Main menu

শুটিং এন এলিফেন্ট (১৯৩৬) – জর্জ অরওয়েল

নিচু বার্মার মোলমেন অঞ্চলে বহু মানুষই আমারে দেখতে পারতো না। আমি ছিলাম ওই শহরের সাব-ডিভিশনাল পুলিশ অফিসার। ফলে একপ্রকার দিশাহীন, ছোটখাটো ইউরোপবিরোধী ঘৃণা আইসা আমার উপর পড়তো। কারো মধ্যেই দাঙ্গা বাঁধানোর সাহস ছিল না, কিন্তু একজন ইউরোপীয় মহিলা যদি একা একা বাজারের মধ্য দিয়া হাঁইটা যায় তাইলে লোকে নির্ঘাত তার জামার উপরে পানের পিক মারবে। পুলিশ অফিসার হিসেবে তাদের এই এলোপাথাড়ি ঘৃণার এক রেগুলার নিশানা ছিলাম আমি। যখনই তারা চিপা পাইত, আমার উপর তাদের ক্ষোভ ঝাইড়া নিত। একবার এক ফটকা বার্মিজ বেটা ফুটবল মাঠে আমারে ল্যাং মাইরা ফালায়া দিসিল, আর রেফারি তা দেইখাও দেখে নাই। আশেপাশের জনতা তাতে হাইসা একসের হইসিল। এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে। একটা সময় আমার দিকে ঘৃণার নজর নিয়া তাকায়ে থাকা এতগুলা হলুদ জুয়ান বেটাদের মুখ, আমার থিকা নিরাপদ দূরত্বে গিয়াই লোকের আমার দিকে ছুইড়া দেয়া গালিগালাজ, এগুলা আমারে কাবু কইরা ফেললো। সবচেয়ে বিচ্ছিরি ছিল জুয়ান বৌদ্ধ সন্ন্যাসিগুলা। এদের সংখ্যা ছিল হাজার হাজার, আর রাস্তার চিপায় দাঁড়ায়া ইউরোপিয়ানদের প্যারা দেয়া ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ ছিল না মনে হয়।

এইসব আমার জন্য নেয়া কঠিন হইয়া পড়তেসিল। কারণ ততদিনে আমি মনে মনে ঠিক কইরা ফেলসি যে ইমপেরিয়ালিজম একটা জঘন্য জিনিস এবং যত তাত্তাড়ি সম্ভব আমার এই চাকরি ছাইড়া ভাগা দরকার। তত্ত্বে এবং গোপনে আমি ছিলাম এই বার্মিজদেরই পক্ষে, এবং তাদের ব্রিটিশ জালিমদের বিপক্ষে। এবং আমার এই চাকরির কথা যদি বলি, ওইটারে আমি এত ঘিন্না করতাম যে বইলা বুঝাইতে পারবো না। এরকম চাকরিতে সরকারের আসল নোংরামিগুলা সবচাইতে কাছ থিকা দেখা যায়। জেলখানার ছোট্ট ময়লা খাঁচাগুলায় জড়োসড়ো হইয়া পচতে থাকা কয়েদি, তাদের ফ্যাকাশে, ডরানো মুখ, বাঁশ দিয়া পিটানো কয়েদিদের দাগপড়া পাছা—এইসব কিছু আমার মধ্যে এমন এক অপরাধবোধের জন্ম দিসিল যা আর আমি নিতে পারতেসিলাম না। কিন্তু কোনোকিছুই আমি ঠিক করতে পারতেসিলাম না। তখন আমার বয়স কম ছিল এবং পড়াশুনাও তেমন ছিল না। তারউপর সবকিছু আমারে ভাবতে হইত এক ভয়াবহ নিরবতার মধ্যে যা এই অঞ্চলের প্রত্যেকটা ব্রিটিশের উপর চাপায়া দেয়া হইত। আমি এমনকি জানতামও না যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য মারা যাইতেসে, এই সাম্রাজ্যের বদলে যারা আসবে তাদের কথা তো আরো না। আমি শুধু জানতাম আমি আমার সরকারের বিরুদ্ধে এক ভয়াবহ ক্ষোভ আর এইখানের ছোট্ট বদমাইশগুলা যারা আমার চাকরি আরো কঠিন বানায়া তুলতেসে তাদের প্রতি ঘেন্নার মধ্যে ফাঁইসা গেসি। আমার মনের এক অংশ ভাবতো ব্রিটিশ রাজের এই জুলুম কখনোই শেষ হবে না, যুগের পর যুগ ধইরা মানুষরে দমায়া রাখা হবে। আর আরেক অংশে মনে হইত দুনিয়ার সবচাইতে আনন্দের ব্যাপার হবে যদি ওই বৌদ্ধ সন্ন্যাসিটার ভুড়ির মধ্যে একটা বেয়োনেট ঢুকায়া দিতে পারি। ইমপেরিয়ালিজম এরকম উদ্ভট চিন্তার জন্ম দেয়। যেকোনো এংলো-ইন্ডিয়ান অফিশিয়ালরে জিগায়া দেখতে পারেন, যদি তারে অফ ডিউটি পান।

এরমধ্যে একদিন এমন এক ঘটনা ঘটলো যা অদ্ভূতরকমের স্পষ্টতা আইনা দিসিল। ঘটনাটা খুবই ছোট, কিন্তু এর ফলে ইমপেরিয়ালিজম নিয়া, এই কলোনিয়াল সরকারের সত্যিকারের উদ্দেশ্যের ব্যাপারে আমার ধারণা আগের চাইতে আরো ক্লিয়ার হইসিল। এক ভোরে আরেক অঞ্চলের এক সাব-ইন্সপেক্টর আমারে ফোন দিয়া জানাইল ওইখানে একটা হাতি বাজারে ঢুইকা সব তছনছ কইরা ফেলতেসিল, তো আমি যেন আইসা একটু দেখি ঘটনা কী। এমন সময়ে কী করা উচিত তা আমিও জানতাম না, কিন্তু এই ঘটনা সামনাসামনি দেখা দরকার মনে কইরা একটা ঘোড়ার পিঠে চইড়া আমি রওনা দিলাম। সাথে আমার রাইফেলটাও নিলাম, একটা পুরান .৪৪ উইনচেস্টার যা দিয়া হাতি মারা মোটেও সম্ভব না। কিন্তু ভাবলাম প্রয়োজন পড়লে গুলির শব্দে হাতিটারে ভয় দেখাইতে পারব। পথে বার্মিজ লোকেরা একটু পরপর আমারে থামায়া বলতে লাগলো হাতিটার কারবার সম্পর্কে। হাতিটা জংলি ছিল না, বরং একটা পোষা হাতিই ছুইটা পাগল হইয়া গেসিল। এরে চেইন দিয়া আটকায়া রাখা হইসিল কিন্তু গতরাতে সে ছুইটা যায়। হাতিটার মাহুত ছিল একমাত্র লোক যে এই দশায় তারে শান্ত করতে পারতো, কিন্তু বেটা তখনও ছিল বারো ঘণ্টা দূরের পথে। আর হাতিটা সকালবেলা শহরের মধ্যে ঢুইকা পড়লো। সাধারণ বার্মিজ জনগণের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না, ফলে তারা এই বিশাল জন্তুর সামনে বেশ অসহায় হয়া পড়সিল। ততক্ষণে হাতিটা একজনের বাঁশের ঘর ভাইঙ্গা ফেলসিল, একটা গরু মাইরা ফেলসিল এবং কতগুলা ফলের দোকানে ঢুইকা সব সাবাড় কইরা ফেলসিল। এছাড়াও পথে তার একটা ময়লার ভ্যানের সাথে মোলাকাত হয়, এবং যখন ভ্যানওয়ালা নাইমা দৌড় লাগায় তখন সে ভ্যানটা উপুড় কইরা তার উপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়।

বার্মিজ সাব-ইন্সপেক্টর আর কিছু ভারতীয় কনস্টেবল আমার জন্য কোয়ার্টারে অপেক্ষা করতেসিল। কোয়ার্টারটার খুবই করুণ দশা ছিল, কতগুলা বাঁশের ঘর একসাথে লাগায়া তালপাতা দিয়া ঢাকা। আমার মনে আছে চারপাশ ছিল মেঘে ঢাকা, বৃষ্টির আগেআগে যেমন আবহাওয়া থাকে। আমরা মানুষজনরে জিজ্ঞেস করা শুরু করলাম হাতিটা কই গেসে, এবং সবসময়ের মতই কোনো ঠিকঠাক উত্তর পাইতে ব্যর্থ হইলাম। এই অঞ্চলে সবসময় এই অবস্থাই হয়। দূর থিকা প্রতিটা কাহিনিই খুব স্পষ্ট লাগে, কিন্তু কাছে গেলেই সব ঘোল পাকায়ে যাইতে থাকে। কেউ বলে হাতিটা ওইদিকে গেসে, কেউ বলে এইদিকে গেসে, কেউ কেউ আবার জানেই না হাতির ব্যাপারে কিছু। আমি মোটামুটি ভাইবা নিসিলাম যে পুরা খবরটাই ভুয়া। ঠিক এমন সময় একটু দূর থিকা একটা চিৎকার শুনতে পাইলাম।

একটা জোরদার গলায় কেউ চিৎকার করতেসিল, “ভাগ, পিচ্চির দল! এক্ষনি ভাগ!” আর সাথেসাথে এক বুড়ি মহিলা একটা সুইচ হাতে একটা কুড়েঘরের চিপা দিয়া কতগুলা লেংটা পোলাপানরে ধাওয়াইতে ধাওয়াইতে বাইর হইয়া আসলো। পিছে পিছে আরো কতগুলা মহিলা আসলো, সবাই খুব উত্তেজিত হইয়া ছিল। খুব সম্ভবত বাচ্চাগুলা এমনকিছু দেইখা ফেলসিল যা তাদের দেখার কথা ছিল না। আমি কুড়েঘরটা রাউন্ড দিয়া দেখি পিছনে একটা লাশ কাদার মধ্যে পইড়া আছে। একজন ভারতীয় কুলি, প্রায় লেংটা, এবং মারা গেসে কয়েক মিনিটের বেশি হয় নাই। আশেপাশের লোকেরা জানাইল হাতিটা আচানক আইসা শুড় দিয়া তারে প্যাচায়ে মাঠির মধ্যে ঠুইকা দিয়া পাড়া দিয়া চইলা যায়। তখন বর্ষাকাল থাকায় মাটি কাদাকাদা হইয়া ছিল, ফলে তার মুখটা মাটির মধ্যে প্রায় এক ফুট গভীরে ঢুইকা পড়সিল। পেটের উপর ভর কইরা শুইয়া ছিলেন, দুই হাত ক্রুশের মত ছড়ানো এবং ঘাড়টা একদিকে বাঁকানো। পুরা চেহারা কাদায় ঢাকা, মুখ হা কইরা খোলা, আর দাঁতগুলা এক অসহ্য ব্যথায় লাইগা ছিল। (ভালো কথা, আমারে কোনোদিন বলতে আইসেন না মৃতদের দেখতে অনেক শান্ত লাগে। আমি জীবনে যত লাশ দেখসি সব বীভৎস ছিল।) সেই বিশাল জন্তুর পায়ের ঘর্ষণে তার পিঠের চামড়া একদম সুন্দর কইরা উইঠা আসছিল যেইভাবে লোকে খরগোশের চামড়া ছিলায়। লাশটা দেখামাত্র আমি আর্দালি বন্ধুর বাসা হইতে একটা হাতি মারার রাইফেল আনাইতে দিলাম। আমার ঘোড়াটারে ততক্ষণে বাসায় পাঠায়ে দিসিলাম, কারণ চাই নাই হাতির ডরে সে আমারে ফালায়া দিক।

কয়েক মিনিট পর আর্দালি একটা রাইফেল আর পাঁচটা কার্টিজ নিয়া আসলো। ততক্ষণে কয়েকজন বার্মিজ লোক আইসা বললো হাতিটা নিচে ধানক্ষেতে আছে, কয়েকশ গজ দূরেই। আমি সামনে আগাইতেই আমার পিছে পিছে পুরা অঞ্চলের সব লোক ঘরবাড়ি ফালায়া আমার পিছে আসা শুরু করলো। রাইফেলটা দেইখা তারা সবাই চেচামেচি শুরু করসিল যেন আমি হাতিটারে গুলি করি। এতক্ষণ যখন হাতিটা তাদের ঘরবাড়ি তছনছ কইরা ফেলতেসিল তখনও তাদের এত আগ্রহ ছিল না। কিন্তু হাতিটারে মাইরা ফেলব ভাইবা তাদের উৎসাহের অন্ত নাই। ব্যাপারটায় যেন একটু মজাই পাইতেসিল তারা, তাছাড়া মাংসটাও তাদের দরকার ছিল। আমার একটু অস্বস্তি লাগতেসিল। হাতিটারে গুলি করার কোনো নিয়ত আমার ছিল না। রাইফেলটা আনসিলাম স্রেফ প্রয়োজনে নিজেরে বাঁচাইতে। কিন্তু এখন পিছে এমন উৎসাহী জনতা আমারে বিপদে ফালায়ে দিল। পাহাড় বাইয়া নামলাম, পুরাই ভোদাই মনে হইতেসিল নিজেরে, ওদিকে আমার কাঁধে রাইফেল আর মানুষের বাড়ন্ত জটলা। নিচে কুড়েঘরগুলা থিকা দূরে একটা পাকা রাস্তা, তারপর একটা কাদামাখা ধানক্ষেত। তখনও চাষ করা হয় নাই কিন্তু পশলা বৃষ্টিতে ভেজামাটি আর হালকা হালকা ঘাস উইঠা ছিল। হাতিটা আমাদের থেকে আট গজ দূরে দাঁড়ায়া ছিল, বামদিকটা আমাদের দিকে ফেরানো। এত বড় ভিড়টারে সে পাত্তাও দিল না। সে স্রেফ বড় বড় ঘাস ছিঁড়া হাটুতে ঝাড়া দিয়া গিলতে ব্যস্ত ছিল।

পথে থাইমা গেলাম। হাতিটারে দেখামাত্রই বুইঝা ফেলসিলাম এরে গুলি করা ঠিক হবে না। একটা কর্মক্ষম হাতিরে মাইরা ফেলা জটিল কারবার, প্রায় একটা বিশাল ও দামি মেশিন নষ্ট করার শামিল। এড়ানো সম্ভব হইলে এমন না করাই উচিত। আর ওইখানে শান্তিতে ঘাস চিবাইতে থাকা হাতিটারে একটা গরুর চাইতে বেশি ভয়ানক কিছু মনে হইতেসিল না। তখন মনে হইসিল, এবং এখনও মনে হয় তার পাগলামি ততক্ষণে শান্ত হইয়া আসছিল। তো সে আর কতক্ষণ দিশাহীন হাঁইটা বেড়াইত আর মাহুত আইসা সব সামলায়ে নিতে পারতো। তারচেয়ে বড় কথা, আমার তারে গুলি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। তাই ঠিক করলাম কিছুক্ষণ তার উপর স্রেফ নজর রাখব। তারপর আর কোনো ঝামেলা না হইলে বাসায় যাবগা।

কিন্তু ঠিক তখন আমার চোখ পড়লো আমার পিছে পিছে আইসা পড়া জটলার দিকে। এক বিশাল ভিড়, অন্তত দুই হাজার মানুষ, তাও মিনিটে মিনিটে বাড়তেসে। যেকোনো দিক থিকা পথ আটকায়ে ফেলসিল তারা। চারিদিকে আমি দেখলাম এই হলুদ মুখের সাগর, প্রত্যেকে খুব উৎসাহী একটু মজা দেখার আশায়, কারণ তারা একদম নিশ্চিত যে হাতিটারে গুলি করা হবে। আমার দিকে তারা তাকায়ে ছিল যেমনে জাদু দেখানোর আগে লোকে জাদুকরের দিকে তাকায়ে থাকে।

তারা আমারে এমনিতে একটুও পছন্দ করে না, কিন্তু এই জাদুর রাইফেল হাতে থাকায় সবার চোখ আমার উপর আটকায়ে গেল। আর ঠিক তখনই আমার মনে হইল হাতিটারে আমার গুলি করতে হবে। মানুষগুলা আমার থেকে এইটাই আশা করতেসে এবং এইটাই আমারে করতে হবে। আমি টের পাইতেসিলাম এই দুই হাজার জন মানুষের মিলিত ইচ্ছাশক্তি আমারে ঠেলতেসে।

আর ঠিক তখন, যখন এই রাইফেল হাতে নিয়া দাঁড়ায়া আছি, তখনই ধরতে পারলাম এই অঞ্চলে সাদাদের হেডম কত ফাঁপা। এইযে আমি, রাইফেলহাতে একজন সাদা লোক, এই নিরস্ত্র আঞ্চলিক জটলার সামনে দাঁড়ানো। মনে হইতে পারে আমিই এইখানের কর্তৃত্বে আছি, কিন্তু আসলে আমি স্রেফ একটা পুতুল যার সুতা নাড়তেসে পিছে দাঁড়ায়া থাকা এই হলুদ মুখের জনতা।

তখন আমি বুঝতে পারলাম যে যখন সাদারা জালিম হইয়া ওঠে তখন তারা নিজেদের স্বাধীনতাই সবার আগে ধ্বংস করে। একপ্রকার ফাঁপা, প্রাণহীন পুতুল হইয়া পড়ে সে। একজন “সাহেব” এর যে ইমেজ তারই রিফ্লেকশন। তার এই শাসনের নিয়মই হইল এই যে তারে এই অঞ্চলের লোকেদের মুগ্ধ কইরা যাইতে হবে, ফলে যেকোনো সংকটের কালে তারে তাই করতে হবে যা ওই অঞ্চলের লোকেরা আশা করে। সে একবার মুখোশ পরা শুরু করে, আর আস্তে আস্তে তার মুখ সেইটার সাথে মানাইয়া যায়। আমার হাতিটারে গুলি করতেই হইত। রাইফেলটা আনানোর মাধ্যমেই আমি এইটা নির্ধারণ কইরা ফেলসি। একজন সাহেবরে সাহেবের মত আচরণ করতে হবে। তার সবসময় শক্ত থাকতে হবে, যেকোনো পরিস্থিতিতে। এতদূর একটা রাইফেল নিয়া আসা, পিছে পিছে এই বিশাল জনতাসহ, আর তারপর কিছু না কইরা ভীতুর মত ভাইগা যাওয়া—না, এইটা হইতে দেয়া যায় না। সবাই হাসবে আমার উপর। আর আমার পুরা জীবন, এই অঞ্চলে যেকোনো সাদা লোকের জীবনই হইল অন্যের হাসি এড়ানোর এক অশেষ স্ট্রাগল।

কিন্তু আমি হাতিটারে গুলি করতে চাই নাই। আমি দেখতেসিলাম ও কীভাবে কতগুলা ঘাস হাঁটুতে ঝাড়া দিয়া খাইতেসিল, কেমন একটা দাদিসুলভ ভাব নিয়া, যেমনটা হাতিদের থাকে। এরে গুলি করা হবে খুন করার শামিল। সেই বয়সে আমার পশুপ্রাণীর হত্যা নিয়া খুব সমস্যা ছিল তা না, কিন্তু কোনোদিন কোনো হাতিরে গুলি করি নাই এবং করতে চাইও নাই। (কেন জানি একটা বড় প্রাণীরে খুন করা সবসময়ই বেশি অপরাধ বইলা মনে হয়।) তাছাড়া প্রাণীটার মালিকের কথাও তো মাথায় রাখতে হবে। জ্যাতা অবস্থায় এই হাতির দাম কমপক্ষে একশ পাউন্ড, মরলে পরে স্রেফ তার দাঁত দুইটার জন্য কিছু পাওয়া যাইতে পারে, হয়তো পাঁচ পাউন্ড। কিন্তু যা-ই করি তাড়াতাড়ি করতে হবে। আমি কতগুলা বুজুর্গ চেহারার বার্মিজরে জিজ্ঞেস করলাম হাতিটার আচরণ এখন কেমন। তারা সবাই একই কথা বললো: এমনিতে হাতিটা চুপচাপ, কারো দিকে কোনো নজর নাই। তবে বেশি কাছে গেলে ধাওয়া দিতে পারে। আমার কী করা উচিত তা এতক্ষণে স্পষ্ট ছিল। আমার হাতিটার পঁচিশ গজের কাছাকাছি গিয়া দেখা উচিত ছিল সে ধাওয়া করে কিনা। যদি করে, তাইলে গুলি করাই যায়। আর যদি পাত্তা না দেয়, তাইলে মাহুত আসা পর্যন্ত তারে অমনে ছাইড়া দেয়াই ভালো। কিন্তু আমি জানতাম আমি এই কাজ করতে পারবো না। আমার রাইফেলের নিশানা খুব ভালো না। আর তাছাড়া জমিন ছিল পুরা কাদা-কাদা যাতে পাড়া দিলেই পা ডুইবা আটকায়ে যায়। হাতিটা যদি দৌড় দেয় আর আমার গুলি যদি মিস করে, তাইলে আমার দশা হবে স্টিমরোলারের তলে চাপাপড়া ব্যাঙের মত। কিন্তু তখনও আমি নিজের কথা যত না ভাবতেসিলাম, তার চেয়ে ভাবতেসিলাম সেই হলুদ চেহারাগুলার কথা, যারা আমারে কড়া নজরে দেখতেসিল। তবে তখনও আমি ওই অর্থে ভয় পাই নাই, যতটা পাইতাম একলা থাকলে। কারণ একজন সাদা সাহেবের তো এই আঞ্চলিক লোকগুলার সামনে ভয় পাওয়া মানায় না। আমার মাথায় তখন কেবল চলতেসিল যে আমি যদি ভুল করি, যদি এই হাতির পায়ের তলে চাপা পইড়া লাশ হইয়া যাই, তাইলে খুব সম্ভবত এদের কেউ কেউ খুব মজা পাইয়া হাইসা ফেলবে। তা তো হইতে দেয়া যায় না।

আর একটাই পথ ছিল। আমি রাইফেলটার ম্যাগাজিনে কার্টিজ ঢুকায়া মাটিতে শুইয়া পড়লাম ভালো নিশানার জন্য। পুরা ভিড় একবারে চুপচাপ হইয়া গেল। আর সবাই মিলা একটা গভীর, চাপা, আনন্দের হাঁফ ছাড়লো, যেন অবশেষে পর্দাটা উঠতে দেখতে পাবে। পাওনা মজাটা তাইলে তারা পাবে। আমি জানতাম না একটা হাতিরে গুলি করার সময় কান থিকা কানে গুলি করতে হয়। কিন্তু আমি তার কয়েক ইঞ্চি সামনে তাক করলাম, ভাবসিলাম মগজ বোধহয় আরেকটু সামনে হবে।

ট্রিগারটা টান দেয়ার পর আমি গুলির শব্দ শুনতে পাই নাই, আমি শুনতে পাইসিলাম শত শত মানুষের পাশবিক উল্লাসের চিল্লানি। আর সাথেসাথেই, এত অল্প সময়ের মধ্যে, গুলিটা ঠিকমত পৌঁছাইতে পারার আগেই যেন হাতিটার শরীরে একটা অদ্ভূত, ভয়াবহ বদল আইসা গেল। সে কাঁপেও নাই পইড়াও যায় নাই। বরং তার শরীরের প্রতিটা রেখা বদলায়ে গেসিল। এক মুহূর্তের মধ্যে তারে স্তব্ধ, ছোট্ট, ভয়ানক বুড়া হয়ে যাইতে দেখলাম মনে হইল। যেন বুলেটটা তারে চিৎ করতে না পাইরা তার সারা শরীর ওরমই জমায়ে ফেলসে। অবশেষে অনেকক্ষণ পরে, সম্ভবত পাঁচ সেকেন্ড পরে হাতিটা হাঁটুতে ভর দিয়া পইড়া গেল। মুখ থেকে লালা বের হওয়া শুরু হইল। একটা বিশাল জরা যেন ওরে গিলা ফেললো। যেন এই হাতির বয়স হাজার হাজার বছর। আরো একবার একই জায়গায় গুলি করলাম। এইবার সে পইড়া না গিয়া খুবই দুর্বলভাবে আবার উইঠা দাঁড়াইল। টলমল পা, মুখ হইতে বাইয়া নামতেসে লালা। তৃতীয়বার গুলি করলাম। এইবার অবশেষে সে মরলো। ব্যথার চোটে শরীরের শেষটুক শক্তি দিয়া আরেকবার উইঠা দাঁড়াইতে চাইয়া আবার কাঁপতে কাঁপতে ধ্বইসা পড়া। তার পিছের দুই পা আগে বাঁইকা যায়, তার বিশাল শুঁড় আসমানের দিকে গাছের মত হাত বাড়ানো। এইবার সে ডাক ছাড়লো, প্রথম ও শেষবারের মত। তারপর সে পুরাপুরি পইড়া গেল, পেট আমার দিকে দিয়া। তার পতনে যেন আমার পায়ের তলার মাটি কাঁইপা উঠলো।

আমি উইঠা দাঁড়াইলাম। বার্মিজরা এরমধ্যেই আমারে ডিঙ্গায়া ওইদিকে দৌড় দেয়া শুরু করসে। হাতিটা যে আর উঠতে পারবে না তা স্পষ্ট, কিন্তু সে এখনও মরে নাই।

বেশ ছন্দে সে ঘরঘর শব্দে শ্বাস ফেলতেসিল। তার পাশ ফিরা বিশাল শরীর ফুলতেসে আর চুপসায়ে যাইতেসে। মুখ হা, বিশাল ফ্যাকাশে গোলাপি গলার ভিতরটাও স্পষ্ট দেখা যাইতেসিল। অনেকক্ষণ ধইরা আমি অপেক্ষা করতেসিলাম তার মরার, কিন্তু তার শ্বাস সমানতালে চলতেসিল। সবশেষে আমি তার হার্ট বরাবর আরো দুইটা গুলি মারলাম। লাল মখমলের মত ঘন রক্ত গলগল কইরা বাইর হইতে থাকলো, তবুও সে মরে না। এমনকি গুলির চোটে তার শরীরটা পর্যন্ত কাঁপলো না। ব্যথার শ্বাস একটুও না থাইমা চলতেই থাকলো। সে মরতেসিল, খুব আস্তে আস্তে আর ভীষণ যন্ত্রণায়। কিন্তু এরমধ্যে সে এমন এক দুনিয়ায় চইলা গেসে যেইখানে কোনো বুলেটই তারে আর আঘাত করতে পারতেসিল না। আমার কেবল মনে হইতেসিল এই ভয়ানক শব্দটা যেমনে পারি থামাইতে হবে। এই বিশাল জন্তুটা এমনে অসহায় পইড়া আছে, নড়তেও পারতেসে না মরতেও পারতেসে না, এই দৃশ্য আমি নিতে পারতেসিলাম না। আমি আমার ছোট রাইফেলটা আনাইয়া ওর হার্ট আর গলার মধ্যে একটার পর একটা গুলি করতেই থাকলাম। তবু মনে হইতেসিল যেন কিছুই হইতেসে না। ঘড়ির টিকটক আওয়াজের মত ওর জেদি ঘরঘর শ্বাস তখনও চলতেসে।

শেষ পর্যন্ত আমি আর সহ্য করতে না পাইরা উইঠা চইলা গেলাম। পরে শুনসিলাম প্রাণীটার মরতে আধাঘণ্টা লাগসিল। আমি ওইখান থিকা আসার আগে থিকাই বার্মার লোকজন দা আর ঝুড়ি নিয়া আসতেসিল। বিকাল হওয়ার আগেই তারা হাড্ডি ছাড়া হাতিটার শরীরের কিচ্ছু বাকি রাখে নাই।

পরে অবশ্য এই ঘটনা নিয়া অনেক কাহিনি হইসিল। হাতিটার মালিক প্রচুর চেতসিল, কিন্তু একজন ইন্ডিয়ান আর কি করতে পারবে? আর তাছাড়া আইনের দিক দিয়াও আমি ঠিক কাজটাই করসি। একটা পাগলা হাতিরে যদি তার মালিক সামলাইতে না পারে তাইলে তারে মাইরা ফেলাই নিয়ম।

ইউরোপিয়ানরা অবশ্য নানান কথা বলতেসিল। মুরুব্বিরা বলতেসিল আমি ঠিক কাজটাই করসি। জুয়ানরা অবশ্য মারাত্মক খেপসিল যে একটা কুলিরে মাইরা ফেলার জন্য আমি একটা হাতি মাইরা ফেলসি। কারণ একটা হাতির দাম যেকোনো কুলির চাইতে বেশি। তবে কুলিটা মইরা যাওয়াতে আমি খুশিই হইসিলাম, কারণ তাতে আমি হাতিটারে মারার আইনি বৈধতা পায়া গেসিলাম। তবে মাঝেমাঝে ভাবি কেউ কি বুঝছিল আমি আস্ত একটা হাতিরে মাইরা ফেলসি, স্রেফ লোকে যেন আমারে ভোদাই না ভাবে?

The following two tabs change content below.
Avatar photo

মাহীন হক

মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →