Main menu

সোনালি কাবিনের আগের ও পরের আল মাহমুদ ঠিক কতটা আলাদা?

আল মাহমুদের জন্মদিনে একটা ঘটনা মনে পড়ল।

একটা পোস্টের স্ক্রিনশট দিলাম। (লেখার শেষে আছে।) এই পোস্টটা গত ফেব্রুয়ারি মাসের। আল মাহমুদের তিনটা লাইনরে পোস্টদাতা বলছেন ‘ঘেন্নার প্রতীক’; বা এন্টি সেমেটিক। এরপর আল্লাহর বান্দা বলতেছেন যে, আল মাহমুদের এইসব কবিতা পইড়া ভাবাই মুশকিল যে, উনি ‘সোনালি কাবিন’ নামে একটা বই লেখছিলেন। এখন মজার ঘটনা এই যে, খোদ ওই ‘এন্টি সেমেটিক’ লাইনগুলাই ‘সোনালি কাবিন’ বইয়ের৷

এই আল্লাহর বান্দারা প্রায়ই ‘সোনালি কাবিন’র অত্যুচ্চ প্রশংসা করেন, কয়টা সমাজতান্ত্রিক লাইনের জন্য। ‘সোনালি কাবিন’র আগে আর পরে, এইভাবে ভাগ করেন আল মাহমুদরে। কিন্তু, তাতে কি লাভ হয় কোন? আমার মতে, বিশেষ লাভ হয় না। ‘সোনালি কাবিন’ কাব্যের বা আল মাহমুদের নিজের, কোন একরৈখিক ইডিওলজিতাড়িত কাব্যবিশ্বাস ছিল কি কোনকালে? সন্দেহ হয়।

‘সোনালি কাবিন’র কথাই ধরা যাক। আমার তো মনে হয় মাঝেমধ্যে যে, সমাজতন্ত্র বলি বা ইসলামতন্ত্র, এসব নিয়া আল মাহমুদের মিশ্রচিন্তাটা কেমন ছিল, এই বাঙলাদেশের প্রেক্ষাপটে, তারই সরল ও স্বার্থক চিত্র হইল ‘সোনালি কাবিন’। ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ সম্ভবত বাঙলা ভাষার প্রথম কবিতা, যেখানে একটা পুরা কোরআনের আয়াত ব্যবহৃত হইছে৷ ব্যাপকভাবে পাঠকপ্রিয় এই কবিতাটা ‘সোনালি কাবিন’ বইয়ের। ‘কেবল আমার পদতলে’ কবিতায় দেখি, ‘সদোমের সিংহদরজায় কেবল লুতের মত অনিদ্রায়’ থাকতে চাইছেন এই কবি। ‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছেও আছে এই ধরনের লাইন। সমাজতন্ত্র আর বাঙালির কৌম জাতিবাদরে কাছাকাছি আনতে চাওয়া কবি, এই সনেটগুচ্ছের লাস্ট সনেটে, মানুশের যাপিত জীবনের ধর্মরেও অবলম্বন করছেন নিপুণ স্বরে ও সুরে। এই কবিতায় সরাসরি কোরআনের বাকরীতি ইউজ করছেন তিনি; পাঠকের বোঝার সুবিধার্থে, আমি পুরাটা তুইলা দিলাম:

১৪.
বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।
কথার খেলাপ করে আমি যদি জবান নাপাক
কোনদিন করি তবে হয়ো তুমি বিদ্যুতের ফলা
এ বক্ষ বিদীর্ণ করে নামে যেন তোমার তালাক
নাদানের রোজগারে না উঠিও আমিষের নলা।
রাতের নদীতে ভাসা পানিউড়ী পাখির ছতরে
শিষ্ট ঢেউয়ের পাল যে কিসিমে ভাঙে ছল ছল
আমার চুম্বনরাশি ক্রমাগত তোমার গতরে
ঢেলে দেব চিরদিন মুক্ত করে লজ্জার আগল
এর ব্যতিক্রমে বানু এ মস্তকে নামুক লানৎ
ভাষার শপথ আর প্রেমময় কাব্যের শপথ।

‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছের ১৪-সংখ্যক সনেটটা শব্দ, বাকরীতি ও ম্যাটাফোরের দিক থিকা অন্যান্য সনেটগুলার চাইতে বেশ আলাদা। অন্য সনেটগুলায় ভাষার ক্ষেত্রে গুরু আর চণ্ডালি ভাষার মিকচার; বাঙলার আদি ইতিহাস থিকা উইঠা আসা প্রাকৃত ও আর্য মাইথলজির ব্যবহার, সমাজতন্ত্রের কিছু আলাপ, এইসব আছে। তবে ১৪ সংখ্যক সনেটটা ভিন্ন। এই এক সনেটে একসাথে যতগুলা আরবি-ফারসিজাত শব্দ ব্যবহৃত হইছে, আর কোন সনেটে এরকম হয় নাই। সনেটগুলায় আল মাহমুদ তার প্রেমিকারে কিছু ইউনিক শব্দ ও বিশেষণে সম্বোধন করছেন৷ যেমন: হরিণী, সখি, নারী (সনেট-১); পানোখী, কলাবতী (সনেট-২); হংসিনী, অষ্টাদশী (সনেট-৩); সুন্দরী, বন্য বালিকা, বধূ (সনেট-৪); বালা, শবরী, পক্ষিণী, মেয়ে (সনেট-৫); নারী (সনেট-৬); কাতরা, অবলা, চঞ্চলা (সনেট-৭); সতী, বেহুলা, কন্যা (সনেট-৮); মানিনী, শ্যামাঙ্গী (সনেট-৯); প্রিয়তমা, সাহসিনী, নারী, সুকণ্ঠি (সনেট-১০); মেয়ে, সুশীলা, বিহ্বলা (সনেট-১১); ভদ্রে (সনেট-১২); রুপবতী, দেখনহাসি, মহিয়সী, কন্যা (সনেট-১৩)।

এই ১৩ টা সনেটে প্রেমিকারে ডাকার জন্য ব্যবহৃত বেশিরভাগ বিশেষণই সংস্কৃতজাত; বাকিগুলা প্রাকৃত। হিন্দু মাইথলজিজাত শব্দও আছে; কিন্তু আরবি-ফারসিজাত কোন বিশেষণই, এই ১৩ টা সনেটে, আল মাহমুদ আনেন নাই, তার প্রেমিকারে ডাকার জন্য। বাট, ইন দিস ফোরটিন্থ ওয়ান, আল মাহমুদ প্রেমিকারে ডাকার জন্য দুইটা শব্দ আনছেন, এবং দুইটাই আরবি-ফারসিজাত— বিবি আর বানু [বৃষ্টির দোহাই বিবি….; এর ব্যাতিক্রমে বানু এ মস্তকে নামুক লানত…]। ১৪ নম্বর সনেটের এই শব্দচয়ন ও প্রয়োগের অভিনবত্ব, বাকরীতির ইউনিকনেস এ কথারই সাক্ষ্য দেয় যে, আল মাহমুদ এইটা বেশ ডেলিবারেটলি করছিলেন। কোরআনের বাকরীতিও এই কবিতায় পষ্ট; এবং সেইটারেই আরেকটু পষ্ট করে তুলতেই সম্ভবত, অন্যান্য সনেটের স্বভাব-চরিত্রের বাইরে গিয়া, এই সনেটে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ ও বিশেষণ ইউজ করছেন আল মাহমুদ। সনেটের শেষ লাইনটা পড়লে বোঝা যায়, এই সনেটে নিজের এই প্রকল্পটারে এক ধরনের ঐশ্বরিক বাকরীতিতে অমর করে রাইখা যাইতে চাইছেন উনি।

আল মাহমুদের এই সনেটে কোরআনের বাকরীতি ব্যবহারের স্বীকৃতি দিছেন বিখ্যাত কবি ও সমালোচক, ঢাবির ইংরাজির সাবেক অধ্যাপক খোন্দকার আশরাফ হোসেনও। তিনি লেখেন: ‘কিন্তু তিনি যখন শেষ সনেটে উচ্চারণ করেন: ‘বৃষ্টির দোহাই বিবি…’, তখন তার ভঙ্গিতে অনস্বীকার্যভাবে কোরআনের অনুসৃতি। আল মাহমুদের তাবৎ কবিতায়ই এ রকম অকস্মাৎ প্রচ্ছায়া দেখা যায় তার প্রতিবেশের, যা নিঃসন্দেহে মুসলিম সমাজে তার বেড়ে ওঠার ফল। আল মাহমুদের ভাষার বিশিষ্টতার অন্যতম নিয়ামকও সম্ভবত এটাই।’ (সোনালি কাবিন, নওরোজ সাহিত্য সম্ভার প্রকাশিত, ১৯৮৮; পৃ. ৭২)

যারা বলেন, ‘সোনালি কাবিন’ পর্যন্ত আল মাহমুদ ঠিক ছিলেন, পরে বেঠিক হইছেন ইত্যাদি, তারা মুখস্থ কথা বলেন। আল মাহমুদের কাব্যপ্রবণতা কখনোই সরলরৈখিক ছিল না; কাব্য থেকে কাব্যে, তার যে জার্নি, এর ধারাবাহিকতা ছিল, এবং সেইটা খুবই পষ্ট বোঝা যায়। আব্দুল মান্নান সৈয়দ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ’ থেকে ‘সকল প্রশংসা তার’-এ কীভাবে পৌঁছলেন? কাব্যমূর্খরা এগুলা বুঝবে না। তারা কেবল পার্সোনাল লাইফ ইভেন্টের হিশাবে বইলা দেবে যে, ওনার এই এই বই ভাল, তার পরেরগুলা খারাপ। কিন্তু মূর্খরা যদি পড়াশোনা করত, তাইলে জানত যে, স্যুররিয়ালিজমের সাথে সুফিজমের একটা ঘনিষ্ঠ তাত্ত্বিক যোগাযোগ আছে। এ ব্যাপারে আগ্রহীরা সিরিয়ার কবি এডোনিসের ‘আস সুরিয়ালিয়্যা ওয়াস সুফিয়্যা’ পড়তে পারেন। তো, এই কারণে দেখবেন, মান্নান সৈয়দের ধর্মাশ্রয়ী কবিতাগুলা স্বভাবে রাজনৈতিক না, সুফিবাদী। ধ্যানের মত। আল মাহমুদের তা না। কারণ উনি শুরু থিকাই কম্যুনিস্ট, বিপ্লব ও রাজনীতির প্রতি প্রবলভাবে ঝুঁইকা থাকা লোক৷ তাই তার ধর্মাশ্রয়ী কবিতায়ও রাজনীতি আর বিপ্লবের আভা থাইকা গেছে।

কিন্তু আল মাহমুদ কাব্যচিন্তা, কাব্যভাবনার ধারাবাহিকতা আছে। যেমন আছে মান্নান সৈয়দের। এই ধারাবাহিকতার নিশানি তার প্রথম তিন কাব্য (যেগুলা মাহমুদবিরোধীদের খুব পছন্দ) একটু চোখ মেইলা পড়লেই পষ্ট হবে। আর না পড়লে, এই কুলদা রায়ের মত অবস্থা হবে; ‘সোনালি কাবিন’র কবিতারেই সাম্প্রদায়িক বইলা, আবার বলা লাগবে, ‘বিশ্বাসই হয় না যে, উনি ‘সোনালি কাবিন’র মত বই লিখছিল…আল্লাহ…!’

……………………

কুলাদা রায়ের পোস্টের স্ক্রীণশট:

The following two tabs change content below.
Avatar photo

তুহিন খান

কবি ও অনুবাদক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ বিভাগে অধ্যায়নরত।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →