Main menu

বুদ্ধিজীবীদের মজ্জার ভিতরেই এই জিনিসটা আছে যে তারা সবকিছু নিয়া ভুয়া আইডিয়া বানাইতে পারে – হানা আরেন্ট

জার্মানির ফ্রেইবার্গ, হেইডেলবার্গ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন নিয়ে পড়ালেখা করছেন আরেন্ট। তারে পড়াইছেন হেইডেগার, কার্ল জ্যাসপাগো মতো বড় বড় দার্শনিক। তয় তিনি নিজেরে দার্শনিক বলেন না। উনার লেখাপত্তর সব পলিটিকাল থিওরি নিয়ে। তাই নিজেরে মনে করেন এক পলিটিকাল থিওরিস্ট। রাজনীতি আর দর্শনের ভিতর ভাইটাল একটা দ্বন্দ্ব আছে। দার্শনিকরা নিরপেক্ষ থাকতে পারে, আর পলিটিকাল থিওরিস্টগো নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব না, প্লেটোর পর কেউ থাকতে পারে নাই আরকি। দ্বন্দ্ব নাকি আছে নারী-পুরুষের বোঝাপড়াতেও। পুরুষ সবসময় চায় প্রভাব বিস্তার করতে, আর আরেন্টের মতো নারীরা চান সবকিছু বুঝতে। আরেন্ট ইহুদি। জন্মাইছিলেন ১৯০৬ সালে, জার্মানির হ্যানোভারে। বাপ মা ছিলেন ইহুদি সেক্যুলার। তিনি বড় হইছেন আর তার সাথে পাল্লা দিয়া বাড়ছে হিটলারের দাপট। যার শেষ পরিণতি তো ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির ইহুদিগো একেবারে মাইরা ফেলা। আর যারা বাঁচছিলো, তারা একেবারে ফিলিস্তিন গিয়া ওঠে। এবং আমরা সবাই জানি, সেইখানে তৈরি হইছে আরেক কাহিনি।

হিটলারের অত্যাচার তুঙ্গে উঠলে দেশ ছাইড়া পালাইয়া আসেন তিনি। ফ্রান্সে ইহুদি সংগঠনগো সাথে কাজ করছেন। ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি গইড়া তুলার সাথে সরাসরি কানেক্টেড ছিলেন। কিন্তু এখন ইসরায়েল সেইখানে যা চালাচ্ছে, সেইডা তিনি দেখতে পারেন না। তাই এখনকার ইহুদি জাতীয়তাবাদিরাও তারে দেখতে পারে না। ১৯৪১ সালে তিনি আমেরিকা চইলা যান। তার একদশক পরে বই লেখালেখির মাধ্যমে একাডেমিক তাত্ত্বিক হিসাবে নিজের অবস্থানডা শক্তপোক্ত কইরা নেন।

রাজনীতিতে একটা জিনিস উনি খুব মানেন। সেইডা হইলো ‘কিছু করা’। ‘কিছু করাডা’-রে উনি অত্যন্ত পজিটিভ হিসাবে দেখেন। আর মনে করেন যে, আমাগো অবশ্যই লাইফের পুরা আনন্দ পাইতে হলে পাবলিক লাইফে আসতে হবে, ‘কিছু করতে’ হবে। আর এইডা তখনই সম্ভব হবে, যখন অন্য মানুষের উপর আমাগো আস্থা থাকবে। কম্যুনিজম নিয়া আরেন্টের বোঝাপড়া বেশ ইন্টারেস্টিং। কম্যুনিস্টগো উনি খুব একটা কাজের মনে করেন না। সমালোচনা করেন অনেক শক্ত কইরা। যুক্তি দিয়া দেখান যে এইডা পুঁজিবাদেরই অন্যরূপ। কিন্তু ওনার দ্বিতীয় স্বামী, হেনরিক ব্লুচার ছিলেন একজন কমুনিস্ট। লোকে বলাবলি করে, সমালোচনা করলেও নাকি কমুনিস্টগো উপর উনার সিমপ্যাথি ছিলো। আর আমেরিকারেও উনি পুরোপুরি সুবিধার জিনিস মনে করতেন না।

উনার বিখ্যাত বইগুলার মধ্যে আছে দ্য অরিজিন্স অফ টোটালিটারিয়ানিজম (১৯৫১), দ্য হিউম্যান কন্ডিশন (১৯৫৮), অন রেভ্যুলিউশন (১৯৬৩), ইশমান ইন জেরুজালেম (১৯৬৪)।

১৯৭৫ সালে উনি মারা যান।

সুমাইয়া ফেরদৌস
জানুয়ারি, ২০২৪

[ইন্টারভিউ’র শেষের দিকের অংশ…]

গাউস: মিস আরেন্ট, আপনার রাজনৈতিক-দার্শনিক ভাবনাচিন্তা, বা সামাজিক বিশ্লেষণ, এইগুলার মাধ্যমে আপনি যেইটা জানতে পারেন, সেইটা প্রকাশ করাটাকে কি আপনার দায়িত্ব বইলা মনে করেন? নাকি আপনি যেইটা জানেন, সেইটা নিয়া নীরব থাকারও বিষয়-আশয় থাকে?

আরেন্ট: হুম, এইটা আসলে অনেক কঠিন একটা সমস্যা। আইখম্যানের বই নিয়া যে বিতর্ক হইছিলো, শুধু এই প্রশ্নটার কারণেই ঐটা নিয়া আমার আগ্রহ ছিলো। কিন্তু আমি শুরু না করলে এইটা নিয়া কখনো কথা হইতো না। এইটাই ছিলো একমাত্র সিরিয়াস প্রশ্ন, বাকিসব হইলো পিওর প্রোপাগান্ডা। তো, প্রশ্ন হইতেছে, ফিয়াট ওয়েরিটাস, এট পেরেয়াট মুন্ডুস [দুনিয়া ধ্বংস হোক, তাও সত্য কও]? কিন্তু, আইখম্যানের বইতে আসলে এই ধরণের কোনো বিষয় ধরাই হয়নি। বইটা কোনোভাবেই কারো বৈধ স্বার্থের কোনো ক্ষতি করে না। কেউ কেউ এমনটা ভাবছে আরকি শুধু।

[ফিয়াট ইয়াস্টিয়া, এট পেরেয়াট মুন্ডুস [দুনিয়া ধ্বংস হোক, তাও ন্যায় থাক] — এইডা একটা পুরালো ল্যাটিন প্রবাদ। আরেন্ট এইটারেই ঘুরাইয়া কইছিলেন। চাইলে আরো দেখতে পারেন পাস্ট & ফিউচারের (নিউ ইয়র্ক: ভাইকিং প্রেস, ১৯৬৮) ১২৮ নাম্বার পাতা।]

গাউস: কোনটা বৈধ, সেই প্রশ্নটা অবশ্যই আলোচনার সুযোগ রাখা উচিত।

আরেন্ট: হ, সেইটা সত্য। আপনি ঠিক বলছেন। কোনটা বৈধ, সেইটা নিয়া আলোচনার সুযোগ এখনও আছে। আমি আসলে “বৈধ” [লেজিটিমেট] কইতে যেইটা বুঝাইছি, সেইটার সাথে মনে হয় ইহুদি সংগঠনগুলো যেইটা বুঝায়, তার মিল নাই। কিন্তু ধইরা নেওয়া যাক, সত্যিকারের স্বার্থ ঝুঁকিতে ছিলো, যেইটা আমিও স্বীকার করতেছি।

গাউস: তারমানে সত্য জাইনাও কেউ চাইলে চুপ থাকতে পারে?

আরেন্ট: আমি কি চাইলে চুপ থাকতে পারতাম? অবশ্যই! আসলে আমি লিখতাম হয়তো… কিন্তু দেখেন, আমারে একজন জিজ্ঞাস করছিলো, আমি যদি কোনো না কোনো একটা বিষয় ধইরা নিতাম, তাইলে কি আইখম্যানের বইটা ভিন্নরকম কইরা লেখতাম না? আমি কইছিলাম, না। বরং, বিকল্প নিয়া ভাবতাম। সেইটা হইলো, বইটা লিখবো, নাকি লিখবো না? কারণ, চাইলে কেউ চুপ কইরাও থাকতে পারে।

গাউস:হ্যাঁ।

আরেন্ট: কাউরে সবসময় কথা কইতে হবে বিষয়টা এমন না। কিন্তু এরপর যে প্রশ্নটা আসে, সেইটারে আঠারো শতকে ‘ট্রুথস অফ ফ্যাক্ট’ নামে ডাকা হইতো। এইটা কিন্তু আসলেই ট্রুথস অফ ফ্যাক্টেরই একটা বিষয়, কার কি মতামত সেইটার বিষয় না। এই ট্রুথস অফ ফ্যাক্টের গার্ডিয়ান হইলো বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ইতিহাস বিজ্ঞানগুলা পড়ানো হয়, সেইগুলা।

গাউস: তারা গার্ডিয়ান হিসাবে সবসময়ই যে ভালো, সেইটাও কিন্তু না।

আরেন্ট: না। তারা কলাপস করে। তাগোরে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ করে। আমারে কেউ একজন এক ইতিহাসবিদের কথা কইছিলো। সেই ইতিহাসবিদ নাকি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অরিজিন নিয়া লেখা কোনো বইয়ের উপর মন্তব্য করছিলো: “আমি এইটারে ওইরকম চমৎকার একটা সময়ের স্মৃতি নষ্ট করতে দিবো না।” এ হইলো এমন এক মানুষ যে আসলে জানেনা সে কে। কিন্তু এইটা তেমন ইন্টারেস্টিং না। বাস্তবে সে হইলো ঐতিহাসিক সত্যের গার্ডিয়ান, ট্রুথ অফ ফ্যাক্টের গার্ডিয়ান। আর বলশেভিক ইতিহাস থাইকা আমরা জানি এই গার্ডিয়ানগো গুরুত্ব আসলে কতখানি। যেমন, পাঁচ বছর পর পর ইতিহাস নতুন কইরা লেখা হয়, কিন্তু সত্যি কথা অজানাই থাইকা যায়: যেমন ধরেন, মিস্টার ট্রটস্কি বইলা একজন ছিলো কিন্তু। আমরা কি এইরকম কিছু চাই? সরকার কি এইসব জিনিস নিয়া ইন্টারেস্টেড?

গাউস: এইগুলা নিয়া তারা ইন্টারেস্টেড হইতেই পারে। কিন্তু তাগোর কি এইসব করার রাইট আছে?

আরেন্ট: তাগোর কি এইসব করার রাইট আছে? দেইখা মনে হয় যে এইটা তারা নিজেরাও বিশ্বাস করে না। নাইলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলারে সহ্য করার কোনো দরকার ছিলো না তাগোর। তারমানে সত্য নিয়া রাষ্ট্রেরও আগ্রহ আছে। আমি কিন্তু মিলিটারি সিক্রেটের কথা কইতাছি না; ওইডা ভিন্ন জিনিস। কিন্তু এই ঘটনাগুলার বয়স বিশ বছর। তাইলে সত্যিটা না কওয়ার কি কারণ আছে?

গাউস: এমন তো হইতে পারে যে বিশ বছর এখনো অনেক কম সময়?

আরেন্ট: এইকথা ম্যালা মানুষ কয়; আবার অনেকেই আছে কয় যে বিশ বছর পর আসলে কেউ আর সত্যিটা খুঁইজা বাইর করতে পারে না। ব্যাপার যা-ই হোক, আসল ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার ব্যাপারে একটা ইন্টারেস্ট আছে। কিন্তু তার মানে এই না যে সেইটা একটা বৈধ ইন্টারেস্ট।

গাউস: সন্দেহের বিষয় থাকলে আপনি সত্যিটাই প্রিফার করবেন।

আরেন্ট: আমি ব্যাপারটারে বলবো নিরপেক্ষতা – যেই জিনিসটার সাথে দুনিয়ার পরিচয় হয় হোমার যখন…।

গাউস: যে হাইরা গেছে তার জন্যেও…

আরেন্ট: ঠিক!

যে হাইরা গেছে তার জন্য যদি
গান গাওয়ার কেউ না থাকে,
তাইলে আমি হোমার
নিজেই হেক্টরের হয়ে সাক্ষী দিবো

[শিলারের দাস সিগেসফেস্ট থাইকা]

ঠিক কিনা? হোমার কিন্তু ওই কাজটাই করছিলো। এরপর আসলো হেরোডোটাস, যে কিনা “গ্রিক আর বর্বরগো মহান কাজকর্ম’’ নিয়া লেইখা গেছে। এই স্পিরিটটা থেকেই কিন্তু সব ধরণের বিজ্ঞানের জন্ম, এমনকই আধুনিক বিজ্ঞান, ইতিহাস বিজ্ঞান এইগুলাই আসছে ওইখান থেকে। যদি কেউ নিজের জাতের মানুষরে খুব ভালোবাসে বইলা এই নিরপেক্ষতা দেখাইতে অক্ষম হইয়া সবসময় তেলবাজি করতে ব্যস্ত থাকে – তাইলে আর কি করার আছে? আমি মনে করি না যে এই ধরণের মানুষরে দেশপ্রেমিক কওয়া যায়।

গাউস: আপনার সবচেয়ে জরুরি কাজগুলোর মধ্যে একটা হইলো ‘দ্য হিউম্যান কন্ডিশন’। মিস আরেন্ট, ওইখানে আপনি একটা সিদ্ধান্তে আসছেন যে, সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা ধারণা আধুনিক যুগে আইসা হারায়া গেছে, যেইটা হইলো রাজনীতিকে সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়ার ধারণা। বিপুল পরিমাণ শিকড় ছাড়া মানুষ আর তাগো লোনলিনেসরে আপনি আধুনিক সমাজের বিষয় বইলা শনাক্ত করছেন। এই মানুষগুলো খালি শ্রম দিয়া আর ভোগ কইরাই তৃপ্ত থাকে। আমার এইটা নিয়া দুইটা প্রশ্ন আছে। প্রথমডা হইলো, এই ধরণের দার্শনিক জ্ঞান আসলে ব্যক্তিগত কোনো অভিজ্ঞতার, যেই ধরণের অভিজ্ঞতা থেইকা চিন্তার শুরু হয় আরকি, সেইগুলার উপর কতটা নির্ভরশীল?

আরেন্ট: আমি বিশ্বাস করি না যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ছাড়া কোনোদিনও কোনো চিন্তার শুরু হওয়া সম্ভব। সব চিন্তাই আসলে আফটারথট, মানে যা আসলে আগের কোনো বিষয় বা ঘটনার সুতা ধইরা আসে। তাইতো, নাকি? আমি আধুনিক যুগের মানুষ, তাইলে তো আমার অভিজ্ঞতা আসলে আধুনিক যুগরে নিয়া, আধুনিক যুগেরই অভিজ্ঞতা। এইটা তো আর তর্কের বিষয় না। কিন্তু খালি শ্রম দিয়া আর ভোগ কইরা তৃপ্ত থাকার বিষয়টার গুরুত্ব খুব বেশি। কারণ ওইখানেও একটা ওয়ার্ল্ডলেসনেসের ব্যাপার আছে। মানে দুনিয়াটা কেমন থাকলো এইডা নিয়া কেউ আর মাথা ঘামায় না।

গাউস: “দুনিয়া” মানে সবসময়ই এমন একটা জায়গা, যেইখান থেকে রাজনীতি শুরু হইতে পারে।

আরেন্ট: আমি এখন বিষয়ডারে আরো বড় কইরা দেখি। এইডা হইলো এমন একটা জায়গা যেইখানে জিনিসপত্র পাবলিক হইয়া ওঠে, এইডা হইলো এমন একটা জায়গা যেইখানে মানুষ বসবাস করে, এবং সেইটা মাস্ট প্রেজেন্টেবল হইতে হবে। এবং অবশ্যই, আর্টের জন্মও হয় এইখানে। এইখানে আসলে সব ধরণের জিনিসপত্রেরই জন্ম হয়। আপনার মনে থাকার কথা, কেনেডি একদম সিদ্ধান্ত নিয়াই একটা কাজ করছিলেন একবার। পাবলিক পরিসর বাড়ানোর জন্য উনি হোয়াইট হাউজে কবি থেকে শুরু কইরা এমন আরো অনেক অকম্মাদের হোয়াইট হাউজে দাওয়াত দিছিলেন। যাতে এই সবকিছুই ওই পরিসরটার আওতায় আসতে পারে। তয়, শ্রম আর ভোগ করার চক্করে পইড়া মানুষ একেবারে নিজেরে লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়ে।

গাউস: জৈবিক বিষয় লইয়া আরকি।

আরেন্ট: জৈবিক বিষয় লইয়া আর নিজেরে লইয়া। এবং ওইখানেই কিন্তু আপনি লোনলিনেসের সাথে কানেকশনটা পাইয়া যাবেন। লেবার প্রসেসের ভিতর দিয়া এক অদ্ভুত ধরণের লোনলিনেস তৈরি হয়। সেইডা নিয়া এখন কথা কইতে চাই না, তাইলে বিষয় থেকে অনেক দূরে চইলা যাওয়া লাগবে। কিন্তু এই লোনলিনেসের কারণ হইলো নিজেরে লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়তে বাধ্য হওয়াটা। সেইডা তখন এমন একটা পরিস্থিতি হইয়া দাঁড়ায় যে, অন্য মানুষের সাথে মেলামেশার সমস্ত ব্যাপার বাদ পইড়া সেই জায়গা দখল কইরা নেয় ভোগ।

গাউস: এই বিষয়ে দ্বিতীয় প্রশ্নটা হইলো: ‘দ্য হিউম্যান কন্ডিশন’ বইতে আপনি আরেকটা সিদ্ধান্তে আসছেন যে, “সত্যিকারের দুনিয়াবি অভিজ্ঞতা”– মানে আপনি বুঝাইতে চাইছেন সেইসব ইনসাইট আর অভিজ্ঞতার কথা যেইগুলা রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব নিয়া চলে, তো সেইগুলা “সাধারণ মানুষজনের অভিজ্ঞতার আওতা থেকে দিন দিন বাইরে চলে যাইতেছে।” আপনি বলছেন, “এখন কিছু করার ক্ষমতা খুব অল্প মানুষের হাতে।” মিস আরেন্ট, বাস্তব রাজনীতির হিসাবে এইটা দিয়া কি বুঝায়? অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হইলেও যেই সরকারের ভিত্তি হইলো সকল জনগণের দায়িত্বশীলতা ও সহযোগিতা, সেই বিষয়টা তো এই সময়ে আইসা আজগুবি গল্প হইয়া গেছে। এখন আমি জানতে চাই যে, এইটা ঠিক কতখানিক আজগুবি হইছে?

আরেন্ট: আমি বিষয়ডা আরেকটু ব্যাখা করতে চাই। দেহেন, খালি জনগণ না, বাস্তবের সাথে যুক্ত না হইতে পারার ব্যর্থতা সমাজের বাদবাকি ধাপেও দেখবেন। এমনকি আমি তো বলবো এইডা আপনি মন্ত্রী এমপিগো মধ্যেও দেখবেন। মন্ত্রী এমপিগো চারপাশে সবসময় একপাল বিশেষজ্ঞ থাকে। কিছু করতে পারার প্রশ্নডা তহন মন্ত্রী এমপি আর বিশেষজ্ঞগো মইধ্যে ঘুরপাক খায়। ফাইনাল সিদ্ধান্তডা মন্ত্রী এমপিগোরেই নিতে হয়। কিন্তু বাস্তবে এইডা করা তো প্রায় অসম্ভবই, কারণ সে তো আর নিজে সবকিছু জানতে পারে না। তারে তহন পরামর্শের জন্য বিশেষজ্ঞগো কাছেই যাইতে হয়। কিন্তু তাগো কাজের প্রিন্সিপালই তো হইলো একজন আরেকজনরে বিরোধিতা করা। তাইতো, নাকি? জ্ঞানবুদ্ধি আছে এমন যেকোনো মন্ত্রী বা এমপি ভিন্ন ভিন্ন মতের বিশেষজ্ঞগো সাথে আলাপ আলোচনা করে। কারণ তারে তো সকল দিকে থেইকাই দেখতে হবে বিষয়ডা। ঠিক কি না? তারে এইগুলা বিচার করে দেখতে হবে। আর এই বিচার প্রক্রিয়াডা হইলো অত্যন্ত রহস্যজনক একটা প্রক্রিয়া – যেইডার ভিতর দিয়া কমনসেন্সরে প্রকাশ করা হয়। জনগণ এইডা নিয়া কতডা মাথা ঘামায়? আমি বলবো যে: মানুষ যহনই একসাথে হয়, তা সংখ্যায় যতোই হোক, বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় পাবলিক ইন্টারেস্ট।

[“কমন সেন্স” (গেমাইনজিন) দিয়া আরেন্ট যেইডা বোঝাইছেন, তার সাথে বড় মানুষরা সবসময় যে ধরণের জ্ঞানবুদ্ধি নিয়া চলার চেষ্টা করে, যেইডারে জার্মান ভাষায় কওয়া হয় ‘গেজুন্ডার মেনশেনফেয়ার্সট্যান্ড’ ঐ বিষয়ডার কোনো মিল নাই। উনি বরং বলছেন, যেইডা কান্ট কইছিলো, “এমন একটা সেন্স যেইডা সবার মধ্যেই কমন… যেইডার ছায়ায় পরবর্তীতে এক প্রকার বিচারবুদ্ধি তৈরি হয়…. যেইডার মিল পাওয়া যায় অন্য সব মানুষের মধ্যে,” ইমানুয়েল কান্ট, ক্রিটিক অফ জাজমেন্ট, ৪০, এইডার রেফারেন্স পাওয়া যায় কান্টের পলিটিকাল ফিলোসফি নিয়া আরেন্টের লেকচারে, যেইডা পরে আর. বেইনারের সম্পাদনায় পাবলিশ হয় (শিকাগো: ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো প্রেস, ১৯৮২), ৭০-৭২]

গাউস: সবসময়ই।

আরেন্ট: এবং এমনেই তৈরি হয় পাবলিকের দুনিয়া। আমেরিকায় এইডা আপনি আরো পরিষ্কারভাবে দেখতে পাবেন। ওইখানে এখনো একা একাই গইড়া উঠছে এইরকম সমিতির দেখা পাওয়া যায়, যেইগুলা আবার একা একাই ভাইঙ্গা যায় – এই ধরণের সমিতির কথা টোকোভিল আগেই বইলা গেছেন। পাবলিক ইন্টারেস্টের কিছু কিছু বিষয় আছে যেইগুলা কোনো একটা নির্দিষ্ট গ্রুপের সাথে জড়িত। হইতে পারে তা কোনো পাড়া, কিংবা শুধু একটা মাত্র বাড়ি, কিংবা কোনো শহর বা অন্য কোনো ধরণের গ্রুপ। এই মানুষগুলা এরপর একসাথে হয়। তহন কিন্তু তারা এইসব বিষয়ে পাবলিকলি কাজ করার শক্তি রাখে – কারণ তারা কে এইটা নিয়া তাদের একটা ধারণা থাকে। আপনার প্রশ্নটা কিন্তু ছিলো সবচেয়ে উচুঁ পর্যায় থেকে নেওয়া বড় বড় সিদ্ধান্তগুলো সম্পর্কে। এবং, বিশ্বাস করেন, এইসব মন্ত্রী এমপি ওই রাস্তায় থাকা মানুষগো মাঝে তেমন মূল কোনো পার্থক্য নাই।

গাউস: মিস আরেন্ট, আপনার সাবেক শিক্ষক কার্ল জ্যাসপারের সাথে আপনার খুব ভালো যোগাযোগ ছিলো, আপনাগো ভিতর একটা ডায়লগ চলতেছিলো। আপনার উপর প্রফেসর জ্যাসপারের সবচেয়ে বড় প্রভাব কোনটা বইলা আপনার মনে হয়?

আরেন্ট: আসলে জেসপার যখন আইসা কথা কওয়া শুরু করে, সব কিছু কেমন আলোয় ভইরা যায়। তার ভিতর একটা খোলামেলা ব্যাপার আছে, একধরণের বিশ্বাস, কথার ভিতর কোনো চাওয়া পাওয়া নাই, যেইডা আমি অন্য কারো ভিতরে দেখি নাই। বয়স অনেক কম থাকতে এই ব্যাপারডা আমারে প্রচন্ড ইমপ্রেস করে। তাছাড়াও ফ্রিডম নিয়া তার একটা চিন্তা ছিলো, যেইটা কারণের সাথে সম্পর্কিত। প্রথম যখন হাইডেলবার্গ আসলাম, ওই চিন্তা তখন আমার কাছে একদম নতুন। যদিও কান্ট পড়া হইছিলো, তাও এইটা সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। বলা যায় যে, এই কারণটা আমি দেখতে পাইছি কাজের ভিতর। আরো বলা যায় যে – আমি যেহেতু বাপ ছাড়া বড় হইছি – তার কাছ থেকে আমি শিক্ষা পাইছি। খোদার কসম, আমার দায় তার ঘাড়ে ফালাইতে চাই না, কিন্তু আমার ভিতর যদি কেউ কিছু বোধবুদ্ধি ঢুকাইতে সক্ষম হয়, সেইডা হইলো উনি। তাছাড়া আজকের দিনে আইসা সেই ডায়লগটাও অবশ্যই আলাদা হয়ে গেছে একেবারেই। যুদ্ধের পর ওইডাই ছিলো আমার সবচেয়ে তীব্র অভিজ্ঞতা, যে এইভাবেও আলাপ আলোচনা করা সম্ভব! যে, কেউ এই লাইনেও কথা কইতে পারে!

গাউস: শেষ আরেকটা প্রশ্ন করতে চাই। জ্যাসপাররে শ্রদ্ধা জানায়ে আপনি একবার বলছিলেন, “একা একা কোনোদিন মানবিক হওয়া যায় না, কিংবা নিজের কাজ জনগণরে দিয়া দিলেও সেইটা মানবিকতা হয় না। এইটা খালি একমাত্র তারে দিয়াই সম্ভব যে নিজেরে শুদ্ধা নিজের জীবনরে ‘পাবলিকের দুনিয়ায় ভাসায় দিছে” এই যে “পাবলিকের দুনিয়ায় ভাসায় দেওয়া”-র ব্যাপারটা– যেইডা জ্যাসপারের একটা উক্তি– হানা আরেন্টের কাছে আসলে এই জিনিসটার মানে কি?

[“কার্ল জ্যাসপার: এ লডাশিও,” মেন ইন ডার্ক টাইমস বই থেইকা, ৭৩-৭৪]

আরেন্ট: পাবলিকের দুনিয়ায় ভাসায় দেওয়ার ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কারই মনে হয়। সেইডা হইলো কাউরে একজন ব্যক্তি হিসাবে জনগণের সামনে নিজেরে খোলাসা করতে হবে। যদিও আমার মত হইলো আত্ম-সচেতন হইয়া জনগণের সামনে আসা কিংবা কাজকর্ম করা উচিত না, যদিও আমি জানি যে, অন্য কোনোভাবেই না, কাজের মাধ্যমেই একটা মানুষ সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশিত হয়। কথা কওয়াও এক ধরণের কাজ। কথা কইলেও নিজেরে একভাবে ভাসায় দেওয়া হয়। অন্যটা হইলো: আমরা একটা কিছু শুরু করি। সম্পর্কের একটা জালের ভিতর আমরা যার যার সুতা বুনতে থাকি। এইডার ফলাফল কি হবে, তা আমরা কেউ জানি না। আমাদের এইডা বলতে শিখানো হইছে যে: আল্লা, ওগো মাফ কইরা দাও। ওরা যা করতেছে, না বুইঝা করতেছে। এইডা সব কাজের ব্যাপারেই সত্য। একেবারেই সিম্পল আর একশভাগ সত্য। কারণ, কারো জানা সম্ভব না। ভাসায় দেওয়া বলতে আসলে এইটাই বুঝানো হইছে। এখন আমি বলবো যে, এই ভাসায় দেওয়াটা আসলে তখনই সম্ভব হবে, যখন আপনার মানুষের প্রতি আস্থা থাকবে। এই আস্থা হইলো মানুষের ভিতর যতটুকু মানবতা তার উপরে আস্থা, যেই আস্থাডা আনা খুব কষ্টের, কিন্তু যেইডা একেবারেই মৌলিক। এইডা ছাড়া এমনে ভাসায় দেওয়া আসলে কোনোভাবেই সম্ভব না।

জার্মানি
২৮ অক্টোবর, ১৯৬৪

The following two tabs change content below.
Avatar photo

সুমাইয়া ফেরদৌস

বয়স পঁচিশ। তেইশ পর্যন্ত বয়স বাড়লে তার ভালো লাগতো। এরপর চব্বিশ হওয়ার সাথে সাথে কোনো এক আজব কারণে তার ছোটো মতো একটা ম্যানিয়া হয়ে গেছে যে সে বুইড়া হয়ে গেছে। জাহাঙ্গীরনগর থেকে মাস্টার্স শেষ করলো জার্নালিজমে, বেশি দিন হয় নাই।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →