Main menu

কবিতা আর বিশ্বাস নিয়া একটা নোট – টি. এস. এলিয়ট

দ্য ক্রাইটেরিয়ন পত্রিকার ১৯২৫ এর জুলাইয়ের সংখ্যায় আইভোর আর্মস্ট্রং রিচার্ডসের একটা জোস এসে বাইর হইসিলো। আমার কিসমত, উনি ওই এসেতে যেই থিওরি নিয়া কাজ করতেসিলেন ওইটা ব্যাখ্যা করতে আমার একটা কবিতা কাজে লাগাইসিলেন। ওইখানে ফুটনোটে তিনি একটা অবজারভেশন দিসিলেন যে, “এই অথর নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর তার কবিতারে পুরাপুরি আলাদা করতে পারসেন, তাও আবার কবিতাটারে দুর্বল না কইরা। ফলে এতদিন যা স্রেফ একটা দূরবর্তী সম্ভাবনা ছিল, উনি ওইটারে বাস্তবে করতে পারসেন।” এই ফুটনোটটা উনি নিচের এই বাক্যটা বুঝাইতে গিয়া লিখসেনঃ

“একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ, অনিশ্চয়তা, মিনিংলেসনেস, সব ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষারে ভিত্তিহীন মনে হওয়া, যেকোনো উদ্যোগ বা প্রচেষ্টারে ফালতু লাগা, আর জীবনদেনেওয়ালা পানির প্রতি তৃষ্ণা যা হুট কইরাই ব্যর্থ হয়, এইসবই হইলো আমাদের জীবনটারে রিঅর্গানাইজ করার তাগিদ।”

আমি একদমই এইটা মনে করি না যে একজন অথর তার নিজের লেখার গভীর অর্থ ব্যাখ্যা করতে কোনো ট্রেনিংপ্রাপ্ত, বোধসম্পন্ন, আর অন্তত সমান ইন্টেলিজেন্সওয়ালা কোনো লোকের চাইতে বেশি কোয়ালিফাইড। যেই কবিতা নিয়া আলাপ করা হইসে, ওইটা আমার লেখা বইলা তার ব্যাখ্যার বেলায় আমি রিচার্ডস সাবের উপরে কোনো জোর খাটাইতেসি না। তার মতামত আমার কাছে খুবই ইন্টেরেস্টিং লাগসে, তা কেবল আমার কবিতার উপর প্রয়োগ করা হইসে বইলাই না; আর আমার মনে হইতেসে সে আমার কবিতার বদলে অন্য কোনো ব্যাটার কবিতা ইউজ করলেই ভালো হইতো, কারণ তাইলে আমি আরেকটু ফ্রিলি ব্যাপারটা নিয়া আলাপ করতে পারতাম। কারণ এই প্রশ্নটা নতুন আর ইম্পর্ট্যান্ট আর খুউউউবই ইন্টেরেস্টিং।

কিন্তু, কবিতায় কবির ব্যক্তিগত বিশ্বাস ক্লিয়ারলি বোঝা না গেলেও, কবির নিজের বিশ্বাস হইতে কবিতা কদ্দূর আর আলাদা হইতে পারে? পরে মিস্টার রিচার্ডসের সাথে আলাপ কইরা জানতে পারসি যে উনি হিউম্যান মাইন্ডের এমন উন্নতি কল্পনা করেন যেইখানে সেন্সিবিলিটি আর ইন্টেলেক্ট আলাদা হইয়া থাকবে, আর ওইখানে ‘বিশ্বাস’ মানে হবে কেবল সমর্থনযোগ্য সাইন্টিফিক হাইপোথিসিসের প্রতি শর্তাধীন সম্মতি, আর যেইখানে একটা নির্দিষ্ট সময়ে যেইটারে সত্য বইলা মনে হয় সেইটা দিয়া আমাদের সেন্স প্রভাবিত হবে না। তবে একটা পয়েন্টে আমরা দুইজনই এগ্রি করসিলাম, সেইটা হইলো এইঃ সাহিত্যের ইতিহাসে কোনো নির্দিষ্ট সময়ে যা কিছুরে সত্য বা বাস্তব মাইনা নিতে হইতো সেইটা দিয়া সেইসময়কার মানুষের ফিলিংস আর ইমোশন সবসময়ই প্রভাবিত, আর এমনকি নষ্টও হইয়া আসছে। মিস্টার রিচার্ডসের ভিউ হইসে, যার কিছুটা উপরের ওই প্রবন্ধেও উনি বলসেন, যে এখন সাইন্সের একটা জামানা ধীরে ধীরে আগাইয়া আসতেসে। এবং এর ফলে পোয়েট্রির নারিশমেন্টের জায়গা খুম কইমা যাবে। তো এই জামানায় কাব্যবোধ যদি টিক্যা থাকতে চায় (তা সম্ভব কিনা সেই বিষয়ে উনি ডাউটফুল) তাইলে তারে নিজেরে টিকাইয়া রাখতে হবে কোনো বিশ্বাস না, বরং নাথিং-এর মধ্য দিয়া।

পোস্টার ডিজাইন: ক্রো-হাউজ

রিচার্ডস সাবের সাথে আমার দ্বিমত যেই পয়েন্টে তা হইলো এইঃ রিচার্ডস সাব সম্ভবত হাল্কা ম্যাথিউ আর্নোল্ডসের আবেগী প্রভাবের আন্ডারে রইসেন, যারে তিনি আর্টিকেলটার শুরুতে কোটও করসেন। ওনার কথা শুনলে মনে হয় পুরা দুনিয়া একটা সার্টেন টাইম পর্যন্ত, ধরা যাক ষাইট বছর আগেও ধর্মবিশ্বাসের ঘোরে ঝিমাইয়া ছিল, আর এখন হুট কইরা তার ঝিমুনি ভাইঙ্গা গেসে (সম্ভবত ওনার ওই সাইন্সের স্নোবলের ঠুয়া খাইয়া) আর এখন সে উইঠা দেখতেসে যে আশেপাশের আবহাওয়াই পুরা বদলাইয়া গেসে। তার কথামত মনে হয়, দুনিয়ার মানুষজন আজীবন একই জিনিস একইভাবে বিশ্বাস কইরা আসছে। (আমি জানি আমি ওনার চিন্তাটারে নিয়া হাল্কা মশকরা করতেসি, কিন্তু তবু উনি যা বুঝাইতে চাইসেন আমি তাই বলতেসি।) কিন্তু আমি মোটামুটি শিওর – স্রেফ কবিতার ইতিহাসের উপর আমার পড়াশুনার উপর ভিত্তি কইরাই – আর খ্রিষ্টান ধর্মের ইতিহাস দেখলেও এইটাই মনে হবে যে – সভ্যতার শুরু হইতেই বিশ্বাস নিজেই সবসময় একটা কনস্ট্যান্ট মিউটেশনের মধ্য দিয়া গেসে। (যেইটারে কোনোভাবেই সব ক্ষেত্রে উন্নতি বলা যায় না।) যদি স্রেফ খ্রিষ্টানধর্মের মধ্যেই লিমিটেড থাকি, তাইলেও দেখা যায় ধর্মীয় কবিতা ১৩ শতকে, ১৭ শতকে, আবার ১৯ শতকেও লেখা হইসে। কিন্তু তাই বইলা এমন বলাটা খুব হাস্যকর হবে যে ক্রিস্টিনা রোজেটির ধর্মবিশ্বাস ক্র‍্যাশ’র মতন শক্তপোক্ত ছিল না, বা ক্র‍্যাশ’র বিশ্বাস দান্তের মত ছিল না। এবং এই তিনজনই একই জিনিস বিশ্বাস করতেন, এবং তারা তা প্রায় একই শব্দ দিয়া লিখসেন। তবুও তারা তিনজন একজন আরেকজন থিকা অতটাই আলাদা যতটা তারা আমার চাইতে আলাদা।

আর আমার নিজের কবিতাটা নিয়া উনি যা বলসেন, অন্তত আমি এইটাতে “বিশ্বাস হইতে পুরাপুরি আলাদা হইয়া যাওয়ার” কোনো আলামত দেখতে পাই না। অন্তত এইটা দান্তে হইতে ক্রিস্টিনা রোজেটির আলাদা হইয়া যাওয়ার চাইতে কমপ্লিট কিছুনা। আর ওই “একটা বিচ্ছিন্নতাবোধ,” এইসব হ্যানত্যান (যদি তা আসলেই থাইকা থাকে) মোটেই বিশ্বাস হইতে আলাদা হইয়া যাওয়ার কোনো ঘটনা না। বরংচ, ডাউট, অনিশ্চয়তা, মিনিংলেসনেস এইগুলা সব ওনার মতের উল্টাদিকেই গিয়া দাঁড়ায়; কারণ ডাউট আর অনিশ্চয়তা মূলত বিশ্বাসেরই ভ্যারাইটি।

আর আমি জানিনা এই আলাপে আমার কবিতা দিয়া আদৌ কিছু প্রমাণিত হয় কিনা, আর আমার নিজেরও উচিৎ হবে না তার উপর ভিত্তি কইরা নিজের স্টেটমেন্ট প্রমাণ করতে যাওয়া। কিন্তু আমার মনে হয় না কবিতারে কখনোই আমরা যেইটারে বিশ্বাস বলি তা হইতে পুরাপুরি আলাদা করা যাবে। আর এইটারে বিশ্বাস ছাড়া অন্যকিছু বলার কারণও দেখিনা, যদি না এমনিই হুদাকামে আমরা সব শব্দই ওলটপালট কইরা ফেলি। আর এইটা আলাদা কইরা বলার কিছু নাই যে সেই বিশ্বাস খ্রিষ্টধর্মের বিশ্বাসই হবে তা না, যদিও সেইটার সম্ভাবনাও রইসে, কারণ যেহেতু খ্রিষ্টানধর্ম তখনও নিজেরে মোডিফাই কইরা বিশ্বাসযোগ্য হইয়া উঠতে থাকবে, যেমনটা সে অতীতেও করসে (আমি কনশাস মোডিফিকেশনের কথা বলতেসি না যেমন মডার্নিজম, ইত্যাদি, এইসবের সবসময়ই একটা উলটা এফেক্ট থাকে)।

বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস কিংবা ডাউটের অনেক তলায় থাকে। কোনোকিছু বিশ্বাস করতে হইলে প্রচুর ডেডিকেশন, আর একপ্রকার জিনিয়াসেরও দরকার হয়। আর আমার মনে হয় সময় যত আগাইতে থাকবে, কোনোকিছুতে বিশ্বাস করা ততই কঠিন হইতে থাকবে (এইখানে আমি স্রেফ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করার কথা বলতেসি না।) কিন্তু আমাদের সবসময়ই বলা হয় জীবন সময়ের সাথে সাথে কত জটিল হইয়া যাইতেসে – টেলিফোন, ওয়ায়ারলেস, এ্যারোপ্লেন আরো ফিউচার ইনভেনশনগুলা সব আমাগো নার্ভরে যথেষ্ট প্যারার মধ্যে রাখে। আর জীবনের এইসব জটিলতার মতই বিশ্বাসের জটিলতার সাথেও আমাদের মোকাবেলা করতে হইতেসে। ইন ফ্যাক্ট, আমরা সেই গ্রেট জিনিয়াসের অপেক্ষায় বইসা রইসি (যেমন মিস্টার রিচার্ডস অপেক্ষায় রইসেন ভবিষ্যতের কবি’র), যে চরম দাপটের সাথে কোনোকিছুতে বিশ্বাস করতে পারবে। আর আমরা যারা জনসাধারণের চাইতে একটু উপরে আছি, কিন্তু ওইসব গ্রেট মানুষদের নিচেই রইয়া গেসি, তাদের জন্য আছে কেবল ডাউট। আর এই ডাউট নিয়াই আমরা পরজীবীর মতোন বাঁইচা আছি (যা কিনা না বাঁচার চাইতে অন্তত ভালো) অতীতের জিনিয়াসদের মাইন্ডে যারা কোনোকিছু বিশ্বাস করতে সক্ষম হইসিলেন।

… … …

বইটা কিনতে পারবেন এই লিংকে:
(1) ইন্টারভিউ সিরিজ এবং বাছবিচার ও প্রিন্ট পোয়েট্রি’র বই – Posts | Facebook

The following two tabs change content below.
Avatar photo

মাহীন হক

মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →