Main menu

সুলতানার স্বপ্ন – রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

This entry is part 2 of 9 in the series বাংলাদেশি ফিকশন

রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের সুলতানা’স ড্রিম হইতেছে একটা ওয়ার্ল্ড ক্ল্যাসিক। ১৯০৫ সালে উনি ইংলিশেই লেখছিলেন এইটা। দ্য ইন্ডিয়ান লেডিস পত্রিকা’তে ছাপা হইছিল। পরে ১৯০৮ সালে বই হিসাবেও ছাপা হয়। অই সময়টাতে ধারণা করা যায়, রোকেয়াও উনার লিটারারি এডভেঞ্চারের জায়গাটাতে ছিলেন। ১৮৯৮ টু ১৯০৯, উনার কনজুগাল লাইফের সময় জামাইয়ের অনেক সার্পোট পাইছেন, যার ফলে উনার পড়াশোনা, চিন্তা-ভাবনায় ডর-ভয়ের জায়গাগুলারে এড়াইতে পারছিলেন। মানে, এইরকম ভাবা যাইতে পারে যে, সুলতানা’স ড্রিম হইতেছে উনার ফ্রি লাইফের একটা আউটকাম। পরে ১৯২২ সালে উনার মতিচূর (২য় খন্ড) বইয়ে বাংলায় ছাপাইছিলেন। তো, সেই হিসাবে লেখাটার ৯৯ বছর পার হইতে যাইতেছে এখন। এই জিনিসগুলা “মাস্ট রিড” হিসাবে আমাদের পড়ার লিস্টে থাকতে পারে। তো, পড়েন!

এডিটর, বাছবিচার

………………….

একদা আমার শয়নকক্ষে আরাম কেদারায় বসিয়া ভারতললনার জীবন সম্বন্ধে চিন্তা করিতেছিলাম, – আমাদের দ্বারা কি দেশের কোন ভাল কাজ হইতে পারে না?—এই সব ভাবিতেছিলাম । সে সময় মেঘমুক্ত আকাশে শারদীয় পূর্ণিমার শশধর পূর্ণগৌরবে শোভমান ছিল ; কোটীলক্ষ তারকা শশীকে বেষ্টন করিয়া হীরক-প্রভায় দেদীপ্যমান ছিল। মুক্ত বাতায়ন হইতে কৌমুদীস্নাত উদ্যানটী স্পষ্টই আমার দৃষ্টিগোচর হইতেছিল। এক একবার মৃদুস্নিগ্ধ সমীরণ শেফালিসৌরভ বহিয়া আনিয়া ঘরখানি আমোদিত করিয়া দিতেছিল। দেখিলাম, সুধাকরের পূর্ণ কান্তি, কুসুমের সুমিষ্ট সৌরভ, সমীরণের সুমন্দ হিল্লোল, রজতচন্দ্রিকা – ইহারা সকলে মিলিয়া আমার সাধের উদ্যানে এক অনির্বচনীয় স্বপ্নরাজ্য রচনা করিয়া ফেলিয়াছ। তদ্দর্শনে আমি আনন্দে আত্মহারা ইলাম, যেন জাগিয়াই স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম ! ঠিক বলিতে পারি না আমি তন্দ্রাভিভূত হইয়াছিলাম কি না ; – কিন্তু যতদূর মনে পড়ে, আমার বিশ্বাস আমি জাগ্রত ছিলাম।

সহসা আমার পার্শ্বে একটি ইউরোপীয়া রমণীকে দণ্ডায়মানা দেখিয়া বিস্মিত হইলাম। তিনি কি প্রকারে আসিলেন, বুঝিতে পারিলাম না। তাঁহাকে আমার পরিচিতা ‘ভগিনী সারা’ (Sister Sara) বলিয়া বোধ হইল। ভগিনী সারা “সুপ্রভাত” বলিয়া আমাকে অভিবাদন করিলেন! আমি মনে মনে হাসিলাম,—এমন শুভ্র জ্যোৎসা-প্লাবিত রজনীতে তিনি বলিলেন, “সুপ্রভাত !” তাঁহার দৃষ্টিশক্তি কেমন? যাহা হউক, প্রকাশ্যে আমি প্রত্যুত্তরে বলিলাম, –

“আপনি কেমন আছেন?”

“আমি ভাল আছি, ধন্যবাদ। আপনি একবার আমাদের বাগানে বেড়াইতে আসিবেন কি?”

আমি মুক্তবাতায়ন হইতে আবার পূর্ণিমা-চন্দ্রের প্রতি চাহিলাম, ভাবিলাম, এসময় যাইতে আপত্তি কি? চাকরেরা এখন গভীর নিদ্রামগ্ন ; এই অবসরে ভগিনী সারার সমভিব্যাহারে বেড়াইয়া বেশ একটু আনন্দ উপভোগ করা যাইবে।

দার্জিলিং অবস্থানকালে আমি সর্ব্বদাই ভগিনী সারার সহিত ভ্রমণ করিতাম। কত দিন উদ্ভিদকাননে (বোটানিকাল গার্ডেনে) বেড়াইতে বেড়াইতে উভয়ে লতাপাতা সম্বন্ধে—ফুলের লিঙ্গ নির্ণয় সম্বন্ধে কত তর্ক-বিতর্ক করিয়াছি, সে সব কথা মনে পড়িল। ভগিনী সারা সম্ভবতঃ আমাকে তদ্রূপ কোন উদ্যানে লইয়া যাইবার নিমিত্ত আসিয়াছেন: আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁহার সহিত বাহির হইলাম।

ভ্রমণকালে দেখি কি –এত সে জ্যোৎস্নাময়ী রজনী নহে! এযে দিব্য প্রভাত ! নগরের লোকেরা জাগিয়া উঠিয়াছে, রাজপথে লোকে লোকারণ্য ! কি বিপদ ! আমি দিনের বেলায় এভাবে পথে বেড়াইতেছি ভাবিয়া লজ্জায় জড়সড় হইলাম—যদিও পথে একজনও পুরুষ দেখিতে পাই নাই।

পথিকা স্ত্রীলোকেরা আমার দিকে চাহিয়া হাস্য পরিহাস করিতেছিল। আমি তাহাদের ভাষা না বুঝিলেও ইহা স্পষ্ট বুঝিলাম, যে তাহাদের উপহাসের লক্ষ্য বেচারী আমিই। সঙ্গিনীকে জিজ্ঞাসা করিলাম, –

“উহারা কি বলিতেছে ?”

উত্তর পাইলাম, –“উহারা বলে, যে আপনি অনেকটা পুরুষ ভাবাপন্ন।” “পুরুষভাবাপন্ন। ইহার মানে কি?”

“ইহার অর্থ এই, যে আপনাকে পুরুষের মত ভীরু ও লজ্জানম্র দেখায় !”

‘পুরুষের মত লজ্জানম্র!” এমন ঠাট্টা! এরূপ উপহাস ত কখন শুনি নাই! ক্রমে বুঝিতে পারিলাম, আমার সঙ্গিনী সে দার্জিলিংবাসিনী ভগিনী সারা নহেন,—ইহাকে আর কখনও দেখি নাই! ওহো! আমি কেমন বোকা একজন অপরিচিতার সহিত হঠাৎ চলিয়া আসিলাম! কেমন একটু বিস্ময়ে ও ভয়ে অভিভূত হইলাম। আমার সর্ব্বাঙ্গ রোমাঞ্চিত ও ঈষৎ কম্পিত হইল। তাঁহার হাত ধরিয়া চলিতেছিলাম কি না, তিনি আমার হস্তকম্পন অনুভব করিয়া সস্নেহে বলিলেন,—

“আপনার কি হইয়াছে? আপনি কাঁপিতেছেন যে !”

এরূপে ধরা পড়ায় আমি লজ্জিত হইলাম। ইতস্ততঃ করিয়া বলিলাম, “আমার কেমন একটু সঙ্কোচ বোধ হইতেছে; আমরা পদার্নশীন স্ত্রীলোক, আমাদের বিনা অবগুণ্ঠনে বাহির হইবার অভ্যাস নাই।”

“আপনার ভয় নাই—এখানে আপনি কোন পুরুষের সম্মুখে পড়িবেন না। এ দেশের নাম ‘নারীস্থান’ i এখানে স্বয়ং পুণ্য নারীবেশে রাজত্ব করেন।”

ক্রমে নগরের দৃশ্যাবলী দেখিয়া আমি অন্যমনস্ক হইলাম। বাস্তবিক পথের উভয় পার্শ্বস্থিত দৃশ্য অতিশয় রমণীয় ছিল। সুনীল অম্বর দর্শনে মনে হইল যেন ইতিপূর্ব্বে আর কখন এত পরিষ্কার আকাশ দেখি নাই! একটী তৃণাচ্ছাদিত প্রান্তর দেখিয়া ভ্রম হইল, যেন হরিৎ মখমলের গালিচা পাতা রহিয়াছে। ভ্রমণ কালে আমার বোধ হইতেছিল, যেন কোমল মনদের উপর বেড়াইতেছি,—ভূমির দিকে দৃপাত করিয়া দেখি, পথটি শৈবাল ও বিবিধ পুষ্পে আবৃত ! আমি তখন সানন্দে বলিয়া উঠিলাম, “আহা! কি সুন্দর!”

ভগিনী সারা জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি এ সব পছন্দ করেন কি?” (আমি তাঁহাকে ‘ভগিনী সারা’ই বলিতে থাকিলাম, এবং তিনিও আমার নাম ধরিয়া সম্বোধন করিতেছিলেন।) “হা এসব দেখিতে বড়ই চমৎকার। কিন্তু আমি এ সুকুমার কুসুমস্তবক পদদলিত করিতে চাই না।” “সে জন্য ভাবিবেন না, প্রিয় সুলতানা আপনার পদস্পর্শে এ ফুলের কোন ক্ষতি হইবে না। এগুলি বিশেষ এক জাতীয় ফুল, ইহা রাজপথেই রোপণ করা হয়।”

দুইধারে পুষ্পচূড়াধারী পাদপশ্রেণী সহাস্যে শাখা দোলাইয়া দোলাইয়া যেন আমার অভ্যর্থনা করিতেছিল। দূরাগত কেতকী-সৌরভে দিক্ পরিপূরিত ছিল। সে সৌন্দর্য্য ভাষায় ব্যক্ত করা দুঃসাধ্য—আমি মুগ্ধ নয়নে চাহিয়া দেখিতে দেখিতে বলিলাম, “সমস্ত নগরখানি একটি কুঞ্জ ভবনের মত দেখায়! যেন ইহা প্রকৃতি-রাণীর লীলাকানন! আপনাদের উদ্যানরচনা-নৈপুণ্য অত্যন্ত প্রশংসনীয়।” “ভারতবাসী ইচ্ছা করিলে কলিকাতাকে ইহা অপেক্ষা অধিক সুন্দর পুষ্পোদ্যানে পরিণত করিতে পারেন!”

“তাঁহাদিগকে অনেক গুরুতর কার্য্য করিতে হয়, তাঁহারা কেবল উপবনের উন্নতিকল্পে অধিক সময় ব্যয় করা অনাবশ্যক মনে করিবেন।”

“ইহা ছাড়া তাঁহারা আর কি বলিতে পারেন? জানেন ত অলসেরা অতিশয় বাক্‌পটু হয়!”

আমার বড় আশ্চর্যবোধ হইতেছিল, সে দেশের পুরুষেরা কোথায় থাকে? রাজপথে শতাধিক ললনা দেখিলাম, কিন্তু পুরুষ বলিতে একটি বালক পর্য্যন্ত দৃষ্টিগোচর হইল না। শেষে কৌতূহল গোপন করিতে না পারিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “পুরুষেরা কোথায়?”

উত্তর পাইলাম, “যেখানে তাহাদের থাকা উচিত সেইখানে, অর্থাৎ তাহাদের উপযুক্ত স্থানে।”

ভাবিলাম, তাহাদের “উপযুক্ত স্থান” আবার কোথায়, আকাশে না পাতালে? পুনরায় বলিলাম, “মাফ করিবেন, আপনার কথা ভালমতে বুঝিতে পারিলাম না। তাহাদের ‘উপযুক্ত স্থানের’ অর্থ কি?”

“ওহো! আমার কি ভ্রম! আপনি আমাদের নিয়ম আচার জ্ঞাত নহেন, একথা আমার মনেই ছিল না। এ দেশে পুরুষজাতি গৃহাভ্যন্তরে অবরুদ্ধ থাকে।”

“কি ! যেমন আমরা অন্তঃপুরে থাকি, সেইরূপ তাঁহারাও থাকেন না কি?”

“হাঁ, ঠিক তদ্রূপই।”

“বাঃ! কি আশ্চর্য্য ব্যাপার!” বলিয়া আমি উচ্চহাস্য করিলাম। ভগিনী সারাও হাসিলেন! আমি প্রাণে বড় আরাম পাইলাম; — পৃথিবীতে অন্ততঃ এমন একটি দেশও আছে, যেখানে পুরুষজাতি অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ থাকে ! ইহা ভাবিয়া অনেকটা সান্ত্বনা অনুভব করা গেল !

তিনি বলিলেন, “ইহা কেমন অন্যায়, যে নিরীহ রমণী অন্তঃপুরে আবদ্ধা থাকে, আর পুরুষেরা মুক্ত স্বাধীনতা ভোগ করে। কি বলেন, সুলতানা, আপনি ইহা অন্যায় মনে করেন না?”

আমি আজন্ম অন্তঃপুরবাসিনী, আমি এ প্রথাকে অন্যায় মনে করিব কিরূপে? প্রকাশ্যে বলিলাম,—“অন্যায় কিসের? রমণী স্বভাবতঃ দুর্ব্বলা, তাহাদের পক্ষে অন্তঃপুরের বাহিরে থাকা নিরাপদ নহে।”

“হাঁ, নিরাপদ নহে ততদিন,— যতদিন পুরুষজাতি বাহিরে থাকে ! তা কোন বন্য জন্তু কোন একটা গ্রামে আসিয়া পড়িলেও ত সে গ্রামখানি নিরাপদ থাকে না। কি বলেন?” “তাহা ঠিক; হিংস্রজন্তুটা ধরা না পড়া পর্য্যন্ত গ্রামটি নিরাপদ হইতে পারে না।”

“মনে করুন, কতকগুলি পাগল যদি বাতুলাশ্রম হইতে বাহির হইয়া পড়ে, আর তাহারা অশ্ব, গবাদি—এমন কি ভাল মানুষের প্রতিও নানা প্রকার উপদ্রব উৎপীড়ন আরম্ভ করে, তবে ভারতবর্ষের লোকে কি করিবে?”

“তবে তাহারা পাগলগুলিকে ধরিয়া পুনরায় বাতুলাগারে আবদ্ধ করিতে প্রয়াস পাইবে।” “বেশ বুদ্ধিমান লোককে বাতুলালয়ে আবদ্ধ রাখিয়া দেশের সমস্ত পাগলকে মুক্তি ‘ওয়াটা বোধ হয় আপনি ন্যায়সঙ্গত মনে করেন না?”

“অবশ্যই না ! শান্তশিষ্ট লোককে বন্দী করিয়া পাগলকে মুক্তি দিবে কে?”

“কিন্তু কার্য্যতঃ আপনাদের দেশে আমরা ইহাই দেখিতে পাই! পুরুষেরা—যাহারা নানা প্রকার দুষ্টামী করে, বা অন্ততঃ করিতে সক্ষম, তাহারা দিব্য স্বাধীনতা ভোগ করে, আর নিরীহ কোমলাঙ্গী অবলারা বন্দিনী থাকে অশিক্ষিত অমার্জ্জিতরুচি পুরুষেরা বিনা শৃঙ্খলে থাকিবার উপযুক্ত নহে। আপনারা কিরূপে তাহাদিগকে মুক্তি দিয়া নিশ্চিন্ত থাকেন?”

সুলতানা’স ড্রিম নিয়া Chitra Ganesh’র আঁকা ছবি।

 

“জানেন, ভগিনী সারা! সামাজিক বিধিব্যবস্থার উপর আমাদের কোন হাত নাই। ভারতে পুরুষজাতি প্রভু,—তাহারা সমুদয় সুখ সুবিধা ও প্রভুত্ব আপনাদের জন্য হস্তগত করিয়া ফেলিয়াছে, আর সরলা অবলাকে অন্তঃপুর রূপ পিঞ্জরে আবদ্ধ রাখিয়াছে ! উড়িতে শিখিবার পূর্ব্বেই আমাদের ডানা কাটিয়া দেওয়া হয়—তদ্ব্যতীত সামাজিক রীতিনীতির কত শত কঠিন শৃঙ্খল পদে পদে জড়াইয়া আছে।”

“তাই ত ! আমার বলিতে ইচ্ছা হয়,–‘দোষ কার, বন্দী হয় কে !’ কিন্তু বলি, আপনারা ওসব নিগড় পরেন কেন?”

“না পরিয়া করি কি?‘জোর যার মুলুক তার’; যাহার বল বেশী, সেই স্বামিত্ব করিবে— ইহা অনিবাৰ্য্য।”

“কেবল শারীরিক বল বেশী হইলেই কেহ প্রভুত্ব করিবে, ইহা আমরা স্বীকার করি না। সিংহ কি বলে বিক্রমে মানবাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ নহে? তাই বলিয়া কি কেশরী মানবজাতির উপর প্রভুত্ব করিবে? আপনাদের কর্ত্তব্যের ত্রুটী হইয়াছে, সন্দেহ নাই। আপনারা সমাজের উপর কর্তৃত্ব ছাড়িয়া একাধারে নিজের প্রতি অত্যাচার এবং স্বদেশের অনিষ্ট দুই–ই করিয়াছেন। আপনাদের কল্যাণে সমাজ আরও উন্নত হইত—আপনাদের সাহায্য অভাবে সমাজ অৰ্দ্ধেক শক্তি হারাইয়া দুর্ব্বল ও অবনত হইয়া পড়িয়াছে।” “শুনুন ভগিনী সারা! যদি আমরাই সংসারের সমুদয় কার্য্য করি, তবে পুরুষেরা কি করিবে?”

“তাহারা কিছুই করিবে না, তাহারা কোন ভাল কাজের উপযুক্ত নহে। তাহাদিগকে ধরিয়া অন্তঃপুরে বন্দী করিয়া রাখুন।”

“কিন্তু ক্ষমতাশালী নরবরদিগকে চতুষ্প্রাচীরের অভ্যন্তরে বন্দী করা কি সম্ভব, না সহজ ব্যাপার? আর তাহা যদিই সাধিত হয়, তবে দেশের যাবতীয় কার্য্য-যথা রাজকার্য্য, বাণিজ্য ইত্যাদি—সকল কাজই অন্তঃপুরে আশ্রয় গ্রহণ করিবে যে!”

এবার ভগিনী সারা কিছু উত্তর দিলেন না; সম্ভবতঃ আমার ন্যায় অজ্ঞানতমসাচ্ছন্ন অবলার সহিত তর্ক করা তিনি অনাবশ্যক মনে করিলেন !

ক্রমে আমরা ভগিনী সারার গৃহতোরণে উপনীত হইলাম। দেখিলাম, বাড়ীখানি একটি বৃহৎ হৃদয়াকৃতি উদ্যানের মধ্যস্থলে অবস্থিত। এ ভাবটি কি চমৎকার!—ধরিত্রী জননীর হৃদয়ে মানবের বাসভবন! বাড়ী বলিতে, একটি টীনের বাঙ্গালা মাত্র, কিন্তু সৌন্দর্য্যে ও নৈপুণ্যে ইহার নিকট আমাদের দেশের বড় বড় রাজপ্রাসাদ পরাজিত! সাজ সজ্জা কেমন নয়নাভিরাম ছিল, তাহা ভাষায় বর্ণনীয় নহে তাহা কেবল দেখিবার জিনিস !

আমরা উভয়ে পাশাপাশি উপবেশন করিলাম। তিনি সেলাই করিতে আরম্ভ করিলেন; একটি খঞ্চিপোষে রেশমের কাজ করা হইতেছিল। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমিও সেলাই জানি কি না। আমি বলিলাম, –

“আমরা অন্তঃপুরে থাকি, সেলাই ব্যতীত অন্য কাজ জানি না।”

“কিন্তু এদেশের অন্তঃপুরবাসীদের হাতে আমরা কারচোবের কাজ দিয়া বিশ্বাস করিতে পারি না!” এই বলিয়া তিনি হাসিলেন; “পুরুষদের এতখানি সহিষ্ণুতা কই, যে তাহারা ধৈর্য্যের সহিত ছুঁচে সুতা পরাইবে?”

তাহা শুনিয়া আমি বলিলাম, “তবে কি কারচোবের কাজগুলি সব আপনিই করিয়াছেন?” তাহার ঘরে বিবিধ ত্রিপদীর উপর নানা প্রকার সলমা চুমকির কারুকার্য্যখচিত বস্ত্রাবরণ ছিল।

তিনি বলিলেন, “হাঁ, এ সব আমারই স্বহস্ত প্রস্তুত।”

“আপনি কিরূপে সময় পান? আপনাকে ত আফিসের কাজও করিতে হয়, না? কি বলেন?”

“হা। তা আমি সমস্ত দিন রসায়নাগারে আবদ্ধ থাকি না। আমি দুই ঘণ্টায় দৈনিক কৰ্ত্তব্য শেষ করি।” “দুই ঘণ্টায় ! আপনি একি বলেন?—দুই ঘণ্টায় আপনার কার্য্য শেষ হয় ! আমাদের দেশে রাজকর্মচারীগণ—যেমন মাজিষ্ট্রেট, মুন্সেফ, জজ প্রভৃতি প্রতিদিন ৭ ঘণ্টা কাজ করিয়া থাকেন।”

“আমি ভারতের রাজপুরুষদের কার্য্যপ্রণালী দেখিয়াছি। আপনি কি মনে করেন, যে তাঁহারা সাত আট ঘণ্টাকাল অনবরত কাজ করেন?”

“নিশ্চয় ! বরং এতদপেক্ষা অধিক পরিশ্রমই করেন।”

“না প্রিয় সুলতানা ! ইহা আপনার ভ্রম! তাঁহারা অলসভাবে বেত্রাসনে বসিয়া ধূমপানে সময় অতিবাহিত করেন! কেহ আবার আফিসে থাকিয়া ক্রমাগত দুই তিনটি চুরুট ধ্বংস করেন। তাঁহারা মুখে যত বলেন, কাৰ্যতঃ তত করেন না। রাজপুরুষেরা যদি কিছু করেন ত তাহা এই, যে কেবল তাঁহাদের নিম্নতম কর্মচারীদের ছিদ্রান্বেষণ মনে করুন একটি চুরুট ভস্মীভূত হইতে অৰ্দ্ধঘণ্টা সময় লাগে, আর কেহ দৈনিক ১২টি চুরুট ধ্বংস করেন, তবে সে ভদ্রলোকটি প্রতিদিন ধূমপানে মাত্র ছয় ঘণ্টা সময় ব্যয় করেন !”

তাই ত! অথচ ভ্রাতৃমহোদয়গণ জীবিকা অর্জ্জন করেন, এই অহঙ্কারেই বাঁচেন না ! ভগিনী সারার সহিত বিবিধ প্রসঙ্গ হইল। শুনিলাম, তাঁহাদের নারীস্থান কখনও মহামারী রোগে আক্রান্ত হয় না। আর তাঁহারা আমাদের ন্যায় হুলধর মশার দংশনেও অধীর হন না ! বিশেষ একটি কথা শুনিয়া আমি অত্যন্ত বিস্মিত হইলাম,–নারীস্থানে নাকি কাহারও অকাল মৃত্যু হয় না। তবে বিশেষ কোন দুর্ঘটনা হইলে লোকে অপ্রাপ্ত বয়সে মরে, সে স্বতন্ত্র কথা। ভগিনী সারা আবার হিন্দুস্থানের অসংখ্য শিশুর মৃত্যু সংবাদে অবাক হইলেন। তাঁহার মতে যেন এই ঘটনা সৰ্ব্বাপেক্ষা অসম্ভব। তিনি বলিলেন, যে প্রদীপ সবে মাত্র তৈল সলিতা যোগে জ্বলিতে আরম্ভ করিয়াছে, সে কেন (তৈল বর্ত্তমানে) নিৰ্ব্বাপিত হইবে? যে নব কিশলয় সবে মাত্র অঙ্কুরিত হইয়াছে, সে কেন পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্ব্বে ঝরিবে !

ভারতের প্লেগ সম্বন্ধেও অনেক কথা হইল; তিনি বলিলেন, “প্লেগ টেলেগ কিছুই নহে—কেবল দুর্ভিক্ষপ্রপীড়িত লোকেরা নানা রোগের আধার হইয়া পড়ে। একটু অনুধাবন করিলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, গ্রাম অপেক্ষা নগরে প্লেগ বেশী,—নগরের ধনী অপেক্ষা নির্ধনের ঘরে প্লেগ বেশী হয়, এবং প্লেগে দরিদ্র পুরুষ অপেক্ষা দরিদ্র রমণী অধিক মারা যায়। সুতরাং বেশ বুঝা যায়, প্লেগের মূল কোথায়—মূল কারণ ঐ অন্নাভাব। আমাদের এখানে প্লেগ বা ম্যালেরিয়া আসুক ত দেখি !”

তাই ত, ধনধান্যপূর্ণা নারীস্থানে ম্যালেরিয়া কিম্বা প্লেগের অত্যাচার হইবে কেন? প্লীহা স্ফীত উদর ম্যালেরিয়াক্লিষ্ট বাঙ্গালায় দরিদ্রদিগের অবস্থা স্মরণ করিয়া আমি নীরবে দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিলাম।

অতঃপর তিনি আমাকে তাঁহাদের রন্ধনশালা দেখাইবার জন্য লইয়া গেলেন। অবশ্য যথাবিধি পর্দা করিয়া যাওয়া হইয়াছিল ! একি রন্ধন গৃহ, না নন্দন কানন? রন্ধনশালার চতুৰ্দ্দিকে মনোরম সবজী বাগান এবং নানাপ্রকার তরিতরকারীর লতাগুল্মে পরিপূর্ণ। ঘরের ভিতর ধূম বা ইন্ধনের কোন চিহ্ন নাই,—মেজেখানি অমল ধবল মর্ম্মর প্রস্তর নির্মিত ; মুক্ত বাতায়নগুলি সদ্য প্রস্ফুটিত পুষ্পদামে সুসজ্জিত! আমি সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করিলাম, –

“আপনারা রাধেন কিরূপে? কোথাও ত অগ্নি জ্বালিবার স্থান দেখিতেছি না?”

তিনি বলিলেন, “সূর্য্যোত্তাপে রান্না হয়।” অতঃপর কি প্রকারে সৌরকর একটা নলের ভিতর দিয়া আইসে, সেই নলটা তিনি আমাকে দেখাইলেন। কেবল ইহাই নহে; তিনি তৎক্ষণাৎ এক পাত্র ব্যঞ্জন (যাহা পূর্ব্ব হইতে তথায় রন্ধনের নিমিত্ত প্রস্তুত ছিল) রাধিয়া আমাকে সেই অদ্ভুত রন্ধন প্রণালী দেখাইলেন।

আমি কৌতূহলাক্রান্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনারা সৌরোত্তাপ সংগ্রহ করেন কি প্রকারে?”

ভগিনী বলিলেন, “কিরূপে সৌরকর আমাদের করায়ত্ত হইয়াছে, তাহার ইতিহাস শুনিবেন? ত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে যখন আমাদের বর্তমান মহারাণী সিংহাসন প্রাপ্ত হন, তখন তিনি ত্রয়োদশ বর্ষীয়া বালিকা ছিলেন। তিনি নামতঃ রাণী ছিলেন, প্রকৃতপক্ষে প্রধান মন্ত্রী রাজ্যশাসন করিতেন।

“মহারাণী বাল্যকাল হইতেই বিজ্ঞান চর্চ্চা করিতে ভালবাসিতেন। সাধারণ রাজকন্যাদের ন্যায় তিনি বৃথা সময় যাপন করিতেন না। একদিন তাঁহার খেয়াল হইল, যে তাহার রাজ্যের সমুদয় স্ত্রীলোকই সুশিক্ষা প্রাপ্ত হউক। মহারাণীর খেয়াল,—সে খেয়াল তৎক্ষণাৎ কার্য্যে পরিণত হইল! অচিরে গবর্ণমেন্ট পক্ষ হইতে অসংখ্য বালিকা স্কুল স্থাপিত হইল। এমন কি পল্লীগ্রামেও উচ্চশিক্ষার অমিয় স্রোত প্রবাহিত হইল। শিক্ষার বিমল জ্যোতিতে কুসংস্কাররূপ অন্ধকার তিরোহিত হইতে লাগিল, এবং বাল্যবিবাহ প্রথাও রহিত হইল। একুশ বৎসর বয়ঃক্রমের পূর্ব্বে কোন কন্যার বিবাহ হইতে পারিবে না এই আইন হইল। আর এক কথা, এই পরিবর্তনের পূর্ব্বে আমরাও আপনাদের মত কঠোর অবরোধে বন্দিনী থাকিতাম।”

সুলতানা’স ড্রিম নিয়া Chitra Ganesh’র আঁকা ছবি

“এখন কিন্তু বিপরীত অবস্থা!” এই বলিয়া আমি হাসিলাম।

“কিন্তু স্ত্রীলোক ও পুরুষের মধ্যে ব্যবধান ত সেই প্রকারই আছে ! কতকদিন তাঁহারা বাহিরে, আমরা ঘরে ছিলাম ; এখন তাঁহারা ঘরে, আমরা বাহিরে আছি! পরিবর্তন প্রকৃতিরই নিয়ম ! কয়েক বৎসরের মধ্যে আমাদের স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হইল; তথায় বালকদের প্রবেশ নিষেধ ছিল।”

“আমাদের পৃষ্ঠপোষিকা স্বয়ং মহারাণী, – আর কি কোন অভাব থাকিতে পারে? অবলাগণ অত্যন্ত নিবিষ্টচিত্তে বিজ্ঞান আলোচনা আরম্ভ করিলেন। এই সময় রাজধানীর একতর বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা প্রিন্সিপাল একটি অভিনব বেলুন নির্মাণ করিলেন ; এই বেলুনে কতকগুলি নল সংযোগ করা হইল। বেলুনটি শূন্যে মেঘের উপর স্থান করা গেল,—— বায়ুর আর্দ্রতা ঐ বেলুনে সংগ্রহ করিবার উপায় ছিল,–এইরূপে জলধরকে ফাঁকি দিয়া তাঁহারা বৃষ্টিজল করায়ত্ত করিলেন! বিদ্যালয়ের লোকেরা সর্ব্বদা ঐ বেলুনের সাহায্যে জল গ্রহণ করিত কি না, তাই আর মেঘমালায় আকাশ আচ্ছন্ন হইতে পারিত না। এই অদ্ভুত উপায়ে বুদ্ধিমতী লেডী প্রিন্সিপাল প্রাকৃতিক ঝড় বৃষ্টি নিবারণ করিলেন।”

“বটে? তাই আপনাদের এখানে পথে কৰ্দ্দম দেখিলাম না!” কিন্তু আমি কিছুতেই বুঝিতে পারিলাম না,–নলের ভিতর বায়ুর আর্দ্রতা কিরূপে আবদ্ধ থাকিতে পারে; আর ঐরূপে বায়ু হইতে জল সংগ্রহ করাই বা কিরূপে সম্ভব? তিনি আমাকে ইহা বুঝাইতে অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু আমার যে বুদ্ধি !–তাহাতে আবার বিজ্ঞান রসায়নের সঙ্গে আমাদের (অর্থাৎ মোসলেম ললনাদের) কোন পুরুষে পরিচয় নাই! সুতরাং ভগিনী সারার ব্যাখ্যা কোন মতেই আমার বোধগম্য হইল না। যাহা হউক তিনি বলিয়া যাইতে লাগিলেন :—

“দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এই জলধর বেলুন দর্শনে অতীব বিস্মিত হইল, — অতিহিংসায় ৩ (হিংসা বৃত্তিটা কি বাস্তবিক বড় দোষনীয়? কিন্তু হিংসা না থাকিলে প্রতিদ্বন্দিতার ইচ্ছা হয় কই? এই হিংসাই ত মানবকে উন্নতির দিকে আকর্ষণ করে। তবে দেশকাল ভেদে ঈর্ষায় পতন হয়, সত্য। তা যে কোন মনোবৃত্তির মাত্রাধিক্যেই অনিষ্ট হয়; সকল বিষয়েরই সীমা আছে।) তাহার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সহস্রগুণ বৰ্দ্ধিত হইল। প্রিন্সিপাল মনস্থ করিলেন, যে এমন কিছু অসাধারণ বস্তু সৃষ্টি করা চাই, যাহাতে কাদম্বিনী-বিজয়ী বিদ্যালয়কে পরাভূত করা যায়! তাঁহারা অল্পকাল মধ্যে একটি যন্ত্র নির্ম্মাণ করিলেন, তদ্বারা সূর্যোত্তাপ সংগ্রহ করা যায়। কেবল ইহাই নহে, – তাঁহারা প্রচুর পরিমাণে ঐ উত্তাপ সংগ্রহ করিয়া রাখিতে এবং ইচ্ছামত যথা তথা বিতরণ করিতে পারেন।”

“যৎকালে এদেশের রমণীবৃন্দ নানাবিধ বৈজ্ঞানিক অনুশীলনে নিযুক্ত ছিলেন, পুরুষেরা তখন সৈনিক বিভাগের বলবৃদ্ধির চেষ্টায় ছিলেন। যখন নরবীরগণ শুনিতে পাইলেন যে জেনানা বিশ্ববিদ্যালয়দ্বয় বায়ু হইতে জলগ্রহণ করিতে এবং সূর্য্যোত্তাপ সংগ্রহ করিতে পারে, তাহারা তাচ্ছিল্যের ভাবে হাসিলেন। এমন কি তাঁহারা বিদ্যালয়ের সমুদয় কাৰ্য্যপ্রণালীকে ‘স্বপ্ন-কল্পনা’ বলিয়া উপহাস করিতেও বিরত হন নাই।”

আমি বলিলাম, “আপনাদের কার্য্যকলাপ বাস্তবিক অত্যন্ত বিস্ময়কর! কিন্তু এখন বলুন দেখি, আপনারা পুরুষদের কি প্রকারে অন্তঃপুরে বন্দী করিলেন? কোনরূপ ফাঁদ পাতিয়াছিলেন না কি?”

ভগিনী বলিলেন, “না।”

“তাঁহারা যে নিজে ধরা দিবেন ইহাও ত সম্ভব নয়। মুক্ত স্বাধীনতায় জলাঞ্জলি দিয়া স্বেচ্ছায় চতুষ্প্রাচীরের অভ্যন্তরে বন্দী হইবে কোন্ পাগল? তবে অবশ্যই পুরুষেরা কোনরূপে আপনাদের দ্বারা পরাভূত হইয়াছিলেন।”

“হাঁ, তাই বটে !”

‘কে প্রথমে পুরুষ প্রবরদের পরাভূত করিল, সম্ভবতঃ কতিপয় নারীযোদ্ধা?”

“না, এদেশের পুরুষদল বাহুবলে পরাস্ত হয় নাই।” “হাঁ,ইহা অসম্ভবও বটে, কারণ পুরুষের বাহু নারীর বাহু অপেক্ষা দুর্ব্বল নহে। তবে?”

“মস্তিষ্ক বলে।”

“তাহাদের মস্তিষ্কও ত রমণীর তুলনায় বৃহত্তর ও গুরুতর। না?— কি বলেন?” “মস্তিষ্ক গুরুতর হইলেই কি? হস্তীর মস্তিষ্কও ত মানবের তুলনায় বৃহৎ এবং ভারী, তবু ত মানুষ হস্তীকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছে !”

“ঠিক ত! কিন্তু কি প্রকারে কর্তারা বন্দী হইলেন, এ কথা জানিবার জন্য আমি বড় উৎসুক হইয়াছি। শীঘ্র বলুন আর বিলম্ব সহে না !”

“স্ত্রীলোকের মস্তিষ্ক পুরুষের অপেক্ষা ক্ষিপ্রকারী, এ কথা অনেকেই স্বীকার করেন। পুরুষ কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হইবার পূর্ব্বে অনেক ভাবে—অনেক যুক্তি তর্কের সাহায্যে বিষয়টি বোধগম্য করে। কিন্তু রমণী বিনা চিন্তায় হঠাৎ সেই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। যাহা হউক, দশ বৎসর পূর্ব্বে যখন সৈনিক বিভাগের কর্মচারীগণ আমাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ইত্যাদিকে ‘স্বপ্ন–কল্পনা’ বলিয়া উপহাস করিয়াছিলেন, তখন কতিপয় ছাত্রী তদুত্তরে কিছু বলিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু উভয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডী প্রিন্সিপালদ্বয় বাধা দিলেন। তাঁহারা বলিলেন, যে তোমরা বাক্যে উত্তর না দিয়া সুযোগ পাইলে কার্য্য দ্বারা উত্তর দিও। ঈশ্বর কৃপায় এই উত্তর দিবার সুযোগের জন্য ছাত্রীদিগকে অধিক দিন অপেক্ষা করিতে হয় নাই।”

“ভারী আশ্চর্য্য!” আমি অতি আনন্দে আত্মসম্বরণ করিতে না পারিয়া করতালি দিয়া বলিলাম, “এখন দাম্ভিক ভদ্রলোকেরা অন্তঃপুরে বসিয়া ‘স্বপ্ন কল্পনায়’ বিভোর রহিয়াছেন!”

ভগিনী সারা বলিয়া যাইতে লাগিলেন,—

“কিছুদিন পরে কয়েকজন বিদেশী লোক এদেশে আসিয়া আশ্রয় লইল। তাহারা কোন প্রকার রাজনৈতিক অপরাধে অভিযুক্ত ছিল। তাহাদের রাজা ন্যায়সঙ্গত সুশাসন বা সুবিচারের পক্ষপাতী ছিলেন না, তিনি কেবল স্বামীত্ব ও অপ্রতিহত বিক্রম প্রকাশে তৎপর ছিলেন। তিনি আমাদের সহৃদয়া মহারাণীকে ঐ আসামী ধরিয়া দিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু মহারাণীত দয়া প্রতিমা জননীর জাতি—সুতরাং তিনি তাঁহার আশ্রিত হতভাগ্যদিগকে ক্রুদ্ধ রাজার শোণিত-পিপাসা নিবৃত্তির জন্য ধরিয়া দিলেন না। প্রবল ক্ষমতাশালী রাজা ইহাতে ক্রোধান্ধ হইয়া আমাদের সহিত যুদ্ধ করিতে প্রস্তুত হইলেন।

“আমাদের রণসজ্জাও প্রস্তুত ছিল, সৈন্য সেনানীগণও নিশ্চিন্ত ছিলেন না। তাঁহারা বীরোচিত উৎসাহে শত্রুর সম্মুখীন হইলেন। তুমুল সংগ্রাম বাধিল—রক্ত গঙ্গায় দেশ ডুবিয়া গেল ! প্রতিদিন যোদ্ধাগণ অম্লাণ বদনে পতঙ্গপ্রায় সমরানলে প্রাণ বিসর্জ্জন দিতে লাগিল।

“কিন্তু শত্রুপক্ষ অত্যন্ত প্রবল ছিল, তাহাদের গতিরোধ করা অসম্ভব হইয়া পড়িল। আমাদের সেনাদল প্রাণপণে কেশরীবিক্রমে যুদ্ধ করিয়াও শনৈঃ শনৈঃ পশ্চাত্ত্বর্ত্তী হইতে লাগিল, এবং শত্রুগণ ক্রমশঃ অগ্রসর হইল। “কেবল বেতনভোগী সেনা কেন, দেশের ইতর ভদ্র—সকল লোকই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইল। এমন কি ৬০ বৎসরের বৃদ্ধ হইতে ষোড়শবর্ষীয় বালক পর্য্যন্ত সমরশায়ী হইতে চলিল।

কতিপয় প্রধান সেনাপতি নিহত হইলেন; অসংখ্য সেনা প্রাণ হারাইল; অবশিষ্ট যোদ্ধাগণ বিতাড়িত হইয়া পৃষ্ঠপ্রদর্শনে বাধ্য হইল। শত্রু এখন রাজধানী হইতে মাত্র ১২/১৩ ক্রোশ দূরে অবস্থিত—আর দুই চারি দিবসের যুদ্ধের পরেই তাহারা রাজধানী আক্রমণ করিবে। “এই সঙ্কট সময়ে সম্রাজ্ঞী জনকতক বুদ্ধিমতী মহিলাকে লইয়া সভা আহবান করিলেন। এখন কি করা কর্ত্তব্য ইহাই সভার আলোচ্য বিষয় ছিল।

“কেহ প্রস্তাব করিলেন যে, রীতিমত যুদ্ধ করিতে যাইবেন; অন্য দল বলিলেন যে, ইহা অসম্ভব—কারণ একে ত অবলারা সমরনৈপুণ্যে অনভিজ্ঞ, তাহাতে আবার কৃপাণ, তোষাদান, বন্দুক ধারণেও অক্ষমা; তৃতীয় দল বলিলেন, যে যুদ্ধনৈপুণ্য দূরে থাকুক— রমণীর শারীরিক দুর্ব্বলতাই প্রধান অন্তরায়।

“মহারাণী বলিলেন, ‘যদি আপনারা বাহুবলে দেশ রক্ষা করিতে না পারেন, তবে মস্তিষ্ক বলে দেশ রক্ষার চেষ্টা করুন।’

“সকলে নিরুত্তর ; সভাস্থল নীরব। মহারাণী মৌনভঙ্গ করিয়া পুনরায় বলিলেন, ‘যদি দেশ ও সম্ভ্রম রক্ষা করিতে না পারি, তবে আমি নিশ্চয় আত্মহত্যা করিব।”

“এইবার দ্বিতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেডী প্রিন্সিপাল (যিনি সৌরকর করায়ত্ত করিয়াছেন) উত্তর দিলেন। তিনি এতক্ষণ নীরবে চিন্তা করেিতছিলেন–এখন অতি ধীরে গম্ভীরভাবে বলিলেন যে, বিজয় লাভের আশা ভরসা ত নাই, শত্রু প্রায় গৃহতোরণে। তবে তিনি একটি সঙ্কল্প স্থির করিয়াছেন—যদি এই উপায়ে শত্রু পরাজিত হয়, তবে ত সুখের বিষয়। এই উপায় ইতিপূর্ব্বে আর কেহ অবলম্বন করে নাই–তিনিই প্রথমে এই উপায়ে শত্রু জয়ের চেষ্টা করিবেন। এই তাহার শেষ চেষ্টা—যদি ইহাতে কৃতকাৰ্য্য হওয়া না যায় তবে অবশ্য সকলে আত্মহত্যা করিবেন। উপস্থিত মহিলাবৃন্দ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলেন যে, তাঁহারা কিছুতেই দাসত্ব শৃঙ্খল পরিবেন না। সেই গভীর নিস্তব্ধ রজনীতে মহারাণীর সভাগৃহ অবলাকণ্ঠের প্রতিজ্ঞা—ধ্বনিতে পুনঃ পুনঃ প্রতিধ্বনিত হইল। প্রতিধ্বনি ততোধিক উল্লাসের স্বরে বলিল, ঝাত্মহত্যা করিব!’ সে যেন ততোধিক তেজোব্যঞ্জক স্বরে বলিল, ‘বিদেশীয় অধীনতা স্বীকার করিব না!”

“সম্রাজ্ঞী তাঁহাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিলেন, এবং লেডী প্রিন্সিপালকে তাঁহার নূতন উপায় অবলম্বন করিতে অনুরোধ করিলেন।

“লেডী প্রিন্সিপাল পুনরায় দণ্ডায়মান হইয়া সসম্ভ্রমে বলিলেন, ‘আমরা যুদ্ধযাত্রা করিবার পূর্ব্বে পুরুষদের অন্তঃপুরে প্রবেশ করা উচিত। আমি পর্দ্দার অনুরোধে এই প্রার্থনা করি।” মহারাণী উত্তর করিলেন, ‘অবশ্য! তাহা ত হইবেই।’

“পর দিন মহারাণীর আদেশপত্রে দেশের পুরুষদিগকে জ্ঞাপন করা হইল যে, অবলারা যুদ্ধযাত্রা করিবেন, সে জন্য সমস্ত নগরে পর্দ্দা হওয়া উচিত। সুতরাং স্বদেশ ও স্বাধীনতা রক্ষার অনুরোধে পুরুষদের অন্তঃপুরে থাকিতে হইবে।

“অবলার যুদ্ধযাত্রার কথা শুনিয়া ভদ্রলোকেরা প্রথমে হাস্য সম্বরণ করিতে পারিলেন না ; পরে ভাবিলেন, ‘মন্দ কি?’ তাঁহারা আহত এবং অত্যন্ত শ্রান্ত ক্লান্ত ছিলেন—যুদ্ধে আর রুচি ছিল না, কাজেই মহারাণীর এই আদেশকে তাঁহারা ঈশ্বর প্রেরিত শুভ আশীর্ব্বাদ মনে করিলেন। মহারাণীকে ভক্তিসহকারে নমস্কার করিয়া তাঁহারা বিনা বাক্যব্যয়ে অন্তঃপুরে আশ্রয় লইলেন ! তাহাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, দেশরক্ষার কোন আশা নাই—মরণ ভিন্ন গত্যন্তর নাই। দেশের ভক্তিমতী কন্যাগণ সমরচ্ছলে মৃত্যু আলিঙ্গন করিতে যাইতেছেন, তাঁহাদের এ অন্তিম বাসনায় বাধা দেওয়ার প্রয়োজন কি? শেষটা কি হয় দেখিয়া দেশভক্ত সম্ভ্রান্ত পুরুষগণও আত্মহত্যা করিবেন।

“অতঃপর লেডী প্রিন্সিপাল দুই সহস্র ছাত্রী সমভিব্যাহারে সমর প্রাঙ্গণাভিমুখে যাত্রা করিলেন—”

আমি বাধা দিয়া বলিলাম, “দেশের পুরুষদিগকে ত পর্দ্দার অনুরোধে জেনানায় বন্দী করিলেন, যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে পর্দ্দার আয়োজন করিলেন কিরূপে? উচ্চ প্রাচীরের ছিদ্র দিয়া গুলিবর্ষণ করিয়াছিলেন না কি?” “না ভাই! বন্দুক-গুলি ত নারী যোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল না, অস্ত্রদ্বারা যুদ্ধজয়ের সম্ভাবনা থাকিলে আর বিদ্যালয়ের ছাত্রীর প্রয়োজন ছিল কি? আর শত্রুর বিরুদ্ধে পর্দ্দার বন্দোবস্ত করিবার আবশ্যক ছিল না– যেহেতু তাহারা অনেক দূরে ছিল; বিশেষতঃ তাহারা আমাদের দিকে দৃষ্টিপাত করিতেই অক্ষম ছিল।”

আমি রঙ্গ করিয়া বলিলাম,— “হয়ত রণভূমে মূর্ত্তিমতী সৌদামিনীদের প্রভা দর্শনে তাহাদের নয়ন ঝলসিয়া গিয়াছিল—” “তাহাদের নয়ন ঝলসিয়াছিল সত্য, কিন্তু সৌদামিনীর প্রভায় নয়, স্বয়ং তপনের প্রখর কিরণে!”

“বটে? কি প্রকারে? আর আপনারা বিনা অস্ত্রে যুদ্ধ করিলেন কিরূপে?”

“যোদ্ধাদের সঙ্গে সেই সূর্য্যোত্তাপ সংগ্রহের যন্ত্র ছিল মাত্র। আপনি কখনও ষ্টীমারের সার্চলাইট (Search light) দেখিয়াছেন কি?”

“দেখিয়াছি।”

সুলতানা’স ড্রিম নিয়া আঁকা Chitra Ganesh’র ছবি

“তবে মনে করুন, আমাদের সঙ্গে অন্যূন দ্বিসহস্র সার্চলাইট ছিল,— অবশ্য সে যন্ত্রগুলি ঠিক সার্চলাইটের মত নয়, তবে অনেকটা সাদৃশ্য আছে; কেবল আপনাকে বুঝাইবার জন্য * তাহাকে ‘সার্চলাইট’ বলিতেছি। ষ্টীমারের সার্চলাইটে উত্তাপের প্রাখর্য্য থাকে না, কিন্তু আমাদের সার্চলাইেট ভয়ানক উত্তাপ ছিল। ছাত্রীগণ যখন সেই সার্চলাইটের কেন্দ্রীভূত উত্তাপ-রশ্মি শত্রুর দিকে পরিচালিত করিলেন,—তখন তাহারা হয় ত ভাবিয়াছিল, একি ব্যাপার ! শত সহস্র সূর্য্য মর্ত্তে অবতীর্ণ ! সে উগ্র উত্তাপ ও আলোক সহ্য করিতে না পারিয়া শত্রুগণ দিগ্‌বিদিগ্‌ জ্ঞানশূন্য হইয়া পলায়ন করিল! নারীর হস্তে একটি লোকেরও মৃত্যু হয় নাই—একবিন্দু নরশোণিতেও বসুন্ধরা কলঙ্কিত হয় নাই—অথচ শত্রু পরাজিত হইল!

তাহারা প্রস্থান করিলে পর তাহাদের সমুদয় অস্ত্রশস্ত্র সূর্য্যকিরণে দগ্ধ করা গেল।” আমি বিস্ময়ে অভিভূত হইয়া বলিলাম, “যদি বারুদ দগ্ধকালে ভয়ানক দুর্ঘটনা হইয়া আপনাদের কোন অনিষ্ট হইত।”

“আমাদের অনিষ্টের সম্ভাবনা ছিল না, কারণ বারুদ ছিল বহুদূরে। আমরা রাজধানীতে থাকিয়াই সার্চলাইটের তীব্র উত্তাপ প্রেরণ করিয়াছিলাম। তবু অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য জলধর বেলুন সঙ্গে রাখা হইয়াছিল। তদবধি আর কোন প্রতিবেশী রাজা মহারাজা আমাদের দেশ আক্রমণ করিতে আইসেন নাই।”

“তার পর পুরুষ-প্রবরেরা অন্তঃপুরের বাহিরে আসিতে চেষ্টা করেন নাই কি?”

“হাঁ, তাঁহারা মুক্তি পাইতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কতিপয় পুলিশ কমিশনার ও জেলার ম্যাজিষ্ট্রেট এই মৰ্ম্মে মহারাণীসমীপে আবেদন করিয়াছিলেন, যে যুদ্ধে অকৃতকার্য্য হওয়ার দোষে সমর-বিভাগের কর্মচারীগণই দোষী, সেজন্য তাঁহাদিগকে বন্দী করা ন্যায় সঙ্গত হইয়াছে ; কিন্তু অপর রাজপুরুষেরা ত কদাচ কর্তব্যে অবহেলা করেন নাই, তবে তাঁহারা অন্তঃপুর কারাগারে বন্দী থাকিবেন কেন? তাঁহাদের পুনরায় স্ব স্ব কার্য্যে নিযুক্ত করিতে আজ্ঞা হউক।”

“মহারাণী তাঁহাদিগকে জানাইলেন, যে যদি আবার কখনও রাজকার্য্যে তাঁহাদের সহায়তার আবশ্যক হয় তবে তাহাদিগকে যথাবিধি কার্য্যে নিযুক্ত করা যাইবে। রাজ্যশাসন ব্যাপারে তাঁহাদের সাহায্যের প্রয়োজন না হওয়া পর্য্যন্ত তাঁহারা যেখানে আছেন, সেইখানে থাকুন।

আমরা এই প্রথাকে ‘জোনানা’ না বলিয়া ‘মৰ্দ্দানা’ বলি।”

আমি বলিলাম, “বেশ ত ! কিন্তু এক কথা,—পুলিশ ম্যাজিষ্ট্রেট ইত্যাদি ত ‘মৰ্দ্দানায়’ আছেন, আর চুরি ডাকাতির তদস্ত এবং হত্যাকাণ্ড প্রভৃতি অত্যাচার অনাচারের বিচার করে কে?” “যদবধি ‘মৰ্দ্দানা’ প্রথা প্রচলিত হইয়াছে, তদবধি এদেশে কোন প্রকার পাপ কিম্বা অপরাধ হয় নাই ; সেই জন্য আসামী গ্রেফতারের নিমিত্ত আর পুলিশের প্রয়োজন হয় না,— ফৌজদারী মোকদ্দমার জন্য ম্যাজিষ্ট্রেটেরও আবশ্যক নাই।”

“তাই ত, আপনারা স্বয়ং শয়তানকেই ৪ (পুরুষ জাতিকে) শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছেন, আর দেশে শয়তানী ৫ (পাপ) থাকিবে কিরূপে! যদি কোন স্ত্রীলোক কখনও কোন বে-আইনী কাজ করে, তবে তাহাকে সংশোধন করা আপনাদের পক্ষে কঠিন নয়। যাহারা বিনা রক্তপাতে যুদ্ধজয় করিতে পারেন,— অপরাধ ও অপরাধীকে তাড়াইতে তাঁহাদের কতক্ষণ লাগিবে ?”

অতঃপর তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, “প্রিয় সুলতানা ! আপনি এইখানে আরও কিছুক্ষণ বসিবেন, না আমার বসিবার ঘরে চলিবেন?” আমি সহাস্যে বলিলাম, “আপনার রান্নাঘরটি রাণীর বসিবার ঘর অপেক্ষা কোন অংশে নিকৃষ্ট নয় ! কিন্তু কর্তাদের কাজ বন্ধ করিয়া এখানে আমাদের বসা অন্যায় ; আমি তাঁহাদের বে-দখল করিয়াছি বলিয়া হয় ত তাঁহারা আমাকে গালি দিতেছেন!” আমি ভগিনী সারার বসিবার ঘরে যাইবার সময় ইতস্ততঃ উদ্যানের সৌন্দর্য্য নিরীক্ষণ করিয়া বলিলাম,–“আমার বন্ধুবান্ধবেরা ভারী আশ্চর্য্য হইবেন, যখন আমি দেশে গিয়া নারীস্থানের কথা বলিব,–নন্দনকাননতুল্য নারীস্থানে নারীর পূর্ণ আধিপত্য, যৎকালে পুরুষেরা মদানায় থাকিয়া রন্ধন করেন, শিশুদের খেলা দেন,—এক কথায় যাবতীয় গৃহকাৰ্য্য করেন! আর রন্ধন প্রণালী এমন সহজ ও চমৎকার, যে রন্ধনটা অত্যন্ত আমোদজনক ব্যাপার! ভারতে যে সকল বেগম খানম প্রমুখ বড় ঘরের গৃহিণীরা রন্ধনশালার ত্রিসীমায় যাইতে চাহেন না, তাঁহারা এমন কেন্দ্রীভূত সৌরকর পাইলে আর রন্ধনকার্য্য আপত্তি করিতেন না !” “ভারতের লোকেরা একটু চেষ্টা করিলেই সূর্য্যোত্তাপ লাভের উপায় করিতে পারেন। বিশেষ এক খণ্ড কাচ (Convex glass) দ্বারা যেমন রবিকর একত্রিত করিয়া কাগজাদি দগ্ধ করা যায়, সেইরূপ কাচ বিশিষ্ট যন্ত্র নির্মাণ করিতে অধিক বুদ্ধি ও টাকা ব্যয় হইবে না।”

“জানেন ভগিনী সারা! ভারতবাসীর বুদ্ধি সুপথে চালিত হয় না—জ্ঞান বিজ্ঞানের সহিত আমাদের সম্পর্ক নাই। আমাদের সব কার্য্যের সমাপ্তি বক্তৃতায়—সিদ্ধি করতালি লাভে ! কোন দেশ আপনা হইতে উন্নত হয় না, তাহাকে উন্নত করিতে হয়। নারীস্থানে কখনও স্বর্ণবৃষ্টি হয় নাই, – কিম্বা জোয়ারের জলেও মণিমুক্তা ভাসিয়া আইসে নাই?”

তিনি হাসিয়া বলিলেন, “না।”

“তবেই দেখুন, ত্রিশ বৎসরে আপনারা একটা নগণ্য দেশকে সুসভ্য করিলেন,–না, প্রকৃতপক্ষে দশ বৎসরেই আপনারা এদেশকে স্বর্গতুল্য পূণ্যভূমিতে পরিণত করিতে পারিলেন। আর আমরা একটি সুসভ্য রত্নগর্ভা দেশকে ক্রমে উন্নত করিব দূরের কথা, বরং ক্রমশঃ তাহাকে দীনতমা শ্মশানে পরিণত করিতে বসিয়াছি !”

“পুরুষের কার্য্যে ও রমণীর কার্য্যে এই প্রভেদ। আমি যে বলিয়াছিলাম, পুরুষেরা কোন ভাল কাজ সুচারুরূপে করিবার উপযুক্ত নয়, আপনি বোধ হয় এতক্ষণে সে কথাটা বুঝিতে পারিলেন?”

“হাঁ, এখন বুঝিলাম, নারী যাহা দশ বৎসরে করিতে পারে, পুরুষ তাহা শত শত বর্ষেও করিতে অক্ষম ! আচ্ছা ভগিনী সারা, আপনারা ভূমিকৰ্ষণাদি কঠিন কার্য্য করেন কিরূপে?”

“আমরা বিদ্যুৎ-সাহায্যে চাষ করিয়া থাকি। চপলা আমাদের অনেক কাজ করিয়া দেয়,—ভারী বোঝা উত্তোলন ও বহনের কার্য্যও সে-ই করে। আমাদের বায়ু-শকটও তদ্দ্বারা চালিত হয়। দেখিতেছেন, এদেশে রেল-বৰ্ত্ম বা পাকা বাঁধা সড়ক নাই, কেবল পদব্রজে ভ্রমণের পথ আছে।”

“সেই জন্য এখানে রেলওয়ে দুর্ঘটনার ভয় নাই-রাজপথেও লোকে শকট–চক্রে পেষিত হয় না। যে সব পথ আছে, তাহা ত কুসুম-শয্যা বিশেষ! বলি, আপনারা কখন কখন অনাবৃষ্টিজনিত ক্লেশ ভোগ করেন কি?”

“দশ এগার বৎসর হইতে এখানে অনাবৃষ্টিতে কষ্ট পাইতে হয় না। আপনি ঐ যে বৃহৎ বেলুন এবং তাহাতে সংলগ্ন নল দেখিতে পাইতেছেন, – উহা দ্বারা আমরা যত ইচ্ছা বারিবর্ষণ করিতে পারি। আবশ্যক মত সমস্ত শস্যক্ষেত্রে জলসেচ করা হয়। আবার জলপ্লাবনেও আমরা ঈশ্বরকৃপায় কষ্টভোগ করি না। ঝঞ্ঝাবাত এবং বজ্রপাতেরও উপদ্রব নাই।”

“তবে ত এদেশ বড় সুখের স্থান। আহা মরি ইহার নাম ‘সুখস্থান’ হয় নাই কেন? আপনারা ভারতবাসীর ন্যায় ঝগড়া কলহ করেন কি? এখানে কেহ গৃহবিবাদে-সৰ্ব্বস্বান্ত হয় কি?”

“না ভগিনী ! আমাদের কোঁদল করিবার অবসর কই? আমরা সকলেই সর্ব্বদা কাজে ব্যস্ত থাকি—প্রকৃতির ভাণ্ডার অন্বেষণ করিয়া নানা প্রকার সুখ স্বচ্ছন্দতা আহরণের চেষ্টায় থাকি। অলসেরা কলহ করিতে সময় পায়– আমাদের সময় নাই। আমাদের গুণবতী মহারাণীর সাধ,—সমস্ত দেশটাকে একটি উদ্যানে পরিণত করিবেন!”

“রাণীর এ আকাঙ্ক্ষা অতি চমৎকার! আপনাদের প্রধান খাদ্য কি?”

“ফল।”

“ভাল কথা, আপনারই ত সব কাজ করেন, তবে পুরুষেরা কি করেন?”

“বড় বড় কলকারখানায় যন্ত্রাদি পরিচালিত করেন; খাতা-পত্র রাখেন,—এক কথায় বলি, তাঁহারা যাবতীয় কঠিন পরিশ্রম অর্থাৎ যে কার্য্যে কায়িক বলের প্রয়োজন, সেই সব কার্য্য করেন।”

“আমি হাসিয়া বলিলাম, – “ওঃ! তাঁহারা কেরাণী ও মুটে মজুরের কাজ করিয়া থাকেন!”

“কিন্তু কেরাণী ও শ্রমজীবী বলিতে ঠিক যাহা বুঝায় এদেশের ভদ্রলোকেরা তাহা নহেন। তাঁহারা বিদ্যা, বুদ্ধি, সুশিক্ষায় আমাদের অপেক্ষা কোন অংশে হীন নহেন। আমরা শ্রম বণ্টন করিয়া লইয়াছি –তাঁহারা শারীরিক পরিশ্রম করেন, আমরা মস্তিষ্কচালনা করি। আমরা যে সকল যন্ত্রের উদ্ভাবনা বা সৃষ্টি কল্পনা করি, তাঁহারা তাহা নির্ম্মাণ করেন। নরনারী উভয়ে একই সমাজ-দেহের বিভিন্ন অঙ্গ,— পুরুষ শরীর, রমণী মন!”

“তা বেশ! কিন্তু ভারতবাসী পুরুষেরা একথা শুনিলে খড়গহস্ত হইবেন! তাহাদের মতে তঁাহারা একাই এক সহস্ৰ—‘তনমন’ সব তাঁহারা নিজেই! আমরা তাঁহাদের ‘ছাই ফেলিবার জন্য ভাঙ্গাকুলা’ মাত্র আপনাকে আর একটী কথা জিজ্ঞাসা না করিয়া থাকিতে

পারিতেছি না, আপনারা গ্রীষ্মকালে বাড়ীঘর ঠাণ্ডা রাখেন কিরূপে? আমরা ত বৃষ্টিধারাকে স্বর্গের অমিয়ধারা মনে করি।” “আমাদেরও সুস্নিগ্ধ বৃষ্টিধারার অভাব হয় না। তবে আমরা পিপাসী চাতকের ন্যায় জলধরের কৃপা প্রার্থনা করি না; এখানে কাদম্বিনী আমাদের সেবিকা—সে আমাদের ইচ্ছানুসারে শীতল ফোয়ারায় ধরণী সিক্ত করিয়া দেয়। আবার শীতকালে সূর্য্যোত্তাপে গৃহগুলি ঈষৎ উত্তপ্ত রাখা হয়।”

অতঃপর তিনি আমাকে তাঁহার স্নানাগার দেখাইলেন। এ কক্ষের ছাদটা বাক্সের ডালার মত ছাদ তুলিয়া ফেলিয়া ইচ্ছামত বৃষ্টিজলে স্নান করা যায় ! প্রত্যেকর গৃহপ্রাঙ্গণে বেলুনের ন্যায় বৃহৎ জলাধার আছে,– আদি বেলুনের সহিত ঐ জলাধারগুলির যোগ আছে। আমি মুগ্ধভাবে বলিলাম, “আপনারা ধন্য! স্বয়ং প্রকৃতি আপনাদের সেবাদাসী আর চাই কি! পার্থিব সম্পদে ত আপনারা অতিশয় ধনী; আপনাদের ধর্ম্মবিধান কিরূপ—জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”

“আমাদের ধর্ম প্রেম ও সত্য। আমরা পরস্পরকে ভালবাসিতে ধৰ্ম্মতঃ বাধ্য এবং প্রাণাস্তেও সত্য ত্যাগ করিতে পারি না। যদি কালে ভদ্রে কে মিথ্যা বলে—”

“তবে তাহার প্রাণদণ্ড হয়?”

“না, প্রাণদণ্ড হয় না। আমরা ঈশ্বরের সৃষ্টিজগতের জীব হত্যায়—বিশেষতঃ মানব হত্যায় আমোদ বোধ করি না। কাহারও প্রাণনাশ করিতে অপর প্রাণীর কি অধিকার? অপরাধীকে নির্বাসিত করা হয় এবং তাহাকে এদেশে কিছুতেই পুনঃপ্রবেশ করিতে দেওয়া হয় না।”

“কোন মিথ্যাবাদীকে কখনও ক্ষমা করা হয় না কি?”

“যদি কেহ অকপট হৃদয়ে অনুতপ্ত হয়, তাহাকে ক্ষমা করা যায়।”

“এ নিয়ম অতি উত্তম। এখানে যেন ধৰ্ম্মই রাজত্ব করিতেছে। ভাল, একবার মহারাণীকে দেখিতে পাইব কি? যিনি করুণাপ্রতিমা, নানা গুণের আধার, তাঁহাকে দেখিলেও পূণ্য হয়।”

“বেশ চলুন!” এই বলিয়া ভগিনী সারা যাত্রার আয়োজন করিতে লাগিলেন। এক খণ্ড তক্তায় দুইখানি আসন ক্রু দ্বারা আঁটা হইল; পরে তিনি কতিপয় গোলা আনিলেন, গোলা কয়টি দেখিতে বেশ চক্চকে ছিল ; কোন্ ধাতুতে গঠিত তাঁহা ঠিক বুঝিতে পারিলাম না, আমার মনে হইল উৎকৃষ্ট রৌপ্য নিৰ্ম্মিত বলিয়া। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমার ওজন কত। আমি জীবনে কখনও ওজন হই নাই, কাজেই নিজের গুরুত্ব আমার জানা ছিল না ; ভগিনী বলিলেন,–“আসুন তবে আপনাকে ওজন করি। ওজনটা জানা প্রয়োজন।”

আমি ভাবিলাম, একি ব্যাপার! যাহা হউক ওজনে আমি এক মণ ষোল সের হইলাম। শুনিলাম তিনি আটত্রিশ সের মাত্র! তবে ভগিনী সারার অপেক্ষা আর কোন গুণে না হউক, আমি গুরুত্বে বেশী ত!

তার পর দেখিলাম ঐ চক্চকে গোলার ছোট বড় দুইটি গোলা এই তক্তায় সংযোগ করা হইল। আমি প্রশ্ন করিয়া জানিলাম, সে গোলা হাইড্রোজেন পূর্ণ। তাহারই সাহায্যে আমরা শূন্যে উত্থিত হইব। বিভিন্ন ওজনের বস্তু উত্তোলনের নিমিত্ত ছোট বড় বিবিধ ওজনের হাইড্রোজেন গোলা ব্যবহৃত হয়। এখন বুঝিলাম, এই জন্য আমার ওজন অবগত হওয়ার প্রয়োজন ছিল। অতঃপর এই অপরূপ বায়ুযানে দুইটী পাখার মত ফলা সংযুক্ত হইল, শুনিলাম ইহা বিদ্যুৎ দ্বারা পরিচালিত হয়। আমরা উভয়ে আসনে উপবেশন করিলে পর তিনি ঐ পাখার কল টিপিলেন। প্রথমে আমাদের ‘তখতে রওয়া’ খানি ৬ ( ইংরাজেিত ‘Travelling throne’ বলা যাইতে পারে।) ধীরে ধীরে ৭/৮ হাত ঊর্দ্ধে উত্থিত হইল, তার পর বায়ুভরে উড়িয়া চলিল! আমি ভাবিলাম, এমন জ্ঞানে বিজ্ঞানে উন্নত দেশের অধীশ্বরীকে দেখিতে যাইতেছি, যদি আমার কথাবার্তায় তিনি আমাকে নিতান্ত মূর্খ ভাবেন—এবং সেই সঙ্গে আমাদের সাধের হিন্দুস্থানকে ‘মূর্খস্থান’ মনে করেন? কিন্তু অধিক ভাবিবার সময় ছিল না,—সবে তখতে রওয়া শূন্যে উড়িতে আরম্ভ করিয়াছে আর অমনই দেখি, আমরা চপলা-গতিতে রাজধানীতে উপনীত! সেই বায়ুযানে বসিয়াই দেখিতে পাইলাম, সখী-সহচরী পরিবেষ্টিতা মহারাণী তাঁহার চার বৎসর বয়স্কা কন্যার হাত ধরিয়া উদ্যানে ভ্রমণ করিতেছেন। সমস্ত রাজধানী যেন একটি বিরাট কুসুমকুঞ্জ বিশেষ ! তাহার সৌন্দর্য্যের তুলনা এ জগতে নাই !

মহারাণী দূর হইতে ভগিনী সারাকে চিনিতে পারিয়া বলিলেন, “বা! আপনি এখানে!” ভগিনী সারা রাণীকে অভিবাদন করিয়া ধীরে ধীরে তখতে রওয়া অবনত করিলে আমরা অবতরণ করিলাম।

আমি যথাবিধি মহারাণীর সহিত পরিচিতা হইলাম। তাঁহার অমায়িক ব্যবহারে আমি মুগ্ধ হইলাম। আমার যে আশঙ্কা ছিল, তিনি আমাকে কি যেন মনে করিবেন, এখন সে ভয় দূর হইল। তাহার সহিত রাজনীতি সম্বন্ধে বিবিধ প্রসঙ্গ হইল। বাণিজ্য ব্যবসায় সম্বন্ধেও কথা উঠিয়াছিল। তিনি বলিলেন, যে অবাধ বাণিজ্যে তাঁহার আপত্তি নাই; “কিন্তু যে সকল দেশে রমণীবৃন্দ অন্তঃপুরে থাকে অথবা যে সব দেশে নারী কেবল বিবিধ বসন ভূষণে সজ্জিতা হইয়া পুত্তলিকাবৎ জীবন বহন করে,— দেশের কোন কাজ করে না, তাহারা বাণিজ্যের নিমিত্ত নারীস্থানে আসিতে বা আমাদের সহিত কাজ কৰ্ম্ম করিতে অক্ষম। এই কারণে অন্য দেশের সহিত আমাদের বাণিজ্য ব্যবসায় চলিতে পারে না। পুরুষেরা নৈতিক জীবনে অনেকটা হীন বলিয়া আমরা তাহাদের সহিত কোন প্রকার কারবার করিতে ইচ্ছুক নহি। আমরা অপরের জমী-জমার প্রতি লোভ করিয়া দুই দশ বিঘা ভূমির জন্য রক্তপাত করি না ; অথবা এক খণ্ড হীরকের জন্যও যুদ্ধ করি না,— যদ্যপি তাহা কোহেনূর অপেক্ষা শত গুণ শ্রেষ্ঠ হয় ; কিম্বা কাহারও ময়ূর সিংহাসন দর্শনেও হিংসা করি না। আমরা অতল জ্ঞানসাগরে ডুবিয়া রত্ন আহরণ করি। প্রকৃতি মানবের জন্য তাহার অক্ষয় ভাণ্ডারে যে অমূল্য রত্নরাজি সঞ্চয় করিয়া রাখিয়াছে, আমরা তাহাই ভোগ করি। তাহাতেই আমরা সন্তুষ্ট চিত্তে জগদীশ্বরকে ধন্যবাদ দিই।”

মহারাণীর নিকট বিদায় লইয়া আমি সেই সুপ্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় দেখিতে গেলাম, এবং কতিপয় কলকারখানা, রসায়নাগার এবং মানমন্দিরও দেখিলাম।

উপরোক্ত দ্রষ্টব্য স্থানসমূহ পরিদর্শনের পর আমরা পুনরায় সেই বায়ুযানে আরোহণ করিলাম। কিন্তু যেই আমাদের তখতে রওয়া খানি ঈষৎ হেলিয়া ঊর্দ্ধে উঠিতে লাগিল, আমি কি জানি কিরূপে আসনচ্যুত হইলাম, – সেই পতনে আমি চমকিয়া উঠিলাম। চক্ষু খুলিয়া দেখি, আমি তখনও সেই আরাম কেদারায় উপবিষ্টা!

Series Navigation<< বাংলা ক্ল্যাসিক। দ্বিজ কানাইয়ের মহুয়া।বাংলাদেশি ফিকশন: গালিভরের সফরনামা – আবুল মনসুর আহমদ >>
The following two tabs change content below.

বাছবিচার

এডিটর, বাছবিচার।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →