Main menu

তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো (পার্ট থ্রি)

This entry is part 3 of 5 in the series তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো

প্রথম এবং দ্বিতীয় পার্ট-এ চমস্কি এবং ফুকো’র কাজ সর্ম্পকে বলা হইছিল। এই পার্টে, তর্ক সম্পর্কে অনুবাদকের অবজারভেশন এবং তর্কের প্রথম বারো মিনিটের বাংলা ট্রান্সক্রিপশন রাখা হইলো।

________________

 

[৩]

১৯৭১ সালে নোম চমস্কি এবং মিশেল ফুকো নেদারল্যান্ডের একটা টেলিভিশনে মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা শীর্ষক বিতর্ক অনুষ্ঠানে প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয়েছিলেন। এই তর্কানুষ্ঠান থেকে দুইজন চিন্তাবিদের মধ্যে কিছু পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। দু’জনাই চলমান সামাজিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে তীব্র সমালোচনামুখর হলেও মানবসত্তার প্রকৃতি সম্পর্কে, ক্ষমতা ও ন্যায্যতা সম্পর্কে তাদের মৌল অনুমান এবং এ-সকল বিষয় অনুধাবনের পদ্ধতির প্রশ্নে তাদের ভাবনা পুরোপুরি আলাদা।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

চমস্কি মনে করেন শাশ্বত মানবপ্রকৃতি বলে অবশ্যই একটা কিছু আছে। তার বিবেচনায় এটাই মূলত ভিত্তি: মোটামুটি সুস্থির একটা মানবপ্রকৃতি যদি না-থাকে তবে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক উপলব্ধিতে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। নিজের গবেষণাধীন বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করে তিনি প্রশ্ন তোলেন: প্রতিটি সংস্কৃতিতেই আংশিক ও গুরুতর রকম খন্ডিত অভিজ্ঞতাগুচ্ছের ওপর নির্ভর করেও মানুষ কীভাবে তাদের মাতৃভাষা কেবল শিখতেই সক্ষম হন না, খুবই সৃজনশীলভাবে সেই ভাষা ব্যবহারও করতে পারেন? চমস্কির মতে এর একটাই মাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে: মনের ভিত্তিস্বরূপ একটা জৈব-শারীরিক কাঠামো অবশ্যই বিদ্যমান, যা মানবপ্রজাতির সদস্য হিসেবে এবং সেইসাথে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে, আমাদেরকে বহুরূপ ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাগুচ্ছ থেকে একটি সুসমন্বিত ভাষায় পৌঁছাতে সক্ষম করে তোলে। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ‘আমাদের সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিক আচরণ পরিচালনাকারী এই বিপুল অনুপুঙ্খ-পরিকল্পনা বা সহজাত-বিন্যাস-নীতির সমগ্রককেই আমি মানবপ্রকৃতি বলে আখ্যায়িত করি …[অর্থাৎ] জৈবিকসূত্রে প্রাপ্ত অপরিবর্তনীয় একটা কিছু আছে, যেটা আমাদের মানসিক সামর্থ্য দিয়ে যা-কিছু করি না কেন তার ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করে’। চমস্কি তার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান-চেষ্টা নিয়োজিত করেছেন মূলত মানবমনের এই কাঠামোসমূহ অনুসন্ধানে। বলা যায়, মন ব্যাখ্যার উপযোগী একটা পরীক্ষাযোগ্য গাণিতিক তত্ত্ব নির্মাণই তার লক্ষ্য।

মানবপ্রকৃতি ও মানববিজ্ঞান সম্পর্কে চমস্কির বক্তব্য সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করেন মিশেল ফুকো। মানবপ্রকৃতি বলে আদৌ কিছু একটা আছে নাকি নেই- এরূপ বিমূর্ত প্রশ্ন স্বভাবসুলভ কায়দায় ফুকো এড়িয়ে যান এবং এর বদলে প্রশ্ন তোলেন: খোদ মানবপ্রকৃতি ধারণাটি আমাদের সমাজে বিভিন্ন সময়ে কীরূপ ভূমিকা পালন করেছে? আঠারো শতকের প্রাণীবিদ্যাসমূহের উদাহরণ টেনে ফুকো নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কালে বিশেষ বিশেষ জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরে ক্রিয়াতৎপর বর্গ-ধারণাসমূহ এবং ‘প্রাণ’ বা ‘মানবপ্রকৃতি’র মতো ইতিহাসোর্ধ ধারণাগত মাইলফলকগুলোর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করেন। ফুকোর মতে, ইতিহাসোর্ধ ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সাধনে খুব সামান্যই ভূমিকা রেখেছে। তার মতে, ‘একজন ভাষাতাত্ত্বিক যা গবেষণার মাধ্যমে বাগধ্বনির রূপান্তরের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, কিংবা একজন ফ্রয়েড স্বপ্ন বিশেস্নষণের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, কিংবা একজন সাংস্কৃতিক নৃবৈজ্ঞানিক মিথ-এর কাঠামো আবিষ্কার করেছিলেন সেটা প্রকৃতপক্ষে মানবপ্রকৃতি ছিল না। … জ্ঞানের ইতিহাসে মানবপ্রকৃতি ধারণাটি বস্তুত ধর্মতত্ত্ব কিংবা প্রাণীবিদ্যা কিংবা ইতিহাসের সাপেক্ষে বা বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডিসকোর্সকে প্রতিষ্ঠিত করতে জ্ঞানকান্ডীয় একটা সূচকের ভূমিকা পালন করেছে’।

সর্বজনীন সত্যতা দাবিকারী ধারণাগুলোর প্রতি ফুকো অত্যন্ত সন্দিহান। তিনি সেগুলো খারিজ করেন না, তবে সবসময় তিনি সেসব অতি-ধারণাগুলোর (grand abstractions) ঐতিহাসীকতা বিচার করার উদ্যোগ নেন। মানবপ্রকৃতি বলে কিছু আছে কি নেই সেব্যাপারে ফুকো শেষ পর্যন্ত কোনো অবস্থান নেন না। বরং আলোচনাটাকে তিনি ঘুরিয়ে নিয়ে অনুসন্ধান করেন ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে এধরনের ধারণা বিভিন্ন জ্ঞানকান্ডীয় পরিপ্রেক্ষিতে কোন্ সামাজিক ভুমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, ‘অর্থনীতি, প্রযুক্তি, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব এবং মানববিদ্যার অন্যান্য এরকম ক্ষেত্রগুলোতে মানবপ্রকৃতি ধারণাটি বাদ দিয়ে সেই বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে যেগুলো এই বিধানসমূহের গড়ে-ওঠা, মডেল নির্মাণ, প্রতিষ্ঠা করার শর্ত হিসেবে কাজ করে। আমি জানতে আগ্রহী কারো পক্ষে বিজ্ঞানকে সম্ভব-করে-তোলা এই সীমা-বিধি ব্যবস্থাগুলোকে, এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাগুলোকে অন্য কোথাও, এমনকি মানবমনেরও বাইরে সামাজকাঠামোর মধ্যে, উৎপাদন-সম্পর্কের মধ্যে, শ্রেণী-সংগ্রাম ইত্যাদির মধ্যে খুঁজে পাওয়া সম্ভব কিনা।’

ফুকোর বিবেচনায় সর্বজনীন উপলব্ধি বলে কিছু নেই, উপলব্ধি সবসময়ই ইতিহাস ও সমাজসাপেক্ষ। কোনোরূপ সর্বজনীনত্বের ওপর নির্ভর না-করে বিশেস্নষণকর্ম এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই তার কৌশল। পদ্ধতি হিসেবে ফুকো সর্বজনীন বলে স্বীকৃত মানবপ্রকৃতির মতো তথাকথিত অতি-ধারণাগুলোকে সবসময়ই ঐতিহাসীকরণের উদ্যোগ নেন এবং বিশেষ বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকান্ড ও বিশেষ সময়ের সামাজিক চর্চাসমূহের মধ্যে গড়ে-ওঠা সম্পর্কগুলো অনুধাবন করতে চান।

রাজনীতি নিয়ে আলোচনার সময়ও চমস্কি এবং ফুকোর মধ্যে অনুরূপ একগুচ্ছ মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে আসে। উভয়কে মডারেটর ফন এল্ডার্স জিজ্ঞাসা করেন, কেন তারা রাজনীতিতে আগ্রহী। চমস্কি সর্বজনীন মানবপ্রকৃতি ও যুক্তিশীলতার পরিসরে থেকে এর জবাব দেন। তার মতে, সৃজনশীল কাজ ও অনুসন্ধানের চাহিদা মানুষের মধ্যে সর্বজনীন। কিন্তু আমাদের সমাজে এইসব চাহিদা পূরণের সম্ভাবনা রুদ্ধ হয়। চমস্কি যুক্তি দেখান, আধুনিক প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের সুবাদে বর্তমানের শিল্পভিত্তিক সমাজগুলোতে অন্তঃত শ্রমের ক্লেষ ও বিচ্ছিন্নতা থেকে উত্তরণের উপায়সমূহ হাজির আছে। কিন্তু তারপরও সেখানে যদি এই লক্ষ্য অর্জন না-করা হয় তার জন্য বিজ্ঞান দায়ী নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন-কাঠামো দায়ী। সেহেতু, সত্যিকারের যে-সমস্যাটি আমাদেরকে অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে সেটা চরিত্রগত দিক থেকে রাজনৈতিক: কীভাবে একটা ন্যায্য সমাজ প্রতিষ্ঠিত করা যাবে যেখানে সৃজনশীলতা ও যুক্তিশীলতার রাজত্ব থাকবে। আমাদের কাজ হলো, ‘ভবিষ্যৎ ন্যায্য সমাজের একটা রূপকল্প তৈরির চেষ্টা করা। অর্থাৎ বলতে পারেন মানবমুখি সামাজিক তত্ত্ব গড়ে তুলতে হবে, যে-তত্ত্বটি যথাসম্ভব মানব-ভাব (essence) বা মানবপ্রকৃতির কিছু দৃঢ় ও সুকুমার ধারণার ওপর ভিত্তিশীল হবে’।

চমস্কির কাছে রাজনৈতিক পদক্ষেপের লক্ষ্য সুস্পষ্ট – কিংবা বলা যায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে – কারণ তা হবে বস্তুত যুক্তিশীলতা ও মানবপ্রকৃতি নির্দেশিত পথে পরিচালিত। একজন বুদ্ধিজীবীর কাজ মানবপ্রকৃতি ধারণাকে মানদন্ড হিসেবে ব্যবহার করে সেই মোতাবেক বিদ্যমান সমাজকে মূল্যায়ন করা এবং নিজেদের যুক্তিশীলতা দ্বারা অধিকতর ন্যায্য ও মানবিক একটা সমাজ-ব্যবস্থার রূপকল্প তৈরি করা। তার মতে, আমাদের রাজনৈতিক কর্মকান্ড সর্বজনীন যুক্তিশীলতা ও ন্যায্যতার ধারণা দ্বারা সুসঙ্গত রূপ পেতে পারে।

কেন রাজনীতিতে আগ্রহী এরূপ প্রশ্নের উত্তর দিতে ফুকো অস্বীকার করেন। তার বিবেচনায় এটা খুবই তুচ্ছ একটা প্রশ্ন। তিনি মনে করেন, রাজনীতিতে আগ্রহী হওয়ার কারণ পরিষ্কার বোধগম্য। এর বদলে রাজনীতিতে তার আগ্রহ কী-প্রকারের সে-সম্পর্কে বলেন। তিনি ‘আমাদের বৈজ্ঞানিক বা শিল্পনির্ভর সমাজ পরিচালনার উপযোগী কোনো আদর্শ মডেল’ প্রদানে আদৌ আগ্রহী নন। ফুকোর ব্যাখ্যামতে, পশ্চিমের রাজনৈতিক দর্শনের একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য (বা সীমাবদ্ধতা) হলো এই প্রকারের মডেল বা ইউটোপিয়া বা বিমূর্ত তত্ত্বের মুখাপেক্ষিতা। সমাজের জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থার কথা চিন্তা করতে যেয়ে পাশ্চাত্যে সর্বদাই ন্যায্য একটা মডেল নির্মাণ বা বিদ্যমান পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য কিছু সর্বজনীন নীতির সন্ধান করা হয়েছে। ফুকো দাবি করেন, বস্ত্তত এইরূপ গুরুত্বারোপ, এইরূপ মূলনীতির সন্ধান, এইরূপ ‘জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষার’ কারণে পশ্চিমা সমাজে ক্ষমতা-চর্চার প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধির ক্ষেত্রে আমরা প্রায় পুরোপুরিই অন্ধকারে ডুবে থেকেছি। তাই ফুকো মনে করেন, এইসব ইউটোপীয় ধ্যানধারণা একপাশে সরিয়ে রেখে বরং কীভাবে আমাদের সমাজে ক্ষমতা চর্চিত হচ্ছে সে-সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করাটাই আমাদের কাজ। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আমার মনে হয় আমাদের সমাজের মতো সমাজগুলোতে প্রকৃত রাজনৈতিক কাজ হলো, আপাতদৃষ্টিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা-নিরপেক্ষ ও -স্বাধীন প্রতীয়মান প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মতৎপরতার সমালোচনাত্মক মূল্যায়ন হাজির করা; এমনভাবে বিশেস্নষণ ও আক্রমণ চালাতে হবে যেন সদাসর্বদা তাদের মাধ্যমে অজ্ঞাত কায়দায় পরিচালিত রাজনৈতিক সহিংসতার স্বরূপ উন্মোচিত হয়, এবং মানুষ তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার পথ খুঁজে পায়’।

কিন্তু কেন আমরা রাজনৈতিক সহিংসতার বিরুদ্ধে লড়বো? চমস্কি এবং ফুকোর মধ্যে আবারও মতপার্থক্য দেখা দেয়। চমস্কির মতে, বর্তমান সমাজের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে হবে মূলত উচ্চতর লক্ষ্য ন্যায্যতা কায়েম করার জন্য। তিনি যুক্তি দেখান, কোনো দিকনির্দেশনা নীতি না-থাকলে আসলে আমরা মূল্যায়ন করতে পারি না। ফলে, আমরা এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের আবিষ্কার করতে পারি যেখানে ক্ষমতা থেকে বহিষ্কৃত গোষ্ঠীর তুলনায়ও হয়তো দেখা যাবে বিপ্লব নিকৃষ্টতর হয়ে উঠেছে। উন্নততর সমাজ বলতে আদপে কী বুঝায় সে-সম্পর্কে আমাদের সামনে নির্দিষ্ট কিছু যৌক্তিক মানদন্ড না-থাকলে আমরা বিভ্রান্ত হবো। চমস্কি যোগ করেন, এর মানে এমন নয় যে আমাদেরকে আগে থেকেই একটা নিখুঁত মানদন্ড নির্ধারণ করে ফেলতে হবে, কিন্তু একেবারেই যদি কোনো মানদন্ড না-থাকে তাহলে আমরা কর্মসূচি গ্রহণের বা বর্তমান সমাজকে বিচার করার দিশা পাবো না।

ফুকো দ্বিমত পোষণ করেন। এই প্রসঙ্গে ফুকো সবচেয়ে কট্টর অবস্থান নেন। তিনি বলেন, ‘খোদ ন্যায়পরায়ণতা ধারণাটি বিভিন্ন প্রকারের সমাজে নির্মাণ করা হয়েছে ও সক্রিয়ভাবে কাজে লাগানো হয়েছে প্রকৃতপক্ষে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতাগোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসেবে কিংবা ওই ক্ষমতার বিরুদ্ধে পক্ষের অস্ত্র হিসেবে। … মানবপ্রকৃতি, ন্যায়পরায়ণতা, মানব-সত্তার মৌল স্বভাবপ্রাপ্তি ইত্যাদি ধারণাসমূহ নির্মিত হয়েছে আমাদের বর্গভুক্ত সভ্যতার পরিসরে, আমাদের বর্গভুক্ত জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরে, আমাদের দর্শন-চিন্তার অভ্যন্তরে এবং কিছুটা, আমাদের শ্রেণীব্যবস্থার সুবাদে। সেহেতু, যতোই বেদনাদায়ক হোক না কেন, কেউ এই একই ধারণার সাহায্যে আমাদের সমাজের মূল ভিত্তিসমূহ উৎখাত করার লড়াইকে  বর্ণনা করতে বা সেই লড়াইয়ের যৌক্তিকতা তুলে ধরতে পারেন না’। ফুকো এই অবস্থানে অটল থাকেন। রাজনৈতিক লড়াইয়ে কখনোই ন্যায্যতার প্রশ্ন উঠবে না এমন কথা ফুকো বলছেন না। তবে তার মতে, রাজনৈতিক লড়াইয়ে লিপ্ত হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ক্ষমতা-সম্পর্কের রূপান্তর ঘটানো, ‘ন্যায্য’ সমাজ প্রতিষ্ঠার মতো কোনো ইউটোপীয় স্বপ্ন নয়।

তিনি মনে করেন, সকল প্রকার জ্ঞানই সদাসর্বদা আধিপত্যের নৈমিত্তিক সংঘাতের সাথে এবং একইসাথে বৃহত্তর লড়াইয়ের সঙ্গে জড়িত থেকেছে। জ্ঞান ক্ষমতার লড়াই থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো প্রপঞ্চ নয়। ফুকোর বিচারে, আমাদের সভ্যতায় ‘‘জ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা’’ একই সাথে বিপদের আলামতবাহী আবার বিপদ থেকে উত্তরণের হাতিয়ারও বটে।

————————

[১]

এল্ডার্স: সম্মানিত অভ্যাগতবৃন্দ, আন্তর্জাতিক দার্শনিক প্রকল্পের i তৃতীয় বিতর্ক-অনুষ্ঠানে আপনাদেরকে স্বাগতম। আজ রাতের তার্কিকরা হলেন কলেজ ডি ফ্রান্সের মিশেল ফুকো এবং ম্যাসাচুসেট্স ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির নোম চমস্কি। এই দুই দার্শনিকেরই মিলের জায়গা যেমন রয়েছে, তেমনই মতভিন্নতার জায়গাও। দুই দার্শনিককে তুলনা করার সবচেয়ে ভালো উপায় সম্ভবত তাদেরকে পাহাড়-খোদক হিসেবে দেখা, যারা পরস্পরের উল্টা দিক থেকে একই পাহাড় খুঁড়ে চলেছেন ভিন্ন ভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে, তারা এমনকি জানেনও না যে পরস্পরের দিকেই তারা এগিয়ে চলেছেন।

তবে, দু’জনাই তাদের কর্ম-তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন একেবারে অভিনব সব ধ্যান-ধারণা ব্যবহার করে; সর্বোচ্চ নিবিড়ভাবে তারা খুঁড়ে চলেছেন, সেইসাথে দর্শন ও রাজনীতির প্রতিও রয়েছে তাদের সমপরিমাণ অঙ্গীকার: আমার মনে হয়, দর্শন ও রাজনীতি বিষয়ে তাদের কাছ থেকে একটা চমকপ্রদ বিতর্ক প্রত্যাশা করার জন্য এতোটুকু বলাই যথেষ্ট।

তাই একটুও কালক্ষেপণ না-করে একটা কেন্দ্রীয় ও দীর্ঘস্থায়ী প্রশ্নের মাধ্যমে শুরু করতে চাই: মানবপ্রকৃতি বলতে কী বুঝায়?

ইতিহাসবিদ্যা থেকে শুরু করে ভাষাতত্ত্ব ও মনস্তত্ব পর্যমত্ম মানব-অধ্যয়নের সকল শাখা আজ এইরূপ প্রশ্নের মুখোমুখি: চূড়ান্ত বিচারে, আমরা সর্বপ্রকার বাহ্যিক পরিস্থিতি ও শর্তসমূহের দ্বারা সৃষ্ট নাকি আমাদের মধ্যে বিভিন্নতা সত্ত্বেও এমন কোনো অর্ন্তগত ব্যাপার আছে যাকে সর্বজনীন মানবপ্রকৃতি বলা চলে, যা-দ্বারা আমরা নিজেদেরকে মানবসত্তা হিসেবে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারি?

সুতরাং আমার প্রথম প্রশ্ন, জনাব চমস্কি, আপনার কাছে। কারণ আপনি হরহামেশাই মানবপ্রকৃতি ধারণাটি ব্যবহার করেন; এ-প্রসঙ্গে এমনকি ‘‘সহজাত ভাব’’ii (innate ideas) এবং ‘‘সহজাত কাঠামো’’ (innate structure)-এর মতো প্রত্যয়ও আপনাকে ব্যবহার করতে দেখা যায়। মানবপ্রকৃতি ধারণাটিকে গুরুত্বের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার পক্ষে ভাষাতত্ত্ব থেকে আপনি কী কোনো যৌক্তিকতা হাজির করতে পারেন?

চমস্কি: ঠিক আছে, আমি কিছুটা শাস্ত্রীয় কলাকৌশলগত ভাষার আশ্রয় নিয়ে শুরু করতে চাচ্ছি।

যে-কেউ ভাষা অধ্যয়নে আগ্রহী হলে আনিবার্যভাবে একটা বাস্তব সঙ্কটের মুখোমুখি হন। তিনি একটা পূর্ণবিকশিত প্রাণীসত্তা, কিংবা বলা যায় পরিণত বক্তার মুখোমুখি হন, যে-বক্তা কোনো-না-কোনোভাবে বিস্ময়কর মাত্রার সক্ষমতা অর্জন করেছেন। এই সক্ষমতা তাকে, বিশেষত, যেটা বোঝাতে চান ঠিকঠিক সেইটা বলতে এবং অন্য মানুষজন কী বলছে সেইটা বুঝতে সক্ষম করে তোলে। তাছাড়াও, তিনি এগুলো এমন পারঙ্গমতায় সম্পাদন করতে সক্ষম হয়ে ওঠেন যাকে আমার মতে অত্যন্ত সৃজনশীল বলাই শ্রেয়…। বলা চলে, অন্য যে-কারো সাথে স্বাভাবিক আলাপচারিতায় একজন ব্যক্তি যাকিছু বলেন তার বেশিরভাগটাই অভিনব; আপনি যা শোনেন তার বেশিরভাগটাই নতুন, আপনার পূর্ব-অভিজ্ঞতার কোনোকিছুর সাথে এগুলোর নিবিড় সাদৃশ্য থাকে না। এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো অভিনব আচরণ নয়, এগুলো এমন ধরনের আচরণ যা যথাযথরূপে পরিস্থিতিমাফিক। কিছুদিক বিবেচনায় এধরনের আচরণ সংজ্ঞায়িত করা অত্যন্ত দুরূহ এবং সত্যিকারার্থে এসব আচরণের ভিতর এমন অনেক বৈশিষ্ট্য জাহের থাকে যাকে সৃজনশীলতা বলাই যায়।

এখন, এই জটিল এবং সুব্যক্ত (highly articulated) ও সুসংবদ্ধ সক্ষমতাসমগ্রক – যে সক্ষমতাসমগ্রককে আমরা ভাষা-শিক্ষা বলে থাকি – অর্জনকারী একজন ব্যক্তি একটা নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতারাজীর সম্মুখীন হন: জীবনভর সময়জুড়ে তিনি একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ [ভাষিক] উপাত্ত গ্রহণ করেন, কোনো একটা ভাষায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।

এই ব্যক্তির কাছে বিদ্যমান উপাত্ত আমরা পরখ করে দেখতে পারি; কিন্তু সেটা পরখ করতে গেলে অন্তঃত নীতিগতভাবে আমরা একটা অনিবার্য যুক্তিসঙ্গত ও প্রত্যক্ষ বৈজ্ঞানিক সমস্যার সম্মুখীন হই, সমস্যাটা হলো: একজন শিশু হিসেবে তার কাছে পরিবেশিত গুণগত দিক থেকে অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত ও ক্ষুদ্র পরিমাণের উপাত্ত বনাম কোনো না কোনোভাবে এই উপাত্তের ওপর নির্ভর করেই তার দ্বারা অর্জিত অত্যমত্ম গ্রন্থিবদ্ধ, সুব্যক্ত (well articulated) ও গভীরভাবে সুসমন্বিত [ভাষিক] জ্ঞানের মধ্যকার ফারাক।

এছাড়াও আমরা লক্ষ করি, যেকোনো ভাষায় খুবই আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও বিভিন্ন ব্যক্তি তবু এমন [ভাষা] বিধানসমূহে এসে উপনীত হন যা তাদের সকলেরই চেনা। যেমন ধরেন, ইংরেজি ভাষার দু’জন বক্তা তাদের খুবই স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও যে বিধানসমূহে উপনীত হন তা পরস্পরের চেনা এই অর্থে যে, বিস্ময়কর মাত্রায় ও বহুল পরিমাণে, তাদের একজন যা-কিছু বলেন বিধানগুলোর সুবাদে অন্যজন সেটা বুঝতে পারেন।

এমনকি আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, আমরা লক্ষ করি অনেক ভাষাতেই, বস্ত্তত নিবিড় গবেষিত সকল ভাষাতেই, মানুষের খুবই ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও যে-বিধানসমূহ তাদের কাছে পাওয়া যায় তা অত্যমত্ম সীমিত ধরনের।

এই বিস্ময়কর প্রপঞ্চের একটাই সন্তোষজনক ব্যাখ্যা হতে পারে, ব্যাখ্যাটা আমি বরং গুছিয়ে হাজির করি। ব্যক্তি নিজে সক্রিয়ভাবে [ভাষার] সাধারণ নকশা-কাঠামো (general schematic structure) অর্জন এবং এমনকি সম্ভবত তার নিজস্ব বিক্ষিপ্ত ও সীমিত অভিজ্ঞতার বিশেষ জ্ঞান-ভান্ডারটি বিন্যাসের ক্ষেত্রেও অনেকটা, কিংবা বলা চলে বিপুল মাত্রায়, অবদান রাখে।

ভাষা-সক্ষম একজন ব্যক্তি সেই ভাষা-জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন কারণ খুবই সুনির্দিষ্ট ছক-মাফিক (Schematism) তিনি এই শিক্ষণ-অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন, যা তাকে বলে দেয় কী প্রকৃতির ভাষার সাথে তিনি পরিচিত হচ্ছেন। অর্থাৎ সোজাসুজি বলা যায়: [ভাষা শেখার বেলায়] শিশুকে অবশ্যই পূর্ব-জ্ঞানসহ শুরু করতে হয়। নিশ্চয়ই সেটা এমন কোনো পূর্বজ্ঞান নয় যে সে ইংরেজি শুনছে কিংবা ডাচ ভাষা শুনছে বা ফরাসি বা অন্য কোনো ভাষা শুনছে; বরং সে এরূপ পূর্বজ্ঞানসহ শুরু করে যে খুবই সীমাবদ্ধ ও সু-স্পষ্ট একটি মানব-ভাষা সে শুনছে, যা খুব সামান্যই বৈচিত্র ধারণে সক্ষম। আর, যেহেতু সে অত্যন্ত শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ও অনুপুঙ্খ ছক-মাফিক শুরু করে, সেহেতু বিক্ষিপ্ত ও অবিন্যস্ত [ভাষিক] উপাত্তের ওপর নির্ভর করেও তার পক্ষে এক লাফে সুসংহত জ্ঞানে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে আমি আরও যোগ করব যে আমরা কিছুটা এগিয়ে, তবে আমার মতে অনেকটা দূর এগিয়ে, এই জ্ঞানভান্ডারটির বৈশিষ্টাবলী (properties) উপস্থাপন করতে পারি। আমি একে বলি সহজাত-ভাষা বা অন্তর্জ্ঞান (innate language or instinctive knowledge), যা শিশুটি ভাষাশিক্ষার বেলায় কাজে লাগায়। একইভাবে, আমরা অনেকটা দূর এগিয়ে তার এই জ্ঞানের মনোগত-প্রকাশ iiiকে বর্ণনাও করতে পারি।

আমি তাই দাবি করবো, এই অর্ন্তজ্ঞান কিংবা বলতে পারেন এই অনুপুঙ্খ ছকমাফিকতা বা পরিকল্পনা, যাকিনা আংশিকমাত্র তথ্যের ভিত্তিতে জটিল ও দুরূহ জ্ঞানার্জন সম্ভাবিত করে তোলে, মানবপ্রকৃতির অন্যতম মৌলিক একটা সাংগঠনিক উপাদান। কেবল মানবীয় যোগাযোগের ক্ষেত্রে নয় বরং ভাবপ্রকাশ ও মানুষে মানুষে মিথস্ক্রিয়ায় ভাষার ভূমিকার কারণেও আমি এটাকে মানবপ্রকৃতির মৌলিক একটা উপাদান মনে করি; এবং আমি আন্দাজ করি, মানব-প্রজ্ঞার অন্য ক্ষেত্রগুলোতে, মানব-উপলব্ধি ও আচরণের অন্যান্য এলাকায়ও আমদেরকে এরকমই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে।

আমাদের সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিক আচরণ পরিচালনাকারী বিপুল অনুপুঙ্খ-ছকমাফিকতা বা সহজাত-বিন্যাস-নীতির এই সমগ্রককেই আমি মানবপ্রকৃতি ধারণা বলে আখ্যায়িত করি।

এল্ডার্স: জনাব ফুকো, আপনার পুস্তক যেমন ধরেন হিস্টরি অব ম্যাডনেস এবং ওয়ার্ড এন্ড অবজেক্ট-এর বিষয়বস্ত্তর কথা বিবেচনা করে আমার মনে হয়েছে আপনি স্বতন্ত্র পরিসরে এবং সম্পূর্ণ বিপরীত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছেন; মানবপ্রকৃতির ক্ষেত্রে ছক-মাফিকতা প্রত্যয়টি ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি আপনি বেশকয়েকটি সময়কালকে আলাদা আলাদা ছক-মাফিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন। এ-প্রসঙ্গে আপনার মতামত কী?

ফুকো: আপনারা নাখোশ না-হলে আমি ফরাসিতে উত্তর দিতে চাই, কারণ আমার ইংরেজি ভাষাজ্ঞান এতোটাই দুর্বল, আমি উত্তর দিতে কুণ্ঠিত হব।

[youtube id=”Q95jdQyDvIA”]

এটা ঠিক যে মানবপ্রকৃতি ধারণার প্রতি আমি কিছুটা সন্দিগ্ধ এবং তার কারণ নিম্নরূপ: আমি বিশ্বাস করি বিজ্ঞানে ব্যবহারযোগ্য সব ধারণা বা ভাবনার সমমাত্রার বিস্তার নেই এবং সাধারণভাবে বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্সে এগুলো একই রকমের ভূমিকা পালন করে না, একই রকমভাবে ব্যবহৃতও হয় না। যেমন প্রাণীবিদ্যার কথাই ধরেন। সেখানে আপনি দেখতে পাবেন শ্রেণীকরণ, পার্থক্যকরণ এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ভূমিকাপালনকারী ধারণা: কিছু ধারণা আমাদেরকে সক্ষম করে তোলে অনুসন্ধানবস্ত্তকে বৈশিষ্ট্যায়িত করতে, যেমন ‘কোষ’-এর ধারণা; কিছু ধারণা উপাদানগুলোকে বিশ্লিষ্ট করতে, যেমন ‘পরম্পরা-বৈশিষ্ট্য’র ধারণা; এবং কিছু ধারণা যোগসূত্র নির্ধারণে, যেমন ‘স্পন্দন’-এর ধারণা। অনুরূপভাবে, ডিসকোর্স iv এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার আভ্যন্তরীণ নিয়ম-নীতির ক্ষেত্রে ভূমিকাপালনকারী ধারণা আছে। আবার একইসাথে, ‘সীমান্তনির্ধারণী’ ধারণাও আছে যার দ্বারা বৈজ্ঞানিক চর্চাসমূহ নিজেদের পরিচয় নির্মাণ করে, অন্যান্য চর্চাসমূহ থেকে নিজেকে আলাদা করে, নিজের আওতাভুক্ত বিষয়বস্ত্তর সীমানা নির্ণয় করে এবং নিজের আগামী কর্মকান্ডগুলোকে শনাক্ত করে। প্রাণীবিদ্যায় একটা সময়ে ‘প্রাণ’ ধারণাটি কিছুটা এইরূপ ভুমিকা পালন করেছিল।

সতেরো এবং আঠারো শতকে প্রকৃতি-অধ্যয়নে প্রাণ ধারণাটি কদাচিৎ ব্যবহৃত হতো: সপ্রাণ বা অপ্রাণ যাই হোক না কেন সকল প্রাকৃতিক সত্তাকে শ্রেণীকরণ করা হতো ব্যাপক-বিস্তৃত ক্রমতান্ত্রিক চিত্রপটে, যার মধ্যে খনিজ পদার্থ থেকে মানুষ পর্যন্ত সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত হতো। খনিজ পদার্থের সাথে উদ্ভিদজগত বা প্রাণীজগতের পার্থক্য ছিল অনেকাংশেই অনির্ধারিত; তাদের অবস্থান তর্কাতীতভাবে চিরকালের মতো নির্দিষ্ট করে দেয়াটাই কেবল সেসময় জ্ঞানগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হতো।

আঠারো শতকের শেষ নাগাদ এসকল প্রাকৃতিক সত্তা অধ্যয়নে নিয়োজিত বিবরণধর্মী ও বিশ্লেষণমূলক জ্ঞানকান্ডসমূহ অত্যন্ত নিখুঁত যন্ত্রপাতি ও আধুনিকতম কৃৎকৌশলের সহায়তায় অনুসন্ধানবস্ত্তসমূহের একটি অখন্ড পরিসর, সেগুলোর সম্পর্ক ও প্রক্রিয়াসমূহের একটি অখন্ড ক্ষেত্রকে স্পষ্ট করে তোলে। ফলে আমাদের পক্ষে প্রকৃতি-জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরে প্রাণীবিদ্যার জন্য আলাদা একটা পরিসর সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব হয়ে ওঠে। কেউ কি বলতে পারবেন, খোদ প্রাণ-এর ওপর গবেষণা প্রাণীবিদ্যা নামক জ্ঞানকান্ডের পরিধি নির্মাণ করেছিল? প্রাণীবিদ্যাগত জ্ঞানের পরিসর কী এই প্রাণ ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল? আমি সেটা মনে করি না। আমার কাছে বরং অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়, আঠারো শতকের শেষ নাগাদ প্রাণীবিদ্যাগত জ্ঞানের রূপান্তর ঘটেছিল মূলত বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্সে সম্পূর্ণ নতুন একগুচ্ছ ধারণা ব্যবহারের ফলে এবং এগুলো সে-সময় প্রাণ ধারণারও জন্ম দিয়েছিল, যা আমাদেরকে একটি বিশেষ ধরনের বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্সকে সংজ্ঞায়িত করতে, তার সীমা-নির্ণয় করতে ও প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম করে তুলেছিল। তাই আমি বলবো, প্রাণ ধারণাটি কোনো বৈজ্ঞানিক ধারণা নয়; এটা মূলত জ্ঞানকান্ডীয় একটা সূচক, যার ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্রে শ্রেণীকরণ, সীমানির্ধারণ ও অন্যান্য কার্য সম্পাদিত হয়েছিল, খোদ আলোচ্য বিষয়টির ভিত্তিতে এসব কাজ সম্পাদিত হয়নি।

আমার মনে হয় মানবপ্রকৃতি ধারণাটিও অনুরূপ। যা গবেষণার মাধ্যমে একজন ভাষাতাত্ত্বিক বাগধ্বনির রূপান্তরের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, কিংবা ফ্রয়েড স্বপ্ন বিশ্লেষণের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, কিংবা একজন সাংস্কৃতিক নৃবৈজ্ঞানিক মিথ-এর কাঠামো আবিষ্কার করেছিলেন সেটা বস্ত্তত মানবপ্রকৃতি নয় v। আমার মনে হয়েছে, জ্ঞানের ইতিহাসে মানবপ্রকৃতি ধারণাটি আসলে ধর্মতত্ত্ব কিংবা প্রাণীবিদ্যা কিংবা ইতিহাসের সাপেক্ষে বা বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডিসকোর্সকে প্রতিষ্ঠিত করতে জ্ঞানকান্ডীয় সূচকের ভূমিকা পালন করেছে মাত্র। এর মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক ধারণা দেখতে পাওয়া আমার জন্য সত্যিই কষ্টকর।

চমস্কি: বেশ; আমরা যদি স্নায়ুব্যবস্থার মতো করে মানবচৈতন্য-ব্যবস্থার (cognitive structures) বৈশিষ্ট্যসমূহও (properties) শুরুতেই নির্ধারণ করতে পারতাম, যার দ্বারা একটা শিশু ওই জটিল জ্ঞানব্যবস্থাসমূহ অর্জনে সক্ষম হয়ে ওঠে, তাহলে অন্তঃত আমার পক্ষ থেকে ওই বৈশিষ্ট্যগুলোকে মানবপ্রকৃতির গঠন-উপাদান হিসেবে মেনে নিতে কোনো দ্বিধা থাকতো না। সেহেতু দেখা যাচ্ছে, জৈবিকসূত্রে প্রাপ্ত অপরিবর্তনীয় একটা কিছু আছে যেটা আমাদের – এক্ষেত্রে মানসিক – সামর্থ্য দিয়ে আমরা যা-কিছু করি না কেন তার ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করে।

তবে, আপনি বিকাশ-ধারার যে চিত্র আঁকলেন সেই পথে আমি আরেকটু অগ্রসর হতে চাই; আপনার সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত যে প্রাণীবিদ্যায় প্রাণ ধারণাটি বস্ত্তত বিন্যাসকারী ভূমিকা পালন করেছে।

আমরা যেহেতু অতীত নয় বরং ভবিষ্যত নিয়ে কথা বলছি, সেহেতু আমার মনে হয় কিছুটা দূর পর্যন্ত এগিয়ে আমরা অনুমান গঠন করতে পারি এবং প্রশ্ন করতে পারি: প্রাণ-বিষয়ক কিছু প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়ার পরে – অন্তঃত প্রাণীবিজ্ঞানীদের ধারণা-মোতাবেক, যদিও অনেকেই দ্বিমত করবেন – মানবপ্রকৃতির ধারণা বা সহজাত বিন্যাস-কৌশল বা অন্তঃস্থ মানসিক ছক-মাফিকতার ধারণা… বা যে নামেই আমরা এটাকে আখ্যায়িত করি না কেন আমি বিশেষ হেরফের দেখি না তাই আসুন বরং সংক্ষেপে এটাকে মানবপ্রকৃতি হিসেবেই আখ্যায়িত করি … মানবপ্রকৃতি ধারণাটি কি প্রাণীবিদ্যার পরবর্তী কাজ হিসেবে পরিমাপযোগ্য একটা চূড়া হিসেবে হাজির হয় না?

প্রশ্নটাকে অন্যভাবে সুনির্দিষ্ট করে সাজিয়ে যদি বলি, শিশুর দুরূহ জ্ঞানব্যবস্থা অর্জন-সামর্থ্যকে এবং তদুপরি, এ-ধরনের জ্ঞানব্যবস্থা অর্জনের পরে নিজ বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে অবাধে ও সৃজনশীলভাবে এবং বিস্ময়কর বিচিত্রভাবে এই জ্ঞানভান্ডারটিকে সে যে-কায়দায় ব্যবহার করে সেইটার কোনো প্রাণীবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়া…বা কোনো বস্ত্তগত ব্যাখ্যা দেয়া কিংবা আমাদের বিদ্যমান বস্ত্তগত ধারণাসমূহের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা কি সম্ভব?

আমরা কি প্রাণীবিদ্যাগত ধারণার সাহায্যে, ও শেষবিচারে বস্ত্তগত ধারণার সাহায্যে, প্রথমত এই জ্ঞানব্যবস্থা অর্জন সামর্থ্যকে এবং তার পরে এই জ্ঞানভান্ডার ব্যবহার-সামর্থ্যকে ব্যাখ্যা করতে পারি? আমার সত্যিই মনে হয় না এরূপ বিশ্বাস করার কোনো কারণ আছে। সুতরাং, বিজ্ঞান যেহেতু অন্যান্য বহুকিছু ব্যাখ্যা করতে পেরেছে সেহেতু এটাও ব্যাখ্যা করতে পারবে- এরূপ মনে করা বিজ্ঞানীদের দিক থেকে নিছকই একটা আপ্ত বিশ্বাস ছাড়া আর কিছু নয়।

একদিক থেকে কেউ হয়তো দাবি করতে পারেন এটা হলো শরীর/মন সমস্যার ভিন্ন একটা প্রকরণ। কিন্তু আমরা যদি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি বিজ্ঞান কীভাবে বিভিন্ন চূড়া পরিমাপ করেছে এবং কীভাবে প্রাণ ধারণাটি দীর্ঘকাল দৃষ্টিসীমার বাইরে থাকার পরে বিজ্ঞানের আওতাভুক্ত হয়েছে, আমার মনে হয়, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে – বিশেষত, সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে এরূপ দৃষ্টান্ত বহুল পরিমাণে দেখতে পাবেন – বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছিল খোদ প্রকৃতি-বিজ্ঞানের পরিসরটি সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে। নিউটনের অভিকর্ষণ-শক্তিসমূহের নীতি আবিষ্কার এধরনের একটা ধ্রুপদী ঘটনা। কার্তেসীয়দের vi কাছে দূরবর্তী ক্রিয়া একটা অতীন্দ্রিয় ধারণা বলে বিবেচিত হতো, এবং স্বয়ং নিউটনের চিন্তায়ও দূরবর্তী ক্রিয়া ছিল অতিপ্রাকৃত গুণবাচক অতীন্দ্রিয় ধারণা, যাকিনা বিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত নয়। কিন্তু আমরা দেখি, বিজ্ঞানের পরিধিভুক্ত হওয়ার সুবাদে দূরবর্তী ক্রিয়ার ধারণাটি পরবর্তী প্রজন্মের মানুষের কাছে সাধারণ জ্ঞানে পরিণত হয়েছিল।

যেটা ঘটেছিল সেটা এই যে শরীর ধারণাটি বা প্রাকৃতিক ধারণাটিই বদলে গিয়েছিল। কোনো কট্টর কার্তেসীয় যদি আমাদের আজকের সমাজে হাজির হয় তাহলে দেখা যাবে তার কাছে নভোমন্ডলীয় প্রপঞ্চসমূহের আচরণ ব্যাখ্যা-উপযোগী কোনো ধারণা নেই। যদিও আজকাল বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় শক্তির মাধ্যমে এসকল প্রপঞ্চের যে-ব্যাখ্যা হাজির করা হয়, বলা যায়, তা অবশ্যই কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা নয়। কিন্তু তবুও, প্রকৃতি-বিজ্ঞানের বিস্তার ঘটানোর মাধ্যমে এযাবত অপ্রাপ্য ধারণাসমূহ, সম্পূর্ণ নতুন ধারণাসমূহ অঙ্গীভূত করার ফলে জটিল থেকে জটিলতর কাঠামোর নির্মাণ আজকাল সম্ভব হয়ে উঠেছে, যাকিনা বৃহত্তর পরিধির প্রপঞ্চসমূহ অনুসন্ধানের আওতাভুক্ত করার উপযোগী।

যেমন ধরেন, কার্তেসীয়দের পদার্থবিদ্যা বস্ত্তর মৌল পরমাণুর আচরণ ব্যাখ্যা করতে পারবে এরূপ কথা নিশ্চয় সত্য নয়, ঠিক তেমনি মানবপ্রকৃতি ধারণাটি ব্যাখ্যা করতেও তা অপারগ।

অনুরূপভাবে আমার মতে যে-কেউ প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেন, আজকাল প্রাণীবিদ্যাসহ যা-কিছু বিজ্ঞান হিসেবে পরিচিত সেগুলো কি সেইসব তত্ত্ব ও ধারণা সমন্বিত করেছে যার দ্বারা মানুষের সহজাত বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্যকে, এবং আরও তাৎপর্যপূর্ণ হলো, স্বাধীন পরিবেশে মানুষ যেভাবে এই সামর্থ্য ব্যবহার করে সেইটা ব্যাখ্যা করা সম্ভব? আমি বিশ্বাস করার বিশেষ কোনো কারণ দেখি না যে আজকের প্রাণীবিদ্যায় বা পদার্থবিদ্যায় এইরূপ ধারণা বিদ্যমান। তাই প্রস্তাব করা যায় যে পরবর্তী চূড়াটি পরিমাপের জন্য, পরবর্তী পদক্ষেপটি নেবার জন্য, [মানবপ্রকৃতি নামক] এই বিন্যাসকারী ধারণাটির ওপর মনোযোগ দিতে হবে এবং এ-সম্পর্কে বোধগম্যতা অর্জনের জন্য জ্ঞানকান্ডের পরিধিটাকেও বিস্তৃত করতে হবে।

ফুকো: ঠিকই বলেছেন।



[i] ১৯৭১ সালে নেদারল্যান্ডের ডাচ টেলিভিশন এর আমত্মর্জাতিক দার্শনিক প্রকল্পের আওতায় এই বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়। প্রকল্পটির চেয়ারম্যান ছিলেন ইউনিভার্সিটি ফর হিউম্যানিস্ট স্টাডিজ, উত্রেস, নেদারল্যান্ড এর প্রফেসর ড. ফন এল্ডার্স। ১৯৭৪ সালে ফন এল্ডার্স-এর সম্পাদনায় রিফ্লেক্সিভ ওয়াটার: দ্য বেসিক কনসার্নস অব ম্যানকাইন্ড (স্যুভেনির প্রেস, লন্ডন) নামের পুসত্মকে বিতর্কটি প্রকাশিত হয়। আমি নিজে এটা সংগ্রহ করেছি ওয়েবসাইট থেকে: http://criminyjicket.tripod.com/chomfouc.html

[ii] সহজাত ভাব ধারণাটি বিকশিত হয় মূলত সপ্তদশ শতকে। রেনে দেকার্তে এর প্রধানতম প্রবক্তা ছিলেন। ভাববাদী দর্শন মোতাবেক মানুষের মনের ভাব দু’রকমের: অভিজ্ঞতাজাত ভাব এবং জন্মগত বা সহজাত ভাব।

সহজাত ভাব/ধারণায় বিশ্বাসী দার্শনিকেরা দাবি করতেন যে মানুষের মনের সব ভাব অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত নয়। তার মনে এমন কতকগুলো ভাব থাকে যেগুলো জন্মগত। মানুষ সেগুলো ইন্দ্রিয়ানুভূতি বা অভিজ্ঞতার মাধ্যমে লাভ করে না। তাদের মতে, সহজাত ভাব যেমন স্বভাবস্বীকৃত তেমনই অনিবার্যও বটে। যেমন দেকার্তে বলতেন: ‘আমি চিন্তা করি’- এটা এমন একটা ধারণা যাকে মানুষ আদৌ সন্দেহ বা অস্বীকার করতে পারে না। কারণ, মানুষের সন্দেহ করাটাও চিন্তারই এক ধরনের প্রকাশ। সন্দেহের অতীত এই ধারণা মানুষের জন্মগত। এরূপ সহজাত ধারণার ওপর ভিত্তি করেই মূলত মানুষের জ্ঞানরাজ্য গড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতকে ইমানুয়েল কান্ট সহজাত ভাব ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করেন।

বস্ত্তবাদী দার্শনিকদের মতে, বস্ত্তজগতের সাথে নিয়ত প্রবাহমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ামূলক সম্পর্কের মাধ্যমেই মানুষের মনে বস্ত্ত সম্পর্কে ভাবের সৃষ্টি হয়। তাদের মতে, অন্য সকল প্রকার ভাবের ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য।

বিশ শতকে এসে মানুষের ভাষা-সক্ষমতা ব্যাখ্যা করতে যেয়ে নোম চমস্কি ‘সহজাত ভাব’ ধারণাটি পুনরায় আলোচনায় টেনে এনেছেন।

[iii] রেপ্রিজেন্টেশন অর্থে প্রকাশ শব্দটি ব্যবহার করা হলো। ইংরেজি ভাষাভাষী জগতে রেপ্রিজেন্টেশন-এর প্রধান দুটো অর্থ হলো: ক) ইমেজ, অনুরূপতা/সাদৃশ্যতা কিংবা পুনরুৎপাদন, এবং খ) প্রতিনিধিত্ব করা বা প্রতিনিধি দ্বারা মতামত উপস্থাপিত/রেপ্রিজেন্টেড হওয়া। এখানে দ্বিতীয় অর্থটি প্রযোজ্য।

[iv] সাধারণভাবে ডিসকোর্স একটি ভাষাতাত্ত্বিক প্রত্যয়। সোজাসুজি বাংলা করলে মানে দাঁড়ায় ‘বহস’। কিন্তু মিশেল ফুকোর ব্যবহৃত ডিসকোর্স ধারণাটি কেবলই বহস প্রত্যয়টির মধ্যে সীমিত থাকে না। তিনি ধারণাটির ওপর ভিন্ন অর্থ আরোপ করেন। ডিসকোর্স বলতে ফুকো বুঝিয়েছেন, একগুচ্ছ আন্তঃসম্পর্কিত বিবৃতিকে যা বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক কালে নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নিয়ে আলাপচারিতার – ও সেই বিষয়টির জ্ঞান প্রকাশের – ভাষা দান করে। …ডিসকোর্স মূলত ভাষাবাহিত জ্ঞান উৎপাদনের ব্যাপার। কিন্তু যেহেতু সকল রকমের সমাজিক চর্চাই অর্থপূর্ণ এবং সেই অর্থ (meaning) আমরা যাকিছু করি না কেন সেটাকে – আমাদের কর্মকান্ডকে – সাকার করে তোলে ও প্রভাবিত করে সেহেতু সকল সামাজিক চর্চারই একটা ডিসকার্সিভ (Discursive) দিক থাকে। নজর দেওয়া জরুরি যে এরূপ ব্যবহারে ডিসকোর্স ধারণাটি কেবলই ‘ভাষাগত’ থাকে না। ধারণাটিতে ভাষা ও বাসত্মব চর্চার ব্যাপারটি অর্ন্তভূক্ত হয়। ব্যক্তি যা বলে (ভাষা) এবং যা করে (চর্চা)- এই দুইয়ের মধ্যে সনাতন যে ফারাক ছিল ডিসকোর্স ধারণায় সেটা থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হয়। ফুকো দাবি করেন, ডিসকোর্স বিষয়কে নির্মাণ করে। এটা আমাদের জ্ঞানের বিষয়বস্ত্ত নির্দিষ্ট করে দেয় ও উৎপাদন করে। কোনো বিষয়ে আমাদের অর্থময় আলাপচারিতার ও যুক্তিবিন্যাসের পদ্ধতিও এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। ডিসকোর্স কোনো ধারণাকে বাস্তব চর্চায় রূপান্তর করার ব্যপারটিকে প্রভাবিত করে এবং অন্যদের কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহৃত হয়। একদিকে, ডিসকোর্স কোনো বিষয় নিয়ে আলাপচারিতার বিশেষ কিছু নিয়ম বেঁধে দেয়; আলাপের, লিখনের বা কর্মকান্ডের কিছু গ্রহণযোগ্য ও বোধগম্য পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেয়; তেমনই অপরদিকে, কোনো বিষয়ে আলাপচারিতা ও জ্ঞান উৎপাদনের অপরাপর পদ্ধতিগুলোকে প্রতিরুদ্ধ ও সীমায়িত করে। ফুকোর মতে, ডিসকোর্স কখনোই একটা মাত্র বিবৃতি, একটা মাত্র টেক্সট, একটা মাত্র চর্চা বা একটা মাত্র সূত্রের দ্বারা নির্মিত হয় না।  (এ সম্পর্কে দেখুন, স্টুয়ার্ট হল সম্পদিত রেপ্রিজেন্টেশন গ্রন্থটিতে তাঁরই লেখা ‘‘দ্যা ওয়ার্ক অব রেপ্রিজেন্টেশন’’ প্রবন্ধটি [পৃ. ৪৪, সেজ পাবলিকেশন্স: লন্ডন, ১৯৯৭])

[v] ফুকো এই বাক্যটিতে নোম চমস্কির ‘জেনারেটিভ গ্রামার’ এবং কাঠামোবাদী নৃবিজ্ঞানী লেভি স্ত্রাউস এর ‘স্ট্রাকচার অব মিথ’ এর ইঙ্গিত করেছেন। লেভি স্ত্রাউসের মতে মানুষের মন ও মিথের (অতিকথা) কাঠামো একই রকম।

[vi] কার্তেসীয় হলো ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের লেখাপত্র থেকে গড়ে ওঠা দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনার একটি ধারা। সার্বিকভাবে কার্তেসীয়রা দেকার্তের কেন্দ্রীয় মতবাদগুলো সমর্থন করে- অর্থাৎ, সমর্থন করে যে বাস্তবতাকে মন ও বস্ত্তসত্তা এই দুই ভাগে ভাগ করা যায়। মানব-মনের নির্যাস হলো চিন্তাশীলতা। আর বস্ত্তসত্তার নির্যাস তিন ধরনের মাত্রার (dimensions) সম্প্রসারিত রূপের সমন্বয়; ঈশ্বর, মন ও বস্ত্তসত্তার ধারণা মানুষের সহজাত, অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আহরিত নয়; এবং সংশয়াতীতভাবে স্বতন্ত্র ও সুস্পষ্ট কোনো একটি প্রস্তাবনা বা ধারণায় পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত সকল কিছুতে সন্দেহ জারি রাখাই হলো দার্শনিক সত্যে পৌঁছানোর সঠিক পথ। অধিকাংশ দেকার্তে অনুসারী এরকম অন্তঃত একটা প্রস্তাবের বেলায় তার সাথে সহমত পোষণ করেন: ‘‘কজিটো, আরগো সাম’’ – আমি চিন্তা করি, তাই আমি অস্তিত্ববান।

অধিকাংশ দেকার্তেপন্থী বিশ্বাস করতেন যে কেবলমাত্র এই একটি সন্দেহাতীত সত্যের ওপর নির্ভর করেই সংশয়বাদকে খারিজ করা এবং মানব-যুক্তিশীলতানির্ভর একটি দর্শন ও বিজ্ঞান-ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

কিন্তু অচিরেই কার্তেসীয় দর্শনের মন ও বস্ত্তসত্তার দ্বৈততা বিষয়ক একটি কেন্দ্রীয় প্রস্তাবনা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। দেকার্তের প্রস্তাব মোতাবেক মন ও বস্ত্তসত্তা যদি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয় তাহলে এদের মধ্যে কোনোরূপ মিথস্ক্রিয়া কীভাবে সম্ভব? সমালোচকেরা আরও যুক্তি দেন, মন ও শরীর এবং সাধারণভাবে মন ও বস্ত্তসত্তার মধ্যে যদি মিথস্ক্রিয়া না-ঘটে থাকে তাহলে মনের পক্ষে সরাসরি বহির্জগতের অভিজ্ঞতা আহরণ সম্ভব নয়। ফলে, ব্যক্তি বহির্জগত সম্পর্কে যে-ধারণা গঠন করে সেটা প্রকৃত বহির্জগতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না-হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এই সমস্যার একটি সমাধান হতে পারে যদি স্বীকার করে নেওয়া হয় কেবলমাত্র সর্বশক্তিমান, দয়ালু ও সর্বদা সচেতন এক ঈশ্বরের অস্তিত্বই বাসত্মবতা সম্পর্কে ব্যক্তি-ধারণা এবং খোদ বাস্তবতার মধ্যে ঐক্য তৈরি করতে সক্ষম। এ-কারণে কার্তেসীয় দার্শনিক ধারা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রহ হ্রাস পেতে থাকে- যাকিনা সম্পূর্ণরূপে মানব-যুক্তিশীলতাভিত্তিক একটি দর্শন ও বিজ্ঞান-ব্যবস্থা গড়ে তোলার দাবি করেছিল।

সতেরো শতকের শেষের দিকে থেকে কার্তেসীয় অধিবিদ্যাগত ধারা বহুলাংশেই আবেদন হারিয়ে ফেলে। কিন্তু তবু, মন ও বস্ত্তসত্তার আন্তঃসম্পর্ক অনুসন্ধান তৎপরতা এখনও কার্তেসীয় ধারার উত্তরাধিকার হিসেবে টিকে আছে। সম্প্রতি মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক নোম চমস্কি দেকার্তের দৃষ্টিভঙ্গি – মানুষের কেন্দ্রীয়-ভাব অবশ্যই সহজাত হতে হবে – নতুন করে আলোচনায় টেনে এনেছেন। তাঁর মতে, সহজাত মনোগত-কাঠামোর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেই কেবল ব্যাখ্যা করা সম্ভব কীভাবে একটা শিশু অতি দ্রুত অসীম সংখ্যক নতুন ও নির্ভুল অর্থবোধক বাক্য নির্মাণের সক্ষমতা অর্জন করে, যদিও সেই বাক্যগুলো সে ইতোপূর্বে কখনোই শোনেনি।

 

 

Series Navigation<< তর্ক: চমস্কি এবং ফুকো (পার্ট টু)তর্ক: চমস্কি ও ফুকো (পার্ট ফোর) >>
The following two tabs change content below.
Avatar photo

আ-আল মামুন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →