ঢাবি বাসের উল্টাপথে যাত্রা: কী করব আমরা?
কয়দিন আগে ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠানটার সাবেক এক শিক্ষক এক নারীরে গাড়ি চাপা দেন। ব্যাপারটা নিয়া অনেক হাউকাউ হয়, অনেক আন্দোলন হয়, অনেক চিল্লাপাল্লা হয়। বহিরাগত প্রতিরোধ, ঢাবি ক্যাম্পাসের সুরক্ষাসহ আরো অনেকগুলা এজেন্ডা নিয়া ছাত্ররা রাস্তায় নামে। টানা কয়েকদিন চলে আন্দোলন (যদিও পরে ছাত্রলীগের হাতে এই আন্দোলনের অপমৃত্যু ঘটে, যা ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’দের ব্যানারে সংগঠিত যেকোন ছাত্র আন্দোলনের স্বাভাবিক পরিণতি)।
কয়দিন আগে এই ভার্সিটিরই বাস ‘ক্ষণিকা’র ড্রাইভার বজলু, ফার্মগেট থেকে বিজয় সরণী যাওয়ার পথে রং রুটে গাড়ি চালাইতে গিয়া এক পথচারী, আল আমিন টুটুলরে (২৪) চাপা দেয়। টুটুল হসপিটালে যাওয়ার পর মারা যায়। খবর থেকে জানতে পারি, বাসের শিক্ষার্থীরা তখন ড্রাইভার বজলুরে পুলিশে সোপর্দ করে আদর্শ নাগরিকের দায়িত্ব পালন করে।
এই ঘটনা নিয়া দেশের কোথাও তেমন কোন আন্দোলন-সংগ্রাম দেখা যায় নাই। না নিরাপদ সড়কের ইস্যুতে, না ‘ঢাবি বাসের উল্টারুটে চলা’ ইস্যুতে— কোন ইস্যুতেই কোন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ হয় নাই। কেবল ভার্সিটির কিছু বিবেকবান স্টুডেন্ট নিজেদের ফেসবুকের পাতায় নিজেদের অক্ষম প্রতিবাদ প্রকাশ করছেন; ঢাবির গ্রুপগুলায় এ বিষয়ে টুকটাক আলাপ হইছে।
ক্যাম্পাসে গাড়ির চাপায় মানুশ মরলে ঢাবি শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেন ‘বহিরাগতমুক্ত ক্যাম্পাস চাই’। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানেরই বাস যখন ক্যাম্পাসের বাইরে দূর-দূরান্তে গিয়া মানুশ খুন কইরা আসে, তখন ওই মানুশেরা কি ‘ঢাবি পরিবহনমুক্ত এলাকা’র আন্দোলন করেন বা করতে পারেন? না, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা তাদের পক্ষে কোন অবস্থান নেন? আমরা আজ অবধি এরকম কিছু দেখি নাই। স্ট্রেঞ্জ, নাহ?!
ঢাবির পরিবহন উলটা রুটে ঢুইকা পড়া এবং এর ফলে দুর্ঘটনার ঘটনা এই প্রথম না। এর আগেও বহুবার উলটা রুটে ঢুইকা পত্রিকার শিরোনাম হইছে ঢাবির বিভিন্ন পরিবহন। ২০১৭ সালের জুন মাসেও একবার, এই বিজয় সরণীতেই, উলটা রুটে ঢোকা ‘বৈশাখী’ বাসের ধাক্কায় আহত হন দুই বাইকার। কেন ঢাবির বাস উলটা রুটে ঢোকে— এটা একটা কোশ্চেন।
পত্রিকায় প্রকাশ: পথচারী টুটুল আহত হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা ড্রাইভার বজলুরে পুলিশে সোপর্দ করে। কিন্তু বজলু যখন উলটা রাস্তায় ঢুকল, তখন এই দরদী ও মোরাল শিক্ষার্থীরা কই ছিল? তখন কেন তারা বজলুরে সঠিক রুটে গাড়ি চালাইতে উৎসাহিত করল না, বা রঙ রুটে ঢোকায় চার্জ করল না? এর কারণ খুবই রহস্যময়।
এর কারণ হইল, বজলু সিম্পলি ওই শিক্ষার্থীদের চাপেই রঙ রুটে ঢুকতে বাধ্য হইছে। সমস্যাটা একটু খোলাসা কইরা বলা যাক।
দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে। নারায়ণগঞ্জ রুটের বাস ঈশা খাঁ সুদূর মেঘনা পর্যন্ত যায়। ‘ক্ষণিকা’ যায় সুদূর গাজীপুর পর্যন্ত। ঢাকা নামক দোজখটার অন্যতম প্রধান আজাব ‘জ্যাম’র ব্যাপারে ঢাকাবাসী মাত্রেরই ধারণা থাকার কথা। ফ্লাইওভারের উপরেও ঘন্টার পর ঘন্টা জ্যাম লাইগা থাকে এই শহরে। স্বাভাবিকভাবেই, যেসব শিক্ষার্থী ঢাকা পার হয়ে মেঘনা বা গাজীপুর বা একটু দূরের গন্তব্যে যান, তারা এই জ্যামের ওয়ান অব দ্য সিভিয়ার ভিক্টিমস।
এই জ্যামের কারণে বাসের ডাউন ট্রিপ বা আপ ট্রিপ প্রায়ই দেরি কইরা গন্তব্যে পৌঁছায়। এই যে দেরি, এরে মিনিমাইজ করার লক্ষ্যেই সম্ভবত এই ‘উল্টা পথে চলা’র শুরুটা। ঢাবির প্রত্যেকটা বাসে বাসে ‘বাস কমিটি’ আছে। এই কমিটি আবার মূলত ছাত্রলীগের কমিটি; এরে ‘বাস ছাত্রলীগ কমিটি’-ও বলা যায়। যেহেতু জ্যামের কারণে লেট হওয়ার মত একটা বাস্তবিক সমস্যা সমাজে হাজির, ফলে এই সমস্যারে সামনে রাইখা নিজেদের পাওয়ার এক্সারসাইজ করেন উনারা। বাস ছাত্রলীগের পাওয়ার কী? ড্রাইভারদের উলটা রুটে গাড়ি ঢুকাইতে বাধ্য করা।
আপনার বোঝা দরকার যে, ঢাবির মত একটা প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত একজন ড্রাইভারের রঙ রুটে গাড়ি চালানোর মত সাহস বা ক্ষমতা— কোনটাই নাই। মূলত জ্যামের সমস্যাটারে সামনে রাইখা বাস কমিটি ছাত্রলীগের পাওয়ার এক্সারসাইজের শিকার তারা। এই পাওয়ার এক্সারসাইজে আবার সাধারণ শিক্ষার্থীরাও সোল্লাসে সায় দেন। জ্যামের সমস্যা পুরা ঢাকার; সবাই এর ভুক্তভোগী। বাট আমরা তো ঢাবিয়ান, আমাদের আলাদা কিছু ফেভার পাওয়া উচিত না? আমাদের বাস উলটা রাস্তায় মাঝেমধ্যে তো যাইতেই পারে; কারণ ‘আমরা শক্তি আমরা বল, আমরা ডিউর ছাত্রদল (লীগের আন্ডারে)’।
তো এই যে ‘ডিউ স্টুডেন্ট প্রাইড’, এইটা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উস্কানি দেয়, বাস কমিটির এসব অ্যাকশনরে লেজিটিমাইজ করতে। ফলে যেটা হয়, জ্যামের মত একটা সিস্টেমেটিক সমস্যারে সিস্টেম্যাটিক্যালি অ্যাড্রেস না কইরা, গর্বিত ঢাবিয়ানরা তাদের বাসগুলা রঙ রুটে ঢুকায়ে দেন, মাচোগিরি দেখান এবং এর ফলাফলে পথচারীর মৃত্যু ঘটলে ড্রাইভাররে পুলিশে সোপর্দ করেন (অথচ ড্রাইভার যে উলটা পথে ঢুকছিল ছাত্রদেরই চাপে, তা একাধিক রিপোর্টে আসছে। এরকম একটা রিপোর্ট করছিল ‘কালের কণ্ঠ’, যদিও পরে, মেবি কারুর ইশারায়, তারা ওই নিউজ সরায় দিছে। প্রথম কমেন্টে স্ক্রিনশট)।
এই সমস্যা কি খালি ঢাবির? না। পত্রিকা মারফত জানতে পারতেছি যে, রাজধানীর সবগুলা পাবলিক ভার্সিটির বাস নিয়মিত এই কাজ করে। নিজেদের বাস ঢুকায়ে দেয় উলটা রাস্তায়। এতে দুর্ঘটনা ঘটে, আননেসেসারি জ্যাম হয়। একটা সিস্টেমেটিক সমস্যারে সিস্টেমেটিক্যালি অ্যাড্রেস না কইরা, পাবলিক ভার্সিটির শিক্ষার্থীরা সমস্যা জর্জরিত সড়কে আরো আরো সমস্যা তৈরিই করেন কেবল। কেন সব পাবলিকের এই অবস্থা? কারণ, প্রত্যেক ভার্সিটির বাসেই আছে বাস (লীগ) কমিটি। তারাই বাসগুলারে উলটা পথে নেয়; আর শিক্ষার্থীরা পাবলিক ভার্সিটির স্টুডেন্ট হিশাবে নিজেদের প্রাইড আর ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ সেলিব্রেট করার আশায় এতে সায় দ্যান। আর এই পুরা প্রক্রিয়াটার বলি হয় টুটুলের মত নিহত পথচারী আর বজলুর মত অক্ষম ভিলেন ড্রাইভার। মানবজীবনের কী দুর্দান্ত অপচয়!
আর সম্ভবত এ সমস্ত কারণেই, ঢাবি বাসের উলটা চলা, ঢাবি বাসের চাপায় পথচারীর মৃত্যু ইত্যাদি নিয়া কোন সড়ক আন্দোলন, ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের বিশাল বিক্ষোভ বা অন্যকিছু হয় না।
আন্দোলন সংগ্রাম তো করে ভার্সিটির ছাত্ররা। তারা দেশের ভবিষ্যত, জাতির গৌরব। তাদের দিকে তাকায়ে থাকে দেশের শত শত গরিব মধ্যবিত্ত পরিবারের হাজার হাজার চোখ। তাদেরই বাসের চাপায় যদি দুই একজন মানুশের মৃত্যু হয়, দুই একটা ড্রাইভার তাদের চাপে পইড়া যদি জেলে যায়, সেইটারে কি দেশগড়ার স্বার্থে সংঘটিত কোলাটেরাল ড্যামেজ হিশাবে, আমাদের মাইনা নেওয়া উচিত না?
জানুয়ারি ৫, ২০২৩
তুহিন খান
Latest posts by তুহিন খান (see all)
- ইনকেলাব ও নয়া ইনসান - আগস্ট 18, 2024
- সাঈদীর মামলার রায়: কিছু বিচারিক পর্যবেক্ষণ - আগস্ট 19, 2023
- ঢাবি বাসের উল্টাপথে যাত্রা: কী করব আমরা? - জানুয়ারি 7, 2023