Main menu

আমাদের রূপালি গিটার…

…………………………………………………………………

সোশ্যাল মিডিয়া এবং বিভিন্ন পার্সোনাল স্পেস/ব্লগ থেকে লেখা এই বিভাগে পাবলিশ করবো আমরা; ক্যাটেগরি নামেই একভাবে ক্লিয়ার করা হইছে যে, আমাদের বিবেচনায় যেগুলি আরো বেশি রিডারের মাঝে ছড়ানো দরকার এবং আর্কাইভিং ভ্যালু আছে সেগুলিই রাখা হবে এই ক্যাটেগরিতে। যে লেখাগুলিকে অমন মনে হবে তার সবগুলি ছাপাইতে পারবো না মে বি; এখানে আমাদের চোখে পড়া বা আওতা এবং রাইটারের পারমিশন–এইসব ইস্যু আছে; ইস্যুগুলি উতরাইয়া যেইটার বেলায় পারবো সেগুলিই ছাপাতে পারবো মাত্র।

…………………………………………………………………

 

আশি সাল।

নিউইয়র্কের বিখ্যাত GuiterWorld চেইন মিউজিকের দোকানে বয়সে তরুন এক ছেলে ঘুরছে তার পছন্দের গীটারের জন্য। যেই দেশ থেকে সে এসেছে সে দেশে এরকম গিটারের দোকান তো দূরের কথা গিটার সামনা সামনি দেখেছে এমন মানুষই খুব কম।

দোকানে সাজানো সারি সারি গিটার থেকে ছেলেটি সাহস করে একটি গিটার ধরল, কিছুক্ষন আনমনে বাজালও। বাজনো শেষে গিটারটা রেখে ছেলেটি শুকনো মুখে পা বাড়ালো দরজার দিকে।

ছেলেটির এই প্রথম নিউইয়র্ক আসা। এই গিটার কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই। যে দলটির সাথে সে দেশ থেকে এসেছে সে দলেরও খুব কম মানুষকেই সে চেনে যে তাকে টাকাটা ধার দিতে পারবে।

বাইরে পা বাড়াতেই দোকানের ভিতর থেকে কেউ একজন তাকে ডাক দিলো। একজন বৃদ্ধ কাউন্টার থেকে ডাকছেন। বৃদ্ধ ছেলেটিকে নিয়ে গেল দোকানের পিছনের দিকের কিছু দামী গিটারের মাঝে।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

বৃদ্ধ বলল, বাজাও। তোমার যেটা বাজাতে ইচ্ছা করে সেটা আমাকে তুমি বাজিয়ে শোনাও।

অবাক ছেলেটি কোনদিনও হাতে পায়নি এতো ভালো গিটার। নিউইয়র্কের সেই ছোট্টো দোকানের কোনে হৃদয়ের সমস্ত উজার করে বাজিয়ে গেল ছেলেটি। যখন খেয়াল হলো তখন ছেলেটি অবাক হয়ে দেখলো পুরো শপিং মলের লোকজন জড়ো হয়ে তন্ময় হয়ে শুনছে তার গিটার। সবাই বলছে, এমন গিটার বাজানো তারা বহুদিন শুনে নাই।

বৃদ্ধ জানালেন দোকানের প্রধান তিনিই। গিটারটা প্যাক করে ছেলেটিকে দিয়ে তিনি বললেন, প্রতিদিন অনেক মানুষের গিটার আমাকে শুনতে হয়। এমন প্যাশনেট ভাবে বাজাতে বহুদিন পরে কাউকে দেখলাম আমি। এই গিটারটা আমার দোকানের পক্ষ থেকে তোমাকে উপহার।

এই ঘটনার দশ বছর পর।

নব্বই দশকের মধ্যভাগ ,আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। প্রথম প্রেমে পড়ার বয়স সেটা। কিন্তু আমাদের কোন বন্ধুদের জীবনে তখনো কোন প্রেমিকা নেই। বয়সটাই এমন, জীবনে আমাদের প্রেম না থাকতে পারে কিন্তু আমাদের সব প্রেমেরই তখন একটা জীবন ছিলো। সেই আশ্চর্য জীবনটা চারপাশের সব কিছুরই প্রেমে পড়তে চায়, আর অদ্ভূত সব কষ্ট পায়।

ঠিক সেই সময়ে আমাদের জীবনে রুপালী গিটার হাতে আবির্ভূত হলেন এক হ্যমিলনের বাঁশিওয়ালা। সেই প্রথম জানলাম আমাদের কষ্টগুলোর এক একটার নাম আছে, যাদুকর বাঁশিওয়ালা বললেন চলো বদলে যাই, সেইদিন থেকে আমাদের রাতগুলি আচমকা বদলে হয়ে গেল তারাভরা, ঘুমভাঙ্গা শহরে সেদিন ফেরারী মন নিয়ে জেগে উঠলাম স্কুল কলেজে পড়া হাজার হাজার আমরা। আমরা প্রেমে বাঁধা পড়লাম ব্যান্ড মিউজিক নামের আশ্চর্য এক জগতের।

আরো বিশ বছর পরে, ঢাকার আর্মি স্টেডিয়ামে কনসার্ট হচ্ছে। নাম, ওল্ড ইজ গোল্ড কনসার্ট। নব্বই দশকের সেরা দশটা ব্যান্ড দল নিয়ে বামবার আয়োজন। কনসার্ট সফল হবে তো, মানুষ আসবে তো। দুরুদুরু বুকে বহুদিন পরে আবারো কনসার্টের টিকিট কিনলাম।

রুপালী গিটার হাতের সেই ছেলেটি সেদিন আর বয়সে তরুন নেই। আমরাও আর কেউ কিশোর নই। মনে আছে, সেদিন সন্ধ্যায় আমার আশে পাশে যারা ছিলো প্রায় সবাই আমাদেরই বয়সী। দেখা হতে লাগলো পুরানো বন্ধুদের সাথে। আশ্চর্য আমরা সবাই কিভাবে যেন এসেছি, স্টেডিয়াম পূর্ন করে আমরা অপেক্ষা করছি।

কনসার্টের শেষের দিকে তিনি এলেন। আমরা গলা মিলিয়ে গাইলাম যেন হাজার বছরের পরিচিত একএকটি গান। এমনি এক সময়ে গিটারে বেজে উঠলো অপার্থিব এক গানের সুর। আমরা বড় হবো, একদিন আমাদের ছেলেমেয়েরাও বড় হবে কিন্তু এই গানের সুর আর কথা কখনো পুরনো হবে না। কলেজ জীবনে বহুবার কনসার্টে শুনেছি আর চিৎকার করে গেয়েছি এই গান। কিন্তু এইবার, অনেক বছর পরে, যখন সেই বিশেষ গানটি শুরু হলো তখন টের পেলাম আমার চারপাশে নেমে এলো আশ্চর্য ধ্যানমগ্নতা। বাতাস ঘন হয়ে এলো, একটা করুন অন্ধকার যেন ঝুপ করে নিরবতার চাদর পরে সমস্ত স্টেডিয়ামকে ঘিরে ফেললো। আমি প্রথমে অনেকের মতই গানে গলা মেলাতে চাইলাম। কিন্তু, বুকের ভিতর থেকে হাহাকারের মতো কি যেন গলার কাছে বারবার আসতে চাইলো।

অবাক হয়ে পাশ ফিরে দেখলাম, আমার ভালোবাসার মানুষটা চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। যে বন্ধুদের দলটার সাথে গিয়েছিলাম তারা সবাই বিহ্বল হয়ে চোখের পানি থামানোর চেষ্টা করছে। দূরে, কাপলরা একজন আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। সমস্ত স্টেডিয়াম জুড়ে এক অদ্ভূত দৃশ্য।

জীবনে আমরা বহুবার কৈশোরকে হারাই। সেই দিন, কনসার্টের মাঠে সেই গানটির সাথে, আমরা আরেকবার হারালাম আমাদের কৈশোর।

কেউ যদি জানতে চায় আমার কৈশোরের গল্প তবে বলবো, আমি বেড়ে উঠেছিলাম কিছু লিজেন্ড’দের সময়ে, আমাদের কিছু একই রকম ভালোলাগা আর দুঃখের গল্প নিয়ে, সেই সময়টা অনেক অন্যরকম ছিলো।

তোমরা বুঝবে না।

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

সিফাত বিন আজিজ

জীবনের প্রতিটি মোড়ে আমি কবিতা দাঁড় করিয়ে রাখতে চাই, নিদেনপক্ষে কিছু ছোটো গল্প, ক্লান্ত হলে, পথ হারালে, যদি প্রয়োজন পড়ে, যে কোন একটি কবিতার আঙুল ধরে আমি আমার কাছেই বারবার ফিরে আসতে চাই।
Avatar photo

Latest posts by সিফাত বিন আজিজ (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →