ফিকশন: দোস্তি
- বাংলা ক্ল্যাসিক। দ্বিজ কানাইয়ের মহুয়া।
- সুলতানার স্বপ্ন – রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
- বাংলাদেশি ফিকশন: গালিভরের সফরনামা – আবুল মনসুর আহমদ
- বাংলাদেশি ফিকশন: অগ্নিগিরি – কাজী নজরুল ইসলাম
- বাংলাদেশি ফিকশন: নেড়ে – সৈয়দ মুজতবা আলী
- শাহেদ আলীর গল্প – ঐ যে নীল আকাশ
- বই থেকে: একটি নীল বোতাম – হুমায়ূন আহমেদ
- ফিকশন: দেশ নাই
- ফিকশন: দোস্তি
১.
পায়রার পুব পাড়ে, তিতকাটা নামের গেরামটা পছন্দ হইলো রেজন মিরার বাপের। তাছাড়া নৌকায় আর কতো দিন! শেই মুর্শাদাবাদ থিকা পানিতে, পেরায় ১ মাশ কাটলো, এর ভিতর কোথাও তেমন ভিড়তে পারলো না, পছন্দ হয় না ঠিক! তিতকাটাও জে খুব পছন্দ হইছে, তা না; কিন্তু এইবার মাটিতে নামা দরকার মনে হইলো তার; আর নৌকায় বইশাই জাইল্লাদের থিকা তাজা ইলিশ কিনা দুপুরের ভাত খাইতে খাইতে রেজন মিরার বাপের মনে হইলো–কিশের কি পদ্দা, এই পায়রার ইলিশই তো মনে হইতেছে শবচে বেশি ভালো লাগলো! পোলার কাছে জিগাইলো, রেজন মিরাও কইলো, হ, ভালোই তো লাগতেছে! রেজন মিরার মায়ের দিকে নজর ফিরাইতে শে কইলো, খাই নাই এখনো, তবে রানতে রানতে কড়া ঘেরান পাইছি, মাছটায় তেলও আছিলো জব্বর!
আর কিছু দিন মুর্শিদাবাদে থাকলে হয় খয়রাত করতে হইতো বা না খাইয়া মরা লাগতো! পলাশির জুদ্ধের পরে পেরায় ১২০ বছর পার হইছে, এতো দিনে মির বংশের লোকেরা পেরায় শবাই চইলা গেলো কোন কোন দিকে, খালি রেজন মিরার বাপেই থাইকা গেছিলো! কামাই আছিলো না কোন, কোন মতে খাইয়া পইরা আছিলো, ব্যবশা আছিলো কাপড়ের, ঐটা খতম; একে তো কলের কাপড়, তার উপর মুর্শিদাবাদ নামের ঐটা তখন একটা গেরাম, শহর চইলা গেছে কলিকাতায়। তার বাপ-দাদার আমলের কিছু শোনাদানা, আর বাড়িটা আছে। শোনা বেইচাই খাইতেছিলো, কিন্তু অমনে জে টিকতে পারবে না, শেইটা বুঝতেছিলো ভালোই!
তাই একদিন বউ, ৩ পোলা, বড়ো পোলা রেজনের বউ, ধর্ম মাইয়া আর জামাইরে লইয়া একটা নৌকায় উইঠা পড়লো রেজন মিরার বাপে। বাড়িটা বেচলো, বাকি শোনাদানাও শব এক লগে বেইচা দিলো। একটা নৌকা কিনলো। ধর্ম মাইয়ার জামাই নৌকার কাজকাম পারে; হাড়িপাতিল, পাটা-পুতা শব নৌকায় তুইলা অজানায় রওনা দিয়া দিলো। অল্প কিছু টাকা রাইখা বাকিটা দিয়া চাল-ডাল-লাকড়ি কিনলো, আর কিনলো কতগুলা কলের কাপড়, একটা শদাগরি নৌকা জেনো, কাপড়ের ব্যবশা করে–এমন একটা পরিচয় ঠিক কইরা পাল তুইলা দিলো নৌকায়! ধর্ম মাইয়ার জামাই হাল ধরলো, নৌকা টানলো পালে। ২/৩ দিনের ভিতর রেজন মিরা আর তার বাপেও নৌকার খুটিনাটি শিখা নিলো জামাইর কাছে।
এমনেই ভাশতে ভাশতে এই তিতকাটা। এই দুর ভিনদেশে কেমনে নিজের ঠাই গাড়বে, ভাবলো রেজন মিরার বাপ। আখেরে বেশি কঠিন হয় নাই। হাটে পরিচয় হইলো তিতকাটার পাশের গেরামের করিম দফাদারের লগে। কথার টানে এমনিতেই বোঝা জাইতেছিলো; তার লগে নিজেই কইলো, আমি মোটামুটি বিদেশি; ওদিকের মাল এদিকে, এদিকের মাল ওদিকে বেইচা শদাগরি করার খায়েশ মনে। তাই এদিকে একটা বাড়ি করতে চাই, পরিবার এইখানে রাখতে চাই। আমারে এক টুকরা জমিনের বন্দোবস্ত কইরা দেন।
কথা দিলো দফাদার। জমিন আছে জানাইলো, চাইলে এখনি লইতে পারে! রেজন মিরার বাপ তাড়াহুড়া করলো না, ৮/১০ দিন পরে আশবে জানাইলো। তবে জমিটা দেখতে চাইলো। দেখা গেলো, পায়রায় জেইখানে নাও ভিড়াইছে তার, শেই বরাবরই জমিটা! দফাদারের কাছে বিদায় লইয়া নৌকায় উঠলো রেজন মিরার বাপ। তারপর দিন ১২ পানিতে পানিতে ঘুরলো, আরো শামনের দিকে গেলো, আমতলির হাট করলো, গোলবুনিয়া, তালতলি ঘুইরা তিতকাটা ফিরলো আবার। এইভাবেই এই বাড়িতে রেজন মিরাদের পত্তন হইছিলো। কয় বছর পর বাপ মরলো। মা মরলো। মাঝে ঘর উঠলো, আশেপাশে আরো কিছু ধানি জমি কিনলো, নয়া ঘর বানাইয়া ভাইরা জুদা হইয়া গেলো। কেউ কিশান হইয়া গেলো, কেউ মাছ ধরতে নামলো পায়রায়।
৩০/৩৫ বছরের ভিতর রেজন মিরা তিতকাটার মাতবর হইয়া উঠলো। শদাগরি বাদ দিয়া চাশবাশ করে এখন, শালিশি কইরাও কিছু কামাই হয়, গরু-বাছুর আছে, হাশ-মুরগি, নদিতে মাছ, খোরাকি ধান, মিশ্টি কুমড়া, বাদাম, মিশ্টি আলু, নারিকেল বাগানেও ফলন ভালো। পোলা ছোবাহান বেশ তাগড়া হইয়া উঠছে, পুরা বংশে কয়েকটা তাগড়া পোলা থাকলে জমিজমার দখল রাখতে অতো মুশকিল হয় না। পুবের দিকে ধানি জমি লইয়া ক্যাচাল আছে, মাঝে মাঝে রাম দা, বল্লম, মাছ ধরার চল বইলা একটা জিনিস আছে–একটা লোহার থাবার গোড়ায় লম্বা একটা বাশ লাগাইয়া বানায়, বাশের লাঠি লইয়া হুলাহুলি হয়, কিন্তু ছোবাহানের বুদ্ধি ভালো, পুবের গেরামের ওরা ততো শুবিধা করতে পারে না। মোটের উপর, আরামেই আছে রেজন মিরা।
আফছোছ, মাঝখানে ছোবাহানের মা শরিফুন্নেছা মইরা গেল! ২ মাইয়া আর ১ পোলা হইছে তার পেটে। মুর্শিদাবাদের খান্দানি ঘরের মাইয়া, দুধে-আলতা গায়ের রঙ, হাতের রগের ভিতর রক্তের চলাচল দেখা জায়; জেনো ইরানি কার্পেটের ভিতর ঢুইকা নগদ নগদ চালান হইয়া আশছে!
ছোবাহানের মা মরার পরে দুইটা বিয়া করলো রেজন মিরা, কিন্তু শেই খান্দান আর পাইলো না। ছাহেরার মায়রে দিয়া বউয়ের কাম চলে কদ্দুর, কিন্তু রেজন মিরার মনে পিরিতি গজাইলো না আদৌ! মেজাজ খাপ্পা হইয়া থাকে পেরায়ই। এমনও হইছে জে, দুপুরে খাইয়া ঘুমায় রেজন মিরা, মোরগের ডাকে ঘুম ভাংলো, অমনি ছাহেরার মায়রে ডাইকা পিটানি শুরু করলো; মোরগের ডাক কেন তার কানে ঢুকবে, দেইখা রাখে নাই কেন! ছাহেরা তবু একটু শ্যামলা হইছে, পরে পেরায় কয়লার মতো কালা একটা পোলা হইলো। বাচ্চা হবার ধকলের লগে রেজন মিরার মাইর মিলাই বুঝি ছোট ছোট পোলা-মাইয়া রাইখা মইরা গেলো ছাহেরার মা! তবে আরেক বউ থাকলো, শেই ঘরে হইলো আরেক পোলা আর ১ মাইয়া। পরে আরো কি কি হইতে পারতো, শেইটা বোঝার উপায় নাই; একদিন দেখা গেলো, দুপুর বেলা মোরগ ডাকলো, কিন্তু রেজন মিরার ঘুম ভাংলো না, বিকাল গড়াইলো, উঠলো না তবু! মাগরিবের আগে আগে খালেকের মা ছোবাহানরে জাইয়া কইলো, ছোবাহান বাপের গায়ে হাত দিয়াই বুঝলো, ঘুমের ভিতরই আখেরি দম ছাড়ছে রেজন মিরা।
২.
রাইত পেরায় ১২ টা, গেরামে অনেক রাইত। ঘুমাইয়া পড়ছিলো ছোবাহান মিরা। কিন্তু কাচা ঘুমটা ভাংলো কাদের মুনশির ডাকে। ছোবাহান মিরার ঘরের বাইরে থিকা ডাকলো কাদের মুনশি, ‘মিরার পো, ঘুমাইছো?’ কয়েকবার ডাকার পরে শাড়া দিলো ছোবাহান মিরা। মুনশি তখন কয়, ‘একটু নিচে নামবা? জরুলি ২ খান কথা আছিলো।’
দোতলা টিনের ঘরের দোতলায় ঘুমায় ছোবাহান মিরা, রাইতে বাইরে নামে না। খাটের নিচে রাম দা, বল্লম আছে; নিজের জানের ব্যাপারে হুশিয়ার ছোবাহান, তাই দোতলা থিকাই কাদের মুন্সিরে কইলো, ‘তুমি কও, শুনতেছি আমি।’ কিন্তু মুন্সি তারে নিচে নামতে কয় আবারো!
অমনেই চলতে থাকলো কতোখন; উপর থিকাই ছোবাহান মিরার মনে হইলো, কাদের মুনশি একলা না! ছোবাহান গলা চড়াইলো; তার ঘরের পুব পাশে আর ৩ টা ঘর, ছোবাহান মিরার চাচা, চাচাতো ভাইদের; ছোবাহান মিরা আশা করতেছে, একটু বেশি শব্দ হইলে তার চাচাতো ভাই আর ভাইপুতেরা জাগবে। ছোবাহান মিরার শন্দেহ হইতেছে কাদের মুনশিরে। আশল ডরের ব্যাপার হইলো, ঘরে জদি আগুন দেয়, তাইলে খবর আছে! ডাক-চিক্কুরে পাশের ঘরগুলায় ঘুম ভাংছে আশলেই, কয়েকটা হারিকেন উশকাইছে, ঘরগুলার ভিতর থিকা আলো বাইরাইতেছে হালকা। এর পরে পরেই পাশের ঘরগুলা থিকা চিক্কুর শোনা গেলো–এই, কেডা? এতো রাইতে কি, কালকে দিনে আইশো!
কতোখন পরে ছোবাহান মিরার মনে হইলো, নিচে কেউ নাই। ডাক দিলো– কাদের, এই মুনশির পুত? শাড়া দিলো না কেউ।
পর দিন শকালে ঘটনা আন্দাজ করতে পারলো ছোবাহান মিরা। পুবের গেরামে তার দোস্ত ওদুদ খুন হইছে কালকে রাইতে, আন্দাজ ১১টার দিকে! এক রাইতেই মামলা খালাশ করতে খুনিরা কাদের মুনশিরে দিয়া ছোবাহান মিরারে ডাকাইছে!
দোস্ত হইলেও ওদুদের বয়শ বেশি না, ছোবাহান মিরার পোলার বয়শি। তবে দোস্তিটা জতো না পেয়ারের, তারচে বেশি খমতার, পলিটিক্সের। তাই পয়লা লোকশানটা খমতার। কিন্তু ওদুদের মরন ছোবাহান মিরার মনে লাগলো খুব; তার মনে হইলো, তার ভাইগ্না ফারুক মরলে জেমন লাগতে পারতো, তেমন লাগতেছে। তবে আফছোছের চাইতে রাগ হইলো বেশি; ওদুদরে হুশিয়ার থাকতে কইছিলো, কিন্তু তাগড়া পোলা পাত্তা দেয় নাই। কিন্তু ওদুদরে খুন করছে, তার বাড়িতে আশছে তারপর, রাগে কথা কইতে পারতেছে না ছোবাহান মিরা। কছম খাইলো, ওদুদের রক্ত কড়ায়-গন্ডায় উশুল করবে শে।
ছোবাহান মিরা জানে, বাইচা থাকা শোজা ঘটনা না কোন! তার বাপ বা শে নিজে, বাচার জন্ন কম কিছু তো করলো না! আবার বাইচা জদি থাকাই জায়, তাইলে ছেরেফ বাইচা থাকাটাই কাফি হয় না! আরেকটু ভালো বাচতে মন চায়, শেইটা এমনকি বাইচা থাকার চাইতেও কঠিন! ছোবাহান মিরা জানে, শে বাচবে। কিন্তু আরেকটু ভালো বাচতে ওদুদের খুন উশুল করতে হবে তার। মরা ওদুদের জন্ন জতোটা, তারচে বেশি নিজের জন্ন, নিজের পোলা কয়টারও নাইলে মরতে হবে!
বাচার জন্নই তার বাপে মুর্শিদাবাদ ছাড়ছে। বাচার জন্ন ছাড়তে রাজি থাকতে হয়, ছোবাহান মিরা জানে।
মুর্শিদাবাদ ছাড়ার পরেও কিছু দিন ঘরের ভিতর, নিজেদের ভিতর উর্দুই চলতো তাদের। রেজন মিরা জখন ছাহেরার মায়রে বিয়া করলো, তারপর থিকাই ঘরে উর্দু মোটামুটি বন্ধ হইয়া গেলো। পরের বউ ঘরে ঢোকার পরে উর্দু পুরাই বন্ধ! ছাহেরা বা ছোবাহানের পরের ভাইবোনেরা উর্দু জানেই না, বাংলায় কথা কয়। মুর্শিদাবাদেও ছোবাহানেরা বাংলায় কথা কইতো, তবে বাইরেই বেশি, ঘরে উর্দুই চলতে পারতো। তিতকাটায় আইশা ছাড়তে হইলো। উর্দু এখন ছোবাহান মিরার মনেও পড়ে না পেরায়!
খালি উর্দু না। রেজন মিরার পরের দুই বউ’র মামলা তো আছেই, তিতকাটা আইশা রেজন মিরা নিজের শিয়া পরিচয় লুকাইয়া ফেললো পুরা। গেরামের শবাই ছুন্নি, উজানের দিকে, শুবিদখালির ইয়ারউদ্দিন খলিফার দরগায় জায় গেরামের অনেকেই, ঐ পির শাহেবরেও শবাই ছুন্নি হিশাবেই চেনে! বা শিয়া নাকি ছুন্নি, ঐ ব্যাপারে মাথাই ঘামায় না কেউ। তিতকাটায় শবাই একই কিছিমের মোছলমান, কিন্তু তারা জে হানাফি ছুন্নি, এইটা তারা নিজেরাও জানে না, আর কিছু জে হওয়া জায়, আছে দুনিয়ায়, ঐটাও পেরায় জানে না! রেজন মিরা তিতকাটা আইশা শিয়া থাকার বদলে মোটামুটি তিতকাটার রঙেই নিজেরে বানাইয়া লইলো। পরের দুই বউও ছুন্নি, রেজন মিরাও নাক গলাইলো না, বরং তারে শিয়া হিশাবে কেউ চিনতে পারে, তেমন নিশানাগুলা মোটামুটি শরাইয়া ফেললো!
আর খান্দান, খান্দানের দেমাগ তো ছাড়তেই হইলো! রেজন মিরার পরের দুই বিয়ার ঘটনায় খান্দান দেখার উপায় আছিলো না।
নিজের বিয়ার কথা ভাবে ছোবাহান মিরা। বাপের চাইতে নিজে আরেকটু বেশি মাইনা নিতে পারছে। একটাই বিয়া করছে শে, তিতকাটার পুবে, পায়রা দিয়া জেই ছোট নদিটা গুলিশাখালি দিয়া পুবে ঢুকছে, ঐটা দিয়া আরো আগাইলে মরিচবুনিয়া। শেই মরিচবুনিয়ার মির্ধা বাড়ি বিয়া করছে ছোবাহান মিরা। মরিচবুনিয়ারে ডাকাতের গেরাম নামে চেনে শবাই। ছোবাহান মিরা খবর দিলে ২/৩ ঘন্টার ভিতর ৫০ জন পালোয়ান-লাঠিয়াল হাজির হবে মরিচবুনিয়া থিকা!
ঐ একটা বিয়া কইরাই পারছে ছোবাহান মিরা, বাপের মতো মারেও না বউরে। ঐটা বাপের চাইতে একটু ভালো হবার কারনেও হইতে পারে, আবার শশুরবাড়িরে একটু ডরাবার কারনেও হইতে পারে, ছোবাহান মিরা নিজেও জানে না! ছেরেফ এইটাই জানে জে, বিয়াশাদির মামলা খতম তার, এখন বরং আর শব মামলায় বিজি রাখতে হবে নিজেরে!
এবং বাস্তবেই শে ঘুঘুর মতো ধুরন্ধর একজন মামলাবাজ হইয়া উঠলো! তার নামে পটুয়াখালি আদালতে মামলা করলো কাদের মুনশির বাপে, ধান কাইটা লইয়া জাবার ডাকাতি মামলা। পরে মিলমিশ হইছে। কিন্তু তার আগে ছোবাহান মিরা আদালতে দরখাস্ত দিলো জে, শে ঢাকায় থাকে, মামলাটা ঢাকার আদালতে পাঠাবার আর্জি জানাইলো! মামলার তারিখে ছোবাহান মিরা ঢাকায় জায়, ছোট ভাই খালেকের বাশায় আরামে থাকে। আর কাদের মুনশির বাপে তো তারিখে তারিখে ঢাকায় জাইতে পারে না! পর পর কয়েকটা তারিখে বাদি গরহাজির থাকার পরে মামলাই খারিজ কইরা দিলো আদালত!
তবে নিজের ব্যাপারে জেইটাই করুক, বোনগুলারে শে একটু দুরে, লেখাপড়া করা পোলার কাছে বিয়া দিতে চাইছে। তিতকাটা বা আশে পাশে বিয়া দিতে রাজি হয় নাই। ওদুদ খুন বা তারেও জে খুন করতে আশলো, তিতকাটা বা আশে পাশে বিয়া দিলে হয়তো তার খমতা আরো বাড়তো, খুনিরা শাহশও পাইতো না এতো! ওদুদের গেরাম থিকাই ছাহেরার পয়গাম আইছিলো, কিন্তু ছাহেরার বিয়া শে দিলো আমতলিতে; তাও আবার পোলার বউ আছে আরেকটা! লেখাপড়া করা পোলা, বংশের শুনাম আছে ভালো, মারামারি-কাটাকাটির ভিতর নাই একদম। ছাহেরার চেহারা-ছুরতও ভালো না ততো, শ্যামলা। শৎ বোন না হইলে কি ঐখানে বিয়া দিতো ছোবাহান মিরা? তবে ছাহেরার জেই চেহারা-ছুরত, তাতে জে খুব ভালো বিয়া দিতে পারতো, তাও মনে হয় না! শিয়া ঘর তো পাইতোই না, ভালো খান্দানও পাইতো না মনে হয়!
কিন্তু ছোবাহান মিরারে ঐ ব্যাপারে অনেক দোশ দেবার উপায় নাই, নিজের মাইয়ারেও এমনকি খুব ভালো বিয়া দেয় নাই শে! মাইয়ার বিয়া দিতে হইছে পায়রার পচ্চিম পাড়ে, আয়লা-পাতাকাটায়! আর কোন উপায় আছিলো না আর কি!
তখন পর পর ৪/৫ বছর ডাকাতি হইলো মিরা বাড়িতে। পায়রার ওপার থিকা, আয়লার ডাকাত গেরাম থিকা ডাকাতেরা আশে, হাড়ি-বাটি-পাটা-পুতা থিকা তোশক বালিশ, শব লইয়া জায়! তখন ঘরটাও ততো ভালো আছিলো না, ছোবাহান মিরা বেদিশা হইয়া পড়লো বেশ!
তারপর পায়রার ওপাড়ে ফজু খন্নারের লগে দোস্তি পাতাইলো, তার এক কুটুমের লগে নিজের মাইয়ার বিয়া দিলো ছোবাহান মিরা! পোলার কিছু লেখাপড়া আছে, কিন্তু চেহারা-ছুরত পুরাই কালি! আর শিয়া-ছুন্নির চিন্তা তো কবেই পুরা বাদ দিছে। ঐ বিয়ার পরে ডাকাতি থামলো!
তবে আয়লার থাবা থিকা পুরা রেহাই পাইলো না! আমতলিতে বোন ছাহেরার বাড়ি থিকা ৫ টা গরু চুরি হইলো এক রাইতে! পরে খোজ খবর কইরা ছোবাহান মিরা জানলো জে, গরু নিছে আয়লার চোরেরা! পরে চোরেরা মাফ চাইছে বটে; ছোবাহান মিরার বোনাই বাড়ি জানলে নাকি চুরি করতো না ঐ বাড়িতে। তবে গরু ৫ টা পাওয়া গেলো না, ২টা পাওয়া গেলো, বাকি ৩ টা ততদিনে বেইচা দিছে চোরেরা। পরে আরেকটা কিনা দিলো, বাকি দুইটা তাগো খরচ হিশাবে ধরতে কইয়া মাফ চাইলো!
কিন্তু বিয়া এমন একটা জিনিশ জে, শব শময় হিশাবে কুলায় না! মিরা গুশ্টির শবচে কালা বউটা আশছে অমনই এক হিশাবে ঝামেলা হওয়ায়! পায়রার আরেকটু উজানে, কাকড়াবুনিয়ায় বিয়া ঠিক হইছিলো ছোবাহান মিরার এক চাচাতো ভাইর। একটা বজরা নাও চইড়া ৩০/৩৫ জনের একটা দলের বর পক্ষ গেল বিয়া করতে। কনের বাড়ির শামনে নাও ভিড়াইয়া চরে নামলো, কনে পক্ষের লোকজন আশলো। তারপর তো ছোবাহান মিরার আরেক চাচাতো ভাইর লগে কনে পক্ষের একজনের তামশা করতে করতে পুরা মারামারি লাইগা গেলো! দুই পক্ষের বাকিরাও হাত লাগাইলো, পরে বিয়াই ভাইংগা গেলো!
তারপর তারা খালে-নদিতে ঘুইরা ঘুইরা কনে খুজতে শুরু করলো! বিয়া করতে নামছে, বউ লইয়া জাইতে হবে, নাইলে তো ইজ্জতের ফালুদা হইয়া জাবে! নদি-খালের পাড়ে দোকানপাট-হাটবাজার দেখলে নাও ভিড়ায়, নাইমা লোকজনের লগে আলাপ করে, শাবালক মাইয়া আছে কিনা খবর লইবার চেশ্টা করে! অমনে ঘোরাঘুরির ৩ দিনের মাথায় এক মাইয়া পাওয়া গেলো, কালা একটা মাইয়া, কিন্তু উপায় নাই! শেই মাইয়ারেই বিয়া কইরা বউ লইয়া বাড়ি ফিরলো তারা! ছোবাহানের চাচাতো ভাই’র শেই দুক্খো এখনো ঘোচে নাই!
নিজের ৪ পোলার বিয়া লইয়া ভাবে ছোবাহান মিরা। একটু হিশাব কইরা বিয়া করাইতে হবে, মারামারি শে করতেই পারে, দরকারে মামলাও, ওগুলায় আশপাশের কেউ পারবে না, কিন্তু মারামারির চাইতে শান্তি ভালো, আপোশ খুব পছন্দ ছোবাহান মিরার; ভাবে শে, শমঝোতাই আশলে চালায় দুনিয়ারে! কিন্তু দুর্বলের লগে শমঝোতা করে না কেউ, ওদুদের খুনের বদলা লইতে না পারলে তার লগে কারো শমঝোতার দরকারই বা কি আর!
৩.
ওদুদের খুনিদের চেনে ছোবাহান মিরা। মানে ওদুদ আর তারে কারা মারতে চায়, তা তো জানাই। তিতকাটা আর পুবে ওদুদের গেরাম, গুলিশাখালি মিলাইয়া ১৭ জনের নাম ভাবলো ছোবাহান মিরা। এই ১৭ জনের কেউ এখন বাড়িতে নাই, ১০০% শিওর শে। তবু কনফাম হইতে ৪/৫ জনরে তালাশে পাঠাইলো। ঘন্টা দেড়েকের ভিতরই তারা আইশা জানাইলো, ১৭ জনের একজনরেও বাড়িতে পায় নাই তারা।
ওদুদের ভাই থাকে আমতলি, ও আশলো, ওরে লইয়া ছোবাহান মিরা পটুয়াখালি রওনা দিলো। মামলা দিলো থানায়, আশামি করলো ১৬ জন, কাদের মুনশির নাম দিলো না, শে জে ছোবাহান মিরারে রাইতে ডাক দিছিলো, পুরাই চাইপা গেলো ব্যাপারটা!
পুলিশ আশলো, ওদুদের লাশ লইয়া গেল। রাম দার কোপে পুরা গতর ফালাফালা, একটা কান পইড়া গেছে, মাথা দুই ভাগ হইয়া আছে, ঘিলুও। পিঠে, পায়ে, রানে অনেকগুলা কোপ, মাংশ ঝুইলা আছে, হাড্ডি দেখা জাইতেছে।
ছোবাহান মিরা পরের পেলান শাজাইতে বশলো মনে মনে।
৪.
কাউকেই ধরতে পারলো না পুলিশ, শবাই পালাইয়া আছে, বাড়িতেও ফেরে নাই কেউ। মাশ তিনেক পরে মামলায় চার্জশিট দিলো পুলিশ। কাদের মুনশি মামলায় নাই, কিন্তু শেও ফিরলো না বাড়িতে।
এর মাঝে ছোবাহান মিরা একদিন কাদের মুনশির বাড়িতে জাইয়া হাজির। তার বউ পোলামাইয়া পুরা শাভাবিকভাবেই তারে বশাইলো। শরবত দিলো, আর মুড়ি-বাদাম। মুড়ি-শরবত খাইলো না ছোবাহান মিরা, কয়েকটা বাদাম খুইটা খাইলো। বাদাম খাইতে খাইতে আলাপ শুরু করলো। কাদের মুনশির পোলার বয়শ ২৩/২৪, ছোবাহান মিরার এক পোলার লগে ইশকুলে পড়ছে এই পোলা। ঐ পোলারে কইলো, তোমার লগে দুই খান কথা আছিলো বাবা। চলো শামনের ঐ গাছতলায় জাই, ঘরের ভিতর আলাপ করতে চাই না।
পোলা, মানে ছগির মনে হয় একটু ডরাইলো, আমতা আমতা করা শুরু করলো। বাড়িতে ছোবাহান মিরা একলাই ঢুকছে, কিন্তু ওদিকে শাংগপাংগ আছে কিনা, বুঝতেছে না কাদের মুনশির পোলা!
হাশলো ছোবাহান মিরা। কইলো, তুমি আমার পোলার মতো বাবা, তোমার বাপেরে দিয়া তোমার হিশাব করি না আমি। ডরাইও না।
পরে দুইজনে গাছতলায় জাইয়া খাড়াইলো, বাড়ির উঠানের পরেই, আর বেশি দুরে টানলো না ছোবাহান। খাড়াইয়া কইলো, ওদুদের খুনের পরে রাইতে আমারে জাইয়া ডাক দিছিলো কে, জানো তুমি? ছগির কইলো, না। মিরায় কইতে থাকলো–আমারে ডাক দিয়া বাইরে নামতে কইছে তোমার বাপে! কিন্তু দ্যাখো, তারে কিন্তু আশামির লিস্টিতে ঢুকাই নাই আমি।
মাথা নিচা কইরা চুপচাপ খাড়াইয়া থাকলো ছগির। হজম করার একটু টাইম দিয়া ছোবাহান মিরা কইলো–তোমার বাপেরে খবর দাও। তারে জানাও জে, এই ব্যাপারে কিছুই করবো না আমি, জদি আমারে শে একটুখানি মদদ দেয়! তার লগে আমার হিশাবের খাতা কাইটা দিবো আমি, আমার লগে গোপনে দেখা করতে কও তারে। তোমার লগে কছম খাইলাম, আমি জদি কথা না রাখি, তাইলে জেনো আমার পোলা জসিমের মরা মুখ দেখতে হয়!
তার ৭ দিন পরে ছগির আশলো ছোবাহান মিরার কাছে। জানাইলো, পরদিন শন্ধার পরে পায়রায় জে চর পড়ছে, ঐখানের ছৈলা গাছের বনে থাকবে তার বাপ।
পরদিন বিকাল বেলায় একটা নৌকায় শওয়ার হইলো ছোবাহান মিরা। জশিমরে কইলো, ছগিররে লইয়া ছৈলা গাছের চরে জাইতে, পরে কাদের মুনশিরে লইয়া নৌকায় দিয়া জাইতে হবে। আগে ভাগে কিছু জানাইতে মানা কইরা দিলো, তার নৌকা একটু দুরে কই থাকবে, ঐটা জানাইয়া রাখলো জশিমেরে।
পরদিন শন্ধার পরে ভালোয় ভালোয় ছোবাহান মিরার নৌকায় উঠলো কাদের মুনশি। ছোবাহান মিরা তার লগে দিল খোলা আচরন করলো। দুই ভাইপোরে আইনা রাখছে নৌকায়, ওদের কইলো, পান-তামাক দিতে।
পরে কাদের মুনশিরে জিগাইলো ছোবাহান মিরা, কে কই আছে? মুনশি জানাইলো, তারে আশামি না করায় শবাই তারে শন্দেহ করতেছে। তাই পুরা জানে না শে! লগে কইলো–আমারে ওরা আটকাইয়া ফেলছিলো, না আইসা পারি নাই! আমি কিন্তু নিজের ইচ্ছায় জোগ দেই নাই, ওদুদের ঐখানে আমি আছিলামও না!
হাশলো ছোবাহান মিরা, জবাবে কইলো না তেমন কিছু। পাল্টা জিগাইলো, এখন ওদের পেলান কি, চার্জশিটের পরে?
কাদের মুনশি কয়, আমারে কিছু জানায় না ওরা, মিরার পো! গুলিশাখালির জব্বারের পোলার কাছে ছগির নাকি শুনছে জে, শুক্রবার রাইতে ফজরের আগে আগে শবাই লন্চঘাটে দেখা কইরা ভোর রাইতের লন্চে পটুয়াখালি জাইয়া আদালতে হাজির হবে। উকিল-জজ নাকি রেডি, জামিন পাইয়া জাবে শবাই! শুক্রবার শন্ধার পরে শবাই বাড়িতে ফিরা বউ-বাচ্চার লগে দেখা কইরা এক লগে লন্চে উঠতে চায় তারা।
বেশি কিছু জানার দরকারও নাই ছোবাহান মিরার; এই কথাটাই জদি ঠিক হয়, তাইলেই হবে। আর বেশি আটকাইয়া রাখলো না কাদের মুনশিরে, তার পোলায় আর কিছু ভাবা শুরু করতে পারে। তারে পালাইয়া থাকতেই কইলো; নিজের আন্দাজ জানাইলো, বাকিরা ধরা খাবার আগে কাদের মুনশি বাড়িতে ফিরলে ঝামেলায় পড়তে পারে শে। লগে কইলো, তুমি পড়শি আমার, আমি কিছু করছি, তুমিও কিছু করছো, আগামিতে আর বাইড়ো না, পুরানা কথা আমি ভুইলা গেলাম, তুমিও ভুইলা জাও! শান্তি একটা দামি জিনিশ, আমার শান্তি ঠিক রাখো, তোমার শান্তিও ঠিক থাকবে। মনে রাইখো।
শুক্রবারের আগে ছোবাহান মিরা একদিন গেলো মরিচবুনিয়া, আরেকদিন আয়লা। পরে শুক্রবার রাইত ৯ টায় বড়ো একটা নৌকায় মরিচবুনিয়া থিকা উঠলো ২৫ জন, ১১ টায় নৌকাটা আয়লা ঘাটের একটু উত্তরে ভিড়লো, আগে থিকাই রেডি ২৫ জন উঠলো নৌকায়। কেন কই জাইতেছে, কেউই কিছু জানে না।
নৌকাতেই একটা গরু জবাই হইলো, ছোট্ট একটা খাশিও জবাই হইলো, ৫/৬ জন হিন্দু আছে দলে। আর পায়রার ইলিশ। এর লগে মহুয়া। তালতলির রাখাইনরা এইটা বানায়, কড়া মাল! পায়রার মাঝখানে একটা ডুবা চরে নৌকা থামাইলো মাঝি, রাত আড়াইটার দিকে নৌকাতেই ভরপেট খাইলো শবাই। রাত ৪ টায় নাও ভিড়লো ছোবাহান মিরার বাড়ি বরাবর। ছোবাহান মিরা নৌকায় উঠলো, শবাই-ই চেনে তারে।
নৌকা ছাড়লো, ইন্জিন বন্ধ, বৈঠা বাইয়া লন্চঘাটের দিকে চলতে শুরু করলো। ছোবাহান মিরা খাড়াইয়া কইতে শুরু করলো–লন্চঘাটে একটা ঘর আছে, ঐখানে ১৫/১৬ জন লোক থাকবে। আমরা জাইয়া ঐটা ঘিরা ফেলবো। নৌকায় শবার জন্নই রাম দা আর দড়ি আছে। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই শবাইরে বাইন্ধা ফেলবো আমরা। আগেই কেউ মারবা না কাউকে, আগে বাইন্ধা ফেলতে হবে। বান্ধার পরে কি করতে হবে, কইতেছি আমি পরে। শবাই বুঝতে পারছে কিনা, জিগাইলো।
আরো কইলো, ‘লন্চ আশার কথা শাড়ে ৫ টায়। আমরা ৪ টা ৫০ মিনিটে ঢুকবো। পরেও কেউ আশতে পারে। ৫ জন কইরা দুইটা গুরুপ ঘাপটি মাইরা থাকতে হবে ঘাটে ঢোকার রাস্তায়।’ তারপর আয়লা আর মরিচবুনিয়ার দুইটা গুরুপ বানাইয়া দিলো ছোবাহান মিরা। কেউ আশলে ধইরা বাইন্ধা ঘাটের ঘরে থুইয়া আবার জাবা।
আখেরে জোগ করলো–বাকি ৪০ জন ঢুকবে ভিতরে। শবাই মুখে গামছা বাইন্ধা লও। আর শবচে বেশি খেয়াল রাখবা, রেগুলার জাত্রি কেউ থাকলে তোমাদের চেহারা জেন না দ্যাখে তারা! ভিতরে হেরিকেন থাকলে নিভাইয়া দিবা। টর্চ ধরবা নিচে, নিজেদের কারো গায়ে জেনো টর্চের আলো না পড়ে!
কয়েকজন উশখুশ করতেছিলো। ইশারায় জিগাইলো ছোবাহান মিরা, কিছু কইলো না কেউ।
পরে ৫ জনের আরো একটা গুরুপ বানাইলো শে। লগে কইলো, বান্ধার পরে রেগুলার জাত্রিদের বাইর কইরা নদির পাড়ে লইয়া জাবো আমরা। এই ৫ জন পাহারা দিবা। আর টাইমের হিশাব রাখবা শবাই, আমরা ২০ মিনিটে কাম শারতে চাই। এমনিতে ভাটার টাইম আছে, আমতলি থিকা লন্চ আশতে ৫.৪৫ বাইজা জাইতে পারে, তাইলে হয়তো আরেকটু বেশি টাইম পাওয়া জাবে।
নাও ভিড়লো চুপচাপ। একটা মাত্র টর্চ জালাইয়া শামনের জন রাস্তা দেইখা আগাইতেছে, বাকিরা আন্ধারে, আন্দাজে পা ফেলতেছে। শামনে ছোবাহান মিরা পাঠাইলো তার এক ভাইপোরে। ও চেনেও শবাইরে। নিজে থাকলো একদম পিছে। লগে রাখলো শুনিল কর্মকারের পোলারে; নিজের পোলার পরে ছোবাহান মিরা পুরা ভরশা রাখে ছেরেফ ২/৩ জনের উপর; তার ভিতর ওদুদ মরলো, এখন বাকি আছে শুনিল কর্মকার আর তার পোলা জতিন। তবে এরা হিন্দু বইলা এদের গ্যান্জামে ডাকে না শে, ছোবাহান মিরার লগে কর্মকারদের বাড়তি খাতিরের পুরা ব্যাপারটাই আশলে গোপন, জানাজানি হইলে ওরা হুদাই ঝামেলায় পড়তে পারে! পুবের গেরামের এক মোছলমান মাইয়া আর শুনিলের বড়ো পোলা নোটন জখন ভাগলো, তখন বড়ো বিপদে পড়ছিলো শুনিল। শেই বিপদে ছোবাহান মিরা তারে বাচাইছে। নোটনরে ছোবাহান মিরা ঢাকায় ছিস্টেম কইরা দিছে, ঢাকায় ছোবাহানের ছোট ভাইর ইশকুলের দপ্তরি শে এখন! তারপর থিকা শুনিল নাপিত ছোবাহান মিরার চুল কাটে, দাড়ি ছাটে আর ছোট ছোট কথা কয়; শুনিল কর্মকারের কাছে ভালো ভালো খবর থাকে!
লন্চ ঘাটের ঘরের ভিতর তেমন কোন ঝামেলাই হইলো না। হুড়মুড় কইরা ৪০ জন ঢুইকা পড়লো, ভিতরের কেউ ভাবতেই পারে নাই এমন কিছু, পুরা বেদিশা হইয়া গেলো! ভিতরে মোট ১৭ জনরে পাওয়া গেলো, তার ভিতর বউ-বাচ্চা লইয়া তিতকাটারই এক লোক আর আরেকজন উত্তরের কোন গেরামের হবে। ভিতরে পুরুশ শবাইরে বাইন্ধা ফেললো, ছোবাহান মিরা বাইরে, জতিন আর তার ভাইপোরেও বাইরে রাখলো শে। ভিতর থিকা একজন উকি দিয়া টর্চের আলোর ইশারায় জানাইলো, বান্ধা হইছে।
ভাইপোরে ভিতরে পাঠাইলো ছোবাহান মিরা। তারপর ভিতর থিকা চেহারা দেইখা রেগুলার জাত্রিদের খুইলা বাইরে আনলো ৫ জনের ঐ দলটা। একদম নদির পাড়ে লইয়া গেলো। তারপর মিনিট দশেক চুপচাপ আন্ধারে বইশা রইলো শবাই, তার মাঝেই রাস্তায় ঘাপটি মাইরা থাকা দল দুইটা বাকি ৩ জনরে পাকড়াও কইরা ঘরের ভিতর রাইখা গেলো। ছোবাহান মিরা ঐ দল দুইটারে বাইরেই রাখলো, হুকুম দিয়া রাখলো, কেউ আশলে জেনো একদম নদির পাড়ে রাইখা আশে, ঘরে জেনো না ঢোকে।
ছোবাহান মিরা ঘরে ঢুইকা টর্চ ঘুরাইয়া শবাইরে দেখলো, হাত-পা বান্ধা, মুখও বান্ধা, মোট ১৬ জন পইড়া রইছে।
জতিনরে ইশারা করতে তার হাতের একটা পোটলা মাটিতে রাইখা খুললো। আর হাতে আরেকটা ছোট পোটলা খুললো, টর্চের আলোয় দেখা গেলো, অনেকগুলা বেলেড।
ছোবাহান মিরা কইলো, শবাই বেলেড লও, ১৬ জনের চোখ পিয়াজ কাটার মতো ফালা ফালা কইরা ফেলো। নিচের পোটলা দেখাইয়া কইলো, এইটাতে মরিচের গুড়া মাখানো বালি আছে। ফালা ফালা চোখে এই বালি ঢুকাইয়া দিবা, জিন্দেগিতে জেনো কিছু না দ্যাখে আর! পুরা আন্ধা বানাইয়া ফেলতে হবে।
অপারেশন আগাইলো ছোবাহান মিরার হুকুম মতোই। হাত-পা-মুখ এমনিতেই বান্ধা, দুশমনেরা কোন মওকাই পাইলো না। ১৬ জনরে আগে পিটাইলো আচ্ছা মতো, তারপর একেকজনরে ৩/৪ জনে ধইরা বেলেড দিয়া চোখ মোটামুটি গালাইয়া ফেললো পুরা। তারপর মরিচ মাখানো বালি দিয়া দিলো। অপারেশনের এই আখেরি পাট খতম করলো ঘড়ি ধরা ১৫ মিনিটে।
৫ টা ৩৫ মিনিটে শবাই বাইরাইয়া আশলো ঘর থিকা, ঐ ১৬ জন পইড়া কাতরাইতে থাকলো ঘরে।
নদির পাড়ে জাইয়া ছোবাহান মিরা দুরে লন্চের বাতি দেখতে পাইলো। নিজেদের নৌকার দিকে আগাইতে আগাইতে জোরে বাশি বাজাইলো ২ বার। ৫ মিনিটের ভিতর শবাই নৌকায় উঠলো, তারপর ছাইড়া দিলো নৌকা।
নদিতে বালতি ফালাইয়া পানি তুইলা হাত-মুখ ধুইলো শবাই। খেজুরের গুড়, নাকিকেল দিয়া পায়েশ রানতেছে চুলায়, কড়া ঘেরান পাইলো ছোবাহান মিরা। ইন্জিনের ভটভট আওয়াজের ভিতরই ভাইপোরে কইলো, আজান দে, জামাতে নামাজ পড়ি শবাই।
…
ফিকশনের এই বইটা কিনার ব্যাপারে জানতে নিচের লিংকে ক্লিক করেন:
https://www.facebook.com/smrkmanu/posts/pfbid0k89cG8KLqDYaFSnDtrtVz76n72bA1bwcKTQfZKbwJFJm57AKotXLbW5ZMA2GaY2Rl
রক মনু
Latest posts by রক মনু (see all)
- হিস্ট্রিওগেরাফি এন্ড পলিটিকেল লয়ালটি - অক্টোবর 18, 2024
- খলিফা হইয়া ওঠা - সেপ্টেম্বর 2, 2024
- আমাদের নিয়ত এবং বাংলাদেশের ফিউচার - আগস্ট 25, 2024