বই থেকে: একটি নীল বোতাম – হুমায়ূন আহমেদ
- বাংলা ক্ল্যাসিক। দ্বিজ কানাইয়ের মহুয়া।
- সুলতানার স্বপ্ন – রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন
- বাংলাদেশি ফিকশন: গালিভরের সফরনামা – আবুল মনসুর আহমদ
- বাংলাদেশি ফিকশন: অগ্নিগিরি – কাজী নজরুল ইসলাম
- বাংলাদেশি ফিকশন: নেড়ে – সৈয়দ মুজতবা আলী
- শাহেদ আলীর গল্প – ঐ যে নীল আকাশ
- বই থেকে: একটি নীল বোতাম – হুমায়ূন আহমেদ
- ফিকশন: দেশ নাই
- ফিকশন: দোস্তি
[হুমায়ূন আহমেদের এই ফিকশনটা ছাপানোর পারমিশন আমাদের নাই, কাকলী প্রকাশনী থিকা ছাপানো উনার “গল্প সমগ্র” বই থিকা এই গল্পটা বাছাই করা হইছে। বইয়ের স্ক্যান কপি অনলাইনে এভেইলেবল। কপিরাইট সংক্রান্ত কোন অভিযোগ আসলে পোস্ট’টা মুছে দিতে রাজি আছি আমরা।
এমনিতে হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্প নিয়া আলাপ কমই, এর একটা বড় কারণ মেবি কোন বাছাই না থাকা। যে কোন রাইটারেরই সব গল্প-উপন্যাসই তার সেরা-লেখা হওয়ার কোন কারণ নাই; বা কোন ক্রাইটেরিয়ার বেসিসে আমার সেরা বইলা ধরে নিতেছি, সেইটাও একটা ঘটনা। তবে অইসব বিচারে না গিয়াও বলা যায়, এইটা হুমায়ূন আহমেদের সিগনেচার একটা গল্প।
তো, গল্পটা পড়তে পারেন আবার।]
বারান্দায় এশার বাবা বসেছিলেন।
হাঁটু পর্যন্ত তোলা লুঙ্গি, গায়ে নীল রঙের গেঞ্জি। এই জিনিস কোথায় পাওয়া যায় কে জানে? কী সুন্দর মানিয়েছে তাঁকে! ভদ্রলোকের গায়ের রঙ ধবধবে শাদা। আকাশি রঙের গেঞ্জিতে তাঁর গায়ের রঙ ফুটে বেরুচ্ছে। সব মিলিয়ে সুখী-সুখী একটা ছবি। নীল রঙটাই বোধহয় সুখের। কিংবা কে জানে ভদ্রলোকের চেহারাটাই বোধহয় সুখী-সুখী। কালো রঙের গেঞ্জিতেও তাঁকে হয়তো সুখী দেখাবে।
তিনি আমাকে দেখতে পাননি। আমি ইচ্ছা করেই গেটে একটু শব্দ করলাম। তিনি আমাকে দেখলেন। সুন্দর করে হাসলেন। ভরাট গলায় বললেন, ‘আরে রঞ্জু, তুমি? কী খবর? ভালো আছ?’
“জি ভালো।
‘গরম কি রকম পড়ছে বল দেখি?’
“খুব গরম।’
“আমার তো ইচ্ছা করছে চৌবাচ্চায় গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকি।’ তিনি তাঁর পাশের চেয়ারে আমাকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘বসো। তোমার কাছ থেকে দেশের খবরা-খবর কিছু শুনি।’
‘আমার কাছে কোনো খবরা-খবর নেই চাচা।’
‘না থাকলে বানিয়ে বানিয়ে বলো। বর্তমানে চালু গুজব কী?’
আমি বসলাম তাঁর পাশে। এশার বাবার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। মাঝে মাঝে এ বাড়িতে এসে শুনি এশা নেই – মামার বাড়ি গেছে। রাতে ফিরবে না। তার মামার বাড়ি চাক। প্রায়ই সে সেখানে যায়। আমার খানিকটা মন খারাপ হয়। কিন্তু এশার বাবার সঙ্গে কথা বললে আমার মন খারাপ ভাবটা কেটে যায়।
এই যে এখন বসলাম উনার পাশে— এখন যদি শুনি এশা বাসায় নেই, মামার বাড়ি গিয়েছে— আমার খারাপ লাগবে না।
‘তারপর রঞ্জু নতুন কোনো গুজবের কথা তাহলে জান না?’
‘জি না।’
‘বল কী তুমি! শহর ভর্তি গুজব। আমি তো ঘরে বসে কত কি শুনি। চা খাবে?’
‘জি না।’
‘খাও এক কাপ । তোমার সঙ্গে আমিও খাব। তুমি আরাম করে বস। আমি চায়ের কথা বলে আসি।’
“আপনাকে বলতে হবে না, আমি বলে আসছি। এশা কি বাসায় নেই?’
“আছে। বাসাতেই আছে।’ বলেই তিনি চায়ের কথা বলতে উঠে গেলেন।
কী চমৎকার তাঁর এই ভদ্রতা! আমি কে? কেউ না। অতি সামান্য একজন। একটা এ্যাড ফার্মে কাজ করি। অল্প যে ক’টা টাকা পাই তার প্রতিটির হিসাব আমার আছে। আর এঁরা? আমারা ধারণা, এদের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা দারোয়ান আমার চেয়ে বেশি টাকা পায়। নিতান্ত ভাগ্যক্রমে এঁদের এক আত্মীয়ের সঙ্গে এ-বাড়িতে এসেছিলাম।
প্রথম দিনেই এশার কী সহজ সুন্দর ব্যবহার! যেন সে অনেকদিন থেকেই আমাকে চেনে। সেদিন কেমন হাসিমুখে বলল, ‘আপনি তো বেশ লম্বা। আসুন একটা কাজ করে দিন। চেয়ারে দাঁড়ান, দাঁড়িয়ে খুব উঁচুতে একটা পেরেক লাগিয়ে দিন।
আমি বললাম, ‘এত উঁচুতে পেরেক দিয়ে কী করবেন?’
‘আজ বলব না। আরেকদিন এসে দেখে যাবেন।’
২.
দ্বিতীয়বার এ বাড়িতে আসার কী চমৎকার অজুহাত তৈরি হলো। অথচ অজুহাতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। এঁদের বাড়ি দুয়ারখোলা বাড়ি। যে-কেউ যে কোনো সময় আসতে পারে। কোনো বাধা নেই। অথচ মনে আছে দ্বিতীয়বার কত ভয়ে ভয়ে এসেছি। গেট খুলে ভেতরে ঢোকার সাহস হয়নি। যদি আমাকে কেউ চিনতে না পারে। যদি এশা বিস্মিত হয়ে বলে, আপনি কাকে চান?
সে-রকম কিছুই হলো না। এশার বাবা আমাকে দেখে হাসি-মুখে বললেন, ‘কী ব্যাপার রঞ্জু, গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছ কেন? আসে ভেতরে আসো।’
আমি খানিকটা বিব্রত ভঙ্গিতেই ঢুকলাম। তিনি হাসিমুখে বললেন, ‘দেশের খবরা-খবর বল। নতুন কী গুজব শুনলে?”
এশা বোধহয় বাইরে যাচ্ছিল। আমাকে দেকে থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘বেছে বেছে আজকের দিনটিতেই আপনি এলেন? এখন বেরুচ্ছি। আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারব না। চট করে আসুন। পেরেকটা কী কাজে লাগছে দেখে যান।’
আমি ইতস্তত করছি। এশার সাবার সামনে থেকে উঠে যাব, উনি কী মনে করেন কে জানে। উনি কিছুই মনে করলেন না। সুখী-সুখী গলায় বললেন, ‘যাও দেখে আস। জিনিসটা ইন্টারেস্টিং।’
পেরেক থেকে হলুদ দড়ির মতো একটা জিনিস মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। এশা বাড়ি নিভিয়ে একটা সুইচ টিপতেই অদ্ভুত ব্যাপার হলো। হলুদ দড়ি আলোয় ঝিকমিক করতে লাগল। সেই আলো স্থির নয়। যেন পড়িয়ে গড়িয়ে নিচে নামছে। আলোর করনা।
‘অপূর্ব।’
“কি, অবাক হয়েছেন তো?”
“হ্যাঁ হয়েছি।’
‘এ রকম অদ্ভুত জিনিস এর আগে কখনো দেখছেন?’
“জি না।’
“আমার বড় বোন পাঠিয়েছেন। নেদরল্যান্ড থাকেন যিনি, তিনি। এখন যান। বসে বসে বাবার গল্প শুনুন। বাবা কি আপনাকে তার কচ্ছপের গল্পটা বলেছে?’
‘জি না।’
‘তা হলে হয়তো আজ বলবে। বাবার গল্প বলার একটা প্যাটার্ন আছে। কোনটির পর কোন গল্প আসবে আমি সব জানি।’
এশা হাসল। কী সুন্দর হাসি। আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম – না জানি কোন ভাগ্যবান পুরুষ এই মেয়েটিকে সারা জীবন তার পাশে পাবে। এশার বাবা সেদিন কচ্ছপের গল্প বললেন না। পরের বার যেদিন গেলাম সেদিন বললেন।
‘কচ্ছপ কোথায় ডিম পাড়ে জান তো রঞ্জু? ডাঙায়। সে নিজে থাকে কিন্তু পানিতে। চলাফেরা, জীবনযাত্রা সবই পানিতে অথচ তার মন পড়ে থাকে তার ডিমের কাছে, ডাঙায়। ঠিক না?’
‘জি ঠিক।’
‘বুড়ো বয়সে মানুষেরও এই অবস্থা হয়। সে বাস করে পৃথিবীতে কিন্তু মন পড়ে থাকে পরকালে। আমার হয়েছে এই দশা।’
৩.
এই পরিবারটির সঙ্গে পরিচয় হবার পর আমার বড় ধরনের কিছু পরিবর্তন হলো। আগে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে ঘন্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিতে চমৎকার লাগত। এখন আর লাগে না।। একসময় মেয়েদের নিয়ে কেউ কোনো কুৎসিত কথা বললে বেশ মজা পেতাম এখন ভয়ঙ্কর রাগ লাগে। মনে হয় এই কুৎসিত কথাটি কোনো-না-কোনোভাবে এশাকে স্পর্শ করছে। যে খুপড়ি ঘরটায় থাকি সেই ঘর আমার আর এখন এতো ভালো লাগে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। নোনাধরা বিশ্রী দেয়া একটি ছোট জানালা যা দিয়ে আলো-বাতাস আসে না, রাতের বেলা শুধু মশা ঢুকে। চৈত্র মাসের গরমে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকি। নানানরকম কল্পনা মাথায় আসে।
কল্পনায় আমার এই ঘর হয়ে যায় পদ্মানদীর নৌকায় একটা ঘর। জানালা খুললেই নদী দেখা যায়। সেই নদীতে জোছনা হয়েছে। চাঁদের আলো ভেঙে ভেঙে পড়ছে। ঘরের দরজায় টোকা পড়ে। আমি জানি কে টোকা দিচ্ছে। তবু কাঁপা গলায় বলি, কে? এশা বলে, কে আবার? আমি। এ-রকম চমৎকার রাতে আপনি ঘরটার বন্ধ করে বসে আছেন। পাগল নাকি? আসুন তো।
কোথায় যাব?
কোথায় আবার নৌকার ছাদে বসে থাকব।
আমরা নৌকার ছাদে গিয়ে বসি। মাঝি নৌকা ছেড়ে দেয়। এশা গুনগুন করে গায়, যদি আমায় পড়ে তাহার মনে, বসন্তের এই মাতাল সমীরণে। আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে।
সবই খুব সুন্দর সুখের কল্পনা। তবু এক এক রাতে কষ্টে চোখে জল আসে। সারারাত জেগে বসে থাকি। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবি, আমার এই জীবনটা আমি কি কিছুতেই বদলাতে পারি না?
বন্ধু-বান্ধব সবাইকে অবাক করে এক সন্ধ্যায় জগন্নাথ কলেজের নাইট সেকশানের এম.এ ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাই। ধার-টার করে আমার ঘরের জন্যে নতুন পর্দা, বিছানার নতুন চাদর, নেটের মশারি কিনে ফেলি। অনেক ঘোরাঘুরি করে একটা ফুলদানি কিনি। একশ’ টাকা লেগে যায় ফুলদানিতে। তা লাগুক, তবু তো একটা সুন্দর জিনিস। একগুচ্ছ রজনীগন্ধা যখন এখানে রাখব তখন হয়তো এই ঘরের চেহারাও পাল্টে যাবে। আমার এক আর্টিস্ট বন্ধুর কাছ থেকে একদিন প্রায় জোর করে জলরঙ্গা একটা ছবিও নিয়ে আসি। নোনাধরা দেয়ালে সেই ছবি মানায় না। নিজেই চুন এনে দেয়ালে চুনকাম করি।
চুন দেয়ালে আটকায় না, করে ঝরে পড়ে। তবু আমার ঘরে দেখে বন্ধুরা চোখ কপালে তুলে ।
করছিস কী তুই! ইন্দ্রপুরী বানিয়ে ফেলেছিস দেখি। আবার দেখি খুশবুও আসছে। বিছানায় আতর ঢেলে দিয়েছিস নাকি?
মাই গড়। মেয়ে মানুষ ছাড়া এই ঘর মানায় না। এক কাজ কর একশ’ টাকা দিয়ে একটা মেয়ে মানুষ এক রাতের জন্যে নিয়ে আয়। ফুর্তি কর। আমরা পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখি।
রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। কিছু বলি না। কী হবে বলে? আমার বন্ধুরা গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়। সিগারেটের টুকরা দিয়ে মেঝে প্রায় ঢেকে ফেলে। একজন আমার নতুন বিছনায় চায়ের কাপ উল্টে দিয়ে বলে, যা শালা, চাঁদে কলঙ্ক লেগে গেল।
আমি কিছু বলি না। দাঁতে দাঁত চেপে থাকি। আর মনে মনে ভাবি — এই মূর্খদের সঙ্গে কি করে এতদিন কাটিয়েছি। কি করে এদের সহ্য করেছি?
ইরফান বলল, ‘প্রেম করেছিস কিনা বল। তোর হাবভাব যেন কেমন রঙ্গিলা।’
আমি জবাব দেই না। ইরফান পান যাওয়া লাল দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে জিনিস কেমন বল। টিপে-টুপে দেখেছিস তো?
সবাই হো হো করে হাসে। কোন অন্ধকার নরকে এরা পড়ে আছে? এদের কি কোনোদিন মুক্তি ঘটবে না? আমার ইচ্ছা করে এশাকে একদিন ওদের সামনে উপস্থিত করি। সেটা নিশ্চয়ই খুব অসম্ভব নয়। বললেই সে আসবে। তবে আমার বলতে সাহস করে না।
৪.
প্রথম যেদিন তাকে তুমি বললাম কী প্রচণ্ড ভয়ে ভয়েই না বললাম। সে গোলাপ গাছের ডাল ছেঁটে দিচ্ছিল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ কি হলো নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম, কাঁচিটা আমার হাতে দাও, আমি ছেঁটে দি।
বলেই মনে হলো— এ কী করলাম আমি। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। আমার মনে হলো সে এবার চোখে চোখে তাকিয়ে শীতল গলায় বলবে, আমাকে তুমি করে বলবেন না। এত ঘনিষ্ঠতা তো আপনার সঙ্গে আমার নেই।
এশা সে রকম কিছুই বলল না। কাঁচি আমার হাতে দিয়ে বলল, “তিন ইঞ্চি করে কাটবেন। এর বেশি না। আর আপনি কি চা খাবেন?
‘হ্যাঁ খাব।’
‘চা নিয়ে আসছি। শুনুন, এ রকম কচকচ করে কাটবেন না, ওরা ব্যথা পায়। গাছেরও জীবন আছে। জগদীশচন্দ্র বসুর কথা।’
এশা ঘরে ঢুকে গেল। চৈত্র মাসের বিকেলে আমি গোলাপ ছাঁটতে লাগলাম। আমার ত্রিশ বছর জীবনের সেটা ছিল শ্রেষ্ঠতম দিন। বিকালটাই যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। শেষ বিকেলের রোদকে মনে হলো লক্ষ লক্ষ গোলাপ, বাতাস কী মধুর!
এশার বাবা যখন বাইরে এসে বললেন, ‘তারপর রঞ্জু দেশের খবর কী বল? নতুন কী গুজব শুনলে?’
কী যে ভালো লাগল সেই কথাগুলি! মনে হলো এ-রকম সুন্দর কথা এর আগে আমাকে কেউ বলে নি।
‘গোলাপের ডাল ছাঁটছ মনে হচ্ছে।’
‘জি চাচা।’
‘এর একটা ফিলসফিক আসপেক্ট আছে, লক্ষ্য করেছ? ফুল ফোটাবার জন্যে গাছকে কষ্ট দিতে হচ্ছে। হা হা হা…’
তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও হাসলাম।
এশা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘এত হাসাহাসি হচ্ছে কেন? আমি কি যোগ দিতে পারি?’
ওদের বাড়ি থেকে ফিরলাম সন্ধ্যার পর। এশা গেট পর্যন্ত এল। হাসিমুখে বলল, ‘আবার আসবেন।’ এই কথাটি কি পৃথিবীর মধুরতম কথার একটি নয়?
আমি আবার আসতে পারি এ বাড়িতে। যতবার ইচ্ছা আসতে পারি। আমাকে কোনো অজুহাত তৈরি করতে হবে না। তবুও ছোটখাট কিছু অজুহাত আমি তৈরি করেই রাখি। যেমন একবার আমার একটা হ্যান্ড ব্যাগ ফেলে এলাম যাতে পরদিন গিয়ে বলতে পারি, জরুরি কিছু কাগজপত্র ছিল। যাক পাওয়া গেল। সবচেয়ে বেশি যা করি তা হচ্ছে— গল্পের বই নিয়ে আসি। তারপর সেই বই ফেরত দিতে যাই।
গল্পের বই আমি পড়ি না। ভালো লাগে না। কোনো কালেও ভালো লাগেনি। তবু রাতে শুয়ে শুয়ে বইয়ের ঘ্রাণ নেই, পাতা ওল্টাই। এশার স্পর্শ এই বইগুলির পাতায় পাতায় লেগে আছে ভাবতেই আমার রোমাঞ্চ বোধহয়। গা শিরশির করে। গভীর আনন্দে চোখ ভিজে উঠে।
বই ওল্টাতে ওল্টাতে একরাতে অদ্ভুত এক কাণ্ড হলো। টুক করে বইয়ের ভেতর থেকে কি যেন পড়ল। তাকিয়ে দেখি ছোট একটা নীল রঙের বোতাম। যেন একটা নীল অপরাজিতা। নাকের কাছে নিয়ে দেখি সত্যি গন্ধ আসছে। আমি গভীর মমতায় বোতামটা বালিশের নিচে রেখে দিলাম। সারারাত ঘুম হলো না। কেবলি মনে হলো একদিন না একদিন এশা আসবে এ বাড়িতে। আমি তাকে বলব, তুমি যে ফুলটি আমাকে দিয়েছিলে সেটা এখনো ভালো আছে। কী সুন্দর গন্ধ! সে অবাক হয়ে বলবে, আমি আবার ফুল দিলাম কবে?
এর মধ্যে ভুলে গেলে? একটা নীল ফুল দিয়েছিলে না?
বলেন কি! নীল ফুল আমি কোথায় পাব?
আমি বালিশ সরিয়ে বোতামটা বের করে আনব। এশা বিস্মিত হয়ে বলবে— এটা বুঝি আপনার নীল ফুল? আমি বলব, বিশ্বাস না হলে গন্ধ এঁকে দেখো।
৫.
এশার বাবা নিজেই দু’কাপ চা নিয়ে ঢুকলেন। আমার বড় লজ্জা লাগল। আমি বললাম, ‘ছিঃ ছিঃ। আপনি কেন?’
তিনি হেসে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে? খাও, চা খাও। চিনি হয়েছে কিনা বল।’
‘হয়েছে।’
‘গুড। চিনি আমি নিজেই দিয়ে এনেছি। কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ব্যস্ত।’
‘কোনো উৎসব নাকি?’
‘না, উৎসব কিছু না। মেয়েলি ব্যাপার। এশার বিয়ে ঠিক হলো। ওরা দিন পাকা করতে আসবে। রাত আটটায় আসবে। এখনো তিন ঘণ্টা দেরি, অথচ ভাব দেখে মনে হচ্ছে…।’
আমি নিঃশব্দে চায়ে চুমুক দিতে লাগলাম।
এশার বাবা বললেন, ‘ব্যারিস্টার ইমতিয়াজ সাহেবের ছেলে। তুমি চিনবে নিশ্চয়ই। ইমতিয়াজ চৌধুরী, জিয়ার আমলে হেলথ মিনিস্টার ছিলেন। ছেলেটা খুব ভালো পেয়েছি। জার্মানি থেকে পিএইচডি করেছে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ। এখন দেশে কি সব ইন্ডাস্ট্রি দিবে। রঙ তৈরি করবে। আমি ঠিক বুঝিও না।’
চা শেষ করবার পরও আমি খানিকক্ষণ বসে রইলাম। যাবার আগে এশা বেরিয়ে এল। কী চমৎকার করেই না আজ তাকে সাজিয়েছে! তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হয়। এশা হাসিমুখে বলল, ‘বেছে বেছে আপনি ঝামেলার দিনগুলিতে আসেন কেন বলুন তো?’
৬.
আমি ফিরে যাচ্ছি আমার খুপড়ি ঘরে। অন্যসব রাতের মতো আজ রাতেও হয়তো ঘুম হবে না। বালিশের নিচ থেকে নীল বোতাম বের করে আজও নিশ্চয়ই দেখব। এই পরিবারটির কাছ থেকে একটা নীল বোতামের বেশি পাওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না। এই সহজ সত্যটি আজ রাতেও আমার মাথায় ঢুকবে না। আজ রাতেও বোতামটিকে মনে হবে একটি অপরাজিতা ফুল ।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- আমি – জহির রায়হান (১৯৬৭) - অক্টোবর 31, 2024
- (বই থিকা) ঈশ্বর কোটির রঙ্গকৌতুক – কমলকুমার মজুমদার - অক্টোবর 12, 2024
- নজরুলের চিঠি: ফজিলাতুন্নেসা ও নারগিস’কে - জুন 13, 2024