ন্যারেটিভের বাইরে সিনামার কি কোনো ফিউচার আছে? – রজার এবার্ট (পার্ট ২)
পার্ট ১ ।।
…
নতুন সিনামার এই পরিবর্তন, এক দিক দিয়া বেশ উপকারি। এই পরিবর্তন এমন এক ফিল্ম জেনারেশন তৈরি করছে যারা নতুন ফিল্মমেকারদের প্রতি ঝুঁকছে, নিজেদের ছাড়াইয়া যাইতে চাওয়া নতুন অভিনেতা এবং কমার্শিয়াল এপ্রোচ থেকে সরে আসা নতুন গল্প বলা স্ক্রিপ্টরাইটারদের প্রতি ইন্টারেস্টেড। এইটা নতুনদের জন্য হলিউড সিস্টেমের দরজা খুলে দিসেঃ সমসাময়িক সেরা ফিল্মমেকারদের মধ্যে রইসে অল্টম্যান, স্করসেইজি, ফ্রান্সিস কপোলা, মাজুরস্কি, স্টিভেন স্পিলবার্গ, জর্জ লুকাস ও জন এভিল্ডসন—১০ বছর আগেও এদের কেউ চিনতো না কিংবা ব্যবসাসফল বলে বিবেচিত হইতো না।
ডেনিস হপারের ‘ইজি রাইডার’-এর ব্যাপক সাফল্যকে ধরা হয় পুরান হলিউডের থেকে নতুন হলিউডের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্রেকিং পয়েন্ট। লোকেশনে গিয়ে ৫ লাখ ডলারের কমে সিনামা বানায়া ৪০ মিলিয়নের উপ্রে আয় করার মানে হইতেছে আগের সব নিয়ম নতুন করে লিখতে হইছে। আমার নিজের ধারণা ‘ইজি রাইডার’ হইতেছে এমন এক বিকার, যার শুরু নাই, শেষ নাই, আছে শুধু দারুণ বিনোদনমূলক মাঝের অংশ। এই সিনামাই জ্যাক নিকলসনকে প্রথমবারের মতো নন-এক্সপ্লয়টেশন সিনামার দর্শকদের সাথে পরিচয় করায় দিসে। ইজি রাইডার থেকে ইন্সপায়ার্ড প্রতিটা সিনামা ফেইল করছে (সেই সময় একটা কথা প্রচলিত ছিলো যে শহরের প্রতিটা প্রযোজকের ভাতিজা ক্যামেরা, বাইক আর ১ লাখ ডলার নিয়া মরুভূমিতে শ্যুট করতেছে)। ঐ সময়েই আরেকটা প্রভাবশালী সিনামা পাইসি আমরা, সম্ভবত ৬০’র দশকের সবচে গুরুত্বপূর্ণ আম্রিকান সিনামা— আর্থার পেন-এর ‘বনি এন্ড ক্লাইড’।
এই সিনামা একদম নতুন ফিল দিছিলো আর দর্শকদের উচ্ছ্বাস ইন্ডাস্ট্রিরে মুগ্ধ (এবং ভীত) করছিলো। কারণ “বনি এন্ড ক্লাইড” সিনামাতে দর্শকেরা এমন কিছু পাইছিলো যা আম্রিকান সিনামা এর আগে তাদের দিতে পারে নাই। এতে অভিনয় করছিলেন ওয়ারেন বেটি, যাকে সবাই ওল্ড হলিউডমার্কা ডোরিস ডে, রক হাডসন বা অন্যান্য ফুল প্যাকেজড নায়কদের মতনই ভেবে আসছিলো এতকাল। এই সিনামা আরও প্রমাণ করছিলো যে অরিজিনাল ম্যাটারিয়েল ফ্যাশনেবল ওয়েতে ইউজ করলে ফরমুলা ফিল্ম বাদেও ‘স্টার’দের ব্যবহার করা যায়। এইটার স্ট্রাকচারও ইন্টারেস্টিং— বনি এন্ড ক্লাইড শুরু হয় ট্রাজিকমেডি স্টাইলে, এরপর ডিরেক্টর এমনচভাবে সিনামারে সাজান যে প্রতিটা হাসির পর ভায়োলেন্স আসে আরও নৃশংসভাবে। শেষমেষ সিনামাটা আর মোটেও ফানি লাগে না আর একদম শেষ সিনে ডিরেক্টর এত রক্তপাত আর যন্ত্রণা দেখাইছেন যে রোমান্টিক গ্যাংস্টারের মিথে শেষ পেরেকটা গেঁথে গেছিলো।
অভিনেতাদের দিয়া পর্ব পর্ব আকারে অনিবার্য পরাজয়ের দিকে ঠেলে নিয়া যাওয়ার এই স্ট্রাকচারটা তিনি কই খুঁজে পেয়েছিলেন? তিনি অবশ্যই ডেভিড নিউম্যান ও রবার্ট বেন্টনের চিত্রনাট্যে এরকম স্টাইল পাইছিলেন, ট্রু। কিন্তু আমার ধারণা পেন, নিউম্যান বা বেন্টন (এবং স্ক্রিপ্টে কাজ করা বেটি ও রবার্ট টাউনি) সবাই এপিসোডিক স্টাইলটা খুঁজে পাইছিলেন ত্রুফো’র জুলস এন্ড জিম সিনামা থেকে। তারা ত্রুফোরে কপি করে নাই, ত্রুফোর থেকে শিখে নিছে এবং এক দশক পরে হইলেও বনি এন্ড ক্লাইডের মাধ্যমে নিউ ওয়েভরে আম্রিকাতে নিয়া আসছে। এরপর সহজ-সরল ন্যারেটিভের সিনামা আর হলিউড স্ট্যান্ডার্ড থাকলো না। বনি এন্ড ক্লাইড ৫০ মিলিয়নের উপর আয় করছিলো। যার ফলশ্রুতি নতুন প্রজন্মের একপাল ডিরেক্টর পাইছিলো আমেরিকা।
এই বিশাল বক্স অফিস কামাইকে আরও ক্লোজলি দেখা দরকার। স্পেশালি ‘ইভেন্ট সিনামা’ আসার পর থেকে। শুধুমাত্র কোয়ালিটি ভালো ছিলো বইলাই নতুন ফিল্মমেকাররা ক্রিটিকদের প্রশংসা আর স্টুডিও’র সমাদর পাইসে, ব্যাপারটা এমন না। বরং তাদের সিনামা টাকা কামাই করছে বইলাই তারা খাতির পাইছে (ইন্ডাস্ট্রির পুরাতন প্রবাদঃ “টাকা লস করবে এমন ‘ভালো’ সিনামা কেউ বানাইতে চায় না।”)। টেলিভিশনে ১ দশক কাটানোর পর অল্টম্যানের ফিল্ম ক্যারিয়ার শুরু হইছিলো ম্যা*শ দিয়া। ‘মিন স্ট্রিট’ (১৯৭৩) বের হওয়ার আগে স্করসেইজির প্রথম মাস্টারপিস ‘হু’জ দ্যাট নকিং এট মাই ডোর’ (১৯৬৯) পাত্তাই পায় নাই। এরমধ্যে স্করসেইজি পড়াইসে, এডিট করছে, ১টা এক্সপ্লোয়টেশন সিনামা বানাইসে। অনেকগুলা ফ্লপ সিনামার পর কপোলা ‘গডফাদার’ দিয়া হুলুস্থুল সাফল্য পায়। উইলিয়াম ফ্রিডকিনের বেলাতেও সেইম — হ্যারল্ড পিন্টারের নাটক থেকে বানানো বার্থডে পার্টি আর বয়েজ ইন দ্য ব্যান্ড-এর মতন লো বাজেট আর পার্সোনাল দুইটা সিনামা ফ্লপের পর ক্যারিয়ার যায় যায় অবস্থায় ফ্রেঞ্চ কানেকশন আর এক্সোর্সিস্ট দিয়া রক্ষা পায়।
এই নতুন জেনারেশন এক প্যারাডক্সের মুখোমুখি হয়। নতুন সিনেমাটিক স্বাধীনতা তারা পাইছিলো, পারসোনাল সিনামা বানানোর স্বাধীনতা তাদের ছিলো কিন্তু দিনশেষে সাফল্যের বিচার হইতো বক্স অফিসের কামাই দিয়া। নিউ ইয়র্কারের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধে কায়েল যেমন বলছিলেন, একটা সফল সিনামা, এমনকি একটা ভালো সিনামাও আর যথেষ্ট ছিল না; সর্বকালের সবচে ব্যবসাসফল সিনামার আশায় নতুন জেনারেশন প্রতিবারই ধরা খেতে যাচ্ছে বলে মনে হইতো। মাঝেমধ্যে সফলও হইতো (কপোলা’র গডফাদার, লুকাসের স্টার ওয়ার্স)। মাঝেমাঝে চেষ্টাগুলা ব্যর্থ হইতো (স্ক্রসেইজি’র নিউ ইয়র্ক, নিউ ইয়র্ক, এবং ফ্রিডকিনের সরসরার)
সবসময়-ই ২ ধরনের থিয়েট্রিকাল সিনামা হইছে (অবশ্যই নন-থিয়েট্রিকাল, এক্সপেরিমেন্টাল কাজ মানে যেগুলাকর আন্ডারগ্রাউন্ড ফিল্ম বলা হয় সেগুলা বাদে)। বহুবছর আগে, সিনামারে নিয়মিতভাবে কমার্শিয়াল সিনামা এবং আর্ট সিনামা নামক ক্যাটাগরিতে ফেলানো হইতো — যদিও আর্ট বলতে কি বুঝায় সে ব্যাপারে কারো মাথা ব্যথা ছিলো না। সাবটাইটেলসহ ছোটখাটো বিদেশি সিনামাগুলা আর্ট হাউজে দেখানো হইতো আর বড় বড় তারকা দিয়া ভরা বিগ বাজেট প্রোডাকশন দেখানো হইতো মুভি থিয়েটারে। প্রচলিত জ্ঞান ছিলো যে আর্ট থাকে ছোটখাটো সিনামায় আর বিনোদন থাকে বড় সিনামায়।
আর এখন? টেলিভিশন যখন রুটিন বিনোদন দিচ্ছে, সেরাদের সেরা ফিল্মমেকাররা ওপেনলি কমার্শিয়াল প্রোজেক্টে কাজ করছে (যত ভালো কাজ-ই হোক না কেন) তখন ফিল্মের মার্কেটপ্লেস কি টুকরা টুকরা হইতেছে না? সবই সিনামারেই কি হিউজ টাকা কামাইতে হবে? তবে কি টাকা কামানোই সফলতার একমাত্র ক্রাইটেরিয়া?? ১৫ মিলিয়ন আয় করা কাজিন, ক্যুজিন-এর মতন পপুলার না হইলে কি সাবটাইটেল-আলা বিদেশি সিনামারা (এদের এখন আর ‘আর্ট ফিল্ম’ বলা হয় না) হল পাবে না???
ফিল্ম ক্রিটিক হিসেবে এইদেশে মুক্তি পাওয়া সব সিনামাই দেখা লাগে আমার। কমার্শিয়াল সিনামার বাইরে আমদানি করা সিনামাগুলাও কান, নিউ ইয়র্ক, শিকাগো ফিল্ম ফেস্টিভালের সুবাদে দেখা হয়। দেশ-বিদেশের কম বাজেটের অনেক সিনামা ফেস্টিভেলের জন্য ঠিকঠাক হইলেও কমার্শিয়ালে রিলিজ দেয়ার উপযুক্ত না। যা দেখি তার বেশিরভাগই অখাদ্য, এবং সেকেন্ড টাইম দেখার যোগ্য না। ফেস্টিভেলে দেখানো সিনামার বাইরেও এত এত ভালো সিনামা দেখি যে আমার ধারণা এইসব বাদপড়া সিনামা দিয়া তেমন লস ছাড়াই ফেস্টিভেলের স্লট ফিলাপ করা যাবে। বাদপড়া এইসব সিনামা আম্রিকান হার্ড মেন্টালিটির শিকার। ‘ইভেন্ট ফিল্ম’ যখন রাস্তা পর্যন্ত লাইন টাইনা নিয়া যায় তখন রাস্তার ঐপাশেই ভালো সিনামারা দর্শক পায় না। ৮ বছর হইলো নিউ জার্মান (রাইনার হ্বের্নার ফাসবিন্দার, হ্বের্নার হের্জগ, বোলকার শ্লোন্দর্ফ, হ্বিম হ্বেন্দার্স) সিনামা’রে ইউরোপের সবচে ইন্টারেস্টিং ফিল্ম মুভমেন্ট বলে মনে করে ফেস্টিভেল আর ক্রিটিক সার্কেল। অথচ আম্রিকান ফিল্ম মার্কেটে পশ্চিম জার্মানির এই সিনামাগুলো কমার্শিয়ালি ফ্লপ, কারণ এই সিনামা নিয়া কোনো ‘ইভেন্ট’ তৈরি হয় নাই।
আমার টেনশন হয় যে আমরা বোধহয় বিপ্লবরে জেতার পর হেরে যাইতে দেখতেছি। গতানুগতিক প্রোগ্রামারদের উৎখাতের পর জনরা, কাস্টিং, ব্যবসাদারি, এবং স্টাইলের সেন্সরিং থেকে ফিল্মমেকারদের যে মুক্তি ঘটছিলো সেইটারে আবার নতুন কিছু নিয়ম সেট করে আবার ব্যাকওয়ার্ডে নেয়া হইতেছে। সিনামার দর্শকেরা এখন একটা লেভেল পর্যন্ত শিক্ষিত, সাবটাইটেলও আর বিদেশি সিনামার জন্য প্যারা না, এবং মূলধারার বাইরের সিনামাগুলা—যাদের আগে এড়াইয়া যাওয়া হইতো— এখন সাদরে গ্রহণ করা হইতেছে। অল্টম্যান বা স্করসেইজি’র মতন ডিরেক্টরদের এক্সপেরিমেন্টাল স্টাইল টেলিভিশনে বুঁদ হয়ে থাকা জেনারেশনের দর্শকরা ইজিলি নিতে পারতেছে। তবে, পুরাপুরি থাইমা না গেলেও এই পরিবর্তনের ধার কইমা গেছে। বিপ্লবের শুরুর দিকে ফাঁকা সিনামা হলে একা একা ভিশনারি ফিল্মমেকারদের সিনামা দেখা যে তৃপ্তি আর আনন্দ দিতো এখন আর তেমনটা দেয় না। সেরকম সিনামা বানানো হইলেও অল্প কয়দিন দেখানোর পর হারায় যায়, অথবা সফল হইলে বা মাসখানেক চললেও সেইটা হয় কোনো ‘ইভেন্ট’-এর কারণে। সিনামার সত্যিকার এক্ছিলেন্স অজানা থাইকা যায়।
পরোক্ষভাবে হইলেও নিউ ওয়েভ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখছি। আমরা ব্যক্তি ফিল্মমেকারদের প্রতি সচেতন হইসি, পারসোনাল স্টাইলের প্রতি নজর দিতে শিখছি। আবার আমরা একটু অন্যরকম সিনামা যেগুলা ‘ইভেন্ট’ ঘটাইতে ব্যর্থ, তাদের নিয়া সতর্ক হয়ে গেছি। এরা অল্প কয়টা দর্শকরে সন্তুষ্ট করলেও বাকিদের কনফিউজড করে দেয়। ন্যারেটিভ থেকে এই নয়া স্বাধীনতা ফিল্মমেকাররা ততদিনই নিতে পারবে যতদিন না দর্শকেরা সিনামারে আবারও “কাহিনী কি?”র ফাঁদে ফেলে। এবং যেহেতু মার্কেটপ্লেসের চাপ এত তীব্র হয়ে উঠেছে, যেহেতু আগের চে কম সিনামা তৈরি হয়, যেহেতু দর্শক কমে গেছে এবং যারা সিনামা হলে যায় ঐ অল্প কয়টা সিনামা দেখতেই যায়, সেহেতু স্টাইল নিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করা ডিরেক্টরদের জন্য অতটা সহজ থাকে না। বিপ্লব হিসেবে নিউ ওয়েভের বয়স ২০ বছর, বিজয়ের ধন লুটেপুটে শেষ। কিন্তু যে সিনামা ন্যারেটিভের সূত্র না মেনে অন্যদিকে পা বাড়ায়, যে সিনামা ব্যাখ্যা আর বিবৃতির বাইরে নিজেকে নিয়া যাইতে চায়, যে সিনামা শুধুই বিশুদ্ধ সিনামা হইতে চায়, সেই নিউ ‘নিউ ওয়েভের’ বিরুদ্ধে এখনও প্রতিরোধ চলে।
তাহলে সিনামা কেমনে দেখে?
পেইন্টিং, নাচ কিংবা মিউজিক উপভোগ করতে এখন আর কোনো প্যারাফ্রেজেবল ব্যাখ্যা লাগে না। দেরিতে হইলেও নাটক এখন এই ফ্রিডম পাইতে শুরু করছে। কিন্তু সিনামার বেলায় এইটা হয়-ই নাই। গল্পের শক্তি এমন একরোখা যে ন্যারেটিভ সিনামার ব্যাপারে দর্শকের প্রথম প্রশ্নটাই থাকেঃ “কাহিনী কি?”এবং এই প্রশ্নের উত্তর পাইলেই সিনামা নিয়া তাদের কৌতুহলি পেট ভরে যায়। সিনামার বিজ্ঞাপন ও প্রচারের সাথে যারা যুক্ত তাদের বিশ্বাস সিনামার কাহিনী এক লাইনে বলা গেলে নিশ্চিত বক্স অফিস হিটঃ “এই সিনামাটা একটা দৈত্যকার হাঙর নিয়া।”
মার্লন ব্র্যান্ডোর সাথে ফাঁকা এপার্টমেন্টে এক মেয়ের দেখা হয় এবং তারপর…
এটা স্পেশাল ইফেক্টসহ ২ ঘণ্টার ফ্ল্যাশ গর্ডন।
দুনিয়ার উচ্চতম বিল্ডিং-এ আগুন ধরা নিয়া এই সিনামা।
বস্তির ছেলে হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়া সিনামা।
লেইট সিক্সটিজে অল্প কিছুদিনের জন্য ন্যারেটিভ সিনামা সেকেলে হয়ে গেছিলো। ‘ইজি রাইডার’ থেকে ইন্সপায়ার্ড হয়ে একঝাঁক সিনামা হইছিলো যেগুলার স্ট্রাকচার অনেক ছাড়া ছাড়া। এদের কিছু আবার প্লট আকারে যে পুরাতন ন্যারেটিভ সেইটা সচেতনভাবেই বাদ দিয়া দিছিলো। রোড মুভিজ নামে একটা সাবজনরা তৈরি হইছিলো যেখানে হিরো যা হওয়ার হবে মেন্টালিটি নিয়া রাস্তায় নামতো। এইসব রোড মুভিজে ডিরেক্টররা ৬০’র আম্রিকান সমাজের খণ্ড খণ্ড চিত্র দেখাইতো। ইজি রাইডার সিনামাও খণ্ড খণ্ড এপিসোডে বানানো—গ্রামীণ কমিউনিটিতে একটা অংশ, এরপর ড্রাগ-ডিলিং সাবপ্লট, মার্ডি গ্রাসে ঘুরতে যাওয়া, ক্যাম্পাফায়ারের পাশে মারিহুয়ানা খেয়ে পিনিক করা, এবং সবশেষের এপিসোডে রেসিস্ট রেডনেকদের হাতে হিপি হিরোদের খুন হওয়া।
কিছু সিনামা ন্যারেটিভ টোটালি বাদ দিয়া দিছিলো। ঐ সময়ের অন্যতম পপুলার ডকুমেন্টারি ‘উডস্টক’ গুছানো কাহিনীর বদলে রক কনসার্টের ইমেজ আর মিউজিকের রিদমের উপর ভিত্তি করে সিনামা বানাইছে। কমার্শিয়াল হলগুলাতেও কিছুদিন আন্ডারগ্রাউন্ড আর সাইকেডেলিক সিনামা চলসে। বিটলসের ইয়েলো সাবমেরিন ফ্যান্টাসি ইমেজ আর মিউজিকের যা-ইচ্ছে-তাই সিনামা। কুবরিকের ২০০১ঃ অ্যা স্পেস অডিসি – টাইটেল ট্রাডিশনাল ডকু ধাঁচের হইলেও স্টানলি কুবরিক এই সিনামায় যাবতীয় ট্রেডিশনাল ন্যারেটিভ স্টাইলরে বাদ দিছেন।
নাম নেয়া সিনামাগুলা ব্যবসাসফল হইলেও অধিকাংশ নন-ন্যারেটিভ সিনামা সফল হয় নাই। সেভেন্টিজের সবচে ব্যবসাসফল সিনামা যেমন ফ্রেঞ্চ কানেকশন, গডফাদার, প্যাটন, চায়নাটাউন, দ্য স্টিং, স্টার ওয়ার্স ইত্যাদির ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার দুর্দান্ত। গল্পের মাধ্যমে পুরোপুরি বোঝা যায় বলে এই সিনামাগুলা দর্শকদের সন্তুষ্ট করছে। এদের কয়টার মধ্যে ভয়াবহ লেভেলের সাইকোলজিক্যাল এবং ভিজুয়াল মোটিফ ছিল সেসব নিয়া কারও আগ্রহ বা উচ্চবাচ্য শোনা যায় নাই।
এ থেকে বুঝা যায়, শুধু চোখ আর ইমোশনকে টার্গেট করে বানানো সিনামারা বড় আকারে দর্শক পায় না। এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মমেকাররা রঙ, আলো, পালস, এডিটিং আর সাউন্ডের সমন্বয়ে নতুন কিছু ট্রাই করতে পারেন। কিন্তু তাদের এইসব নন-ন্যারেটিভ কাজগুলা কয়েকটা মিউজিয়াম, গ্যালারি আর ভার্সিটি ক্যাম্পাসে দেখানো হবে। বড় আকারে দর্শকেরা খুব সুন্দর করে বলা ভালো গল্পের কমার্শিয়াল সিনামার কাছেই যাবে।
আমি সেই জেনারেশনের লোক যারা প্রতি শনিবার দুপুরে ১৯৪০’র ন্যারেটিভ ফিল্ম দেখতো (আমার ফ্যাভারিট মুভির লিস্টে হিচককের নটোরিয়াস, ক্যারল রিডের দ্য থার্ড ম্যান, আর একটা হামফ্রে বোগার্ট ক্লাসিক থাকেই)। কিন্তু আমার বিশ্বাস, এজ এন আর্ট ফর্ম, সিনামার ভবিষ্যৎ সব সম্ভাবনা ন্যারেটিভের বাইরেই— ইমেজ, স্বপ্ন, বাস্তবতার সাথে বিমূর্ততা আর এদেরকে কোনো একটা গল্পের মধ্যে রিলেট করানোর প্যারা থেকে মুক্ত করার মধ্যেই সিনামার ভবিষ্যৎ। দর্শকেরা খুব দ্রুত এই ন্যারেটিভরে পরিত্যাগ করবে এমনটা ভাবি না, তবে, ৩টা জিনিস সিনামার এই স্বাভাবিক পরিবর্তনরে স্লো করে দিচ্ছেঃ ‘ইভেন্ট ফিল্ম’-এর হাইপ, প্যারাফ্রেজেবল গল্পের প্রতি আমাদের হাই অবসেশন আর অতিরিক্ত টিভি দেখার কারণে ভিজুয়াল এটেনশন স্প্যান কমে যাওয়া।
টিভি নিয়া আমার টেনশন আসলে সহজেই অনুমেয়। আমরা সবাই অতিরিক্ত টিভি দেখি এবং যা দেখি তার বেশিরভাগই জাতের কিছু না। আমাদের মনোযোগ ধরতে এবং ধরে রাখতে, টিভিতে সবকিছুকেই খুব দ্রুত হইতে হয়। এখানে, নেটওয়ার্কগুলাতে, প্রতি রাতে হাজার হাজার ছোট ছোট ক্লাইম্যাক্স দেখানো হয়: অপ্রস্তুত অবস্থায় খুন করা, দরজা বন্ধ করা, গাড়ি থেকে পড়ে যাওয়া, কৌতুক বলা, চুমু খাওয়া, কাঁদা, অথবা নতুন কেরেক্টাররে পরিচয় করায়ে দেয়া (“মিট জনি”)— সবই এখানে খুবই অল্প সময় নেয়। এই ছোট ক্লাইম্যাক্সগুলারে আবার আনুমানিক নয় মিনিট পরপর আরও বড় ক্লাইম্যাক্স এসে খেয়ে দেয়, যাদের বলা হয় কমার্শিয়াল। কিছু কিছু কমার্শিয়াল দেখলেই বুঝা যায় এইটা বানানোর খরচ টিভিতে দেখানো শো’টার চে বেশি। টেলিভিশনের জন্য বানানো সিনামার স্ক্রিপ্ট সচেতনভাবে লেখা হয় যেন নিয়মিত বিরতিতে কমার্শিয়াল দেখানো যায়। গল্পগুলা এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে দারুণ আগ্রহের মুহূর্তগুলার আগে বিজ্ঞাপন বিরতিতে যাওয়া যায়।
সিনামারে গল্প বলতেই হবে— আমাদের এই চাওয়া ন্যারেটিভের প্রতি একধরনের অবসেশন ছাড়া আর কিছু না। টেলিভিশনের প্রতিও আমার একই রকম অভিযোগ। আমরা উপন্যাস পড়ি কেন? এসপেক্ট অফ নভেলে ই এম ফস্টার যাই বলুক না কেন, কাহিনী শেষপর্যন্ত কি হয় সেইটা জানতেই আমরা উপন্যাস পড়ি। তাই কি? ট্রেডিশনাল উপন্যাস আর সিনামার, বিশেষত ভালো সিনামার, একটা চমৎকার দিক ছিলো যে তারা তাদের স্ট্রাকচারের ভিতর থেকে নিজেদের ধীরে ধীরে প্রকাশ করতো। হিচককের ঘন ঘন ডাবল মিনিং করার যে অভ্যাস সেইটা তাঁর সাম্প্রতিক ‘ফ্রেঞ্জি’ (১৯৭২) সিনামাতেও লক্ষ্য করা যায়। চরিত্র, দৃশ্য, আর শট জোড়া দিয়া সারকাস্টিক ইমেজ তৈরি করাতেই তাঁর আনন্দ। কিন্তু ম্যাস অডিয়েন্স কি এই কারিকুরি দেখার মতন ধৈর্য রাখে? নাকি টেলিভিশনের এই টুকরা-টুকরা ন্যারেটিভ আমাদের ভিজ্যুয়াল কনজামশনরে বিনাশের বদলে অভ্যাসে পরিণত করছে?
এই প্রশ্নগুলা সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম সেরা দুই সিনামা—ইংমার বার্গম্যানের ‘পারসোনা’ এবং রবার্ট অল্টম্যানের ‘থ্রি উইমেন’-এর সাথে প্রাসঙ্গিক। ফিল্ম মিডিয়ামের নন-ন্যারেটিভ সম্ভাবনা নিয়া আলোচনায় আমি অন্য অনেক সিনামা আনতে পারতাম, তবুও এই ২টাকে বেছে নিছি এই কারণে না যে এরা সত্যিকার অর্থেই গ্রেট সিনামা, বরং এদের থিম এক হওয়াতে এরা একে অপরকে ব্যাখ্যা করতে হেল্পাবে।
২টা সিনামার ১টাও ব্যবসাসফল হয় নাই। নিজের সিনামা “দ্য মাঞ্চুরিয়ান ক্যান্ডিডেট” নিয়া বলা জন ফ্রাঙ্কেনহাইমারের কথাটাই পারসোনা সম্পর্কে ১০০% খাটে—”ফ্লপ থেকে এই সিনামা সরাসরি ক্ল্যাসিক স্ট্যাটাসে চলে গেছিলো। মাঝখানে যে সাকসেসফুল স্ট্যাটাস আছে, তার ধার ধারে নাই।” আর অল্টম্যানের সিনামা খরচের টাকাই উঠাইতে পারে নাই, যদিও ১৯৭৭ সালের স্ট্যান্ডার্ডে এইটা একটা লো বাজেট সিনামা ছিলো। সাইট এন্ড সাউন্ড ম্যাগাজিনের গ্রেটেস্ট ফিল্ম এভার মেইড লিস্টে স্থান পেয়ে বার্গম্যানের সিনামা খুব দ্রুতই ক্লাসিক মর্যাদা পেয়ে গেছিলো। অল্টম্যানের সিনামাটা এখনও তার প্রাপ্য দর্শকদের খুঁজে পায় নাই। ২টা সিনামাই এমন নারী চরিত্র নিয়া ডিল করছে তারা একাধিক পারসোনালিটিতে অদল-বদল বা লীন হয়ে গেছে। কিন্তু কোনো সিনামাই অদল-বদলের কারণ ব্যাখ্যা করে নাই বা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে নাই। বিশাল সংখ্যক দর্শকের জন্য এই ব্যাখ্যাহীনতাই বিপাক হয়ে দাঁড়াইছিলো।
[বাকি অংশ পড়তে পারবেন বইয়ে]
…
এই লিংকে ক্লিক কইরা বইটা কিনতে পারেন:
https://web.facebook.com/bacbicharbooks/posts/pfbid02zy4akedBZiy11GcwpQrme25Nx1kx3jr6S4j1ugNVVYBsuvv1P7gYFMts6xkrAJVUl
আবীর হাসান একা
Latest posts by আবীর হাসান একা (see all)
- ন্যারেটিভের বাইরে সিনামার কি কোনো ফিউচার আছে? – রজার এবার্ট (পার্ট ২) - এপ্রিল 24, 2023
- ন্যারেটিভের বাইরে সিনামার কি কোনো ফিউচার আছে? – রজার এবার্ট (পার্ট ১) - মার্চ 1, 2023