Main menu

মেরিন অ্যাকুরিয়ামে কাছিমের কী কাজ?

অনেকে বলেন, মুক্ত চিড়িয়া বন্দি রাখে চিড়িয়াখানা-অ্যাকোরিয়মগুলা। অনেকে বলেন, দরকারই তো; এই প্রাণিদের দেখায়ে তাদের ব্যাপারে বেবুঝ মানুষদের মনে মায়া জাগাতে হবে— মায়া হলে পরে মানুষেরা তখন দুনিয়া ও প্রাণপ্রকৃতির ব্যাপারে যত্নশীল হবে। এইসব বলাবলির মধ্যেই কিছুকাল আগে মাস চারেক কাজ করেছিলাম উত্তর আমেরিকার জর্জিয়া দেশের একটা অ্যাকোরিয়মে। জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকোরিয়মে, কমুনিকেশন ও পাবলিক প্রোগ্রামের কাজ।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

দিনে তো ভিজিটররা থাকেন, এবং হাজবেন্ড্রির কাজ ইত্যাদি, ফলে রাতের বেলায়ও অ্যাকোরিয়মে যেতাম একলা; ক্যাম্পাসে কেউ নাই, নিরিবিলিতে ডকুমেন্টেশনের কাজ করা যেতো। এমন এক রাতে কাছিমের টাঙ্কির সামনে বসে কাজ করতে করতে কী মনে করে একটা ছবি তুলে শেয়ার দিলাম। ছবিতে এক বন্ধু কমেন্ট দিলেন যে, এমন বন্দি প্রাণি দেখলে তার গভীর দুঃখ হয়। ব্যাপারটা মনে থাকলো আমার। কিছুকাল পরের আরেকদিন, স্কিডাওয়ে আইল্যান্ড ক্যাম্পাসে পালন হচ্ছে মেরিন সায়েন্স ডে, পাবলিকের জন্য, ল্যাবে-মাঠে-পানিতে-বনে বিরাট জনসমাগম; অনেকানেক বাচ্চা ও বুড়োরা আসছেন। অ্যাকোরিয়ম বিল্ডিংয়ের ভেতরে হর্স-শু কাঁকড়া, স্পাইডার ও হারমিট কাঁকড়া, শুামুক-ঝিনুকের একটা টাচ-ট্যাঙ্কের সামনে ভিজিটরদের হেল্প করতেছি; এই প্রাণিদের ব্যাখার কাজে, এবং ছুঁয়ে দেখার জন্য। টাচ করে দেখতে বাচ্চারাই বেশি আগ্রহী।

সুস্থ করে তুলবার পরে অ্যাকোরিয়মে একজন কাছিমকে বেশ ক’বছর রাখা যেতে পারে শিক্ষামূলক কাজে। এই ‘লেফটি’ ইউজিএ অ্যাকোরিয়মে তিন বছর ছিলো। এখন আটলান্টিকে মুক্ত।

সুস্থ করে তুলবার পরে অ্যাকোরিয়মে একজন কাছিমকে বেশ ক’বছর রাখা যেতে পারে শিক্ষামূলক কাজে। এই ‘লেফটি’ ইউজিএ অ্যাকোরিয়মে তিন বছর ছিলো। এখন আটলান্টিকে মুক্ত।

এরই মধ্যে দুপুরের দিকে নতুন আসা একজন বাচ্চাকে ব্যাখা করলাম, হর্স-শু কাঁকড়ারা কোথায় কীভাবে থাকে পানিতে— ওনাদের ছয়জোড়া সুন্দর পা কোনটা কী কাজে লাগে— পানিতে ওনাদের সুখ ও সমৃদ্ধির জন্য কেমন পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে আমাদের— ওনাদের ডিমের সাথে মাইগ্রেটরি পাখির জীবন কেমনে বান্ধা, ইত্যাদি। জিজ্ঞেস করলাম পানির মধ্যে হাত দিয়ে কাঁকড়া-শামুক-ঝিনুক কাউকে টাচ করতে চান কি না। জবাবে বাচ্চা জিজ্ঞেস করলেন, এইযে অনেক লোকেরা দেখছে প্রাণিদের এই ব্যাপারটা প্রাণিরা পছন্দ করছে কি না। ‘ডু দে লাইক ইট?’ মনে হলো ঘটনা সিরিয়াস। ওনার সাথে আসা ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলে বললেন সন্তানের বয়স পাঁচ। সহজে ব্যাখা করবার চেষ্টা করলাম, পাঁচ বছর বয়সী একজন মানুষকে যত সহজে বলা যায় দুই কি আড়াই মিনিটে; দেখো আমারো তো একই প্রশ্ন— কিন্তু এইখানে টাচ-ট্যাঙ্কে যেইমাত্রায় পরিকল্পনা করে এবং যতো যত্নের সাথে প্রাণিদের হ্যান্ডল করা হয় তাতে বায়োলজিস্টরা স্থির করেছেন যে এইটুকু হিউম্যান-কন্টাক্ট এই প্রাণিদের জন্য স্ট্রেসফুল রকমের ক্ষতিকর না।

ব্যাখ্যা শেষ হবার সাথেসাথে ওনার প্রশ্ন; বাট ডু দে লাইক ইট? সো মেনি পিপল আর সিয়িং দেম অ্যান্ড টাচিং, ডোন্ট দে ফিল স্যাড? ওনার মা বললেন, সন্তান তার বায়োলজিস্ট হতে চান— ফলে এই মেরিন সায়েন্স ওপেন ডে-তে নিয়ে আসছেন এইসব দেখাতে, কিন্তু উনি কোনো প্রাণিরই কাছে যেতে চাচ্ছেন না, দূরে দূরে দাঁড়িয়ে দেখেন শুধু। আমি পাঁচ বছর বয়সীর সামনে বসে বললাম, ইউ নেসেসারিলি ডোন্ট নিড টু টাচ দেম, বিকজ আই সি ইয়ু অলরেডি কেয়ার ফর দেম, সো গো অ্যান্ড বি আ বায়োলজিস্ট অর হোয়াটেভার ইউ লাইক টু বি লেটার ইন লাইফ। ইত্যাদি।

বিহাইন্ড দি সিন; জর্জিয়া-ক্যারোলিনার তিন অ্যাকোরিয়াম। হ্যাবিটাট তৈরি করা ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রাণিদের পালাপোষার জন্য দরকারি অবকাঠামো তৈরি ও দক্ষ-দায়িত্বশীল হাজবেন্ড্রি চালু রাখতে হবে।

বিহাইন্ড দি সিন; জর্জিয়া-ক্যারোলিনার তিন অ্যাকোরিয়াম। হ্যাবিটাট তৈরি করা ও স্বাস্থ্যসম্মতভাবে প্রাণিদের পালাপোষার জন্য দরকারি অবকাঠামো তৈরি ও দক্ষ-দায়িত্বশীল হাজবেন্ড্রি চালু রাখতে হবে।

 

আজকে ‘ওয়াইল্ড-লাইফ টুরিযম’ বিষয়ে একটা রিপোর্ট (https://www.nationalgeographic.com/magazine/2019/06/) পড়তে পড়তে এসব মনে পড়লো। তো, চিড়িয়াখানা কিম্বা অ্যাকোরিয়মের কাজ তো আসলে একইসাথে গভীর বেদনা ও আনন্দের কাজ। জগতের মাখলুকাতের ভালোর জন্য কিছু প্রাণিদের এনে মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা, যাতে মানুষেরা দেখতে পারে। এতে কাজের কাজ হয় কি না সেবিষয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ আছে। পক্ষের লোকেরা বলেন, কাজ হয়; মানুষদের যাদের দিলের মধ্যে জগতের অমানুষ প্রাণিদের জন্য রহম নাই, তাদের সাথে ওই প্রাণিদের একটা দেখাসাক্ষাতের ব্যবস্থা করে অন্তরের যোগাযোগ ঘটানো সম্ভব। কিন্তু যেই ব্যাপারে সবাই একমত সেইটা হলো; করতেই যদি হয় তবে চিড়িয়াখানা ও অ্যাকোরিয়মগুলাকে খুবই পেশাদার ও পোক্ত নিয়মকানুন-রীতপদ্ধতি মেনে ব্যবস্থাপনা করতে হবে। এমন একটা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবমূর্তি এবং ভেতরে-বাইরে এমন একটা অবকাঠামো ও পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে অত্যন্ত সম্মান-আদব-শ্রদ্ধার সাথে প্রাণিদের সাথে ইন্টার‌্যাক্ট করেন ভিজিটররা। বিশেষ করে বিপদাপন্ন প্রাণির বন্দিত্বের ব্যাপারটা যাতে হালকা চালে নেয়ার সুযোগ না থাকে, নিছকই ফুর্তি ও বিনোদনের ব্যাপার যাতে না হয়; বরং আল্লার নেয়ামত ও প্রাণিজগতের বৈচিত্র্য অ্যাপ্রিসিয়েট করবার উপযোগী অবকাঠামো-পরিবেশ-আবহ যাতে থাকে।

ধরা যাক, একটা অ্যাকোরিয়ম, তারা কীভাবে বিল্ডিয়ের বাইরে ও ভেতরে এমন পরিবেশ তৈরি করবে? জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকোরিয়ম; ওই দেশেরই আটলান্টায় অবস্থিত দুনিয়ার-সবচে-বড়ো অ্যাকোরিয়ম; এবং ক্যারোলিনা দেশের চার্লসটন অ্যাকোরিয়মের অভিজ্ঞিতার ভিত্তিতে কয়েকটা কথা বলি।

এক.

ধরা যাক, একটা কাছিম রাখা হবে টাঙ্কির মধ্যে প্রদর্শনীর জন্য। তাহলে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে, অন্যান্য অপশন থাকলে পরে আর মুক্ত একটা কাছিমকে সাগর থেকে ধরে নিয়ে আসা হবে না। সব কাছিমই কমবেশি বিপদাপন্ন, ফলে মুক্ত পরিবেশে যেই কাছিম নরমালি থাকতে পারতেছেন তাকে প্রদর্শনীর জন্য ধরে আনা বেঠিক, এবং ভিজিটরদের কাছে ভুল মেসেজ যায়। দেখা গেলো কোনো একটা আহত কাছিম পাওয়া গেলো, এমন আহত যে কিছুকাল চিকিৎসা দিলে ভালো হবে, কিন্তু সাগরে গিয়ে মুক্তভাবে নিজেরটা করেকেটে খেয়েপড়ে বেঁচে থাকতে পারবে না। ওই কাছিমকে অ্যাকোরিয়মে রাখা যেতে পারে। কিন্তু যদি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় যে সাগরে গিয়ে বাঁচতে পারবে, তবে তাকে কয়েক বছর পরে হলেও ছেড়ে দিতে হবে। যদি পারমানেন্টলি লিমিটেড ইলনেস থাকে তবে রেখে দেয়া যেতে পারে। কিম্বা কাছিম একজন ডিম থেকে বাচ্চা হয়ে বেরোবার পরেই এমন বিপদ ঘটলো যে আর সাগরে যেতে পারছে না (ধরা যাক ওনার ফ্লিপার একটা মচকে গেছে); তারে অ্যাকোরিয়মে রেখে যত্নে বড় করা যেতে পারে। কিন্তু বড় হবার পরে সুস্থ অবস্থায় থাকলে তারে অবশ্যই মুক্ত করে দিতে হবে।

টাচ-ট্যাঙ্কগুলা হইলো সবচে ক্রিটিকাল জায়গা। বুড়ো ও বাচ্চারা যাতে একইসঙ্গে প্রানিদের সাথে ইন্টার‌্যাক্ট করতে পারে এবং রেস্পেক্টফুল-অ্যাপ্রিসিয়েটিভ থাকে এই জটিল ব্যালান্সেল কাজটা করতে পারতে হবে।

টাচ-ট্যাঙ্কগুলা হইলো সবচে ক্রিটিকাল জায়গা। বুড়ো ও বাচ্চারা যাতে একইসঙ্গে প্রানিদের সাথে ইন্টার‌্যাক্ট করতে পারে এবং রেস্পেক্টফুল-অ্যাপ্রিসিয়েটিভ থাকে এই জটিল ব্যালান্সেল কাজটা করতে পারতে হবে।

গোড়ার কথা হলো প্রাণি সংগ্রহ-পালন-প্রদর্শনীর সব কাজের পেছনে মূল দর্শন হলো মুক্ত প্রাণিদের আসলে প্রকৃতিতে মুক্ত থাকারই কথা ছিলো, আপাতত এখানে রাখতে হচ্ছে মানুষের শিক্ষার জন্য। প্রাণি সে বিপদাপন্ন হোক বা না হোক, যদি তাকে ওয়াইল্ড থেকে সংগ্রহ করা হয়, তবে কবে কাকে কোত্থেকে এনে অ্যাকোরিয়মে ঢোকানো হলো— কেনো কীভাবে কতদিন রাখা হচ্ছে— সেসব বিস্তারিত টেক্সট ও ভিজুয়াল মাধ্যমে, বা ইন্টারঅ্যাকটিভ মাধ্যমে পরিস্কার করে তুলে ধরতে হবে ভিজিটরদের কাছে। বড়ো প্রাণি হোক বা ছোট, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রাণিদের আলাদা আলাদা নাম দিতে হবে সম্ভবপর ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে। তাতে করে ভিজিটররা অনেকদিন ধরে মনে রাখতে পারেন, যোগযোগ ঘটে দ্রুত, সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়। কোনো প্রাণিকে মুক্ত করা হলে, বা মারা গেলে, সেসব বিস্তারিত জানাতে হবে; কেনো কোথায় কীভাবে ইত্যাদি। সব প্রাণির সংখ্যা, জাতপাত, কালেকশন ডেট, রিলিজ/ডেথ ইত্যাদির রেজিস্টার পাবলিকের কাছে একসেসেবল থাকে সিরিয়াস অ্যাকোরিয়মে। এসবই গেলো প্রাণিদের সংগ্রহের আদবকেতা ও দায়িত্বশীলতার প্রশ্ন।


দুই.

ভেতরে কেমন ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো ও পরিবেশ থাকে মেরিন অ্যাকোরিয়মে? পারপোজ-বিল্ট দালানবাড়ি হতে হবে। প্রাণিদের জন্য যথাসম্ভব ভালো হ্যাবিটাট তৈরি রাখতে হবে টাঙ্কিতে ও টাঙ্কির বাইরে। দক্ষ ও পেশাদার হাজবেন্ড্রি নিশ্চিত করতে হবে প্রাণিদের পালাপোষার জন্য। যদি সে সারাদিনরাত আলোতে থাকার প্রাণি না হয় তবে নয়টা-পাঁচটা তার প্রদর্শনি খোলা রাখা যাবে না। যখন যাদের প্রদর্শনি ওপেন থাকবে সেখানে গাইড-এডুকেটরদের উপস্থিত থাকতে হবে পুরো ব্যাপার ব্যাখা করার জন্য— ভিজিটররা যাতে রেসপনসিবল আচরণ করেন সেটা নিশ্চিত করার জন্য। যেমন, কাছিমের ট্যাঙ্কের সামনে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে যে, কাছিমের এখানে বন্দি থাকার কথা না, কিন্তু দুনিয়াজুড়ে এনাদের জাতবংশের ওপর এত এত হামলা করছে মানুষ তাতে করে ওনারা হারায়ে যেতে বসছেন মরতে মরতে— ফলে এই একটা বা দুইটা কাছিমকে এখানে কিছুদিনের জন্য যত্নে বন্দি রাখা হয়েছে— জগতের সকল বিপদাপন্ন কাছিমের প্রতিনিধি হিসাবে কাছিমের দুঃখের ব্যাপারে ভিজিটরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। যেমন, প্রাণিদের কেউ যাতে অসম্মান না দেখায়, যেমন টাঙ্কির গ্লাসে এসে যাতে টোক্কা না মারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
তিন.

এভাবে অ্যাকোরিয়ামে যদি দায়িত্বশীল রীতিপদ্ধতি ফলো না করে তবে দেখা গেলো বিপদাপন্ন প্রাণিদের সব সাগর থেকে ধরে আনা শুরু করবে, টাঙ্কির মধ্যে মাসে মাসে মরবে, আবার নতুন নতুন ধরে আনবে। পত্রিকান্তরে পড়েছি যে চীনদেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত অনেক অ্যাকোরিয়মে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। থ্যাইল্যান্ডের দেশে আগে ঘটতো, এখন দায়িত্বশীল রীতিপদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে হলেই পরে যে ক্ষতিকর অ্যাকোরিয়ম হবে তেমনও নয়। শিক্ষা ও সচেতনতার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও দায়িত্বশীল হতে পারে। মালেশিয়ার উপদ্বীপে সিঙ্গাপুর দেশে তেমন অ্যাকোরিয়ম আমরা দেখেছি।

পুরানো কাছিম-দূত লেফটিকে আটলান্টিক সাগরে ছাড়া হচ্ছে, নতুন অ্যামবাসেডর ‘নেপচুন’কে আনা হইছে অ্যাকোরিয়মে। দুজনকেই বেবিকালে উদ্ধার করা হয় বিচে আটকা ও অসুস্থাবস্থায়। © UGA

পুরানো কাছিম-দূত লেফটিকে আটলান্টিক সাগরে ছাড়া হচ্ছে, নতুন অ্যামবাসেডর ‘নেপচুন’কে আনা হইছে অ্যাকোরিয়মে। দুজনকেই বেবিকালে উদ্ধার করা হয় বিচে আটকা ও অসুস্থাবস্থায়। © UGA

স্কিডাওয়ে দ্বীপের অ্যাকোরিয়মে যেই কাছিমের টাঙ্কির সামনে বসে রাতে আমি লিখালিখি করেছি ক’মাস, ওনার নাম ছিলো লেফটি। নামের পেছনে কাহিনী আছে। সম্প্রতি জানলাম, প্রাপ্তবয়স্ক যেহেতু হইছে, ফলে পুরাপুরি সুস্থ অবস্থায় ওনাকে আটলান্টিকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অ্যাকোরিয়মে থাকা অবস্থায় কাছিমের ভালোমন্দ নিয়ে অনেক গবেষণায়ও কাজে লেগেছে লেফটি। এখন আবার সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি নিয়ে একজন কয়েকদিন-বয়স্ক বাচ্চা কাছিমকে আনা হয়েছে, একদম পিচ্চি বেবি, তিনিও বিচে পড়েছিলেন, সাগরে যাওয়ার মত স্বাস্থ্য ছিল না। আগামী অনেক বছর আবার এই নতুন কাছিম, ‘নেপচুন’ নাম যার, তিনি অ্যাকোরিয়মের টাঙ্কির ভেতর নির্মমভাবে একলা এক দূত হবেন; জগতের মানুষদের সামনে কাছিম-সমাজের দূত হিসেবে কাজ করবেন, কাছিমসহ তামাম প্রাণ-প্রকৃতির কথা মনে করাবেন বেবুঝ মানুষদের।


চার.

কাজেই আমার মনে হয়, এমন দায়িত্বশীল অ্যাকোরিয়ম হইলে পরে নেসেসসারি ইভিল হিসেবে চলে। তবে সেই পুরানো কথা আবার; পেশাদার রীতিপদ্ধতি মেনে না চললে— অ্যাকোরিয়মের ভেতরে দরকারি অবকাঠামো ও পরিবেশ না থাকলে— ভিজিটরদের সমস্ত ব্যাপারগুলা না বুঝাইলে পরে কাঙ্খিত রেজাল্ট মিলবে না। একটা অপেশাদার অ্যাকোরিয়মে দেখা যাবে; জীবনে সামনাসামনি একটা জ্যাতা কাছিম দেখার পরেও একজন লোক সাগর-সৈকত দখল-দূষণের পক্ষে থাকতে থাকবেন। কিম্বা উল্টা রেজাল্ট হতে পারে; ভিজিটর যদি এই মেসেজ পান যে কোনো একটা অ্যাকোরিয়মে সাগর থেকে মুক্ত প্রাণিদের ধরে আনা হয় শুধু তার মতো বাকি ভিজিটরদের টুরিযম ও বিনোদনের জন্য; যদি অ্যাকোরিয়মের ভেতরে প্রাণবৈচিত্র্যকে অ্যাপ্রিসিয়েট করবার মত আবহ না থাকে তবে দেখা গেলো ভিজিটরদের এতো বদ-উৎসাহ হতে পারে যে কাছিম পালার শখ হবে নিজের, কিম্বা বিচের ওপর কাছিম দেখলে পিঠের ওপর বসে ছবি তুলতে শুরু করবেন। সেটা খুবই দুঃখজনক হবে।
এই দুঃখজনক অবস্থা এড়ানোর জন্য সিরিয়াস অ্যাকোরিয়মগুলা অনেক সাবধান থাকে। ওয়াইল্ড লাইফ দেখে ভিজিটরের চিত্তে যেই ফুর্তি ঘটে, সেই এনজয়মেন্ট যাতে ওয়াইল্ড-লাইফ ধ্বংসের জ্বালানি না হয় সেইটা তারা খেয়াল রাখে। প্রাণবৈচিত্র্যের নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা— অ্যাপ্রিসিয়েট করবার মত উপযোগী পরিবেশ শতভাগ নিশ্চিত করা হয়। টাচ-ট্যাঙ্কের কথাই ধরা যাক; একজন কাঁকড়াকে সীমিত সংখ্যক ঘন্টার বেশি টাচ-ট্যাঙ্কে রাখা হয় না এক দিনে— হর্স-শু কাঁকড়াকে যাতে লেজে না ধরে ভিজিটররা সেইটা নিশ্চিত করা হয়— কোন প্রাণিকে কীভাবে ধরতে হবে সেই ব্যাপারটা ভিজিটরদের শতভাগ আমলে দিয়েই পরে ধরতে দেয়া হয়। অন্যান্য প্রাণির প্রদর্শনীও নিয়ম মেনে সীমিত সময়ের জন্য করা হয়। সপ্তাহে-মাসে অনেক দিন অনেক প্রদর্শনী বন্ধ থাকে। কারণ মুনাফা নয়, প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষাই আসলে সিরিয়াস চিড়িয়াখানা-অ্যাকোরিয়মের উদ্দেশ্য বলে পক্ষের লোকের দাবি করেন, ফলে দাবি তো পূরণ করতে হবে।
The following two tabs change content below.
Avatar photo

মোহাম্মদ আরজু

পেশায় দালাল; দরিয়া ও প্রাণ-প্রকৃতির দালালি। ভোলায় জন্ম, কর্মোপলক্ষে নানা চরাঞ্চলে ও শহরে-বন্দরে থাকেন। ভদ্র পোলা (ভদ্রে গুরুত্ব)।
Avatar photo

Latest posts by মোহাম্মদ আরজু (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →