Main menu

দ্য ডেইলি স্টোয়িক: ৩৬৬ দিনের জার্নাল।। রায়ান হলিডে।। (১)

ফ্রম গ্রীস টু রোম টু টুডে

এখন সময় রাইত ১২ : ০৫। মেহেরাব ইফতি আমারে ভূমিকা লেইখা দিতে কইছিলো সকালে। সারাদিন ভাবলাম। মূল বইয়ের ভূমিকাটাও পড়লাম কয়েকবার। এখন লেখতে বসলাম; যা বুঝলাম সারাদিনে -একটা চেনা প্রবাদ দিয়া শুরু করা যাইতে পারে কথাগুলা, “পুরান চাইল ভাতে বাড়ে।”

তিন হাজার বছর আগের গ্রিক সময়কার দর্শন নিয়া এই সময়ে আইসা আলাপ দেয়ার মানেটা কী? তাও স্টোয়িক দর্শন নিয়া বিশেষভাবে। দর্শনের ছাত্র হিসেবে প্রথম পাঠ যেগুলা পাইছিলাম তার মধ্যে একটা ছিলো, কোনো সময় দর্শন একেবারেই বাতিল হইয়া যায় না। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের সূত্র বাতিল হইয়া যাইতে পারে, মৃত হইয়া যাইতে পারে, কিন্তু দর্শন বাতিল হয়না, মৃত হয়না। এইটা একটা কারণ, যেটার জন্য এখনও দার্শনিকরা এরিস্টটল-প্লেটো কপচাইতে পারে, হয়তো ভবিষ্যতেও পারবে। স্টোয়িক ফিলোসফিও প্লেটো-সক্রেটিসের সময়কারই। নতুন কইরা স্টোয়িক দর্শনের আবির্ভাব আমাদের এইসময়ে, এর পিছনে কিছু আর্থ-সামাজিক ও বৈশ্বিক কারণ অবশ্যই আছে, যদিও এই বইয়ের বিষয়বস্তু সেইটা না, এমনকি আমার আলাপেরও না, তাও বইলা রাখলাম চিন্তার উস্কানি হিসাবে। তো এই বইয়ে আসলে আলাপটা কী নিয়া? কারা ছিলো স্টোয়িক? স্টোয়িক বলতে আমরা জেনারেল সেন্সে কী বুঝি? প্রথম কথা, স্টোয়িক বলতে আমরা জেনারেল ইমেজে এইটা ধইরা নিই যে :আবেগহীনতা (এমনকি ইংরেজি শব্দেও সেরকমই অর্থ)। এইটা নিয়া রায়ান হলিডেও তার বইতে আক্ষেপ করছেন। মহান রোমান সম্রাট মার্কাস অরিলিয়াস, দার্শনিক সেনেকা এবং প্রথমজীবনে দাস থাকা ও পরের জীবনে দার্শনিক হইয়া যাওয়া এপিকটেটাস, এরা হইলো স্টোয়িক দর্শনের ত্রিশূল। এদের আগেও স্টোয়িক ঘরানার চর্চা ছিলো কমবেশি, কিন্তু এরা তিনজনই মূল জায়গার ফাইটটা দিছেন স্টোয়িক দর্শন নিয়া। এছাড়াও জর্জ ওয়াশিংটন, ওয়াল্ট হুইটম্যান, ইমানুয়েল কান্ট, অ্যাডাম স্মিথ, থমাস জেফারসন, ম্যাথু আরনল্ড, থিওডোর রুজভেল্ট, এসব বিখ্যাত ব্যক্তিরা স্টোয়িকদের পাঠ করছে, প্রশংসা করছে।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

এই বইটা লেখছেন রায়ান হলিডে, রায়ান হলিডে কে? রায়ান হলিডে একজন আমেরিকান লেখক, উদ্যোক্তা, মিডিয়া স্ট্রাটেজিস্ট, এবং নিউ ইয়র্ক অবজার্ভারের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। পড়ালেখা করছেন পলিটিকাল সায়েন্স এবং ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর উপরে।

এই বই কেন পড়বেন? উপরে বলছি একজায়গায়, স্টোয়িক দর্শনের পুনরায় আবির্ভাবের পিছনে আর্থ-সামাজিক ও বৈশ্বিক কারণ আছে কিছু, আপনি নিজেও ব্যক্তি হিসাবে আপনার আর্থ-সামাজিকতা ও বৈশ্বিক দুনিয়ার একটা অংশ। এসবের প্রভাব আছে আপনার উপরে। এসবের ক্রাইসিস আছে আপনার জীবনে। যদি সেগুলারে মোকাবিলা করতে চান ঠিকঠাকভাবে, তাইলে স্টোয়িক দর্শন নিয়া ঘাঁটাঘাঁটিটা আপনার কাজে লাগতে পারে অল্প হইলেও, আর বেশি হইলেতো তোফা!

শেষকথা, এইটা দর্শনের একাডেমিক বই না।পপুলার বই, পপুলার স্টাইলেই লেখা।দর্শনের বই দেইখাই ঘাবড়ায়ে যাইয়েন না। উল্টায়া দেখেন একটু।একদম সহজ ভাষায় ডায়েরি স্টাইলে লেখা, কিন্তু এর মধ্যেই প্রকাশ পাইছে গভীর দার্শনিক চিন্তা এবং নিজের জীবনে সেইটার প্রয়োগের পদ্ধতি। কথা বাড়ায়া আর বিরক্ত কইরা লাভ নাই, এইখানেই শেষ করলাম ফুলস্টপ

 

…………………………………………………………………………..

১ জানুয়ারি: (নিয়ন্ত্রণ এবং নির্বাচন)

“কোন জিনিসগুলা আমার নিজের নিয়ন্ত্রণে আছে বা থাকতে পারে আর কোনগুলা নাই, এই দুই বিষয়রে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা এবং এদের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারাটাই জীবনে প্রধান কাজ। এরপর ভালো এবং মন্দের পার্থক্য আমি কীভাবে বুঝবো? বাইরের কোনো বিষয়ের উপর ভিত্তি কইরা না, বরং যেইগুলা আমার নিজের নিয়ন্ত্রণে ছিল সেগুলা নিয়া কীরকম সিদ্ধান্ত নিছি তার উপরে ভিত্তি কইরা বুঝতে হবে…”

-এপিকটেটাস, Discourses, 2.5.4-5


স্টোয়িক দর্শনে একমাত্র সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চর্চা হইতেছে কোনটা আমরা চেইঞ্জ করতে পারি, আর কোনটা পারিনা, এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য বুঝা। কোনটার উপর আমাদের প্রভাব আছে আর কোনটায় নাই। ওয়েদারের কারণে কোনো ফ্লাইট লেইট করলে, সে ব্যাপারে এয়ারলাইন্স প্রতিনিধিরে যতই গালিগালাজ করেন না কেন, তাতে ওয়েদার পরিবর্তন হয়ে যাবেনা। লম্বা হওয়ার জন্য বা খাটো হওয়ার জন্য বা অন্য কোনো দেশে জন্মাইলেন না কেন, এই নিয়ে মনের ভেতরে যতই কামনা পোষণ করেন না কেন, তাতেও কাজ হবেনা। আপনি যত চেষ্টাই করেন না কেন, কেউ আপনারে পছন্দ না করলে তারে আপনি জোর কইরা পছন্দ করাইতে পারবেন না। এবং শেষ কথা এই যে, আপনি এইসব নিজস্ব নিয়ন্ত্রণহীন ব্যাপারে যতই টাইম পাস করেন না কেন, তা অপচয়ই হবে।

রোগ-শোকের সময় শান্তির দোয়া নামে একটা দোয়া আছে যেটা এরকম : “হে খোদা! আমি যা চেইঞ্জ করতে পারি না তা শান্তভাবে মাইনা নিতে আমারে হেল্প করেন, যা চেইঞ্জ করতে পারি তা চেইঞ্জ করার সাহস দেন, এবং এই দুইয়ের পার্থক্য জানার হেদায়েত দান করেন।” শিশু নির্যাতনের স্বীকার হয়ে, পরবর্তীতে ডিফেন্স মেকানিজম হিসেবে যে ব্যক্তি বড় হইয়া ড্রাগঅ্যাডিক্ট হয়া যায়, সে চাইলেও তার শিশুকালের ঘটনাগুলা চেইঞ্জ করতে পারবেনা। অতীতে, একজন ব্যক্তি যেসব সিদ্ধান্ত নিয়া ফেলেছে বা যে আঘাত সে অন্যরে দিছে, সেগুলা সে হয়তো চেইঞ্জ করতে পারবেনা। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন না করার বিষয়টা তার নিজের ডিসিশানের ব্যাপার। আর সেই ডিসিশান সে বর্তমানেই নিতে পারে। যেমনটা এপিকটেটাসের ভাষ্যমতে, “একজন ব্যক্তি কী ডিসিশান নিবে সেটা সে চাইলে এই মুহূর্তেই বাছাই করতে পারে।”

ঠিক এমনটাই আমাদের আজকের দিনের লাইগাও সত্য। যদি আমরা দিনের শুরুতেই এইটা ক্লিয়ারলি ভাইবা নিতে পারি যে, দিনের কোন কোন ঘটনাগুলা আমাদের কন্ট্রোলে থাকতে পারে, আর কোনগুলা পারে না, তাইলেই আমাদের দিনটা বেশি সুখে যাবে। শুধু তাই না, আমরা ঐসব ব্যক্তির তুলনায় বেশি সুবিধা পাবো, যারা আজকের সত্যটা টের পাইতেছে না এবং এমন এক যুদ্ধে জড়ায়া আছে যেখানে জয় পাওয়া অসম্ভব।

 

২ জানুয়ারি: (শিক্ষাই স্বাধীনতা)

“এসব উপদেশের, এসব জ্ঞানের ফল কী? প্রশান্তি, সাহসিকতা এবং স্বাধীনতা, একজন শিক্ষিত ব্যক্তির লাইগা এইগুলি হইতেছে সব থিকা সুন্দর এবং সুষম শস্য। যেরকমটা সাধারণ মানুষেরা বলে যে, শুধুমাত্র যারা মুক্ত, শিক্ষা তাদেরই জন্য। এইটা ভুল। বরং, বুঝদার’রা যেমনটা বলে, শুধুমাত্র শিক্ষিতরাই মুক্ত। সেইটা ঠিক।”

-এপিকটেটাস, Discourses, 2.1.21-23


আপনি কেন এই বইটা পড়ার জন্য ধরলেন? কেনইবা যেকোনো বই আপনি পড়েন? নিশ্চয়ই আরও বেশি স্মার্ট হওয়ার জন্য না, কোন জার্নিতে টাইম পাসের জন্যও না, যা শুনতে চান সেটা শোনার জন্যও না- এসবের জন্য আরও ভালো অপশন আছে বই পড়ার থিকা।

আপনি এই বইটা পড়া শুরু করেছেন কারণ আপনি বাঁচতে শিখতেছেন। কারণ আপনি আরও স্বাধীন হইতে চান, সাহসী হইতে চান, এবং এক ধরনের প্রশান্তি অর্জন করতে ইচ্ছুক। শিক্ষা (পড়া কিংবা মহৎ মানুষদের জ্ঞান সম্পর্কে জানা) জ্ঞানের জন্য জ্ঞান অর্জন না। এর একটা উদ্দেশ্য আছে।

কর্মব্যস্ততার যাঁতাকলে পিষে যাওয়া বিভ্রান্ত মন নিয়া, দর্শনচর্চা করা বা একটা বই পড়ার থিকা, হাল্কা নাস্তা করতে করতে টিভি দেখাটাই বেশি আরামের মনে হয়। জ্ঞান, বিশেষ কইরা নিজের সম্পর্কে জ্ঞান রাখাটাই স্বাধীনতা।

 

৩ জানুয়ারি : (যেসব জিনিস তেমন একটা ম্যাটার করবে না দূর ভবিষ্যতে, সেগুলার প্রতি নির্দয় থাকেন)

“আপনার নিজের অজান্তেই জীবনের কতটা সময় আপনি অপচয় করে ফেলছেন হয়তো ধারনাও নাই সে সম্পর্কে, অর্থহীন বিষাদ, নির্বুদ্ধি আনন্দ, লোভী কামনা এবং সামাজিক ঠাট্টা-মশকরা, এসবের যাঁতাকলে ঠিক কতটুকুইবা আপনি নিজেরে নিজে দিতে পারছেন? একসময় আপনি হঠাৎ উপলব্ধি করবেন, এসব সময়কে টের পাওয়ার আগেই আপনার নিজের সময় শেষ হইয়া যাচ্ছে!”

-সেনেকা, ON THE BREVITY OF LIFE, 3.3b


“না” বলতে পারাটা জীবনের অন্যতম কঠিন কাজগুলার মধ্যে একটা। কোনো দাওয়াত, কারও অনুরোধ, কখনো কর্তব্য, এবং সবাই যা করতেছে তা নির্বিচারে করা, এইসব বিষয়রে মাঝেমাঝে না বলতে পারাটা জীবনে একটা বড় অর্জন। এমনকি সময় অপচয়কারী অনেক আবেগরেও না বলা আরও কঠিন, যেমন রাগ, উত্তেজনা, বিভ্রান্তি, অবসেশন, কামনা। এইগুলার কোনোটারেই আসলে তেমন বড় কোনো আবেগের ইস্যু হিসেবে দেখা হয় না, কিন্তু এইগুলাই একটা সময় কমিটমেন্টের মত হয়া ওঠে, পিছ ছাড়ে না আমাদের। আপনি যদি সতর্ক না থাকেন, তাইলে এইগুলাই আপনার জীবনরে উলট-পালট কইরা দিতে পারে। আপনার কি কখনো এমন মনে হয় নাই যে আপনি বেশি ব্যস্ত দিন কাটাইতেছেন? ইশ! ফ্রি সময়গুলা যদি ফেরত পাইতাম আরেকবার- এমন মনে হয় একবারও! তাইলে “না” বলার শক্তি অর্জন করেন। যেমন, “না ভাই থাক, থ্যাংকস”, “না আজকে ওইখানে যাইতে পারবো না, সরি”, “না, এইটা এখন করতে পারবো না, সরি”। হয়তো এইটা কিছু মনোমালিন্য সৃষ্টি করবে মাঝেমাঝে। হয়তো কাজটা অনেক পরিশ্রমেরও। কিন্তু যে বিষয়গুলা ভবিষ্যতে তেমন একটা ম্যাটার করবে না আপনার কাছে, আপনি সেইগুলারে যত না বলবেন, ততই যেইগুলা আসলেই প্রভাব ফেলবে, সেইগুলারে হ্যাঁ বলতে পারবেন। তাতে কইরা আপনিই আপনার জীবনে আরও সুন্দর করে বাঁচতে পারবেন, উপভোগ করতে পারবেন – যেমনটা আপনি আসলেই চান।

 

৪ জানুয়ারি : (তিন পাত্তি)

মাত্র তিনটা জিনিসই আপনার সব থিকা বেশি দরকার : বর্তমানের কোনো একটা সিদ্ধান্ত বা বিচার সম্পর্কে নিশ্চিত থাকা, কমন গুড সার্ভ করে এমন কাজ করা (মঙ্গল), এবং আপনার চলার পথে যাই আসুক না কেন, সেটারে কৃতজ্ঞতার সাথে গ্রহণ করা।

-মার্কাস অরিলিয়াস, MEDITATIONS, 9.6


প্রত্যক্ষন, কাজকাম এবং ইচ্ছাশক্তি। এই তিনটা ব্যাপার হইতেছে স্টোয়িক দর্শনের মূলভিত্তি (এমনকি এই বই লেখার ক্ষেত্রেও আমি সেই নির্দেশনাই কাজে লাগাইছি)। স্টোয়িক দর্শনের ইতিহাস জানার থিকা, এর মূল বিষয়গুলো নিয়া আলোচনাই বেশি ফলপ্রসূ। স্টোয়িক দর্শনের বিভিন্ন দার্শনিকরা কই থাকতো, তাদের জন্ম কতসালে, এসব আলোচনার থিকা তারা কী বিশ্বাস করতো, এবং সেইটা কীভাবে আমাদের জীবনে কাজে লাগতে পারে, এই আলাপ বেশি জরুরী। “হেরাক্লিটাস অমুক কথাটা বলছে…” “জেনোর আবাসস্থল সাইপ্রাসের সিটিয়াম শহরে, সে অমুক কথাগুলা বলছে…” এই টাইপের আলাপ সারাদিনই চালানো যাইতে পারে, কিন্তু এইগুলা আমাদের জীবনে কীভাবে কাজে আসতে পারে, সেই আলাপটাই আরও বেশি জরুরী। কোন দার্শনিক কী বলছে, কোন দার্শনিকের জন্ম কতসালে, সেইটা আমাদের প্র্যাকটিক্যাল জীবনে কোনো কাজে লাগে কি? তার থিকা বেশি কাজে লাগে তাদের ওই কথাগুলা কীভাবে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করা যায়, সেই আলাপ।

যা-ই হোক, উপরের তিনটা বিষয় সম্পর্কে একটা ছোট রিমাইন্ডার স্টোয়িক দর্শনের সবথেকে প্রয়োজনীয় অংশগুলোর কথা বলে, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে কাজে লাগতে পারে।

নিজের প্রত্যক্ষনরে কন্ট্রোল করেন।

ঠিকভাবে নিজের কাজ করেন।

যেইসব জিনিস আপনার কন্ট্রোলের বাইরে, সেইগুলারে ইচ্ছাকৃতভাবেই নিতে শিখেন।

স্টোয়িক দর্শনরে জীবনে কাজে লাগাইতে গেলে এই তিনটাই সবচেয়ে দরকারী।

 

৫ জানুয়ারি : (উদ্দেশ্যের স্পষ্টতা)

যে কোনো কাজের ক্ষেত্রে আপনার সকল চেষ্টাকে নিয়োজিত করেন, এবং তার গন্তব্য ও সমাপ্তি সম্পর্কে ভাইবা রাখার চেষ্টা করেন। মানুষরে যা বিভ্রান্ত করে তা কাজকর্ম না, বরং কোনো কিছু সম্পর্কে ভুল ধারণাই তারে উন্মাদ কইরা তোলে।

-সেনেকা, ON TRANQUILITY OF MIND, 12.5


The 48 Laws of Power বইয়ের ২৯নং পয়েন্টটা হইলো, যে কোনো কাজের পরিকল্পনা একদম শেষ পর্যন্ত করবেন। রবার্ট গ্রিনের মতে, “একবারে শেষ পর্যন্ত চিন্তা কইরা সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা সাজাইলে বিভ্রান্তি কমে এবং এ সম্পর্কেও নিশ্চিত থাকা যায় কোন জায়গায় থামতে হবে। দূরদর্শী চিন্তার মাধ্যমে ভবিষ্যত সম্পর্কে ভাবেন এবং ভাগ্যের উপর কম নির্ভর করেন।” The 7 Habits of Highly Effective People বইতে দ্বিতীয় অভ্যাসটাই হইলো, যেকোনো কাজ শুরু করার সময় ওই কাজের শেষটা সম্পর্কেও পরিকল্পনা কইরা রাখা।

একটা কাজ কীভাবে শেষ হবে বা করতে হবে, সেইটা সম্পর্কে ভাইবা রাখলেই যে আপনি কাজটি সাকসেসের সাথে কমপ্লিট করতে পারবেন, তেমনটাও না আবার। তবে যদি সেইরকম না ভাইবা রাখেন, তাইলে এটা গ্যারান্টির সাথে বলা যায় যে, অন্তত ঐ কাজটা আপনি সম্পূর্ণ শেষ করতে পারবেন না। স্টোয়িকদের মতে oiêsis (false conceptions) বা ভুল ধারনা, বিভ্রান্তি, এইগুলা শুধু আপনার মানসিক অশান্তির জন্যই দায়ী না, আপনার জীবনের বিশৃঙ্খলার জন্যও দায়ী। আপনার যদি কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্যই না থাকে আগে থিকা, তাইলে কীভাবে বুঝবেন যে কোন কাজটা আপনারে করতে হবে? আর কোনটা করা যাবে না? আপনি কীভাবে কোনো কাজ যথেষ্ট হইছে কিনা সেটাই বা কীভাবে পরিমাপ করবেন? যদি আপনি এটাই না জানেন যে আপনার মূল লক্ষ্যটা কী?

উত্তর হইতেছে, আপনি পারবেন না। এবং ফ্রাস্টেশনে ভুগবেন – অথবা তার থিকাও খারাপ, উদ্দেশ্যহীনতার কারণে পাগল হয়া যাবেন।

 

৬ জানুয়ারী : (কোথায়, কে, কী এবং কেন)

যে ব্যক্তি জানে না দুনিয়া কী, দুনিয়ার কোন অংশে সে অবস্থান করতেছে, জীবনের উদ্দেশ্য কী, দুনিয়াতে তার পরিচয় কী। এসব প্রশ্নের কোন উত্তরই যে ব্যক্তি জানে না এবং এটা বুঝার চেষ্টাও করে না যে তার জন্ম দুনিয়াতে কেন হইছে। এমন ব্যক্তির কাছ থেকে কোনো ধরনের ফাঁপা প্রশংসা আশা করেই বা লাভ কী?

-মার্কাস অরিলিয়াস, মেডিটেশন্স, ৮.৫২


পরলোকগত কমেডিয়ান মিচ হেডবার্গের এই বিষয়ে একটা মজার ঘটনা আছে। একবার সে রেডিওতে গেল ইন্টারভিউ দিতে। রেডিও’র ডিজে অন এয়ারেই তারে প্রশ্ন কইরা বসলো, আপনি কে? আপনার পরিচয় কী? এই মুহুর্তে, হেডবার্গ কিছুটা কনফিউজড হইলো এবং নিজেরেই নিজে প্রশ্ন করলো, এই লোকটা কি আমার কাছে আসলেই গভীর প্রশ্ন করে বসছে নাকি আমি ভুল কোনো রেডিও স্টেশনে চলে আসলাম?

আমরা প্রতিদিনই কাউকে না কাউকে প্রশ্ন করি, আপনি কে? কী করেন আপনি? কোত্থেকে আসছেন ভাই? এই ধরনের প্রশ্নগুলারে হয়তো আমরা হালকাভাবেই নেই, এবং সে অনুযায়ীই জবাব দেই। এর বেশি কিছু চিন্তাও করি না আমরা। কিন্তু কাউরে যদি কখনো এইসব প্রশ্নগুলার উত্তর গভীরভাবে দেয়ার জন্য বাধ্য করা হয়, তখন বেশিরভাগ লোকজনই এর কোনো আলাদা উত্তর দিতে পারবে না। পাঠক, আপনারা নিজেরা কি পারতেন উত্তর দিতে? ভাইবা দেখেন একবার, আপনি দিনে কতক্ষণ সময় ব্যয় করেন এই ধরণের প্রশ্নগুলারে গভীরভাবে রিয়েলাইজ করতে? নাকি আপনিও জীবনের অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলা নিয়াই বেশি ব্যস্ত? ভুল জিনিসের পিছনে ছুটে সময় অপচয় করতেছেন? যার পরিণতি খুবই ফ্রাস্ট্রেটিং?

 

৭ জানুয়ারী : (মনস্তত্ত্বের ৭টা স্পষ্ট ক্রিয়াকলাপ)

বাছবিচার, প্রত্যাখান, আকাঙ্খা, বিতাড়ন, প্রস্তুতি, উদ্দেশ্য এবং সম্মতি, এই সাতটা জিনিস ঠিকঠাক মত চর্চা করতে পারাই একজনের মনস্তত্ত্বের কাজ। এইগুলা নিয়া ঠিকঠাক সিদ্ধান্তে যে আসতে পারে, একমাত্র কুমতলব ছাড়া অন্য আর কিছুই তার মনস্তত্ত্বকে দূষিত করতে পারে না।

-এপিকটেটাস, ডিসকোর্সেস, ৪.১১.৬-৭

 

চলেন এইবার এই কাজগুলারে একটা একটা কইরা ভাইঙ্গা দেখা যাক :

বাছবিচার- সঠিক কাজ করতে পারা এবং সঠিকভাবে ভাবতে পারা

প্রত্যাখান-  প্রলোভনরে প্রত্যাখান করতে পারা

আকাঙ্খা- উন্নতিসাধনের

বিতাড়ন- নেতিবাচকতা, কুপ্রভাব, অসত্য, এইগুলারে তাড়াইতে পারা

প্রস্তুতি- সামনে যাই আসুক, যাই ঘটুক, সেগুলারে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত থাকা

উদ্দেশ্য- আমাদের লাইফের গাইডেন্স এবং কোন বিষয়টাকে প্রাধান্য দিবো বেশি সেটা ঠিক করা

সম্মতি- আমাদের কন্ট্রোলের মধ্যে ও বাইরে যা আছে সেগুলা সম্পর্কে ইল্যুশন দূর করা এবং কন্ট্রোলের বাইরে যা আছে সেগুলাকে মাইনা নেয়া।

আমাদের মনস্তত্ত্বের এই সাতটা কাজই প্রধান। এটা আমাদের নিশ্চিত করা উচিত প্রথমে, এবং এর বাইরে যা আছে সেগুলা যেকোনো সময় আমাদের মনকে দূষিত কইরা তুলতে পারে।

 

৮ জানুয়ারী : (আসক্তি সম্পর্কে সচেতনতা)

আমাদের যেকোনো ধরনের অ্যাডিকশন বাদ দিতে পারা উচিত, সেইগুলা যদি ভালো হয় তারপরেও। তা নাইলে, সাহসের অভাব দেখা দেয় আমাদের মধ্যে, যেটা প্রতিনিয়ত পরীক্ষার মধ্যে রাখতে হয়। আত্মার মহত্ত্ব লোপ পায় অ্যাডিকশনে, আত্মার মহত্ত্ব জারি রাখতে আমাদের তুচ্ছ বিষয়গুলারে ঝাইড়া ফেলতে হবে ভেতর থিকা, যেইগুলা আসলে হুজুগে জনতার তুচ্ছ আকাঙ্খা।

-সেনেকা, মোরাল লেটার্স, ৭৪.১২বি-১৩


যে বিষয়গুলাকে আমরা প্রথমে ছোটখাটো ইচ্ছাপূরণের মত কইরা দেখি, সেইগুলাই একসময় পুরাদস্তুর আসক্তিতে রূপ নিতে পারে। সকালবেলা আমরা কফি বা চা খাইয়া দিনটা শুরু করি, এবং এভাবে চলার কিছুদিন পরে দেখা যায়, আমরা চা কফি ছাড়া সকালটাই ঠিকমত শুরু করতে পারি না। মোবাইলে ইমেইল চেক করি আমরা কারণ এটা আমাদের কাজের অংশ, এবং শীঘ্রই দেখা যায় আমরা একটু পরপর ইমেইল চেক করার বিষয়টাতে অ্যাডিক্টেড হয়া পড়ি। ফেসবুকের লাইক, কমেন্ট, মেসেজ চেক করার ক্ষেত্রেও এমন হয় আমাদের। একটা সময়ে দেখা যায়, এই ক্ষতিহীন অভ্যাসগুলাই আমাদের জীবনটারে নিয়ন্ত্রন করে চালাইতেছে। এই ছোট ছোট ব্যাপারগুলাই একসময়ে আমাদের স্বাধীনতাকে খাটো করতে শুরু করে, আমাদের চিন্তার স্বচ্ছতারে অন্ধকারাচ্ছন্ন কইরা তুলে। আমরা ভাবতে থাকি, আমরাই কন্ট্রোল করতেছি, কিন্তু আসলেই কি ব্যাপারটা সেইরকম? যেমন একবার এক অ্যাডিক্টেড লোকের মুখে শুনেছিলাম : অ্যাডিকশন হইতেছে, কোনোকিছু থিকা অফ থাকার স্বাধীনতা বন্ধ হয়া যাওয়া।

আপনার অ্যাডিকশনের ক্ষেত্র কি হতে পারে? মদ? ড্রাগস? সবকিছু নিয়া অভিযোগ? পরচর্চা? ইন্টারনেট? নখ কামড়ানো? অ্যাডিকশন যা-ই হোক, সেইটা থিকা বিরত থাকার স্বাধীনতারে পুনরায় পাইতে হবে, নাইলে সেইটা আপনার সেলফ-কন্ট্রোল এবং চিন্তার স্বচ্ছতারে ক্ষতি করবে।

 

৯ জানুয়ারী : (আমাদের কন্ট্রোলে কি আছে এবং কি নাই)

কিছু জিনিস আমাদের কন্ট্রোলে থাকে, কিছু জিনিস থাকে না। আমাদের মতামত, বাছবিচার, কামনা, ঘৃনা, এক কথায় যেইগুলা আমাদের নিজস্ব কাজের মধ্যে, সেগুলোকে আমরা কন্ট্রোল করতে পারি। আমরা আমাদের জৈবিক ক্রিয়াকলাপ, সম্পত্তি, মর্যাদা, অবস্থান, এক কথায় যেইগুলা আমাদের নিজের কাজের বাইরে, সেইগুলারে আমরা কন্ট্রোল করতে পারি না। এমনকি আরও বলা চলে, যেইগুলা আমাদের কন্ট্রোলে, সেইগুলা ন্যাচারালি স্বাধীন, বাধাহীন এবং রোধহীন। অন্যদিকে যেইগুলা আমাদের কন্ট্রোলের বাইরে, সেইগুলা দুর্বল, দাসসুলভ, বাধাযুক্ত এবং নিজস্ব না।

-এপিকটেটাস, এনক্রিডিওন, ১.১-২


আজকে আপনি এমন কোনো কাজ কন্ট্রোল করার ট্রাই কইরেন না, যেইটা আপনার কন্ট্রোলের বাইরে। ভয় লাগছে? কিছুটা ভয়েরই, কিন্তু এইটাই ব্যালেন্স হয়ে যায় যখন বুঝতে পারবেন যে, বাইরে কী ঘটতেছে সেটা আপনার কন্ট্রোলে না থাকলেও, সেই সম্পর্কে আপনার মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি আসলে আপনার কন্ট্রোলেই আছে। আপনি নিজেই ওইসব ঘটনার বিচারক হইতে পারেন, বিচার করতে পারেন সেইগুলা ভালো নাকি খারাপ। আপনি সিচুয়েশন কন্ট্রোল করতে পারেন না, কিন্তু সে সম্পর্কে আপনি কী ভাববেন, সেটা আপনার কন্ট্রোলে।

এইটা কীভাবে কাজ করে দেখতে চান? প্রতিটা জিনিস, যেটা আপনার কন্ট্রোলের বাইরে – বাইরের জগত, আপনি বাদে অন্যরা, আপনার ভাগ্য, আপনার কার্মা, অথবা যাই বলেন না কেন, কন্ট্রোলের বাইরের সবকিছুই আপনার কন্ট্রোলের মধ্যে যে কাজগুলা, সেইগুলার সাথে একভাবে রিলেটেডও। এবং এই ব্যাপারটাই আপনারে অনেক শক্তি দেয় বিষয়গুলারে ম্যানেজ করার ক্ষেত্রে।

সব থেকে ভালো ব্যাপার এই যে, আপনার কন্ট্রোলে কোন কাজগুলা আছে, সেইগুলা সম্পর্কে একটা স্বছ বোঝাপড়া করতে পারলে, দুনিয়া সম্পর্কেও আপনার একটা স্বচ্ছতা আইসা পড়ে। একমাত্র মন ছাড়া আমাদের আর কিছুই নাই। মনে রাখবেন, আজকে আপনি যে বাইরের দুনিয়ায় আপনার আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করতেছেন, সেইটা যদি আপনার ভিতরের দুনিয়ার ক্ষেত্রে হইতো, তাইলে আপনি অনেক আগায়া যাইতেন।

 

১০ জানুয়ারী :(যদি আপনি অটল থাকতে চান)

যে কোনো শুভ ব্যাপারের মূলকথা হইতেছে যৌক্তিক বিচার; আর অশুভ ব্যাপারের মূলকথা ঠিক তার উল্টা। এই তো গেল এদের অন্তঃসারের ব্যাপার। তাহলে এদের বাইরের রূপগুলারে কীভাবে দেখবো? বাইরের দুনিয়ার বিষয়গুলা শুভ অথবা অশুভ’র অন্তঃসারের মালমসলা হিসেবে কাজ করে শুধু। তাইলে কীভাবে শুভ অশুভ’র সন্ধান করবো? অবশ্যই বাইরের দুনিয়ার কোনো কিছুর উপর ভিত্তি করে না। হিসাবটা একদম সোজা, যৌক্তিকভাবে বিচার কইরাই আমরা সহজ পথে কোনোকিছুর শুভ দিকটা বাইর করতে পারি, আর যদি সেইখানে ঝামেলা মনে হয়, তাহলে ওই জিনিসটা অবশ্যই অশুভ।

-এপিকটেটাস, ডিসকোর্সেস, ১.২৯.১-৩

 

স্টোয়িকরা সবসময় অবিচল থাকতে চায়, স্থিতি চায়, প্রশান্তি চায়, যেগুলা আমরা সবাইই চাই, কিন্তু খুব অল্পই স্বাদ পাই এসবের। তাইলে তারা কীভাবে এই জিনিসটা পায়?

মোটেই ভাগ্যের উপর নির্ভর করে পায় না উনারা। বাইরের সবকিছু থিকা নিজেরে বঞ্চিত কইরা, একা একা জঙ্গলে গিয়া বইসা ধ্যান কইরাও তারা পায়না এইগুলা। এইগুলা পাওয়ার জন্য তাদের একমাত্র পথই হইতেছে যৌক্তিকতার দিক থিকা বিচার বিবেচনার প্রবণতা। হ্যাঁ, আমাদের যৌক্তিক বিবেচনার শক্তি এতটাই যে, এটা আমাদের বাইরের দুনিয়ার সব জটিল এবং বিভ্রান্তিকর জিনিসরেও আমাদের সামনে সুশৃংখল উপায়ে দেখায়া দিতে পারে।

যা-ই হোক, যদি আমাদের যৌক্তিক বিচার প্রক্রিয়াতে জটিলতা থাকে, তাইলে এর সাথে সাথে আমরা কীভাবে আমাদের চারপাশের সবকিছুরে দেখতেছি, সেই প্রক্রিয়াতেও জটিলতা ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়, যা আমাদের মনের শান্তিতে ডিস্টার্ব করতে পারে। যদি আপনি প্রশান্তি ও অবিচল থাকতে চান, তাইলে একমাত্র উপায় হইতেছে স্পষ্টতার সাথে যৌক্তিক পদ্ধতিতে বিচার বিবেচনারে কাজে লাগানো।


১১ জানুয়ারী :(ফ্লেক্সিবল থাকার মন্ত্র)

যদি কোনো ব্যক্তি তার যৌক্তিক বিচারের ফোকাস হিসাবে ঐসব জিনিসগুলারেই বাইছা নেয়, যেইগুলা তার কন্ট্রোলের বাইরে, যেইগুলা অন্যের কন্ট্রোলে; তাইলে সে প্রচন্ড ডরাইন্না, অস্থির এবং জঘন্য সিচুয়েশনের সামনাসামনি হবে। আর যে ব্যক্তি নিজের অন্তর্গত কারণ এবং যেইসব বিষয়ের উপর তার কন্ট্রোল আছে, সেইগুলার উপরে যৌক্তিক বিচারের ফোকাস রাখে, একমাত্র তাইলেই সে পারবে বাইরের অনিয়ন্ত্রিত বিষয়গুলা থিকা নিজের মনের প্রশান্তিকে বাঁচাইতে।

-এপিকটেটাস, ডিসকোর্সেস, ২.১.১২

 

জেন দার্শনিকদের কথা ভাবলেই, আমাদের মাথায় যেমন একটা ইমেজ ভাইসা ওঠে, থান কাপড় পড়া এক টাকলা বেটা বইসা আছে সবুজ পাহাড়ের উপরে কোনো এক মন্দিরে, বইসা বইসা ধ্যান করতেছে। স্টোয়িকরা একদম এই ইমেজের একটা অ্যান্টিথিসিস বলা চলে। পারতপক্ষে, একজন স্টোয়িক যে কেউই হইতে পারে, শেয়ারবাজারে ঘুরাফিরা করা দালাল, সংসদের এমপি, মনোযোগ দিয়া শিল্পকর্ম করতে থাকা শিল্পী অথবা একজন সাধারণ গৃহিনী যে তার সৈনিক স্বামীর যুদ্ধ থিকা ফিরা আসার অপেক্ষায় দিন গোনে।

এসব কথা বইলা এপিকটেটাস আসলে আমাদের কী বুঝাইতে চায়? তার পয়েন্ট এটাই যে, প্রশান্তি ও স্থিতি আমাদের বাছবিচারের ব্যাপার, বাইরের পরিবেশের ব্যাপার না। আপনি চাইলে একা একা সব ছাইড়া জঙ্গলে গিয়া বইসা থাকতে পারেন, টেনশন কমানোর লাইগা, কিন্তু লাভ নাই, সেখানেও আপনি চাপ খাইতে পারেন, কিন্তু আপনি যদি নিজের মধ্যেই চাপ না খাওয়ার একটা যৌক্তিক বাছবিচার পদ্ধতি বাইর কইরা নিতে পারেন, তাইলে আপনি যে অবস্থানে আছেন, সেইখান থিকাই টেনশন ফ্রি জীবনযাপন করতে পারেন।

 

১২ জানুয়ারী :(প্রশান্তি লাভের পথ)

সকাল দুপুর রাত, এই তিনবেলা নিজেরে শুধু এই কথাটাই মনে করায়া দিবেন যে : সুখলাভের একমাত্র পথ হইতেছে, নিজের বাছবিচারের বাইরে যা কিছু আছে তা নিয়া কোনো চিন্তা না করা, এমনকি আপনি যেই সম্পত্তির মালিক, সেই সম্পত্তির কন্ট্রোলও আপনার হাতে না আসলে। নিজের বাছবিচারের জায়গা বাদে আর যা আছে, তা সবকিছুই আল্লাহ এবং তাকদীরের ব্যাপার।

-এপিকটেটাস, ডিসকোর্সেস, ৪.৪.৩৯


আজকে সকালে, নিজেরে একবার মনে করায়ে দেন, কী কী জিনিস আপনার কন্ট্রোলে আছে, আর কী কী জিনিস নাই। যেগুলা কন্ট্রোলে আছে সেগুলার উপরে ফোকাস করার জন্য নিজেরে বুঝান। দুপুরে খাওয়ার আগে, নিজেরে এটা মনে করায়ে দেন যে, একমাত্র নিজের বাছবিচারই আপনার সম্বল, এছাড়া আর সবকিছুই আপনার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব।

আপনার নিজের বাছবিচারের বাইরে, আপনার যে তাকদীর, সেইটাও পুরাটা আপনার উপরে নির্ভরশীল না। দুনিয়া ঘুরতেছে, আমরাও এর সাথে সাথে ঘুরতেছি, খারাপ কি ভাল সেটা আমাদের হাতে নাই, এইটা নিজেরে মনে করায়া দিবেন বিকালে।

দুনিয়ার কতোটা আপনার নিজের কন্ট্রোলে আর কতোটা নিজের কন্ট্রোলের বাইরে, এইটা ভাবতে পারেন সন্ধ্যার দিকে।

সবশেষে, ঘুমাইতে যাওয়ার সময় অবশ্যই এইটা মনে রাখবেন যে, ঘুমানো এক ধরণের সারেন্ডারের মত, একটা বিশ্বাসের মত, যে আগামীকাল সকালে আপনি উঠবেন এবং ঠিকঠাকভাবে আজকের দিনের একই সার্কেল কমপ্লিট করবেন।

 

১৩ জানুয়ারী :(কন্ট্রোলের ভুলভুলাইয়া)

আমরা শুধুমাত্র আমাদের যৌক্তিক বাছবিচার এবং সে অনুযায়ী নৈতিক ইচ্ছাতে করা কাজগুলাই কন্ট্রোল করতে পারি। বাকি সব, এমনকি যেইগুলার সাথে আমরা খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িত, আমাদের শরীর, শরীরের অংশ, সম্পত্তি, বাবা মা, সন্তান এমনকি আমাদের রাষ্ট্র, এসবের কোনোকিছুই আমাদের নিয়ন্ত্রণে না।

-এপিকটেটাস, ডিসকোর্সেস, ১.২২.১০

এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা স্টোয়িকরা বারবার রিপিট করে : একজন প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি খুব ভাল কইরাই জানে, কী তার কন্ট্রোলের সার্কেলের মধ্যে আছে আর কী নাই।

স্টোয়িক মতে, কন্ট্রোলের সার্কেলের মধ্যে শুধুমাত্র একটা জিনিসই আছে, সেইটা হইতেছে আমাদের মন। এমনকি আপনার শরীরও অনেক সময় আপনার কন্ট্রোলের বাইরে থাকে, এই যেমন ধরেন, আপনার কখন অসুখ করবে, সেটা আপনার কন্ট্রোলে নাই একেবারেই। বিদেশ ভ্রমণে গিয়া হঠাৎ কইরাই আপনার জেলখানায়ও থাকতে হইতে পারে যে কোনো কারণে। কিন্তু এইগুলা আসলে একরকম সুখবরই, কারণ যত কম জিনিস আপনি কন্ট্রোল করতে পারবেন, তত আপনার উপরে চাপ কমবে আসলে, তত কম জিনিস নিয়া আপনারে চিন্তা করতে হবে। স্পষ্টতা একমাত্র সরলতার মাধ্যমেই পাওয়া সম্ভব। দুনিয়ার সবাই এমন সব জিনিস নিয়া দৌড়ের উপরে থাকে, যেগুলার জন্য আসলে তারা নিজেরা দায়ী না বেশিরভাগ সময়ে। কিন্তু আপনি স্টোয়িক হইলে আপনার চিন্তা একটাই, সেটা হইতেছে আপনার নিজের মনের উপরে দখল রাখা। আপনার চিন্তার বিষয় হবে আপনার ইচ্ছাশক্তি, আপনার বাছবিচার, আপনার মন। এইটাই মনে রাখবেন সবসময়।

 

১৪ জানুয়ারী :(কীভাবে আরেকজনের পাপেট হইবেন না)

শারীরিক চাহিদা যা আপনারে অন্যের পাপেট বানায়া ফেলতে পারে, এই চাহিদার থিকাও আরও শক্তিশালী এবং গায়েবি ক্ষমতা আপনার মধ্যে আছে, এইটুক যদি আপনি উপলব্ধি করতে পারেন, তাইলে এমন আর কি আছে যা আপনার মনকে অশান্তি দিতে পারে? সেগুলা কি ভয়, সন্দেহ, কাম বা এর থিকা অন্য কিছু?

-মার্কাস অরিলিয়াস, মেডিটেশন্স, ১.২.১৯


কিছুক্ষণের জন্য চিন্তা করে দেখেন, বাজারের পণ্য কীভাবে আপনার পকেট থেকে টাকা খসানোর ধান্দা করতে পারে। খাদ্যবিজ্ঞানীরা এমন সব খাবার আইটেম তৈরীতে ব্যস্ত যা আপনার জিভরে এক্সপ্লয়েট করতে পারে। সিলিকন ভ্যালির ইঞ্জিনিয়াররা ব্যস্ত নতুন কোনো অ্যাডিক্টিভ অ্যাপ তৈরীতে, যা আসলে জুয়া খেলার মতই অ্যাডিকশন তৈরী করে। মিডিয়া প্রতিনিয়ত এমন সব গপ্পো ফাঁদতে থাকে যা আপনার ক্রোধের আগুনে ঘি ঢালতে পারে। এতসব উদ্দীপকের ভীড়ে আসল চিন্তার ব্যাপারগুলাই হারায়া যাইতে পারে। মার্কাসের একদিক থেকে সুবিধা হইছিলো যে তার সময়ে এসব ছিলো না, তবে তার সময়ে কি একেবারেই কিছু ছিলো না যা বিভ্রান্তকর? ছিলো অবশ্যই। কানাঘুষা করা, কাজের প্রচণ্ড ব্যস্ততা, ভয়, সন্দেহ, কাম। প্রতিটা মানুষই অন্তরের এবং বাইরের বিভিন্ন বিষয় দিয়া সিডিউস হইতে পারে যেগুলা আসলে খুবই শক্তিশালী। কিন্তু এইখানে দর্শনের কেরামতি আপনাকে বাঁচাইতে পারে। দর্শন আপনাকে শুধুমাত্র দাবার একজন সৈন্য হইয়া থাকতে দেয় না, সে আপনাকে যৌক্তিকভাবে চিন্তা করতে শেখায়, যার ফলে আপনি অন্যের পাপেট হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পারেন। ভিক্টোর ফ্রাংক তার The Will to Meaning বইতে বলছিলেন, মানুষ তার মটিভেশন দিয়া কাজ করে এবং মূল্যবোধের কারণে বিরত থাকে। এখন এই বিরত থাকা আসলে কী? অন্যের পাপেট হওয়ার থেকে বিরত থাকা। এটা ঠিক যে মনোযোগ দিয়া যুক্তিসহকারে চিন্তা করা একটা কঠিন ব্যাপার, কিন্তু আরেকজনের হাতের পাপেট হইয়া থাকার চেয়ে ওটাই কি ভালো না?

 

১৫ জানুয়ারী : (নিজের পথে অবিচল থাকতে পারাই প্রশান্তি)

প্রশান্তি একমাত্র তারে দিয়াই পাওয়া সম্ভব যার বাছবিচারের শক্তি অটল এবং মজবুত, বাকিরা শুধুমাত্র একটা সিদ্ধান্তহীনতার বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাইতে থাকে। পরিস্থিতি মাইনা নিতে পারা আর না নিতে পারার মধ্যে ঘুরপাক খাইতে থাকে তারা। এই ঘুরপাক খাইতে থাকার কারণ কী? এর কারণ তাদের বাছবিচারের জায়গাটা অস্পষ্ট এবং সাধারণ মানুষের মতামতের মতই তা নির্দেশনাহীন।

-সেনেকা, মোরাল লেটার্স, ৯৫.৫৭বি-৫৮এ


প্রশান্তি সম্পর্কে সেনেকার প্রবন্ধে, উনি গ্রিক শব্দ euthymiaব্যবহার করছেন। নিজের উপরে বিশ্বাস রাখা এবং আপনি ঠিক পথে আছেন এই আস্থা রাইখা অন্যদের বাছবিচারের ঘুরপাক চক্রে পড়তে মানা করতেছেন সেনেকা উনার প্রবন্ধে। দৃষ্টির স্পষ্টতা থাকলেই এইটা আয়ত্ব করা সম্ভব। তার মানে এই না যে, সবসময়েই আমরা একশত ভাগ ঠিক সিদ্ধান্তে পৌছাবো, এমনটা উচিতও না। এখানে আসল কথা হইতেছে, নিজের বাছবিচারকে অন্যের প্রভাবমুক্ত রাখা, বাকিদের সাথে নিজেকে তুলনা কইরা ছোট না করা। বাকিদের বাছবিচার দিয়া প্রভাবিত হয়া বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে না পরা।

পক্ষান্তরে, প্রশান্তি হইতেছে এমন এক বিষয়, যেটা আয়ত্ত্ব করার জন্য আপনার নিজেকেই নিজের নির্দেশনা খুঁইজা নিতে হবে, এবং সেটাতেই স্থির থাকা উচিত। এদিক-ওদিক ঘুরপাক খাইতে থাকলে কখনোই নিজের প্রশান্তির পথ খুঁইজা পাওয়া সম্ভব না।

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

শাহরিয়ার জিম

জন্মঃ ১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৯৬ সালে, ঢাকা মেডিকেলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের ছাত্র, ফিলোসফি গিক, আইলসা লেখক। আপাতত আজিমপুরে থাকেন।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →