Main menu

একটা নভেলের জন্ম একটা কবিতা দিয়া শুরু হয় – গুন্টার গ্রাস

This entry is part 27 of 27 in the series ইন্টারভিউ সিরিজ

এই ইন্টারভিউটা যখন আমি অনুবাদ করতে বসি তখন গুন্টার গ্রাস সম্বন্ধে আমার জ্ঞান বিসিএস প্রিলিমিনারি পর্যন্ত। দ্য টিন ড্রাম বইয়ের লেখক কে? গুন্টার গ্রাস। এরপর আর কোনো কিছু না জেনেই যখন বইটা পড়া শুরু করলাম, প্রথম চাপ্টারে পুলিশের ধাওয়া থেকে পালাইতে আর্সোনিস্ট কালিয়াইচেক যখন আনা ব্রনস্কির স্কার্টের নিচে আশ্রয় নিলো, তখন অদ্ভুত আনন্দে মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগলো, গ্রাস কি মার্কেজ পড়ে এ জিনিস লেখতে বসছিলো? প্যারাগ্রাফসম সেন্টেন্স, এবজার্ড হিউমার, ফুলানো ফাঁপানো লিরিকাল প্রোজ, সঙ্গে সকল ট্যাবুকে তাচ্ছিল্য করা একটা ইঁচড়ে পাকা হাসি। দ্য টিন ড্রাম পড়ে যে আমার মার্কেজের কথা মনে পড়ে গেছে তার কারণ ম্যাজিক রিয়ালিজম না। গ্রাসকে যে ‘ইউরোপিয়ান ম্যাজিক রিয়ালিজম’-এর এক প্রধান হোতা হিসাবে সাব্যস্ত করা হয় তা জানতে আমার আরো সময় লেগে গেছে। (বাই দ্য ওয়ে মার্কেজ মার্কেজ হওয়ার আগে গ্রাস গ্রাস হয়ে গেছেন। দ্য টিন ড্রাম এর প্রকাশকাল ১৯৫৯-এ, সলিটিউড ১৯৬৭-এ।) স্কার্টের নিচে ঢুকে পড়ার ঘটনাকে যে আমি ‘মার্কেজ’ বলে আইডেন্টিফাই করছি তার কারণ ছিলো একে অতীত বর্ণনার এক বিশেষ টেকনিক হিসাবে দেখা, যে টেকনিক অতীতকে মহিমান্বিতভাবে বর্ণনা করার যে চল আছে তাকে ইউনিকভাবে ডাইভার্ট করতে পারছে, যে ধরণের ন্যারেটিভ আমরা দেখতে পাই রুশদি ও বুলগাকভে।

এদের মধ্যে আমরা যা কমন পাই তা হলো, ‘অফিশিয়াল হিস্টোরি’ বা জনরা হিসাবেই ‘হিস্টোরি’র এক ধরণের প্যারোডি তৈরি করা, যেই প্যারোডি ইতিহাসের প্রচ্ছন্ন বিষয়গুলি নিয়া কোনো রাখ ঢাক ছাড়াই কথা বলতে পারে। গ্রাস তার এই ইন্টারভিউতে জানাচ্ছেন, পোস্ট-ওয়ার জার্মান সোসাইটিতে নাৎসি পিরিয়ড নিয়া আলাপ করা এক ধরণের ট্যাবু ছিলো, যে ট্যাবু পরবর্তীতে নানা ধরণের ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিছে। (এ ক্ষেত্রে আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সাহিত্য ও সেগুলা যেধরণের একপাক্ষিক ও সীমিত এক্সপেরিয়েন্স অফার করে তার কথা চিন্তা করতে পারি।) যুদ্ধের পর গ্রুপ-৪৭ নামে রাইটার ক্রিটিকদের যে গ্রুপ তৈরি হয়, এবং গ্রাস যে গ্রুপের অংশ ছিলেন, তাদের প্রধান কাজ ছিলো এমন সাহিত্য ভাষা উদ্ভাবন করা যা ওই ট্যাবুকে ভাঙতে পারে। এভাবে চিন্তা করলে গ্রাসের সাহিত্যকে এক ধরণের ‘অথেনটিক এক্সপেরিয়েন্স’ বা ‘কলম তুলে নেওয়া’ ধরণের সাহিত্য হিসাবেও দেখা যাইতে পারে। গ্রাসের যাপিত জীবন রিডারকে সে ধরণের এক রিডিং-এ যাওয়ার দিকেই প্ররোচিত করে। ভার্সাই চুক্তির ক্ষত বহন করা জার্মানিতে বড় হওয়া, টিএনএইজ থাকতে নাৎসিদের প্রতি সমর্থন, জার্মান আর্মিতে সার্ভ করা, যুদ্ধের পর ডুসেলডর্ফ ও বার্লিনে স্কাল্পটিং ও পেইন্টিং শেখা, ষাটের দশকে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে ক্যাম্পেইন করা, এনভাইরনমেন্টাল ইস্যু নিয়া তার কর্নসার্ন, সত্তুর ও আশির দশকে ইন্ডিয়া ট্রাভেল, জার্মান রি-ইউনিফিকেশনের বিরোধিতা — এসব বায়োগ্রাফিকাল ডিটেইল তার কাজে কেবল পার্সোনাল ইন্টেগ্রিটি যুক্ত করে তা না, ব্যক্তিকে সমষ্টির সঙ্গেও একাকার করে দেয়। গ্রাসকে মার্কেজের সঙ্গে তুলনা করার আরেকটা সুবিধা হলো, শুধু সাহিত্যিক হিসাবেই না, যার যার জমিনে তারা যে কালচারাল আইকনে পরিণত হইছেন, তাও মাথায় রাখা।

কিন্তু কেবল বায়োগ্রাফি ও প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মকান্ড নির্ভর ইন্টারপ্রিটেশন সমস্যাজনক হতে পারে। প্রথমত এইটা ইন্টারপ্রিটেশনের স্কোপকে কেবল একধরণের ‘বাস্তবিকতা’র মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলতে পারে, দ্বিতীয়ত এরকম ইন্টারপ্রিটেশন গ্রাসের কাজকে তার রাজনৈতিক পজিশন, সোশাল এক্টিভিজম এবং তিনি যে পাবলিক পারসোনা তৈরি করছেন শুধু তার জাস্টিফিকেশনে ব্যবহার করতে পারে। এ ধরণের সীমাবদ্ধতা উতরানোর একটা উপায় হলো, আর্টকে সব কিছুর উপরে একটা ‘এস্থেটিক কনস্ট্রাক্ট’ হিসাবে দেখা। ইন্টারভিউতে গ্রাস তার এস্থেটিক কনসার্নের কথা নানান ভাবে জানান দিচ্ছেন। ফিকশনে ‘মিথ্যা’ বলার গুরুত্ব, তার প্রথম দিককার বইগুলাকে তার একটা বিশেষ ‘পলিটিকাল’ ফেইজের প্রোডাক্ট হিসাবে দেখা, ফিকশন-ননফিকশন ক্যাটাগরিগুলার সাথে তার সম্পর্ক, নভেলকে জনরা হিসাবে কিভাবে দেখেন, তার কোন কোন নভেলে ফরমাল ইনোভেশন আছে, কোনগুলা ফর্মের দিক দিয়া পিউর, ড্রয়িং কিভাবে তার রাইটিংকে সাপ্লিমেন্ট করে, প্রোজ কবিতা ও ড্রয়িং কিভাবে তার লেখায় সম-অধিকার পায় বা আদও পায় কী না, যে মিশ্র সময়কালকে উনি Vergegenkunft বলেন তা কিভাবে নতুন পার্সপেক্টিভ তৈরি করতেছে, এনথ্রোপসেন্ট্রিক ন্যারেটিভ থেকে বের হয়ে বইয়ের কেন্দ্রে প্রানীদের রাখা, কিংবা কোন জার্মান ট্র্যাডিশন ও অন্যান্য লিটারেরি সোর্স গ্রাসকে আকৃতি দিছে ইত্যাদি সব কিছুই এ ধরণের এস্থেটিক কনসার্নের বিষয়বস্তু। আল্টিমেটলি ইন্টারপ্রিটেশনের গুরুত্বটা এখানে সবার উপরে থাকতেছে টেক্সটের উপর।

ইন্টারভিউটার ফোকাস কোথায় থাকতেছে, পলিটিক্সে নাকি আর্টে, তা শেষমেশ পাঠক ডিসাইড করবেন। এর একটা অভিনব উত্তর গ্রাস নিজেই দিতেছেন ইন্টারভিউতে, ‘লিটারেচার কি রাজনীতির মতো চেঞ্জ আনতে পারে সমাজে?’ এরকম একটা প্রশ্নের উত্তরে, গ্রাস কাম্যুর দ্য মিথ অফ সিসিফাস এর বরাত দিয়া বলতেছেন, “আমি এইটায় [চূড়ান্ত লক্ষ্যে] বিশ্বাস করি না। আমরা অস্থির জিনিস। এরকম হতে পারে যে পাথরটা সব সময়ই আমাদের থেকে গড়ায়ে দূরে চলে যাবে, এবং প্রতিবার সেটাকে আগের জায়গায় ফিরায়ে আনতে হবে।”

সবশেষে, ইন্টারভিউটার একটা ভালো ব্যাপার হলো এখানে বার বার গ্রাসের বিভিন্ন বইয়ের রেফারেন্স টানা হইছে এবং বইগুলাকে কেন্দ্রে রেখে আলাপ করা হইছে। এ জিনিস আনকোরা পাঠককে গ্রাসের সামগ্রিক আর্টিস্টিক জার্নিকে ট্র্যাক করতে হেল্প করবে।

তাহমিদ রহমান
নভেম্বর, ২০২৩

কনটেম্পরারি শিল্প ও সাহিত্যের দুনিয়ায় এক রেয়ার জিনিস অর্জন করতে পারছেন গুন্টার গ্রাস। যে যে জনরা আর শিল্প মাধ্যমে হাত দিছেন প্রত্যেকটাতেই অর্জন করছেন ক্রিটিকাল সম্মাননা ও কমার্শিয়াল সাফল্য। একাধারে একজন নভেলিস্ট, কবি, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, ভাস্কর এবং গ্রাফিক শিল্পী, গ্রাস তার প্রথম উপন্যাস ১৯৫৮ সালের বেস্ট-সেলার দ্য টিন ড্রাম প্রকাশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক লিটেরারি সিনে হাজির হন। দ্য টিন ড্রাম এবং তার পরবর্তী কাজ — ১৯৬১ সালের নভেলা ক্যাট এন্ড মাউজ ও ১৯৬৩ সালের নভেল ডগ ইয়ারস — একসঙ্গে ডানজিগ ট্রিলজি নামে পরিচিত। তার আরো অনেক বইয়ের মধ্যে আছে ফ্রম দ্য ডায়েরি অফ আ স্নেইল (১৯৭২), দ্য ফ্লাউন্ডার (১৯৭৭), দ্য মিটিং এট টেলগটি (১৯৭৯), হেডবার্থস, অর দ্য জার্মানস আর ডায়িং আউট (১৯৮০), দ্য র‍্যাট (১৯৮৬), এবং শো ইয়োর টাঙ (১৯৮৯)। গ্রাস তার বইয়ের জ্যাকেট নিজেই ডিজাইন করেন এবং তার বইয়ের মধ্যে প্রায়ই লেখকের করা ইলাস্ট্রেশন সংযুক্ত থাকে। অসংখ্য সাহিত্য পুরষ্কার ও মেডেল জমা হইছে তার বাসায়। এর মধ্যে আছে ১৯৬৫ সালের গেয়র্গ বুখনার প্রাইজ এবং ১৯৭৭ সালের কার্ল ভন ওসিয়েটজস্কি মেডেল, এবং তিনি আমেরিকান একাডেমি অফ আর্টস এন্ড সায়েন্সেসের একজন বিদেশী অনারারি মেম্বার।

গ্রাসের জন্ম হইছিলো ১৯২৭ সালে, বাল্টিক উপকূলে, দ্য ফ্রি সিটি অফ ডানজিগের একটা শহরতলীতে, যা বর্তমানে পোল্যান্ডের গডানস্কে অবস্থিত। তার বাবা মা ছিলেন মুদি ব্যবসায়ী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিনি জার্মান আর্মিতে ট্যাঙ্ক-গানার হিসাবে সার্ভ করেন এবং ১৯৪৫ সালে আমেরিকান ফোর্সের হাতে আহত হন এবং ধরা পড়েন। মুক্তি পাওয়ার পর, একটা চক খনিতে কাজ শুরু করেন তিনি এবং তারপর ডুসেলডর্ফ আর বার্লিনে চলে যান আর্ট নিয়া পড়াশোনা করতে। গ্রাস তার প্রথম ওয়াইফ, সুইস ব্যালে ড্যান্সার আনা শোয়ার্জকে বিয়ে করেন ১৯৫৪ সালে। ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি, জার্মান লেখক ও ক্রিটিকদের একটা ইনফরমাল কিন্তু প্রভাবশালী এসোসিয়েশন, গ্রুপ-৪৭ এর মিটিংগুলাতে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। এই গ্রুপ প্রথম একসঙ্গে হইছিলো ১৯৪৭ এর সেপ্টেম্বরে, গ্রুপের নাম তারই সাক্ষী। হাইনরিখ বোল, উভে জনসন, ইলসা আইকিঞ্জার এবং গ্রাস সহ এর সদস্যরা সংগঠিত হইছিলেন একটা কমন মিশনকে কেন্দ্র করে, যার লক্ষ্য ছিলো এমন এক লিটারেরি ভাষা ডেভলপ ও ব্যবহার করা, যা নাৎসি-যুগের প্রোপাগান্ডায় ব্যবহৃত জটিল ও অলংকৃত প্রোজ স্টাইলের একদম বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায়। গ্রুপের সদস্যরা লাস্ট মিট করেন ১৯৬৭ সালে।

পাবলিশিং হাউজ লুখটারহ্যান্ডের একটা ছোট ভাতায় নির্ভর করে, গ্রাস ও তার পরিবার ১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ সাল প্যারিসে কাটান। সেখানেই তিনি দ্য টিন ড্রাম লেখেন। সেসময়, তার চলমান কাজ থেকে পড়ে শোনানোর জন্য গ্রুপ-৪৭ আয়োজিত ১৯৫৮ সালের বার্ষিক পুরস্কার জিতছিলেন তিনি। নভেলটা জার্মান ক্রিটিক এবং রিডারদের চমকে দিছিল। তারা প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টাইমফ্রেমে জার্মান বুর্জোয়াক্লাসের এক কঠোর চিত্রায়নের সামনাসামনি হন। গ্রাসের ১৯৬৯ সালের ভলিউম, দ্য মিটিং এট টেলগটি, ১৬৪৭ সালে ত্রিশ বছরের যুদ্ধ সমাপ্তির শেষ দিকে জার্মান কবিদের একটা সভার ফিকটিশাস বিবরণ। ওই ফিকশনাল জমায়েতের উদ্দেশ্য, সেই সঙ্গে বইয়ের চরিত্রগুলার মডেল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী গ্রুপ-৪৭ এর সঙ্গে প্যারালাল তৈরি করে।

জার্মানিতে, গ্রাস দীর্ঘকাল ধরে তার বিখ্যাত উপন্যাসগুলার জন্য যেমন বিখ্যাত তেমনি তার বিতর্কিত রাজনীতির জন্যও পরিচিত। তিনি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির দীর্ঘদিনের সমর্থক এবং দীর্ঘ দশ বছর যাবত উইলি ব্র্যান্ডের প্রধান স্পিচরাইটার ছিলেন। এখনকার সময়ে, উনি সেই অল্প কিছু জার্মান বুদ্ধিজীবীদের একজন যারা, জার্মান রিইউনিফিকেশনের জন্য যে তাড়াহুড়া’র পথ বেছে নেওয়া হইছে, পাবলিকলি তার প্রতিবাদ করছেন। শুধুমাত্র ৯০ সালেই, গ্রাস এই বিষয়কে উদ্দেশ্য করে দুই ভলিউম লেকচার, স্পিচ ও ডিবেট পাবলিশ করেন।

যখন ট্রাভেল করেন না, তখন তিনি তার সময়কে শ্লেসউইগ-হলস্টাইন এস্টেট এবং বার্লিনের শোয়েনবার্গ সেকশনের বাড়ির মধ্যে ভাগ করে নেন। প্রথম জায়গায় তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী উটে গ্রুনার্টের সাথে থাকেন, এবং দ্বিতীয় জায়গায়, যেখানে এককালে তার চার সন্তান বড় হইছিল, তার সহকারী ইভা হোনিশ এখন তার বিষয়-আশয় পরিচালনা করেন। এই ইন্টারভিউটা নেয়া হইছিলো দুইটা সেশনে, একবার ম্যানহাটনের ৯২তম স্ট্রিট YMWHA-তে দর্শকদের সামনে, এবং পরেরবার গত হেমন্তে নিয়েডস্ট্রাবের ইয়ালো হাউজে, যেখানে সংক্ষিপ্ত যাত্রাবিরতির মধ্যে কয়েক ঘন্টা সময় হাতে পাইছিলেন গ্রাস। তিনি আমাদের সাথে কথা বলছিলেন তার স্টাডিতে বসে। গ্যাবল-জানালাযুক্ত, ধবধবে সাদা দেওয়াল আর উডেনফ্লোরের একটা ছোট রুম ছিলো ওইটা। রুমের অন্য কর্নারে বই ও ম্যানুস্ক্রিপ্টের বক্স স্তুপ করা। তার পরনে ছিলো একটা টুইড জ্যাকেট ও একটা বাটন-ডাউন শার্ট। অরিজিনালি তিনি ইংরেজিতে ইন্টারভিউটা দিতে রাজি হইছিলেন, যাতে ইন্টারভিউ-পরবর্তী অনুবাদের জটিলতাগুলি এড়ানো যায়। কিন্তু সেইটা মনে করায়ে দিতেই চোখ টিপে হাসলেন, আর ঘোষণা করলেন, “আমি সাংঘাতিক টায়ার্ড! আমরা জার্মানেই আলাপ করবো।” ট্রাভেল সিকনেসের দাবি করলেও, তিনি তার কাজ সম্পর্কে বেশ উদ্যম এবং উৎসাহের সঙ্গেই কথা বললেন, মুখ টিপে হাসলেন প্রায়ই। যমজপুত্র রাউল ও ফ্রানৎস তাদের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাদের বাবাকে একটা ডিনারের জন্য নিতে আসলে ইন্টারভিউটা শেষ হয়।

এলিজাবেথ গ্যাফনে
১৯৯১

ইন্টারভিউয়ার: আপনি একজন রাইটার হইলেন কিভাবে?

গুন্টার গ্রাস: আমার মনে হয় আমি যে সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে বড় হইছি তার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে। আমরা একটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি থেকে আসছি। একটা দুই রুমের ছোট এপার্টমেন্ট ছিলো আমাদের। আমার বোন আর আমার জন্য আলাদা কোনো রুম ছিলো না, এমনকি নিজেদের জন্য আলাদা কোনো জায়গাও ছিলো না। বসার ঘরে, দুই জানালার পাশে এক ছোট্ট কোণায়, আমার বইগুলা, আর অন্য যেসব জিনিসপত্র— ওয়াটার কালার ইত্যাদি, রাখা হইতো। আমাকে প্রায়ই আমার যা যা দরকার তা ইমাজিন করে নেয়া লাগতো। কিন্তু আমি দ্রুতই বাসাবাড়ির কোলাহলের মধ্যে পড়তে শিখে গেছিলাম। আর তাই ছোটবেলা থেকেই আমি লেখা আর আঁকাআঁকি শুরু করি। এই রুম না থাকার আরেকটা ফল হইলো যে আমি এখন রুম কালেক্ট করি। আমার এখন চারটা ভিন্ন জায়গায় স্টাডিরুম আছে। ছোটবেলার ওই অবস্থায় ফিরে যাইতে ভয় করে আমার, একটা ছোট রুমের ওই এক চিপায়।

ইন্টারভিউয়ার: এই অবস্থায় আপনি রিডিং রাইটিং এর দিকে গেলেন কেন, মানে আপনি তো খেলাধূলা বা বাইরের কোনো কিছুকেও ডিস্ট্রাকশন হিসাবে বেছে নিতে পারতেন।

গুন্টার গ্রাস: ছোট থাকতে আমি মিথ্যা বলায় ওস্তাদ ছিলাম। কিন্তু ফরচুনেটলি আমার মা সেসব মিথ্যা পছন্দ করতেন। আমি তাকে অবিশ্বাস্য অনেক কিছুর প্রমিজ করছি। আমার বয়স যখন দশ, সে তখন আমাকে পিয়ার গিন্ট বলে ডাকতো। বলতো, পিয়ার গিন্ট, তুমি তো আমাকে নাপলস আর কই কই আমরা এডভেঞ্চার করবো তার কত অদ্ভূত গল্প শুনাইতেছো…তো আমার ওই মিথ্যা কথাগুলাকে আমি তখন থেকেই লিখে রাখতে শুরু করি। যা আমি এখনো লিখে যাইতেছি। একটা নভেল লেখা শুরু করছিলাম আমি যখন আমার বয়স বারো। নভেলটা ছিলো কাশুবিয়ানদের নিয়া, যারা আবার অনেক বছর পর দ্য টিন ড্রাম এ দেখা দেয়। যেখানে ওস্কারের দাদি আনা (আমার নিজের দাদির মতো), একজন কাশুবিয়ান (মূলত উত্তর-মধ্য পোল্যান্ডে বাস করা একটা স্লাভিক এথনিক গ্রুপ যাদের ভাষা ও কালচার পোলিশদের থেকে আলাদা)। কিন্তু প্রথম নভেল লিখতে গিয়া একটা ভুল করছিলাম আমি: যেসব কারেক্টারকে আমি রিডারের কাছে পরিচয় করায় দিছিলাম, প্রথম চ্যাপ্টার শেষ হইতে না হইতেই তারা সবাই মারা যায়। আর আগাইতে পারতেছিলাম না আমি! কিন্তু এইটা ছিলো রাইটিং-এ আমার প্রথম লেসন: তোমার কারেক্টারগুলা নিয়া সাবধান।

ইন্টারভিউয়ার: কোন মিথ্যাগুলা আপনাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিছে?

গুন্টার গ্রাস: যেসব মিথ্যা কাউকে কষ্ট দেয় না, যেসব মিথ্যা নিজের গা-বাঁচানোর বা অন্যকে আঘাত করার মিথ্যা থেকে আলাদা। আমি সেইগুলা নিয়া কারবার করি না। কিন্তু সত্য জিনিসটা বেশির ভাগ সময়ই অনেক বোরিং, আপনি হয়তো ওইটাকে মিথ্যা দিয়া হেল্প করতে পারেন। তাতে কোনো ক্ষতি নাই। আমি এইটা শিখছি যে আমার বলা ভয়ানক মিথ্যাগুলা যতই ভয়ানক হোক না কেন, বাইরে যা কিছু আছে তার ওপর এর কোনো প্রভাব নাই। কয়েক বছর আগে, আমি যদি জার্মানির সাম্প্রতিক পলিটিকাল ডেভলপমেন্টকে প্রেডিক্ট করে কিছু লিখতাম, লোকে বলতো— শালা কত বড় মিথ্যুক!

ইন্টারভিউয়ার: প্রথম নভেলটায় ফেল করার পর আপনার পরবর্তী এফোর্ট কী ছিলো?

গুন্টার গ্রাস: আমার প্রথম বইটা ছিলো একটা কবিতা আর ড্রয়িং এর বই। আর এইটা সবসময়ের জন্যই সেইম যে, কবিতা লেখার ক্ষেত্রে যতগুলা খসড়া বানাই আমি, তার প্রথম কয়েকটার সবই ড্রয়িং আর ভার্সকে কম্বাইন্ড করে, কখনো একটা ইমেজ থেকে ইন্সপিরেশান নিয়া, কখনো কতগুলা শব্দ থেকে। তারপর আমার বয়স যখন পঁচিশ হইলো আর একটা টাইপরাইটার এফোর্ড করতে পারলাম আমি, তখন আমার দুই-আঙুল সিস্টেমে টাইপ করাটাকেই প্রিফার করলাম। দ্য টিন ড্রাম এর ফার্স্ট ভার্সনটা শুধু ওই টাইপরাইটারটা দিয়াই করা হইছিলো। এখন আমি বুড়া হয়ে যাচ্ছি, আর যদিও শুনতে পাই যে আমার কলিগদের অনেকেই নাকি এখন কম্পিউটার দিয়া লেখতেছেন, আমি ফার্স্ট ড্রাফটা টা লেখার জন্য আবার হাতে-লেখার দিকেই ফিরে গেছি! দ্য র‍্যাট এর প্রথম ভার্সনটা আমার প্রিন্টার থেকে পাওয়া সাদা খাতার একটা বড় বইয়ের মধ্যে আছে। আমার কোনো বই যখন পাবলিশড হতে নেয়, তখন আমি পরবর্তী ম্যানুস্ক্রিপ্ট হিসাবে ব্যবহার করার জন্য, খালি পৃষ্ঠাসহ একটা ব্লাইন্ড কপি চেয়ে নেই সবসময়। তো, আজকাল প্রথম ভার্সনটা ড্রয়িং সহ হাতে লেখা হয়, এবং তারপর দ্বিতীয় ও তৃতীয়টা একটা টাইপরাইটারে করা হয়। এই তিনটা ভার্সন না লিখে আমি আজ পর্যন্ত কোনো বই-ই শেষ করি নাই। প্রায়ই দেখা যায় অনেক সংশোধন সহ চার নাম্বারটায় গিয়ে কাজ শেষ হয়।

ইন্টারভিউয়ার: প্রত্যেকটা ভার্সন কি আলফা থেকে শুরু হয়ে ওমেগাতে যায়?

গুন্টার গ্রাস: না। প্রথম ড্রাফটটা আমি খুব দ্রুত লেখি। যদি এটায় কোনো ফুটা থাকে, তাহলে থাকে। সেকেন্ড ভার্সনটা সাধারণত অনেক লম্বা, ডিটেইলড আর সম্পূর্ণ হয়। কোনো ফুটা আর থাকে না তাতে, কিন্তু সেটা কিছুটা শুকনা থেকে যায়। থার্ডটাতে গিয়া আমি আবার প্রথমটার স্পন্টেনিটিটা ফিরা পাওয়ার আর দ্বিতীয়টা থেকে যা কিছু এসেনশিয়াল তা ধরে রাখার চেষ্টা করি। এটা অনেক ডিফিকাল্ট।

ইন্টারভিউয়ার: কাজের সময় আপনার ডেইলি শিডিউল কী?

গুন্টার গ্রাস: যখন প্রথম ভার্সনটা নিয়া কাজ করতে থাকি, তখন দিনে পাঁচ থেকে সাত পেইজ করে লেখি। থার্ড ভার্সনটার জন্য দিনে তিন পেইজ। সেইটা অনেক স্লো।

ইন্টারভিউয়ার: কাজ করেন কখন? সকালে, বিকালে নাকি রাতে?

গুন্টার গ্রাস: নেভার, নেভার এট নাইট। আমি রাতে লেখায় বিশ্বাসী না কারণ তখন লেখা অনেক সহজে আসে। রাতে যা লেখলাম তা যখন সকালে আবার পড়ে দেখি, তখন আর ভালো লাগে না। কাজ শুরু করার জন্য আমার দিনের আলো দরকার। সকাল নয়টা থেকে দশটার মধ্যে পড়া আর গানের সঙ্গে আমি একটা লম্বা নাস্তা করি। নাস্তার পর কাজ শুরু করি, মধ্যখানে বিকালে কফি খাওয়ার জন্য একটা ব্রেক নেই। তারপর আবার শুরু করে সন্ধ্যা সাতটার দিকে উঠে যাই।

ইন্টারভিউয়ার: কখন বোঝেন যে একটা বইয়ের কাজ কমপ্লিট?

গুন্টার গ্রাস: যখন একটা এপিক-দৈর্ঘ্যের বই নিয়া কাজ করি তখন লেখালেখির প্রসেসটা তো বেশ লম্বাই হয়। সবগুলা ড্রাফটের মধ্য দিয়া যেতে প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর লেগে যায়। যখন পুরাপুরি ক্লান্ত হয়ে যাই তখন বইয়ের কাজ শেষ হয়।

ইন্টারভিউয়ার: ব্রেখট তার লেখাকে রি-রাইট করার চাপ অনুভব করতেন সব সময়। এমনকি সেগুলা পাবলিশড হয়ে যাওয়ার পরেও। উনি কখনোই উনার কাজকে শেষ মনে করতেন না।

গুন্টার গ্রাস: আমার মনে হয় না আমি এরকম করতে পারবো। দ্য টিন ড্রাম বা ফ্রম দ্য ডায়েরি অফ আ স্নেইল-এর মতো বই আমার জীবনের একটা বিশেষ পর্যায়েই লেখা সম্ভব ছিলো। আমার তখনকার চিন্তা, ভাবনা আর অনুভবের ভিতর থেকে এই বইগুলা বের হয়ে আসছে। আমি শিউর যে আমি যদি দ্য টিন ড্রাম বা ডগ ইয়ারস বা ফ্রম দ্য ডায়েরি অফ আ স্নেইল – এই বইগুলাকে রি-রাইট করতে বসি, তাহলে ওগুলা নষ্ট হয়ে যাবে।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি আপনার ফিকশন আর ননফিকশনের মধ্যে ফারাক করেন কিভাবে?

গুন্টার গ্রাস: “ফিকশন ভার্সেস ননফিকশন” এই ক্যাটাগরিগুলা আজগুবি। এইগুলা বইবিক্রেতাদের কাছে দরকারি হইতে পারে, বইকে জনরা ধরে ক্লাসিফাই করার জন্য, কিন্তু আমি আমার বইকে এভাবে ক্যাটাগরাইজ করতে পছন্দ করি না। ফিকশন-ননফিকশন এ জাতীয় কথা শুনলে আমি ইমাজিন করি যে কোনো জায়গায় বসে বইবিক্রেতাদের কোনো কমিটি মিটিং করতেছে, আর সেই মিটিং-এ তারা ঠিক করতেছে কোন বইটাকে ফিকশন আর কোনটাকে ননফিকশন বলে ডাকা হবে। আমি বলি যে বইবিক্রেতারা যা করতেছে সেটাই হচ্ছে ফিকশন।

ইন্টারভিউয়ার: কিন্তু আপনি যখন কোনো প্রবন্ধ বা স্পিচ লেখেন, তার প্রক্রিয়াটা কি গল্প বলা বা গল্প বানানোর চেয়ে আলাদা না?

গুন্টার গ্রাস: হ্যা আলাদা, কিন্তু তার কারণ হচ্ছে তখন আমি যেসব ফ্যাক্ট নিয়া ডিল করি সেগুলা আমার পরিবর্তন করার উপায় নাই। আমার নিজের কাছে বেশিরভাগ সময়েই কোনো ডায়েরি থাকে না, তবে ফ্রম দ্য ডায়েরি অফ আ স্নেইল লেখার প্রস্তুতি হিসাবে আমি একটা ডায়েরি রাখছিলাম। আমার মনে হইতেছিলো যে ১৯৬৯ সাল পরিবর্তনের বছর হবে, কেবল নতুন কোনো সরকার গঠন না, এরচেয়েও রিয়েল কোনো পলিটিকাল চেঞ্জ আসবে। তো আমি যখন ১৯৬৯-এর মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত — একটা লম্বা সময়— পথেঘাটে ছিলাম ক্যাম্পেইনের কাজে, তখন একটা ডায়েরি ছিলো আমার কাছে। আবার এই একই জিনিস হয় কলকাতাতে। তখন যেই ডায়েরিটা রাখছিলাম, সেটাই আস্তে ধীরে শো ইউর টাঙ-এ পরিণত হয়।

ইন্টারভিউয়ার: ভিজ্যুয়াল আর্ট এবং লেখাকে আপনার পলিটিকাল একট্টিভিজমের সঙ্গে ব্যালেন্স করেন কিভাবে?

গুন্টার গ্রাস: লেখকরা তো কেবল তাদের ইনটারনাল ইন্টেলেকচুয়াল জীবনের সঙ্গে জড়িত না, ডেইলি লাইফের প্রসেসের সঙ্গেও জড়িত। আমার কাছে লেখালেখি, ছবি আঁকা এবং পলিটিকাল একট্টিভিজম তিনটা আলাদা সাধনা; প্রত্যেকের নিজস্ব ইনটেনসিটি আছে। যে সমাজে আমি বাস করি সে সমাজের সঙ্গে যেভাবেই হোক আমি বিশেষভাবে সম্পৃক্ত ও জড়িত। আমি চাই বা না চাই, আমার লেখা ও আঁকা দুইটাই পলিটিক্সের সঙ্গে মিশে আছে। এমন না যে আমি কোনো প্ল্যান নিয়া আমার লেখায় পলিটিক্স ঢুকানোর চেষ্টা করি। তার চেয়ে বরং কোনো একটা সাবজেক্টকে তৃতীয় বা চতুর্থবারের মতো ঘষামাজা করে লেখার প্রক্রিয়ায় আমি এমন জিনিস আবিষ্কার করি যেগুলা ঐতিহাসিকভাবে নেগলেক্টেড ছিলো। যেমন, একদিকে আমি এমন কোনো গল্প লিখবো না যেইটা বিশেষভাবে এবং সরল করে কোনো পলিটিকাল বাস্তবতাকে হাইলাইট করে, আবার অন্যদিকে রাজনীতিকে — যা আমাদের জীবনের ওপর এত বড় নির্ধারক ক্ষমতা রাখে— বাদ দেয়ার কোনো কারণও আমি দেখি না। এইটা আমাদের জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে কোনো না কোনো ভাবে ঢুকে যায়।

ইন্টারভিউয়ার: আপনার কাজে আপনি এতগুলা আলাদা জনরাকে একসঙ্গে করেন— হিস্টোরি, রেসিপি, লিরিক্স…

গুন্টার গ্রাস: …ড্রয়িং, কবিতা, ডায়ালগ, কোটেশন, স্পিচ, চিঠি! মানে, আমি যখন কোনো এপিক ধারণা নিয়া ডিল করি তখন ভাষায় এভেইলেবল প্রত্যেকটা দিক এবং ভাষিক যোগাযোগের সবচেয়ে বিচিত্র ফর্মগুলি ব্যবহার করা আমার কাছে দরকারি বলে মনে হয়। তবে এটাও খেয়াল রাইখেন, আমার কিছু বই ফর্মের দিক দিয়া একদম পিউর— যেমন ক্যাট এন্ড মাউজ ও দা মিটিং এট টেলেগটি ।

ইন্টারভিউয়ার: লেখা আর আঁকার যে মেলবন্ধন তৈরি করেন আপনি তা ইউনিক

গুন্টার গ্রাস: লেখা ও আঁকা আমার কাজের প্রাথমিক উপাদান। তবে একমাত্র না। সময় পাইলে আমি স্কাল্পটিং-ও করি। আমার জন্য আর্ট আর লেখার মধ্যে খুব স্পষ্ট একটা দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক একজিস্ট করে। কখনো এই সম্পর্ক শক্তিশালী থাকে, কখনো উইক হয়ে যায়। গত কয়েক বছর যাবৎ এইটা শক্তিশালী আছে। কলকাতার উপর লেখা শো ইয়োর টাং তার একটা উদাহরণ। ড্রয়িং করা ছাড়া আমি এই বই কখনোই লিখতে পারতাম না। কলকাতার অসম্ভব দারিদ্র্য একজন আগন্তুককে সবসময় এমন সব পরিস্থিতির সম্মুখীন করে যেখানে ভাষা হারায় যায়— মানুষ শব্দ খুঁজে পায় না। ওখানে থাকার সময় ড্রয়িং আমাকে আবার শব্দ খুঁজে পাইতে হেল্প করছিলো।

ইন্টারভিউয়ার: ওই বইয়ে, কবিতার টেক্সটটা শুধু যে প্রিন্টেই আছে তা না, হাতের লেখায় ড্রয়িং-এর ওপরও বসানো। লেখাগুলাকে কি তাহলে একটা গ্রাফিক উপাদান ও ড্রয়িং-এর অংশ হিসাবে বিবেচনা করতে হবে?

গুন্টার গ্রাস: ড্রয়িংগুলা কবিতার কিছু উপাদানকে সাজেস্ট করছে বা সরাসরি বলে দিছে। ফাইনালি যখন আমার মাথায় শব্দ আসতে লাগলো, আমি যা আঁকতেছিলাম তার ওপরই লেখতে শুরু করি। লেখা আর আঁকা — একটা আরেকটার ওপরে বসানো। ড্রয়িং এর ওপর থেকে যদি লেখার পাঠোদ্ধার করতে পারেন তাহলে তো ভালো, ওগুলা ওখানে পড়ার জন্যই দেয়া। কিন্তু ড্রয়িংগুলার মধ্যে যা আছে সেগুলা হচ্ছে আমার শুরুর দিকের ড্রাফট, অর্থাৎ টাইপরাইটারে কাজ করতে বসার আগে যেগুলা হাতে লেখা হইছিলো সেগুলা। এই বইটা দাঁড় করানো এমনিতে খুবই কঠিন ছিলো, আর আমি শিউর না কেন। একটা কারণ হতে পারে এর বিষয়বস্তু। অর্থাৎ কলকাতা। সেখানে আমি মোটে দুইবার গেছি। প্রথমবার যখন গেছি তা শো ইয়োর টাং লেখতে শুরু করার এগারো বছর আগের কথা। খোদ ইন্ডিয়াতেই ওইটা আমার প্রথম ভ্রমণ। আর কলকাতায় আমি ছিলাম মাত্র কিছুদিন। কিন্তু তাতেই শকড হয়ে গেছিলাম। আর সেই শুরু থেকেই, ফিরা আসার, আরো বেশিদিন থাকার, বেশি কিছু দেখার, কিছু একটা লেখার ইচ্ছা সবসময়ই মনের মধ্যে ছিলো। পৃথিবীর আরো অন্যান্য জায়গাও তো দেখতে গেছি আমি — এশিয়া, আফ্রিকা — কিন্তু যখনই হংকং বা জাকার্তা বা ম্যানিলার কোনো বস্তির মুখোমুখি হইছি তখনই আমার কলকাতার কথা মনে পড়ে গেছে। আমার জানামতে পৃথিবীর আর কোথাও প্রথম বিশ্বের সমস্যাগুলা তৃতীয় বিশ্বেরগুলার সঙ্গে এভাবে দিনের আলোতে, খোলাখুলি মিশে নাই।

তো আমি আবার কলকাতায় গেলাম, আর আমার ভাষা ব্যবহারের ক্ষমতা হারায় ফেললাম। একটা শব্দও লেখতে পারতেছিলাম না তখন। এই অবস্থায় ড্রয়িং করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো, কলকাতার বাস্তবতাকে ক্যাপচার করার আরেকটা উপায় হিসাবে। ড্রয়িং এর সাহায্যে আমি আবার প্রোজ লেখার জন্য তৈরি হয়ে উঠলাম — অর্থাৎ বইয়ের প্রথম সেকশনটা, যেইটা কিছুটা প্রবন্ধ’র মতো। এরপর আমি বইয়ের তৃতীয় সেকশনের কাজে হাত দিলাম যেখানে ছিলো বারো পার্টের একটা লম্বা কবিতা। একটা সিটি পোয়েম ছিলো ওইটা, কলকাতাকে নিয়া। আপনি যদি প্রোজ, ড্রয়িং আর কবিতাকে একসঙ্গে দেখেন, তাহলে দেখবেন তারা কলকাতাকে নিয়াই ডিল করে, কিন্তু আলাদা আলাদাভাবে ভাবে। তাদের মধ্যে একটা ডায়ালগ চলমান, যদিও এই তিনটার টেক্সচার অনেক ডিফরেন্ট।

ইন্টারভিউয়ার: কোনো একটা টেক্সচার কি অন্যগুলা থেকে ইম্পর্টেন্ট?

গুন্টার গ্রাস: আমি শুধু আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, কবিতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। একটা নভেলের জন্ম একটা কবিতা দিয়া শুরু হয়। আমি এরকম বলবো না যে এটা আল্টিমেটলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ, বরং আমার এটা ছাড়া চলে না। স্টার্টিং পয়েন্ট হিসাবে আমার এটা দরকার।

[ইনটারভিউ’র একটা অংশ]

Series Navigation<< সাহিত্য এবং আর্টে কিছু ভড়ং, কিছু মহৎ এটিচিওড ঢুকে গেছে, যেগুলা ডেনজারাস – চেসোয়াফ মিয়শ
The following two tabs change content below.
Avatar photo

তাহমিদ রহমান

জন্ম ১৯৯৯ এর সেপ্টেম্বরে। বড় হওয়া ঢাকায়। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেন। কবি। অনুবাদক। চাকরীপ্রত্যাশী।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →