আপনার যেইটা বলা লাগবে সেইটাই আপনার ফর্মটা ঠিক করে দিবে – ডোরিস লেসিং
- বইয়ের ইন্ট্রু: আমার মনেহয় একজন মানুষের ইমাজিনেশন তার রেসের ভিতর থেকে আসা অভিজ্ঞতার রেজাল্ট – আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।।
- বইয়ের ইন্ট্রু: একেক জন লেখক একেক তরিকায় লেখেন, আর কামিয়াবি তাদের কাছে একেকভাবে ধরা দেয় -টি.এস. এলিয়ট
- বইয়ের ইন্ট্রো: জীবনের মতোই আর্ট দিয়া সবাইরে খুশি করতে পারে না কেউ – পাবলো নেরুদা।
- বইয়ের ইন্ট্রু: যা দরকার… তা হইতেছে… একটা শক্তিশালী লোকাল কালচার উদ্ভাবন করা – ওরহান পামুক
- বইয়ের ইন্ট্রু : একটা কালচার যদি নিজের ক্রিয়েটিভ শক্তিটারে বাঁচায়া রাখতে চায়, তাইলে বিদেশি কালচারের ব্যাপারে উদার থাকা লাগবে – ইতালো কালভিনো।
- এই সময়ে যে কোন কিছুর চাইতে ভিডিও গেমস ফিকশনের অনেক কাছাকাছি – হারুকি মুরাকামি।
- বই: চিনোয়া আচেবে’র ইন্টারভিউ
- এলিস মুনরো’র ইন্টারভিউ (সিলেক্টেড অংশ)
- দেরিদা অন শোয়াহ
- মিডিয়ার আসলে কাজ হইতেছে সুন্দর রকমের ডিসটরশন তৈরি করা – জ বদ্রিয়া
- একটা ক্যারেক্টার কখনোই ভালো বা খারাপ কিছু করতে পারে না, সে জাস্ট ট্রুথের সাইডে থাকতে পারে বা পারে না – টারানটিনো
- আমি সবসময় লিখতে লিখতে অনুবাদ করতে থাকি – অরুন্ধতী রায়
- যেকোনো চিন্তা, পোয়েটিকাল বা অন্যকিছু, যেকোনো চিন্তাই অনেককিছুর জোট হইয়া তৈয়ার হয় – রবার্ট ফ্রস্ট
- একটা ভালো রোমান্স ফিল্ম সবসময় নিঃসঙ্গতার ফিলিংটার উপর নির্ভর করে – ওং কার ওয়াই
- সমাজের উন্নতি করা বা সমাজ পরিবর্তনের উপায় বাতলাইয়া দেওয়া ক্রিটিসিজমের কাজ না – হ্যারল্ড ব্লুম (পার্ট ১)
- ফিকশন হইলো ফ্রিডম – সুসান সনট্যাগ
- উডি এলেনের ইন্টারভিউ: সমস্যা হইতেছে ক্রিয়েটিভ হওয়ায় কিছু গ্ল্যামার আছে
- আপনি আসলে কে সেইটা ঠিক বুইঝা উঠতে পারার আগে আপনি লিখতে পারবেন না – সালমান রুশদি
- একটা নভেলে যদি লিটেরারি ট্রুথ থাকে ওইটার আর কিছু লাগে না – এলেনা ফেরান্তে
- পলিটিক্স যা করে সাহিত্য তার চাইতেও দীর্ঘস্থায়ী বিষয়ের মামলা – মারিও বার্গাস ইয়োসা
- আপনার যেইটা বলা লাগবে সেইটাই আপনার ফর্মটা ঠিক করে দিবে – ডোরিস লেসিং
- একজন লেখকরে রিস্ক নিতে হয়, সে যা দেখে সবকিছুরেই লিখতে পারার বিষয়ে – জেমস বল্ডউইন
- একজন ভালো লেখকের তার নিজস্ব স্টাইল থাকতে হয় – কেনজাবোরো ওয়ে
- সাহিত্য কোনো মোরাল বিউটি কনটেস্ট না – ফিলিপ রথ
- এমন এক অডিয়েন্স থাকে যারা আসলে কোথাও এগজিস্ট করে না – হা জিন
- সাহিত্য এবং আর্টে কিছু ভড়ং, কিছু মহৎ এটিচিওড ঢুকে গেছে, যেগুলা ডেনজারাস – চেসোয়াফ মিয়শ
- একটা নভেলের জন্ম একটা কবিতা দিয়া শুরু হয় – গুন্টার গ্রাস
ডোরিস লেসিং, কেউ কেউ তারে প্রফেট বইলা ডাকতো, উনি সেইটা পছন্দ করতেন না। তার ছবি দেখলে মনে হয় কিছু মুখ আছে, যাগো দিকে তাকাইলে তারা দেখতে সুন্দর কিনা এই প্রশ্ন ইনকনসিকুয়েনশিয়াল হয়ে যায়। তার জন্ম ১৯১৯ সালে, ইরানে। জাতে ব্রিটিশ। তিনি সাহিত্যিক, ২০০৭ সালে নোবেল পাইছিলেন। বাপের কর্ম আর বাতিকের সুবাদে জন্মের পর ১৯২৫ সাল পর্যন্ত কাটছে ইরানে, এরপর রোডেশিয়ায়। ইংল্যান্ডে ফিরতে ফিরতে তার ১৯৩৭। তাই ব্রিটিশ হইয়াও সে খুব একটা ব্রিটিশ না।
তার মৃত্যুর পর গার্ডিয়ানে যে অবিচুয়ারি বাইর হয়, সেইখানে লেখা হইছে সে জীবনে অনেক কিছু হইছে। কোনো সময় কমুনিস্ট সোশাল রিয়েলিস্ট, কোনো সময় দায়ে পড়ে নারীবাদী, কিছুকাল খুঁজলেন সুফীবাদ, হইলেন ক্যাসান্দ্রা (গ্রীক পুরাণে আছে, অ্যাপোলো এই নারীরে আশির্বাদ দিছিলো, তার প্রফেসি সব সত্যি হবে আর অভিশাপ দিছিলো, কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না), এরপর নিজেই নিজেরে বসাইলেন কসমিক অ্যানথ্রোপলজিস্টের পদে।
কসমিক অ্যানথ্রোপলজিস্টরা হইলো অ্যানথ্রোপলজিস্ট, যারা কয় মানবজাতি বিশ্বজগৎ সম্পর্কে যা ভাবে তা তাগো সমাজের কাঠামো তৈরিতে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হইয়া দাঁড়ায়। ক্যাসান্দ্রা বা প্রোফেটের ব্যাপার যেইটা হইলো, উনি নাকি অনেক আগে থেকেই বুঝতে পারতেন রাজনীতি, সমাজ এইগুলার ট্রেন্ড কী হইতে যাচ্ছে। এবং তার লেখাপত্তরে সেইসব পাওয়া যাইতো। যেমন এহন তো আমরা টেররিস্ট শব্দডা ধুমসে সবাই জানি। কিন্তু ১৯৮৫ সালে তেমন কেউ জানতো না। কথাই হইতো না এইডা নিয়া। অথচ তহন উনি লিখলেন ‘দ্য গুড টেররিস্ট’। সেইখানে আবার দেখাইলেন, জীবনে কিছুই যেমন ঠিকঠাক চলে না, যেমন চলার কথা তেমন চলে না, তেমন টেররিস্টরাও ঠিকঠাক কইরা টেররিস্টগিরি করতে পারে না। তারে কেউ কেউ কয় শেপ শিফটার। কারণ উনি একেক সময় একেক রকম লিখছেন। কোনো সময় হার্ডকোর রিয়েলিজম আবার কোনো সময় নির্জলা ফ্যান্টাসি।
এই ইন্টারভিউতেই কইছেন, রিয়েলিস্টরা তারে কয় ফ্যান্টাসি রাইটার, ফ্যান্টাসিওয়ালারা কয় উনি লেখেন রিয়েলিজম। গার্ডিয়ান তার অবিচুয়ারিতে কইছে তার ছোটগল্প, উপন্যাস এইগুলা হইলো ভয়ানক রকমের মৌলিক। দ্য গ্রাস ইজ সিঙ্গিং (১৯৫০), দ্য চিলড্রেন অফ ভায়োলেন্স সিকোয়েন্স (১৯৫২-৬৯), দ্য গোল্ডেন নোটবুক (১৯৬২)– এইগুলারে বিবেচনা করা হয় ২০ শতকের ক্লাসিক। আরো আছে কানোপাস ইন আরগোস (১৯৭৯-৮৩) নামের সায়েন্স ফিকশন সিরিজ, মেমোয়ার্স অফ এ সার্ভাইভার (১৯৭৪), গুড টেররিস্টের কথা তো আগেই কওয়া হইছে, লাভ, এগেইন (১৯৯৬) এইসব। এইগুলা একটা আরেকটার চেয়ে অনেক আলাদা। আর জেন সমার্স নামে যে খেলাটা খেললেন, সেইটা নিয়া টমাস ফ্রিক-ই খুঁচায়া খুঁচায়া শুনছেন।
ফ্রিক এই ইন্টারভিউটা নিছিলেন ১৯৮৮ সালে, দ্য প্যারিস রিভিউ পত্রিকার জন্য। ইন্টারভিউয়ের এক জায়গায় লেসিং বলছেন, তার লেখা পইড়া পাঠক এক ধরণের গোসল দিয়া ওঠে, এইরকম ভাবতে তার ভালো লাগে। তার ইন্টারভিউ পইড়াই অনুবাদক ভালো একটা গোসল দিয়া উঠছে। লেখা পইড়া না জানি কী হবে।
অক্টেবর, ২০২৩
…
ডোরিস লেসিং-এর এই ইন্টারভিউটা নেওয়া হইছিলো ম্যানহ্যাটনের ইস্ট ফোর্টিজে, রবার্ট গটলেইবের বাসায়। ভদ্রলোক অনেকদিন ধরে নফ (Knopf) পাবলিকেশনে লেসিং-এর সম্পাদক ছিলেন। এখন উনি নিউ ইয়র্কারের এডিটর। ম্যানহ্যাটনে লেসিং আসছেন অল্প কয়দিনের জন্য, একটা কাস্টিং-এর কাজে। উনার ‘দ্য মেকিং অফ দ্য রিপ্রেসেন্টেটিভ ফর প্ল্যানেট এইট’ উপন্যাস নিয়া অপেরা বানাইতে চান ফিলিপ গ্লাস। সেখানে লিব্রেটো (libretto) লেখছেন ডোরিস (লিব্রেটো হইলো অপেরার গানের লিরিক্স)। এই অপেরার প্ল্যান খালি বদলাইতেছে। ইন্টারভিউটার সময় ঠিক করার জন্য বেশ কয়েকদফা পোস্টকার্ড চালাচালি করা লাগছে লেসিং-এর সাথে। উনি আবার বেশিরভাগ সময় পোস্টকার্ডে যোগাযোগ করেন, যেগুলা সাধারণত ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে নেওয়া।
টেপ রেকর্ডার রেডি করতে করতে লেসিং বলতেছিলেন, “একসারি বাড়ির পেছনে বাগান, তাও কি গ্যাঞ্জাম ভাবো একবার।” হাত তুলে রাস্তার ওইপাশে টাউন হাউজ দেখায়ে বললেন, ওইখানে ক্যাথরিন হেপবার্ন থাকে। এরপর কিছুক্ষণ শহর নিয়াই কথা হইলো। চল্লিশ বছর ধইরা লন্ডনে আছেন উনি, এরপরো মনে হয়, “শহরের সবকিছু সবসময়ই অসাধারণ!” আরেকখানে সে যা বলছিলো, তা আরেকটু বেশি কড়া, “ধরো যদি জানা যায়, বিল্ডিং-এর সাইজ আমাদের এমনে প্রভাবিত করে যে আমরা ভাবতেও পারি না, তাইলে আমি মোটেও অবাক হবো না।” বয়স পাঁচ বছর হওয়ার আগে ছয়মাস লন্ডনে ছিলেন ডোরিস, বলতেছিলেন, “আমার মনে হয় বাচ্চাদের নিয়া ঘুরাঘুরি করা উচিত। বাপ-মায়ের জন্য ঝামেলার হইলেও বাচ্চাদের জন্য বিষয়টা খুবই ভালো।”
ইন্টারভিউটা নেওয়া হয় বাগানের বারান্দায় বসে। কালো চুলগুলার মাঝে দুই একটা সাদা হয়ে গেছে। মাঝখানে সিঁথি করে সেগুলা পিছন দিকে খোপা করা। পরনে ছোটোখাটো স্কার্ট, ব্লাউজ আর জ্যাকেট। দেখতে বইয়ের কভারে থাকা ফোটোর মতোই লাগতেছিলো উনারে। ক্লান্ত কিছুটা, তা গত কিছুদিনের ব্যাপক ঘুরাঘুরির ফল। গলার স্বর তেজী আর সুরালো, একই সাথে তীক্ষ্ণ আর বিস্মিত, আকুল আর রসালো।
টমাস ফ্রিক
১৯৮৮
ইন্টারভিউয়ার: আপনি তো পারস্য দেশে জন্মাইছিলেন, যেইটা এখন ইরান। আপনার বাপ-মা ওইখানে গেছিলো কেমনে?
ডোরিস লেসিং: আমার আব্বা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছিলেন। যুদ্ধ শেষে উনি আর ইংল্যান্ডে থাকতে পারেন নাই। ওই দেশ তখন তার কাছে অনেক ছোটো মনে হইতো। যুদ্ধের ময়দানে সৈন্যদের এতো বিশাল অভিজ্ঞতা হয় যে, এরপর তারা আর বাড়িতে টিকতে পারে নাই। তাই আব্বা তার ব্যাঙ্কের কাছে বলে তারে অন্য কোথাও পাঠায় দিতে। তো তারা তারে পারস্য পাঠায় দেয়। ওইখানে আমাদেরকে অনেক বড় একটা বাড়ি দেয়া হইছিলো, যেইখানে ঘরগুলাও ছিলো বিশাল। অনেক জায়গা ছিলো আশেপাশে। এমনকি চড়ার জন্য ঘোড়াও দিছিলো আমাদের। সককিছু অনেক খোলামেলা, অনেক সুন্দর ছিলো। আমি জাস্ট শুনলাম যে, ওই শহর এখন ভাইঙ্গা ফেলছে। ওইটা ছিলো একটা সময়ের স্মৃতি। ওইটা ছিলো অনেক পুরান পুরান বাজার আর সুন্দর সুন্দর বিল্ডিং-এর শহর। কেউ খেয়ালই করলো না। এতো কিছু ভাংছে যে আমাদের আর খেয়াল করার টাইম নাই। তো তারপর তারে তেহরান পাঠানো হয়। ওইটা দেখতে খুব বাজে একটা শহর। তয় আমার মা সেইখানে অনেক ভালো ছিলো, কারণ সে একটা গ্রুপের সাথে মিশা শুরু করে। সেইটার নাম ছিলো “লেগেশন সেট’’। মা ওদের সাথে থাকা প্রতিটা সেকেন্ড খুব এনজয় করত। প্রতিরাতেই তাদের ডিনার পার্টি থাকতো। এরপর ১৯২৪ সালে আমরা ইংল্যান্ড ব্যাক করি। ওইখানে তখন এম্পায়ার এক্সিবিশন নামে এক মেলা চলতেছিলো (মাঝে মাঝেই গল্প উপন্যাসে এর নাম শোনা যায়) যেইটার একটা বিশাল বড় প্রভাব থাকার কথা সেইসময়। সেই মেলায় দক্ষিণ রোডেশিয়ার যে তাবু ছিলো, সেইখানে বিশাল বড় বড় যব, ভুট্টো এইসব সাজানো ছিলো। ওদের স্লোগানে “পাঁচ বছরে বড়লোক হয়ে যান” আর এইরকম অনেক হাবিজাবি লেখা ছিলো। এইগুলা দেখে আমার রোমান্টিক আব্বা ব্যাগপত্র গোছানো শুরু করলো। যুদ্ধের সময় পায়ে আঘাত পাওয়ার জন্য উনি পেনশনের সামান্য কিছু টাকা পান – পাঁচ হাজার পাউন্ড মতো – সেইটা নিয়া উনি চললেন অজানা এক দেশে, কৃষক হওয়ার জন্য।
আব্বা ছোটোকালে কলচেস্টারে থাকতেন। সেইসময় ওইটা ছিলো খুব ছোট একটা শহর। উনি আসলে ওইখানে গ্রাম্য পরিবেশে চাষার ছেলে হিসেবেই বড় হইছেন। তো এমনেই আসলে উনি আমাদের নিয়া রোডেশিয়া চলে আসেন। সেই সময়ের হিসাবে এই গল্প কিন্তু মোটেও আলাদা কিছু না। বুঝতে কিছুটা সময় লাগছে আমার, কিন্তু শিকাস্তা লেখার সময় এইটা আমারে খুব গভীরভাবে নাড়া দেয় যে ওই সময় আসলে যুদ্ধে আহত হওয়া সৈনিকের সংখ্যা ছিলো অনেক, সেইটা ইংরেজ, জার্মান দুই পক্ষেই। এদের সবাই মারাত্মক আঘাত পাইছে, এদের সবাই ভীষণ লাকি যে এরা মারা যায় নাই, এদের সবার পরিবারের লোকজনও অনেক লাকি।
ইন্টারভিউয়ার: আমাদের এইখানে ভিয়েতনাম ফেরত সৈন্যরা যে আসার পর আর মানায়া নিতে পারে নাই, সমাজ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তার সাথে এই ব্যাপারটার মনে হয় মিল আছে।
লেসিং: আমি ভেবে পাই না ওই ধরণের কোনো অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া যাওয়ার পরে কেউ হুট করে কেমনে মানায়া নিতে পারে। এইটা অনেক বেশি চাওয়া হয়ে যায়।
ইন্টারভিউয়ার: কয়দিন আগে গ্রান্টা ম্যাগাজিনে আপনার একটা মেমোয়ার পাবলিশ হয়, শিরোনাম অনুযায়ী ওইটা ছিলো আপনার মা-রে নিয়া একটা লেখা। কিন্তু কিছু বিষয়ে মনে হইছে ওইখানে আপনার বাবার কথাই বেশি ছিলো।
লেসিং: আসলে তাদেরক নিয়া আলাদা আলাদা লেখা কি সম্ভব? মা তো তার জীবন, যেমনটা তখন বলা হইতো, আব্বার জন্য উৎসর্গ করছিলো।
ইন্টারভিউয়ার: উনার ব্যাপারে পড়তে গিয়া কিন্তু দারুণ লাগছে, বিশেষ করে উনার পরশ পাথর দিয়া সোনা বানানোর চিন্তা, উনার বড় বড় সব পরিকল্পনা, উনার নানান এডভেঞ্চার…
লেসিং: আমার বাপ ছিলো আসলেই এক আজব লোক। দিন-দুনিয়া নিয়া তার কোনো হুঁশই ছিলো না। এর পিছনে যুদ্ধের একটা ভূমিকা ছিলো। যুদ্ধ শেষে উনি আর খাপ খাওয়াতে পারেন নাই, ভেসে গেছিলো একরকম। আমার মা ছিলো এইখানে ভরসা করার মতো, উনি সবকিছু ঠিকঠাক রাখছিলেন।
ইন্টারভিউয়ার: আমার মনে হইছে পরশ পাথর নিয়া উনি বেশ প্রগতিশীল আর বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা করছেন।
লেসিং: উনার ধারণা ছিলো যদি উপায় জানা থাকে, তাইলে শুধু সোনা কেনো, যেকোনো ধাতুই বানানো সম্ভব। এই চিন্তার ভিতর কিছুটা সত্য থাকতেই পারে। তো, উনি সবসময়ই পরীক্ষা-নীরিক্ষার তালে থাকতেন। কথায় কথায় চলে আসলো, আমি তারে নিয়াও একটা গল্প লিখছিলাম। ওইটার নাম “এলডোরেডো”। আসলে আমরা যেখানে ছিলাম, ওইটা ছিলো একটা সোনার দেশ। চারপাশে ছোট ছোট সোনার খনি দিয়া ভর্তি ছিলো।
ইন্টারভিউয়ার: তারমানে তার বিষয়টা খুব একটা আজগুবি ছিলো না।
লেসিং: একেবারেই না! ওইখানকার চাষারা গাড়ির ভিতর সবসময় একটা হাতুড়ি আর গামলা রাখতো। মাঝে মাঝেই বাড়ি আসার সময় হালকা-পাতলা সোনা আছে এমন পাথর নিয়া আসতো।
ইন্টারভিউয়ার: ছোটোকালে কী আপনার আশেপাশে অনেক গল্প বলা মানুষ ছিলো?
লেসিং: নাহ… আফ্রিকানরা গল্প বলতো, কিন্তু আমাদের মিশতে দিতো না ওদের সাথে। এইটা ছিলো ওইখানে থাকার সবচেয়ে বাজে দিক। মানে এইটা না থাকলে আমি কিন্তু বাচ্চাকালে সবচেয়ে দারুণ অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া যাইতে পারতাম। কিন্তু একটা সাদা চামড়া ওয়ালা বাচ্চা এইগুলার কিছুই বুঝতে পারতো না। এখন আমি ইংল্যান্ডে একটা গ্রুপের সাথে আছি, ওইটার নাম “স্টোরিটেলার’স কলেজ”। তিনবছর আগে গল্প বলারে একটা শিল্প হিসেবে চালু করার জন্য কাজ শুরু করে কয়জন। তারা কিন্তু বেশ ভালোই করতেছে। কিন্তু ঝামেলা হইলো, ওইখানে আমি শুধু একজন প্যাট্রন। ওদের কিছু মিটিং-এ গেছি আমি – দেখলাম যেটা, লোকজন প্রথম প্রথম ভাবে গল্প বলা মানে কৌতুক বলা। তো তাদেরকে তখন থামাইতে হয়। আবার কেউ কেউ এইটারে মনে করে এনকাউন্টার গ্রুপ, যেইখানে সবাই যার যার নিজের গল্প বলতে চায়। এরকম মানুষজন সবসময়ই থাকে। কিন্তু বেশ বড় একটা অংশ ওইখানে আসছে যারা আসলেই গল্প কইতে পারে। তাদের কেউ কেউ আফ্রিকান – পুরা মহাদেশ থেকেই এমন সব মানুষ-জন আসছে যারা এখনও আগের মতো গল্প কয় কিংবা যারা আবার এইটারে চালু করতে চায়। তো, এটা চলতেছে, বেশ ভালোই চলতেছে। লন্ডনে বা অন্য কোথাও একটা গল্প বলার আসর বসাইলে কিন্তু লোকজন ভালো পরিমাণেই আসে। এইটা ভাবতে কিন্তু অবাক লাগে, কারণ তারা চাইলে তো আরো অনেক কিছুই করতে পারে – ধরেন ডালাস (আশির দশকের একখান আমেরিকান টিভি শো) দেখলো বা অন্যকিছু।
ইন্টারভিউয়ার: ইংল্যান্ডে ফিরা আসার পর আসলে কেমন লাগছিলো? সাংহাই থেকে ওইদেশে ফিরার পর জে. জি. ব্যালার্ড সম্ভবত একখান কথা বলছিলো যে, তার খুবই দমবন্ধ লাগতেছে। তার মনে হইতেছিলো সবকিছু খুব ছোটো আর উলটাপাল্টা।
লেসিং: আসলেই তাই! আমার খুব দমবন্ধ লাগতো। কেমন জানি ফ্যাকাসে, স্যাঁতস্যাতে লাগতো। সবকিছু কেমন আটকানো আর সাইজ করা। এখনও আমার সেইটাই মনে হয়। ইংল্যান্ড সুন্দর, কিন্তু অনেক বেশি গোছানো। আমার মনে হয় না, এইদেশে এমন কোনো জায়গা আছে যার উপর কোনো না কোনোভাবে হাত চালানো হয় নাই। আমার মনে হয় না যে এইখানের কোথাও কোনো জংলি ঘাস আছে।
ইন্টারভিউয়ার: তো ওই যে এক ধরণের কল্পনার আফ্রিকা, ওইখানকার প্রকৃতি – আপনার মনের ভিতর কি ওইখানে ফিরা যাওয়ার কোনো বাসনা আছে, মানে আপনার কি ওইখানে ফিরা যাইতে ইচ্ছা করে?
লেসিং: আসলে ওই কল্পনার আফ্রিকায় তো ফিরতে পারবো না, পারবো কী? সেইটা তো আর অতীত কাল থাকবে না। তিনবছর আগে যখন জিম্বাবুয়ে গেলাম, ওইদেশ তখন দুইবছর হইলো স্বাধীন হইছে। এইটা কিন্তু পরিষ্কার ছিলো যে, আমি গেলে সেই অতীতকাল থেকেই যাবো। বর্তমানকালে আমার একমাত্র পরিচয় হইলো অতীতকালের কোনো টোকেন। এইটা তো এড়ানো যাবে না! কারণ আমি হইলাম সেই লোকাল মেয়েটা যে ফেমাস হয়ে গেছে। সাদাদের আমলে আমি কিন্তু খুব খারাপ মেয়ে ছিলাম। আমার হয়ে একটা কথাও কেউ ভালো বলতো না। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না আমারে কতটা খারাপ ভাবা হইতো। কিন্তু এখন আমি “ওকে”।
ইন্টারভিউয়ার: আপনি খারাপ ছিলেন কেনো? কালোদের সাথে মেশার জন্য?
লেসিং: আমি আসলে শেতাঙ্গ শাসনের বিরোধী ছিলাম। ওইসময় তো পুরাই একটা কালার বার ছিলো। এখন তো এই “কালার বার” শব্দটা আর শোনাই যায় না। কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে আমার একমাত্র যেটুকু মেলামেশা ছিলো তা ওই চাকরবাকরদের সাথেই। যেই আফ্রিকানরা রাজনীতি বুঝতো, তাদের সাথে মেশাটা আসলে খুব কঠিন ছিলো। কারফিউ আছে বলে যাদের রাত নয়টার মধ্যে ঘরে ঢুকা লাগতো, যারা চরম গরিব, কিন্তু আপনার তো সেই অবস্থা না – এমনে কি তাদের সাথে কোনো রিজনেবল সম্পর্কে থাকা যায়।
ইন্টারভিউয়ার: গ্রান্টা মেমোয়ারে আপনার ছোটোকালের একখান ছবি আছে, বন্দুক হাতে ঘুইরা বেড়াইতেছেন, শিকার করতেছেন…
লেসিং: হ, ওই সময় অনেক বেশি শিকার ছিলো আশপাশে। এখন তো খুব সামান্যই আছে, কারণ সাদারা সব মাইরা ফেলছে।
ইন্টারভিউয়ার: ছোটোকালের ওই সময়গুলাতে আপনার কি লেখক হওয়ার কোনো ইচ্ছা ছিলো? এক জায়গায় লিখছিলেন, লেখাপত্তর মায়ের কাছ থেকে লুকায় রাখতেন, কারণ সে ওইগুলা নিয়া ম্যালা আদিখ্যেতা করতো।
লেসিং: মা ছিলেন একজন হতাশ মহিলা। তার অনেক গুণ ছিলো, কিন্তু সব উনি আমার আর আমার ভাইয়ের পিছনে ঢালছেন। আমরা কিছু না কিছু হই, এইটাই উনি চাইতেন সবসময়। ম্যালাদিন ধরে উনি আমারে আমারে গানের শিল্পী বানানোর পাঁয়তারা করছেন, কারণ উনি নিজে বেশ ভালো গান গাইতেন। তবে আমি গান পারতাম না খুব একটা। কিন্তু সেইসময় সবাইরেই গান শিখতে হইতো। মা আমাগোরে সবসময় ঠেলতে থাকতেন। এইটা তো অবশ্যই একদিক দিয়া ভালোই ছিলো, কারণ বাচ্চাগের ঠ্যালা লাগে। কিন্তু এরপর উনি করতো কী, সবকিছু দখল কইরা বসতো। তাই আসলে নিজেরে প্রোটেক্ট করার একটা বিষয় ছিলো। তবে আমার মনে হয়, নিজের কাজের মালিকানা পাওয়ার উপায় সব শিশুরেই খুঁইজা বাইর করতে হয়।
ইন্টারভিউয়ার: আমি আসলে জানতে চাইছি ছোটোকালে আপনার মনে লেখক হওয়ার কোনো স্বপ্ন ছিলো কিনা
লেসিং: সেইটা ছিলো একভাবে আরো অনেক বিষয়ের সাথে। ডাক্তার তো হইতেই পারতাম আমি। ভালো একতা চাষাও হইতে পারতাম কিম্বা এমন আরো ম্যালা কিছু। লেখক হইছি আসলে হতাশা থেকে, আমার যেইটা মনে হয় অনেক লেখকই আসলে এই কারণেই লেখালেখি করে।
(ইন্টারভিউ’র একটা অংশ)