সোলায়মান কবীর ঋষি
এক.
শিল্পী সোলায়মান কবীর ঋষির জন্মদিন আজকে। তিনি মারা গেছেন কয়েকবছর হইল। যিনি ইতমধ্যে মৃত, তার জন্মের দিনটি পালন করা এক উদ্ভট আনন্দের ব্যাপার। আমার সেই আনন্দ এখন হচ্ছে।
আমি পরবর্তীতে ঋষি ভাইয়ের ব্যক্তিগত জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়া একটু ভাবছি। আমার মনে হইছে নিয়মিত কড়া নেশাপাতি করার খারাপ অভ্যাসটাই তারে খায়া দিছিলো।
বাকি সব ঠিকই ছিল।
অনেকেই বলেন, বাংলাদেশে চিত্রকলা চর্চার যে প্রাতিষ্ঠানিক বাস্তবতা, সেইখানে ঋষি অত্যন্ত বেমানান। আরো দশজন ‘স্বাভাবিক-শিল্পী’র সাথে একযোগে সমাজের সামনে উপস্থিত হওয়াটা কোনোভাবেই তাকে দিয়ে হইত না।
কিন্তু আমি এরকম মনে করি না। বরং যারা এইভাবে চিন্তা করে, তারা নন-ক্রিয়েটিভ সিস্টেমের কাছে অসচেতনে হইলেও মাথা বিক্রি কইরা দিছেন বলে আমি মনে করি। শিল্পকর্মের সাথে সমাজের সম্পর্ক নির্মাণের পদ্ধতি তৈরির ক্ষেত্রেও শিল্পী ক্রিয়েটিভ হইতে পারেন। একই মূখস্থ ব্যবস্থায় ঘটনা না ঘটাইলে কিছুই হবে না, এমন চিন্তা মূলত একটা শিল্পমারা রাজনৈতিক চিন্তা। প্রতিষ্ঠানগুলিও চায় আমরা এমন মরা-মরা হতাশ চিন্তাই করি।
ঋষিভাই এমনভাবে ভাবতেন না। তিনি স্বচ্ছন্দে ইম্প্রোভাইজ করতেন। ইডিওলজিকাল কোনো চরমপন্থাও তার ছিল না। আমি পরবর্তীতে তার অনেক কাজের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারছি বইলা মনে করি।
আমি তাঁকে মিস করি।
২৬/০৪/২০২৩
দুই. ঋষি ভাইয়ের করা পোর্ট্রেইটগুলি
৮০% নিশ্চিত থাকা যাইতে পারে যে, এইটা সোলায়মান কবীর ঋষির সেল্ফ পোর্ট্রেইট।
এর টাইটেল, মিডিয়াম, ডাইমেনশন এবং ডেট সম্পর্কিত কোনো তথ্য আমার কাছে যদিও নাই, তবু অভিজ্ঞতা ব্যবহার কইরা আন্দাজ করা যায় যে কাজটা হাফশিটের বেশি নয়, মিক্সড মিডিয়ামে করা, মূল পোর্ট্রেইটের অংশটা সাধারণ কলমে করা। বাকি রঙিন অংশটাও আরেকধরনের কলমই বটে।
ঋষি ভাই সাধারণ কলম ব্যবহার করতে পছন্দ করতেন। জেনারেল স্টোর থেইকা কেনা বলপেন। উনার অজস্র ভাল কাজ এই মিডিয়ামেই করা। বিশেষ কইরা পোর্ট্রেইট বেইজড কাজ যেগুলা। অনেক কাজ করতেন উনি এইধরনের। রেখাপ্রধান। ব্যাকগ্রাউন্ডে অসংখ্য রেখার মজবুত ঢালাই। ফর্মে তুলনামূলক অল্প কিন্তু বিশিষ্ট রেখা।
প্রথম আমি ঋষি ভাইয়ের কাজ দেখি একটা ক্যাটালগে। শো’টা কবে কোথায় হইছিল মনে পড়ে না। আমি তখন চারুকলায় ঢুকবো-ঢুকবো অবস্থা, কোচিং করতে ভাল লাগে না তাই করি না (তবু ১৪তম হইছিলাম), বামপন্থী ইনটেলেকচুয়ালদের সাথে ঘুরি, পাঠচক্র করি, কালাপানি বস্তির সাথে একটা টিনশেডে রুম শেয়ার কইরা থাকি। দাঁত মাজতে মাজতে গাঁজা বানাই এবং সর্বক্ষণ বব ডিলানের গান গাইতে থাকি।
কালাপানির পাশেই কালশীতে এক বড়ভাইয়ের রুমে উনি এবং আমি ছাড়া আরো কয়জন নিয়মিত জমায়েত হইতাম। সোহাগ ভাই, উনি এখন প্রভাবশালী কর্পোরেট কর্মকর্তা , শাওন, এখন লেখক ও জার্নালিস্ট, শেখর, এখন ফিল্মমেকার, আর জাহাঙ্গীরনগর থেকে কাফকার মত দেখতে একটা ছেলে আসত, সে এখন কই আছে জানিনা। তো আমরা আপেল ছিদ্র কইরা সেইখানে জয়েন্ট ভইরা খাইতাম তারপর ঝিমাইতাম বা কুত্তার মত প্যাচাল পাড়তাম। ঐ রুমে বিচিত্র সব পাবলিকেশন্স কীভাবে কীভাবে জানি আইসা একজায়গায় স্তূপাকৃতি হইত। সেই স্তূপ থেকে আমি একদিন ঋষি ভাইয়ের ঐ আশ্চর্য ক্যাটালগটা খুঁইজা পাই। জিনিসটা দেখতে অত্যন্ত অড এবং মার্জিনাল। ছোট্ট সাইজের (পেঙ্গুইন পেপারব্যাকের অর্ধেক), যথেষ্ট খারাপভাবে ছাপা, সাদাকালো এবং মাত্র কয়েকটা পৃষ্ঠার।
কোনো আর্ট ক্যাটালগ এত সাদামাটা হইতে পারে আমি আগে দেখি নাই। ভিতরে ছাপা কাজগুলিও এই অর্থে সাদামাটা যে সেগুলিতে বলপয়েন্টে আঁকা বেশকিছু ঘোঁটপাকানো রেখা ছাড়া কিছুই নাই। সাই টোম্বলির কিছু টেকনিকাল প্রভাব থাকলেও নন্দনতাত্ত্বিকভাবে তার থেকে অনেক ক্যাজুয়াল।
হিসাবানুযায়ী তার অল্প কিছুকাল পূর্বে ঋষি ভাই নিউইয়র্ক থেকে আইসা পড়ছেন, কী একটা জটিলতা হইছিল ওনার। পরবর্তীতে যখন আমি সরাসরি উনার সংস্পর্শে আসি ২/৩ বছর পরে, তখন উনি নিজের মুখেও আমাকে কয়েকবার জানাইছিলেন যে বাংলাদেশে আসার পরে থেকে উনার কাজ ক্রমশ অনেক বদলাইছে।
তা বদলাইলে পরেও, নাঈভ এবং প্রায়-অনিয়ন্ত্রিত-দেখতে রেখার প্রতি উনার পক্ষপাত আমি যাইতে দেখি নাই মৃত্যুর আগপর্যন্ত। এবং উনার সাথে যতদিনে দেখা হইল, ততদিনে শুধু রেখাসর্বস্ব কাজ আর উনি না কইরা সেই রেখাগুলি দিয়া সরাসরি ফর্ম বানাইতেছেন। বিশেষত পোর্ট্রেইটস।
বাংলাদেশের বাস্তবতায় আশ্চর্য শুনাইলেও সত্যি যে আমি ছাত্র বয়সাবস্থায়ই উনার আঁকা একটা পোর্ট্রেইট কিনে ফেলি। এরজন্যে তখনকার গার্লফ্রেন্ডের কাছ থেকেও কিছু টাকা আমারে ধার করতে হয়। তবু আমি কাজটা কালেক্ট করছিলাম, কারণ এর সম্মোহনী শক্তির কাছে আমি তখন পরাজিত হইয়া গর্বিত।
মোর জীবনাচরণ যথা, ঐ পোর্ট্রেইটটা একসময় আমি হারায়ে ফেলি, কিন্তু আমার মাথার ভিতরে সেইটা চিরতরে গাঁথা হইয়া আছে বটে।
কাজটার নাম ছিল ‘দ্য পোয়েট’। কোয়ার্টার শিট। পেন অন পেপার। কোনো রঙ ছিল না। প্রায় ফুল ফ্রেম নিয়া, সরলতম সৌকর্যের নীতি প্রয়োগ কইরা, পূর্বোল্লিখিত প্রকারের রেখাব্যবহার কইরা আঁকা একটা পোর্ট্রেইট। যতদূর জানা আছে, শাহবাগে সকলের পরিচিত, প্রথিতযশা গীতিকার ও কবি জাহিদ ভাইয়ের মুখাবলম্বনে কাজটা শুরু হইছিল। অতিদৃঢ় চোয়াল, সোজা তাকানো, এবং দ্বিধাহীন কিন্তু উদাস ভঙ্গিমাটুকু এই থিওরির পক্ষেই সাক্ষ্য দেয়।
কিন্তু আর্টিস্ট হিসাবে ঋষি ভাই অনঢ় ছিলেন কয়েকটা ইস্যুতে। অফিসিয়ালি উনি সাধারণত কোনো পোর্ট্রেইটের পিছনে দায়ী কোনো বাস্তব ব্যক্তির পরিচয় রিভিল করতেন না। অতিসাদৃশ্যমূলক কোনো পোর্ট্রেইটও কখনো করতে দেখি নাই। গ্রামাটিক্যাল কারেক্টনেসকে অশৈল্পিক মনে করতেন।
উনি এক্সিসটেনশিয়ালিস্ট বইলা দাবি করতেন নিজেরে। কোরান পড়তেন এবং ‘গড’ বিষয়ক বিভিন্ন প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন। এগুলি নিয়া আমার সাথে উনার মতবিরোধ হইত। তবে আমি টের পাইতাম যে প্রত্যেক অস্তিত্বের এক অপার মহিমা উনি ফিল করতে পারতেন। মাইরপিট, গালাগালি, শত্রুতা, এগুলিও পাশাপাশি সব করতেন যদিও। উনাকে অনেকেই যেহেতু পাগল ভাবতো, তাই উনিও পাগলামি দিয়াই ঐসবের জবাব দিতেন। আমি এইসবের বিপক্ষে ছিলাম। এমনিতেই যথেষ্টের বেশি পাগলামি আমাদের মধ্যে আছে, ঢং কইরা আরো পাগলামি কেন দেখাইতে যাব তা আমি বুঝতাম না। এখনো বুঝি না। অডিয়েন্সকে খুশি করা আর্টিস্টের আসল কাজ না, বা অডিয়েন্সের মূর্খামির জগতকে ভারসাম্যপূর্ণ করা।
মোটকথা কোনো প্রোটোটাইপের সাথেই সাদৃশ্যের সঙ্গতি তৈয়ার করা নয় আর্টিস্টের কাজ। এইটা প্রেমিজ হিসাবে ইউনিকনেস এবং নিউনেসের বিরোধী। তবে অবশ্যই এইসব ইউনিকনেস বা নিউনেস মূলত অত্যন্ত সাটল একটা পার্থক্যের ঘটনা। এইটাকে প্রায় ‘কোয়ান্টাম কারেকশন’ এর সমতূল্য ঘটনা বলা যায়।
এবং বরাবরই সোলায়মান কবীর ঋষির চিত্রকলায় আমি এইটা খুঁইজা পাইছি। অতিক্ষুদ্র পার্থক্য সম্বলিত সাদৃশ্য। অস্তিত্বে-অস্তিত্বে প্রায় অভেদ এবং অতিসামান্য ভেদ। উনার পোর্ট্রেইটগুলিতে দুই চোখই থাকে, এক নাকই থাকে, কিন্তু আমাদের চাক্ষুস বাস্তবতার প্রোটোটাইপগুলিকে তার হাল্কা রেখার প্রায় নিরুত্তাপ প্রকাশভঙ্গী দিয়া উনি নিজের মত সৃষ্টি কইরা নেন। যেইখানে লজিকাল বা ম্যাটেরিয়াল স্ট্রাকচারকে ধূলিসাৎ না করাসত্ত্বেও এফিমেরালিটি তৈরি হয়, যেইটা চিত্রকলার একটা নিজস্ব গুণ।
উনার ব্যক্তিচরিত্রের সাথেও সুন্দরভাবে খাপ খাইতো এইটা। উনার সাথে ক্রাফ্টের বারান্দায় বইসা রাত্রিবেলা আমি টের পাইতাম। যে আমরা বসা আছি অজানা অভূতপূর্ব মহাবিশ্বের ভিতরে। সংস্কৃতি এবং শূন্যতা যেইখানে একত্রে বিরাজ করতেছে।
৩১/০৩/২২
তিন. গুডবাই মায়েস্ত্রো ঋষি ভাই
ঋষি ভাই আমার মায়েস্ত্রো আছিলেন। আদর করতেন কিন্তু গায়ে পড়তেন না। সবসময় প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধি দিতেন।
মাঝেমাঝে ঝগড়াও করতেন কিন্তু সেইসব ঝগড়া বাধাইতাম মূলত আমিই। উদ্ভট সব কথা বলতেন হিরোইন খাওয়ার পরে। তখনকার দিনে সেগুলি আরো বেশি উদ্ভট লাগতো, আগামাথা পাইতাম না, মধ্যেমধ্যে বোরিং লাগতো। তবু শুনতাম। কারণ ছিল উনার আঁকা ছবিগুলি এবং উনার ক্যারিশম্যাটিক আর্টিস্টগিরি (এক্সপ্রেশন আর লাইফস্টাইলের কথা বলতেছি), দুইটাই।
আই ওয়াজ আ বিগ ফ্যান অব হিম।
কয়েকটা ছবি তো আমি কখনোই ভুলব না। একটার নাম হইলো ‘ইন দ্য গার্ডেন’। প্রচুর অন্ধকারাচ্ছন্ন অথচ কেমন অত্যন্ত সুখী-সুখী একটা ছবি। কয়েকটা পোর্ট্রেইট ছিল ঐটাতে, কিশোর কিশোরীদের মুখের মত দেখতে। যেন বাগানের অন্ধকারে, সন্ধ্যার পরে-পরে খেলাশেষে ওদের সন্তুষ্ট মরমী মুখগুলি ফুটে আছে।
আরেকটা ছবি, ঐটার নাম ফিয়ার অব নাথিংনেস বা এইটাইপের কিছু। বেশ ভয়-ভয় লাগতেছিল ছবিটা প্রথমবার দেখার পর। নাথিংনেসের ধারালো আতঙ্ক সেইটা, এক্সিসটেনশিয়াল।
তো আমরা মাঝেমাঝে একসাথে একজিবিশন দেখতে যাইতাম কারো। ভুংভাং ছবি আমি সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু ঋষি ভাই যেকোনো ছবির সামনে দাঁড়াইতে পারতেন। দাঁড়ায়ে, থাকতে পারতেন। আমি উনাকে বলতাম এইসব বালের ছবি আপনি দাঁড়ায়ে দেখতেছেন, কী বাল দেখতেছেন এইসব বালের ছবি ?
উনি হাসতে-হাসতে আমারে বুঝানোর চেষ্টা করতেন, যে, যেকোনোকিছুই দেখা যায়। নকল ছবি, ললিপপ ছবি, এক্সট্রিমলি লো-কোয়ালিটি আইক্যান্ডি, মূর্খ ছবি, জ্ঞানের জন্জালে ভর্তি ছবি। সব ছবি। যেকোনো ছবি।
যেকোনো চিত্রকর্ম দেখলেই কিছু ব্যাপার রিয়েলাইজ করা যায়। সেইসব ব্যাপার হয়তো আর্টের জগতের না। সামাজিক বা রাজনৈতিক বা নৈতিক বা অন্য কোনো জগতের। কিন্তু এই জীবজগতের তো বটে।
তো সেই লোক, সমাজপ্রদত্ত নাম নাকি একসময় ‘লিটন’ ছিলো, পরে নিজে দিছিলেন ‘ঋষি’; এই জীবজগত হইতে সেই আর্টিস্ট নিষ্ক্রান্ত হইছেন।
উনার নিউইয়র্ক-ইয়ার্সের এক গার্লফ্রেন্ডরে খুব মিস করতেন দেখতাম। তার সেই এক্স-গার্লফ্রেন্ড এই খবর পাইছেন বা পাবেন কিনা আল্লাই জানে।
গুডবাই মায়েস্ত্রো। গুডবাই।
১৩/০৩/২০১৮
মনজুরুল আহসান ওলী
Latest posts by মনজুরুল আহসান ওলী (see all)
- সোলায়মান কবীর ঋষি - এপ্রিল 26, 2023
- আমার জীবনানন্দ অবলোকন - অক্টোবর 25, 2022