Main menu

আপনি আসলে কে সেইটা ঠিক বুইঝা উঠতে পারার আগে আপনি লিখতে পারবেন না – সালমান রুশদি

This entry is part 18 of 27 in the series ইন্টারভিউ সিরিজ

সালমান রুশদির জন্ম বোম্বেতে ১৯৪৭ সালে, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিনে। পড়ালেখা ওইখানে আর ইংল্যান্ড মিলায়ে, পরে ইংল্যান্ডেই লেখালেখির জীবনের বেশিরভাগ অংশ কাটান। ইদানীং রুশদি মূলত তার নিউইয়র্কের বাড়িতেই থাকেন, সেইখানেই এই ইন্টারভিউটা গত এক বছর ধইরা কয়েক দফায় নেয়া হয়। কাকতালীয়ভাবে, দ্বিতীয় দফার ইন্টারভিউটা নেয়া হইসিলো ২০০৫ সালের ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তে, যা কিনা একইসাথে রুশদীর বিরুদ্ধে আয়াতুল্লাহ খোমেনীর ফতোয়ার ষোলতম বছরপূর্তির দিন। সেই ফতোয়ায় রুশদীরে সেটানিক ভার্সেস লেখার জন্য কাফের দাবি করা হয় এবং ইসলামী আইন মোতাবেক তার মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়। ১৯৯৮ সালে, মোহাম্মেদ খাতামি, ইরানের প্রেসিডেন্ট এই ফতোয়া নাকচ করে, এবং রুশদীও ধারণা করেন বিপদ কাইটা গেসে। কিন্তু কট্টরপন্থী মুমিনেরা মনে করেন ফতোয়া নাকচ করা যায় না এবং রুশদীর ঠিকানা এখনও গোপন রাখা আছে।

যেই লোকরে ঘিরা এত ভয়ানক কাণ্ড ঘইটা গেলো, যারে এইভাবে প্রকাশ্যে ঘৃণা ও অপবাদ দেয়া হইসে, হুমকি ও তলব করা হইসে, যার কুশপুত্তলিকা পুড়ানো হইসে, আবার যারে তুইলা ধরা হয় বাকস্বাধীনতার এক অনন্য আইডল হিসেবে, এরকম একটা মানুষের হিসাবে রুশদী খুবই সাবলীল আর ক্যান্ডিড—তিনি খুব কর্কশও না আবার ভিক্টিম মেন্টালিটিরও না। ক্লিন শেভ করা, জিন্স আর সোয়েটার পরা, তারে দেখতে অনেকটা রিচার্ড অ্যাভেডনের ১৯৯৫ সালের বিখ্যাত পোর্ট্রেটের সেই আসামীর মত দেখায় যে নিজের অভিযোক্তাদের দিকে তাকায়ে ছিল। “আমার ফ্যামিলি ওই ছবিটা সহ্যই করতে পারে না,” হাসতে হাসতে বলতেসিলো উনি। আর পরে যখন জিজ্ঞেস করা হইলো ছবিটা কোথায় রাখা, সে শয়তানি হাসি দিয়া বললো, “দেয়ালেই ঝুলানো।”

যখন সে লিখতে বসে, রুশদী বলেন, “তখন আমার জন্য দিনের বেলা নিজের রুম হইতে বের হওয়া বেশ অস্বাভাবিক ঘটনা।” কিন্তু গতবছরের শেষেই উনি শালিমার দ্য ক্লাউন, উনার নয় নাম্বার উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি জমা দিসেন, এবং এখনও নতুন কোনো কাজে হাত দেন নাই। যদিও উনার দাবি এই উপন্যাসটা লিখতে গিয়া তার সব রসদ ফুরায়ে গেসে, তবু দেখা গেলো নিজের অতীত, লেখালেখি আর রাজনীতি নিয়া আলাপ করতে করতে যেন উনি জোশ ফিরা পাইতে লাগলেন। আলাপ করার সময়ও রুশদী সেই একই মানসিক কসরত জারি রাখেন যা তার ফিকশনে পাওয়া যায়—মূল কথায় ফিরা আসার আগে অসংখ্য শাখা-প্রশাখা গজাইতে থাকে যা বিভিন্ন মহাদেশ আর ঐতিহাসিক সময়কালরে টোক্কা দিয়া চইলা আসে।

সেই ফতোয়ার ফলে রুশদীর নাম এখন যেকোনো জীবিত ঔপন্যাসিকের চেয়ে বেশি চেনাজানা। কিন্তু এইসব রাজনৈতিক আক্রমণে লেখক হিসেবে রুশদীর রেপুটেশন একটুও কমে নাই। ১৯৯৩ সালে তার মিডনাইটস চিল্ড্রেন বইটারে ‘বুকার অফ বুকার্স’ এওয়ার্ড দেয়া হয়, ২৫ বছর আগে এই বই পাবলিশ হওয়ার পর থেকে ম্যান বুকার প্রাইজ পাওয়া সকল বইগুলার মধ্যে এইটা শ্রেষ্ঠ হিসেবে। এবং বর্তমানে উনি পেন-আমেরিকান সেন্টারের প্রেসিডেন্ট। উপন্যাস ছাড়াও, উনি পাঁচ খণ্ড ননফিকশনের এবং একটা গল্পগ্রন্থের লেখক। ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তে উনি নিজের জন্য একটা প্যাডওয়ালা চেয়ার নিয়া বসছেন, হালকা কইরা তুষার পড়তেসে, কয়েক ঘর দূর হইতে একটা চুল্লি আকাশে কালো ধুঁয়ার কলাম আঁইকা দিসে। রুশদি এক গ্লাস পানি খাইলেন আর মূল আলাপ শুরুর আগে বউরে কী গিফট দেয়া যায় তা নিয়া একটু কথা বললেন।

জ্যাক লিভিংস, ২০০৫

ইন্টারভিউয়ার: আপনি যখন লেখেন, তখন কি আপনারে যারা পড়বে তাদের কথা চিন্তা কইরা লেখেন?

সালমান রুশদি: আমি ঠিক জানিনা। যখন বয়স আরেকটু কম ছিল, তখন বলতাম, না, আমি কেবল আমার লেখার সার্ভেন্ট।

ইন্টারভিউয়ার: এইটা তো বেশ আইডিয়ালিস্টিক।

রুশদি: অতিরিক্ত আইডিয়ালিস্টিক। ইদানীং আমার কাছে লেখার ক্ষেত্রে স্পষ্টতারেই বেটার গুণ মনে হয়, জটিলতার চাইতে। তার কারণ এখন সম্ভবত আমি কিছুটা বুঝি মানুষ একটা বই কেমনে পড়ে, এইটা আমি জাজ করতেসি আমার লেখা বইগুলা এখন পর্যন্ত মানুষ কেমনে পড়সে তার উপর বেস কইরা। বাজারের মর্জিমত লেখা বই অবশ্যই আমার পছন্দ না, তবে এখন একটা গল্প বলতে গেলে আমার লক্ষ্য থাকে যতটা সম্ভব স্পষ্টভাবে লেখা, এবং তার মাধ্যমে রিডারের সাথে এনগেজ করা। তবে এইটা আগেও মনে করতাম, মিডনাইটস চিল্ড্রেন লেখার সময়ও। একটা জিনিস অদ্ভূত লাগতো যে এনগেজিং স্টোরিটেলিং আর মহৎ সাহিত্য যেন আলাদা পথে চইলা গেসে। কিন্তু দুইটারে এমন আলাদা ভাবাটা আমার কাছে বেহুদা মনে হইসে। একটা গল্পের সিম্পল হইতে হবে তা না, ওয়ান-ডিমেনশনালও হইতে হবে না, কিন্তু গল্পটা যদি জটিল এবং বহুমাত্রিকও হয়, তবু তো আপনার গল্পটা বলার একটা স্পষ্ট ওয়ে খুঁজতে হবে, যাতে রিডার এনগেজ করতে পারে।

আর আস্তে আস্তে যেই একটা সাবজেক্ট আমার নিজস্ব জিনিস হইয়া দাঁড়াইসে তা হইলো, কিভাবে পৃথিবীর যেকোনো জায়গার গল্প আসলে সবজায়গারই গল্প। কিছু মাত্রায় তা আমি আগে থিকাই জানতাম কারণ মুম্বাই, যেইখানে আমার বাইড়া ওঠা, সেই শহরে পশ্চিম পুরাপুরি পুবের সাথে মিইশা ছিল। আমার জীবনের নানান দুর্ঘটনা এখন আমারে এই ক্ষমতা দিসে যে আমি দুনিয়ার নানান জায়গার ঘটনারে আমার গল্পের অংশ বানায়া নিতে পারি, কখনো কখনো তারা শান্তিতে মেলে, বা কখনো তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লাইগা থাকে—বা বেশিরভাগ সময় দুইটাই একসাথে ঘটে। এইসব গল্প লেখার একটা সমস্যা হইলো আপনি যদি সবজায়গার গল্প লিখতে বসেন, তাইলে শেষমেষ দেখা যাইতে পারে আপনি কোনো জায়গার গল্পই লিখতে পারেন নাই। যেইসব লেখকরা স্রেফ একটা জায়গারে কেন্দ্র কইরা লেখে তারা এই সমস্যাটা ফেস করে না। সেইসব লেখকরা অন্য কোনো প্রবলেম ফেস করে। কিন্তু ফকনার বা ওয়েল্টির মত লেখকদের যা আছে–দুনিয়ার বুকে একটুখানি জায়গা যা তারা এতটাই ভালোমত চেনে, এবং তাদের শিকড় ওই জায়গাটার এতই ভিতরে যে তারা সারাটা জীবন সেই জায়গা নিয়া লিখ্যা গেলেও তা ফুরাবে না–এই জিনিসটা আমার অনেক ভাল্লাগে, কিন্তু আমি এইভাবে লিখি না।

ইন্টারভিউয়ার: আপনার মতে আপনি কিভাবে লেখেন?

রুশদি: আমার জীবন আমারে লেখার জন্য অন্য একটা সাবজেক্ট দিসে: দ্বন্দ্বের মুখোমুখি নানান দুনিয়া। মানুষরে আপনি কিভাবে দেখাবেন যে এখন সবার গল্পই আসলে অন্য সবার গল্প। স্রেফ লেইখা যাওয়া এক জিনিস, কিন্তু আপনি পাঠকরে জিনিসটা ফিল কেমনে করাবেন, যেন সে নিজেই এই জীবনটা এক্সপেরিয়েন্স করতেসে? আমার শেষ তিনটা উপন্যাসে আমি এই প্রশ্নগুলার উত্তর দেয়ারই চেষ্টা করসি: দ্য গ্রাউন্ড বিনিথ হার ফিট, ফিউরি আর এই নতুনটা, শালিমার দ্য ক্লাউন, এইটার শুরু আর শেষ লস অ্যাঞ্জেলেসে, কিন্তু মাঝখানের কিছু ঘটনা হয় কাশ্মীরে, কিছু আছে নাৎসির দখলে থাকা স্ট্র‍্যাসবার্গে, আবার কিছুটা ১৯৬০ দশকের ইংল্যান্ডে। শালিমারে, ম্যাক্স অফ্যুলসের কারেক্টারটা থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার রেজিস্টেন্সের এক হিরো। রেজিস্টেন্স, যারে আমরা তখনকার সময়ে হিরোইক ভাবতাম, তা একচুয়ালি ছিল একটা বিদ্রোহ। আমরা এখন এমন একটা সময়ে বাস করি যখন এরকম বিদ্রোহরে আর সবসময় হিরোইক ভাবা হয় না, অনেকেরে আমরা জঙ্গি বলি। আমি কোনো নৈতিক সবক দিতে চাই না। আমি জাস্ট বলতে চাইসি: তখন এইরকম ঘটসে, এখন এইরকম ঘটতেসে, আমার এই গল্পে এই দুইটা জিনিসই আছে, খালি দেখবেন দুইটা জিনিস পাশাপাশি বসাইলে কী দাঁড়ায়। আমার মনে হয় না একজন ঔপন্যাসিক “এইটা দিয়া ওইটা বুঝানো হইসে” বলার এখতিয়ার রাখে।

ইন্টারভিউয়ার: আপনার কি মাঝেমাঝে “এইটা দিয়া ওইটা বুঝানো হইসে” বলা থেকে নিজেরে জোর কইরা আটকানো লাগে?

রুশদি: না। উপন্যাসের ক্ষেত্রে আমি এই জিনিসটার বিরুদ্ধে। যদি কোনো প্রবন্ধ-টবন্ধের জন্য হয়, তাইলে ঠিকাসে। কিন্তু উপন্যাসে পাঠকরে দিকনির্দেশনা দিতে গেলে উপন্যাসটা নষ্ট হয়, আমার মতে। যেমন ধরেন, শালিমারের কারেক্টারটা কিন্তু একটা দুর্ধর্ষ খুনী। আপনি তারে ভয় পাবেন, কিন্তু কিছু কিছু পয়েন্টে–যেমন যেই সিনে সে স্যান কুয়েন্টিনের দেয়াল হইতে ঝাপ দিয়া উইড়া পড়ে–তখন আপনি তার পক্ষে চইলা যাবেন। আমি চাইসি যেন এমন ঘটে, আমি চাইসি মানুষ ওর মত কইরা দেখুক, ও যেমনে ফিল করে অমনে ফিল করুক, ও কেমন মানুষ তা স্রেফ ধারণা কইরা নেয়া না লাগুক। আমার অন্যসব বইগুলার মধ্যে এই একটাই কারেক্টারদের দ্বারা সবচেয়ে বেশি লিখিত হইসে। এই বইয়ের অরিজিনাল কনসেপ্টের অনেকটাই পরে বদলানো লাগসে কারণ কারেক্টারগুলা ভিন্নপথে হাঁটতে চাইতেসিলো।

ইন্টারভিউয়ার: কী বলতে চাইতেসেন আপনি?

রুশদি: লেখার সময় হুটহাট একেক মুহূর্তে, এমনসব ঘটনা ঘটতো যা আমি আগে থিকা ভাইবা রাখি নাই। এই বইয়ের ক্ষেত্রে অদ্ভূত কিছু ব্যাপার ঘটসে। এই বইয়ের মানুষগুলা আমারে পুরা দখল কইরা ফেলসিলো। এতটাই যে আমি এই বইয়ের কারেক্টারদের জন্য কান্নাকাটিও করসি। বইতে একটা অংশ আছে যেইখানে বুন্যির বাবা, পণ্ডিত পেয়ারেলাল তার ফলের বাগানে মারা যায়। আমি এইটা নিতে পারি নাই। আমি আমার ডেস্কে বইসা কাইন্দা দিসিলাম। পরে ভাবতেসিলাম, আমি কী করতেসি? এই লোক তো আমার নিজের বানানো একজন কারেক্টার। তারপর আরেক জায়গায় আমি কাশ্মীরের একটা গ্রাম ধ্বংস হইয়া যাওয়ার কথা লিখতেসিলাম। এই জায়গাটা লেখার কথা আমি মাথাতেও আনতে পারতেসিলাম না। আমার ডেস্কে বইসা বইসা আমি ভাবতাম, এইসব বাক্য তো আমি লিখতে পারবো না। এইরকম বীভৎসতা নিয়া লেখার ট্রাই করসেন এমন অনেক লেখকই সোজাসুজি এই ব্যাপারগুলা সামলাইতে পারে না। আমি কখনো নাই যে স্রেফ একটা গল্প বলতে গিয়া আমি এতটা প্যারা খাবো–যে এতটা বিচ্ছিরি লাগবে জিনিসটা। আমি লিখতে চাই না এইসব, অন্যকিছু কি হইতে পারে না? আর তারপর মনে হয়, ওহ, আর কিছুই হওয়ার নাই, এইটাই হইতে হবে।

ইন্টারভিউয়ার: কাশ্মীর তো আপনার পরিবারের জায়গা।

রুশদি: হ, আমার পরিবার অরিজিনালি কাশ্মীরের, কিন্তু খুব রিসেন্ট সময়ের আগে আমি তা ঠিক পুরাপুরি ফিল করতে পারি নাই। মিডনাইটস চিল্ড্রেন শুরু হয় কাশমিরে, হারুন অ্যান্ড দ্য সি অফ স্টোরিজও কাশ্মীর নিয়াই একটা রূপকথার গল্প, কিন্তু আমার ফিকশনগুলাতে আমি কখনোই কাশ্মীররে মিন কইরা কিছু লিখি নাই। কাশ্মীরে যেবার আসল বিস্ফোরণটা হইলো, ১৯৮৯ সালে, সেবার আমার জীবনেও একটা বিশাল বিস্ফোরণ হইসিলো। ভালো কথা, আজকে কিন্তু আমার বিরুদ্ধে দেয়া ফতোয়ার বার্ষিকী। এইজন্য ভ্যালেন্টাইন্স ডে আমার প্রিয় দিন না, এই নিয়া আমার বউ খুব বিরক্ত। যাইহোক, শালিমার ছিল অনেকটা প্যারাডাইজ লস্টের একটা কাশ্মীরি ভার্শন লেখার কোশিশ। পার্থক্য হইলো, প্যারাডাইজ লস্ট ছিল একজন মানুষের পতনের গল্প, বেহেশতটা কিন্তু তখনও আছে, জাস্ট আমাদের সেইখান দিয়া বাইর কইরা দেয়া হইসে। কিন্তু শালিমার হচ্ছে বেহেশতটাই ভাইঙ্গা পড়ার গল্প। অনেকটা যেন আদম কতগুলা বোমা নিয়া বেহেশতে ফেরত গিয়া জায়গাটা উড়ায়া দিয়া আসছে।

পুরা দুনিয়ায় আমি কাশ্মীরের মত সুন্দর জায়গা আর একটাও দেখি নাই। এইটার একটা কারণ হইলো ছোট ছোট উপত্যকা ঘেরাও কইরা বিশাল বিশাল পাহাড়, তো দেখা যায় ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম ঘিরা দাঁড়ায়া আছে বিশাল হিমালয়, পুরাই অসাধারণ একটা জিনিস। আর হ, মানুষগুলাও প্রচণ্ড সুন্দর। কাশ্মীর বেশ সমৃদ্ধ জায়গা। এর জমি উর্বর, তো ফসলও হয় প্রচুর। ফসলগুলার রসও আলাদা, ভারতের বাকি অংশে এমনটা পাবেন না। কিন্তু এখন তো এইসব আর নাই, এখন শুধু আছে কষ্ট আর সংগ্রাম।

কাশ্মীরের প্রধান ব্যবসাই ছিল টুরিজম। বিদেশী টুরিস্ট না, ভারতের মধ্যকার টুরিস্টরাই। আপনি ইন্ডিয়ার সিনেমাগুলা দেখেন, যখনই তাদের একটু এক্সোটিক এরিয়া প্রয়োজন হইতো, তারা নাচের সিকুয়েন্স শুট করতে কাশ্মীরে চইলা যাইতো। কাশ্মীর ছিল ইন্ডিয়ার রূপকথার দেশ। ইন্ডিয়ানরা কাশ্মীরে যাইতো কারণ ওরকম গরম একটা দেশে সবাই ঠাণ্ডা অঞ্চলে যাইতে চায়। লোকজন তুষার দেইখা একদম মুগ্ধ হইয়া যাইতো। এমনকি এয়ারপোর্টে অনেক লোকরে দেখা যাইতো চিপাচাপার নোংরা, কোণায় সরায়ে রাখা তুষার দেইখাও এমনভাবে জটলা পাকায়ে ফেলতো যেন তারা হীরামানিকের খোঁজ পায়া গেসে। কেমন যেন একটা ম্যাজিকাল ব্যাপার ছিল জায়গাটার মধ্যে। এখন আর নাই এইসব, আর কালকে যদি একটা শান্তিচুক্তিও হইয়া যায়, তাতেও ওইসব আর ফেরত আসবে না। কারণ যেই জিনিসটা ভাইঙ্গা গুড়ায়ে দেয়া হইসে তা হইলো কাশ্মীরের নানানরকম কালচারের একসাথে শান্তিতে মিইশা থাকার ব্যাপারটা। যেইভাবে ওইখান দিয়া হিন্দুদের তাড়ায়ে দেয়া হইলো, তারপরে আবার মুসলমানদের মৌলবাদী তকমা দিয়া অত্যাচার করা হইলো, এরপরে আর সব জোড়া দেয়াটা সম্ভব না। আমি বইটাতে বলতে চাইতেসিলাম: এই গল্পটা স্রেফ পাঁচ-ছয় হাজার মাইল দূরের কিছু পাহাড়বাসী লোকের গল্প না। এইটা আমাদেরও গল্প।

ইন্টারভিউয়ার: আমরা সবাই এই গল্পটার অংশ?

রুশদি: আমি এই বইতে একটা জিনিস করার চেষ্টা করসি, তা হইলো গল্পটা পলিটিকাল না, পারসোনাল জায়গা থিকা লেখার ট্রাই করসি। আমি চাইসি লোকে যেন এইটা পইড়া কারেক্টারগুলার সাথে খুব কানেক্টেড ফিল করতে পারে। আর যদি কাজটা আমি ঠিকঠাক কইরা থাকতে পারি, তাইলে উপন্যাসটা একদম ঠোকাঠুকি-মার্কা মনে হবে না, এবং আপনার সবার জন্যই দরদ জাগবে। আমি চাইতেসিলাম কোনো মাইনর ক্যারেক্টার ছাড়া একটা বই লিখতে।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি কি বড় হওয়ার সময়টাতে কাশ্মীরি পলিটিক্সের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন?

রুশদি: আমার বয়স তখন বারোর বেশি হবে না, আমরা পুরা পরিবার সেবার কাশমিরে ঘুরতে গেসিলাম। ওইখানে ছোট্ট ছোট্ট ঘোড়ার পিঠে কইরা উঁচা পাহাড়ে উঠা যাইতো, বরফ-নদী দেখা যাইতো। আমরা সবাই গেসিলাম–আমার বোনেরা, আমার বাপ-মা, আর আমি–আর ওইখানে কিছু গ্রাম ছিল যেইখানে সরকারি রেস্টহাউজে রাতটা পার করা যাইতো। খুব ছোটখাটো ছিমছাম ঘর ছিল ওগুলা। আমরা আমাদের রেস্টহাউজে উঠার পর আম্মা টের পাইলো যেই ঘোড়াটার পিঠে আমাদের খাবার থাকার কথা ছিল তার পিঠে কিছুই নাই। ওদিকে তার সাথে তিনটা ডানপিটে না-খাওয়া বাচ্চা। তো সে ঘোড়াওয়ালারে পাঠাইলো গ্রামের কারো কাছে কোনো খাবার আছে কিনা খবর নিতে। আর সে ফেরত আইসা বললো, কোনো খাবার নাই, কিচ্ছু নাই। আম্মা বললো, মানে কী? কিচ্ছু নাই কেমনে হয়? অন্তত কিছু ডিম তো থাকবে, কিছু নাই মানে কী? আর সে বললো, না কিছুই নাই। তো আম্মা আইসা আমাদের বললো, আজকে রাতে কোনো খাবার নাই, কারো পেটে কিছু জুটবে না।

তার প্রায় এক ঘণ্টা পর দেখি প্রায় হাফ-ডজন লোকের একটা দল গ্রামের ওইদিক থিকা আসতেসে, সাথে খাবার নিয়া। গ্রামের মোড়ল আমাদের আইসা বললো, আপনাদের কাছে মাফ চাই, যখন আমরা ওই লোকেরে বললাম যে কোনো খাবার নাই, আমরা ভাবসিলাম আপনারা হিন্দু পরিবার। কিন্তু পরে যখন আমরা টের পাইলাম আপনারা মুসলমান, তখন খাবার না আইনা আর পারলাম না। আমরা কোনো টাকা নিব না, আর এই অভদ্রতার জন্য আবারও মাফ চাইতেসি।

আমি ভাবলাম, ওয়াও! এইটা কাশ্মীর, এর তো সহনশীলতার কালচার থাকার কথা ছিল। আমি প্রায়ই যাইতাম ওইখানে, আর যখনই তারা শুনতো আমার নাম সালমান, যা কিনা একটা মুসলমান নাম, তখনই তারা আমার সাথে এমনভাবে কথা বলা শুরু করতো, যা মনে করেন আমার নাম যদি রঘুবীর বা এই টাইপ কিছু হইতো তাইলে তারা অমনে বলতো না। তো তাদের সাথে আমি অনেক সময় ধইরা কথা বলতাম, তাদের জীবন নিয়া, তাদের রাগ নিয়া। কিন্তু যখনই আমি দিল্লি বা মুম্বাইতে ফেরত আসতাম আর এই কথাগুলা সবাইরে জানাইতাম, তখন এমনকি ওইখানের বুদ্ধিজীবীরাও ঠিক স্বীকার করতে চাইতো না তাদের মধ্যকার এই রাগটা কত গভীরে চইলা গেসে। লোকে আমারে বলতো, তোমার এমনে বলা উচিত না, তোমার কথা অনেক সাম্প্রদায়িক শোনাইতেসে। আমি নাকি একজন মুসলিম সাম্প্রদায়িক!

ইন্টারভিউয়ার: আপনার পক্ষে কি একটা অ্যাপলিটিকাল বই লেখা সম্ভব?

রুশদি: হ্যাঁ, এই নিয়া আমার অনেক আগ্রহ আছে। আর অনেক বিরক্তও লাগে যে তা এখনও লেইখা উঠতে পারি নাই। আমার মনে হয় আমাদের সময়ে আইসা পাবলিক লাইফ আর প্রাইভেট লাইফের ভিতরকার স্পেসটা গায়েব হইয়া গেসে। আগে এই জায়গাটাতে বিস্তর দূরত্ব ছিল। যেমন ধরেন, জেন অস্টেন তার উপন্যাসে নেপোলিয়নিক যুদ্ধের কথা বলতে ভুইলা যান। জেন অস্টেনের উপন্যাসে ব্রিটিশ আর্মির একমাত্র কাজ হইলো খুব কিউট সাইজা পার্টিতে যাওয়া। তার মানে এই না যে সে কিছু এড়ায়ে যাইতেসে। এর কারণ হইলো সে তার উপন্যাসের কারেক্টারগুলারে পাবলিক পরিবেশের রেফারেন্স না টাইনাও ঠিকঠাক ব্যাখ্যা করতে পারতেসিল। এইটা এখন আর সম্ভব না। আর তার একমাত্র কারণ এই না যে আমাদের সবার ঘরের কর্ণারে একটা টিভি পইড়া আছে। এর কারণ হইলো দুনিয়ার ঘটনাগুলা আমাদের ব্যক্তিগত ডেইলি জীবনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলতেসে। আমাদের কি চাকরি থাকবে নাকি না? আমাদের টাকার দাম কীরকম? এইসব জিনিসই আমাদের আওতার বাইরের ব্যাপার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। হেরাক্লিটাসের ‘ব্যক্তিত্বই নিয়তি’ ধারণা এইখানে আইসা আর টেকে না। কিছু কিছু সময় আপনার ব্যক্তিত্ব আপনার নিয়তি নির্ধারণ করে না। কখনো কখনো আচমকা একটা প্লেন একটা বিল্ডিংয়ে ঢুইকা পড়াই আপনার নিয়তি। এই বাইরের দুনিয়াটা আমার গল্পে আইসা পড়ে তার কারণ এই না যে আমি পলিটিক্স নিয়া লিখতে চাই, বরং এইজন্য যে আমি মানুষের কথা লিখতে চাই।

ইন্টারভিউয়ার: মুম্বাইর তো অনেকগুলা ভাষা। আপনার মাতৃভাষা কোনটা ছিল?

রুশদি: উর্দু। উর্দু আক্ষরিকভাবেই আমার মাতৃভাষা। এইটা আমার বাপের-ভাষাও। কিন্তু ভারতের উত্তরের দিকে লোকে আবার হিন্দিও বলতো। আসলে, আমরা যেই ভাষায় কথা বলতাম ওইটা উর্দুও ছিল না, হিন্দিও ছিল না, আবার দুইটাই ছিল। মানে, ভারতের উত্তরের দিকে লোকে যেই ভাষায় কথা বলে ওইটা কোনো আসল ভাষা না। এইটা হিন্দি আর উর্দুর একটা জবানি মিশাল, এইটার নাম হিন্দুস্তানি। এই ভাষায় কিছু লেখাও হয় না। এইটা হইলো বলিউড সিনেমার ভাষা। আর এই হিন্দুস্তানি আর ইংলিশ মিলাইয়া আমরা ঘরে কথা বলতাম। যখন আমি স্কুলে পড়তে ইংল্যান্ডে গেলাম, তখন বয়স আমার সাড়ে তেরোর মত, ওই সময়টাতে আমি দুইটা ভাষাই জানতাম। দুইটা ভাষাতেই সমান পাকা ছিলাম। এমনকি এখনও আমি হিন্দি আর উর্দুতে বলতে পারি সহজেই, কিন্তু তাতে লেখার কথা ভাবি না।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি কি ভালো ছাত্র ছিলেন?

রুশদি: নিজেরে যতটা মেধাবী ভাবতাম অতটা আমি ছিলাম না। এমনিতে স্কুলটা ভালোই ছিল, বোম্বের ক্যাথিড্রাল স্কুল আরকি। যখন ইংল্যান্ডে আসলাম তখনও মনে হয় নাই যে আমি পিছায়ে আছি, তবে ওইসময়কার রেজাল্ট কার্ড দেখলেই বুঝবেন, আমি খুবএকটা ভালো করতেসিলাম না। রাগবি খেলার আগেও আমার বাপে, বেশিরভাগ ইন্ডিয়ান বাপেদের মত, আমারে দিয়া নানান কাজ করাইতো। আমার মনে আছে আমার বিরাট বিরাট রচনা লেখা লাগতো, ঘরে নানান কাজ করা লাগতো, আর এগুলা সব আমি প্রচণ্ড হেইট করতাম। আমারে দিয়া সে শেক্সপিয়রের নানান লেখাপত্রের সারমর্ম লেখাইত। ইন্ডিয়ান ফ্যামিলিগুলাতে এই ব্যাপারগুলা সবচাইতে বড় সন্তান, বিশেষ কইরা যদি একমাত্র ছেলে হয়, তাইলে খুবই স্বাভাবিক। রাগবিতে ঢুকার পর, অনেকটা আমার বাজে সোশ্যাল লাইফের কারণেই আমি নানান কাজের মধ্যে ডুইবা গেসিলাম। যদিও তা ক্রিয়েটিভ রাইটিং ছিল না, ওইসময়ে আমার মেইন ইন্টারেস্টের বিষয় ছিল ইতিহাস। আমি অনেক থিসিস আর রচনার জন্য প্রাইজ পাইতাম। বই পড়ার প্রতি এত ভালোবাসা থাকার পরেও, ক্যান জানি আমার মাথায় কোনোদিনই স্কুলে বা ভার্সিটিতে সাহিত্য নিয়া পড়াশুনা করার কথা আসে নাই। গল্প-উপন্যাস পড়াটারে কখনোই তেমন কষ্টের কাজ মনে হয় নাই। আবার আমার বাপ মনে করতো ইতিহাস পড়াও তেমন কষ্টের কিছু না। সে চাইসিলো আমি কেম্ব্রিজে একটা কাজের কিছু নিয়া পড়াশুনা করবো—ইকোনমিক্স।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি কি তারে অমান্য করসিলেন?

রুশদি: আমাদের ডিরেক্টর অফ স্টাডিজ, ডক্টর জম ব্রডবেন্ট আমার জান বাঁচায়া দিসিলেন। আমি তার কাছে গিয়া বললাম, দেখেন, আমার বাপ বলসে ইতিহাস পইড়া কামের কাম কিছু হবে না, তো আমি যেন ইকোনমিক্স নিয়া ফেলি, নাইলে উনি আর আমার পড়ার খরচ চালাবে না। ব্রডবেন্ট বললো, এইটা আমার উপরে ছাইড়া দাও। তারপর উনি আমার বাপেরে তুমুল একখান চিঠি লিখলেন: “প্রিয় মিস্টার রুশদি, আপনার ছেলে আমাদের আপনার কথা জানাইলো। দুর্ভাগ্যক্রমে, আমাদের মনে হয় না আপনার ছেলে কেম্ব্রিজে ইকোনমিক্স পড়ার যোগ্যতা রাখে। তো, আপনি যদি চান সে ইতিহাস পড়া ছাইড়া দিক, তাইলে আমার পরামর্শ হইলো তারে কেম্ব্রিজ থেকে নিয়া যান যাতে তার জায়গায় অন্য কোনো যোগ্য ছাত্ররে আমরা সুযোগ দিতে পারি।” ওই সময়টা খুব অদ্ভূত ছিল, কারণ আমি কেম্ব্রিজে আসছিলাম একটা যুদ্ধের মাঝখানে–ইন্ডিয়া আর পাকিস্তান, ৬৫’র সেপ্টেম্বর। তখন কাউরে ফোনও করতে পারতেসিলাম না কারণ সব লাইন মিলিটারিরা কব্জা কইরা রাখসিলো। সব চিঠি সেন্সর করা হইতেসিলো এবং তা পৌঁছাইতে কয়েক সপ্তাহ লাইগা যাইতো, তারউপর তখন বম্বিং আর রেইডের কথা কানে আসতেসিলো। কিন্তু ব্রডবেন্টের চিঠিটার পর আমার বাপ ইকোনমিক্স নিয়া জীবনে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করে নাই। গ্র‍্যাজুয়েট করার পর যখন তারে বললাম আমি উপন্যাস লিখতে চাই উনি পুরা তব্দা খাইয়া গেসিলো। উনি প্রায় কাইন্দাই দিসিলো: আমি আমার বন্ধুদের কী বলবো? উনি আসলে যা বলতে চাইতেসিলো তা হইলো উনার সবকয়টা বন্ধুর ভোদাই পোলাপানগুলাও সিরিয়াস চাকরি কইরা বস্তা বস্তা টাকা কামাইতেসিলো, আর আমি—আমি একটা ফকির লেখক হইয়া জীবন কাটায়া দিব? এতে উনার ইজ্জত মাটিতে মিইশা যাইতো, কারণ উনার কাছে লেখালেখি ছিল সর্বোচ্চ একটা শখের বিষয়। যদিও কিসমতের জোরে উনি শেষমেষ দেইখা যাইতে পারসিলো যে লেখালেখি করার সিদ্ধান্তটা অতটাও বলদামি ছিল না।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে থাকসেন। আপনার কী মনে হয়, আপনি আসলে কোনখানের লোক?

রুশদি: আমার সবসময়ই দেশ বা জাতির চাইতে জায়গাগুলার প্রতি বেশি টান ছিল। আপনি যদি অফিসিয়ালি জিগান, তাইলে হয়তো এখনও আমি নিজের পরিচয় দিব ভারতীয় অরিজিনের ব্রিটিশ সিটিজেন হিসেবে। কিন্তু নিজেরে আমি মনে করি একজন নিউইয়র্কার এবং লন্ডনার। আমার কাছে মনে হয় পাসপোর্ট কিংবা জন্মস্থানের চেয়েও আমার আইডেন্টিটি হিসেবে এইগুলাই বেশি নিখুঁত।

ইন্টারভিউয়ার: আপনি কখনো মেমোয়ার লিখবেন না?

রুশদি: ফতোয়ার ঘটনাটার আগ পর্যন্ত আমার কখনো এমন মনেই হয় নাই যে আমার জীবন একটুও ইন্টেরেস্টিং কিছু। আমি উপন্যাস লিখতাম এবং আশা করতাম ওগুলা হয়তো ইন্টেরেস্টিং হবে। কিন্তু লেখকের জীবন নিয়া কার কী আসে যায়? তারপর এই খুব অস্বাভাবিক একটা ব্যাপারটা ঘটলো আমার সাথে, এবং আমি একটা ডাইরি রাখা শুরু করলাম, যাতে এখন কী কী ঘটতেসে তা ঠিকমত পরে মনে থাকে। যখন সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিক হইয়া গেল, তখন মনে হইল একটা স্মৃতিকথা লিখলে এইটার পাট চুকায়ে ফেলা যাবে। তাইলে আর কেউ আমারে এই ব্যাপারে কিছু জিগাইতে আসবে না। কিন্তু তারপরে আবার মনে হইল এইসব নিয়া রিসার্চ করতে লাগবে এক বছর, লিখতে লাগবে অন্তত আরো এক বছর, আর এই নিয়া কথা বলতে বলতে কাইটা যাবে আরো এক বছর। এতে কইরা যেই জিনিসটা হইতে আমি পালাইতে চাইতেসি সেইখানেই আমি নিজেরে আরো তিন-চার বছরের জন্য বন্দি কইরা ফেলব। এইটা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হইত না।

ইন্টারভিউয়ার: ফতোয়াটা কি লেখক হিসেবে আপনার কনফিডেন্সরে নাড়ায়ে দিসিল?

রুশদি: আমারে খুব বেসামাল কইরা ফেলসিল। তারপর, আমি খুব লম্বা একটা শ্বাস নিলাম, এবং আমার আর্টের প্রতি নিজেরে আবার ডেডিকেট করলাম। আর ভাবলাম, ধুর হইসে যা হওয়ার! কিন্তু একদম প্রথমে আমার মনে যা চলতেসিল তা হইসে: এই বই লিখতে আমার পাঁচ বছরের বেশি সময় লাগসে। আমার জীবনের পাঁচটা বছর, যা আমি দিসি এই বইটারে যতটা সম্ভব সেরা বানাইতে। আমি মনে করি লেখালেখির ক্ষেত্রে লেখকেরা একদমই স্বার্থপর না। তারা টাকাপয়সা কিংবা খ্যাতি নিয়া একদমই ভাবে না। তারা শুধু ভাবে যতটুকু সম্ভব সেরা একজন লেখক হইতে, একটা সাদা পাতারে যতটা সেরা বানানো যায়, যেই বাক্যই লিখুক সেইটা যেন শ্রেষ্ঠ বাক্য হয়, কারেক্টারগুলারে ইন্টেরেস্টিং, থিমগুলারে ঠিকমত ডেভেলাপড বানানো। ব্যাপারটা যেন ঠিকঠাক দাঁড়ায়, এইটাই তখন মাথায় ঘুরে। লেখা এতই কঠিন একটা প্রক্রিয়া এবং তা আপনার কাছে এতটাই দাবি করে যে বইয়ের প্রতি সবার প্রতিক্রিয়া, বেচাবিক্রি, এগুলা খুবএকটা গুরুত্ব পায় না। তো আমি আমার জীবনের পাঁচটা বছর এমনে কাটাইসি, এবং বিনিময়ে পাইসি পুরা দুনিয়াব্যাপী একজন ভিলেনে পরিণত হওয়া এবং আমার জানের উপর হুমকি। এমনকি আমার শরীরের উপর হামলার হুমকিটাও অত ভয়াবহ ছিল না, যতটা ছিল বুদ্ধিজীবীদের ঘৃণা, আমার বইটার অগভীর একটা জিনিস বইলা মনে করা, এমন ধারণা যে আমি খুব ফালতু একটা মানুষ এবং আমার এই বইটাও খুব ফালতু একটা কাজ হইসে। এবং দুর্ভাগ্যের কথা, এমন অনেক পশ্চিমা ট্র‍াভেলারও ছিল যাদের সেম জিনিসই মনে হইসে। তখন আমার মনে হইল, আমি এই বাল করতেসি কীসের জন্য? এর কোনো দামই নাই। জীবনের পাঁচটা বছর যতটা সম্ভব নিষ্ঠার সাথে একটা কাজের পিছনে লাইগা থাকা, এবং তার বদলে সুবিধাবাদী, ফটকা, আত্মকেন্দ্রিক তকমা পাওয়া। “সে এইসব ইচ্ছা কইরাই করসে।” অবশ্যই ইচ্ছা কইরা করসি! ইচ্ছা না থাকলে কেউ পাঁচ বছর ধইরা নিছক ভুল কইরা এমন একটা কাজ করতে পারে?

ইন্টারভিউয়ার: মানুষ যখন বলতেসিল আপনি এইসব ইচ্ছা কইরা করসেন, তারা বুঝাইতে চাইসে যে আপনি ইচ্ছা কইরাই মানুষরে উস্কাইতে চাইসেন, যে আপনি এই প্রতিক্রিয়ার কথা জাইনা-বুইঝাই করসেন এবং এইটাই চাইতেসিলেন। বইটা লেখার সময় কি আপনার মনে হইসিল ইসলামের ব্যাপারে আপনার এই সেকুলার অ্যাপ্রোচ এরকম উস্কানিমূলক হইতে পারে?

রুশদি: আমি এইটুকু অবশ্যই জানতাম আমার বই মৌলবাদী মোল্লাদের পছন্দ হবে না।

ইন্টারভিউয়ার: তাও, ফতোয়ার ব্যাপারটা আরো অনেক বিশাল।

রুশদি: হ্যাঁ, ওইটার কথা কারো পক্ষেই আগেভাগে বোঝা সম্ভব ছিল না। কেউ না। এমনটা এর আগে কারো সাথে হয় নাই। আমার মাথাতেও আসে নাই এমন ঘটতে পারে। আর জানেন, আমি অনেকদিন পরে জানতে পারসিলাম আমার এর আগের উপন্যাস, শেমের একটা আনঅফিশিয়াল তরজমা বের করসিল ইরানিরা, এবং বইটা সেই বছরের সেরা অনুদিত বইয়ের পুরষ্কারও পাইসিল। এর মানে হইল সেটানিক ভার্সেস বের হওয়ার আগে ইরানের বই বিক্রেতারাও আমারে পছন্দ করতো, কারণ মোল্লারা আমার বইগুলারে কবুল কইরা নিসিল। এবং এইজন্যই ইরানের এবং অন্যান্য জায়গার লোকেরা এত বেশি অবাক হইসিল।

ইন্টারভিউয়ার: কিন্তু ওইসময় অনেকেই মনে করতো সামনে যা যা হইতে পারে সেইসব জাইনা-বুইঝাই আপনি সব করসেন।

রুশদি: বইটা শেষ করার পর প্রথমদিকে কয়েকজনরে পড়তে দিসিলাম, তাদের মধ্যে এডওয়ার্ড সাইদ একজন। সে খেয়াল করসিল যে আমার বইতে এইসব ব্যাপারে অনেককিছু লেখা হইসে, আর সে আমারে জিগাইছিলো এই নিয়া আমি চিন্তিত কিনা। সেইসময় খুব সরল ছিলাম আমি, উত্তর দিলাম যে না, এই নিয়া প্যারা খাওয়ার কী আছে? সাড়ে পাঁচশ পাতার একটা ইংরেজি উপন্যাস। এইটা যে তাদের নজরে পড়বে সেইটাই মাথায় আসে নাই৷ আর তাছাড়া সত্যি বলতে, আমার কিছু আসতো-যাইতোও না।

সাহিত্য কেন মানুষরে উস্কাবে না? সবসময়ই তা এইটাই কইরা আসছে। আর কারো উপর হামলার হুমকি হইলে সে নিজেই ওই হামলার জন্য দায়ী এমন ধারণা আসলে দোষটা ভিক্টিমের ঘাড়েই ফালায়, এবং ১৯৮৯ সালে এই কাজটা করা বেশ সোজাই ছিল। কিন্তু রিসেন্টলি ইংল্যান্ডে, আল-কায়েদার বম্বিং ঘটনার পরে অনেক সাংবাদিকেরাই বলতেসেন এই মৌলবাদী আচরণের সূত্র পাওয়া গেসিল সেটানিক ভার্সেসের সময়েই, আর আমার সাথে তখন যা হইসিল তা নিয়া এখন সবাই আমার প্রতি বেশ সিম্প্যাথেটিক। এখন আর কেউ বলে না যে ওইটা আমারই দোষ ছিল বা আমি জাইনা-বুইঝা সব করসি, কারণ মানুষ এখন আরো ভালোমত বুঝতেসে ইসলামিক মৌলবাদের ব্যাপারগুলা।

[ইন্টারভিউ’র অংশ]

পুরা ইন্টারভিউটা পড়তে বইটা কিনতে পারেন রকমারিডটকম থিকা:

https://www.rokomari.com/book/255025/salman-rushdir-interview

Series Navigation<< উডি এলেনের ইন্টারভিউ: সমস্যা হইতেছে ক্রিয়েটিভ হওয়ায় কিছু গ্ল্যামার আছেএকটা নভেলে যদি লিটেরারি ট্রুথ থাকে ওইটার আর কিছু লাগে না – এলেনা ফেরান্তে >>
The following two tabs change content below.
Avatar photo

মাহীন হক

মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →