Main menu

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভ্যুত্থানের রাত

আমি সূর্যসেন হলের যে রুমে থাকি সেটা পলিটিকাল রুম। ফলে ছাত্রলীগের প্রোগ্রামে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসে।

১ তারিখ থেকে আন্দোলন শুরু হবার পর থেকে প্রতিদিন ছাত্রলীগও আন্দোলনকারীদের একই সময়ে মধুতে প্রোগ্রাম ডাকে। উদ্দেশ্য হলো যারা আন্দোলনে যেতে চায় তাদের ওখানে নিয়ে আটকে রাখা, যাতে আন্দোলনে ছেলেপেলে কম হয়। কিন্তু ছেলেদের আটকে রাখা যেতো না।

প্রোগ্রামের ঘন্টাখানেক আগেই ছেলেরা হল থেকে বের হয়ে যায়। আমরা যারা সিনিয়র তাদের ডাকে না ভাইটাল প্রোগ্রাম ছাড়া। কিন্তু ১৩ তারিখ থেকে দেখলাম আমাদেরও ডাকতে আসে। আমার রুমে ২ বার ডেকে গেলো। হুমকি দিলো রুম তালা মেরে দেবে। তাও আমি না গিয়ে আন্দোলনে চলে গেলাম। যথারীতি ১৪ই জুলাই সকালেও ডাকতে আসছে রুমে। আমি গেলাম না। আমার রুম্মেট বন্ধু ফয়সালের সাথে মিছিলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে গেলাম। সেদিন রাষ্ট্রপতির কাছে মিছিল নিয়ে স্মারকলিপি দিতে যাওয়ার প্রোগ্রাম ছিল। ফয়সাল DU Insider পেইজটা চালায়; সেটার জন্য ভিডিও করতে যায় সে। সেদিন আমাদের মিছিল সচিবালয়ের সামনে আটকে দেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা গুলিস্তানে অবস্থান নেয় এবং সমন্বয়করা কয়েকজন মিলে বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দিতে যায়। এরমধ্যেই সবাই পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বাইতুল মোকাররম পার হয়ে যায়। এরপর আর যেতে পারেনি। সেদিনের মতো শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল শেষ হয়।

রাতে ইউরো আর সকালে কোপার ফাইনাল। পুরান ঢাকা থেকে শান্ত টিএসসিতে খেলা দেখতে আসবে বলেছে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে রেডি হচ্ছি, একবারে বাইরে খেয়ে সারারাত বাইরে থাকবো, খেলা দেখবো, আড্ডা দেবো। ফেসবুকে ঢুকে দেখি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, চাকরি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের না দিয়ে কি রাজাকারের সন্তানদের দেবো? মনে মনে ভাবছি, খাইছে! আজকে একটা ফাড়াফাড়ি হবে।

সাড়ে ৯ টার দিকে হলের নিচে কে জানি হঠাৎ চিৎকার করে উঠছে, তুমি কে, আমি কে! মুহুর্তেই একাত্তর হল আর সূর্যসেন হলের সমস্ত জানালা কেঁপে উঠছে। সবাই চিৎকার করে উঠছে। তুমি কে, আমি কে, রাজাকার রাজাকার। আঁচ করলাম আজকে কিছু একটা হবে।

মুহুর্তেই ছাত্রলীগ প্রোগ্রাম ডাকলো, সবাই এক্ষুনি গেস্টরুমে আসো।

আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলাম হল থেকে, দেরি করলেই আর বের হতে পারব না। আটকে দেবে। হল গেটে বের হয়ে দেখি মহসিন হল থেকে একটা বিরাট মিছিল ধেয়ে আসছে। যে যেই অবস্থায় আছে ওই অবস্থায় বের হয়ে আসছে। কেউ লুঙ্গি পড়া কেউ ট্রাউজার পড়া। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত। মিছিলের সাথে গেলাম হল পাড়ার দিকে। আমি রাতে খাই নাই। তাড়াতাড়ি জিয়া হলে ঢুকে পরোটা-ডাল খাইলাম। ততোক্ষণে হল পাড়ার সমস্ত ছেলেপেলে একাত্তর হলের সামনে চলে এসেছে। সেদিন সম্ভবত হলে আর কোন পোলাপান বাকি ছিলো না। সূর্যসেন হল থেকে ছেলেদের বের হতে দিচ্ছে না, এই খবর শুনে মেয়েদের হল থেকে মেয়েরা তালা ভেঙে থালা চামচ নিয়ে বেরিয়ে গেছে। মেয়েরা মিছিল নিয়ে সূর্যসেন হলের সামনে হাজির। আমরাও হল পাড়া থেকে মিছিল নিয়ে সূর্যসেন হলের সামনে গিয়ে সূর্যসেন হলের সবাইকে বের করে নিয়ে আসলাম। এরপর মহসিন হল, এফ রহমান হল, সার্জেন্ট জহুরুল হক হল চক্কর দিয়ে সবাই ভিসি চত্তরে। সম্ভবত সেদিন হলে কোন ছেলেপেলে বাকি ছিল না ছাত্রলীগ ছাড়া। সবাই রাস্তায় নেমে এসেছে। বিশ হাজারের কাছাকাছি হবে। এতো উত্তাপ, এতো উত্তেজনা ক্যাম্পাস লাইফে আমরা আর দেখি নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণ-অভ্যুত্থান হলো। স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে গেলো গোটা ক্যাম্পাস।

‘চাইলাম অধিকার
হয়ে গেলাম রাজাকার’

‘তুমি কে, আমি কে
রাজকার রাজাকার’

‘কে বলেছে, কে বলেছে
স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’

দেড়টার দিকে টিএসসি থেকে সবাই ধীরে ধীরে হলে ফিরে গেলে, ছাত্রলীগ বাইরের লোকজন এনে রাজু ভাস্কর্যের সামনে সমাবেশ করলো।

আমি খালিদ দের সাথে এস এম হলে চলে গেলাম খেলা দেখব বলে। টিএসসিতে সেদিন আর কোন খেলা চলে নাই। এস এম হলে খেলা ইউরোর ফাইনাল দেখে হলে চলে আসি। ঘুম আর আটকানো যাচ্ছে না। হলে ফিরে মোবাইলে আর্জেন্টিনার খেলা ছেড়ে শুলাম। খেলা দেখা অবস্থায় কখন ঘুমিয়ে গেছি জানি না। এক্সট্রা টাইম শুরু হবার একটু পর ঘুম ভাঙলো। খেলা দেখা শেষ করে আবার ঘুম দিলাম।

বি:দ্র: এই ভিডিওটা আমার মোবাইলে করা। মহসিন হল থেকে বের হওয়া প্রথম মিছিল। এই মিছিল দেখেই আমি পোস্ট দিয়েছিলাম, আজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

এবং এই রাতটিই ছিলো স্বৈরাচারের পতনের শুরুর রাত।

লেখার সময়ঃ ৩২ জুলাই ২০২৪।

The following two tabs change content below.
Avatar photo

হামিদুল ইসলাম আরফাত

জন্ম ২০০০ সালে, কক্সবাজারের মহেশখালীতে। বর্তমানে পড়াশোনা করতেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
Avatar photo

Latest posts by হামিদুল ইসলাম আরফাত (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →