আর্টিস্টরা কি করে? – কার্ট ভনেগাট
ভনেগাটের স্পিচটা তার স্পিচের সংকলন If this isn’t nice, what is? বইটা হইতে নেয়া। বোঝাই যাইতেসে স্পিচটা একদল কলেজ গ্র্যাজুয়েটের সামনে দেয়া। ( কত সালে, কোথায় দিসেন বের করা সম্ভব হয় নাই।)
অনেকটা তার উপন্যাসগুলার মতই, সে শুরুতেই ডিসক্লোজ কইরা দেয় সামনে কি আসতেসে। আগাম জানায়ে দেন তিনি তিনটা ব্যাপার বলবেন এই ছাত্রদের, যা তাদের যথেষ্ট বলা হয় নাই। কথা তিনটা হইলো: থ্যাঙ্কিউ, সরি এবং আইলাভিউ। নিজের সন্তানের বয়সী পোলাপানের সামনে সেই যুগের একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ এত সহজে ক্ষমা চাবে, কৃতজ্ঞতা জানাবে, বা অন্তত ভালোবাসা জানান দিবে, এইটা হয়তো ভাবাও যাইতো না। ওই অডিয়েন্সে নিশ্চয়ই এমন অনেকেই ছিল যারা নিজের বাপের কাছ থিকাও “আইলাভিউ” কথাটুকু জীবনে শুনে নাই। এইজন্য আমার মনে হয় ভনেগাট তার যুগের পুরুষের রাফনেস নামক টক্সিক আচরণের অনেকাংশই ঝাইড়া ফেলতে পারসিলেন।
স্পিচ দেয়ার ক্ষেত্রে ভনেগাটের ডিমান্ড ছিল প্রচুর। প্রতিবছর নাকি তার ডেস্কে ডজনের পর ডজন হাইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটিতে কিছু কথা বলতে যাওয়ার ইনভিটেশন জমা হইতো। তার কারণও আন্দাজ করা যায়। কারণ এরকম অধিকাংশ স্পিচই হয় কেউ একজন আপনার চেয়ে বয়সে বড় বইলা আপনার কাছে জ্ঞান ঝাড়বে, ফলে তা পরিণত হয় বিরক্তিকর লেকচারে। ভনেগাট অমন না। সে শুরুতেই নিজের ভালনারিবিলিটির কথা স্বীকার কইরা নেয়। সে শুরুতেই বইলা নেয় আমরা সবাই মানুষ, সবাই সমান দিশাহারা। আগামীর দিনটা আমাদের প্রত্যেকের কাছে সমানভাবে নতুন।
মাহীন হক
… … …
এই অল্পসময়ের মধ্যে আমি আপনাদের তিনটা জিনিস বলার নিয়ত করসি। এই জিনিসগুলা আপনাদেরকে যথেষ্ট বলা হয় নাই, আপনাদের বাপমাদেরও বলা হয় নাই, আমারেও বলা হয় নাই, আপনাদের টিচারদেরও বলা হয় নাই। কিন্তু আমি এখন বলবো। সেইজন্যই আপনাদের তৈয়ার কইরা নিতেসি।
প্রথমে, আমি বলবো থ্যাঙ্কিউ। দ্বিতীয়ত, আমি আপনাদের কাছে মাফ চাবো। এইটা তো এখন বেশ নতুন বিষয় হইয়া দাঁড়াইসে। আজকাল আর কেউ কাউরে সরি বলে না, তার বদলে তারা ওপরাহ উইনফ্রি’র শো’তে গিয়া কান্নাকাটি কইরা তুলকালাম কাণ্ড ঘটায়া আসে। এবং আমার স্পিচের শেষের দিকে তৃতীয় যেই কথাটা আমি আপনাদের বলবো তা হইলো, “আমরা আপনাদের ভালোবাসি।” এখন যদি আমি শেষমেষ এই তিনটার একটাও বলতে ভুইলা যাই, তাইলে আপনারা কেউ হাত তুইলা আমারে মনে করায়া দিবেন, আমি আমার ঘাটতি পূরণ কইরা নিব।
এখন তার আগে আমি আপনাদের আরেকটা কারণে হাত তুলতে বলবো এখন। আমি শুরুতেই আপনাদের জানায়া রাখি, পড়াশুনা মধ্য দিয়া জীবনে সবচাইতে মূল্যবান যেই জিনিসটা আপনি পাইতে পারেন তা হইলো একজন সত্যিকারের শিক্ষকের স্মৃতি, যে আপনারে এবং আপনার জীবনরে আরো অনেক ইন্টেরেস্টিং কইরা তুলতে পারসে, যে আপনার সামনে এমন অপার সম্ভাবনার দুয়ার খুইলা দিসে যা আপনি আগে কল্পনাও করেন নাই। আমি এখন এইখানের সবাইরে জিজ্ঞেস করতেসি, যারা স্টেজের উপরে আছেন তারাও, আমাদের মধ্যে কয়জন, আপনাদের মধ্যে কয়জন জীবনে এমন একজন শিক্ষক পাইসিলেন? কিন্ডারগার্টেন হইলেও চলবে। আপনারা প্লিজ হাত তুলেন। তাত্তাড়ি করেন। এবার সম্ভব হইলে আপনারা এই গ্রেট শিক্ষকের নামটা মনে করার চেষ্টা করেন।
ওকে, এইবার আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাবো শিক্ষিত হওয়ার জন্য। এইযে, থ্যাঙ্কিউ বইলা ফালাইলাম। এইটা আপনাদের প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার স্বীকৃতি অনুষ্ঠানের মত। আমরা বুইড়ারা, যাদের জীবনের প্রধান যোগ্যতা হইসে আমরা আপনাদের চেয়ে বয়সে বড়, এবার আমাদের স্বীকার করতে হবে যে আপনারাও বড় হইয়া গেসেন। এইখানে এই মুহূর্তেই হয়তো আমাদের মধ্যে এমন কোনো খাইষ্টা বুড়া আছে যে আপনাদের বলবে কোনো বিশাল দুর্যোগ পার হইয়া না আসা পর্যন্ত কেউ সত্যিকারের পুরুষ বা নারী হইয়া উঠতে পারে না, যেমন তারা পার করসে দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন, ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু, ভিয়েতনাম, বা যাইহোক। এই ভয়ানক সুইসাইডাল মিথের জন্য দায়ী লেখকেরা। লেখকেরা বারবার গল্পের মধ্যে দেখায় একটা বিশাল ঝামেলার পর ক্যারেক্টারটা বলে, “আজ আমি পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠলাম, আজ আমি সত্যিকারের পুরুষ হলাম। দি এন্ড।”
এইবার আমি আপনাদের কাছে মাফ চাইতেসি। আমি বলসিলাম আমি মাফ চাবো, এইযে চাইতেসি। কি করুণ দশা করসি আমরা পৃথিবীটার! কিন্তু পৃথিবীর দশা সবসময়ই করুণই ছিল। “অতীতের সোনালী দিনগুলি” বলতে কিছু ছিল না, ছিল স্রেফ দিন। আমার নাতিদের আমার প্রায়ই বলা লাগে, “আমার দিকে এইভাবে তাকায়ো না। আমি নিজেও কিছুই বুঝতেসি না।” তো আমি এখন কি করবো জানেন? আমি ডিক্লেয়ার করতেসি যে এইখানের আমরা সবাই একই জেনারেশনের মানুষ, জেনারেশন এ। আগামীকালের দিনটা আমাদের প্রত্যেকের জন্য সমানভাবে নতুন।
যাইহোক, এইবার আমি আমাদের জন্য এমন একটা জিনিস বানাইসি যা আমাদের প্রত্যেকের খুবই দরকার কিন্তু কারোই নাই–একটা বড় একান্নবর্তী পরিবার। এইখানে একজনের জন্য সবাই, সবার জন্য একজন। একজন স্বামী, একজন বউ আর কিছু বাচ্চাকাচ্চা, এইটা আসলে কোনো পরিবার না; এইটা খুবই ভঙ্গুর একটা সার্ভাইভাল ইউনিট। আপনারা যারা বিবাহিত বা বিয়া করবেন, তারা যখন নিজের স্বামী-স্ত্রীর সাথে ঝগড়া করবেন তখন আপনারা আপনাদের শত অভিযোগের নিচে একচুয়ালি বলতেসেন, “তুমি যথেষ্টসংখ্যক মানুষ না। তুমি মাত্র একজন মানুষ। আমার তো শতশত মানুষের সাথে একসাথে থাকার কথা।” তো, আমি আমাদের নিয়া একটা বড় পরিবার বানায়া ফেলসি। আমাদের পরিবারের কি কোনো পতাকা আছে? আলবৎ আছে! একটা বড় কমলা পতাকা। কারণ কমলা অনেক ভালো একটা রঙ, হয়তো সবচেয়ে সেরা রঙ। আর এইটা ভিটামিন সি আর আরো ভালো ভালো জিনিসে ভরা, জাস্ট আয়ারল্যান্ডের ঝামেলাগুলা মনে না রাখলেই হইলো।
এখন আমাদের এই একসাথে জড়ো হওয়াটা একটা আর্টের মত। আমরা যখন ভালো টিচারদের নাম মনে করতেসিলাম তখন আমি যেই টিচারের নাম মনে করসিলাম সে আমারে একবার জিজ্ঞেস করসিলো, “আর্টিস্টরা ঠিক কি করে?” আমি উত্তরে বিড়বিড় কইরা কিছুএকটা বলসিলাম। “তারা মেইনলি দুইটা জিনিস করে”, উনি বললো, “ফার্স্টে, তারা মাইনা নেয় যে পুরা দুনিয়াটারে ঠিক করা তো আর তাদের পক্ষে সম্ভব না। তো সেকেন্ডলি, তারা এই বিশাল দুনিয়ার একটা ছোট্ট অংশ নেয় আর ওইটারে যতটা সম্ভব সুন্দর বানায়া তোলে। একদলা কাদা, একটা ক্যানভাস, এক টুকরা সাদা কাগজ, বা যাইহোক…”
আমরা সবাই এখন এই মুহূর্তটারে আর এই জায়গাটারে যতটা সম্ভব সুন্দর কইরা তুলসি।
আপনাদের তো আগেই বলসি, আমার এক খাইষ্টা চাচা ছিল ড্যান নামে, সে বলতো যুদ্ধ হইতে ফিরা আসার আগে একটা ছেলে সত্যিকারের পুরুষ হইতে পারে না। আর আমার এক ভালো চাচাও ছিল, নাম অ্যালেক্স। সে আমারে বলতো, জীবনে যখন একটু সুন্দর মুহূর্ত আসে–তা হইতে পারে স্রেফ একটা গাছের ছায়ায় এক গ্লাস ঠাণ্ডা শরবত খাওয়ার মত মুহূর্ত–সে তখন একটু থাইমা বইলা উঠতো, “এই যদি সুন্দর না হয়, তাইলে সুন্দর কি?” উনি যদি এমনে বারবার, মাসে পাঁচবার কি ছয়বার আমাদের এইটা মনে না করাইতেন, আমরা হয়তো কখনো একটু থাইমা খেয়ালও করতাম না জীবন মাঝেমাঝে কি সুন্দর মুহূর্ত দেয় আমাদের! হয়তো আমার এই ভালো চাচা অ্যালেক্স আপনাদের কারো মধ্যে রইয়া যাবে, আর হয়তো আপনারাও মাঝেমাঝে থামবেন, আশেপাশে তাকায়া বলবেন, “এই যদি সুন্দর না হয়, তাইলে সুন্দর কি?”
তো, আমার সময় প্রায় শেষ আর আমি আপনাদের এখনও অতীতের কোনো বীরগাথা শুনায়া ইন্সপায়ার করলাম না—স্যান উয়ান পাহাড়ে টেডি রুজভেল্টের দুর্ধর্ষ আক্রমণের কথা, বা মরুঝড়ের কথা। চকচকে ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখাইলাম না—কম্পিউটার প্রোগ্রাম, আরো উন্নত টিভি, ইনফর্মেশনের ছড়াছড়ি, কবে আসবে সেই দিন! আমি এর কিছুই বললাম না। আমি আমার সময় খরচ কইরা এই মুহূর্তটারে, এই জায়গাটারেই সেলিব্রেট করলাম শুধু। এককালে আমরা যেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতাম, আজকে আইসা সেইখানেই পৌঁছাইসি আমরা। এইত্ত, এইটাই। কেমনে করলাম আমরা এতকিছু?
আমার পাশের বাসার এক ব্যাটা, সে ছিল একজন কাঠমিস্ত্রি, তারে আমি ভাড়া করসিলাম আমার লেখার জন্য L আকারের একটা ঘর বানায়া দিতে। সে ফাউন্ডেশনটা বানাইলো, তারপর সাইডের ওয়াল দিলো, আর সবশেষে ছাদটা বসাইলো। এর পুরাটাই সে একলা করসে। আর কাজটা যখন শেষ হইলো, সে একটু পিছে সইরা দাঁড়ায়া বললো, “আমি কেমনে করলাম এতকিছু?” আমরাও বা কেমনে করলাম এতকিছু? তা যেমনেই হোক, আমরা করসি তো! আর এই যদি সুন্দর না হয়, তাইলে সুন্দর কি?
আর একটা কথা যা আমি বলসিলাম বলবো, তা হইলো, আমরা আপনাদের ভালোবাসি। সত্যিই বাসি।
মাহীন হক
Latest posts by মাহীন হক (see all)
- এডগার এলান পো’র ফিকশন: ইলিয়োনোরা - মে 28, 2024
- দি ওভাল পোর্ট্রেইট – এডগার এলান পো - মার্চ 9, 2024
- গরিব যেমনে মরে – জর্জ অরওয়েল - অক্টোবর 19, 2023