বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ – অমর্ত্য সেন (পার্ট ২) Featured
বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ – অমর্ত্য সেন (পার্ট ১)
…
বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ
বন্যা ও দুর্ভিক্ষ
প্রথমে বন্যা; তারপর দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ক্যাপসুল কাহিনীটা মোটামুটি এমন। গিলবার্ট এটিয়েন ১৯৭৪ সালের বন্যার কথা বর্ণনা করছেন এইভাবে:
উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলিতে ১৯৭৪ সালের বন্যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে। নরমাল বছরগুলাতে, বানের সময় ব্রহ্মপুত্র পশ্চিম তীররে সর্বোচ্চ ৩০-৬০ মিটার পর্যন্ত গ্রাস করে। ১৯৭৪ সালে, ১০০ কি.মি. পর্যন্ত, ৩০০ পর্যন্ত প্রশস্ত পানির তোড় এমন ভূমি গ্রাস করে যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ৮০০ জন। ২৪,০০০ মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাছাড়া পলিমাটিজাত হওয়ায়, কিছু জায়গায় জমি খুব উর্বর হইলেও, অন্যত্র বালুর পরিমাণ এত বেশি যে তা অনেকটা নিষ্ফলা…. জুনের শেষ দিকে ভয়াবহ কয়েকটা বন্যা হয়। এবং আউশের (জুলাই-আগস্টে চাষ করা ধান) ফসলের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরও পনের দিন পরে আউশের ফসল তোলার সময়টাতে ব্রহ্মপুত্র আবার বিপদসীমা অতিক্রম করে। আরও ১৫ দিন পর, নদীর পানির মাত্রা আবার বাড়ে এবং ফলে আমনের (জুলাই-সেপ্টেম্বরে চাষ ও নভেম্বর জানুয়ারিতে তোলা ধান) বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপরে, আগস্টের মাঝামাঝি, বন্যা বছরের সবচাইতে ভয়াবহ অবস্থায় পৌছায়। ফলে সদ্যবোনা আমনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এইটাই শেষ না। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ব্রহ্মপুত্রের পানি আবারও বিপদসীমার উপ্রে দিয়া যায়, আর আগের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই এমন ধানক্ষেতও ভাসায়ে নিয়া যায়। i
বন্যার সময় এবং বন্যার ঠিক পরেই চালের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। টেবিল ৯.১ -এ এইটা দেখানো হইছে। সবচাইতে বেশি আক্রান্ত জেলাগুলির কয়েকটাতে, জুলাই ও অক্টোবরের টাইমে, তিন মাসের মধ্যে চালের দাম দ্বিগুণ হয়া যায়। বন্যার পরপরই অনাহারের খবর আসতে থাকে, আর দিন দিন তার ভয়াবহতাও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ গভমেন্ট বন্যার অফিশিয়াল ঘোষণা দেয় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। দুর্গত ঘরহীন মানুষদের জন্য রান্না করা খাবারের কিছু লঙ্গরখানা খোলা হয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতেই এই লঙ্গরখানাগুলা চালানো হয় ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগে আর গভমেন্টের লঙ্গরখানা পুরাপুরি চালু হয় অক্টোবরের শুরুতে। এক পর্যায়ে প্রায় ছয় হাজার লঙ্গরখানা খাদ্য ত্রাণ দেয় প্রায় ৪.৩৫ মিলিয়ন মানুষরে — যা দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬ ভাগ। নভেম্বর আসতে আসতে দ্রব্যমূল্যের দাম কমতে শুরু করে, রিলিফের চাহিদার তীব্রতাও কিছুটা কমতে শুরু করে মনে হয়। নভেম্বরের শেষে লঙ্গরখানাগুলি বন্ধ কইরা দেওয়া হয়।
অঞ্চলভেদে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা নানান মাত্রায় ছিলো। টেবিল ৯.২ লঙ্গরখানা থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করা মানুষের জেলাভিত্তিক অনুপাত তুলে ধরছে। এই অনুপাত রংপুর জেলার ১৭% থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ০% পর্যন্ত। এই হিসাবে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত পাচঁটা জেলা হইতেছে রংপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, সিলেট ও বরিশাল। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের জরিপে ii ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটরে বলা হইছে ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’। সর্বোচ্চ পরিমাণ প্লাবণ যা ‘তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে ৬ ফুটের বেশি উচ্চতার বন্যা’ ও ‘লঙ্গরখানা থেকে জনসংখ্যার শতকরা কতভাগ ত্রাণ নিছে’ — এই দুইয়ের ভিত্তিতে ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’ ঠিক করা হইছে। iii আগ্রাসী ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য নদী থেকে বেশ দূরের জেলা দিনাজপুর কিন্তু ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’ নামের এই তালিকায় পড়ে নাই অথচ এই জেলার ত্রাণ চাওয়া মানুষের সংখ্যার অনুপাত ছিলো সিলেটের চাইতে বেশি। আবার দেখা গেছে, ‘দিনাজপুরের লঙ্গরখানায় আসা মানুষের একটা বড় অংশ আসছে পাশের জেলা রংপুর থেকে।’
মৃত্যুর হিসাব নিয়াও আছে নানান মত। অফিশিয়াল হিসাবে দুর্ভিক্ষের কারণে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ২৬,০০০। iv অন্য হিসাবগুলাতে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি, যেমন, ‘খালি রংপুর জেলাতেই ২-৩ মাসে অনাহার ও অপুষ্টির কারণে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষ মারা গেছে।’ v সন্দেহ নাই, অপর্যাপ্ত হইলেও, ব্যাপক আকারে ত্রাণ তৎপরতা না থাকলে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হইতো। গভমেন্টের সহায়তার বাইরেও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলা দরকারি ভূমিকা রাখছে; এরা দুর্গত জেলাগুলির বাইরেও, অনেক গ্রামে নিজেদের মতো করে ত্রাণ দিছে, যা লিখিত হিসাবের বাইরে থাইকা গেছে। vi
খাদ্য আমদানি ও গভমেন্টের মজুত
সন্দেহ নাই, খাদ্য মজুত অপর্যাপ্ত থাকায়, বাংলাদেশ গভমেন্ট বড় ধরণের ঘাটতিতে পড়ছে। ফলে দুর্ভিক্ষের কঠিনতম অবস্থায় বড় আকারে ত্রাণ কার্যক্রম চালাইতে পারে নাই।vii ১৯৭৪ সাল নাগাদ, বিদেশ থেকে আমদানি করা খাদ্যের উপরে বাংলাদেশ নির্ভরশীল ছিলো, আর দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মধ্যেও ১৯৭৩ সালের তুনলায় ১৯৭৪ সালে খাদ্য আমদানি কম করতে পারছে (দেখেন টেবিল ৯.৩)। সত্যি বলতে, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মতো মাসে, আমদানি সবচাইতে কমে আসে, এবং এই দুই মাসে আমদানি করা খাদ্যের পরিমাণ আগের বছরের ওই দুই মাসের তুলনায় বেশি তো ছিলই না, বরং আগের বছরের ওই দুই মাসের পাচ ভাগের একভাগে নেমে আসছিলো। বাংলাদেশ গভমেন্টের ত্রাণ কার্যক্রম সীমিত করার ক্ষেত্রে, খাদ্য ঘাটতি একটা বড় ধরণের নেগেটিভ ভূমিকা রাখছে।
এই প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় বলা দরকার। দুনিয়ার আরও অনেক দেশের মতো, বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়মিত খাদ্য সহায়তা পাইয়া আসতেছিলো। ঠিক এই সময়টায় কিউবার সাথে বাংলাদেশের বানিজ্য সম্পর্ক বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়ায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা খাদ্য সহায়তা হুমকির মুখে পড়ে। হেমন্তে তীব্র ডলার-সংকটে পইড়া আমেরিকান খাদ্য কোম্পানির থেকে দুইটা পার্চেজ-অর্ডার ক্যান্সেল করতে হইছে, আর এর কিছু দিন পরেই আসে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ।
১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে খাদ্য সহায়তা পাঠানো বন্ধ কইরা দেয়ার হুমকি দেয়। সে সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দেশে, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলামরে ডাইকা বাংলাদেশরে কিউবায় পাট রপ্তানি বন্ধ করতে অনুরোধ করে। পিএল৪৮০ অনুযায়ী, খাদ্য সহায়তা পাওয়া কোনো দেশ কিউবার মতো ব্ল্যাক লিস্টেড দেশের সাথে বানিজ্য সম্পর্ক রাখতে পারে না। বাংলাদেশের মতো প্রায় নিঃস্ব ও দরিদ্র একটা দেশরে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি বন্ধ করতে অনুরোধ করতে পারে – এই বিষয়টাতেই ড. ইসলাম অবাক ও ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা জানায়। বাংলাদেশ গভমেন্ট কিউবায় পাট রপ্তানি বন্ধ করে এমন সময় যখন ইন্ডিয়ান পাট ও অন্যান্য কম দামের বাজারের সাথে কম্পিটিশনের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক রপ্তানি এমনিতেই আগের চাইতে ছোট হয়ে আসছিলো। viii হার মাইনা কিউবার সাথে বানিজ্য সম্পর্ক ত্যাগ করার পরেই কেবল আমেরিকান খাদ্য সরবরাহ আবার চালু হয়। ততদিনে হেমন্তের দুর্ভিক্ষ মোটামুটি শেষ। ix
আমদানির প্ল্যানিংয়ের সমস্যাটা আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও ক্রেডিট ঘাটতির সাথে মিলে আরও জটিল হইছে। ১৯৭৪ সালে গভমেন্টের আরও ভালো ফলনের প্রত্যাশাও হতাশায় পরিনত হইছে। দেখানো যায় যে, ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকের মাসগুলিতে খাদ্য আমদানিও আগের বছরের প্রথম কয়েক মাসের আমদানির তুলনায় অনেক কম। তার উপরে, দেশের ভিতর থেকে কেনার ব্যাপারে পরিকল্পনার চাইতে কম সফল হইছে; এবং ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ১১.৮ মিলিয়ন টন হওয়ায়, সব মাসে গভমেন্টের খাদ্য মজুতও একইরকম ছিল না; ৩৪৭ হাজার থেকে ১৩০ হাজার টন পর্যন্ত নানান রকম ছিলো। x এইটা ত্রাণ কার্যক্রমরে প্রভাবিত করছে কত লোকরে ত্রাণের আওয়াতায় আনা যাবে খালি সেইটাই না, — আরও জরুরি — প্রতিটা নিঃস্ব ও দুর্গত মানুষরে কতটুকু খাদ্য সহায়তা দেয়া যাবে তাও প্রভাবিত করছে। xi
সবাই মোটামুটি একমত যে, খাদ্যের খাটতি গভমেন্টের রিলিফ কার্যক্রমরে সীমিত করতে ভূমিকা রাখছে। তবে এতে প্রমাণ হয় না যে এই ঘাটতিই দুর্ভিক্ষের কারণ। বন্যার কারণে উৎপাদনে ঘাটতির কারণেই কি দুর্ভিক্ষ হইছে? খাদ্যের জেনারেল শর্টেজ ছিলো কি? এক্ষেত্রে ফুড এভেইলেবিলিটি ডিক্লাইন বা ফ্যাড ব্যাখ্যাটা কি খাটে? এবার আমি এই প্রশ্নগুলা বিবেচনা করবো।
ফুড এভেইলেবিলিটি কমে গেছিল?
৬ নাম্বার চ্যাপ্টারে ১৯৪৩ এর বাংলার মহাদুর্ভিক্ষ বিশ্লেষণের সময় যেমনটা বলছি, বাংলায় প্রধানত তিন প্রকার ধানের চাষ হয়: আমন, আউশ আর বোরো। বাংলাদেশে এই ফসলের তুলনামূলক গুরুত্ব ও টাইমিং ১৯৪৩ -এর বাংলার সাথে হুবহু মেলে না। এর আংশিক কারণ বাংলাদেশ অবিভক্ত বাংলার পুরাটা না, তাছাড়া ১৯৪৩ পরবর্তী সময়ে বীজ ও চাষের ধরণেও বদল আসছে। ১৯৭১-৭৬ সালের বাংলাদেশে চাষের আনুপাতিক রেটটা মোটামুটি এমন: আমন (ফসল তোলার মৌসুম: নভেম্বর-জানুয়ারি), ৫৬%, আউশ (জুলাই-আগস্ট), ২৫%, এবং বোরো (এপ্রিল-জুন), ১৯%।
১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের মতো, ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কঠিনতম দশাটা মিলছে গিয়া আউশ ধান তোলার সময় এবং আমন ধান তোলার আগে। এই কারণে ১৯৭৪ সালের বোরো এবং আউশ ধানের সাথে ১৯৭৩-৪ (নভেম্বর-জানুয়ারি) এর আমন ধান যোগ কইরাই ১৯৭৪ সালের প্রোডাকশন-বেজড সাপ্লাইয়ের হিসাব করলে ভালো হবে। আসলে, ৬ নাম্বার চ্যাপ্টারের মতো, এইভাবেই আমরা নির্দিষ্ট বছরের উৎপাদন হিসাব করবো, মানে, আগের বছরের উৎপাদিত আমন ধানের হিসাবটারে গোনায় ধইরা। টেবিল ৯.৪ তুলে ধরছে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের বাৎসরিক চালের উৎপাদন। উৎপাদিত চালের মাথাপিছু পরিমাণের ইনডেক্সও দেয়া হইছে। দেখানো যায় যে, মোট উৎপাদিত চাউল ও মাথাপিছু উৎপাদনের পরিমাণ — দুই বিবেচনাতেই ১৯৭৪ সাল ছিলো শীর্ষে। xii
চাউল থেকে খাদ্যশস্যের এভেইলেবিলিটির দিকে গেলে, মোট গম তা যতই অল্প পরিমাণে হৌক, হিসাবে ধরতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ট্রেডও অবশ্যই হিসাব করতে হবে। কাজটা করা হইছে টেবিল ৯.৫-এ। দেখা গেছে, আবারও, দেশীয় উৎপাদন ১৯৭৪ সালে সর্বোচ্চ। xiii খাদ্যের টোটাল এভেইলেবিলিটি কেউ দেখলে, সে অন্তত আগের বছরগুলার তুলনায় ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করবে কম। অথচ দুর্ভিক্ষটা ঠিক ১৯৭৪ সালেই হইলো।
অবশ্য, খাদ্য এভেইলেবিলিটি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা একটা আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবেই দেখা দরকার, এবং বাংলাদেশের মধ্যে এই সমস্যার সমাধানের সুযোগ ছিলো না। কারণ মূলত গভমেন্টের খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আন্ত:জেলা খাদ্যের চালানে গভমেন্টের তরফে নিষেধাজ্ঞা ছিল। দুর্ভিক্ষে বেশি আক্রান্ত জেলাগুলিতে খাদ্যের এভেইলেবিলিটি কি ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছিলো?
টেবিল ৫ বিভিন্ন জেলায় চালের উৎপাদনের চেহারা এবং ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ এ উৎপাদনে পরিবর্তনের শতকরা হিসাবে তুলে ধরছে। দেখা যাইতেছে, আউটপুট কমছে মাত্র দুইটা জেলায়, যেইখানে দুর্ভিক্ষের মাত্রা ছিলো অনেক বেশি।
আরও দেখা যায়, সবচাইতে বেশি আক্রান্ত জেলাগুলিতে — যেমন, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট — আউটপুট উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ছে (যথাক্রমে, ২২%, ১৭% এবং ১০% কইরা)। অন্যদিকে, আউটপুট বাড়ার রেট বিবেচনায় সবচাইতে কম থাকা তিনটা জেলা ছিল পটুয়াখালি, বরিশাল আর কুমিল্লা। এই তিনটা জেলা মিলে নিঃস্ব ও দুর্গতরা লঙ্গরখানায় ত্রাণ পাইছে মোট দেয়া ত্রাণের ১২.৭%। মোটাদাগে, দুর্ভিক্ষের তীব্রতার আন্ত:জেলা র্যাংকিং (টেবিল ৯.২) এবং কম আউটপুট বৃদ্ধির র্যাংকিংয়ে (টেবিল ৯.৬) শীর্ষ জেলাগুলির মধ্যে কোনো সম্পর্ক খুজে পাওয়াই কঠিন। আর এই দুইয়ের মধ্যকার র্যাংক কোরিলেশন কো-এফিশেন্ট (এইটা কি মিন করে, একটা নোট দিতে পারেন) মাইনাস ০.৫।
তুলনার জন্যে খাদ্যশস্যের এভেইলেবিলিটির মাথাপিছু হিসাব দেয়া হইছে টেবিল ৯.৭-এ। এই তিন তথাকথিত ‘দুর্ভিক্ষ জেলা’য় মাথাপিছু খাদ্যশস্যের এভেইলেবিলিটি ভালোই বাড়ছে: সিলেটে ৩%, রংপুরে ১০% এবং ময়মনসিংহে ১১%। অন্যদিকে, আমরা যদি কম এভেইলেবিলিটি পরিবর্তনের হিসাবে শীর্ষ জেলাগুলির দিকে তাকাই (পটুয়াখালি, বরিশাল ও কুমিল্লা), তাহলে লঙ্গরখানায় ত্রাণপ্রার্থী নিঃস্বদের মাত্র ১৩%-এ দাঁড়ায়। দুর্ভিক্ষের আন্ত:জেলা তীব্রতা আর কম এভেইলেবিলিটি পরিবর্তনের মধ্যকার র্যাংক কোরিলেশন কোএফিশেন্ট হইতেছে মাইনাস ০.৩৩, যা আসলে নিরাশাজনক ডেটাই।
এভেইলেবিলিটি পরিবর্তন দেখার বদলে, মাথাপিছু এবসলিউট এভেইলেবিলিটির কমতির দিকে নজর দিলেও, দুর্ভিক্ষের ব্যাখ্যায় তা কাজে আসে না। তথাকথিত দুর্ভিক্ষ পীড়িত জেলাগুলা পড়ে শেষের দিকেই — উনিশটা জেলার মধ্যে রংপুর, সিলেট আর ময়মনসিংহের র্যাংক যথাক্রমে আসে ১৫, ১৭ ও ১৮ — প্রত্যেকটা জেলাতেই মাথাপিছু খাদ্যের এভেইলেবিলিটি তুলনামূলক উপরের দিকে। xiv এভেইলেবিলিটির নিচের দিকে থাকা জেলাগুলির (পাবনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর) লঙ্গরখানা থেকে ত্রাণ নেয়া নিঃস্বরা মোট ত্রাণনেওয়াদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৬ ভাগ। সবশেষে, দুর্ভিক্ষের আন্ত:জেলা তীব্রতা ও কম এভেইলেবিলিটির সূচকের র্যাংক কোরিলেশন কোএফিশেন্ট মাইনাস ০.৭৩। এই সংখ্যাটা ফ্যাড (FAD) এর ব্যাখ্যা মোটেই সমর্থন করে না।
নিঃসন্দেহে, দুর্ভিক্ষ পীড়িত জেলাগুলির বিশেষ গুরুত্ব সহকারে গভমেন্টের খাদ্য বরাদ্দ পাওয়ার ঘটনাই হয়তো এই উচ্চ ও উল্লেখযোগ্য নেগেটিভ র্যাংক কোরিলেশনরে প্রভাবিত করছে, কিন্তু সেইটাও তুলনামূলক ভালো এভেইলেবিলিটির মধ্যেও ক্যামনে চরম খাদ্য ঘাটতি তৈরি করছে তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। আসলে, অলরেডি আমরা যেমন দেখছি, আউটপুটের চিত্র কিন্তু ফ্যাড দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যায় স্বস্তি দেয় না। ত্রাণ দেওয়ামূলক ডিস্ট্রিবিউশন কিন্তু পুরা খাদ্য ভোগের ছোট্ট একটা অংশ মাত্র এবং নিঃস্ব মানুষপ্রতি দেয়া খাদ্যের পরিমাণ — আগেই দেখানো হইছে — ব্যাপকভাবে দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত জেলাগুলিতে খুবই সামান্য। xv
বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ব্যাখ্যায় খাদ্য এভেইলেবিলিটি এপ্রোচ কাজে আসে না বললেই চলে। বাংলাদেশের মোট আউটপুট আর এভেইলেবিলিটির হিসাব, ঠিক উলটা ছবি তুলে ধরে; আন্ত:জেলা উৎপাদন ও এভেইলেবিলিটি র ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে যেমনই হৌক না কেন, এইটা অন্তত খাদ্য এভেইলেবিলিটির ঘাটতির কারণে সৃষ্টি হওয়া দুর্ভিক্ষ না।
[চেপ্টারের অংশ…]
কে এম রাকিব
Latest posts by কে এম রাকিব (see all)
- বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ – অমর্ত্য সেন (পার্ট ২) - নভেম্বর 5, 2024
- অন পলিটিকাল কাওয়ালি, প্রাতিষ্ঠানিক র.ঠা ও অন্যান্য কালচা(ড়া)ল পেজগি - সেপ্টেম্বর 8, 2024
- বাঙালি ব্যাশিং: কয়েকটা প্যাটার্ন, উইদ এক্সাম্পল - আগস্ট 16, 2024