অনধিকার চর্চা
বৈষম্যমূলক সমাজে কমোডিটিগুলোও সেগ্রেগেটেড থাকলে ভালো হয়। এ নিয়ে বিশ্লেষণে আমি যাবো না, বিশ্লেষণ করার মতো জ্ঞান আমার নেই। তবে রোজ গুলশান-২ আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে একটা গল্প দিয়ে শুরু করতে পারি।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
একটি প্রাসঙ্গিক বাড়তি গল্পঃ আমার অফিস গুলশান-২ নম্বরে, খুব অভিজাত এলাকা। এখানকার বসবাসরত মূল্যবান প্রাণগুলো বাঁচানোর জন্য নিরাপত্তার নামে এখানে সাধারণ মানুষদের হেনস্থা করা হয়। আমার বাসা শেওড়াপাড়া, মিরপুর। আমি সকালবেলা কুড়িল ফ্লাইওভার দিয়ে অফিসে আসি, পথ দূর হলেও আমার সময় কম লাগে। (অন্যান্য পথের ভোগান্তির বৃত্তান্তে আজকে যাচ্ছি না)। মিরপুর ১০-এ এসে কালশী ফ্লাইওভার দিয়ে কুড়িল, বিশ্বরোড যাবে এমন বাসে আমি চড়ি। নর্দ্দা বাসস্ট্যান্ড নামি, রাস্তা পার হয়ে ‘চেকপোস্ট’ (বারিধারা ডিওএইসএস-এর গেট) পর্যন্ত রিকশাতে আসি। এরপর এই সাধারণ রিকশাগুলো আর ঢুকতে পারে না। অসাধারণ রিকশার অপেক্ষায় সাধারণ, অসাধারণ সবাই এক কাতারে দাঁড়ায়। ধরে নিচ্ছি আগে রিকশা ছিলো ২০০, মানুষ ৫০০। এখন চেকপোস্টের ঐপাশে দেড়শ রিকশা, ৫০০ জনের চাহিদা মেটাচ্ছে। আর এই পাশে ৫০০ জনের চাহিদা মেটাচ্ছে ৫০টা রিকশা। যেহেতু এদের চাহিদা বেশি, তাই সবার বিবেচনায় এরা অসাধারণ রিকশা। ঐ পাশ পর্যন্ত সবাই ২০ টাকার রাস্তা ২০টাকা দিয়ে আসে, এই পাশে আসলে পরে হিসাবটা দাঁড়ায়, আপনি ২০ টাকার রাস্তা ৩০ টাকা দিয়ে যেতে রাজি নাকি না? যাত্রীর পরিস্থিতি বিবেচনা করার সুযোগ রিকশাওয়ালাদের নেই, সে হাতেম তাই না। সে শুধু জানে তার রিকশার জন্য অন্তত ৫ জন অপেক্ষা করে আছে, এবং এর মধ্যে অন্তত ২ জন ৫০ টাকা ভাড়া চাইলেও যাবে। ৫০টাকা দিয়ে যে খুশি খুশি যাবেই যাবে এই কথা বিশ্বাস না হলে কয়েকদিন গুলশান-২ অঞ্চলে আসা-যাওয়া করে যান, দুনিয়াদারি কিছু চিনলেও চিনতে পারেন। দুল হারালে বা কাপড়ে চা পড়লে আর মন খারাপ হবে না। যাইহোক, প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পরে যে ৩ জন, তাদের হাঁটতে হয়। কিছু করার নাই, তাদের মাসের রিকশা ভাড়ার বরাদ্দ সীমিত এবং নির্দিষ্ট। আমাকেও হাঁটতে হয়, কারণ আমার অফিস মাঝামাঝি দূরত্বে (মূল দূরত্বঃ ইউনাটেড হাসপাতাল থেকে গুলশান-২)। মাঝামাঝি কোথাও আপনার গন্তব্য হলে যেকোনো দিকেই আসা বা যাওয়ার চিন্তা বাদ দেন। আপনি রিকশাওয়ালাদের জন্য পুরাই লস প্রজেক্ট। 😀
এখন চালু হয়েছে সিএনজি, পার সিএনজি, ৪/৫ জন, প্রতি জন ১৫ টাকা করে। আমি বলি ভালোই হয়েছে, যেমন কাপড়, জামা বানানোর মজুরিও তেমনই হওয়া উচিত। তবে হাঁটার সময়টা রোজ দোয়া করি, ৫ জনের ঐ ২ জন যেন কখনও সিএনজিতে না চড়ে, তাহলে ১৫ টাকার ভাড়া একদিন ২৫ টাকা হলেও হতে পারে! রিজার্ভ করেও যাতে না যায়, পরে দেখা গেলো ঐ চলই হয়ে যাবে, সিএনজিওয়ালারা রিজার্ভ ছাড়া আর যাবে না, যেমন রিকশাওয়ালা গুলশান-২ ছাড়া মাঝামাঝি কোথাও যায় না। তবে ভ্যান আছে, আশা ছাড়া যাবে না।
পুনশ্চঃ এই বাস্তবতা কাকলী হয়ে গুলশান-২ ১৮ নম্বর রোড, ১৮ নম্বর থেকে গুলশান-২, নূতনবাজার থেকে ৯২ নম্বর রোড, ৯২ নম্বর থেকে গুলশান-২, বনানী-১১ থেকে ৫০, ৫০ থেকে গুলশান-২ সব জায়গার জন্য প্রযোজ্য।
সবাই উবার নিয়ে কথা বলে, উবার ভালো নাকি খারাপ। আমি বলি কী; ভালো আর খারাপ তো কেবল প্রায়োরিটির বিষয়। উবার কি আপনার জন্য সুবিধাজনক নাকি না? উবার বাংলাদেশে চলবে কিনা এই নিয়ে কীবোর্ড না ভেঙে সুন্দরবন বাঁচানো নিয়ে কীবোর্ড ভাঙেন। উবার বাংলাদেশে চললে আপনি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবেন না। এতোদিন ধরে তমা, ট্রাস্ট আর সিএনজি ওয়ালারা রক্ত চুষে খাচ্ছে এইগুলা নিয়ে কোনো কথা ছিলো না কারও মুখে।
এখন আসি আমার কথায়। উবার ভালো কিনা আমি জানি না তবে সহজ। বাংলাদেশের মানুষ তাদের দৈন্দন্দিন জীবন নিয়ে খুবই বিধ্বস্ত, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে যাওয়া নিয়ে তা সে আপনি হেলিকপ্টারে চড়ে বা হেঁটে ছাড়া যে উপায়েই যান না কেন। সুতরাং পরিবহন মাধ্যম হিসেবে নূতন যাই আসবে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়বে। দেশ নিয়ে বেশিরভাগের চিন্তা নাই, তাদের চিন্তা একটা বার একটু নির্ঝঞ্ঝাটভাবে কোথাও যাওয়া। আর, একটা জিনিস সবাইই এখন খেয়াল করছে যে, একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষের আয় বেড়েই চলছে। নাগরিক মানুষ হিসেবে আমরা এখন অই পথেই যাচ্ছি যখন মানুষের সব আছে শুধু সময় নাই। সুতরাং সিএনজিওয়ালার সাথে ১০টা কথা বলতে গিয়ে হাফ অ্যান আওয়ার নষ্ট করে প্লাস সকালটা খারাপ করার চেয়ে ১০০টাকা যোগ করে সহজ উপায়ে ট্যাক্সি করে এসির বাতাস খেতে খেতে প্রয়োজনে ল্যাপটপ গুতাইতে গুতাইতে কোথাও যাওয়াটাই ঢাকা শহরের অনেক মানুষ এখন প্রেফার করবে। তবে হ্যাঁ, উবারের খরচ বাড়বে, ভর্তুকি দিয়ে ব্যবসা করা সম্ভব না। একে তো আমাদের দেশে নিজের গাড়ি নিজেই চালাচ্ছে উবারে এই ক্যাটাগরির মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা প্লাস আমাদের শহরটা খুবই ছোটো কিন্তু মানুষ শহরের ধারণক্ষমতার তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত সুতরাং কস্টিং বাড়বেই।
অনেকেই নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলছে। আমাদের দেশে তো মানুষ ঘরেই নিরাপদ না, ঘরে এসে খুন করে দিয়ে যাচ্ছে প্রায়ই। সেখানে উবারের নিরাপত্তা নিয়ে কথা তোলাটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে খুবই আঁতলামিসূচক। আমি তো রাত হয়ে গেলে ইমনকে রাস্তার মাথায় আসতে বলি, জন্মাবধি বড় হওয়া এলাকাতেও পরিস্থিতিভেদে বাসার পথটুকু পার দিতে আমার অনিরাপদ লাগে। তো নিরাপত্তার বিষয়টা তো ভীষণভাবে পরিস্থিতি নির্ভর। আমার নিরাপদ না লাগলে আমি বাসে চড়ি না, আপনার নিরাপদ না লাগলে আপনি উবারে চড়বেন না। কিন্তু উবারের কারণে আমরা অনেক বড় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছি এমনভাবে ফুলায়ে ফাপায়ে বড় করে, উবারকে এতো ফুটেজ দেয়ার দরকার দেখতেছি না আমি।
উবারের কারণে সিএনজি, তমা আর ট্রাস্টের ট্যাক্সির মনোপলি ভাঙবে যদি সত্যিই উবার সাকসেসফুলি রান করতে পারে। সিএনজিওয়ালার ব্যবহার আর হলুদ ট্যাক্সির ভাড়ার হার আমি কখনোই বুঝতে যাই না, গেলেও পারবো না। তো সাসটেইন করার জন্য যদি উবারের দাম বাড়ে তাতে আমার কী, আমি তো এখনও সিএনজিতে চড়তে পারি না রেগুলার। উবারের দাম বাড়লেও ট্যাক্সির মতো হবে না কখনও। রিমেম্বার উবার একটা নির্দিষ্ট গ্রুপের জনগণের জন্য হু আর উইলিং টু পে ফর দেয়ার টাইম অ্যান্ড কমফোর্ট। এরকম আরও বহু রেন্ট-এ-কার সুবিধা আছে যারা ঘণ্টা হিসেবে গাড়ি সরবরাহ করে থাকে, সেগুলোও কারও কারও কাছে রিজনেবল লাগতে পারে। সবচেয়ে জরুরি হলো এর সাথে সামর্থ্যের কোনো সম্পর্ক নেই, পুরো বিষয়টাই প্রায়োরিটির। আপনার একটা জিনিসের দরকার, সামর্থ্য ছাড়া অন্য কোনো ভ্যারিয়েবল নিয়ে আপনাকে ভাবতে হচ্ছে না এটাই কি আকাঙ্ক্ষিত না! সমাজে আর্থিক বৈষম্য আছে, থাকবেই কিন্তু এটাই কি ভালো না যে আপনি একাধিক অপশন পাচ্ছেন কোনো একটা সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে! আর্থিক বাস্তবতা আর পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্বাধীনভাবে কোনো একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার থাকলে আমার তো খুবই ভালো লাগবে। একটা গ্রুপ অফ পিপল, শুধু সিএনজি যাইতে রাজি হইলেই খুশি, মিটারে যাবে কিনা, কতোতে যাবে এইসব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই কারণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোথাও যেতে হবে তাকে। সিএনজিওয়ালা জিম্মি করাতে হয়তো সে অসুখী কিন্তু সে সামর্থ্যবান। সিএনজিওয়ালা তো সাধু সন্ন্যাসী না। মিটারে ছাড়া এবং দেড়শ টাকার ভাড়া আড়াইশ টাকার লোকে তার দিন আরামসে কাটানো গেলে আইন আর নিয়ম নিয়ে তো তার ভাবার কথা না। আমি আর আপনি তখন জিম্মি ঐ সামর্থ্যবান মানুষটির হাতে, আমাদেরকে মিটারে বা সর্বোচ্চ দুইশ টাকায় যাওয়ার জন্য আধা ঘণ্টা/এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হবে যতোই না এমার্জেন্সি থাকুক।
আমি বলি কী, উবার থাকুক। আমরাও না হয় শখ করে এক দুইদিন উঠলাম, শখ করে সিএনজিতে ওঠার চেয়ে এসি গাড়িতে উঠতেই তো আমার বেশি ভালো লাগবে। বরং দেখি কী হয়, ৩০০ টাকা দিয়ে ধানমন্ডি থেকে গুলশান যাওয়া তাদের স্যার/ম্যাডামরা ৩৫০ টাকা দিয়ে উবারে যাওয়া শুরু করলে তারা কী করে! দেখিই না কী হয়, ৬ মাস/১ বছর পরে!! সিএনজিতে চড়ার একটা সুস্থ পরিবেশই না হয় তৈরি হলো, কল্পনা করতে তো আর পয়সা খরচ হচ্ছে না!!! 😉
শিউলী বালা
Latest posts by শিউলী বালা (see all)
- অনধিকার চর্চা - ডিসেম্বর 6, 2016