Main menu

একজন ভালো লেখকের তার নিজস্ব স্টাইল থাকতে হয় – কেনজাবোরো ওয়ে

This entry is part 23 of 27 in the series ইন্টারভিউ সিরিজ

জাপানিজরা শান্তি প্রিয়। দুনিয়া জুড়ে চলা এই সুন্দর বিজ্ঞাপনরে ফুটা করার জন্য যে কয়জন রাইটার কাজ করছেন কেনজাবারো ওয়ে তাদের মধ্যে অন্যতম। আপাত দৃষ্টিতে জাপান গণতান্ত্রিক দেশ হইলেও তাদের খুঁটি এখনো রাজ পরিবারের সাথে গাঁথা। জাপানে রাজ পরিবাররে এখনো ভগবানের মতো মানা হয়। ঠিক এই যায়গাতেই ওয়ের যত আপত্তি। ওয়ে গণতন্ত্রের বাইরে যেকোন অথরিটিরে মানতে আস্বীকার করেন। ওয়ের ডেমোক্রেটিক ভ্যালুগুলা আবার আমেরিকান ডেমোক্রেসি এবং ফ্রেন্স হিউমেনিজম দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড। যদিও ওয়ে জাপানে আমেরিকার আর্মি বেইজের সমালোচনা করেন।

নোবেল লরিয়েট কেনজাবারো ওয়ে জন্ম গ্রহন করেন ১৯৩৫ সালে জাপানের শিকুকু আইল্যন্ডে। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে বাবা মারা গেলে মা এবং দাদির কাছে বেড়ে উঠেন। ওয়ের লাইফে মা আর দাদির ব্যাপক প্রভাব আছে। মা আর দাদির কোলে বসে শুনা গল্পগুলাই ছিল ওয়ের লেখক জীবনের পাথেয়। একাডেমিক বইয়ের বাইরে পড়া প্রথম বইটা ছিল নয় বছর বয়সে মায়ের দেয়া মার্ক টোয়েনের হাকালবেরি ফিন। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে জাপানিজদের আমেরিকান সাহিত্যে পড়া নিষিদ্ধ ছিল। মা বলে দিয়েছিলেন স্কুলের টিচাররা যদি বইটা দেখে ফেলে তাহলে যেন বলেন তা জার্মান রাইটারের ছদ্মনাম।

দুনিয়াতে রাইটার অনেক থাকেলেও ওয়ে ছিল সেই বিরল ঘরানার যারা কলমের পাশাপাশি তাদের মুখকেও ব্যবহার করছেন সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসাবে। যার কারণে তার খাতির সবচেয়ে ভালো জমছে এডওয়ার্ড সাঈদ এবং নোয়াম চমস্কির সাথে। শত বাধাবিপত্তি আর ভয় ভীতির মধ্যেও অথরিটির করা জুলুমের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে ওয়ে কুণ্ঠিত হন নাই।

ওয়ে পলিটিক্যল রাইটার হইলেও কোন দিন পার্টি পলিটিক্সে জড়ান নাই। সারা জীবন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন আর ইয়াং জেনারেশন যাতে পলিটিকালি কনসাস হয় তার জন্য কাজ করে গেছেন। যার কারণে তিনি মুরাকামির ইন্টারন্যাশনাল পপুলারিটির ভক্ত হইলেও তার নন পলিটিকাল লেখাপত্রের সমালোচক ছিলেন। ওয়ের মতে, ’যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাপানে বিরাট কিছু চিন্তক থাকলেও বর্তমান পপুলার রাইটারদের মধ্যে তেমন কিছু দেখা যায় না। সব একেবারে ফাঁপা। মুরাকামি আর বানানা ইয়োশমোটো একেবারেই পলিটিকালি এনগেইজড হইতে চায় না। তাদের লেখাগুলা মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হইলেও ভিড়িও গেইমের মতো চটকদার কিন্ত ভেতরটা একেবারে ফাঁকা।’ তারা নন পলিটিকাল পোলাপানরে টার্গেট কইরা লেখেন বইলাই ওয়ের ক্ষোভটা তাদের উপর বেশী।

ওয়ের লেখক জীবনরে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা হইলো বড় পোলা হিকারির জন্মের আগের আরেকটা হইলো পরের। হিকারের জন্মের আগের লেখাগুলাতে তিনি যুদ্ধ পরবর্তী জাপানের সামাজিক এবং রাজনৈতিক চিত্র তুলে ধরেছেন আর নেক্সট লেখাগুলাতে তিনি প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনের নানা দিক নিয়া আলাপ করেছেন কারণ হিকারি প্রতিবন্ধী হিসাবে জন্মাইছিলো। শুরুতে তিনি ভাবছিলেন এইটা হয়তো পারমাণবিক বোমার রেডিয়েশনের কারণে হইছে। তখন দলে দলে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম গ্রহণ করতো। তাই তিনি হিরোশিমা নিয়া আগ্রহী হইয়া লেখাপত্র শুরু করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নিউক্লিয়ার কাজকামের বিরোধীতা কইরা গেছেন।

ওয়ে বলেন, “আমি রাইটার হিসাবে ট্রেইন্ড হইলেও আমারে মানুষ বানাইছে হিকারি।” ওয়ের ধ্যানজ্ঞান জুইড়া আছে হিকারি এবং লেখাজোকাও হিকারিরে নিয়া ইনফ্লুয়েন্সড। যার কারণে ওয়ে তার নোবেল প্রাইজের পুরা কৃতিত্ব দিতে চান হিকারিরে। হিকারি শব্দের অর্থ আলো। ওয়ে মনে করেন হিকারির জন্ম তার মনের গভীরের অন্ধকার জগতরে আলোকিত করছে।

এই ইন্টারভিউটা প্যরিস রিভিউ ম্যাগাজিনের জন্য নিছিলেন সারাহ ফে ২০০৭ সালে। এইখানে মোটামুটি ওয়ের পুরা জীবনটা ধরা আছে। ওয়ে যেসব বই, রাইটার এবং আইডিয়া দ্বারা ইনফ্লুয়েন্সড ছিলেন সেসব নিয়া বিস্তারিত আলাপ করছেন।

মোহাম্মদ এমদাদুল আমিন
অক্টোবর, ২০২৩

কয়েকটা সাবজেক্টরে মানুষ যাতে সিরিয়াসলি নেয় তার জন্য কেনজোবারো ওয়ে তার জীবনটা উৎসর্গ করছেন। যেমন, হিরোশিমায় এটোমিক বোমার ভিক্টিমরা, ওকিনাওয়ার মানুষদের স্ট্রাগল, প্রতিবন্ধীদের চ্যালেঞ্জ, একজন বুদ্ধিজীবীর নিয়ন্ত্রিত জীবন যেখানে নিজেরে সে সিরিয়াসলি না নেয়ার ভান করে। যদিও জাপানে তিনি গ্যাডফ্লাই এক্টিভিস্টের পাশাপাশি সবচয়ে জনপ্রিয় লেখক হিসেবে পরিচিত। ব্যক্তিজীবনে তিনি বেশ হাসিখুশি একজন মানুশ।

খুবই বিনয়ী এবং হালকা চালের স্পোর্টস শর্টস পরেন, সারাক্ষণ অস্থির থাকেন এবং সহজেই হাসেন। হেনরি কিসিঞ্জার যা কিছু বিশ্বাস করে ওয়ে তার বিপরীতে অবস্থান করেন। কিসিঞ্জার ওয়ের হাসিটারে ডেভিলস স্মাইল হিসেবে মন্তব্য করছিলো।

ওয়ের বাড়ি, যার লিভিং রুমের চেয়ারে বসে বেশীরভাগ সময় কাটান। যেখানে ছড়াইয়া ছিটাইয়া আছে পাণ্ডুলিপির পেইজ, বই, অসংখ্য জ্যাজ এবং ক্ল্যাসিক্যাল সিডির ক্যাসেট। যা তার মতোই আরামদায়ক এবং ভণিতা বিহীন। তার পশ্চিমা স্টাইলের ঘরটা ডিজাইন করছে বউ ইউকারি। টোকিওর সেইমসাইডে যেখানে আকিরা কুরোসাওয়া এবং টোশিরো মিফিউন একসময় থাকতো। এইটা রাস্তা থেকে একটু ভিতরে, অসংখ্য লিলি ফুলের বাগান, ম্যাপল গাছ এবং একশোর বেশী জাতের গোলাপ বাগানের পিছনে লুকাইয়া আছে।

তাদের ছোট ছেলে এবং মেয়ে বড় হয়ে যাওয়াতে নিজেদের মতোই থাকে। ওয়ে এবং ইউকারি তাদের ৪৪ বছর বয়সী প্রতিবন্ধী ছেলে হিকারির সাথে এই বাসায় থাকেন।

ওয়ে বলছিলেন, রাইটারের কাজ হইলো জোকারের কাজের মতো, যে দুঃখ কষ্ট নিয়াও কথা বলে। উনি বলতেছিলেন, উনার অধিকাংশ লেখাই দুইটা উপন্যাসের থিমের উপর বেইজ কইরা। অ্যা পারসোনাল ম্যাটার (১৯৬৪) যেখানে একজন পিতার তার প্রতিবন্ধী সন্তানরে মাইনা নেয়া নিয়ে লেখা এবং দ্য সাইলেন্ট ক্রাই (১৯৬৭) যেখানে যুদ্ধ পরবর্তী গ্রামীণ এবং শহুরে সমাজের কালচারাল কনফ্লিক্ট দেখানো হইছে।

প্রথম ক্যাটাগরির উপন্যাসের মধ্যে পরে, অঘি দ্য স্কাই মন্সটার (১৯৬৪), টিচ আস টু আউটগ্রো আওয়ার ম্যাডনেস (১৯৬৯), দ্য পিন্স রানার মেমোরেন্ডাম (১৯৭৬), রাউজ আপ ও ইয়াং ম্যান অফ দ্য নিউ এইজ (১৯৮৬), এবং অ্যা কোয়াইট লাইফ (১৯৯০)। এই উপন্যসগুলা ওয়ের পারসোনাল লাইফ নিয়া লেখা। বিশেষ করে হিকারির জন্মের পর। এই উপন্যাসগুলার নেরেটর সাধারণত লেখক হয় এবং ছেলের নাম হয় মোরি, ঈওর অথবা হিকারি। কিন্তু গল্পে এমন সব ডিসিশন নেয়া হয় বাস্তবে তিনি যা নিয়েছিলেন তার বিপরীত।

সেকেন্ড ক্যাটাগরির মধ্যে আছে, সাইলেন্ট ক্রাই এর পাশাপাশি প্রাইজ স্টক (১৯৫৮), নিপস দ্য বাডস, শ্যুট দ্য কিডস (১৯৫৮), সমারসল্ট (১৯৯৯), এইখানে ওয়ের মা এবং দাদির কাছে শুনা বিভিন্ন লোককাহিনী এবং পুরাণের গল্প নিয়া আলাপ করা হইছে। এইখানে সাধারণত একজন নেরেটর থাকেন যে সমাজে টিকে থাকার জন্য নিজের ক্রিয়েট করা মিথ্যের বেশাতি পরিক্ষা করতে বাধ্য হন।

ওয়ে শিকুকু আইল্যান্ডের ছোট্ট একটা গ্রামে ১৯৩৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং সম্রাটরে ভগবান হিসাবে বিশ্বাস কইরা বড় হইছেন। তিনি বলেন যে, সম্রাটকে তিনি সাদা পাখি হিসাবে কল্পনা করছেন, এবং পরবর্তীতে রেডিওতে ১৯৪৫ সালে সারেন্ডারের বাণি শুইনা সাধারণ মানুষ হিসাবে দেইখা অবাক হইছেন। ১৯৯৫ সালে ওয়ে নোবেল প্রাইজ পান এবং জাপানের সর্বোচ্চ সম্মাননা অর্ডার অফ কালচার নিতে অস্বীকার করেন। কারণ এই পুরস্কারের সাথে অতীতের সম্রাট পূজার সম্পর্ক ছিল। এই সিদ্ধান্ত তাকে জাপানের জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়া আসে। যে জায়গাটা পরবর্তীতে লেখালেখির জন্য তাকে প্রায়ই দখল করে রাখতে হইছে। তার শুরুর দিকের গল্প ‘সেভেন্টিন’ লেখা হইছে ডানপন্থী এক স্টুডেন্টের লাইফের উপর যে ১৯৬০ সালে সমাজতান্ত্রিক পার্টির লিডাররে খুন করার পর নিজেও সুইসাইড করে। ওয়ে দুইটা গ্রুপের কাছ থেকেই থ্রেট পাইছেন। ডানপন্থী গোঁড়ারা মনে করছে তিনি সম্রাটের সম্মানে কালিমা লেপন করছেন, অন্যদিকে বামপন্থীরা মনে করছে, তিনি একজন টেররিস্টরে মাথায় তুলে রাখছেন। তখন থেকেই তিনি রাজনৈতিক আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন এবং তিনি তার রাজনৈতিক কর্মকান্ডরে তার লেখালেখির সমান মনে করেন। এই আগস্টেই চার দিন ধরে যখন আমি তার ইন্টারভিউ নিচ্ছিলাম, ওয়ে রাখডাক না কইরাই জিজ্ঞেস করছেন, ইন্টারভিউটা তাড়াতাড়ি নেয়া যায় কিনা কারণ সচেতন নাগরিক সমাজের একটা গ্রুপের সাথে তার দেখা করার কথা আছে।

যখন ১৯৬৩ সালে হিকারি জন্মাইছিলো, ওয়ের বিয়ের তিন বছরের মাথায়, ওয়ে অলরেডি দুইটা উপন্যাস এবং কয়েকটা ছোট গল্প পাবলিশড কইরা ফেলছেন, যার মধ্যে আছে, লেভিশ আর দ্য ডেড (১৯৫৭) এবং প্রাইজ স্টক যেটা গুরুত্বপূর্ণ আকুটাগাওয়া পুরস্কার পাইছিলো। ক্রিটিকরা ইউকিয়ো মিশিমার পরেই তারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাইটার হিসাবে বলে আসছে। কিন্ত সমালোচক টাকাশি টাচিবানা বলছে, হিকারিরে ছাড়া ওয়ের সাহিত্যে বলতে কোন কিছু নাই। জন্মের সময়ই হিকারির ব্রেইন হারনিয়া ধরা পরছিলো। খুবই লম্বা এবং ঝুকিপূর্ণ একটা অপারেশনের পরে ডাক্তাররা বলছে হিকারি মারাত্মকভাবে অচল হইতে পারে। ওয়ে জানতো তার ছেলেরে নিয়া সবাই কথা শুনাবে, একটা প্রতিবন্ধী ছেলেরে নিয়া দশ জনের সামনে যাওয়াটা জাপানে লজ্জার মনে করা হইতো। কিন্ত ওয়ে এবং তার ওয়াইফ এই নতুন জীবনরে মাইনা নিছেন। হিকারি শব্দের অর্থ আলো। শিশু হিসাবে হিকারি খুবই কম কথা বলতো এবং পরিবারের লোকজন যখন কথা বলার চেষ্টা করতো মনে হয় বুঝতে পারতো না। তারা পাখির ডাক, মোজার্ট এবং চপিনের রেকর্ডিং বাজাইতো তার দোলনার পাশে, তারে শান্ত করে ঘুম পাড়ানোর জন্য। তারপর হিকারির বয়স যখন ছয় হইলো সে একটা পুরা বাক্য বলা শিখলো। পারিবারিক ছুটিতে ওয়ের হাত ধরে হাটার সময় হিকারি যখন পাখির ডাক শুনছে ঠিকঠাক বলতে পারছে,‘ এইটা একটা পাতা ঝিল্লি (ওয়াটার রেইল) পাখি। এর পরপরই সে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিক বুঝতে শুরু করলো। এবং যখন তার যথেষ্ট বয়স হইলো ওয়ে তারে একটা পিয়ানো ক্লাসে ভর্তি কইরা দিলেন। এখন হিকারি জাপানের সবচেয়ে মেধাবী কম্পোজার। সে জীবনে যত মিউজিক শুনছে তা একবার শুনামাত্রই মনে করতে পারে এবং ট্রান্সক্রাইব করতে পারে। কয়েকটা নোট শুনার পরেই সে মোজার্টের কাজগুলা ধরতে পারে। তার প্রথম সিডি ‘মিউজিক অফ ওয়ে’ ক্ল্যাসিক্যাল ক্যাটাগরির সমস্ত রেকর্ড ভাইঙ্গা দিছে। সে তার অধিকাংশ সময় বাবার সাথে লিভিং রুমে কাটায়। বাবা পড়ে এবং লেখে, সাথে ছেলে শুনে এবং গান বানায়।

আলাপের সময় ওয়ে সহজেই জাপানিজ, ইংলিশ মাঝে মধ্যে ফ্রেন্সে চলে যাইতে পারেন। কিন্ত এই ইন্টারভিউয়ের জন্য উনি একজন অনুবাদকের রিকোয়েস্ট করছেন এবং তার জন্য শিয়োন কানোর কাছে আমি ঋণী। যে এইকাজটা অসাধারণ দক্ষতার সাথে করছে। ভাষার প্রতি ওয়ের যে শ্রদ্ধা বিশেষ করে লিখিত শব্দের প্রতি তা তার নিজের জীবনেও প্রতিফলিত। কথা বলার এক পর্যায়ে একটা প্রশ্নের জবাব দেয়ার জন্য উনি তার উপর লেখা একটা আত্মজীবনীর রেফারেন্স টানছেন। যখন আমি তারে জিজ্ঞেস করলাম এইটা কি তিনি মনে না করতে পারার জন্য করছে কিনা, উনি অবাক হইয়া বললেন, না। এইটা নিজেরে জানার একটা প্রক্রিয়া। কেনজোবারো ওয়ের নিজেরে খুইজা পাওয়ার প্রয়োজনে এইটা দরকার আছে, এই বইয়ের মধ্যে দিয়েই আমি নিজেরে ডিফাইন করতে চাই।

সারাহ ফে
২০০৭

ইন্টারভিউয়ার: ক্যারিয়ারের শুরুতে আপনি অনেকের ইন্টারভিউ নিছেন। নিজেরে কি আপনি ভালো ইন্টারভিউয়ার মনে করেন?

কেনজাবারো ওয়ে: না, না, না। একজন ভালো ইন্টারভিউয়ার সাধারণত এমন কিছু বের করে নিয়ে আসেন যা সাবজেক্ট আগে কখনো বলে নাই। আমার মনে হয় না এমন কিছু করার ক্ষমতা আমার আছে। কারণ সারা জীবনে আমি এমন কিছু বাইর করে আনতে পারি নাই।

১৯৬০ সালে জাপানের নির্বাচিত পাঁচ জন লেখকদের একটা দলে আমি ছিলাম যাদেরকে চেয়ারম্যান মাওয়ের সাথে দেখা করতে দিছিলো। আমরা সুযোগটা পাইছিলাম জাপান-আমেরিকান নিরাপত্তা চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণে। পাঁচ জনের মধ্যে আমি সবার ছোট ছিলাম। তার সাথে দেখা করতে আমাদের অনেক দেরী হয়-রাত ১টার দিকে। তারা আমাদেরকে একটা অন্ধকার বাগানের দিকে নিয়া গেছিলো। বাগানটা এতটাই অন্ধকার ছিল যে পাশে থাকা একটা জেসমিন ফুল আমরা দেখতে পারি নাই কিন্ত ঘ্রাণ পাইতেছিলাম। আমরা যদি জেসমিন ফুলের ঘ্রাণটারে ফলো করি তাইলে মাওয়ের কাছে পৌছাইতে পারবো বলে জোক করছিলাম। মাও অসামান্য মানুষ ছিলেন। অস্বাভাবিক রকমের বড়, বিশেষ করে এশিয়ান স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী। আমাদের প্রশ্ন করার পারমিশন ছিল না। আমাদের সাথে সরাসরি কথা বলার পরিবর্তে উনি প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাইরে উদ্দেশ্যে করে কথা বলতেছিলেন। পুরাটা সময় সে তার বই থেকে লাইন বাই লাইন কোট করতেছিল। এইটা খুবই বিরক্তিকর ছিল। তার সিগারেটের বিশাল একটা ক্যান ছিল এবং চেইন স্মুকার ছিলেন উনি। আমাদের সাথে কথা বলার সময় চৌ মজা করে ক্যানটা দূরে সরাইয়া রাখতো। মাও আবার তা কাছে টাইনা আনতো।

এর পরের বছর আমি সার্তের ইন্টারভিউ নিছিলাম। তখন আমি প্রথম বারের মতন প্যারিস গেছিলাম। সেইন্ট-জার্মেইন-ডেস-প্রে হোটেলে একটা ছোট রুম নিছিলাম। হোটেলে উইঠা প্রথম শব্দটা শুনছিলাম বাইরের প্রতিবাদকারীদের ”আলজেরিয়ায় শান্তি চাই!” সার্তে আমার জীবনে ব্যাপক প্রভাব রাখছে। মাওয়ের মতোই, সেও মূলত যা লিখছিল তাই বারবার বলতেছিল, এক্সিসটেনশিয়ালিজ ইজ হিউম্যনিজম এবং ইন সিচুয়েশন বই থেকে। তাই আমি নোট নেয়া বন্ধ করে শুধুমাত্র বইয়ের নামটা টুকে নিছি। সে আরো বলছিলো মানুষের উচিৎ পারমাণবিক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। কিন্ত সে চায়নার পারমাণবিক অস্ত্র রাখারে সমর্থন করছিলো। আমি অবশ্য স্ট্রংগলি যে কারো পারমাণবিক অস্ত্র রাখার বিরুদ্ধে আবস্থান করি । কিন্ত সার্তেরে আমি এই বিষয়ে বুঝাইতে পারি নাই। উনি জাস্ট বলছেন, নেক্সট কোয়েশ্চন।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি না জাপানীজ টেলিভিশনের জন্য কার্ট ভনেগাটের ইন্টারভিউ নিছেন?

কেনজাবারো ওয়ে: হ, যখন তিনি ১৯৮৪ সালে পেন কনফারেন্সের জন্য জাপানে আসছিলেন তখন। এইটা সিরিয়াস কিছু ছিল না। দুইজন লেখকের মধ্যে হালকা চালের কথাবার্তা হইছে। ভনেগাট একজন সিরিয়াস চিন্তক ছিলেন। যে তার প্রভাব বিস্তারকারী আইডিয়াগুলা ভনেগুটিয়ান হিউমারের মাধ্যেমে প্রকাশ করছিলেন। তার কাছ থেকেও আমি গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু বাইর করে আনতে পারি নাই।

গুরুত্বপুর্ণ কিংবা নতুন কিছু বাইর করে আনার চাইতে লেখকদের সাথে পরিচিতির সুবাধে তাদের অনেস্ট অপিনিয়ন নেয়াতে আমি অনেক বেশি সাকসেসফুল ছিলাম। নোয়াম চমস্কি আমারে বলছিলো, কিশোর বয়সে সামার ক্যম্পে থাকার সময় সেখানে একটা ঘোষণা দিছিলো যে, আমেরিকা এটম বোমা ফেলছে এবং তাতে করে মিত্র শক্তিরা যুদ্ধে জিতে যেতে পারে। এইটা শুনে সেলিব্রেট করার জন্য ক্যম্পের সবাই বনফায়ারের আয়োজন করছিলো। এইটা দেখে চমস্কি দৌড়ে বোনের ভিতরে চলে গেছিলো এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে একা বসে ছিলো। আমি সবসময় চমস্কিরে পছন্দ করতাম এইটা শুনার পর থেকে উনার প্রতি সম্মান আরো বাইড়া গেছিলো।

ইন্টারভিউয়ার: যুবক থাকা অবস্থায় আপনি নিজেরে এনার্কিস্ট বলতেন। আপনি কি এখনো নিজেরে তা মনে করেন?

কেনজাবারো ওয়ে: আদর্শগতভাবে আমি একজন এনার্কিস্ট। কার্ট ভনেগাট একবার বলছিলো, সে একজন এগোনস্টিক যে যিশুখ্রিস্টরে সম্মান করে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে আমি একজন এনার্কিস্ট যে গণতন্ত্ররে ভালোবাসে।

ইন্টারভিউয়ার: আপনার পলিটিক্যাল কাজকর্ম কি কখনো আপনারে বিপদে ফেলছিলো ?

কেনজাবারো ওয়ে: এই মুহুর্তে ওকিনাওয়া নোটের কারণে আমার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা চলতেছে। সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার নিয়া আমার ইম্পর্টেন্ট মেমোরি হইলো এটম বোম মারা আর ১৯৪৫ সালে ওকিনাওয়াতে গণ আত্মহত্যা। আমি হিরোশিমা নোটে প্রথমটা নিয়া এবং ওকিনাওয়া নোটে সেকেন্ডটা নিয়া লিখছিলাম। ওকিনাওয়া যুদ্ধের সময় জাপানিজ মিলিটারি ওকিনাওয়ার ছোট দুইটা দ্বীপের মানুষদের সুইসাইড করতে অর্ডার করছিলো। তারা বলছিলো, আমেরিকান আর্মি এতটাই নৃশংস যে তারা তাদের মেয়েদের রেইপ করবে এবং ছেলেদের মেরে ফেলবে। তারা বলছিলো, আমেরিকান আর্মি আসার আগেই এর চেয়ে সুইসাইড করাটা তাদের জন্য বেটার হবে। তারা প্রত্যেক ফ্যমেলিকে দুইটা করে গ্রেনেড দিছিলো। যেদিন আমেরিকান সৈন্যরা ল্যান্ড করছিলো, পাঁচশোর বেশী মানুষ সুইসাইড করছিলো। দাদায় নাতিরে মারছে, জামাই বউরে।

আমি আমার লেখাতে দেখাতে চাইছিলাম যে, ঐ সময় ওকিনাওয়াতে থাকা জাপানীজ মিলিটারির হেড এই গণহত্যার জন্য দায়ী। ওকিনাওয়া নোটটা পাবলিশড হইছিলো অলমোস্ট ৪০ বছর আগে। প্রায় দশ বছর আগে একটা ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট শুরু হইছিলো। বিশ শতকের শুরুতে এশিয়া জুড়ে করা জাপানীজ আর্মিদের অত্যাচারগুলা যে সব ঐতিহাসিক বইয়ে ডকুমেন্টেড ছিল সেগুলো তারা রিভাইজড করতে চাইতেছিলো। বিশেষ করে নানকিং গণহত্যা এবং ওকিনাওয়া সুইসাইড। জাপানীজ আর্মির ওকিনাওয়া ক্রাইম নিয়া অনেক বই পাবলিশড হইছিলো কিন্ত অল্প কয়েকটার মধ্যে আমারটাই এখনো প্রিন্ট হয়। ডানপন্থী একাংশের একটা টার্গেট দরকার ছিলো এবং আমি সেই টার্গেটে পরিণত হইছি। সত্তরের দশকে বইটা যখন পাবলিশড হইছিলো তখনকার চেয়ে এখনকার আন্দোলনকারীরা অনেক বেশী জাতীয়তাবাদী এবং আমার প্রতি তাদের আক্রমণ অনেক বেশি তীব্র। যারা সম্প্রতি জাইগা-উঠা সম্রাট পূজারিদের একটা ফ্রাকশন। তারা দাবী করে যে, ঐ দ্বীপের মানুষেরা তা করছিলো সম্রাটের প্রতি দেশপ্রেমের বিশুদ্ধ ভালোবাসা থেকে।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি কি মনে করেন ১৯৯৪ সালে ‘অর্ডার অফ কালচার’ না নেয়াটা সম্রাট পূজারীদের বিরিদ্ধে খুব কাজের প্রতিবাদ হইছে?

কেনজাবারো ওয়ে: আমার শত্রুরা-এনিমি শব্দটার মৌলিক অর্থে- কোথায় আছে এবং জাপানীজ সোসাইটি এবং কালচারে তারা কোন ফর্মে আছে সে বিষয়ে সচেতন হইতে কাজে দিছে। কিন্ত ফিউচারে অন্যদের পুরষ্কার প্রত্যাখানের পথ করে দিতে আমার প্রতিবাদ তেমন কাজে দেয় নাই।

Series Navigation<< একজন লেখকরে রিস্ক নিতে হয়, সে যা দেখে সবকিছুরেই লিখতে পারার বিষয়ে – জেমস বল্ডউইনসাহিত্য কোনো মোরাল বিউটি কনটেস্ট না – ফিলিপ রথ >>
The following two tabs change content below.
Avatar photo

মোহাম্মদ এমদাদুল আমিন

জন্ম ২৩ জানুয়ারি চট্টগ্রামে। পড়াশুনা ঢাবি থেকে।বইটই নিয়া আগ্রহ আছে কিন্তু তেমন আদিখ্যেতা নাই। বন্ধুদের মতে পটেনশিয়ালটি অনেক হইলেও কনফিডেন্স তেমন একটা নাই। তাই নিজেরে লুকাইয়া রাখতে পছন্দ করে।
Avatar photo

Latest posts by মোহাম্মদ এমদাদুল আমিন (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →