Main menu

আ ট্রিবিউট টু তলস্তয়

আজকে (সেপ্টেম্বর ৯) তলস্তয়ের জন্মদিন।

তলস্তয়ের সাথে আমার বসবাস মোটামুটি অনেকদিনেরই। আমার পছন্দের লেখক অনেকেই আছেন। তবে কারো কারো প্রতি আমি একটু বেশি মনের টান ফিল করি। এই আলাদা দরদের লেখকদের মধ্যে তলস্তয়ও আছেন। কইতে গেলে আমার ক্লাসিক পড়া শুরু হইছিল তলস্তয় দিয়া। ওইসময়ে ওয়ার এন্ড পিসের মতো একটা দাদামশাই বই আমি মুখ চাইপা পইড়া গেছিলাম। অনেককিছু বুঝি নাই, অনেককিছু ভুল বুঝছি৷ সব মিলায়া দুইবছর লাগছিল তখন। আপনে যখন কোনকিছুর সাথে ২ বছর থাইকা যাইতে পারবেন, তখন ব্যাপারটারে অনেক স্মুথ মনে হইতে থাকবে। আমার লাইফে এখন পর্যন্ত ‘ওয়ার এন্ড পিস’-ই সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী ভালবাসা৷ তলস্তয়ের মধ্য দিয়া বই পড়ারে নতুনভাবে পাইছিলাম আমি, এরপর আবারো এই বইয়ের কাছে ফিরা গেছি, উনার অন্যান্য বইগুলাও পড়ার চেষ্টা করছি৷[pullquote][AWD_comments][/pullquote]

যেকোনো লেখকরে নিয়া আলাপ দিতে গেলে খালি তার জীবনী নিয়া আলাপ দেওয়া সমস্যাজনক৷ এই প্রবণতা আমাদের দেশে মনে হয় একটু বেশিই। আরেকটা ব্যাপার হইলো, তলস্তয়ের নিজের জীবনই খুব নাটকীয়৷ এইজন্য তার লাইফ বা লাইফের কাহিনীগুলার আড়ালে অনেকসময় উনার লিটারারি জিনিয়াস চাপা পইড়া যায় বইলা ভ্রম হয়৷ আসলে তো ব্যাপারটা এমন না। একজন লেখকরে শেষ পর্যন্ত লেখার কাছেই যাইতে হয়, লেখার মধ্যেই খুজতে হয় ওর আত্মাটারে৷

আমি তলস্তয়ের ‘ওয়ার এন্ড পিস’ থেকে উনার লিটারারি সেন্সের ছোট একটা নমুনা দেই খালি৷

ওয়ার এন্ড পিসের একটা মেইন ক্যারেক্টার হইলো পিয়ের। যার সাথে বিয়া হয় হেলেনের৷ আরেকটা ক্যারেক্টার থাকে- দলোখভ। তো পিয়ের একসময় জানতে পারে হেলেনের লগে দলোখভের পরকীয়া চলতেছে৷ একদিন পিয়ের ডুয়েলের আহবান করে দলোখভরে। ডুয়েলের দিন ঠিক হয়। ডুয়েলে পিয়েরের গুলি গিয়া লাগে দলোখভের শরীরে, অন্যপক্ষের গুলি মিস হয়। তবে দলোখভ মরে না। পিয়ের তখন বুঝতে পারে সে কত বড় অর্থহীন পাগলামিটা করছে! বিধ্বস্ত অবস্থায় ফিইরা আসে সে।

এর কিছুদিন পরে, একই পার্টিতে পিয়ের দলোখভরে দেখতে পায় ওর মা আর বোনের সাথে। সে দেখে, যারে সে মারতে চাইছিল, যারে সে ঘৃণা করে- সে তার মা আর বোনের কাছে কত আদরের! সে ওদের একমাত্র ভরসা। পিয়ের দলোখভরে আবার নতুন কইরা চিনতে পারে। কিন্তু এই ‘নতুন দেখার’ কোন ফলাফল উপন্যাসের কাছাকাছি সময়ে আর আমরা পাই না। এমনেই চলতে থাকে সব, কারোই কারো সাথে দেখা হয় না। তলস্তয়ের লিটারারি জিনিয়াসের একটা নমুনা ধরতে গেলে, এই জায়গাটা ইম্পর্টেন্ট।

দলোখভ আর পিয়েরের এনকাউন্টার হয় আরো পরে,যখন নেপোলিয়ন দ্বিতীয়বারের মতো রাশিয়া আক্রমন করে। পুরা রাশিয়াবাসীর স্বপ্নের শহর মস্কো দাউদাউ কইরা জ্বলতে থাকে৷ মস্কোর এই পুড়তে থাকা দশা দেইখা বহু দূর থেকেও রুশবাসীর কান্না আসে৷ পুরা মস্কো প্রায় খালি। আছে খালি ভবঘুরে আর গরীবরা- যাদের পালানোর জায়গা নাই; আর আছে ফরাসি সেনারা। এরমধ্যেই তলস্তয়ের নায়ক পিয়ের ডন কিহোতেমার্কা চেতনা নিয়া নেপোলিয়নরে মারার উদ্দেশ্যে মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে থাকে। কিন্তু উল্টা ফরাসি সৈন্যদের লগে ঝামেলার জন্য বন্দী হইতে হয় তারে। বন্দী অবস্থায় নানা কাহিনীর পর সে ফরাসি বাহিনীর এক ক্যাম্পে যুদ্ধবন্দী হিসেবে থাকে।

এদিকে ফরাসি বাহিনীর বারটা বাজছে,পতন আসন্ন। রাশিয়ানরা দৃঢ়তা দিয়া আটকায়া দিছে তাদের। এখন রিট্রিট ছাড়া ওদের আর কোন পথ নাই। দলোখভও যুদ্ধক্ষেত্রে আছে। ওদের এই রেজিমেন্টেই যোগ দিছে রস্তভ ফ্যামিলির ছোটছেলে পেতয়া। ওর বয়স মাত্র ১৫, বাড়ি থেকে পালাইয়া যুদ্ধে আসছে- অনেকটা বালকসুলভ আগ্রহের কারণে। আইসা রেজিমেন্টে পরিচিত মানুষও পাইয়া যায়, সিদ্ধান্ত হয় এই রেজিমেন্টই একটা ফরাসি ক্যাম্পরে আক্রমন করবে। বেশি সৈন্য নাই ওই ক্যাম্পে, রাত্রেবেলা গেরিলা স্টাইলে আক্রমণ হবে। এইসময়ের তলস্তয় পেতয়ার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা,আগ্রহ, উত্তেজনার এমন দারুণ বর্ণনা দেন! এতো সরল আর এতো রিয়েলিস্টিক! মাত্র কয়েক পেজেই পেতয়া রিডারের হৃদয়ের কুঠুরিতে ঢুইকা যায়।

আক্রমণ শুরু হয় রাতের দিকে। পেতয়ারেও নেওয়া হয় সে অপারেশনে, অনেক অনুরোধের পর। দলোখভরা আক্রমণ কইরা সব ফরাসি সৈন্যরেই মারতে পারে। কিন্তু ফরাসিদের একটা গুলিতে পেতয়া নিহত হয়৷ তলস্তয় আপনারে এমনেই শক দেয়। মাত্র কয়েক পেজে একটা ক্যারেক্টাররে হৃদয়ের ভাই বানায়া আবার মাইরা ফেলতে পারেন উনি, এমনই নির্মম রিয়ালিস্ট! যাই হোক, পেতয়ার মৃত্যুতে পুরা রেজিমেন্ট আপসেট হইয়া যায়। এমন সময় রুশ সৈন্যরা জানতে পারে এই ক্যাম্পে কিছু রুশ যুদ্ধবন্দীও আছে। তাদের মধ্যে কে আছে? – আছে পিয়ের। পিয়ের যুদ্ধের নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়া আইসা প্রায় বিদ্ধস্ত। বাইর হইয়া সে প্রথম দেখতে পায় দলোখভের মুখ। দলোখভ জিগায়, ‘তুমি এখানে!’ পিয়ের দৌড়ায়া আইসা দলোখভরে জড়ায়া ধরে। সেই দলোখভরে, যারে সে ঘৃণা করতো, যারে সে গুলি করছিল ডুয়েলে। ওই পার্টিতে মা আর বোনের সাথে দেইখা তারে যে সে নতুনভাবে চিনতে পারছিল- এর চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে এখানে, এই অবস্থায়৷

সিকোয়েন্সটা খেয়াল কইরেন, পেতয়ার মৃত্যুর পরেই পিয়ের আর দলোখভের এই এনকাউন্টার। মৃত্যু, জীবনরে নতুন কইরা পাওয়া, আশা, হতাশা সব জড়ায়া আসতে থাকে বাক্যে বাক্যে, আবার একইসাথে বাক্যে বাক্যে আসতে থাকে নতুন কোন বোধের ইশারাও।

এই ক্যাথারসিস আপনে ভুলবেন কেমনে! আপনে যদি একজন রিয়ালিস্ট রাইটার হন, কখন রিডাররে কোন সিকোয়েন্সে গল্প কইবেন,সেটা নিয়া ভালো সেন্স থাকাটা জরুরি। সম্ভবত তলস্তয়ের এই সেন্স অন্য অনেক রাইটারের চেয়ে বেশি ছিল।

শুভ জন্মদিন, তলস্তয় ৷ 🙂

সেপ্টেম্বর ০৯, ২০২০

The following two tabs change content below.
Avatar photo

তাসনিম রিফাত

জন্ম ১৯৯৮ সাল। ঢাকায় থাকেন। সাহিত্য ও নৃবিজ্ঞান নিয়া পড়াশোনা করতে পছন্দ করেন।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →