Main menu

সাঈদীর মামলার রায়: কিছু বিচারিক পর্যবেক্ষণ

[আদালতের সব ইম্পর্টেন্ট জাজমেন্ট নিয়াই সমাজে আলাপ হওয়া দরকার। এই জায়গা থিকা না যে আদালতের বিচার ঠিকই ছিল বা ভুল হইছিল; বরং কোন প্রসেসের ভিতর দিয়া বিচারের ডিসিশানটা তৈরি হইতেছে, অই জায়গাগুলারে খেয়াল না কইরা জুরেসপ্রুডেন্সের জায়গাটারে আমরা তৈরি করতে পারবো না। এই ধরণের পাবলিক আলাপ জুডিশিয়ারি’র জন্য আরো দরকারি ঘটনাই হইতে পারার কথা। – এডিটর, বাছবিচার।]

১.
সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা ২০ টা অভিযোগের ১২ টাই ট্রাইব্যুনালের বিচারে প্রমাণিত হয় নাই। প্রমাণিত ৮ অভিযোগের দুইটাতে সাঈদী বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। এই দুইটা অভিযোগ নিয়াই দীর্ঘদিন তর্ক চলে আদালতে। পরে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাপিলেট ডিভিশনে ৮ টার মধ্যে ৩ টা অপরাধ অপ্রমাণিত সাব্যস্ত হয়; বাকি ৫ টার ৩ টায় যাবজ্জীবন ও ২ টায় বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

সুপ্রিম কোর্টে ৫ বিচারকের বেঞ্চ কিন্তু সর্বসম্মতিক্রমে এই সাজা দেয় নাই। এস কে সিনহা, মো. মোজাম্মেল হোসেন ও হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে তারে যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের ফাঁসির রায় বহাল রাখেন। এস কে সিনহা তার লেখা রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন: <‘…সাঈদীর অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী তাকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করার মতো নয়। এ কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দেয়াই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করছে আদালত।’(জাগো নিউজ২৪.কম, ‘সাঈদীর রায়ের পর্যবেক্ষণ’, ০১ জানুয়ারি, ২০১৬)

অন্যদিকে আবদুল ওয়াহহাব মিয়া তারে বেকসুর খালাস ঘোষণা করেন। মোট ৬১৪ পৃষ্ঠার রায়ের ১৫৪ থেকে ৩৯৬ পৃষ্ঠা পর্যন্ত বেশ দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ পেশ করছেন আবদুল ওয়াহহাব মিয়া।

২.
এই পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই পর্যবেক্ষণে প্রসিকিউশন ও, বিশেষত ডিফেন্স পক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য বিষয়ে ইন ডিটেইল পর্যবেক্ষণ হাজির করেন তিনি। এর কারণ হিশেবে তিনি লেখেন: ‘ঘটনাস্থলে অনুপস্থিত থাকার ব্যাপারে অভিযুক্তর দাবি প্রমাণিত হইল কিনা, তা যাচাই করার জন্য ডিফেন্সের সাক্ষীদের সাক্ষ্য সবিস্তারে আলোচনা করা ছাড়া আমার অন্য কোন বিকল্প নাই। এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ট্রাইব্যুনাল ডিফেন্সের সাক্ষীদের বক্তব্য নিয়া কোন পর্যালোচনাই করে নাই; ‘ঘটনাস্থলে অনুপস্থিতি’র ব্যাপারে তাদের সাক্ষ্য আমলে নেওয়া হয় নাই (এই রায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতেও এই বিষয়টা (অর্থাৎ, ডিফেন্সের সাক্ষীদের সাক্ষ্য পর্যালোচনা না করা) ফুটে উঠছে।’ (সুপ্রিম কোর্টের রায়, পৃ. ১৫৯)

এরপর আবদুল ওয়াহহাব মিয়া উপসংহারে লেখেন: ‘প্রসিকিউশনের কেস ও ডিফেন্সের আর্জি বিবেচনায় নিয়া বলা লাগে যে, অভিযুক্ত ১৯৭১ সালে একজন রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন, এবং ফলে, তার বিরুদ্ধে আনীত মানবতাবিরোধী অপরাধগুলো তিনি করছেন— এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা প্রমাণের দায়িত্ব ছিল প্রসিকিউশনের। কিন্তু প্রসিকিউশন সন্দেহাতীতভাবে এই সত্য প্রমাণে ব্যর্থ হইছে। তাছাড়া ডিফেন্সের তরফে উত্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ, বিশেষত ডকুমেন্টারি এভিডেন্স, এক্সিবিট নাম্বার ‘E’, ‘Q’, ‘R’, ‘V’, ‘X’, ‘Aj’ ও ‘AK’, প্রসিকিউশনের এই দাবির ব্যাপারে স্পষ্টতই যুক্তিগ্রাহ্য সন্দেহ তৈরি করেছে যে, ১৯৭১ সালে অভিযুক্ত রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে অভিযুক্ত অবশ্যই ‘বেনিফিট অব ডাউট’ পাবেন।’ (সুপ্রিম কোর্টের রায়, পৃ. ৩৯৫)

আবদুল ওয়াহহাব মিয়া প্রমাণিত অভিযোগগুলো থেকেও সাঈদীকে বেকসুর খালাস দেন। ফলে, অন্তত এতটুকু বলা যায় যে: সুপ্রিম কোর্টের জাজদের মধ্যে অন্তত একজন, সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে, সাঈদীকে ‘রাজাকার’ মানতে রাজি হন নাই। এখন, ওই ভদ্রলোক কি স্বাধীনতাবিরোধী?

৩.
আব্দুল ওয়াহহাব মিয়ার পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ একারণে না যে, তিনি সাঈদীরে বেকসুর খালাস দিছেন। বরং, আবদুল ওয়াহহাব মিয়া তার রায়ে যেভাবে ইন ডিটেইল উভয়পক্ষের সাক্ষী ও ডকুমেন্টারি এভিডেন্সের তুলনামূলক পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি হাজির করছেন, ট্রাইব্যুনালের রায়, তদন্তের ধরন, রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত তথ্য ইত্যাদি নিয়া যে ইন ডিটেইল আলাপ করছেন, সেটা আর কেউ করে নাই। ট্রাইবুনালের রায় পড়লে আপনার মনে হবে যে, সাঈদীর পক্ষে কোন প্রমাণই বুঝি হাজির করা হয় নাই। অথচ, প্রমাণ হাজির করা হইলেও, এসব নিয়া ওই রায়ে আলাপই করা হয় নাই।

সাঈদী আদৌ রাজাকার ছিলেন কিনা, এ প্রসঙ্গে আব্দুল ওয়াহহাব মিয়া দুই পক্ষের উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত নিয়া ইন ডিটেইল আলাপের পরে বলতেছেন:

‘সাঈদী রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্য হইলে, এবং ১৯৭১ সালে প্রসিকিউশন-কথিত এসব অপরাধ কইরা থাকলে, মুক্তিযুদ্ধের উপরে লেখা প্রামাণ্য বইগুলোর যেকোন একটায় তার নাম অবশ্যই থাকত। অথচ উপরের আলাপে আমরা দেখলাম যে, সেক্টর-৯ এর সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জিয়াউদ্দিন, আয়েশা ফয়েজ, হুমায়ূন আহমেদ, হাসান হাফিজুর রহমান ও পিরোজপুর জেলা পরিষদ কর্তৃক লিখিত, সম্পাদিত ও প্রকাশিত কোন বইতে রাজাকার বা শান্তি কমিটির সদস্য হিশেবে তার নাম আসে নাই।

প্রাসঙ্গিকভাবে এটাও উল্লেখযোগ্য যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় পিরোজপুরে, বিশেষত পারের হাটে ঠিক কী ঘটেছিল, সে ব্যাপারে উল্লেখিত প্রথম তিনজনের লেখা বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল।… মেজর জিয়াউদ্দিন সেক্টর-৯’র সাব-সেক্টর কমান্ডার ছিলেন, পারেরহাট তার কমান্ডের আন্ডারে ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার লেখা বইয়ের কোথাও, রাজাকার বা শান্তি কমিটির মেম্বার হিশাবে অভিযুক্তের নাম আসেনি; পারের হাটে ঘটা কোন ঘটনার সাথেই তারে সম্পৃক্ত করা হয় নি।

…এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যে, রাষ্ট্রপক্ষের ২৮ নং সাক্ষী (তদন্ত কর্মকর্তা) ক্রস-এক্সামিনেশনে স্বীকার করেছেন যে, ১৯৭১ সালে প্রকাশিত কোন পত্রিকায়ই (পত্রিকাগুলার নাম) অভিযুক্তের ভূমিকার ব্যাপারে কোন সংবাদ প্রকাশিত হয় নাই। তিনি আরো স্বীকার করছেন যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট পর্যন্ত, ইত্তেফাকসহ তার জব্দ করা কোন নিউজ পেপারে, অভিযুক্তের ব্যাপারে কোন তথ্যই ছিল না।’ (সুপ্রিম কোর্টের রায়, পৃ. ৩৫৩-৫৫)

৪.
৮ ও ১০ নং অভিযোগে সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এই দুই অভিযোগই বহাল রাখে সুপ্রিম কোর্ট। এবং প্রধানত এই দুই অভিযোগেই তার সাজা হয়।

১০ নং অভিযোগ ছিল বিশাবালি হত্যাকাণ্ড। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলাপ করব না। বিশাবালির ভাই সুখরঞ্জন বালির কেস সবাই জানেন। যে ১৫ জন সাক্ষীর রেকর্ডেড বক্তব্য কোর্টে এভিডেন্স হিশেবে পেশ করার অনুমতি চাওয়া হয়, সুখরঞ্জন তাদের একজন। তাকে ‘পলাতক’ দেখায়ে কোর্টে উপস্থিত করা হয় নাই। পরে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী সুখরঞ্জন আসেন আসামীর পক্ষে সাক্ষী দিতে। তখন, ‘নিউ এজ’র খবর মোতাবেক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তারে কোর্ট চত্তর থেকে তুইলা নিয়া যায়। তারে পাওয়া যায় ভারতের কারাগারে। কারা কর্তৃপক্ষ দাবি করে যে, সন্দেহজনকভাবে সীমান্ত এলাকায় ঘোরাফেরা করায় তারে গ্রেফতার করা হয়। পরে জেল থেকেই একজন জেলরক্ষীর সাহায্যে সুখরঞ্জন তার বক্তব্য রেকর্ড কইরা নিউ এজকে পাঠান। নিউ এজ তাদের রিপোর্টে দাবি করে যে, এই বক্তব্যের রেকর্ড তাদের কাছে আছে। (অমিতাভ ভট্টশালী, ‘নিখোঁজ’ সাক্ষী সুখরঞ্জন বালির নথিপত্রে অপহরণের কথা নেই’, বিবিসি বাংলা, ১৬ মে, ২০১৩)

সুখরঞ্জন মুক্তি পাওয়ার পর ভারত সরকারের কাছে অ্যাসাইলামের আবেদন করছিল, কিন্তু সেটা প্রত্যাখ্যান করা হয়। তারপর আবার সুখরঞ্জন দৃশ্যপটে আসলেন এই সেদিন, সাঈদীর জানাজায়।

শাহবাগের তরফে একটা স্পেকুলেশন আছে এমন যে, সুখরঞ্জনকে জামায়াতই ‘গুম’ করে রাখছিল। কিন্তু এর পক্ষে কোন প্রমাণ নাই। সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্র ও শাহবাগের বিরুদ্ধে গিয়া জামায়াত এই কাজ করতে পারে, সেটাও অবিশ্বাস্য, এমনকি শাহবাগের পক্ষের লোকেদের কাছেও। আরিফ জেবতিক তার সাম্প্রতিক এক লেখায়, লেখায় সেই প্রশ্ন তুলেছেনও:

‘সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যদি জানতোই যে সুখরঞ্জন বালি জামায়াতের হেফাজতে রয়েছে, তাহলে তারা আগেই উদ্ধার না করে আদালতে হুট করে আসার পরপরই অপহরণ করলো কেন, এই যৌক্তিক প্রশ্নের কোনও জবাব কেউ দেবে না।’ (আরিফ জেবতিক, ‘সুখরঞ্জন বালি: যে প্রশ্নের জবাব জানা হবে না’, বাংলা ট্রিবিউন, ১৬ আগস্ট, ২০২৩)

যেহেতু রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রসিকিউশন, পুলিশ ও গোয়েন্দার নজর এড়ায়ে একজন রাজসাক্ষীকে গুম করা জামায়াতের পক্ষে প্রায় অসম্ভব, তাই এই লেখায় জেবতিকের বিজার স্পেকুলেশন হইল, রাষ্ট্রপক্ষ ও জামায়াত মিলেই বালিরে গুম করছিল। সেটারে সত্য মানলেও এই ট্রাইব্যুনাল ও আদালতের মেরিট মারাত্মক প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিন্তু এই প্রশ্নবিদ্ধ ট্রাইব্যুনাল নিয়া কোন আলাপ দেওয়া শাহবাগের সময় প্রায় নিষিদ্ধই ছিল।

৫.
৮ নং অভিযোগ ছিল ইবরাহিম কুট্টি হত্যাকাণ্ড। ইবরাহিম কুট্টি হত্যাকাণ্ডে আসামীপক্ষ ডকুমেন্টারি এভিডেন্স হাজির করে এই মর্মে যে, ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই কুট্টির স্ত্রী মোমতাজ বেগম তার খুনের বিরুদ্ধে একটা এফআইআর করেন। এই এফআইআরের কোথাও সাঈদীর নাম নাই। এমনকি এফআইআরের খুনের বর্ণনা, স্থান ইত্যাদির সাথে রাষ্ট্রপক্ষের বয়ানেরও কোন মিল নাই। ২০০৯ সালে এই খুনের বিরুদ্ধে বাদী মানিক পসারি যে মামলা করেন, তার সাথেও আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের উপস্থাপিত তথ্য ও সাক্ষীর অসামঞ্জস্যতা ছিল লক্ষণীয়।

এই এফআইআরটিকে রাষ্ট্রপক্ষের তরফে ‘ভুয়া’ দাবি করলে, ডিফেন্স আশল কাগজপত্র হাজির করার কথা বলে। কিন্তু প্রসিকিউশন সেটা করতে পারে নাই। এই এফআইআরের ব্যাপারে এসকে সিনহার পর্যবেক্ষণ নিয়াও ভয়াবহ বিতর্ক হয় বিচারকদের প্যানেলে। এসকে সিনহা এই ব্যাপারে তার পর্যবেক্ষণে বলেন: ‘ইব্রাহিম কুট্টি বিষয়ে আসামিপক্ষ যে ফটোকপি দাখিল করছে সেটা ভুয়া, তা সরকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও ওই দলিলটি আমরা সন্দেহাতীতভাবে ভুয়া বলে মনে করি। তবে রাষ্ট্র এটা ভুয়া প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’ (জাগো নিউজ২৪.কম, ‘সাঈদীর রায় : প্রধান বিচারপতির সমালোচনায় বিচারপতি মানিক!’, ১ জানুয়ারি, ২০১৬)

এই বক্তব্যের সেল্ফ কন্ট্রাডিকশন খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। বিচারপতি মানিক এই মর্মে এসকে সিনহার তীব্র সমালোচনাও করেন।

এই মামলায়, আসামী পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য যে একেবারেই আমলে নেওয়া হয় নাই, এ ব্যাপারে আব্দুল ওয়াহহাব মিয়ার পর্যবেক্ষণ নিয়া আগে আলাপ করছি। ইব্রাহীম কুট্টি হত্যাকাণ্ডে আসামী পক্ষের একজন সাক্ষী ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক আকন্দ। ইনি ছিলেন রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী আব্দুল হালিম বাবুলের মামা। আবদুল ওয়াহহাব মিয়ার পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, আব্দুল হালিম বাবুল যখন সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে চাইলেন, তখন তার মা তারে সাঈদীর বিরুদ্ধে ‘মিথ্যা’ সাক্ষ্য দিতে নিষেধ করেন৷ বাবুল কথা না শোনায় উনি বাবুলের বাসা ছাইড়া আরেক ছেলে বাহাদুরের বাসায় চইলা আসেন এবং তার ভাই আব্দুর রাজ্জাক আকন্দরে ট্রাইব্যুনালে সত্য সাক্ষ্য দিতে বলেন। আকন্দ তারপর বাবুলের সাক্ষ্য খণ্ডন করে বলেন যে, একাত্তরে বাবুলের বয়স ছিল ৮/৯ বছর; এবং তার বাড়িতে কোন আগুন বা লুটপাটের ঘটনা ঘটে নাই।

এরপর আকন্দ ইব্রাহীম কুট্টি হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ দেন। বিবরণে দেখা যায় যে, ইব্রাহীম কুট্টি খুন হইছিল নলবুনিয়ায়, যা তার স্ত্রী মোমতাজ বেগমের এফআইআরের তথ্যের সাথে মেলে; কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের দাবির সাথে মেলে না। ইব্রাহীম কুট্টির সাথে উপস্থিত রাজাকারদের সকলের নামও বলেন আকন্দ, এবং সেখানে সাঈদীর উপস্থিতি অস্বীকার করেন। (বিস্তারিত দেখুন: সুপ্রিম কোর্টের রায়, পৃ. ১৬৮-৭০)
সাঈদীর সাজা কমানোর যুক্তি হিশাবেও সুপ্রিম কোর্টের রায়ে কুট্টি হত্যাকাণ্ডের এই আফআইআরের কথা আসছে। পড়েন:

‘সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহা বলেন, ইব্রাহিম কুট্টি বিষয়ে আসামিপক্ষ যে ফটোকপি দাখিল করছে, সটা যে ভুয়া তা রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও ওই দলিলটা আমরা সন্দেহাতীতভাবে ভুয়া বলে মনে করি। তবে রাষ্ট্র এটা ভুয়া প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।…অনেক অপরাধই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যার বেনিফিট অব ডাউট সাঈদী পেতে পারে। সব দিক বিবেচনা করে আমরা মনে করি আমৃত্যু কারাদণ্ডই তার জন্য উপযুক্ত।’ (জাগো নিউজ২৪.কম, ‘সাঈদীর রায়ে প্রসিকিউশনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন!’, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫)

৬.
আবদুল ওয়াহহাব মিয়ার পর্যবেক্ষণ পুরাটা পড়লে দেখা যায় যে, লিগাল আসপেক্টের বাইরে, স্রেফ তদন্তের ক্ষেত্রেও কী পরিমাণ অনিয়ম ও অসততা করা হইছে এই কেসে৷ অন্য কোন রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের হাজির করা সাক্ষ্য বা প্রমাণ নিয়া এত ডিটেইল আর্গুমেন্ট নাই।
মূলত সাঈদীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণে ব্যর্থ হওয়া ও তদন্ত কর্মকর্তাদের নানারকম কেলেঙ্কারিতে জড়ায়ে পড়ার খবর ফাঁস হওয়ার ফলে, এই কেসের মেরিট নিয়া সিরিয়াস প্রশ্ন তখনই উঠছিল। পরে যে সুপ্রিম কোর্ট তার ফাঁসির রায় বদলাইল, সেটা একরকম বাধ্য হয়েই বদলাইছে বলা যায়।

বিচারক ও অ্যাটর্নি জেনারেল তখন সাঈদীর রায় প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত হওয়ার পুরা দায়টা প্রসিকিউশিনের কান্ধে তুইলা দিছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রীতিমত শাসানো হইছে প্রসিকিউটরদের৷ পড়েন:

‘আমরা বেশ কয়েকটি অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তার গাফিলতি লক্ষ করেছি। তদন্ত কর্মকর্তা ইব্রাহিম কুট্টি হত্যার অভিযোগের বিষয়ে মমতাজ বেগমের করা এজাহার সংগ্রহে কার্যকর কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি। একইভাবে প্রসিকিউটরও কোনো পদক্ষেপ নেননি। তিনি (প্রসিকিউটর) কোনো তদন্ত করেননি যে, মমতাজ বেগমের করা ওই এজাহার সত্য কিংবা মিথ্যা। তিনি এ বিষয়ে নিশ্চুপ থেকেছেন।

এটা মনে রাখার দরকার যে, রাষ্ট্র মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সামনে অপরাধীদের মুখোশ উম্মোচন ও সঠিক ইতিহাস লেখার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। রায়ে আরো বলা হয়, আমাদের অভিমত প্রসিকিউটর একজন শিক্ষানবীশ আইন কর্মকর্তার মতো কাজ করেছেন। তার মধ্যে মামলা পরিচালনার যোগ্যতায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তিনি এ মামলাকে উদাসীনতার সঙ্গে করেছেন। দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মামলা পরিচালনা করেননি। চিফ প্রসিকিউটর তখন যথাযথ ব্যবস্থা নেননি।

রায়ে বলা হয়, তিনি (চিফ প্রসিকিউটর) যদি যথাযথভাবে তদারকি না করেন তবে তার এই অফিসে থাকার প্রয়োজন নেই। প্রসিকিউশন অফিস শহীদদের রক্তের সঙ্গে জুয়া খেলতে পারে না। এই মামলার মতো অন্য মামলাও তারা যেভাবে পরিচালনা করেছেন তাতে আমরা মর্মাহত। এটা মনে রাখা দরকার যে এসব মামলার পরিচলানার সঙ্গে জড়িতরা অতিরিক্ত অর্থসহ অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ করেছেন। ভবিষ্যতে তাদের সরকারি কোনো দায়িত্ব দেয়া উচিত না।’ (জাগো নিউজ২৪. কম, ‘সাঈদীর রায়ে প্রসিকিউশনের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন!’, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৫)

আদালতের এই রায়ের পর, রাজনীতিবিদ, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, শাহবাগ— সবার ক্ষোভ গিয়া পড়ে প্রসিকিউটরদের উপর।

‘প্রসিকিউটরদের গাফিলতি ও অদক্ষতায়ই সাঈদীর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ প্রমাণ করা যায় নাই’— এমন একটা ন্যারেটিভ সামনে আসে৷ মূলত এর মাধ্যমে জামায়াতের সাথে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটরদের আঁতাতের দিকে ইঙ্গিত করা হয়। অর্থাৎ, আদালয়ে সাঈদী যে এনাফ দোষী প্রমাণিত হইলেন না, এইটা যেনবা জামায়াতের সাথে রাষ্ট্রপক্ষের আঁতাতেরই ফল।

যদি এই দাবি সত্য ধইরাও নিই, তাইলেও এটা প্রমাণ হয় যে, মারাত্মক সব অনিয়ম, অবহেলা, ত্রুটি ও বিতর্কের মধ্যেই এই মামলার বিচার হইছে, যেখানে রাষ্ট্রপক্ষ বিভিন্ন বিষয়ে প্রমাণ হাজির না কইরা চুপ থাকছে, সাক্ষী গুম ও খুনের ঘটনাও ঘটছে। আর এসব সত্ত্বেও, অভিযোগ আনডাউটেডলি প্রুভড না হওয়ার পরেও সাঈদীরে সাজা দেওয়া হইছে। অথচ এই পুরা প্রসেস নিয়া আমাদের কেবল এইটুক আলাপের অনুমতি ছিল যে, এগুলার সব দোষ, পুরা দায়, জামায়াতের। সর্বোচ্চ প্রসিকিউটরদের, যারা জামায়াতের সাথে আঁতাত করছে। আ. লীগ বা ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তোলার মওকা, বা বিচারপ্রক্রিয়া নিয়া কিছু বলার সুযোগ, এরপরেও শাহবাগ দেয় নাই কাউরে।

৭.
২০১৩ সালেই, আফজাল গুরুর ফাঁসি হইছিল ভারতের তিহার জেলে। আফজাল গুরুর বিচার ও ফাঁসির প্রক্রিয়া নিয়া তখন মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় ভারতে ও সারা বিশ্বে। বুদ্ধিজীবীরা আলাপ করেন, বাম সংগঠনগুলা আন্দোলন করে এই ফাঁসির বিরুদ্ধে। অরুন্ধতী রায়ের সম্পাদনায় পরে একটা বই বের হয়: The Hanging of Afzal Guru and the Strange Case of the Attack on the Indian Parliament. এই বইতে গুরুর অপরাধ, বিচার, সাজা, ফাঁসি ইত্যাদি নিয়া বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ইন ডিটেইল আলাপসহ দুর্দান্ত সব প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন একঝাঁক মানবাধিকারকর্মী, বুদ্ধিজীবী ও অ্যাকাডেমিশিয়ান। সাঈদীর মামলার রায় নিয়াও আজ হোক বা কাল, এ ধরনের কাজ হওয়া উচিত।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চাইতে গিয়া জাতিবাদী উন্মাদনার গর্ভে যে আরেকপ্রস্ত জুলুম, আরেকদফা অপরাধ জন্ম নিতেছিল বহুকাল যাবত, সাঈদীর এই ট্রায়াল ছিল তার পিক মোমেন্ট। বাঙালি জাতিবাদী কল্পনায় ‘একাত্তরের ইনসাফ’ ধারণার বিপরীতে, একটা জ্বলজ্বলে প্রশ্নবোধক হিশাবে থাইকা যাবে সাঈদীর মামলার বিচারপ্রক্রিয়া।

/অগাস্ট ১৭, ২০২৩

The following two tabs change content below.
Avatar photo

তুহিন খান

কবি ও অনুবাদক, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ বিভাগে অধ্যায়নরত।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →