দি ওভাল পোর্ট্রেইট – এডগার এলান পো
যে প্রাসাদটাতে আমার খানসামা প্রায় জোর কইরাই আমারে নিয়া ঢুকলো—আমার জখমি দশার কারণে খোলা বাতাসে থাকতে না দিয়া—সেইটা ছিল বিষাদ আর রাজকীয়তার এক মিশেল যা বহুকাল ধইরা অ্যাপেনাইন পাহাড়ের সামনে মাথা নিচু কইরা দাঁড়ায়ে আছে নির্ঘাত। চোখের দেখায় এইটারে দেইখা মনে হইতেসিল খুব অল্পদিন আগে এবং সাময়িকভাবে এই বাড়িটা কেউ ছাইড়া চইলা গেসে। সবচেয়ে ছোট ও কম আসবাবপত্রওয়ালা একটা ঘরে আমরা ঠাঁই নিলাম। দালানটার খুব চিপা এক গম্বুজের কাছে ছিল ঘরটা। ঘরটার সাজ-সজ্জা ছিল খুবই দামি, তবু মলিন আর বহু পুরানো। দেয়ালে ঝুলানো ছিল পরদা ও তাতে আঁকা ছিল বহু জমিদারি নিশানা ও অস্ত্র-বর্মওয়ালা পুরস্কার, তার সাথে ছিল একটু অস্বাভাবিকরকমের অনেকগুলা আধুনিক পেইন্টিং যার ফ্রেম ছিল দামি সোনালি আরবীয় নকশায় কাঁটা। এই ছবিগুলা কেবল দেয়াল থেকে সোজাসুজি ঝুলানো ছিল না, বরং বাড়িটার উদ্ভট নকশার কারণে আরো নানারকম পেরেকের মাধ্যমে ঝুলায়ে রাখা লাগসিল। এই ছবিগুলার দিকে তাকায়ে শুরুতেই আমি এমন এক ধন্ধে পইড়া গেলাম যে তাদের প্রতি আমার আগ্রহ বাইড়া গেল। তাই আমি পেদ্রোরে বললাম ঘরের ভারি ঝাপগুলা নামায়ে দিতে যেহেতু ততক্ষণে রাত হয়ে গেসে—আর আমার বিছানার মাথায় থাকা মোমবাতিটা জ্বালায়ে দিতে—আর তারপর বিছানা পর্যন্ত ছড়ায়ে থালা বিশাল কালো ঝালরওয়ালা পরদাগুলারে দুই পাশে টাইনা দিতে। এইসব আমি করাইলাম যাতে শান্তিতে বইসা, যদি ঘুমাইতে নাও পারি, যেন অন্তত ছবিগুলারে আরো গভীরভাবে খুটায়ে দেখতে পারি। বিছানার পাশেই একটা ছোট্ট বই পাওয়া গেল, যেইখানে ছবিগুলার ব্যাখ্যা দেয়া ছিল।
অনেক—অনেকক্ষণ ধইরা আমি পড়লাম—এবং মগ্ন, নিমগ্নভাবে আমি তাকায়ে থাকলাম ছবিগুলার দিকে। দ্রুত ও অসাধারণভাবে পার হয়ে গেল ঘণ্টার পর ঘণ্টা, আর হাজির হইলো গভীর মধ্যরাত। এমন জায়গায় মোমবাতিদানিটা রাখা ছিল যে আমার বিরক্ত লাগতেসিল, তাই খানসামার ঘুম না ভাঙায়ে আমি নিজেই খানিকটা কসরত কইরা হাত বাড়াইলাম, আর এমনভাবে বসাইলাম যাতে বইটার উপর সরাসরি আলো পড়ে।
কিন্তু এর ফলে যা হইলো তা ছিল পুরাপুরি আন্দাজের বাইরে। এতগুলা মোমবাতির আলোয় (কেননা মোমবাতি ছিল অনেকগুলা) আমার চোখের সামনে ফুইটা উঠলো ঘরের এমন এক কোণ যা বিছানার এক পায়ার ছায়ায় এতক্ষণ ঢাকা পইড়া ছিল। সেই আলোয় আমি দেখতে পাইলাম একটা ছবি যা এর আগে আমার নজর এড়ায়ে গেসিল। চোখেমুখে সদ্য নারীত্ব ফুইটা ওঠা এক মেয়ের ছবি ছিল ওইটা। খুব তাড়াহুড়ায় একবার নজর ফেললাম ছবিটার উপর, তারপর চোখ বুইজা ফেললাম। এইটা আমি কেন করলাম তা প্রথমে আমি নিজেও বুইঝা উঠতে পারি নাই। চোখের পাতা এইরকম বোজা থাকতে থাকতেই আমি এমনটা করার কারণ ভাবতে থাকলাম। একটু ভাবার সময় বের করার জন্যই হুজুগে তা কইরা বসছিলাম আমি—নিশ্চিত হইতে যে আমার নজর আমারে ধোঁকা দেয় নাই—নিজের কল্পনায় লাগাম লাগায়ে শান্ত ও নিশ্চিতভাবে আরো একবার তাকানোর জন্য প্রস্তুত করতেসিলাম নিজেরে। আর কয়েক পলক পরেই আমি আরো স্থিরভাবে চোখ ফেললাম ছবিটায়।
এবার যেহেতু ঠিকভাবে দেইখা নিসি সেহেতু আর সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকলো না; কেননা সেই মোমবাতির প্রথম আলোটা ক্যানভাসে পড়ার সাথে সাথে আমার বোধবুদ্ধির ঘোরলাগা জড়তা একটানে ছুইটা গেল, এবং এক ধাক্কায় আমি আবার সজাগ হইয়া উঠলাম।
ছবিটা, আমি আগেই বলসি, ছিল একটা যুবতীর। স্রেফ মাথা ও কাঁধ, অনেকটা ভিনিয়েটের মত কইরা আঁকা; সালি পরিবারের কর্তাদের যেরকম পছন্দ ছিল। ওর বাহু, বুক, এমনকি ওর সোনালি চুলের উজ্জ্বল প্রান্তটুকুও এত নিখুঁতভাবে মিশে যাইতেসিল ব্যাকগ্রাউন্ডের আবছা অথচ গভীর ছায়ায়। ফ্রেমটা ছিল ডিম্বাকার, দামি সজ্জা ও মুরীয় নকশায় সাজানো। শিল্পের বিচারে পেইন্টিংটার চাইতে সুন্দর কিছুই ছিল না। কিন্তু এই অসাধারণ কারুকার্য, বা ছবির মুখটার শাশ্বত সৌন্দর্য—এর কোনোটাই দায়ী ছিল না আমার মধ্যে এমন প্রবল তোলপাড় জাগানোর পিছনে। ন্যূনতম সম্ভাবনা হইলো যে এর কারণ ছিল আমার নিজেরই ভ্রম, আধা-ঘুম থেকে আচানক উইঠা ছবিটা দেইখা আমার মনে হইসিল ওইটা হয়তো জ্যান্ত কারো মাথা। এক নজরে ছবিটার নকশার, ভিনিয়েটের, ফ্রেমের অনন্য সব খুটিনাটি দেইখা ফেলার পরেই এই ধারণা দূর হইলো—এমনকি ছবিটা থেকে খানিক আনন্দ পাওয়ার সুযোগও পাওয়া গেল না। গভীরভাবে এইসব নিয়া ভাবতে ভাবতে আমি, প্রায় আধা ঘন্টা, আধা-বসা, আধা-শোয়া অবস্থায় নজর স্থির কইরা রাখলাম ছবিটার উপর। কতক্ষণ পর, এই ঘটনার গোপন কারণ বুঝতে পারার পর, শান্তিতে আমি আবার বিছানায় শুইয়া পড়লাম। ছবিটার ঘোর-জাগানো ব্যাপারটা ছিল এর পুরা জ্যান্ত-রকমের মুখের ভঙ্গিটা, যা প্রথমে আমারে খানিকটা অপ্রস্তুত, আর তারপরে স্তম্ভিত, জব্দ ও শেষমেষ আতঙ্কিত বানায়ে ছাড়লো আমারে। খানিকটা ভয় ও সমীহের সাথেই আমি মোমবাতিদানিটা আগের জায়গায় সরায়ে আনলাম। আমার অস্বস্তির কারণটা এর ফলে নজরের আড়ালে চইলা গেল। খুব কইরা তখন আমি সেই বইটা খুঁজতে লাগলাম যেইখানে ছবিগুলার ইতিহাস লেখা রইসে। সেই ডিম্বাকার পোরট্রেইটটার সাথে নাম্বার মিলায়ে বইটার পাতা উল্টাইলাম, সেইখানে পড়তে পারলাম এই অস্পষ্ট ও অদ্ভুত শব্দগুলা:
“সে ছিল অনন্য রূপসী এক মেয়ে, এবং ততটাই সে সুন্দর ছিল যতটা হাসিখুশি। আর অশুভ ছিল সেই সময় যখন সে এই শিল্পীরে দেখলো, ভালোবাসলো আর বিয়া করলো। শিল্পীটা ছিল আবেগি, পড়ুয়া, সরল এবং নিজের শিল্পের সাথে তার আগে থেকেই ছিল প্রেম; ওদিকে মেয়েটা ছিল অনন্য রূপসী এক কুমারী, এবং ততটাই সুন্দরী যতটা হাসিখুশি; শুধু আলো আর হাসি, সে ছিল একটা বাচ্চা হরিণের মতই চঞ্চল; সবকিছু ভালোবাসতো, আগলায়ে রাখতো; ঘৃণা করতো শুধু এই শিল্পটারে যা ছিল তার সতীন। ঘৃণা করতো শুধু প্যালেট ও তুলি আর আরো যত সরঞ্জাম যা তারে তার প্রেমিকের মুখ থেকে বঞ্চিত কইরা রাখে। ফলে মেয়েটা যখন শুনলো যে তার স্বামী তারও একটা ছবি আঁকতে চায় তখন বেশ বাজে একটা ব্যাপার হইলো। কিন্তু মেয়েটা ছিল খুবই অমায়িক ও বাধ্য, তাই চুপচাপ সপ্তার পর সপ্তা সে অন্ধকারে বইসা থাকলো সেই উচা গম্বুজের ঘরটায় যেইখানে মাথার উপর দিয়া আলোটুক কেবল সফেদ ক্যানভাসটাতেই পড়তো। কিন্তু শিল্পীটার নিজের কাজ নিয়া গর্ব ছিল অনেক, ফলে তা চলতে থাকলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন। সে ছিল ভীষণ আবেগী, বন্য ও খামখেয়ালি একটা লোক, যে নানানরকম জল্পনা-কল্পনায় ডুইবা থাকতো। ফলে সে দেখতে পাইলো না যে এই স্যাতসেতে আলোয় ওই একলা কোণটায় বইসা থাকতে থাকতে তার বউয়ের স্বাস্থ্য কেমনে দুর্বল হয়ে যাইতেসিল। তবুও মেয়েটা হাসিমুখে বইসাই রইলো, টু শব্দও করলো না, কেননা সে দেখতে পাইতেসিল যে এই শিল্পী (যার খ্যাতি ছিল অনেক) নিজের কাজ থেকে তীব্র আনন্দ পাইতেসে, এবং দিনরাত এক কইরা ছবি আঁকতেসে মেয়েটার, যদিও মেয়েটা দিনে দিনে মনে ও শরীরে আরো দুর্বল হয়ে পড়তেসিল। আর সত্যিই যারাই ছবিটা দেখতো তারাই ছবিটার অপূর্ব শৈলী দেইখা চাপা গলায় বলাবলি করতো, যেনবা কোনো মহান সৃষ্টির সামনে দাঁড়ায়ে আছে তারা। আর অবশ্যই এই ছবি যতটা প্রমাণ ছিল শিল্পীর অসাধারণ প্রতিভার, ততটাই ছিল স্ত্রীর প্রতি তার ভালোবাসার, যারে সে এত নিখুঁতভাবে ফুটায়ে তুলতেসিল। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন কাজটা শেষের দিকে আগাইতে থাকলো, সেই ঘরে আর কাউরে ঢুকতে দেয়া হইলো না; কেননা সেই শিল্পী নিজের কাজের প্রেমে বন্য পাগলের মত হয়ে যাইতেসিল। নিজের স্ত্রীর মুখের দিকে তাকানো বাদে সে ক্যানভাস থেকে একবারের জন্য মুখও সরাইতো না। ফলে সে দেখতে পাইতেসিল না সে যতই ক্যানভাসের উপর রঙ মাখাইতেসিল, তার পাশে বইসা থাকা মেয়েটার গালের রঙ ততই উবে যাইতেসিল। আর কয়েক সপ্তা কাইটা যাওয়ার পর, খুব অল্প কাজই বাকি ছিল তখন, হয়তো মুখে এক আঁচড় তুলি বা চোখের উপর একটুখানি রঙ, আর তখনই মেয়েটার মধ্যকার প্রাণ আরো একবার জ্বইলা উঠলো যেইভাবে ঝাড়বাতির আগুন জ্বইলা ওঠে। আর তখনই কাটা হয়ে গেল সেই আঁচড়, বসানো হয়ে গেল রঙ; আর তখন, এক পলকের জন্য, শিল্পী নিজের হাতে গড়া ছবিটার সামনে দাঁড়ায়ে ঘোরের মধ্যে পইড়া গেল; আবার পরমুহূর্তেই—যদিও নজর তখনো স্থির—সে কাঁপতে কাঁপতে ফ্যাকাশে হয়ে গেল, এবং প্রচণ্ড ভয়ে জোরে চিৎকার দিয়া উঠলো সে, “এ তো স্বয়ং জীবন!” আর তারপর নিজের প্রিয়তমার দিকে তাকায়ে আচানক দেখলো:— সে মারা গেসে!
মাহীন হক
Latest posts by মাহীন হক (see all)
- এডগার এলান পো’র ফিকশন: ইলিয়োনোরা - মে 28, 2024
- দি ওভাল পোর্ট্রেইট – এডগার এলান পো - মার্চ 9, 2024
- গরিব যেমনে মরে – জর্জ অরওয়েল - অক্টোবর 19, 2023