Main menu

গরিব যেমনে মরে – জর্জ অরওয়েল

১৯২৯ সালে আমি প্যারিসের ১৫ সাব-ডিভিশনের এক্স হাসপাতালে কয়েক সপ্তাহ ছিলাম। রিসেপশন ডেস্কে আমার সেইখানকার কেরানিদের কাছে সবসময়ের মত বহু প্রশ্নের উত্তর দিতে হইল, এবং ঢুকতে দেয়ার আগে প্রায় বিশ মিনিট আমারে সেইখানে দাঁড় করায়ে রাখা হইসিল। আপনি যদি কখনো কোনো ল্যাটিন দেশে কোনোপ্রকার ফর্ম ফিলাপ কইরা থাকেন, তাইলে হয়তো প্রশ্নগুলার ধরণ আপনি বুঝবেন। বেশ আগে থেকেই আমার রেউমুর (তাপমাত্রার পরিমাপ) থেকে ফারেনহাইটের হিসাব করতে সমস্যা হয়, তবু আমি জানি যে আমার গায়ের তাপমাত্রা তখন ১০৩ এর মত ছিল, এবং ওই কড়া জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হইতে হইতে আমার জন্য দাঁড়ায়ে থাকাটাও কঠিন হয়া পড়সিল। আমার পিছনে অপেক্ষা করতেসিল রোগীদের বিশাল সারি, হাতে রঙিন রুমাল। তারাও তাদের ইন্টেরোগেশনের পালার অপেক্ষা করতেসিল।

ইন্টেরোগেশনের পরেই গোসল – যারা নতুন আসে তাদের এইটা করতেই হয়, অনেকটা কোনো কারখানা বা জেলখানার মত। আমার কাছ থেকে আমার জামাকাপড় নিয়া যাওয়া হয়। কাঁপতে কাঁপতে কয়েক মিনিট পাঁচ ইঞ্চির মত গরম পানির উপর দাঁড়ায়ে থাকার পরে আমারে একটা লিনেনের নাইটশার্ট আর ফ্ল্যানেলের গাউন দেয়া হয়। আমার পায়ের সাইজের কোনো স্লিপার নাকি তারা পান নাই, তাই ওই অবস্থায়ই আমারে বাইরে নিয়া যাওয়া হয়। ওইটা ছিল ফেব্রুয়ারির এক রাত, আর আমার তখন নিউমোনিয়া। যেই ওয়ার্ডের কাছে আমরা যাইতেসিলাম সেইটা প্রায় ২০০ গজ দূরে ছিল, এবং হাসপাতালের পুরা গ্রাউন্ড পার হইয়া ওইখানে যাওয়া লাগতেসিল। পাথুরে পথটা ঠাণ্ডায় জইমা ছিল, আর বাতাসে ফ্ল্যানেলের নাইটশার্টটা আমার উদাম উরুর উপরে ঝাপ্টাইতেসিল। ওয়ার্ডরুমে পৌছানোর পর আমার কেমন যেন একটা চেনা-চেনা অনুভূতি হইতেসিল যেইটার সোর্স আরো রাত হওয়ার আগে আমি ধরতে পারি নাই। রুমটা বেশ লম্বা, নিচু আর অন্ধকার-অন্ধকার ছিল। সেইখানে ফিসফিস শব্দ শোনা যাইতেসিল সবসময়, আর তিনটা বিছানা একটা আরেকটার খুবই কাছাকাছি ঠাসা ছিল। একটা বিচ্ছিরি, পায়খানা-টাইপ আবার মিষ্টি-মিষ্টি গন্ধ আসতেসিল। আমি শুইয়া পড়তেই দেখি আমার উল্টাপাশের বিছানায় একজন ছোটখাটো, গোল কাধ আর খসখসে চুলওয়ালা একজন লোক আধল্যাংটা হয়ে বইসা আছে আর একজন ডাক্তার আর তার ছাত্র লোকটার উপর অদ্ভূত কোনো অপারেশন চালাইতেসে। ডাক্তারটা প্রথমেই তার কালো ব্যাগ থেকে প্রায় ডজনখানেক ছোট ছোট ওয়াইনের গ্লাসের মত গ্লাস বাইর করলো, আর ছাত্রটা ম্যাচ জ্বালায়ে সব বাতাস বাইর কইরা নিল। এরপর রোগী লোকটার পিঠে বা বুকে গ্লাসগুলা চাইপা ধইরা রাখার পর ভ্যাকিউমের মাধ্যমে রক্ত জমাট বাইধা আসলো। কিছুক্ষণ পর আমি টের পাইলাম ওনারা কী করতেসে। ওইটারে বলা হয় কাপিং। এই চিকিৎসার কথা পুরানা ডাক্তারি বইতে পাওয়া যায়, কিন্তু এতদিন আমি ভাইবা আসছি এই অপারেশন কেবল ঘোড়ার উপরই চালানো হয়।

বাইরের ঠাণ্ডা বাতাসে আমার গায়ের তাপমাত্রা মনে হয় কইমা আসছিল, আর এই জঘন্য চিকিৎসার কায়দাটা আমি মানসিকভাবে একটু দূর থেকে আর এমনকি খানিকটা মজা নিয়াই দেখতেসিলাম। কিন্তু তার পরপরই ডাক্তার আর তার ছাত্র আমার বিছানার দিকে আগাইলো। হ্যাচকা টানে আমারে সোজা কইরা বসাইয়া একইভাবে সেম গ্লাসগুলা কোনোভাবে না ধুইয়া-টুইয়াই আমার গায়ে বসানো শুরু করলো। হাল্কা একটু প্রতিবাদ আমি করসিলাম, কিন্তু তা কোনো জানোয়ারের ডাকের চাইতে বেশি আমলে নিলো না তারা। যেইভাবে তারা আমার উপরও একই কায়দায় সেই চিকিৎসা শুরু করলো তা দেইখা বেশ ইম্প্রেসডই হইলাম। এর আগে আমি কখনো কোনো হাসপাতালের পাবলিক ওয়ার্ডে থাকি নাই, তাই ডাক্তারদের এইভাবে রোগীর সাথে কথাও না বলা, বা মানুষ হিসেবে রোগীদের নোটিসই না করার ব্যাপারটা আমি এর আগে কখনো দেখি নাই। আমার উপরে তারা ছয়টা গ্লাস লাগাইলো, তারপর রক্তের জমাট বাঁধা জায়গায় গ্লাসগুলা আবার লাগাইলো। প্রতিটা গ্লাসে প্রায় এক চামচ কইরা কালো রক্ত উইঠা আসলো। আমার সাথে যা করা হইল তার কথা ভাইবা প্রচণ্ড ঘিন্না, ভয় আর অপমানে আমি শুইয়া পড়লাম আর ভাবলাম এখন অন্তত তারা আমারে ছাইড়া দিবে। কিন্তু না, একদমই না। আরো একটা ইলাজ বাকি ছিল: গায়ে সরিষাবাটা লাগানো। এইটা ওই গরম পানি দিয়া গোসলের মতই রেগুলার জিনিস ছিল। দুইজন নোংরা মতন নার্স আগে থিকাই সরিষাবাটা রেডি কইরা রাখসিলেন, এরপর তারা সেইটা স্ট্রেইটজ্যাকেটের মত আমার গায়ে মাখাইয়া দিলেন। ওদিকে ট্রাউজার আর শার্ট পইরা ওয়ার্ডে ঘুরঘুর করতে থাকা কতগুলা লোক আমার কাছে আইসা জটলা পাকাইয়া আধা-দরদের সাথে ভ্যাটকাইতে থাকলো। পরে আমি জানসিলাম সে অন্য কোনো রোগীর গায়ে সরিষাবাটা মাখাইতে দেখা এই ওয়ার্ডের এন্টারটেইনমেন্টের অন্যতম উৎস। প্রায় পোনে এক ঘণ্টা এগুলা মাখায়া রাইখা দেয়া হয়, আর বাইরের লোকের কাছে এইটা ফানি লাগাটাই স্বাভাবিক। প্রথম পাঁচ মিনিটে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, কিন্তু তাও মনে ভরসা থাকে যে সইয়া ফেলা যাবে। পরের পাঁচ মিনিটে সেই ভরসাও উইবা যায়। আর সরিষাবাটার কাপড়টা বেল্ট দিয়া বাইন্ধা রাখা হয়, কোনোভাবেই খোলা যায় না। এইটাই দর্শকরা সবচাইতে মজা নিয়া দেখে। শেষের পাঁচ মিনিটে, আমি খেয়াল করলাম, একপ্রকার অবশ হইয়া আসে সব। তারপর সরিষাবাটা গা থিকা উঠায়া ফেলার পর আমার মাথার নিচে বরফ-ভরা একটা ওয়াটারপ্রুফ বালিশ দিয়া আমারে একলা রাইখা সবাই চইলা গেল। কিন্তু আমি ঘুমাইলাম না। এবং আমার জানামতে, এইটাই আমার জীবনের একমাত্র রাত—মানে যেই রাতে আমি বিছানায় ছিলাম—কিন্তু একটুও ঘুমাইতে পারি নাই, এক মিনিটের জন্যেও না।

হাসপাতাল এক্স-এ আমার পয়লা ঘণ্টার মধ্যেই আমি নানানরকম কন্ট্রাডিক্টোরি চিকিৎসার মুখোমুখি হইসিলাম। তবে এইটাও সত্য না, কারণ এইখানে আসলে চিকিৎসাই পাওয়া যায় না, ভালো-খারাপ কোনোটাই না, যদি না আপনার কোনো ইউনিক আর ইন্টেরেস্টিং রোগ থাইকা থাকে। ভোর পাঁচটার দিকে নার্সরা আইসা রোগীদের ঘুম ভাঙ্গাইয়া টেম্পারেচার চেক করলো, কিন্তু গা ধোয়ায়ে দিলো না। যদি নিজেরে নিজে ধোয়ানোর মত সুস্থ থাকেন তো ভালো, নাইলে আপনার ডিপেন্ড করা লাগবে আশেপাশের কোনো রোগীর করুণার উপর। আবার রোগীরা নিজেরাই বেড বোতল আর বেডপ্যান মজুদ রাখতো, ডাকতো লা ক্যাসেরোল। সকাল আটটার সময় সকালের নাশতা দিতো, আর্মি স্টাইলে তার নাম ছিল লা স্যুপে। স্যুপটা ছিল একটা পাতলা সব্জির ঝোলের উপর ভাসতে থাকা লোদলোদে রুটির টুকরা। আরেকটু বেলা হইলে পর সেই লম্বা, গম্ভীর, কালা দাড়িওয়ালা ডাক্তার আর তার ইন্টার্ন ও ছাত্ররা ওয়ার্ডে একবার টহল দিয়া যাইত। আমাদের ওয়ার্ডে প্রায় ষাটজনের মত মানুষ ছিল আর দেইখাই বুঝা যাইত তার আরো অন্যান্য ওয়ার্ডও দেখতে যাইতে হবে। প্রতিদিনই ব্যথায় কোহাইতে থাকা, কানতে থাকা অনেক বিছানার পাশ দিয়া সে নির্বিকার হাঁইটা যাইত। তবে কোনো রোগীর যদি এমন রোগ থাকতো যেইটার সাথে ছাত্রদের পরিচয় করায়ে দেয়া দরকার, তাইলে সে ভালোই এটেনশন পাইত। যেমন আমার শ্বাসনালীতে সমস্যা থাকার কারণে একেকদিন ডজনখানেক পোলাপানও আমারে ঘিরা থাকতো আমার বুকে কান পাতার জন্য। এই অভিজ্ঞতাটা খুবই অদ্ভূত। অদ্ভূত এই সেন্সে যে, একইসাথে ডাক্তারি শেখার প্রতি তাদের তুমুল আগ্রহ, ওদিকে তাদের রোগীটা যে একজন মানুষ সেইটা আমলেই না নেয়া। ব্যাপারটা রিলেট করতে পারা কঠিন, কিন্তু একেক সময় কোনো ছাত্র যখন শোনার জন্য আগাইয়া আসতো সে এক্সাইটমেন্টে কাঁপতে থাকতো, অনেকটা নতুন চকচকে কোনো মেশিন হাতে পাওয়ার পর পোলাপান যেমনে এক্সাইটেড হইয়া থাকে। আর তারপর কানের পর কান — জুয়ান ছেলেদের, মেয়েদের, নিগ্রোদের কান — আমার পিঠের উপর ঠেকানো, আঙুলের পর আঙুল বারবার আমার শরীরের উপর ঠকঠক, অথচ কখনো একজনও আমার সাথে একটা কথা বলে নাই বা সোজাসুজি মুখের দিকে তাকায়ও নাই। যেহেতু আমি সেইখানে মাগ্নায় থাকতেসিলাম, ফলে মেইনলি আমি ছিলাম ছাত্রদের জন্য একটা নমুনা। ব্যাপারটা যে আমি ঘৃণা করতাম তা না, কিন্তু কখনো অভ্যস্ত হইয়া উঠতেও পারি নাই।

কিছুদিন পর আমার স্বাস্থ্য একটু ফিরলে পর আমি উইঠা বইসা আশেপাশের রোগীদের অবস্থা খেয়াল করলাম। এই ঘিঞ্জি রুমের একেকটা বিছানা এত কাছাকাছি ঠাসা যে চাইলেই পাশেরজনের গায়ে হাত রাখা যায়, আর আল্লাহর দুনিয়ার সমস্ত ছোঁয়াচে রোগও এইখানে। আমার ডানপাশের বিছানার লোকটা ছিল একজন ছোট লালচুলা মুচি যার এক পা আরেক পায়ের চেয়ে ছোট। কোনো রোগী মারা গেলে (এমনটা প্রায়ই হইত, আর হইলে আমার পাশেরজনই খবরটা সবার আগে পাইত) সে-ই সবার আগে জানান দিতো। শিস বাজায়ে, মাথার উপর হাত উঁচায়ে সে বলতো “ন্যুমেরো ৪৩” (বা যেই সংখ্যাই হোক।) এই লোকের অবস্থা তাও অত খারাপ ছিল না। কিন্তু আশেপাশের বেশিরভাগ বিছানায় ভয়াবহ সব ট্র‍্যাজেডি আর স্রেফ হরর ঘটনা ঘটতে দেখা যাইত। যেই বিছানাটা আমার পা বরাবর ছিল, মইরা যাওয়ার আগ পর্যন্ত (আমি তারে মরতে দেখি নাই — ওরা তারে আরেক বিছানায় সরায়ে নিসিলো) সেইখানে ছোট শুকনা একটা লোক, আমি জানিনা তার রোগটা ঠিক কী ছিল, কিন্তু তার পুরা শরীর এতটা সেন্সিটিভ হইয়া গেসিল যে বিন্দুমাত্র নড়াচড়ায়, এমনকি তার নিজের গায়ের জামার ভারের চোটেও সে ব্যথায় চিল্লাইয়া উঠতো।

তার সবচেয়ে বিচ্ছিরি দশা হইত পেশাব করার সময়। একজন নার্স একটা বেড বটল আইনা তার পাশে অনেকক্ষণ দাঁড়ায়ে থাইকা শিস বাজাইতো, যেরকমটা জামাইদের করতে বলা হয় ঘোড়াদের সাথে। অবশেষে সে ‘জে ফিসেল’ বইলা ব্যথায় জোরে চিৎকার দেয়ার পর পেশাব করা শুরু করতো। তার পাশের বিছানাতেই ছিল সেই খসখসে চুলওয়ালা লোকটা যার সাথে কাপিং করা হইসিল। সারাদিন সে কাশতো আর তার সর্দির সাথে রক্ত বের হইতে থাকতো। আমার বাম পাশেরজন ছিল একজন লম্বা, ঢোলা চামড়ার জুয়ান ছেলে যার পিঠে কয়দিন পরপর একটা পাইপ ঢুকাইয়া শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণে ফেনা-ফেনা তরল বাইর করা হইতো। তার একটু পরের এক বিছানায় ১৮৭০ এর যুদ্ধের একজন সারভাইভর ছিলেন মরার অপেক্ষায়। লোকটা বেশ হ্যান্ডসামই ছিল, তার ছিল একটা হোয়াইট ইম্পেরিয়াল। যখনই ভিজিটিং এলাউ করা হইত, তার পাশে চারজন মহিলা পুরা কালো জামা পইরা অবিকল কাকেদের মত বইসা থাকতো। আমার উল্টাপাশের আরেক সারির এক বিছানায় ছিল এক টাকলা বুড়া লোক। তার মোছ ছিল ঝুইলা পড়া, মুখ আর শরীর ছিল ফোলা-ফোলা। কোনোএক রোগের কারণে সে প্রায় সারাক্ষণই পেশাব করতে থাকতো। একটা বিশাল কাচের পাত্র সবসময় তার বিছানার পাশে রাখা থাকতো। একদিন তার বউ আর মেয়ে তারে দেখতে আসছিল। এই দুইজনরে দেইখা বুড়া লোকটার ফোলা মুখে কেমন মিষ্টি একটা হাসি ঝলকায়া উঠলো। তার মেয়ের বয়স বছর বিশেক হবে, সে দেখতেও ছিল বেশ মিষ্টি। মেয়েটা তার কাছে আগায়ে গেলে আমি দেখলাম লোকটা ধীরে ধীরে তার হাতটা উঠাইতেসে। আমি অনেকটা টের পাইলাম এরপরে কী হবে—মেয়েটা হাটুতে ভর দিয়া বইসা থাকবে পাশে, বুড়া লোকটার হাত মরার আগে শেষবারের মত দোয়া কইরা মেয়েটার মাথায় রাখবে। কিন্তু না, সে স্রেফ মেয়েটার হাতে নিজের বেড বটলটা ধরায়া দিলো, আর মেয়েটা ওইটা ওই পাত্রটার মধ্যে খালি কইরা আনলো।

আমার চাইতে প্রায় ডজনখানেক বিছানা দূরে ছিল নাম্বার ৫৭, এইটাই ছিল তার নাম্বার যদ্দুর মনে পড়ে। তার লিভারে সিরোসিস ছিল। এই লোকটারে ওয়ার্ডের সবাই চেহারায় চিনতো কারণ তারে প্রায়ই মেডিকেল লেকচারের সাবজেক্ট হিসেবে ব্যবহার করা হইত। প্রতি সপ্তাহে দুইবার সেই লম্বা, গম্ভীর ডাক্তারটা ওয়ার্ডে আইসা কয়েকজন ছাত্ররে লেকচার দিতো। এবং কোনো কোনো সময় সে ওই ৫৭ নাম্বার লোকটারে ট্রলিতে কইরা ওয়ার্ডের মাঝখানে নিয়া আসতো। তারপর তার নাইটশার্টটা উঠাইয়া তার পেটের একটা থলথলে ফোলা অংশে আঙুল দিয়া দেখাইতো। ধারণা করি ওইটা ছিল তার রোগে ধরা লিভার। তারপর ডাক্তারটা এক্সপ্লেইন করতো যে এই রোগটা মদ খাওয়ার জন্য হইয়া থাকে, এবং যেইসব দেশে ওয়াইন বেশি খাওয়ার চল আছে সেইখানে এইটা বেশি দেখা যায়। এবং সবসময়ের মত তখনো সে রোগীর সাথে কোনো কথা বলতো না, একটা হাসি, কোনো জেশ্চার বা কোনোপ্রকার আমলই দিতো না। খুবই গম্ভীর ও সোজাসুজি কথা বলতো সে, আর বলার সময় সে লোকটার রোগা শরীর দুই হাতের নিচে চাইপা ধরতো আর হাল্কা একটা ঘুরানি দিত, ঠিক মহিলারা যেমনে বেলন চালায়। ৫৭ নাম্বার লোকটার যে এতে খুব খারাপ লাগতো তাও না। সে এই হাসপাতালের বহুত পুরানা রোগী, প্রায়ই তারে এমনে লেকচারে ব্যবহার করা হইত। তার লিভারটার জন্যেও নিশ্চয়ই কোনো না কোনো প্যাথোলজিকাল মিউজিয়ামের কোনো বোতল বরাদ্দ রাখা আছে। তারে নিয়া কী বলা হইতেসে বা করা হইতেসে তাতে কোনো আগ্রহ ছাড়াই সে তার রংহারা দুই চোখ শূণ্যে মেইলা শুইয়া থাকতো। ওদিকে ডাক্তারটা তারে কোনো চাইনিজ এন্টিকের মত ঘুরায়াফিরায়া দেখাইত। লোকটার বয়স ছিল প্রায় ষাইট, শরীর ছিল প্রচণ্ড কুকড়ায়ে যাওয়া। তার ফ্যাকাশে মুখটা শুকাইতে শুকাইতে একটা পুতুলের মুখের মত হইয়া গেসিল। একদিন সকালে আমার পাশের মুচি লোকটা আমার বিছানায় আচড় দিয়া নার্স আসার আগেই আমার ঘুম ভাঙ্গায়ে দিলো। “ন্যুমেরো ৫৭!” বলতে বলতে সে তার হাত মাথার উপর উচায়া ফেললো। ওয়ার্ডে হাল্কা একটু আলো ছিল, কোনোরকম দেখা যায় এমন। আমি দেখতেসিলাম নাম্বার ৫৭ পাশ ফিরা কুচকায়ে শুইয়া রইসে, তার মুখ বিছানার পাশ দিয়া ঢইলা রইসে আমার দিকে মুখ কইরা। রাতে কোনো একসময় সে মারা গেসিল, কেউ জানতো না কখন। নার্সরা আইসা তার মরার খবর শুইনা পুরাপুরি উদাসীনভাবে নিজেদের কাজে চইলা গেল। তার অনেকক্ষণ পর, প্রাহ ঘণ্টাখানেক পরে দুইজন নার্স সেনাবাহিনীর মত মার্চ কইরা ঢুকলো, তারপর একটা চাদরে কইরা লাশটা নিয়া গেল। ওদিকে, একটু বেশি আলো পাওয়াতে আমি নাম্বার ৫৭রে একটু ভালোমত আরেকবার দেইখা নিসিলাম। এই ছিল আমার দেখা প্রথম মরা ইউরোপিয়ান। এর আগে আমি অনেক মরা মানুষ দেখসি, কিন্তু তাদের সবাই ছিল এশিয়াটিক আর নাইলে খুব ভায়োলেন্টভাবে মারা যাওয়া কেউ। নাম্বার ৫৭র চোখ তখনো খোলা ছিল, মুখও। চেহারাটা প্রচণ্ড ব্যথায় কুচকানো অবস্থায় ছিল। কিন্তু আমারে যেইটা সবচেয়ে বেশি অবাক করলো তা হইলো তার চেহারার সাদা রঙ। আগেও তার মুখ ফ্যাকাশে ছিল, কিন্তু এখন যেন প্রায় ধোয়া চাদরের মত সাদা হইয়া গেসিল তার মুখটা। তার ছোট্ট, কুকড়ায়ে যাওয়া মুখটার দিকে তাকায়া আমার মনে হইল, ডাইসেক্টিং রুমে ফালায়ে রাইখা আসার অপেক্ষায় পইড়া থাকা এই জঘন্য জঞ্জালটুকুই হইলো একটা “ন্যাচরাল ডেথ”-এর নজির, যেইটার জন্য দোয়া করি আমরা খোদার কাছে।

এইত্তো, মনে মনে আমি ভাবলাম, এইটাই অপেক্ষা কইরা আছে তোমার জন্য। আজকে থেকে বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ বছর: যাদের কিসমত ভালো, যারা বুড়া বয়স পর্যন্ত বাঁইচা থাকে তারাই এমনে মরতে পারে। মানুষ বাঁচতে চায়, অবশ্যই। এবং এই বাঁচতে চাওয়ার একটা বড় কারণ হইলো মরতে ডরানো। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, আর আগেও মনে হইত, যে এইভাবে বুড়া হইয়া মরার চেয়ে হুট কইরা ভায়োলেন্টলি মইরা যাওয়া ভালো।

মানুষ যুদ্ধের ভয়াবহতার কথা বলে, কিন্তু মানুষ এমন কোনো অস্ত্র কি মানুষ বানাইতে পারসে যেইটা নির্মমতার দিক থেকে প্রকৃতির সবচেয়ে সাধারণ রোগটারও ধারেকাছে যাইতে পারে? “ন্যাচরাল” ডেথ বলতেই বুঝানো হয় প্রচণ্ড ধীর, গন্ধওয়ালা ও পেইনফুল একটা কিছু। তাও যদি কোনো পাবলিক প্রতিষ্ঠানের বদলে নিজের ঘরে মরা যায় তাইলেও একটু ভালো। কিন্তু এই বেচারা বুড়া যে একটা মোমবাতির মত স্রেফ নিভা গেল সে দুনিয়ার কারো কাছে এতটুক ইম্পর্টেন্ট ছিল না যে কেউ মরার কালে তার কাছে আইসা বসবে। সে ছিল স্রেফ একটা নাম্বার, আর ছাত্রদের জন্য একটা সাবজেক্ট। আর এরকম একটা জায়গায় মরাটা কী জঘন্যরকমের পাবলিক ঘটনা! এই হাসপাতালের প্রত্যেকটা বিছানা একটা আরেকটার গায়ে একদম লাগা ছিল। কল্পনা করেন, আমার পায়ের সাথে লাগানো বিছানার ছোট্ট রোগীটার মত মইরা যাওয়া। ওইযে, যেই লোকটা জামা গায়ে লাগলেও চিল্লাইয়া উঠতো। যদ্দুর মনে পড়ে, তার শেষ শব্দ ছিল, “আমি পেশাব করতেসি।” তবে হয়তো যারা মরে তারা এইসব জিনিস নিয়া অত প্যারা খায় না। অন্তত স্ট্যান্ডার্ড উত্তর এইটাই: মরার আগের শেষ দুই-একদিন তারা বেশ নরমালই থাকে।

হাসপাতালের পাবলিক ওয়ার্ডে এমন সব বীভৎসতা দেখা যায় যা যারা নিজের ঘরের মধ্যে মরতে পারে তাদের ভিতর দেখা যায় না। যেমন ধরেন কিছু রোগ কেবল কম আয়ের লোকেদেরই ধরে। কিন্তু এইটা সত্য যে আমি হাসপাতাল এক্স-এ যা দেখসি তা আপনি কোনো ইংরেজ হাসপাতালে দেখবেন না। এইভাবে জন্তু-জানোয়ারের মত মানুষের মইরা যাওয়া, যাদের পাশে কেউ থাকে না, কেউ পাত্তা দেয় না, এমনকি সকাল হওয়ার আগ পর্যন্ত কেউ মরাটা টেরও পায় না—এমনটা কয়েকবারই হইসে। এমনটা আপনি ইংল্যান্ডে দেখতেই পাবেন না। আরো দেখতে পাবেন না অন্য রোগীদের সামনে আরেকজনের লাশ এমনে ফালায়ে রাখা। আমার মনে আছে একবার এক কটেজ হাসপাতালে আমরা যখন চা খাইতেসিলাম তখন একজন মারা গেসিল। আর আমরা ছিলাম মাত্র ছয়জন। তাও নার্সরা এত সুন্দরমত লাশটা সরায়ে সব গোছগাছ কইরা ফেললো যে আমরা কেউ চা শেষ হওয়ার আগে টেরও পাইলাম না। ইংল্যান্ডের যেই ভালো জিনিসটা আমরা আমলে নেই না সেইটা হইলো আমাদের এইখানে প্রচুর পরিমাণে ওয়েল-ট্রেইন্ড আর ডিসিপ্লিনওয়ালা নার্স আছে। ইংল্যান্ডের নার্সরা অনেকে অবশ্যই অনেক ভোদাই। তাদের অনেকেই চায়ের পাতা দিয়া ভবিষ্যৎ বলতে যায়, কেউ ইউনিয়ন জ্যাকের ব্যাজ পরে, বা তাকের উপর রাণীর ছবি রাইখা দেয়। কিন্তু তারা অন্তত আপনারে স্রেফ অলসতার জন্য আপনার কষা হওয়া ও আধোয়া অবস্থায় আপনারে একটা অগোছালো বিছানায় ফালায়ে রাখবে না। হাসপাতাল এক্স-এর নার্সদের মধ্যে তাও একটু মিসেস গ্যাম্পের ছাপ ছিল। কিন্তু পরে আমি রিপাবলিকান স্পেনে এমন নার্সও দেখসি যারা গায়ের টেম্পারেচার মাপতেও জানে না। আবার ইংল্যান্ডের হাসপাতালে আপনি এত ধুলাবালিও পাবেন না। পরে যখন আমি হাল্কা গোসল করার মত সুস্থ হইলাম, তখন দেখসিলাম সেইখানে একটা প্যাকিং কেসে হাসপাতালের নোংরা কাপড়চোপড় আর খাবারদাবার ফালায়ে রাখা। আবার দেয়ালের ভিতরেও ঝিঝিপোকা আস্তানা গাইড়া ফেলসিল।

পায়ে একটু জোর পাইতে না পাইতেই সময় শেষ হওয়ার আগেই কোনো মেডিকেল ডিসচার্জের অপেক্ষা না কইরা নিজের কাপড়চোপড় নিয়া আমি এই হাসপাতাল থেকে পালাইলাম। আমি আসলে শুধু হাসপাতালটা থেকে পালাই নাই, পালাইসিলাম এর বিষাদ আর শূণ্যতা থেকে, এর অসুখ-অসুখ গন্ধ থেকে, আর সবচেয়ে বড় কথা, এই জায়গাটার মানসিক আবহটাই আমার কাছে কেমন যেন আলাদাভাবে মনে পড়ে। আমারে এই হাসপাতালে আনা হইসিল কারণ এইটা আমার সাব-ডিভিশনে পড়সিল। এইখানে আসার আগে আমি জানতাম না যে জায়গাটার রেপুটেশন আগে থেকেই খারাপ। এর প্রায় দুই-এক বছর পরে কুখ্যাত ঠগবাজ বেগম হানাউদরে এইখানে আনা হইসিল। রিমান্ডে থাকাকালীন সে অসুস্থ হইয়া পড়সিল। কয়েকদিন এইখানে থাকতে না থাকতেই সে কোনোমতে গার্ডদের ফাঁকি দিয়া একটা ট্যাক্সিতে কইরা হাজতে ফেরত গিয়া জানাইলো, হাসপাতালটার চাইতে এইখানে সে বেশি শান্তিতে ছিল। এই নিয়া আমার কোনো সন্দেহ ছিল না যে ফ্রান্সের অন্যান্য হাসপাতালের চাইতে এইটা ওই সময়ও বেশ আলাদা ছিল। কিন্তু এইখানের রোগীরা, যারা বেশিরভাগই পুরুষ, তাদের বেশ রিল্যাক্সই মনে হইত। এমনকি কেউ কেউ এই অবস্থাতে প্রায় কমফোর্টেবলও হইয়া উঠসিল। আমাদের মধ্যে অন্তত দুইজন গরীব লোক ছিল যারা অসুখের ভান ধইরা কোনোরকম এইখানে শীতটা কাটায়া দিতে চাইতেসিল। নার্সরা এইটা জাইনাও ঝামেলা করতো না কারণ এই ভেকধারীরা তাদের নানানরকমের ছুটা কাজ কইরা দিত। কিন্তু বেশিরভাগ লোকের এটিটিউড ছিল এইরকম: অবশ্যই এইটা একটা ফালতু জায়গা, তুমি এছাড়া আর কী আশা করসিলা? এইখানে যে ভোর পাঁচটার সময় ঘুম ভাঙ্গায়ে তিন ঘণ্টা বসায়ে রাইখা দিন শুরু করার জন্য একটা পানি-পানি স্যুপ খাইতে দেয়া হয়, বা কারো কোনো খেয়াল ছাড়াই লোকের মইরা যায়, অথবা ভাগ্যক্রমে ডাক্তারের নজর না পড়লে যে বিন্দুমাত্র মেডিকেল এটেনশন পাওয়া যায় না, এইসবের কোনোটাতেই তাদের খুব বেশি আপত্তি ছিল না। তাদের ট্রেডিশন অনুযায়ী হাসপাতাল এরকমই হয়। তোমার যদি বেশি শরীর খারাপ হয় আর তুমি যদি এতটাই গরীব হও যে নিজের ঘরে ট্রিটমেন্ট পাওয়া সম্ভব না, তাইলে তোমার হাসপাতালে যাইতে হবে। আর সেইখানে তোমার সাথে অনেক রাফনেস আর অস্বস্তির ভিতর দিয়া যাইতে হবে, ঠিক আর্মির মত।

এগুলার বাইরে পুরাতন গল্পগুলায় প্রচলিত একটা বিশ্বাস, যা এখন হারাইয়াই গেসে, সেগুলা এইখানে দেইখা বেশ মজা পাইসিলাম। যেমন ধরেন, ডাক্তাররা স্রেফ কৌতুহলের বশে রোগীদের কাইটা দেখে, বা মজার ছলে রোগী পুরাপুরি অবশ হওয়ার আগেই অপারেশন শুরু কইরা দেয়। বাথরুমের ওইপারেই একটা অপারেটিংরুম নিয়া অনেক ভয়ানক গল্প মুখে মুখে ফিরতো। অনেকে নাকি ওই রুম থেকে ভয়াবহ চিৎকার শুনতে পাইসে। এর সত্য-মিথ্যা যাচাই করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নাই। এবং আমি শিওর যে ওগুলা সব ফালতু গপ্পো। তবে আমি একবার দুইটা মেডিকেল স্টুডেন্টরে একটা ষোল বছরের ছেলেরে মাইরা ফেলতে দেখসি। ওয়েল, প্রায় মাইরা ফেলতে দেখসি। (আমি যখন হাসপাতাল ছাড়তেসিলাম তখন তারে দেইখা মনে হইতেসিল মারাই যাবে, তবে পরে বাঁইচা যাইতেও পারে।) এই স্টুডেন্ট দুইটা ছেলেটার উপর এমন এক বদ এক্সপেরিমেন্ট করসিল যা তারা কোনো পয়সা দিয়া আসা রোগীর উপর করতে সাহস পাইতো না। কিছুদিন আগেও লন্ডনে এমন একটা কথা প্রচলিত ছিল যে বড় হাসপাতালের ডাক্তাররা অনেকসময় রোগীদের ইচ্ছা কইরা মাইরা ফেলে যাতে তাদের কাটাছেঁড়ার সাবজেক্ট বানানো যায়। হাসপাতাল এক্স-এ এই গল্পটা কাউরে বলতে শুনি নাই, তবে আমি শিওর গল্পটা শুনলে তাদের অনেকে অবশ্যই বিশ্বাস করতো। কারণ এই হাসপাতালে উনিশ শতকের মেথড না থাকলেও, কেমনে যেন এইখানে উনিশ শতকের আবহ টিকা গেসিল, আর এইখানেই ছিল তার অদ্ভূত আগ্রহের জায়গাটা।

গত প্রায় পঞ্চাশ বছরে ডাক্তার আর রোগীদের সম্পর্কের মধ্যে অনেক বদল আসছে। আপনি যদি উনিশ শতকের শেষদিকের যেকোনো লিটারেচার পইড়া দেখেন, তাইলে দেখবেন যে হাসপাতালরে সেইখানে হাজতখানার মত কইরাই দেখানো হইতেসে। তাও আবার খুব পুরানা আমলের, ঘুপচি কোনো হাজতখানা। হাসপাতাল হইল একটা নোংরা জায়গা, যেইখানে টরচার আর মরণের ছাপ থাকবে সবখানে। কবরের আগের ঘরটাই হইল হাসপাতাল। যারা একান্তই গরীব তারা ছাড়া আর কেউ এমন জায়গায় ট্রিটমেন্টের মত আসতে চাবে না। বিশেষ কইরা গত শতকের শুরুর দিকে যখন মেডিকেল সাইন্সের পশার কোনো সাকসেস ছাড়াই অনেক বাড়তে থাকলো, তখন ডাক্তারি ব্যবসাটারে সাধারণ মানুষ খুবই ভয়ের চোখে দেখতো। বিশেষত সার্জারিরে মনে করা হইত স্রেফ সেডিজমের একটা জঘন্য রূপ। আর শরীর কাটাছেড়া শুধু লাশ চুরি করার মাধ্যমেই সম্ভব হইত, তো লোকে এইটারেও ভাবতো মরাদের সাথে যোগাযোগ করার কোনো জাদুটোনার পদ্ধতি। উনিশ শতকে আপনি ডাক্তার আর হাসপাতাল নিয়া লেখা অনেক হরর লিটারেচারের খোঁজ পাবেন।

বেচারা তৃতীয় জর্জের কথাই ধরেন। বুড়া বয়সে ব্যাটা দেখে ডাক্তাররা তারে অজ্ঞান হওয়ার আগ পর্যন্ত রক্ত ঝরাইতে কাছে আসতেসে, আর সে চিল্লাইয়া দয়া চাইতেসে। বা বব সয়্যার আর বেঞ্জামিন এলিয়েনের কনভারসেশনের কথাই ধরেন, যা কোনোভাবেই শুধু প্যারডি ছিল না। বা লা ডেবাকল আর ওয়ার অ্যান্ড পীসের ফিল্ড হাসপাতালগুলা, অথবা মেলভিলের হোয়াইটজ্যাকেটে হাত কাটার বিবরণ! উনিশ শতকের ইংলিশ ফিকশনে ডাক্তারদের নাম দেখলেই অনেককিছু বুঝতে পারবেন: স্ল্যাশার, কার্ভার, সয়্যার, ফিলগ্রেভ, ইত্যাদি। আর ডাক্তারদের জন্য একটা ধরা নাম ছিল “স-বোন্স”, এগুলা যতটা হাসির ততটাই ভয়ের।

এই সার্জারি-বিরোধী ট্রেডিশনের সবচেয়ে ভালো এক্সপ্রেশন হইলো টেনিসনের ‘দ্য চিলড্রেন্স হসপিটাল’ কবিতাটা। এই কবিতাটারে বলা যায় ক্লোরোফর্মের আগে অপারেশন কেমন ছিল তার একটা দলিল, যদিও এইটা মেবি লেখা হইসিল ১৮৮০র দিকে। এবং টেনিসন এই কবিতায় যেই আউটলুকটারে ধরতে চাইসিল তার পক্ষেও অনেক কথা আছে। এনেস্থেটিক্স ছাড়া একেকটা অপারেশন যেমন ছিল, তাতে যারা এইসব অপারেশন চালাইত তাদের নিয়ত নিয়া প্রশ্ন না কইরা পারা যায় না। কারণ এইসব রক্ত মাখামাখি অপারেশনগুলা, যা মেডিকেল ছাত্ররা এত উত্তেজনার সাথে চালাইত, তা অনেকসময়ই ছিল বেহুদা। আর রোগী শকের চোটে মইরা গিয়া না থাকলে প্রায়ই পরে গ্যাংগ্রিন হইয়া মইরা যাইত। এবং এগুলা বেশ স্বাভাবিক বইলাই ধইরা নেয়া হইত। এখনো এমন অনেক ডাক্তার পাওয়া যাবে যাদের নিয়ত সন্দেহজনক। যাদের কোনো বড়সড় রোগ হইসে, বা যারা কখনো মেডিকেল স্টুডেন্টদের আলাপ করতে শুনসে, তারাই বুঝবে আমি কী বলতে চাইতেসি। এনেস্থেটিক্সের আবিষ্কার ছিল একটা টার্নিং পয়েন্ট, আর ডিসইনফেকটেন্টের আবিষ্কারও। এখন আর পৃথিবীর কোথাও আপনি এক্সেল মুন্থে’র লেখা ‘দ্য স্টোরি অফ সান মিশেল’ বইয়ের মত ঘটনা ঘটতে দেখবেন না। সেই বইতে এক বদ সার্জন একটা টপ হ্যাট ফ্রক কোট পরা থাকে, তার শার্টের সামনের দিকটা রক্ত আর পুঁজে ভরা। সেই ডাক্তার একই ছুরি দিয়া একটার পর একটা রোগীর শরীর কাইটা খুলতে থাকে আর কাটা অঙ্গগুলা একটা টেবিলের উপর পাক্কা মাইরা জমা করতে থাকে। তাছাড়া ন্যাশনাল হেলথ ইন্সুরেন্সও এই ধারণাটা মোটামুটি মাইনাই নিসে যে ওয়ার্কিং-ক্লাস রোগীরা নিতান্তই ফকির এবং তাদের এত পাত্তা দেয়ার কিছু নাই। এই দেশে মাগ্নার রোগীদের প্রায়সময়ই অবশ না কইরাই দাঁত ছুটায়া ফেলা হইত। তারা তো আর পয়সা দেয় নাই, তাইলে তাদের কেন এনেস্থেশিয়া দিব—ভাবখানা ছিল এমন। সেইটাও এখন বদলাইসে। কিন্তু প্রতিটা ইন্সটিটিউশন চিরকালই নিজের অতীতের একটা মেমরি বহন কইরাই চলে। একটা ব্যারাক-রুমে এখনো কিপলিংয়ের ভূত ঘুইরা বেড়ায়, আর অলিভার টুইস্টের কথা মনে না কইরা কোনো কারখানায় ঢোকাও বেশ কঠিন। হাসপাতালের শুরুয়াতটা হইসিল কুষ্ঠ ও এরকম অন্যান্য রোগীদের আইসা মরার একটা জায়গা হিসেবে। আর পরে এর চল ছিল যে এইখানে মেডিকেল ছাত্ররা গরীবদের শরীরের উপর নিজেদের বিদ্যাটা ভালো কইরা শেখে। হাসপাতালগুলার গ্লুমি আর্কিটেকচার দেইখাই এর ইতিহাসের হাল্কা ইশারা পাওয়া যায়। ইংরেজ হাসপাতালগুলায় পাওয়া ট্রিটমেন্ট নিয়া আমি কোনো কমপ্লেইন করতেসি না। কিন্তু এইটুক আমি বুঝি যে হাসপাতালের ডিজাইনগুলা এমন হয় যে মানুষের ইন্সটিঙ্কটই তারে বলে সম্ভব হইলে এইখান থেকে দূরে থাকতে, বিশেষ কইরা পাবলিক ওয়ার্ডগুলা থেকে। আইনের পজিশন যাই হোক না কেন, এই নিয়া কোনো সন্দেহ নাই যে যেইখানে হাসপাতালগুলার নীতি হইল “ডিসিপ্লিন মাইনা নাও নাইলে ভাগো” তখন আপনার নিজের ট্রিটমেন্টের উপর আপনার কন্ট্রোল খুবই কম থাকবে, আর আপনার উপর যে কোনো আজাইরা এক্সপেরিমেন্ট করা হবে না সেই নিশ্চয়তাও পাওয়া যাবে না। আর নিজের ঘরে মরতে পারা অনেক ভালো একটা জিনিস, আরো ভালো নিজের জুতা পইরা মরা। হাসপাতালের উদারতা আর কাজ যতই ভালো হোক না কেন, সেইখানের মৃত্যুগুলায় খুব নির্মম, ছোট্ট কোনো ডিটেইল থাকেই, যা হয়তো মুখে বলাও যায় না কিন্তু ঠিকই একটা পেইনফুল মেমরি রাইখা যায়। এইগুলা তাড়াহুড়ার কারণে ঘটে, বেশি লোক থাকার কারণে, কিংবা প্রতিদিন লোকে মরতে থাকে এমন একটা জায়গার স্বাভাবিক উদাসীনতা থেকে।

আর এক্কেবারে গরীবদের মধ্যে হয়তো হাসপাতালের ভয়টা এখনো আছে। আর আমাদের মধ্য থেকেও ভয়টা গেসে বেশিদিন হয় নাই। আমাদের মনের অল্প গভীরেই এই ভয়টা দানা বাঁইধা রইসে। আমি আগেই বলসি যে এক্স হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢুইকা আমার কিছুএকটা খুব চেনা-চেনা লাগতেসিল। আসলে আমার যেই সিনটা চেনা লাগতেসিল, তা হইল উনিশ শতকের গন্ধওয়ালা, ব্যথায়-ভরা হাসপাতালগুলা, যেগুলা আমি কোনোদিন দেখি নাই কিন্তু একটা ট্রেডিশনাল নলেজ ছিল। আর ওইখানের কিছুএকটা, হয়তো ওই পুরা কালা জামা পরা ডাক্তার আর তার গন্ধওয়ালা কালা ব্যাগ, অথবা হাসপাতালটার অসুখের গন্ধ আমারে টেনিসনের ‘দ্য চিল্ড্রেন্স হসপিটাল’ কবিতাটা মনে করায়ে দিসিল, যেইটার কথা প্রায় ২০ বছর আমার মনেই ছিল না৷ ঘটনা হইলো ছোট থাকতে একজন নার্স আমারে এই কবিতাটা পইড়া শোনাইত। সেই নার্স মেবি টেনিসনের কবিতা লেখার টাইম হইতে এই চাকরি কইরা আসতেসিল। সেই পুরান আমলের হাসপাতালগুলার যন্ত্রণা আর ভয়ের মেমরি তখনো তার মনের মধ্যে ভালোই জ্যাতা ছিল। আমরা দুইজন একসাথে এই কবিতাটা পইড়া ভয়ে কাঁইপা উঠতাম। আর তারপর একসময় আমি কবিতাটা ভুইলা গেলাম। এমনকি এর নাম শোনার পরেও আমার মনে কিছুই আসতো না। কিন্তু ওই নিভু-নিভু ঘরটার চাপা ফিসফিসানি, তার একসাথে ঠাসা বিছানাগুলা আমার চিন্তারে একটানে ফিরায়ে নিয়া গেল ঘরে। আর সেই রাতে আমি দেখলাম পুরা কবিতাটার গল্প আর আবহটা আমার মনে আইসা গেসে, এমনকি কিছু কিছু লাইনও।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

মাহীন হক

মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →