসর থেকে সৃজনশীলতার কথা বলছিলাম তা হলো নৈমিত্তিক স্বাভাবিক মানব কর্মকান্ড।

আমি এমন এক সৃজনশীলতার কথা বলছি, নতুন পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হয়ে ওঠার পর যে-কোনো শিশুই সেটা প্রদর্শন করতে পারে: যথাযথভাবে বর্ণনা করতে পারে, যথাযথভাবে সেই পরিস্থিতির প্রতি সাড়া দিতে পারে, অন্যকে সে-সম্পর্কে বলতে পারে, নিজের মতো করে নতুনভাবে ভাবতে পারে ইত্যাদি। আমার মনে হয় এ-ধরনের কর্মকান্ডকে সৃজনশীলতা বলাই সঙ্গত, তবে অবশ্যই এগুলোকে কোনো একজন নিউটনের কাজ ভাবা চলে না।

তবে, এটাও বোধহয় সত্যি যে শিল্পকলা বা বিজ্ঞানের সৃজনশীলতা, যা স্বাভাবিকের সীমানা অতিক্রম করে যায়, বস্তুত এমনসব বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন যে সেগুলোকেও আমি সহজাত মানবপ্রকৃতিই বলবো; যদিও হয়তোবা সাধারণ মানুষের মাঝে সেগুলো পুরোপুরি বিকশিত অবস্থায় থাকে না এবং হয়তো সেগুলো প্রাত্যহিক জীবনের স্বাভাবিক সৃজনশীলতার (normal creativity) অংশও নয়।

এখন, আমার মনে হয়, স্বাভাবিক সৃজনশীলতা প্রসঙ্গটার দিকে বিজ্ঞান নজর দিতে পারে এবং অনুসন্ধানের একটি বিষয় হিসেবে নিজের আওতাভুক্ত করার উদ্যোগ নিতে পারে। যদিও, আমার মনে হয় এবং আমার আন্দাজ আপনিও একমত হবেন যে অমত্মত নিকট ভবিষ্যতে বিজ্ঞান এইরূপ সৃজনশীলতা, মহান শিল্পী ও বিজ্ঞানীদের অর্জনকে, ব্যাখ্যা করার বাসনা করতে পারবে না। এই অনন্য প্রপঞ্চটিকে নিজ পরিধির মধ্যে জায়গা করে দেওয়ার মতো কোনো অবস্থানে বিজ্ঞান এখনও পৌঁছায়নি। আমি আসলে এই নিম্নতলার সৃজনশীলতা (low-level creativity) নিয়ে কথা বলছিলাম।

তবে, বিজ্ঞানের ইতিহাস প্রসঙ্গে আপনি যাকিছু বললেন, আমার মতে সেগুলো খুবই যথার্থ ও শিক্ষণীয়; এবং মনসত্মত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব ও মন-এর দর্শন জ্ঞানকা– আমাদের সামনে অপেক্ষমান কাজগুলোর বেলায় বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক।

কারণ, এমন কিছু কিছু প্রসঙ্গ আছে যেগুলোকে গত কয়েক শতকজুড়ে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিধারার বাঁকে বাঁকে অবরুদ্ধ রাখা হয়েছে কিংবা পাশে ফেলে যাওয়া হয়েছে।

যেমন ধরেন আমার মতো এরূপ নিম্নতলার সৃজনশীলতা নিয়ে ভাবনাচিন্তা দেকার্তের মধ্যেও হাজির ছিল। তিনি যখন শোনা কথা অনুকরণ করতে সক্ষম তোতা পাখি এবং পরিস্থিতিমাফিক নতুন কথা বলতে সক্ষম মানুষের মধ্যে পার্থক্যের কথা বলেন; অতপর যখন তিনি এখান থেকে কিছু বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করে পদার্থবিদ্যার সীমানার মধ্যে স্থাপন করেন এবং আমাদেরকে, আধুনিক পরিভাষায় বললে, মন-এর বিজ্ঞানের দিকে নিয়ে যান তখন আমার মনে হয় তিনি আসলে সেই ধরনের সৃজনশীলতার কথাই বলছেন যেরূপ ধারণা আমিও বিশ্বাস করি; একইসাথে, এরূপ ধারণাসমূহের অপরাপর উৎস সম্পর্কে আপনার অভিমতের সাথেও আমি সম্পূর্ণই একমত।

বস্তুত স্যার উইলিয়াম জোন্স ও তৎকালীন অন্যান্য ভাষাবিজ্ঞানী-পরবর্তী বিপুল অগ্রগতির কালে এবং সার্বিকভাবে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এইসকল ধারণা এবং এমনকি বাক্যকাঠামোর বিন্যাসকরণ ধারণাটিও সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করা হয়েছিল।

কিন্তু আমার মতে এখন আমরা ওই যুগকে – যে-যুগে এসব ধারণার অস্তিত্বই নেই বলে মিথ্যে ভান করা হয়েছিল – পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারি এবং ভিন্নতর সমস্যাগুলোর দিকে নজর দিতে পারি। আজকের তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এবং সেইসাথে, আমার মতে কাঠামোবাদী ভাষাতত্ত্ব, ও বহুলাংশে আচরণ-মনোবিজ্ঞান এবং মন ও আচরণ অধ্যয়নের লক্ষ্যে অভিজ্ঞাতাবাদী ধারা থেকে গড়ে-ওঠা শাস্ত্রগুলোতে বস্ত্তত এসকল সীমাবদ্ধতা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব এবং আমাদের বিচারবিবেচনার জন্য ঠিক সেইসকল প্রসঙ্গ উত্থাপন করা সম্ভব যা সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ব্যাপক চিমত্মাভাবনা ও ধারণার উদ্রেক করেছিল। এগুলোকে এখন আরও বিস্তৃত, এবং আমার মতে আরও গভীর মানববিজ্ঞানের আওতাভুক্ত করা সম্ভব, যা মানুষের পূর্ণতর ভূমিকা স্বীকার করবে- যদিও নিশ্চয়ই আশা করা বাতুলতা হবে যে, নির্দিষ্ট কিছু বিধান-সমগ্রক ও ছক-মাফিকতার আওতায় থেকে এই গভীরতর মানববিজ্ঞান উদ্ভাবনা, সৃজনশীলতা, স্বাধীনতা এবং নতুন নতুন অস্তিত্বসমূহ, চিন্তা ও আচরণের নতুন বিষয় নির্মাণ সম্পর্কে পরিপূর্ণ উপলব্ধি তৈরি করতে সক্ষম হবে। তথাপি আমার মনে হয়, এখন আমরা এই সকল ধারণা বোঝাপড়া করার চেষ্টা নিতে পারি।

এল্ডার্স: বেশ, প্রথমেই আমি আপনাদের জবাব এতোটা দীর্ঘায়িত না-করতে অনুরোধ করতে চাই। [ফুকো মুচকি হাসেন]

সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতা প্রসঙ্গে আপনাদের আলাপ থেকে আমার মনে হয়েছে, আপনাদের ভুল বোঝাবুঝির একটা উৎস হলো, যদি আদৌ কোনো ভুল বোঝাবুঝি ঘটে থাকে আরকি, জনাব চমস্কি সীমাহীন প্রয়োগ-সম্ভাবনাময় সীমিত সংখ্যক বিধানের অবস্থান থেকে যাত্রা করছেন; অন্যদিকে আপনি, জনাব ফুকো, আমাদের ঐতিহাসিক ও মনস্তাত্ত্বিক সিদ্ধান্ত প্রণয়নে ‘‘ঘের’’-ব্যবস্থার অনিবার্যতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করছেন, যে-ঘের প্রকৃতপক্ষে আমাদের যেকোনো নতুন ধারণা উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও জারি থাকে।

আমরা হয়তো, বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া বিশ্লেষণের মাধ্যমে নয় বরং আমাদের নিজস্ব চিন্তা-প্রক্রিয়া বিশ্লেষণের মাধ্যমেই এই প্রসঙ্গগুলো বুঝে নিতে পারি।

আপনি, জনাব ফুকো, যখন মৌলিক কোনো ধারণা আবিষ্কার করেন, নিজস্ব সৃজনশীলতার বিবেচনায় আপনি কি মনে করেন যে আপনার ভিতরে একটা কিছু ঘটে চলেছে যা আপনাকে একধরনের মুক্তির স্বাদ এনে দিচ্ছে – যেন নতুন একটা কিছু সৃষ্টি করেছেন? যদিও, হয়তো হতে পারে যে কিছুক্ষণ বাদেই আপনি দেখতে পেলেন বিষয়টি অতোটা নতুন নয়। কিন্তু আপনি কি নিজে বিশ্বাস করেন যে আপনার ব্যক্তিত্বের অভ্যন্তরে সৃজনশীলতা ও স্বাধীনতা একইসাথে ক্রিয়াশীল?

ফুকো: ওহ! আপনি জানেন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সমস্যাটি আমার কাছে অতোটা গুরুত্বপূর্ণ না…

এল্ডার্স: কেন নয়?

ফুকো: …অন্তত এরূপ প্রশ্নের ক্ষেত্রে। না, আমি বিশ্বাস করি জনাব চমস্কি যে-কথাগুলো বলেছেন এবং আমি যেটা দেখাতে চেষ্টা করেছি তার মধ্যে সত্যিই গভীর সাদৃশ্য আছে: অন্যভাবে বললে, সৃজনের বা উদ্ভাবনের একটাই মাত্র রাস্তা আছে। ভাষা বা জ্ঞানের ক্ষেত্রে কেবল নির্দিষ্ট কিছু বিধান সক্রিয় করার মাধ্যমেই কারো পক্ষে নতুন কিছু সৃজন করা সম্ভব, যে-বিধানসমূহ এই সৃজিত বিবৃতির গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যাকরণিক (grammatical) বৈধতা নির্ধারণ করে কিংবা জ্ঞানের বেলায় বিবৃতিটি বিজ্ঞানসম্মত কিনা সেটা নির্ণয় করে।

সুতরাং, আমরা সাধারণভাবে বলতে পারি, জনাব চমস্কি-পূর্ববর্তী ভাষাবিদেরা প্রধানত বাক্য নির্মাণের গঠনগত বিধানগুলোর ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রতিটি নতুন বাক্য পরিবেশনায় বা প্রতিটি নতুন বাক্য শ্রবণে-অনুধাবনে ব্যক্তির অভিনবত্বকে কম গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অন্যদিকে, বিজ্ঞানের ইতিহাসে বা চিন্তার ইতিহাসে আমরা সৃজনকারী ব্যক্তির ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছিলাম এবং সম্প্রদায়গত, সর্বজনীন বিধানগুলোকে পাশে অন্ধকারে সরিয়ে রেখেছিলাম, যে-বিধানগুলো প্রকৃতপক্ষে দুর্বোধ্য কায়দায় প্রতিটি বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মধ্যে, প্রতিটি বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনার মধ্যে, এবং এমনকি প্রতিটি দার্শনিক ভাবনা সৃষ্টির মধ্যে জারি থাকে।

সুতরাং, নিঃসন্দেহে ভুল করে আমি যখন ভাবি যে আমি অভিনব কিছু একটা বলছি, আমি তখনও সজাগ থাকি যে আমার বক্তব্যের মধ্যে বিধানসমূহ সক্রিয় আছে- কেবল ভাষাগত বিধান নয়, বরং একইসাথে জ্ঞানতত্ত্বীয় এবং সাম্প্রতিক চিন্তাভাবনার বৈশিষ্ট্যমন্ডিত বিধানগুলোও ক্রিয়াশীল আছে।

চমস্কি: বেশ, আপনার এই অভিমতগুলোর প্রতি আমার নিজস্ব পরিসর থেকে কিছু বলার চেষ্টা করতে পারি, যা হয়তো বিষয়গুলো স্পষ্টতর করতে সাহায্য করবে।[youtube id=”oyg-Gssr1cs”]

আবারও একজন মানব শিশুর কথা ধরা যাক যার মনের গভীরে কিছু অনুপুঙ্খ-ছক বিদ্যমান, যা নির্ধারণ করে দেয় সে কীভাবে কোন্ ধরনের ভাষা শিখবে- ঠিক আছে? এবং তারপরে, অভিজ্ঞতার সুবাদে সে খুবই দ্রুত ভাষাটি শিখে নেয়, যে-ভাষায় বস্ত্তত এই অভিজ্ঞতা হলো অংশবিশেষ বা এই অভিজ্ঞতা সেখানে অর্ন্তভুক্ত হয়। এখন, এটা হলো স্বভাবসুলভ সক্রিয়তা বা স্বাভাবিক বুদ্ধিমত্তার একটি কাজ; কিন্তু একইসাথে এটা অত্যন্ত সৃজনশীল কাজও বটে।

মঙ্গল গ্রহের কোনো বাসিন্দা যদি এই হাস্যকর রকমের স্বল্প উপাত্তের ভিত্তিতে একটা দুরূহ-জটিল-সুবিপুল জ্ঞানব্যবস্থা অর্জনের প্রক্রিয়াটি দেখতে পেত তাহলে সে এটাকে অত্যন্ত সৃজনশীল ও বড় মাপের একটা উদ্ভাবনী কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করতো। আমার মতে, এই মঙ্গলগ্রহবাসী বস্ত্তত এটাকে সামান্য কিছু উপাত্তের ভিত্তিতে একজন পদার্থবিদের কোনো প্রাকৃতিক তত্ত্ব উদ্ভাবনের মতো একটা অর্জন হিসেবে বিবেচনা করতো।

যাহোক, আমাদের এই কল্পিত মঙ্গলগ্রহবাসী যদি এর পরে দেখতে পেত যে প্রতিটি স্বাভাবিক মানবশিশুই অবিলম্বে অবলীলায় এই সৃজনশীল কাজটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়ে ওঠে এবং একেবারে জটিলতামুক্তভাবে তারা সকলেই একইভাবে এই কাজটি করে, কিন্তু তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে ক্রমান্বয়ে একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে পৌঁছানোর জন্য অসংখ্য প্রতিভাবানের শত শত বছর লেগে যায় তাহলে এই মঙ্গলবাসী, যদি যুক্তিশীল হন, সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেন যে ভাষাশিক্ষার বেলায় যে-জ্ঞান-কাঠামোর প্রয়োজন হয় তা বস্ত্তত মানব মনের অমত্মর্গত একটা ব্যাপার; কিন্তু পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে আবশ্যক কাঠামোটি অতোটা প্রত্যক্ষভাবে মানব মনের অন্তর্গত নয়। আমাদের মন ঠিক ওইভাবে গড়ে ওঠেনি, ফলে আমরা যখন প্রাকৃতিক প্রপঞ্চ অধ্যয়নে লিপ্ত হই তখন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যা এসে পড়ে, এবং আমরা সেটাকে লিখে ফেলি ও একটি জ্ঞানকান্ডরূপে পরিবেশন করি; আমাদের মনের পরিগঠন এর সাথে মেলে না।

কিন্তু তথাপি, আমার মনে হয় এই দুই প্রকারের সৃজনশীলতার মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে, এবং সেহেতু বিষয়টির বিশদ ব্যাখ্যা উপকারে আসতে পারে: আসলে, কীভাবে আমাদের পক্ষে যে-কোনোরকমের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নির্মাণ সম্ভব হয়? কীভাবে ক্ষুদ্র পরিমাণ উপাত্তের ওপর ভর করেও, বিভিন্ন বিজ্ঞানী এবং এমনকি বিভিন্ন প্রতিভাবানের পক্ষে দীর্ঘ সময়ের ধারায় কোনো তত্ত্বে পৌঁছানো সম্ভব হয়, যে-তত্ত্বটি কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্তত গভীরতাময় এবং সন্তোষজনকরূপে প্রয়োগসিদ্ধতার গুণসম্পন্ন?

এটা অনন্যসাধারণ এক ঘটনা।

বস্ত্তত, প্রতিভাধর ব্যক্তিবর্গ ও বিজ্ঞানীরা যদি সম্ভবযোগ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের আওতা সম্পর্কে খুব ক্ষুদ্র সীমা-বিধি (narrow limitation) মেনে কাজ শুরু না-করতো, বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বলতে আসলে সম্ভাব্য কী কী বুঝায় সে-সম্পর্কে তারা যদি নিজেদের মনের মধ্যে কোনো-না-কোনোভাবে একটি অপরিত্যাজ্য অচেতন রূপরেখা গড়ে না-তুলতো, তাহলে তাদের পক্ষে কোনো আরোহী লাফে (inductive leap) সিদ্ধান্তে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব হতো না: ঠিক যেরূপ প্রতিটি শিশু তার মনের মধ্যে ক্ষুদ্র সীমা-বিধিসম্পন্ন মানব-ভাষার ধারণা গড়ে না-তুললে তার পক্ষে উপাত্ত থেকে আরোহী লাফে একটি ভাষিক জ্ঞানব্যবস্থায় উত্তীর্ণ হওয়া আদৌ সম্ভব হতো না।

সুতরাং বলা যায়, উপাত্ত থেকে পদার্থবিদ্যাগত জ্ঞান আহরণের প্রক্রিয়াটি যদিও আমাদের মতো প্রাণীসত্তার পক্ষে অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি দুরূহ, দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ, প্রতিভাধরদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয় ইত্যাদি, তবুও কিছু বিবেচনায়, প্রকৃতিবিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞান কিংবা যে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথাই বলেন না কেন সেটা অনেকটাই একজন স্বাভাবিক শিশুর ভাষিক-কাঠামো আবিষ্কারের মতো অর্জনের তুল্য: অর্থাৎ, এটা অর্জনের জন্য অনিবার্যভাবেই আদি সীমা-বিধির ওপর, তত্ত্বের সম্ভবযোগ্য বর্গ সম্পর্কে ধারণার ওপর নির্ভর করতে হবে। আপনি যদি তত্ত্বের সম্ভাব্য প্রকৃতি সম্পর্কে কিছু না-জেনে অগ্রসর হন তাহলে আপনার পক্ষে আদৌ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। তখন উপাত্তের ভিত্তিতে আপনি যে-কোনো দিকে, যে-কোনো লক্ষ্যে গিয়ে হাজির হতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে, বিজ্ঞানের সমকেন্দ্রী-যাত্রা ও অগ্রগতি আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তোলে যে এরূপ আদি সীমা-বিধি ও কাঠামো জারি আছে।

আমরা সত্যিই যদি বৈজ্ঞানিক সৃজন বা শৈল্পিক সৃজন সম্পর্কে তত্ত্ব গড়ে তুলতে আগ্রহী হই তাহলে, আমার মনে হয় একদিকে সুনির্দিষ্টভাবে ওই শর্তগুচ্ছের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে, আমাদের সম্ভাব্য জ্ঞানের সীমা ও আওতা নির্দিষ্ট করতে হবে এবং অন্যদিকে একই সাথে, ক্ষুদ্র পরিমাণ উপাত্তের ভিত্তিতে আরোহী লাফে জটিল জ্ঞান-ব্যবস্থায় উত্তরণের রাস্তা তৈরি করতে হবে। আমার মনে হয়, বৈজ্ঞানিক সৃজনশীলতার তত্ত্ব কিংবা যেকোনো রকমের জ্ঞান-তত্ত্বের দিকে অগ্রসর হওয়ার বস্ত্তত এইটাই পদ্ধতি হতে পারে।

এল্ডার্স: বেশ, আমরা যদি সকলরকম সৃজনসম্ভাবনাময় আদি সীমা-বিধির বিষয়টি বিবেচনায় নিই তাহলে আমার মনে এরূপ ধারণা হচ্ছে যে জনাব চমস্কির কাছে বিধিবিধান ও স্বাধীনতা পরস্পরের বিরুদ্ধ নয় বরং অনেকটা পরিপূরক। কিন্তু অন্যদিকে, আমার মনে হয়েছে জনাব ফুকো, আপনার কাছে বিষয়টি ঠিক উল্টো। আপনার পক্ষ থেকে বিষয়টিকে একবারে বিপরীত অবস্থান থেকে দেখার যুক্তি কী, যেহেতু এটা আজকের বিতর্কের খুবই মৌলিক একটা প্রসঙ্গ, আমার মনে হয় আমরা বিষয়টি বিশদ আলোচনা করতে পারি।

অন্যভাবে সমস্যাটি পেশ করতে চাইলে বলা যায়: আপনি কি কোনোরূপ দমন-পীড়নমুক্ত সর্বজনীন জ্ঞানের কথা ভাবতে পারেন?

ফুকো: আচ্ছা বলছি, এইমাত্র জনাব চমস্কি যে-কথাগুলো বললেন সেখানে কিছু কিছু ব্যাপার আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকেছে, হয়তো আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারিনি।

আমার বিশ্বাস, আপনারা বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ক্ষেত্রে সীমিত সংখ্যক সম্ভাবনার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলছিলেন। আপনি যদি একেবারে স্বল্প সময়সীমার ভিতরে নিজেকে কেন্দ্রীভূত করেন তাহলে অগ্রসরতার ধারণা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি যদি দীর্ঘতর সময়সীমা বিবেচনায় নেন তাহলে দেখতে পাবেন, আমার কাছে বিস্ময়কর ঠেকেছে যে, বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনার সম্প্রসারণ ঘটেছে মূলত নানারকমের বিচ্ছেদের মাধ্যমে।

দীর্ঘকালযাবত এরূপ ধারণা টিকে ছিল যে বিজ্ঞানসমূহ, জ্ঞানকান্ডসমূহ ‘‘প্রবৃদ্ধির’’ নীতি ও সমকেন্দ্রমুখিতার নীতি মেনে একরকমের ‘‘প্রগতির’’ পথ অনুসরণ করেছে। কিন্তু তারপরও, কেউ যদি লক্ষ্য করে দেখেন কীভাবে ইউরোপীয় উপলব্ধির প্রসার ঘটেছে – নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিচারে যা ক্রমশ বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন উপলব্ধির রূপ গ্রহণ করে – তাহলে কি বলা যায় সেখানে আদৌ কোনোরূপ প্রবৃদ্ধির ব্যাপার ছিল? আমি নিজে বরং এটাকে একধরনের রূপান্তর হিসেবেই আখ্যায়িত করবো।

উদাহরণস্বরূপ উদ্ভিদজগতের শ্রেণীবিন্যাসের কথাই ধরেন, মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন বিধান মোতাবেক কতো অসংখ্যবার এর শ্রেণীবিন্যাস কি পুনর্লিখিত হয়নি: প্রতীকবাদের দ্বারা, প্রাকৃতিক ইতিহাস দ্বারা, তুলনামূলক অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যা দ্বারা, বিবর্তন তত্ত্ব দ্বারা। আর প্রতিটি পুনর্লিখনই জ্ঞানব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল এর কার্যকারিতার দিক থেকে, বিন্যাসের দিক থেকে, অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের দিক থেকে। আপনি এখানে প্রবৃদ্ধির তুলনায় বরং বিচ্ছেদ নীতির ক্রিয়াশীলতা অনেক বেশি দেখতে পাবেন। আমি তাই বলবো, স্বল্প কয়েক ধরনের জ্ঞানকেই যুগপৎ বিভিন্নরকমভাবে নির্মাণ করা যায়। সুতরাং বিশেষ একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, প্রতিটা নির্দিষ্ট যুগের জ্ঞানব্যবস্থাগুলোর বাইরে বাড়তি কিছু উপাত্ত থেকে যায়, কিন্তু জ্ঞানব্যবস্থাগুলো তার নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে আমাদেরকে বন্দী রেখে ওই বাড়তি উপাত্তসমূহ উপলব্ধি করতে বাধ্য করে এমনকি নিজ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, ফল হয় এই যে আমরা সেগুলোর সৃজনশীলতা অনুধাবনে ব্যর্থ হই। একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বললে, সবসময় বাড়তি কিছু অবশিষ্টরূপে পড়ে থাকে এবং ক্ষুদ্র পরিমাণ উপাত্ত সত্ত্বেও বিভিন্ন রকমের জ্ঞানব্যবস্থার বিস্তার ঘটতে থাকে, ফলত সর্বব্যাপী ধারণা গজায় যে সেগুলো যেন বিজ্ঞানের ইতিহাসের গতিশীলতা নির্ণায়ক নতুন নতুন আবিষ্কার।

চমস্কি: এখানে আবারও আমি একটু সারসংক্ষেপ করার চেষ্টা করতে পারি। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্পর্কে আপনার ধারণার সাথে আমি একমত; অর্থাৎ, আমিও বিশ্বাস করি না যে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি মানে কেবলই সঞ্চিত নতুন জ্ঞানের বাড়তি সংযোজন বা নতুন তত্ত্ব আত্মীকরণ ইত্যাদির মতো কোনো ব্যাপার। বরং, আমার মনে হয় আপনি যেরূপ বললেন, বিজ্ঞান বাঁকাচোরা পথে অগ্রসর হয়েছে, কিছু সমস্যা এড়িয়ে গেছে এবং নতুন তত্ত্বে উত্তরণ করেছে …

ফুকো: এবং, অবিকল একই জ্ঞানকে রূপান্তরের মাধ্যমে নতুন মোড়কে পরিবেশন করেছে।

চমস্কি: ঠিকই বলেছেন। তবে আমার মনে হয়, এর একটা ব্যাখ্যা হাজির করার ঝুঁকি নেয়া যেতে পারে। আমি বস্ত্তত এখন যা বলতে যাচ্ছি সেটা আক্ষরিক অর্থে নেয়া যাবে না, কেননা অতি-সরলীকরণের মাধ্যমে কেউ হয়তো ভেবে নিতে পারেন যে সার্বিকভাবে নিম্নবর্ণিত ব্যাখ্যাটাই কেবল সঠিক। ব্যাখ্যাটা এরকম- একটা বিশেষ জৈবিক রূপকাঠামোভিত্তিক মানব-সত্তা হিসেবে, জীবন আরম্ভ করার জন্য আমাদের মাথার মধ্যে নির্দিষ্ট কয়েকগুচ্ছ সম্ভবযোগ্য বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো বিদ্যমান থাকে, ঠিক আছে?

এখন, কোনো সুপ্রসন্ন পরিস্থিতিতে হয়তো বাস্তবতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য আমাদের মনের কাঠামোর সাথে মিলে যায়, ফলে আমরা সেখানে একটা বিজ্ঞান লাভ করি: অর্থাৎ বলা যায়, সৌভাগ্যবশত আমাদের অন্তর্গত মনোকাঠামো এবং বাস্তবতার কিছু দিকের বৈশিষ্ট্যাদি পর্যাপ্ত পরিমাণে মিলে গেলে আমরা একটা বোধগম্য বিজ্ঞান গঠন করতে পারি।

বিশেষ বিশেষ প্রকারের সম্ভবযোগ্য বিজ্ঞান নিয়ে আমাদের মনের ভিতরে বিদ্যমান এই আদি সীমা-বিধিই মূলত বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সৃজনশীলতাকে এতো বিপুল ঐশ্বর্যময় করে তোলে। এখানে গুরুত্ব দেয়া জরুরি যে – এবং আপনার [এল্ডার্স] উত্থাপিত বিধিবিধান ও স্বাধীনতার প্রশ্নের ক্ষেত্রে এটা প্রাসঙ্গিকও বটে – আদি সীমাবিধি যদি না-থাকতো তাহলে সৃজনশীল তৎপরতার মাধ্যমে সামান্য একটুখানি জ্ঞান থেকে, সামান্য একটু অভিজ্ঞতা থেকে কোনো একটি সমৃদ্ধ ও সুব্যক্ত (articulated) এবং দুরূহ জ্ঞানব্যবস্থায় পৌঁছানো আদৌ সম্ভব হতো না। কারণ সববিছুই যদি আমরা সম্ভব মনে করি তাহলে আসলে কোনোকিছুই সম্ভব হয় না।

আসলে আমাদের মনের এই বৈশিষ্ট্যসমূহের (properties) সুবাদেই – যার খুঁটিনাটি দিকগুলো এখনও আমরা বুঝতে পারি না, কিন্তু আমার মনে হয় অত্যন্ত সাধারণভাবে অনুধাবনের কাজটি শুরু করা যায় – আমরা মূলত কিছু বোধগম্য কাঠামোর অধিকারী হই, এবং ইতিহাস, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার পরিক্রমায় এই অর্ন্তকাঠামোগুলো পাদপ্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয় কিংবা দৃষ্টির আবডালে চলে যায় ইত্যাদি; আমার মতে আপনি যেমন বললেন, আমাদের মনের এই স্বত্ব’র কারণেই বিজ্ঞানের পথ-চলা ঐরূপ বাঁকাচোরা ধাঁচ ও অনিশ্চয়তা আকীর্ণ।

এর অর্থ এই নয় যে সবকিছুই চূড়ান্তবিচারে বিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, আমরা বুঝতে আগ্রহী হবো এরূপ অনেক বিষয় এবং হয়তো আমরা যে-বিষয়গুলো বুঝতে সবচে পছন্দ করবো, যেমন মানবপ্রকৃতির ধারণা, একটি শিষ্ট সমাজের স্বরূপ বা এরকম আরও বহু বিষয়, সত্যিকারার্থেই সম্ভাবযোগ্য মানববিজ্ঞানের আওতার বাইরে পড়বে।

এল্ডার্স: এইখানে এসে আমার মনে হচ্ছে সীমা-বিধি ও স্বাধীনতার অন্তর্গত সম্পর্কের প্রশ্নে আমরা আবারও সংঘাতময় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। জনাব ফুকো, আপনি কি সীমা-বিধির সমন্বয় ধারণার সাথে একমত … আদি সীমা-বিধির সমন্বয়?

ফুকো: এটা কোনো সমন্বয়ের ব্যাপার নয়। একগুচ্ছ বিধান সচল করার মাধ্যমেই কেবলমাত্র কোনো সৃজনশীলতা সম্ভব; এটা বিধি-বিধান ও স্বাধীনতার সংমিশ্রণের ব্যাপার নয়।

তবে যেইখানটাতে আমি জনাব চমস্কির সাথে হয়তো পুরোপুরি একমত হতে পারবো না তা হলো, তিনি যখন সীমা-বিধির এই নীতিকে মানবমনের বা মানবপ্রকৃতির অন্তর্গত একটা ব্যাপার হিসেবে নির্ধারণ করেন।

ব্যাপারটা যদি এরকম হয় যে এই বিধানগুলোকে মানব-মন যথাযথভাবে সক্রিয় করে তোলে কিনা, মেনে নিতে রাজি আছি; এটাও মেনে নিতে পারি যদি বিষয়টি এরূপ হয় যে ভাষাতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিকরা তাদের শাস্ত্রীয় অবস্থান থেকে নিজেদের মতো করে বিধানগুলো বিচার করতে পারেন কিনা; যদি বলা হয়, ব্যক্তি যা-কিছু বলতে চায় বা ভাবতে চায় তা সম্ভব করে তোলে এই বিধানগুলো, সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু যদি বলা হয়, এই বিধি-বিধানগুলো অস্তিত্বের শর্ত হিসেবে মানব-মন বা মানবপ্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত, তাহলে আমার পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া দুষ্কর: আমার মনে হয় এতোদূর পর্যন্ত ভাবার পূর্বে আমাদেরকে অবশ্যই – এখানে আমি কেবলই উপলব্ধি প্রসঙ্গে বলছি – অর্থনীতি, প্রযুক্তি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব এবং মানববিদ্যার অন্যান্য এরকম ক্ষেত্রগুলোতে মানবপ্রকৃতি ধারণাটি বাদ দিয়ে সেই বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে যেগুলো এই বিধানসমূহের গড়ে-ওঠা, মডেল নির্মাণ, প্রতিষ্ঠা করা ও দৃশ্যমান করার শর্ত হিসেবে কাজ করে। আমি জানতে আগ্রহী কারো পক্ষে বিজ্ঞানকে সম্ভব-করে-তোলা এই সীমা-বিধি ব্যবস্থাগুলোকে, এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাগুলোকে অন্য কোথাও, এমনকি মানবমনেরও বাইরে সামাজকাঠামোর মধ্যে, উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে, শ্রেণী-সংগ্রাম ইত্যাদির মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব কিনা।

যেমন আমার মনে হয়েছে, পাশ্চাত্যে একটা সময়ে এসে মস্তিষ্কবিকৃতি বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের ও জ্ঞানের বিষয়বস্ত্ত হয়ে-ওঠার ব্যাপারটি ছিল একটা নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত।

জনাব চমস্কি ও আমার মধ্যে পার্থক্য হয়তো এইখানে যে তিনি যখন বিজ্ঞানের কথা বলছেন তখন তিনি সম্ভবত জ্ঞানের রূপগত (formal) বিন্যাসকে বোঝাতে চাচ্ছেন; কিন্তু আমি খোদ জ্ঞান বিষয়টাকেই বোঝাচ্ছি, অর্থাৎ বলা যায় আমি বিভিন্ন জ্ঞানব্যবস্থার সারবত্তার কথা বলছি, যা কোনো একটি নির্দিষ্ট সমাজের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে, প্রবাহিত হয় এবং শিক্ষাদীক্ষা, তত্ত্বায়ন ও অনুশীলন ইত্যাদির বুনিয়াদি ভিত হিসেবে কর্তৃত্ব জাহের করে।

এল্ডার্স: কিন্তু, আপনার ব্যক্তিসত্তার মৃত্যু বা উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর অবসান ধারণার ক্ষেত্রে, জ্ঞান বিষয়ক আপনার এই তত্ত্ব কী অর্থ বহন করে?

ফুকো: আমরা যে-বিষয় নিয়ে কথা বলছি তার সাথে তো এর কোনো সম্পর্ক নাই।

 

Series Navigation<< তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো (পার্ট থ্রি)তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (লাস্ট পার্ট) >>
The following two tabs change content below.
Avatar photo

আ-আল মামুন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →