দ্য ডেইলি স্টোয়িক: ৩৬৬ দিনের জার্নাল।। রায়ান হলিডে।। (২)
ফ্রম গ্রীস টু রোম টু টুডে
এখন সময় রাইত ১২ : ০৫। মেহেরাব ইফতি আমারে ভূমিকা লেইখা দিতে কইছিলো সকালে। সারাদিন ভাবলাম। মূল বইয়ের ভূমিকাটাও পড়লাম কয়েকবার। এখন লেখতে বসলাম; যা বুঝলাম সারাদিনে -একটা চেনা প্রবাদ দিয়া শুরু করা যাইতে পারে কথাগুলা, “পুরান চাইল ভাতে বাড়ে।”
তিন হাজার বছর আগের গ্রিক সময়কার দর্শন নিয়া এই সময়ে আইসা আলাপ দেয়ার মানেটা কী? তাও স্টোয়িক দর্শন নিয়া বিশেষভাবে। দর্শনের ছাত্র হিসেবে প্রথম পাঠ যেগুলা পাইছিলাম তার মধ্যে একটা ছিলো, কোনো সময় দর্শন একেবারেই বাতিল হইয়া যায় না। অর্থাৎ, বিজ্ঞানের সূত্র বাতিল হইয়া যাইতে পারে, মৃত হইয়া যাইতে পারে, কিন্তু দর্শন বাতিল হয়না, মৃত হয়না। এইটা একটা কারণ, যেটার জন্য এখনও দার্শনিকরা এরিস্টটল-প্লেটো কপচাইতে পারে, হয়তো ভবিষ্যতেও পারবে। স্টোয়িক ফিলোসফিও প্লেটো-সক্রেটিসের সময়কারই। নতুন কইরা স্টোয়িক দর্শনের আবির্ভাব আমাদের এইসময়ে, এর পিছনে কিছু আর্থ-সামাজিক ও বৈশ্বিক কারণ অবশ্যই আছে, যদিও এই বইয়ের বিষয়বস্তু সেইটা না, এমনকি আমার আলাপেরও না, তাও বইলা রাখলাম চিন্তার উস্কানি হিসাবে। তো এই বইয়ে আসলে আলাপটা কী নিয়া? কারা ছিলো স্টোয়িক? স্টোয়িক বলতে আমরা জেনারেল সেন্সে কী বুঝি? প্রথম কথা, স্টোয়িক বলতে আমরা জেনারেল ইমেজে এইটা ধইরা নিই যে :আবেগহীনতা (এমনকি ইংরেজি শব্দেও সেরকমই অর্থ)। এইটা নিয়া রায়ান হলিডেও তার বইতে আক্ষেপ করছেন। মহান রোমান সম্রাট মার্কাস অরিলিয়াস, দার্শনিক সেনেকা এবং প্রথমজীবনে দাস থাকা ও পরের জীবনে দার্শনিক হইয়া যাওয়া এপিকটেটাস, এরা হইলো স্টোয়িক দর্শনের ত্রিশূল। এদের আগেও স্টোয়িক ঘরানার চর্চা ছিলো কমবেশি, কিন্তু এরা তিনজনই মূল জায়গার ফাইটটা দিছেন স্টোয়িক দর্শন নিয়া। এছাড়াও জর্জ ওয়াশিংটন, ওয়াল্ট হুইটম্যান, ইমানুয়েল কান্ট, অ্যাডাম স্মিথ, থমাস জেফারসন, ম্যাথু আরনল্ড, থিওডোর রুজভেল্ট, এসব বিখ্যাত ব্যক্তিরা স্টোয়িকদের পাঠ করছে, প্রশংসা করছে।[pullquote][AWD_comments][/pullquote]
এই বইটা লেখছেন রায়ান হলিডে, রায়ান হলিডে কে? রায়ান হলিডে একজন আমেরিকান লেখক, উদ্যোক্তা, মিডিয়া স্ট্রাটেজিস্ট, এবং নিউ ইয়র্ক অবজার্ভারের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বে আছেন। পড়ালেখা করছেন পলিটিকাল সায়েন্স এবং ক্রিয়েটিভ রাইটিং এর উপরে।
এই বই কেন পড়বেন? উপরে বলছি একজায়গায়, স্টোয়িক দর্শনের পুনরায় আবির্ভাবের পিছনে আর্থ-সামাজিক ও বৈশ্বিক কারণ আছে কিছু, আপনি নিজেও ব্যক্তি হিসাবে আপনার আর্থ-সামাজিকতা ও বৈশ্বিক দুনিয়ার একটা অংশ। এসবের প্রভাব আছে আপনার উপরে। এসবের ক্রাইসিস আছে আপনার জীবনে। যদি সেগুলারে মোকাবিলা করতে চান ঠিকঠাকভাবে, তাইলে স্টোয়িক দর্শন নিয়া ঘাঁটাঘাঁটিটা আপনার কাজে লাগতে পারে অল্প হইলেও, আর বেশি হইলেতো তোফা!
শেষকথা, এইটা দর্শনের একাডেমিক বই না।পপুলার বই, পপুলার স্টাইলেই লেখা।দর্শনের বই দেইখাই ঘাবড়ায়ে যাইয়েন না। উল্টায়া দেখেন একটু।একদম সহজ ভাষায় ডায়েরি স্টাইলে লেখা, কিন্তু এর মধ্যেই প্রকাশ পাইছে গভীর দার্শনিক চিন্তা এবং নিজের জীবনে সেইটার প্রয়োগের পদ্ধতি। কথা বাড়ায়া আর বিরক্ত কইরা লাভ নাই, এইখানেই শেষ করলাম ফুলস্টপ
…………………………………………………………………………..
।। ১ ।।
…………………………………………………………………………..
১৬ই জানুয়ারীঃ অভ্যাসের বশে কিছু করবেন না
তো বেশিরভাগ সময়েই যেটা হয় আরকি, আমরা কোনো একটা পরিস্থিতিতে, আমাদের সঠিক বাছবিচারের তুলনায় বদভ্যাসের প্রাধান্যই বেশি থাকে। আমার মূল কথা এইটাই যে, এরকম প্রবণতা থেকেই বাইর হইয়া আসতে হবে ব্যক্তির। দুঃখকষ্টরে বারবার এড়ায়া থাইকা, শুধুই আরাম আয়েশ খুঁজার যে প্রবণতা, এইটা থেকে বাইর হইয়া আসতে হবে। মইরা যাওয়ারে ভয় পাইয়া বাঁইচা থাকার নেশায় আসক্ত হওয়া যাবে না, আর টাকাপয়সা সম্পত্তির ক্ষেত্রে, ঐগুলা জিনিস বেশি বেশি গ্রহন করার তুলনায় দান কইরা দেয়াই ভালো।
- মুজোনিয়োস রুফোস, লেকচার্স, ৬.২৫.৫–১১
একজন কর্মচারীরে যদি জিগানো হয়, “আপনি এই কাজটা এভাবে করছেন কেন?” জবাবে যদি সে বলে, “কারণ এইভাবেই তো সবসময় কইরা আসছি এইটা”। এই উত্তরে যেকোনো বস এরই চান্দি গরম হইতে পারে। কারণ তার কর্মচারী চিন্তা করা এবং মনোযোগ বাদ দিয়া, কাজটারে বানায়া ফেলছে অভ্যাসের মত, অভ্যাস হইয়া গেছে তাই করতেছে, ঐ কাজে কর্মচারী কোনো মেধাশক্তি দিতেছেনা আর। এইটা অবশ্যই বসের বিজনেসের জন্য খারাপ, এবং এরকম কর্মচারীরে কোম্পানি থেকে বাইর কইরা দেয়াই স্বাভাবিক, যদি বুদ্ধিমান বস হয় আরকি। আমাদের নিজস্ব যে অভ্যাসগুলা, এগুলার প্রতিও আমাদের একইরকম আচরণ করা উচিত। আসলে আমরা তো এই বইতে দর্শন কপচাইতে একারনেই বসছি, আমাদের খারাপ অভ্যাসগুলারে ছাটাই করার জন্য। খুঁইজা বাইর করেন, কোন কোন কাজগুলা আপনি কোনো কারণ ছাড়াই রুটিনের বশে, অভ্যাসের বশে করেন। প্রশ্ন কইরা দেখেন নিজেরে। আসলে এইটাই কি সব থেকে ভালো মেথড কাজগুলা করার? নাকি আরও অন্যভাবে করা যায়? একটা কাজ কেন করেন, কাজটা কী, এগুলা জানার চেষ্টা করেন, কাজের কারণগুলা যাতে সঠিক হয় সেইটা ভাবেন।
১৭ই জানুয়ারীঃ কাজগুলা আবার খতায়া দেখা
তুমি আমার স্কুলে শিখতে আইছো, আমি তোমার গুরু। আমার লক্ষ্য হইতেছে, তোমারে একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গইড়া তোলা, উল্টাপাল্টা কাজকাম থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করা, সংযম শিখানো, এবং লজ্জ্বা দেয়া ছাড়াই তোমারে নতুন কিছু শিখানো, খোদার সাথে নৈকট্যলাভের পথ দেখানো তোমারে, আর তোমার লক্ষ্য হইতেছে এসব কিছু মনোযোগী হইয়া শিখা নেয়া এবং সেইটা নিজের জীবনে চর্চা করা। যদি তাইই হয়, তাইলে তুমি আমার দেয়া কাজগুলা ঠিকঠাকভাবে করতেছো না কেন? কিসের ঘাটতি আছে? তোমার একটা নিদির্ষ্ট লক্ষ্য আছে শেখার, আমারও একটা নিদির্ষ্ট লক্ষ্য এবং প্রস্তুতি আছে শেখানোর… কাজটা খুবি সোজা, একমাত্র জিনিস যেটা আমাদের সাধ্যের মধ্যে আছে… পিছনের কথা ভুইলা যাও, শুধুমাত্র বর্তমানেই ফোকাস করো। আমার কথা মানো, দেখো কীভাবে জীবনে পরিবর্তন আসে।
- এপিকটেটাস, ডিসকোর্সেস, ২.১৯.২৯–৩৪
ছোটবেলার কথা মনে আছে আপনাদের? যখন কোনো নতুন কিছু একটা শিখতে গেলে, ভয় পাইতেন ফেইল্ড হওয়ার, ভাবতেন যদি ব্যর্থ হই? বিষয়টা কী লজ্জ্বার হবে! বেশিরভাগ টিনেজার পোলাপানই, নতুন কিছু শেখার থেকে জাউরামি কইরা বেড়ানোটারেই প্রেফার করে। ঠিকমত মনোযোগ দেয়না কোনোকিছুতে, ঠিকমত শ্রম দেয়না, যার ফলে তাদের একটা রেডিমেইড অযুহাত থাকেঃ “আরে আমিতো ঠিকমত চেষ্টাই করি নাই ঐটা!”
যখন আমরা বড় হইয়া যাই, তখন এই ব্যর্থ হওয়ার ভয় কিছুটা কমে আমাদের মধ্যে। তখন আমাদের চিন্তার বিষয়গুলা পরীক্ষার মার্কস, কিংবা স্পোর্টস ডে তে পুরস্কার পাওয়া নিয়া পইড়া থাকেনা। তখন আমাদের চিন্তার বিষয় দাড়ায়, কীভাবে জীবনটারে আরও উন্নত করা যায়, কীভাবে এই দুনিয়াতে টিইকা থাকা যায়।
তবে এইটা নিয়া অত দুশ্চিন্তার কিছু নাই। এই বইতে, দুনিয়ার বিখ্যাত দার্শনিকদের চিন্তার সাহচর্য আপনি পাইতেছেন। তারা আপনাকে বলে দিতেছে “কী করিতে হইবে”। আপনি শুধু ঐ অনুযায়ী কাজগুলা করবেন, বাকিসব এমনি এমনিই চইলা আসবে।
১৮ই জানুয়ারীঃ দুনিয়ারে একজন শিল্পী ও কবি’র মত করে দেখেন
একটা পাকা ফল যেভাবে মাটির প্রশংসা করতে করতে নিচে পড়ে, যে মাটির কারনে সে গাছে জন্মাইতে পারছে, আর গাছে প্রতিও কৃতজ্ঞ থাকে সেই ফল, যে গাছ তাকে পরিপক্কতা দিয়েছে। তুমিও ঠিক এই পাকা ফলের মতই, প্রকৃতির সাথে ঐকতান বজায় রাখো, এই সংক্ষিপ্ত সময় প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে অতিবাহিত করো।
- মার্কাস অরিলিয়াস, মেডিটেশন্স, ৪.৪৮.২
মার্কাসের মেডিটেশন্স বইতে অসাধারণ সব প্রকাশভঙ্গি লক্ষ্য করা যায়, এইটার জন্য অবশ্য সে তার রেটোরিক শিক্ষক মার্কাস করনেলিয়াস ফ্রোন্টো’র কাছে কৃতজ্ঞ। ফ্রোন্টো ছিলো রোমের সেরা বক্তাদের একজন, সিসেরো’র পাশাপাশিই তার নাম উচ্চারণ করা হয়। ফ্রোন্টো’রে অরিলিয়াসের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করছিলো তার পালক পিতাই। একারনেই আমরা রেটোরিকের পারদর্শীতা মার্কাস অরিলিয়াসের লেখায়ও দেখতে পাই।
একটা সাধারণ ঘটনাকে শুধু প্রকাশ করাই নয়, সেটাকে কীভাবে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় লেখার মাধ্যমে, সেটা মার্কাসের লেখা পড়লেই বুঝা যায়। সাধারণ কোনো ঘটনার মধ্যে অসাধারণ কিছু খুজে পাওয়ার জন্য চাই শিল্পীর চোখ, এই যেমন একটা পাকা ফল গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার সাথে মানুষের মরে যাওয়ার যে মিল থাকতে পারে, সেইটা মার্কাস দেখতে পাইছিলো। একজন বাবুর্চির রুটি বেলার দৃশ্যপটের মধ্যে লাইফের সাথে রিলেটেড কোনো মেটাফোর খুইজা পাওয়াটাও একজন কবি’র দ্বারাই সম্ভব।
অন্যেরা যা দেখতে পায়না, তা দেখতে পাওয়ার মধ্যে একধরনের স্পষ্টতা এবং আনন্দ আছে। যেসব ঘটনা বা জিনিস সাধারণের চক্ষুর আড়ালে থাইকা যায়, সেসব ঘটনার মধ্যেই হারমোনি, স্বর্গীয় সৌন্দর্য, এসব খুইজা পাওয়াটা একটা অসাধারন ব্যাপার বটে। অন্তত দুনিয়াটারে একটা অন্ধকার জগত ভাবার থেকে তো ভালো!
১৯শে জানুয়ারীঃ যেখানেই যান, চয়েজ আপনারই
মঞ্চ এবং জেল, দুইটাই স্থান, একটা উচ্চস্থান আরেকটা নিম্নস্থান, কিন্তু আপনি চাইলে যে কোনো স্থানেই আপনার নিজের উপর কাবু রাখতে পারেন।
- এপিকটেটাস, ডিসকোর্সের, ২.৬.২৫
স্টোয়িক দার্শনিকদের মধ্যে এক ধরনের বিশাল বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়, তারা সবাইই বিভিন্ন বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া গেছে জীবনে। কেউ ধনী ছিলো, কেউবা আবার রোমের ঐ শক্ত হায়ারার্কির একেবারে তলার শ্রেণীতে জন্ম নিছিলো। কারও জন্য জীবনটা সহজ ছিলো, কারও জন্য ছিলো অকল্পনীয় কঠিন। আমাদের ক্ষেত্রেও বিষয়টা এমনই, আমরা সবাইই দর্শনে আসি বিভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে, এমনকি আমাদের নিজেদের জীবনেই আমরা সৌভাগ্য, দুর্ভাগ্য দুইটারই স্বাদ গ্রহন করি। প্রতিকূল কিংবা অনুকূল যেই পরিস্থিতিই হোক, আমাদের শুধু এটুকুই মাথায় রাখা উচিত যে, যেইটা আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে সেইটুক নিয়াই শুধু চিন্তা করা, নিয়ন্ত্রণের বাইরের কোনোকিছু নিয়া চিন্তা কইরা লাভ নাই। হয়তো এই মুহূর্তে খুব আরাম আয়েশের জীবন যাপন করতেছি আমরা, কিন্তু কয়েকদিন বাদেই এই আরাম আয়েশ শেষ হইয়া যাইতে পারে, আবার কয়দিন পরে দেখা যাইতে পারে, এতই বিখ্যাত হইয়া গেলাম যে সেইটা খ্যাতির বিড়ম্বনায় পরিণত হইলো। কিন্তু এসব উত্থান-পতনের মধ্যে, একটা জিনিসই ধ্রুব থাকে, সেইটা হইতেছে ফ্রিডম অফ চয়েজ- বিগ পিকচারে দেখি আর স্মল পিকচারে দেখি, যেখান থেকেই দেখি না কেন, আমাদের চয়েজগুলাই শেষ পর্যন্ত ম্যাটার করে। আমাদের চয়েজগুলা কী? আমি সেগুলারে কীভাবে মূল্যায়ন করবো? কীভাবে আমি আমার চয়েজগুলা নিবো? এই প্রশ্নগুলাই জীবনের বড় প্রশ্ন, তাতে আমরা যে স্থানেই থাকেন না কেন। আপনি কীভাবে এগুলারে ডিল করবেন?
২০শে জানুয়ারীঃ নিজের চিন্তারে আবার ঝালাই করেন
আপনার চিন্তাপদ্ধতি না পাল্টাইলে আপনার জীবনের নীতিগুলাও পাল্টাবে না, কারন আপনি যা চিন্তা করেন, সেগুলাই আপনার জীবনের নীতি কী হবে এইটা নির্ধারন কইরা দেয়, এইটাও একটা কারণ যার ফলে আপনি চাইলেই ঐ নীতিগুলা পাল্টাইতে পারেন… নতুন চিন্তা নিজের মধ্যে ধারণ করতে থাকলেই নতুন নীতিও তৈরী হবে, যেটা আপনার জীবনরে রিস্টার্ট দেয়ার মত হবে, একটা নতুন ফ্রেশ স্টার্টের মত।
- মার্কাস অরিলিয়াস, মেডিটেশন্স, ৭.২
আপনার কি ইদানীং সময় খারাপ যাইতেছে? এমন কি মনে হইছে কখনো যে আপনে আপনার নীতি এবং বিশ্বাস থেকে দূরে সইরা যাইতেছেন? এরকম হইতেই পারে। সবারই হয় এইরকম। এমনকি, সম্ভবত মার্কাসেরও হইছিলো, যে কারণেই উনি নিজেরেই নিজে নির্দেশনা দেয়ার জন্য ডায়েরি লেখছিলেন। হয়তো তার সিনেটরদের সাথে খারাপ সময় যাইতেছিলো, অথবা তার নিজের পোলার লগে ঝামেলা চলতেছিলো। হয়তো কখনো সেসব ডিল করতে গিয়া উনি রাগ নিয়ন্ত্রন করতে পারতেন না, বিষন্ন হইয়া পরতেন, অথবা নিজের সাথে বোঝাপড়া ঠিকভাবে করতে পারতেন না নিয়মিত। কার না হয় এরকম? কিন্তু এইখানে একটাই রিমাইন্ডার দেয়া বারবার যে, যা কিছুই হোক না কেন, অতীতে যতই নিরাশাজনক কাজকাম আমরা করে থাকি না কেনো, স্টোয়িকদের নিয়মনীতি একই থাকে। আমরা যেকোনো সময়েই আবার ঐসব নিয়মে সাবস্ক্রাইব করতে পারি। গতকাল যা হইছে সেইটা অতীত, এমনকি পাঁচ মিনিট আগেও যা হইছে সেইটাও অতীত। আমরা যেকোনো সময়েই ঝালাই কইরা নিতে পারি নিজেদের, আবার শুরু করতে পারি। যদি তাই হয়, তাইলে এখনই তো শুরু করা যায়?
২১শে জানুয়ারীঃ সকালের রিচুয়াল
প্রতিদিন সকালে উইঠা নিজেরে এই কয়েকটা প্রশ্ন করবেনঃ
অহেতুক আবেগের উচ্ছ্বাস থেকে মুক্তি পাওয়ার পথে কী কী আমার বাঁধা আছে?
প্রশান্তির জন্য কী কী?
আমার পরিচয় কী, আমি কে? আমি কী?
একটা নিছক শরীর মাত্র, নাকি অনেক সম্পত্তির মালিক, নাকি মানমর্যাদার বাহক?
এর কিছুই না, তাইলে কী? একজন র্যাশনাল সত্ত্বা।
তাহলে নিজের কাছে আমার দাবীটা কী? নিজের কাজকামের দিকে মনোযোগী হওয়া, একাগ্রচিত্ত হওয়া। প্রশান্তি থেকে কীভাবে আমি দূরে সইরা যাই? এমন কী করছি আমি যা শত্রুতাপূর্ণ, অসামাজিক এবং নির্মম? কোন কাজটায় আমি ব্যর্থ হইছি?
- এপিকটেটাস, ডিসকোর্সেস, ৪.৬.৩৪-৩৫
বহুত সফল মানুষেরই এক ধরণের প্রাতঃ আচরণবিধি আছে। মানে সকালবেলা ঘুম থেকে উইঠাই যে কাজগুলা নিয়মিত করে আরকি। কারও জন্য কাজটা মেডিটেশন, কারও জন্য কাজটা ব্যায়াম। অনেকের জন্য আবার সকালে উইঠা হাল্কা লেখালেখি করা, যেইখানে তারা নিজেদের মনের ভয় ভীতি, আশাভরসা এগুলা নিয়া দু চারলাইন লেখে। এই কাজগুলা আসলে কাজ হিসেবে অত গুরুত্বপূর্ণ না, গুরুত্বপূর্ণ হইতেছে এক ধরনের আচরণবিধি হিসেবে। এই কাজের আসল কেরামতি হইতেছে, নিজের ভেতরে একটু ডুব মাইরা দেইখা নেয়া কী অবস্থা। সকালের এই আচরনবিধির ব্যাপারটাকে স্টোয়িকরা খুব গুরুত্ব দিতো। তবে এইটা শিওর হওয়া যায়নাই যে, মার্কাস অরিলিয়াস তার মেডিটেশন্স ডায়েরিটা সকালে লিখতো, নাকি রাতে ঘুমানোর আগে লিখতো, সে ঐগুলা একান্ত নিজের জন্যই লিখতো, নিজের নির্দেশনার জন্য। আজকে থেকে আপনারাও শুরু করে দেন এমন কোনো আচরণবিধি, সকালবেলা উঠেন, উইঠা এই প্রশ্নগুলা নিজেরে করেন নিজে, কঠিন মনে হলে যেকোনো একটা নিয়া ভাবেন, উত্তর খোজেন, প্রতিদিন করতে থাকেন রিচুয়ালের মত। দর্শন আর পরিশ্রম, এই দুই মিলায়ে নিজেরে সামনে দিকে আগায়া নিয়া যান।
২২শে জানুয়ারীঃ ডেইলি রিভিউ
নিজের উপরে নিয়মিত পাহারাদারি জারি রাখতে হবে আমার, বিশেষ করে, নিজেই নিজের প্রতিদিনের একটা রিভিউ করতে হবে হবে কাজকর্ম সম্পর্কে। জীবনটাকে উপর থেকে না দেখা, মাঝেমাঝে রিভিউনা কইরা দেখাই আসল সমস্যা। আমরা শুধু এইটাই ভাবতে থাকি যে কী করবো, যদিও আমাদের ভবিষ্যতের প্লানপ্রোগ্রাম আসলে আমাদের অতীত থেকেই উৎপন্ন হয়।
- সেনেকা, মোরাল লেটার্স, ৮৩.২
বড়ভাই নোভাটাসরে লেখা চিঠিতে, সেনেকা এক রকমের বেনেফিসিয়াল অভ্যাসের কথা এইখানে বর্ণনা করতেছিলেন, যেইটা উনি আবার অন্য আরেক দার্শনিকের কাছ থেকে নিছেন। প্রতিদিন একেবারে শেষবেলায়, নিজের সারাদিনের কাজকামগুলা একবার রিভিউ কইরা নেয়ার অভ্যাস করতে বলতেছেন সেনেকা। আজকে কী কী খারাপ অভ্যাস বাদ দিতে পারলাম? দিনের শুরুতে যেমন ছিলাম এখন কি আর থেকে ভালো? সারাদিনের কাজগুলা যে করলাম, এগুলা কি সব ভালো কাজ ছিলো? কয়টা আকাম করলাম সারাদিন? আরও উন্নতি কেমনে করা যায় নিজের? দিনের শুরুতে অথবা শেষে, প্রত্যেক স্টোয়িকই এই ধরনের প্রশ্ন নিজেরে করে, এরপরে সেগুলার উত্তর নোট নেয়। একারনেই মার্কাস অরিলিয়াসের মেডিটেশন্স বইটা দুর্বোধ্য, কারন সে ঐগুলা লেখছিলো নিজের জন্য, পাবলিক বেনেফিটের জন্য না। স্টোয়িক নিয়মাবলী বারবার লিখা নিজেরে রিমাইন্ডার দেয়া, এক ধরনের ইবাদতের মতও বটে, এই যেমন দিনে পাঁচবার নামাজ পড়া একরকম। নিজের একটা জার্নাল রাখেন একারণে, হইতে পারে ডায়েরি, মোবাইলের নোট, কম্পিউটারের নোট, প্রতিদিনের হিসাব প্রতিদিন মিলাবেন, এতে কইরা চর্চাও হবে, সাথে বোনাস আরও একটা লাভ হবে, নিজের প্রগ্রেস রিপোর্টও পাবেন সহজেই।
২৩শে জানুয়ারীঃ ধনদৌলত
ধনীদের কথা বাদ দাও, ধনীদেরকে প্রায়ই গরীবের মত দেখতে লাগে! যখন তারা কোথাও ভ্রমণে যায়, তখন তারা মুসাফিরের মতই প্রায়, কয়েকটা জামাকাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস বাদে আর কিছু নিতে পারেনা ব্যাগে, আবার যখন দ্রুত কোথাও ভ্রমণ করতে হয়, তখন অনুগামী লোকজনরে বাদ দিয়া একা একাই আগাইতে হয় দ্রুত। এমনকি এলিট শ্রেণীর যোদ্ধারাওবা কতটুকু ভোগ করতে পারে তাদের সম্পদ…
- সেনেকা, অন কনসোলেশন টু হেলভিয়া, ১২.১.বি-২
স্কট ফিটজগেরাল্ডের লেখাজোখায় আমরা প্রায়শই দেখতে পাই, সে ধনী এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের লাইফস্টাইলরে কীভাবে গ্লামারাইজ করছে, দ্যা গ্রেট গ্যাটসবি বইতো দুনিয়াবিখ্যাত, সেই বইয়ের প্রথম লাইনটাই এমনঃ “ধনীদের সম্পর্কে একটা বলি আপনারে, তারা আপনার আমার থেকে আলাদা।” এইটা পাবলিশ হবার কিছু বছর পরে, ফিটজগেরাল্ডের বন্ধু আর্নেস্ট হেমিংওয়ে তারে টিটকারি মাইরা বলছিলোঃ “হ, ধনীগো বেশি টেকাপয়সা আছে, তাই আলাদা।” এই কথাটাই সেনেকা আমাদের বুঝাইতে চাইতেছে। সেনেকা ঐসময়ের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ছিলো রোমে, এবং সেই নিজেই বলতেছে, টাকাপয়সা শুধুমাত্র জীবনের একটা অংশই পরিবর্তন করতে পারে। বাহ্যিক সমস্যাগুলার বাহ্যিক সমাধান হইলো টাকাপয়সা, কিন্তু মানুষের অন্তরের যে সমস্যা, তা সবকিছু টাকা দিয়া সমাধান হয় না। আমরা প্রায়ই এইটা ভুইলা যাই, এবং ঝামেলায় পড়ি, পেইন খাই, কনফিউশানে থাকি এই কারণে। এই বিষয়ে হেমিংওয়ে, পরে আরও একবার তার বন্ধু ফিটজগেরাল্ড সম্পর্কে বলতে গিয়া বলছিলোঃ “ওয় আসলে ধনীদেরকে এক প্রকার বিশেষ গোত্রীয় গ্লামারাস কিছু ভাবতো, কিন্তু পরে সেই ধারণা তার ভাইঙ্গা যায় এবং খুবই মর্মাহত হয়, যেমনটা যেকেউই হয় চিরলালিত বিশ্বাস ভাইঙ্গা গেলে।”
একই ব্যাপারটা, আমাদের ক্ষেত্রেও খাটে।
২৪শে জানুয়ারীঃ গভীর বোঝাপড়ার প্রয়োজনীয়তা
রাস্টিকাসের কাছ থেকে আমি শিখেছি, কীভাবে যেকোনো কিছুরে গভীরে গিয়া দেখতে হয়, এবং যেকোনো কিছু সম্পর্কে ভাসাভাসা আন্দাজা নিয়া সন্তুষ্ট থাকতে নাই। সবসময় কারও মতামতের সাথে তৎক্ষনাত সহমতে যাইতে নাই, যতক্ষন না বিষয়টা নিয়া একটা গভীর বোঝাপড়া পাওয়া যাইতেছে।
- মার্কাস অরিলিয়াস, মেডিটেশন্স, ১.৭.৩
মার্কাস অরিলিয়াসের মেডিটেশন্স বইয়ের প্রথম খন্ডে, সে লেখা শুরু করে সবাইরে কৃতজ্ঞতা জানায়া, যাদের প্রভাব তার নিজের জীবনে খুব গভীরভাবে ছাপ ফেলছে। তাদের মধ্যে একজন হইতেছে কুইন্টাস জুনিয়াস রাস্টিকাস, মার্কাসেরই একজন শিক্ষক, যার কাছ থেকে সে সবসময় শিখে আসছে, কোনো জ্ঞানই খুব সহজে এক্সেপ্ট কইরা নিতে নাই, যতক্ষণ না একটা গভীর বোঝাপড়া না আসতেছে ঐ সম্পর্কে। বারবার পরীক্ষা কইরা দেখা দরকার নিজস্ব বোঝাপড়াকে। রাস্টিকাসই মার্কাসকে পরিচয় করায়া দেয় এপিকটেটাসের কাজের সাথে। এমনকি রাস্টিকাসের যে ব্যক্তিগত কপিটা ছিলো এপিকটেটাসের লেখালেখির, সেটাই সে মার্কাসকে ধার দিছিলো পড়ার জন্য। আমেরিকান লেখক পল জনসন একবার আরেকজন আমেরিকান সাহিত্য ক্রিটিক এডমুন্ড উইলসনরে নিয়া মশকরা করে বলছিলেনঃ উইলসন সাহেব এমনভাবে লেখা পড়ে, মনে হয় যেন লেখকরে সে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়া করাইতেছেন। ঠিক একইভাবে, মার্কাস পাঠ করছিলেন এপিকটেটাসের লেখা। মানুষের ডিএনএ যেরকম থাকে, এপিকটেটাস মার্কাসের জন্য ছিলো ডিএনএ’র মত। মার্কাস এপিকটেটাসরে খুব গভীরভাবে পাঠ করছিলো, এতই গভীর যে মার্কাসের পুরা জীবনের উপরেই এপিকটেটাসের কথাবার্তা ও দর্শনের প্রভাব ছিলো গভীর, যদিও মার্কাস ছিলো বিলাসবহুল প্রাসাদে বাসকারী রাজা, আর এপিকটেটাস ছিলো প্রথমজীবনে দাস। ঠিক এইধরনের গভীর পাঠই দরকার আমাদের, প্রতিদিন একটা অধ্যায় পইড়া সেটা ভাসাভাসা বুঝার থেকে, একটা প্যারাগ্রাফ পইড়া সেইটা গভীরভাবে বুঝা বেশি দরকারি।
২৫শে জানুয়ারীঃ একমাত্র প্রাইজ
প্রাইজ পাওয়ার আর কি বাকি আছে? এইটা, আমার মনেহয় – আমরার কাজকাম করা বা না-করাটা আমরার নিজেদের প্রিপারেশনের লাইগা যা যা করা দরকার তার ভিতরেই লিমিট কইরা রাখে… এইটাই হইতেছে পড়াশোনা আর পড়ানোর সব উদ্দেশ্য – এই হইতেছে ঘটনাটা, প্রাইজ পাওয়ার। যদি আপনি শক্ত কইরা এই জিনিসটারে ধইরা রাখেন, আপনি অন্য যে কোন কিছু ট্রাই করা থিকা নিজেরে থামাইতে পারবেন… যদি না পারেন, তাইলে প্যাশন থিকা ফ্রি, সেলফ-ফিশিয়েন্ট বা স্বাধীন হইতে পারবেন না, বরং যাদের এই পাওয়ারটা আছে এইগুলা পাওয়ার তাদের প্রতি থাকতে থাকে হিংসা, জেলাসি আর সন্দেহ, আর আপনি যেইটারে প্রাইজ ভাবছেন সেইটা যাদের আছে তাদের এগেনেস্টে ষড়যন্ত্র করতে থাকবেন আপনি… কিন্তু নিজের মনে যেহেতু কিছুটা সেলফ-রেসপেক্ট আছে আর প্রাইজের পাওয়ার আশা, আপনি নিজেরে খুশি করবেন আর আপনার লগের মানুষজনের লগে একটা বেটার হারমোনিতে থাকবেন, আর দেবতাদের লগে মিলমহব্বত রাখবেন – শুকরিয়া করবেন তারা যেমনে গুছায়া রাখছে আর আপনার লাইগা যা রাখছে।
- মার্কাস অরিলিয়াস, মেডিটেশন্স, ৬.১৬, ২বি – ৪এ
ওয়ারেন বাফেটের মোট সম্পত্তির পরিমান ৬৫বিলিয়ন ডলার, অথচ সে থাকে এখনও ৫৮সালে ৩১,৫০০ ডলার দিয়া কেনা একটা বাড়িতে। জন উরশ্চেল, বাল্টিমোর র্যাভেন্স এর লাইনম্যান, বছরে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার কামায়, কিন্তু একবছরে তার নিজের ব্যয় ২৫০০০ ডলার। আমেরিকান বাস্কেটবল স্যান আন্তনিও স্পার্স দলের স্টার প্লেয়ার, কাওহি লিওনার্ড এখনো ৯৭ সালের শেভি টাহো মডেলের গাড়িতে কইরা ঘুরে, যেইটা তার কৈশোরকালে কেনা। অথচ তার ক্লাবের সাথে নিজের চুক্তিই আছে ৯৪মিলিয়ন ডলারের। এই উদাহরণগুলার মানে কী? উদাহরণগুলার মানুষগুলা কি সস্তা? ছোটলোক? কৃপণ? না সেরকম কিছুই না। তাদের লাইফস্টাইলটারে তারা বেশ ভালোভাবে প্রায়োরোটাইজ কইরা সাজাইছে। তাই তাদের এমন কোনো চাহিদা তৈরী হয়না যেটা তাদের সাধ্যের বাইরে। নিজের সম্পর্কে তাদের একটা সম্যক ধারনা আছে তারা কোনটা আসলেই চায়, কোনটা ভালোবাসে, তারা বারবার সেই জিনিসগুলাতেই নজর দেয়, প্রায়োরিটির উপরে রাখে। এবং ওই জিনিসগুলার দাম আসলে অত বেশিওনা যে মিলিয়ন বিলিয়ন টাকাপয়সা লাগবে। মার্কেটফল বা ইঞ্জুরির কারণে তাদের টাকাপয়সা যদি অনেকাংশে কমেও যায়, তারপরেও তারা সুখেই থাকতে পারবে। আমরা যত বেশি ডিজায়ারের ঘোড়ারে ছুটতে দিবো, ততই অসুখী হইতে থাকবো। ডিজায়ার ঘোড়ার গলায় লাগাম পরাইতে পারলেই সুখী হওয়া যাবে।
শাহরিয়ার জিম
Latest posts by শাহরিয়ার জিম (see all)
- দ্য ডেইলি স্টোয়িক: ৩৬৬ দিনের জার্নাল।। রায়ান হলিডে।। (২) - জুন 25, 2019
- দ্য ডেইলি স্টোয়িক: ৩৬৬ দিনের জার্নাল।। রায়ান হলিডে।। (১) - মার্চ 20, 2019