বঙ্কিম’স এডভাইস
বাংলাদেশের ইউনির্ভাসিটিগুলাতে ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের উপ্রে কোন কোর্স আছে বইলা জানা নাই। বাংলা-একাডেমি কবি এবং গল্পকার পয়দা করার যে প্রজেক্ট নিছিলো, সেইটা ওয়াইডলি স্প্রেড হয় নাই আর। আবৃত্তি-করা বা শুদ্ধ উচ্চারণের কোর্সও হয় অনেক জায়গায়। বিশ্ব-সাহিত্য কেন্দ্রও মনেহয় বই-ই পড়ায় খালি, লেখালেখিটা শিখাইতে চায় না। এর কারণ হিসাবে মনে হইতে পারে লেখালেখি’তে শিখার মতো কোন জিনিস নাই। কিন্তু যাঁরা লেখালেখি করেন, একটা স্টেইজে আইসা ফিল করতে পারার কথা যে, লেখালেখি নিয়া ডিফরেন্ট পারসপেক্টিভগুলা জানাটা লেখালেখি’তে হেল্পই করে একরকম। এইগুলা খালি বই পইড়া হয় না, এই কারণে যাঁরা লেখালেখি করবেন বইলা ডিসিশান নিছেন, তারা তাদের পরিচিত লেখকদের সাথে দেখা করার, আড্ডা দেয়ার ব্যাপারটার মধ্যে থাকেন; ক্রিয়েটিভ রাইটিং লার্নিংয়ের প্রাকটিস হিসাবে সোসাইটিতে এইটাই চালু আছে। মাসুদ খান মনেহয় একসময় তরুণ কবিদের ইনফরম্যাল ক্লাশ নিতেন, শাহবাগে; অন রিকোয়েস্টে। এইরকম থাকতে পারে আরো।
তো, বাংলায় যেকোন একটা ক্রিয়েটিভ রাইটিংয়ের ফর্মাল কোর্সের শুরুটা বঙ্কিমের অ্যাডভাইস দিয়াই মনেহয় শুরু হইতে পারে।
এই অ্যাডভাইসগুলি রিড করতে পারাটা একটা ব্যাপার, কিন্তু হুবহু মানতে গেলে, ঝামেলাই হওয়ার কথা! অ্যাডভাইস ব্যাপারটা এইরকমই তো…
ই. হা.
—————————————————————————————————————
বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন *
১। যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
২। টাকার জন্য লিখিবেন না। ইউরোপে এখন অনেক লোক টাকার জন্যই লেখে, এবং টাকাও পায়; লেখাও ভাল হয়। কিন্তু আমাদের এখনও সেদিন হয় নাই। এখন অর্থের উদ্দেশ্যে লিখিতে গেলে, লোক-রঞ্জন-প্রবৃত্তি প্রবল হইয়া পড়ে। এখন আমাদিগের দেশের সাধারণ পাঠকের রুচি ও শিক্ষা বিবেচনা করিয়া লোক-রঞ্জন করিতে গেলে রচনা বিকৃত ও অনিষ্টকর হইয়া উঠে।
৩। যদি মনে এমন বুঝিতে পারেন যে, লিখিয়া দেশের বা মনুষ্য জাতির কিছু মঙ্গল সাধন করিতে পারেন, অথবা সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করিতে পারেন, তবে অবশ্য লিখিবেন। যাঁহারা অন্য উদ্দেশ্য লেখেন, তাঁহাদিগকে যাত্রাওয়ালা প্রভৃতি নীচ ব্যবসায়ীদিগের সঙ্গে গণ্য করা যাইতে পারে।
৪। যাহা অসত্য, ধর্ম্মবিরুদ্ধ; পরনিন্দা বা পরপীড়ন বা স্বার্থসাধন যাহার উদ্দেশ্য, সেসকল প্রবন্ধ কখনও হিতকর হইতে পারে না, সুতরাং তাহা একেবারে পরিহার্য্য। সত্য ও ধর্ম্মই সাহিত্যের উদ্দেশ্য। অন্য উদ্দেশ্যে লেখনী-ধারণ মহাপাপ।
৫। যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখিবেন। কিছুকাল পরে উহা সংশোধন করিবেন। তাহা হইলে দেখিবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্যনাটক উপন্যাস দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তারপর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। যাঁহারা সাময়িক সাহিত্যের কার্য্যে ব্রতী, তাঁহাদের পক্ষে এই নিয়ম রক্ষাটি ঘটিয়া উঠে না। এজন্য সাময়িক সাহিত্য, লেখকের পক্ষে অবনতিকর।
৬। যে বিষয়ে যাহার অধিকার নাই, সে বিষয়ে তাহার হস্তক্ষেপ অকর্ত্তব্য। এটি সোজা কথা কিন্তু সাময়িক সাহিত্যতে এ নিয়মটি রক্ষিত হয় না।
৭। বিদ্যাপ্রকাশের চেষ্টা করিবেন না। বিদ্যা থাকিলে, তাহা আপনিই প্রকাশ পায়, চেষ্টা করিতে হয় না। বিদ্যাপ্রকাশের চেষ্টা পাঠকের অতিশয় বিরক্তিকর, এবং রচনার পারিপাট্যের বিশেষ হানিজনক। এখনকার প্রবন্ধে ইংরাজি, সংস্কৃত, ফরাশি, জর্ম্মান্, কোটেশন বড় বেশী দেখিতে পাই। যে ভাষা আপনি জানেন না, পরের গ্রন্থের সাহায্যে সে ভাষা হইতে কদাচ উদ্ধৃত করিবেন না।
৮। অলঙ্কার-প্রয়োগ বা রসিকতার জন্য চেষ্টিত হইবেন না। স্থানে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গের প্রয়োজন হয় বটে; লেখকের ভাণ্ডারে এ সামগ্রী থাকিলে, প্রয়োজনমতে আপনিই আসিয়া পৌঁছিবে —ভাণ্ডারে না থাকিলে মাথা কুটিলেও আসিবে না। অসময়ে বা শূন্য ভাণ্ডারে অলঙ্কার প্রয়োগের বা রসিকতার চেষ্টার মত কদর্য্য আর কিছুই নাই।
৯। যে স্থানে অলঙ্কার বা ব্যঙ্গ বড় সুন্দর বলিয়া বোধ হইবে, সেই স্থানটি কাটিয়া দিবে, এটি প্রাচীন বিধি। আমি সে কথা বলি না। কিন্তু আমার পরামর্শ এই যে, সে স্থানটি বন্ধুবর্গকে পুনঃ পুনঃ পড়িয়া শুনাইবে। যদি ভাল না হইয়া থাকে, তবে দুই চারিবার পড়িলে লেখকের নিজেরই আর উহা ভাললাগিবে না – বন্ধুবর্গের নিকট পড়িতে লজ্জা করিবে।তখন উহা কাটিয়া দিবে।
১০। সকল অলঙ্কারের শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার সরলতা। যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বুঝাইতে পারেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।কেননা, লেখার উদ্দেশ্য পাঠককে বুঝানো।
১১। কাহারও অনুকরণ করিও না। অনুকরণে দোষগুলি অনুকৃত হয়, গুণগুলি হয় না। অমুক ইংরাজি বা সংস্কৃত বা বাঙ্গালা লেখক এইরূপ লিখিয়াছেন, আমিও এরূপ লিখিব, এ কথা কদাপি মনে স্থান দিও না।
১২। যে কথার প্রমাণ দিতে পারিবে না, তাহা লিখিও না। প্রমাণগুলি প্রযুক্ত করা সকল সময়ে প্রয়োজন হয় না, কিন্তু হাতে থাকা চাই।
বাঙ্গালা সাহিত্য, বাঙ্গালার ভরসা।এইনিয়মগুলি বাঙ্গালা লেখকদিগের দ্বারা রক্ষিত হইলে, বাঙ্গালা সাহিত্যের উন্নতি বেগে হইতে থাকিবে।
_______________
*প্রচার, ১২৯১, মাঘ।
_______________
সূত্র: http://www.ebanglalibrary.com/bankim/?p=344#sthash.o3W39nDQ.dpuf
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায়
Latest posts by বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় (see all)
- পাঠ্যপুস্তক: সহজ রচনা শিক্ষা – বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় - জানুয়ারি 3, 2022
- বঙ্গদর্শনের পত্রসূচনা - অক্টোবর 2, 2020
- বঙ্কিম’স এডভাইস - জুলাই 13, 2017