Main menu

কত সময় গেলে প্রিয়জনরে বিদায় বলার পার্ফেক্ট টাইম হয়? Featured

এই বছর ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো অব দ্যা ইয়ার হইসে যে ছবিটা সেই ছবিটা মেবি আমরা সবাই দেখসি। যারা দেখি নাই তাদের দেখার জন্য ছবিটা আমি ইনক্লুডো করে দিসি। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন হইলো এইযে ফটোগ্রাফটা ফটো অব দ্যা ইয়ার হইলো- তাতে আসলে কার কি আসে যায়?

না যুদ্ধ বন্ধ হইসে, না একটা বোমা পড়া থামসে, না মানুষের মরা কমসে, না কমসে ক্ষুধার্ত মানুষের পেটের খিদা। যেই ঘটনা গুলা এই ছবিটারে সম্ভব করসে, তার কোনোটাই কি এই ছবিটা বন্ধ করতে সক্ষম?

না, সক্ষম তো না। তাতো আমরা নিজের চোখেই দেখতেসি।

তাইলে আসলে কি লাভ? আবার করি প্রশ্নটা- কার কি আসে যায়? এর মধ্যে দিয়া আমি আরো একটা প্রশ্ন আসলে করতেসি… সেইটা হইলো, এই ডিজিটাল টাইমে যখন প্রতিদিন লাখ লাখ ইমেজ প্রোডিউস হইতেসে, তখন একজন ফটোগ্রাফারের ছবি তোলার মানেটা কি? কি অর্থ বহন করে একটা ছবি, আজকের এই সময়ে? ইমেজের ইফেক্ট কি আমাদের উপর কমতেসে?

ছবিটা আরো একবার দেখি আমরা… প্লাস আমি কি দেখতেসি তা আপনেদেরে আমি বাংলায় তরজমা করেও বলতেসি। যদিও আপনেরা নিজেরাই দেখতে পারতেসেন ইমেজ টা… তাইলে আমি ক্যান আবার ছবিটারে বাংলায় বলতেসি? বলতেসি কারণ আমি কি দেখতেসি তা আমি বলতে চাই। এমনতো প্রায়ই হয় যে আমি যা দেখি আপনে তা দ্যাখেন না… মানুষ শুধু তাই দ্যাখে যা সে দেখার জন্য প্রস্তুত থাকে, বা যা সে দেখবে বলে আশা করে। যা সে দেখতে প্রস্তুত থাকে না, যা তার আশার বাইরে থাকে- তা সে মিস করে যায়। একদম চোখের সামনে থাকলেও। তাই আমি কি দেখতেসি তা আমি আপনেদেরে বলতে চাই। প্লাস ইমেজ নিজেও তো একটা ভাষা… বাংলাও একটা ভাষা… দুইটাই আমি পড়ার চেষ্টা করি, এবং দুইটা দিয়াই আমি লেখারো চেষ্টা করি… এবং ভাষা যখন একটা থেকে আরেকটায় তরজমা হয় তখন অনেক কিছু চেঞ্জ হয়ে যায়, বাতিল হয় আবার অনেক কিছু এডো হয়। লস্ট ইন ট্রান্সলেশন বইলা একটা কথাও চালু আছে। তো সেই ব্যাপারটাই আমি আসলে করতে চাইতেসি। আমি কি বাতিল করলাম বা এড করলাম, বা কি হারায় গেলো আমার এক ভাষা থেইকা আরেক ভাষায় করা তরজমায়। তা আপনেরা আমারে জানান দিতে পারেন।

ছবিটা তুলসেন মোহাম্মেদ সালেম। ফিলিস্তিনি ফটোজার্নালিস্ট, এক দম গাজা তেই বসবাস ওনার। উনি রয়টার্সের হয়ে কাজ করেন সেই ২০০৩ সাল থেকে। মানে প্রায় ২১ বছর। এবং ওনার ছবি তোলার বিষয় মূলত ইজরাইলী অকুপেশন আর তার বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি রেজিস্টেন্সের ডকুমেন্টেশন।

ছবি মোহাম্মদ সালেম, গাজা, ফিলিস্তিন

সো, বাইরের কোনো তথ্য জানার আগে চলেন আমরা দেখি যে ছবিটায় আমরা কি দেখতে পাই। দেখি একজন মহিলা এবং তার কোলে একটা লাশ। মহিলাটার পরনে একটা বোরখা, যার রং আবার নীল। তার কোলে যে লাশ, এইটা আমরা বুঝতে পারি আমাদের ধর্মীয় এবং কালচারাল নলেজের কারণে। মুসলমানদের কেউ মারা গেলে তারে সাদা কাফনের কাপড়ে জড়ায় কবর দেওয়া হয়। তাই আমরা জানি যে তার কোলে একটা লাশ। কাফনের কাপড়ের জড়ানো লাশটার দৈর্ঘ্য প্রস্থ হিসাবে মনে হয় যে একটা ছোট বাচ্চা… যদিও বামন কেউও হইতে পারে। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে টাইলস, এবং মেঝেতেও টাইলস দেওয়া। লাশের পায়ের দিকটা মোড়ানো হয় নাই, যেমনে মাথার দিকটা মোড়ানো হইসে। তাড়াহুড়ায়? ওনার ডান পাশে আর আমাদের দিক থেকে বাঁ পাশে আরেকটা সাদা কি য্যানো দেখা যাইতেসে… সে যেভাবে আলো রিফ্লেক্ট করতেসে তাতে ওইটারে কাপড় মনে হয় না… মনে হয় প্লাস্টিকের সাদা কিছু একটা… কি জিনিস সেটা? বডি ব্যাগের অংশ?

ওনার মাথাট একটু ডিম ডিম হলুদ/কমলা রঙ্গের স্কার্ফে ঢাকা। যেই ভঙ্গিতে উনি বসে আছেন, মানুষ হিসাবে আমরা জানি যে, প্রিয় কেউ মারা গেলে আমরা এমন ভঙ্গিতে থাকি। উনি লিটারেলি হাটু ভেঙ্গে বসে আছেন- লাশটাকে কোলে নিয়া। ওনার বাঁ হাতটা লাশটার যেখানে মুখ থাকার কথা সেইখানে রাখা। অন্ধ মানুষেরা যেমনে মুখের উপর হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করে চেহারার আকার, অনেকটা তেমন। ডান হাতটা ঘাড়ের পাশ দিয়া জড়ানো। প্রিয় মানুষদেরকে আমরা এমনে জড়ায় ধরে রাখি। ওনার মুখ দেখা যায় না। উনি মুখটা নামায় রাখসেন হাতের উপর, লাশটার বুক বরাবর, এবং কানটা মুখের কাছে ধরা। য্যানোবা খুব মনযোগ দিয়ে কিছু শুনার চেষ্টা করতেসেন। এবং হয়তোবা ঘ্রাণ নেওয়ার চেষ্টা করতেসেন। শেষবারের মত।

ওনার মাথায় থাকা স্কার্ফ টা ওনার মুখের জায়গাটা দখল করে আছে। আর তাই ওনার চেহারাটা দেখা যায় না। আমরা জানি না উনি কে। ওনার চেহারা ক্যামন। ওনার সেই টাইমে কি মনে হইসে, কি অনুভূতি ফুইটা ছিল ওনার চেহারায়। এবং একটা বেশ অবাক ব্যাপার হইলো, আমার ওনার চেহারাটা দেখতে ইচ্ছাও করে না। মনে হয় উনি এভাবেই ঠিক আছেন। ক্যান এমন মনে হইলো- আমি কি তবে ভয় পাইতেসি… ভয় পাইতেসি যে ওনার চেহারায় যা দেখবো তা আসলে আমি নিতে পারবো কিনা…? হয়তো আমি চাইনা আমার মনে তার সেই চেহারাটার ছাপ থাকুক। কিন্তু আমার মনে হয়, ওনার চেহারা দেখা গেলে হয়তো মানুষের ইমোশনাল কানেকশন আরো বেশি হইতো।

আবার একই সাথে এটাও সত্য যে ওনার এই চেহারা দেখা না যাওয়ার কারণে ফিলিস্তিনের আর হাজারো মা-খালা যারা তাদের সন্তান, প্রিয় জন হারাইসেন, উনি খুব দ্রুত তাগো প্রতিনিধি হইতে পারতেসেন। এই ছবিটা তো তাগো প্রতিনিধিত্বই করে।

মোহাম্মদ সালেম ছবিটা তুলসেন, আগেই বলসি সেটা। উনি হসপিটালে ছিলেন ঐ টাইমে কারণ তার ঠিক আগের দিন ওনার নিজের একটা বাচ্চা জন্মাইসে। এই গল্পটা খুব ইম্পর্টেন্ট লাগসে আমার কাছে। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর ওয়েবসাইটেই এই তথ্যটা দেয়া আছে… এইটা একটা পোয়েটিক বিস্বাদ তৈরি করে। জন্ম-মরণের সাইকেলে ছবিটা পইড়া যায়। ছবিটার আরো তথ্য হইলো ৩৬ বছর বয়সী ইনাস আবু মাম্মার তার ভাগনিরে জড়ায় ধইরা রাখসে, যে এখন অলরেডি লাশ হয়ে গেসে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারে কবর দেয়া হবে। আর কোনোদিন তাদের দেখা হবে না। যে লাশ হয়ে গেসে তার নাম ছিল স্যালি বা শেলি। তার বয়স মাত্র ৫ বছর, এবং সে তার মা, এবং বোনের সাথে একসাথে মারা গেসে।

মারা গেসে শব্দ দুইটা আসলে, ঠিক ইউজ করি নাই আমি। মনে হয় য্যানো অটো মারা গেসে তারা… আসলে তারা মারা গেসে ইজরায়েলী মিসাইলের আঘাতে। ইজরায়েলের মিসাইল যখন তাদের বাড়িতে আইসা পড়সে তখন তার আঘাতে তারা মারা গেসে। অর্থ্যাত ইজরায়েল তাদেরকে মারসে। যেখানেই মানুষ মরুক, ইজরাইল হোক আর ফিলিস্তিন, আমেরিকা হোক আর বাংলাদেশ, তার আশেপাশের মানুষেরা তার জন্য কান্দে, কষ্ট পায়। এইটা হিউম্যান কন্ডিশনের অংশ। তার ভাগ্নিরা মারা গেসে, তার বোন মারা গেসে… সে কষ্ট পাইতেসে। ভাগ্নির বুকে মুখ ঢাইকা উনি যেভাবে বইসা আছেন সেইটা থেইকা আমরা দর্শকরা এইটা বুঝতে পারি।

ওনার এই ছবিটা দেইখা আমার ডরোথিয়া ল্যাং এর বিখ্যাত ছবি মাইগ্রেন্ট মাদারের কথা মনে পড়ে।

মাইগ্রেন্ট মাদার বাই ডরোথিয়া ল্যাং, ১৯৩৬

এই ছবিতেও দেখা যায় যে ওনার কোলে একটা ছোট বাচ্চা আছে, ঘুমাইতেসে। পাশে হেলান দেয়া দুইটা বাচ্চার চেহারা দেখা যায় না। কিন্তু ওদের দাড়ানোর ভঙ্গি আর ওদের মায়ের চেহারায় ফুটে উঠা এক্সপ্রেশনে বুঝা যায় যে ওদের কপালে খারাপ ঘটনাই ঘটতেসে। সামনে কি আছে তা নিয়া ছবিতে থাকা মা, যার নাম ফ্লোরেন্স থম্পসন; উনি খুব চিন্তিত। এই ছবিটা নিয়া পরে কোনো এক সময় আরো আলাপ করবো কিন্তু আজকে এইখানে ছবিটারে আনার একটা কারণ আছে-

১৯৩৬ সালে ছবিটা তোলা হয়। প্রায় ৯০ বছর আগে… এই মায়ের চেহারা আমেরিকার চল্লিশের দশকের গ্রেট ডিপ্রেশনের চেহারা হয়ে যায়। তিন বাচ্চা সহ ওনার মুখের এক্সপ্রেশনে বুঝা যায় যে উনি ভবিষ্যত নিয়া খুবই টেনসড। কি হইতে যাইতেসে সামনে, কি আছে কপালে, তার কোনো নিশ্চয়তা নাই। সেই সময়ের পুরা এমবডিমেন্ট হয়্যা উঠেন উনি। সোসালি এবং পলিটিক্যালি ফটোগ্রাফ এমনি পাওয়ার ফুল ছিল যে লোকে মাইগ্রেন্ট মাদারের ভিতর দিয়া আমেরিকার বিরাট অর্থনৈতিক কলাপ্সের বিষয়টারে পোট্রে করতে পারে। একটা আইকনে পরিণত হন ওনারা… ছবিটা।

আমাদের আজকের পুরষ্কার পাওয়া ছবি টা কি তেমন কিছু হইতে পারবে?

আরেকটা ইমেজের কথাও মনে পড়ে যাইতেসে আমার। ১৯৭২ সালে এপির ফটোগ্রাফার ‘নিক উটস’ এর তোলা সেই বিখ্যাত “নাপাম গার্ল” ছবিটা। যেখানে দেখা যাইতেসে যে আমেরিকা ভিয়েতনামের এক গ্রামে নাপাম বোমা ফালাইসে এবং মানুষের গা পুড়ে যাইতেসে। একটা ৯ বছরের পিচ্চি মেয়ে যার গা পুইড়া গেসে। তাই সে গায় কোনো কাপড় রাখতে পারে নাই, জ্বইলা যাইতেসে তার পুরা হাত পা পিঠ। মেয়েটা পরে বাঁচছে, ওনার নাম “পান থি কিম পুক”। তো কিম পুক বলতেসিলেন একটা ইন্টারভিউতে যে, “কপাল ভালো আমার পায়ের পাতা পুড়ে নাই, আমি দৌড়ায় পালাইতে পারসিলাম সে জন্য।”

ছবিটা যে কোনো মানুষরে এক ঝলকে একটা বাড়ি মারতে বাধ্য। একটা শক তৈরি করে। ঐ মেয়েটার ঠিক সামনে একটা ছেলেও আছে, যার চেহারার এক্সপ্রেশনো খুব লাউড। ওদের পিছনে কয়েকজন সৈন্যরে দাড়ায় থাকতে দেখা যায়। সৈন্যরা যেমন হয় আরকি… রিয়েল টাইমে তাদের কাছে ‌ইমোশন ধরা পড়ে না, দে আর প্রি অকুপাইড উইথ অর্ডার। বাচ্চাদের সাথে বড় কেউ নাই… ওরা য্যানোবা এতিম। পিছে ধুয়া দেখা যাইতেসে… বোমের আফটার ম্যাথ।

নাপাম গার্ল বাই নিক উট্স, ১৯৭২

এই একটা ছবি আমেরিকা সহ পুরা দুনিয়ায় আলোড়ন তুইলা ফেলে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় গুলার ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছড়ায় পড়ে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের আগুন। এই দুইটা ছবিরে আমি সামনে আনলাম কারণ এই ছবি গুলা কনটেন্ট আর কনটেক্সটের জায়গা থেইকা আমাদের এইবারের পুরষ্কার পাওয়া ছবি টার সাথে মিলে। কন্টেন্টে মাইগ্রেন্ট মাদার আর কনটেক্সটে নাপাম গার্ল। কিন্তু হিস্ট্রিতে ঐ দুইটা ছবি যেভাবে রোল প্লে করসে, আমাদের মোহাম্মদ সালেমের ছবিটা কি সেই ভাবে রোল প্লে করতে পারবে।

আমার অবজার্ভেশন বলে যে পারবেনা…

তার কারণ হইলো-

নাপাম গার্ল বা মাইগ্রেন্ট মাদার যেই দুনিয়ার ছবি, যে টাইমের ছবি আমরা এখন আর সেই টাইমে বসবাস করি না। যদিও দুনিয়ার ক্যারেক্টার বদলায় নাই(মানে যুদ্ধ এখনো লাভজনক ব্যাবসা), কিন্তু টাইমের ক্যারেক্টার বদলায় গেসে।

সেই সময় ফটোগ্রাফ এক রকমের অথেন্টিসিটির নিশ্চয়তা দিত। ছবি আছে মানে প্রমাণ আছে। কিন্তু আজকে ফটোগ্রাফের উপ্রে সেই প্রমাণের দায়িত্ব কেউ আরোপ করবে না। প্রচুর ফটোগ্রাফ এখন পাওয়া যায় যা কম্পিউটারে তৈরি করা হয়। এ আই তার এলগরিদম ইউজ কইরা তা করে। এমন প্রচুর মানুষের পোর্ট্রেট আছে যাদের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নাই। মনে হইতেসে পোস্ট মডার্ণ টাইমের ভুত ফটোগ্রাফের উপ্রে সবচে বেশি আসর করসে। পোস্ট ট্রুথ টাইমে এখন ফটোগ্রাফের আগের সেই সোসাল পলিটিক্যাল পাওয়ার নাই।

এর আরেকটা কারণ হইলো ফটোগ্রাফের ওভার স্যাচুরেশন। ডেমোক্রেটাইজেশনের কারণে ফটোগ্রাফের সংখ্যা প্রচুর বাইড়া যাওয়ার ফলে মানুষের তার প্রতি রিয়েকশন কমে গেসে… আমি এর নাম দিতে চাই ফটোগ্রাফিক ডাইবিটাইজেশন। শরীলের ডায়বেটিস হইলে যেমন কোষ গুলা ইনসুলিন ইনসেন্সেটিভি হয়ে যায়। নিজেরে বাঁচাইতে গিয়া সে চিনিরে আর ঢুকতে দেয় না কোষের ভিত্রে, ফটোগ্রাফের বেলায় ঘটনাটা তেমনি।

ভিয়েতনাম ওয়াররে বলা হয় ফার্স্ট টেলিভাইজড ওয়ার। ড্রইং রুমে এর আগে কখনো যুদ্ধ ঐভাবে ঢুকতে পারে নাই। যুদ্ধ ছিল বাইরের বিশাল দুনিয়ার কোনো জায়গায় ঘটা ব্যাপার। কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধে বাইরের দুনিয়া টিভির ভিতর দিয়া সকালের নাস্তার পাশে আইসা বসতে পারসে। সেই যে বসলো, এখনো সে আর বাইর হইলো না… বরং বইতে দিলে যেমন শুইতে চায়, তেমনি যুদ্ধ এখন আমাগো লগে বিছানায় গিয়াও উঠসে। আমাগো হাতের মোবাইল আর ডাটার দুনিয়ায় যুদ্ধ এখন কোলের ভিতর বসা। প্রচুর ভিডিও, প্রচুর ইমেজ, প্রচুর ডেটা, প্রচুর প্রোপাগান্ডা, প্রচুর ক্রুয়েলটি- মানুষের তো ডেটা প্রসেস করার একটা লিমিট আছে। তার প্রতিদিনকার লাইফের পাশাপাশি এই যুদ্ধ গুলা সে চলতে দেখতেসে। বছরের পর বছর, দিনের পর দিন। এবং তার সেন্সেটিভিটি কমতেসে- দিনের পর দিন।

আইকনিক “নাপাম গার্ল” প্রকাশ হওয়ার পর আমেরিকার প্রশাসনেও লাড়া পইড়া যায়। নিক্সন সাব কন যে এইগুলা ফেইক… নাপাম বোমায় কেউ বাইচা থাকে না, এই মেয়ে অন্য কোনো ভাবে পুড়সে। মজার ব্যাপার উনি কিন্তু অস্বীকার করেন নাই যে আমেরিকা নাপাম বোমা ফালাইসে। উনি খালি বলসেন নাপাম বোমা পড়লে কেউ বাঁচে না। আজকের টাইম হইলে হয়তো তারা অস্বীকার করতো, গাইগুই করতো, তদন্ত করার নামে তারপর কম্বলের তলে ঘটনাটা ধামাচাপা দেয়ার ব্যাবস্থা করতো।

এখন দিন বদলাইসে। ফার্স্ট টেলিভাইজড ওয়ার থেইকা আমরা ফার্স্ট ব্রডকাস্টেড জেনোসাইডে আইসা পৌছাইসি… প্রকাশ্য দিনের আলোয় জেনোসাইড হইতেসে এখন। হসপিটালে বোমা মারার মত আইন লঙ্ঘন এখন সামনে আমরা আরো দেখবো।

কিন্তু মানুষ এখন সেন্সেটিভিটি কমায় দিসে, চামড়া একটু মোটা করসে, ঐযে শরীলের কোষ যেমন করে, মানুষো নিজেরে বাঁচানোর লাইগা তাই করতেসে। আমরা ফার্স্ট টেলিভাইজড ওয়ারের পরে জেনোসাইডে আইসা পৌছাইসি…

মোহাম্মদ সালেমের এই রিদয় ভাঙ্গা ছবিটা আসলে সেই আইকনিক রোল প্লে করতে পারবে না, “নাপাম গার্ল” যেটা পারসে। যদিও কোনো দিক থেকেই ঘটনাটা কম ট্র্যাজিক না। কিন্তু মানুষ দেখতে দেখতে অভ্যাস্ত হয়ে গেসে।

তাইলে আসলে এই ছবি গুলার দরকার কি? তোলারি বা দরকার কি? মাতামাতি করারি বা দরকার কি?

এগুলারে ইম্পর্টেন্ট প্রশ্ন মনে হয় আমার।

তাই আমি একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি। একটা ইমেজ বা ফটোগ্রাফরে নানান ভাবে ইউজ করা যায়। এক্টিভিজম একটা পথ। মানুষ আর আগের মতো ইমেজে রিয়েক্ট করে না, তাই সাউন্ড সহ ভিডিও আসছে। যত মানুষের সেন্সেটিভিটি কমবে তত মানুষের আরো ইনভেসিভ টুল লাগবো। আগে শুধু সাংবাদিক দের ভিডিও হইলেই হইতো, কিন্তু এখন ফার্স্ট পার্সন পিওভি থেইকা ভিডিও বেশি রেজোনেন্ট হয়। আপনের পুরা ফ্যামেলি এক বোমে মাটির সাথে মিশা গেসে, আর আমি আমার রেফারেন্স পয়েন্ট থেইকা আপনের সেই আহাজারির ফার্স্ট হ্যান্ড ভিডিও দেইখা দুঃখ পামু বা ভাবমু ঠিকই হইসে, ওরা সব টেরোরিস্ট। কিন্তু এক্টিভিজমের জন্য ইমেজের ব্যাবহারের বাইরেও ইমেজের আরেকটা ব্যাবহার আছে, সেটা হইলো মেমোরি ক্রিয়েশন এবং প্রিজারভেশন। ইমেজ “সত্য” না বল্লেও তা মেমোরি তৈয়ার করতে পারে, এবং ধইরা রাখতে পারে। যা দিয়া আমরা সত্যের কাছে পৌছাইতে পারবো কোনো একদিন।

আমার মনে হয় এই জাগাতেই মোহাম্মদ সালেমের এই ইমেজটা দরকারি হয়্যা উঠে। দরকারি হয়্যা উঠে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর এরে রেকগনাইজ করা। ইমেজের কাজ আসলে সত্য বলা না, গল্প বলা। ফটোগ্রাফ এক সময় সত্য বলার দায়িত্ব পালন করসে, কিন্তু সেইটা তার মেইন দায়িত্ব না আসলে। তার মেইন দায়িত্ব হইলো আমরা য্যানো অবিচার অনাচার গুলারে ভুইলা না যাই সেই জন্য কালেকটিভ মেমোরি তৈরি করা। এবং তারে আচারের মত প্রিজারভ করা।

আজ থেইকা পঞ্চাশ বছর – একশ বছর বা আরো বড় টাইমলাইনে যেমন- পাঁচশো- হাজার বছর পরো যখন কেউ আজকের জেনোসাইড নিয়া কথা বলবে ইমেজগুলা তখন গল্পের রেফারেন্স পয়েন্ট হিসাবে কাজ করতে পারবে। এইখানেই ইমেজটার শক্তি। এই জন্যই ফটোগুলা তোলা দরকার। কথা কওয়া দরকার। একদিন সব থাইমা গেলে যখন রিফ্লেকশনের টাইম আসবে, তখন এদের ইউজ করা যাবে গল্পের দানা হিসাবে। একটু একটু কইরা আশ্রয় নিবে মানুষেরা সেই সব গল্পে।

সেই জাগা থেইকা আরেকটা ইমেজ, যেটা আসলে ফটোগ্রাফ না একটা মোজাইক, সেটা নিয়া ছোট কইরা একটা আলাপ করি। একটা ইন্টারেস্টিং ডিটেইল চোখে পড়সে আমার। জেরুজালেমে সিওন বা জায়ন পাহাড়ের Church of the Benedictine Abbey of the Dormition গীর্জার ডান পাশের অল্টারে বিবি মরিয়ম, বা মাতা মেরি বা ম্যাডোনার একটা মোজাইক, যেখানে তিনি ইসা নবি বা যিশু কে নিয়া বইসা আছেন এবং তাকে ঘিরা আরো অনেকে দাড়ায় আছে। বলা হয় এই জাগাতেই ভার্জিন মেরি মারা গেসেন। তো, এই মোজাইক টায় যা দেখা যাইতেসে তা আসলেই ঘটসে কিনা তাতো আমরা জানি না, কিন্তু এই ইমেজটা এমন একটা গল্পের প্রতিনিধিত্ব করে যেখানে অনেক মানুষ আশ্রয় পায়। এই ইমেজটা অনেক অত্যাচার, এবং ট্রমার এক ধরনের এন্টিডট, কাউন্টার। একটু খেয়াল করলেই আমরা দেখবো যে, এখানে ভার্জিন মেরির পরনে যে কাপড় টা আছে তার রং নীল। মোহাম্মদ সালেমের ছবিতে আমরা যারে দেখি তার ভাগ্নীর লাশ কোলে নিয়ে বসে আছেন উনার বোরখাটার রংও নীল।

এইযে প্রায় ১২০০ বছর আগে বানানো মা মেরির একটা ইমেজের সাথে আজকে প্রায় সেই একই জায়গায় থাকা ইনাস আবু মাম্মারের কাপড়ের রং মিলে যায়, কোলের বাচ্চারে বাঁচানোর স্ট্রাগল এবং শেষ পর্যন্ত বাঁচাইতে না পারার বাস্তবতা… এইটা কি কাকতালীয়?

হয়তো দুনিয়ায় পুরা পুরি অত্যাচার আমরা থামাইতে পারবো না কোনোদিন… হয়তো মানুষের ফিতরতই এমন। হয়তোবা কেবল বেহেস্তেই সেটা পসিবল। কিন্তু এইযে একটা নীল আরেকটা অবিচারের নীলের কাছে আমাদের নিয়া আসলো- আমার কাছে এইখানেই ইমেজের শক্তির জায়গা। হইতে পারে তা কাকতালীয়, কিন্তু সিলসিলা এইভাবেই তৈরি হয়। আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের যে সিলসিলা, হিস্ট্রি, তা এমনেই বহমান থাকে। কোলে সাদা কাপড় পরা যিশু বা স্যালির লাশ- আমাদের দেখায় দিবে কতখানি বাকি আছে এখনো রাস্তা। ফটোগ্রাফ যতদিন গল্প বইলা যাইতে পারবে, যতই ভারি হোক আমাদের চামড়া… অন্যের দুঃখ ঠিকই তা ভেদ কইরা অন্তরে পৌছায় যাবে। ভুইলা যাওয়ার সুযোগ নাই কোনো…

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

তু.সা.র. তুষার

দুনিয়া দেখিটেখি, ছবিও তুলি, লিখিও কবিতায়, গল্পও তো...

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →