Main menu

বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ – অমর্ত্য সেন (পার্ট ১)

অনুবাদকের ভূমিকা

১.
নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্র। আমার মতে, পিটার টামাস বাউয়ারের কাজকর্ম বাদ দিলে, তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশের জন্য সবচাইতে প্রাসঙ্গিক ও দরকারি অর্থনৈতিক গবেষণা করছেন অমর্ত্য সেন। সেই গবেষণার বড় অংশ আছে বিখ্যাত বই পভার্টি এন্ড ফ্যামিন-এ, বইয়ের নবম অধ্যায় এইটা।

নবম অধ্যায় অর্থাৎ বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ আসলে একটা কেইস-স্টাডি। ৭৪ এর দুর্ভিক্ষের সাথে বন্যারে সম্পর্কিত বলা হয়। অফিশিয়াল হিসাবমতে মারা গেছেন ২৬০০০ মানুষ। বাস্তবে সংখ্যাটা ছিলো অনেকানেক বেশি। দুর্ভিক্ষের কারণ হিসাবে দায়ী করা হইছে এভেইলেবল খাদ্য ঘাটতিরে (ফ্যাড)। যদিও কম খাদ্য আমদানি ও গভমেন্টের অল্প খাদ্য মজুত রিলিফ ওয়ার্করে সীমিত করে দিছে, সেন দেখাইছেন, এই ফ্যাড এপ্রোচ আসলে তেমন কিছুই ব্যাখ্যা করে না। পেশাগত স্টেটাস আর নিঃস্বতার তীব্রতার বিশ্লেষণ দেখাইছে দুর্ভিক্ষের শিকার সবচাইতে বড় গ্রুপটা ছিলো লেবার। লেবারদের এক্সচেঞ্জ এন্টাইটেলমেন্ট বিস্তারিত বিশ্লেষণ করা হইছ। সেন এই সিদ্ধান্তে আসছেন যে দুর্ভিক্ষ ব্যাখ্যায় ও বোঝাবুঝিতে এক্সচেঞ্জ এন্টাইটেলমেন্ট এপ্রোচ আরও ভালো কাজ করে।

মোটাদাগে এই হইলো বিষয়বস্তু। কিন্তু অমর্ত্য বাবুর গবেষণার আসল মজা ও প্রজ্ঞার জায়গাটা চিকনদাগের ডিটেইলে ও আর্গুমেন্টে। বইয়ে খালি দুর্ভিক্ষের কারণ অনুসন্ধান ও সরকারি ব্যার্থতা না, বাংলার (এখনও) মোটাদাগের কৃষিভিত্তিক সমাজের অর্থনৈতিক ও পেশাভিত্তিক নানান গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচিত হইছে। সাধারণ ডেটা পাঠ কইরাও সমাজ সম্পর্কে কি দারুণ সব পর্যবেক্ষণ বাইর কইরা নিয়া আসা যায় তার প্রমাণ এই গবেষণা। যেমন: ধানমাড়াই পেশাটার সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বভাবচরিত্রের ব্যাখ্যা ড. সেন যেভাবে করছেন, আমিও বেশ অবাক হইছি, অথচ আমি বড় হইছি গ্রামে (দ্যাখেন বাংলার মহাদুর্ভিক্ষ অধ্যায়টা)। উদাহরণ দিয়া ভূমিকা বড় করবো না, অমর্ত্যবাবুর গবেষণা পাঠকরে পইড়া দেখতে বলবো।

সেনের গবেষণায় উঠে আসছে, দুর্ভিক্ষের কারণ খাদ্যাভাব না, আসলে রাষ্ট্রে ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতার অভাব। অমর্ত্য বাবুর একাডেমিক পরিভাষা ‘এন্টাইটেলমেন্ট’। অর্থাৎ খাদ্য কে পাবে আর কেন, কোন মাত্রায় পাবে সেইটা ঠিক কইরা দেওয়া রাজনীতির কারণে দুর্ভিক্ষ হইছিল। মোট সংখ্যা না, ব্যক্তির আলাদাভাবে ও মিনিমাম ভালো থাকা দেখা জরুরি। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষের কথাই ধরেন। সেপ্টেম্বর মাসে ৬০০০ লঙ্গরখানা খুলে ৪৩ লাখ মানুষরে রান্না করা খাবার দেওয়া হয়। ফলে দুর্ভিক্ষের শোচনীয় অবস্থাটা কিছুটা ‘ভালো’ হয়। অথচ সেপ্টেম্বরের আগে এইটা যে দুর্ভিক্ষ সেইটা ঘোষণাই করা হয় নাই! আরও আগে ঘোষণা দিয়া সরকার আগায়ে আসলে ক্ষয়ক্ষতি আরও কমানো যাইতো। আরও মজার ব্যাপার মোট খাদ্যের মাত্র ১.৩৬% ছিলো সরকারের মজুদে। এইটা দিয়াই কাজ চালাইছে। আসলে সরকার যদি মনে করতো খাদ্য সমস্যা সমাধান জরুরি, এইটা সমাধান কঠিন কোনো ব্যাপার ছিলো না।

‘জিডিপি বাড়ছে, আয় বাড়ছে, তার মানে মানুষ খুব ভালো আছে’ –এইসব সরকারি জিকির আমাদের দেশে নতুন না। অমর্ত্য সেন দেখাইছেন যে দুর্ভিক্ষের সময় আয় আরও বেশি বাড়ে। অমর্ত্য বাবু এইসব শুভঙ্করের ফাঁকি আমাদের নজরে আনেন। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ বিশ্লেষণ কইরা অমর্ত্যবাবু তাই প্রস্তাব দিছেন জিডিপির বিপরীতে ‘পার ক্যাপিটা ক্যালোরি ইনটেক’ এর জনশুমারি করতে। শহর আর গ্রামে প্রোটিন ইনটেক আর ক্যালরি ইনটেকের ব্যবধান বেশি যেন না হয়। ব্যবধান বেশি হওয়া দুর্ভিক্ষের একটা লক্ষণ। সমাজে মানুষের স্বাধীনতা ও অধিকার ইত্যাদির হাজির না থাকাই যে দুর্ভিক্ষের কারণ এমন দাবি গবেষণায় আছে। অমর্ত্য সেন একটা কথা জোর দিয়া বলেন যে, মডার্ন যুগে দুর্ভিক্ষ খাদ্যাভাবে হয় না, হয় মানুষের অব্যবস্থাপনার জন্যে, রাষ্ট্র ঠিকমতো না চললে।

জানুয়ারি ২০২৩
হাজারিবাগ| ঢাকা-১২০১

দরকারি টার্মগুলি

ক. নি:স্বতা — ডেস্টিটিউট আর ডেস্টিটিউশন এর বাংলা এই বইয়ে যথাক্রমে নি:স্ব ও নি:স্বতা। আরও চলনসই, সহজ বাংলা পাই নাই বইলা ‘ডেস্টিটিউশন এর চাইতে অন্তত সহজ’ – বিবেচনায় নি:স্বতা রাখছি।

খ. ক্যারি-ওভার — পরিভাষা ডিকশোনারিতে অর্থ দেওয়া আছে অগ্রে আনয়ন /মেয়াদ বর্ধিতকরণ। এই অর্থ আসলে শব্দটা এইখানে বুঝায় নাই। গত বছর/বছরগুলার পরেও এখনও যে পরিমাণ রয়েছে গেছে সেই পরিমাণ খাদ্য (যেমন: চাউল ও গম) এইখানে ক্যারি-ওভার।

গ. মুভিং এভারেজ — (চলমান গড়) ট্রেন্ড ফলোয়িং একটা ইন্ডিকেটর। স্টকের ডিরেকশন (কোন দিকে যাইতেছে?) আর স্বভাব (কোন মাত্রায় যাইতেছে?) বুঝতে মুভিং এভারেজ কাজে দেয়। নির্দিষ্ট পিরিয়ডের (ধরেন, ১৯৩৯–-১৯৪৪) ক্ষেত্রে, কোন একটা পয়েন্ট (ধরেন, ১৯৪৪) পর্যন্ত তার আগের সকল ডেটা পয়েন্ট যোগ করে, টাইম পিরিয়ডের সংখ্যার যোগফল দিয়া ভাগ করলে পাওয়া যায় মুভিং এভারেজ এবং সেই পুরা পিরিয়ডরে ২/৩ বছর ধরে আলাদা আলাদা হিসাব কইরা দেখলে ট্রেন্ড বোঝা যায়। অতীতের প্রাইসের বেসিসে হিসাব করা হয় বইলা মুভিং এভারেজরে ল্যাগিং ইন্ডিকেটরও বলে। কারণ মুভিং এভারেজ মূলত প্রাইসরেই ফলো করে, পিছে পিছে একটু দেরিতে আগাইতে থাকে। যেমন: প্রাইস কমে যাইয়া যদি আবার বাড়তে থাকে, প্রাইসের সাথে সাথে মুভিং এভারেজও সাধারণত বাড়া শুরু করে। মুভিং এভারেজের পিরিয়ডটা যত দীর্ঘ, ল্যাগও তত বেশি হয়।

এন্টাইটেলমেন্ট ও এক্সচেঞ্জ এন্টাইটেলমেন্ট — চালু পরিভাষায়, ‘প্রদেয় অধিকার’, ‘সরকারি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের দ্বারা স্বীকৃত নাগরিকের অধিকার ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও স্বাধীনতা’। এই পরিভাষার বদলে ইংলিশে রেখে দেয়াটাই ঠিক মনে করছি। মূল অর্থটা হক বা অধিকার টাইপ হইলেও, অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘যতরকম বিকল্প প্রডাক্ট ও সার্ভিস এবং তাদের কম্বিনেশন সম্ভব সেইখান থেকে ব্যক্তি যা বাছাই বা পছন্দ করার স্বাধীনতা রাখে, তার সংগ্রহরে বলে এন্টাইটেলমেন্ট’। অর্থনীতিতে, সেনের এই বইয়ে অন্তত, টার্মটার মানে ব্যক্তির বা পরিবারের কামাই, জমি বা অন্যান্য অর্থনৈতিক সম্পদ বিষয়ক সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা। আর এক্সচেঞ্জ এন্টাইটেলমেন্ট হইতেছে, অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘ব্যক্তি কি কিনতে বা বেচতে পারে সেইটা নিয়া এক্সচেঞ্জ এন্টাইটেলমেন্ট মাথা ঘামায় না, বরং ঘামায় ব্যক্তি কী মাত্রায় এক্সচেঞ্জ করে কেমনে টিকে থাকতে পারে সেইটা নিয়া।’ [দেখেন, সেন, অমর্ত্য (১৯৭৬), ফ্যামিন এজ ফেইলিউরস অব এক্সচেঞ্জ এন্টাইটেলমেন্ট। ইকোনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলি, ১১ (৩১/৩৩), ১২৭৩-১২৮০। http://www.jstor.org/stable/4364836)]

ঙ. বোট ডিনায়াল পলিসি — দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়াতে জাপানি আর্মি হামলা করলে যাতে নদীপথে ইন্ডিয়াতে ঢুকতে না পারে সে জন্য ব্রিটিশ প্রশাসন এই পলিসি ঠিক করে। সব ধরণের নৌযোগাযোগ বন্ধ করে দিয়া ঠিক কইরা দেয় নৌকায় এক সাথে দশ জনের বেশি চলাচল করতে পারবে না। দুর্ভিক্ষে এর প্রভাবটা কেমনে পড়ছে তা দুইভাবে দেখা যাইতে পারে। এক. ডিনায়াল পলিসি ১৯৪২ ও ১৯৪৩ এ নরমাল চাউল উৎপাদনরে কমায়ে দিছে, ফলে খাদ্যে ঘাটতি ও দাম বাড়ায় ভূমিকা রাখছে। ডিনায়ালরে দেখার আরেকটা চশমা হইতেছে, নৌকার মাঝি ও ইউজারদের ক্ষতিপূরণ হিশাবে দেওয়ার প্রচুর টাকা। যুদ্ধের সময়কার অনুৎপাদনশীল অবস্থায়, ক্ষতিপূরণের এই প্রসেস লোকাল ইনফ্লেশন তৈরিতে ভূমিকা রাখছে, যার ফলে খাদ্যশস্যের দাম বাড়ায় হেল্পাইছে। বিস্তারিত দেখেন ইফতেখার ইকবালের ২০১০ সালের ভালো ১টা পেপার: [https://www.academia.edu/8831429/Boat_Denial_Policy_and_the_Great_Bengal_Famine_1943]

চ. বুম ফ্যামিন – বুম মানেই বাজারের তেজি ভাব, হঠাৎ বেচাবিক্রি বাইড়া যাওয়া। সাধারণত ব্যাপক সরকারি খরচের (যেমন মেগাপ্রজেক্ট, অবকাঠামো ইত্যাদি খাতে) ফলে এই ধরণের বুম হয়। এই রকম বুমের অবধারিত ফল হয় মুদ্রাস্ফীতি। অমর্ত্য সেন ৪৩-এর দুর্ভিক্ষরে ‘বুম ফ্যামিন’ বলছেন। বর্তমান বাংলাদেশের নানা মেগাপ্রজেক্ট, লুটপাটতন্ত্রের সাথে মুদ্রাস্ফীতির সম্পর্কের কিছু ইশারা এইখানে পাওয়া যায়।

ছ. স্পিয়ারম্যানের র‍্যাংক কোরিলেশন কোএফিশিয়েন্ট — র‍্যাংক কোরিলেশনের একটা নন-প্যারামেট্রিক পরিমাপ। র‍্যাংক কোরিলেশন হইতেছে দুই প্রকার ভ্যারিয়েবলের র‍্যাংকিংয়ের ডেটাভিত্তিক ডিপেন্ডেন্স। দুইটা ভ্যারিয়েবলের মধ্যে সম্পর্করে মনোটোনিক ফাংশন দিয়া কতটা ভালো করে বর্ণনা করা যায় তা বিচার করে স্পিয়ারম্যানের কোএফিশেন্ট। আর মনোটোনিক মানে ফাংশনটার পুরা ডোমেইনে হয় মান বাড়তেছে, না হয় কমতেছে। গ্রাফ দেখে এই বাড়া কমা সহজে ধরা যায়। স্পিয়ারম্যানের কোরিলেশন মূলত র ডেটার ক্ষেত্রে পিয়ারসনের কোরিলেশন। আপনার ডেটা অর্ডিনাল হয়ে থাকলে কোনো কিছু বদলের দরকার নাই, কিন্তু ডেটা কন্টিনিউয়াস হইলে, সেই ডেটারে র‍্যাংকে কনভার্ট করা লাগবে। স্পিয়ারম্যানের কোরিলেশন কোএফিশেন্ট (সহগ) -এর মান -১ থেকে +১ পর্যন্ত। পজিটিভ কোরিলেশন বোঝায় একটা ভ্যারিয়েবল বাড়লে, অন্যটাও বাড়ে। নেগেটিভ কোরিলেশন বোঝায় একটার মান বাড়লে অন্যটার মান কমে। মান যদি -১ বা +১ এর কাছাকাছি থাকে, তাহলে এই দুই ভ্যারিয়েবলের মধ্যে সম্পর্ক গভীর বোঝায়। অন্যদিকে মান শূন্যের কাছাকাছি হইলে ভ্যারিয়েবল দুইটার মধ্যে সম্পর্ক নগন্য ধরা হয়।

৯ম অধ্যায়: বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ

 

৯.১ বন্যা ও দুর্ভিক্ষ

প্রথমে বন্যা; তারপর দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ক্যাপসুল কাহিনীটা মোটামুটি এমন। গিলবার্ট এটিয়েন ১৯৭৪ সালের বন্যার কথা বর্ণনা করছেন এইভাবে:

উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলিতে ১৯৭৪ সালের বন্যাগুলা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে। নরমাল বছরগুলাতে, বানের সময় ব্রহ্মপুত্র পশ্চিম তীররে সর্বোচ্চ ৩০-৬০ মিটার পর্যন্ত গ্রাস করে। ১৯৭৪ সালে, ১০০ কি.মি. পর্যন্ত, ৩০০ পর্যন্ত প্রশস্ত পানির তোড় এমন ভূমি গ্রাস করে যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ৮০০ জন মানুষ। ২৪,০০০ মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাছাড়া পলিমাটিজাত হওয়ায়, কিছু জায়গায় জমি খুব উর্বর হইলেও, অন্যত্র বালুর পরিমাণ এত বেশি যে তা অনেকটা নিষ্ফলা…. জুনের শেষ দিকে ভয়াবহ কয়েকটা বন্যা হয়। এবং আউশের (জুলাই-আগস্টে চাষ করা ধান) ফসলের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরও পনের দিন পরে আউশের ফসল তোলার সময়টাতে ব্রহ্মপুত্র আবার বিপদসীমা অতিক্রম করে। আরও ১৫ দিন পর, নদীর পানির মাত্রা আবার বাড়ে এবং ফলে আমনের (জুলাই-সেপ্টেম্বরে চাষ ও নভেম্বর জানুয়ারিতে তোলা ধান) বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপরে, আগস্টের মাঝামাঝি, বন্যা বছরের সবচাইতে ভয়াবহ অবস্থায় পৌছায়। ফলে সদ্যবোনা আমনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এইটাই শেষ না। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ব্রহ্মপুত্রের পানি আবারও বিপদসীমার উপ্রে দিয়া যায়, আর আগের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই এমন ধানক্ষেতও ভাসায়ে নিয়া যায়। ১

বন্যার সময় এবং বন্যার ঠিক পরেই চালের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। টেবিল ৯.১ -এ এইটা দেখানো হইছে। সবচাইতে বেশি আক্রান্ত জেলাগুলির কয়েকটাতে, জুলাই ও অক্টোবরের টাইমে, তিন মাসের মধ্যে চালের দাম দ্বিগুণ হয়া যায়। বন্যার পরপরই অনাহারের খবর আসতে থাকে, আর দিন দিন তার ভয়াবহতাও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ গভমেন্ট বন্যার অফিশিয়াল ঘোষণা দেয় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। দুর্গত ঘরহীন মানুষদের জন্য রান্না করা খাবারের কিছু কিছু লঙ্গরখানা খোলা হয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতেই এই লঙ্গরখানাগুলা চালানো হয় ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগে আর গভমেন্টের লঙ্গরখানা পুরাপুরি চালু হয় অক্টোবরের শুরুতে। এক পর্যায়ে প্রায় ছয় হাজার লঙ্গরখানা খাদ্য ত্রাণ দেয় প্রায় ৪.৩৫ মিলিয়ন মানুষরে — যা দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬ ভাগ। নভেম্বর আসতে আসতে দ্রব্যমূল্যের দাম কমতে শুরু করে, রিলিফের চাহিদার তীব্রতাও কিছুটা কমতে শুরু করে মনে হয়। নভেম্বরের শেষে লঙ্গরখানাগুলি বন্ধ কইরা দেওয়া হয়।

 

অঞ্চলভেদে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা নানান মাত্রায় ছিলো। টেবিল ৯.২ লঙ্গরখানা থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করা মানুষের জেলাভিত্তিক অনুপাত তুলে ধরছে। এই অনুপাত রংপুর জেলার ১৭% থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ০% পর্যন্ত। এই হিসাবে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত পাচঁটা জেলা হইতেছে রংপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, সিলেট ও বরিশাল। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের জরিপে, ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটরে বলা হইছে ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’। সর্বোচ্চ পরিমাণ প্লাবণ যা ‘তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে ৬ ফুটের বেশি উচ্চতার বন্যা’ ও ‘লঙ্গরখানা থেকে জনসংখ্যার শতকরা কতভাগ ত্রাণ নিছে’ — এই দুইয়ের ভিত্তিতে ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’ ঠিক করা হইছে।৩ আগ্রাসী ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য নদী থেকে বেশ দূরের জেলা (দেখেন, ছবি-৮.১ এ বাংলাদেশের ম্যাপ) দিনাজপুর কিন্তু ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’ নামের এই তালিকায় পড়ে নাই অথচ এই জেলার ত্রাণ চাওয়া মানুষের সংখ্যার অনুপাত ছিলো সিলেটের চাইতে বেশি। আবার দেখা গেছে, ‘দিনাজপুরের লঙ্গরখানায় আসা মানুষের একটা বড় অংশ আসছে পাশের জেলা রংপুর থেকে।’

মৃত্যুর হিসাব নিয়াও আছে নানান মত। অফিশিয়াল হিসাবে দুর্ভিক্ষের কারণে মারা যাওয়া মানুষের সংখ্যা ২৬,০০০।৪ অন্য হিসাবগুলাতে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি, যেমন, ‘খালি রংপুর জেলাতেই ২-৩ মাসে অনাহার ও অপুষ্টির কারণে ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ মানুষ মারা গেছে।’৫ সন্দেহ নাই, অপর্যাপ্ত হইলেও, ব্যাপক আকারে ত্রাণ তৎপরতা না থাকলে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হইতো। গভমেন্টের সহায়তার বাইরেও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলা দরকারি ভূমিকা রাখছে; এরা দুর্গত জেলাগুলির বাইরেও, অনেক গ্রামে নিজেদের মতো করে ত্রাণ দিছে, যা লিখিত হিসাবের বাইরে থাইকা গেছে।৬

[১ এটিয়েন (১৯৭৭এ), প. ১১৩

২ দেখেন, আলমগির ও অন্যান্য (১৯৭৪), এবং আলমগির (১৯৮০)। সামনে পরিষ্কার হবে যে, এই জরিপ ও আলমগিরের অন্যান্য ডেটা, বিশ্লেষণ ও ইন্সাইট থেকে এই চ্যাপ্টারে ব্যাপক পরিমাণে নেয়া হইছে।

৩ আলমগির (১৯৮০)

৪ আলমগির (১৯৭৮এ, প.২)

৫ হক, মেহতা, রহমান ও উইগনারাজা (১৯৭৫), প. ৪৩। আলমগির (১৯৮০) এর গবেষণায় আগস্ট ১৯৭৪ থেকে জানুয়ারি ১৯৭৫ পর্যন্ত প্রায় দশ লক্ষ এবং এবং পরবর্তী বছরে আরও ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর ইশারা দেয় (প.১৪২-৩)

৬ দেখেন রহমান (১৯৭৪এ, ১৯৭৪বি) ]

 

৯.২ খাদ্য আমদানি ও গভমেন্টের মজুত

খাদ্য মজুত অপর্যাপ্ত থাকায়, সন্দেহ নাই, বাংলাদেশ গভমেন্ট বড় ধরণের সীমাবদ্ধতায় পড়ছে। ফলে দুর্ভিক্ষের কঠিনতম অবস্থায় বড় আকারে ত্রাণ কার্যক্রম চালাইতে পারে নাই।৭ ১৯৭৪ সাল নাগাদ, বিদেশ থেকে আমদানি করা খাদ্যের উপরে বাংলাদেশ নির্ভরশীল ছিলো, আর দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির মধ্যেও ১৯৭৩ সালের তুনলায় ১৯৭৪ সালে খাদ্য আমদানি কম করতে পারছে (দেখেন টেবিল ৯.৩)। সত্যি বলতে, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরের মতো মাসে, আমদানি সবচাইতে কমে আসে, এবং এই দুই মাসে আমদানি করা খাদ্যের পরিমাণ আগের বছরের ওই দুই মাসের তুলনায় বেশি তো ছিলই না, বরং আগের বছরের ওই দুই মাসের পাচ ভাগের একভাগে নেমে আসছিলো। বাংলাদেশ গভমেন্টের ত্রাণ কার্যক্রম সীমিত করার ক্ষেত্রে, খাদ্য ঘাটতি একটা বড় ধরণের নেগেটিভ ভূমিকা রাখছে।

 

এই প্রসঙ্গে আরেকটা বিষয় বলা দরকার। দুনিয়ার আরও অনেক দেশের মতো, বাংলাদেশও যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়মিত খাদ্য সহায়তা পাইয়া আসতেছিলো। ঠিক এই সময়টায় কিউবার সাথে বাংলাদেশের বানিজ্য সম্পর্ক বন্ধ করতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চাপ দেওয়ায়, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা খাদ্য সহায়তা হুমকির মুখে পড়ে। হেমন্তে তীব্র ডলার-সংকটে পইড়া আমেরিকান খাদ্য কোম্পানির থেকে দুইটা পার্চেজ-অর্ডার ক্যান্সেল করতে হইছে, আর এর কিছু দিন পরেই আসে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ।

১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে খাদ্য সহায়তা পাঠানো বন্ধ কইরা দেয়ার হুমকি দেয়। সে সময় স্টেট ডিপার্টমেন্টের নির্দেশে, আমেরিকান রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলামরে ডাইকা বাংলাদেশরে কিউবায় পাট রপ্তানি বন্ধ করতে অনুরোধ করে। পিএল৪৮০ অনুযায়ী, খাদ্য সহায়তা পাওয়া কোনো দেশ কিউবার মতো ব্ল্যাক লিস্টেড দেশের সাথে বানিজ্য সম্পর্ক রাখতে পারে না। বাংলাদেশের মতো প্রায় নি:স্ব ও দরিদ্র একটা দেশরে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি বন্ধ করতে অনুরোধ করতে পারে – এই বিষয়টাতেই ড. ইসলাম অবাক ও ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা জানায়। বাংলাদেশ গভমেন্ট কিউবায় পাট রপ্তানি বন্ধ করে এমন সময় যখন ইন্ডিয়ান পাট ও অন্যান্য কম দামের বাজারের সাথে কম্পিটিশনের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক রপ্তানি এমনিতেই আগের চাইতে ছোট হয়ে আসছিলো।৮ হার মাইনা কিউবার সাথে বানিজ্য সম্পর্ক ত্যাগ করার পরেই কেবল আমেরিকান খাদ্য সরবরাহ আবার চালু হয়। ততদিনে হেমন্তের দুর্ভিক্ষ মোটামুটি শেষ।৯

আমদানির প্ল্যানিংয়ের সমস্যাটা আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও ক্রেডিট ঘাটতির সাথে মিলে আরও জটিল হইছে। ১৯৭৪ সালে গভমেন্টের আরও ভালো ফলনের প্রত্যাশাও হতাশায় পরিনত হইছে। দেখানো যায় যে, ১৯৭৪ সালের প্রথম দিকের মাসগুলিতে খাদ্য আমদানিও আগের বছরের প্রথম কয়েক মাসের আমদানির তুলনায় অনেক কম। তার উপরে, দেশের ভিতর থেকে কেনার ব্যাপারে পরিকল্পনার চাইতে কম সফল হইছে; এবং ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যের মোট উৎপাদন ১১.৮ মিলিয়ন টন হওয়ায়, সব মাসে গভমেন্টের খাদ্য মজুতও একইরকম ছিল না; ৩৪৭ হাজার থেকে ১৩০ হাজার টন পর্যন্ত নানান রকম ছিলো।১০ এইটা ত্রাণ কার্যক্রমরে প্রভাবিত করছে কত লোকরে ত্রাণের আওয়াতায় আনা যাবে খালি সেইটাই না, — আরও জরুরি — প্রতিটা নি:স্ব ও দুর্গত মানুষরে কতটুকু খাদ্য সহায়তা দেয়া যাবে তাও প্রভাবিত করছে।১১

সবাই মোটামুটি একমত যে, খাদ্যের খাটতি গভমেন্টের রিলিফ কার্যক্রমরে সীমিত করতে ভূমিকা রাখছে। তবে এতে প্রমাণ হয় না যে এই ঘাটতিই দুর্ভিক্ষের কারণ। বন্যার কারণে উৎপাদনে ঘাটতির কারণেই কি দুর্ভিক্ষ হইছে? খাদ্যের জেনারেল শর্টেজ ছিলো কি? এক্ষেত্রে ফুড এভেইলেবিলিটি ডিক্লাইন বা ফ্যাড ব্যাখ্যাটা কি খাটে? এবার আমি এই প্রশ্নগুলা বিবেচনা করবো।

[৭. দেখেন এন রহমান (১৯৭৭)

৮. ম্যাকহেনরি ও বার্ড ( ১৯৭৭), প. ৪২

৯. এই ঘটনার বিস্তারিত জানতে দেখেন ম্যাকহেনরি ও বার্ড (১৯৭৭); আরও দেখেন সোবহান (১৯৭৯); খাদ্য সহায়তার এই নেগেটিভ দিক আরও বিস্তারিত জানতে দেখেন জর্জ (১৯৭৬) এবং লাপ্পে ও কলিন্স (১৯৭৭,১৯৭৮)

১০. আলমগিরের টেবিল ৬.২। যদিও আলমগির যুক্তি দেখাইছেন যে, আমদানি সমস্যার বাইরেও, গভমেন্ট ত্রান কার্যক্রমের ক্ষেত্রে অকারণ রক্ষণশীল ছিলো; মজুত অনেক কম থাকায় দুর্ভিক্ষের কঠিন মাসগুলিতে গভমেন্টের বিতরণ করা ত্রাণ ছিল খুবই অল্প। গভমেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলির ত্রাণ কার্যক্রমের মাত্রা ও পর্যালোচনা সম্পর্কে জানতে আরও দেখেন রহমান (১৯৭৪এ, ১৯৭৪বি)

১১. দেখেন আলমগিরের (১৯৭৯) দেয়া টেবিল ৫.১৫]

 

৯.৩ ফুড এভেইলেবিলিটি কমে গেছিল?

৬ নাম্বার চ্যাপ্টারে ১৯৪৩ এর বাংলার মহাদুর্ভিক্ষ বিশ্লেষণের সময় যেমনটা বলছি, বাংলায় প্রধানত তিন প্রকার ধানের চাষ হয়: আমন, আউশ আর বোরো। বাংলাদেশে এই ফসলের তুলনামূলক গুরুত্ব ও টাইমিং ১৯৪৩ -এর বাংলার সাথে হুবহু মেলে না। এর আংশিক কারণ বাংলাদেশ অবিভক্ত বাংলার পুরাটা না, তাছাড়া ১৯৪৩ পরবর্তী সময়ে বীজ ও চাষের ধরণেও বদল আসছে। ১৯৭১-৭৬ সালের বাংলাদেশে চাষের আনুপাতিক রেটটা মোটামুটি এমন: আমন (ফসল তোলার মৌসুম: নভেম্বর-জানুয়ারি), ৫৬%, আউশ (জুলাই-আগস্ট), ২৫%, এবং বোরো (এপ্রিল-জুন), ১৯%।

১৯৪৩ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষের মতো, ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কঠিনতম দশাটা মিলছে গিয়া আউশ ধান তোলার সময় এবং আমন ধান তোলার আগে। এই কারণে ১৯৭৪ সালের বোরো এবং আউশ ধানের সাথে ১৯৭৩-৪ (নভেম্বর-জানুয়ারি) এর আমন ধান যোগ কইরাই ১৯৭৪ সালের প্রোডাকশন-বেজড সাপ্লাইয়ের হিসাব করলে ভালো হবে। আসলে, ৬ নাম্বার চ্যাপ্টারের মতো, এইভাবেই আমরা নির্দিষ্ট বছরের উৎপাদন হিসাব করবো, মানে, আগের বছরের উৎপাদিত আমন ধানের হিসাবটারে গোনায় ধইরা। টেবিল ৯.৪ তুলে ধরছে ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ সালের বাৎসরিক চালের উৎপাদন। উৎপাদিত চালের মাথাপিছু পরিমাণের ইনডেক্সও দেয়া হইছে। দেখানো যায় যে, মোট উৎপাদিত চাউল ও মাথাপিছু উৎপাদনের পরিমাণ — দুই বিবেচনাতেই ১৯৭৪ সাল ছিলো শীর্ষে।১২

৯.৪

চাউল থেকে খাদ্যশস্যের এভেইলেবিলিটির দিকে গেলে, মোট গম তা যতই অল্প পরিমাণে হৌক, হিসাবে ধরতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক ট্রেডও অবশ্যই হিসাব করতে হবে। কাজটা করা হইছে টেবিল ৯.৫-এ। দেখা গেছে, আবারও, দেশীয় উৎপাদন ১৯৭৪ সালে সর্বোচ্চ।১৩ খাদ্যের টোটাল এভেইলেবিলিটি কেউ দেখলে, সে অন্তত আগের বছরগুলার তুলনায় ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করবে কম। অথচ দুর্ভিক্ষটা ঠিক ১৯৭৪ সালেই হইলো।

অবশ্য, খাদ্য এভেইলেবিলিটি কমে যাওয়ার সম্ভাবনা একটা আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবেই দেখা দরকার, এবং বাংলাদেশের মধ্যে এই সমস্যার সমাধানের সুযোগ ছিলো না। কারণ মূলত গভমেন্টের খাদ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আন্ত:জেলা খাদ্যের চালানে গভমেন্টের তরফে নিষেধাজ্ঞা ছিল। দুর্ভিক্ষে বেশি আক্রান্ত জেলাগুলিতে খাদ্যের এভেইলেবিলিটি কি ব্যাপক মাত্রায় কমে গেছিলো?

টেবিল ৯.৫ বিভিন্ন জেলায় চালের উৎপাদনের চেহারা এবং ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ এ উৎপাদনে পরিবর্তনের শতকরা হিসাবে তুলে ধরছে। দেখা যাইতেছে, আউটপুট কমছে মাত্র দুইটা জেলায়, যেইখানে দুর্ভিক্ষের মাত্রা ছিলো অনেক বেশি।

আরও দেখা যায়, সবচাইতে বেশি আক্রান্ত জেলাগুলিতে — যেমন, ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট — আউটপুট উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়ছে (যথাক্রমে, ২২%, ১৭% এবং ১০% কইরা)। অন্যদিকে, আউটপুট বাড়ার রেট বিবেচনায় সবচাইতে কম থাকা তিনটা জেলা ছিল পটুয়াখালি, বরিশাল আর কুমিল্লা। এই তিনটা জেলা মিলে নি:স্ব ও দুর্গতরা লঙ্গরখানায় ত্রাণ পাইছে মোট দেয়া ত্রাণের ১২.৭%। মোটাদাগে, দুর্ভিক্ষের তীব্রতার আন্ত:জেলা র‍্যাংকিং (টেবিল ৯.২) এবং কম আউটপুট বৃদ্ধির র‍্যাংকিংয়ে (টেবিল ৯.৬) শীর্ষ জেলাগুলির মধ্যে কোনো সম্পর্ক খুজে পাওয়াই কঠিন। আর এই দুইয়ের মধ্যকার র‍্যাংক কোরিলেশন কো-এফিশেন্ট মাইনাস ০.৫।

তুলনীয় খাদ্যশস্যের এভেইলেবিলিটির মাথাপিছু হিসাব দেয়া হইছে টেবিল ৯.৭-এ। এই তিন তথাকথিত ‘দুর্ভিক্ষ জেলা’য় মাথাপিছু খাদ্যশস্যের এভেইলেবিলিটি ভালোই বাড়ছে: সিলেটে ৩%, রংপুরে ১০% এবং ময়মনসিংহে ১১%। অন্যদিকে, আমরা যদি কম এভেইলেবিলিটি পরিবর্তনের হিসাবে শীর্ষ জেলাগুলির দিকে তাকাই (পটুয়াখালি, বরিশাল ও কুমিল্লা), তাহলে লঙ্গরখানায় ত্রাণপ্রার্থী নি:স্বদের মাত্র ১৩%-এ দাঁড়ায়। দুর্ভিক্ষের আন্ত:জেলা তীব্রতা আর কম এভেইলেবিলিটি পরিবর্তনের মধ্যকার র‍্যাংক কোরিলেশন কোএফিশেন্ট হইতেছে মাইনাস ০.৩৩, যা আসলে নিরাশাজনক ডেটাই।

এভেইলেবিলিটি পরিবর্তন দেখার বদলে, মাথাপিছু এবসলিউট এভেইলেবিলিটির কমতির দিকে নজর দিলেও, দুর্ভিক্ষের ব্যাখ্যায় তা কাজে আসে না। তথাকথিত দুর্ভিক্ষ পীড়িত জেলাগুলা পড়ে শেষের দিকেই — উনিশটা জেলার মধ্যে রংপুর, সিলেট আর ময়মনসিংহের র‍্যাংক যথাক্রমে আসে ১৫, ১৭ ও ১৮ — প্রত্যেকটা জেলাতেই মাথাপিছু খাদ্যের এভেইলেবিলিটি তুলনামূলক উপরের দিকে।১৪ এভেইলেবিলিটির নিচের দিকে থাকা জেলাগুলির (পাবনা, কুষ্টিয়া ও ফরিদপুর) লঙ্গরখানা থেকে ত্রাণ নেয়া নি:স্বরামোট ত্রাণনেওয়াদের মধ্যে শতকরা মাত্র ৬ ভাগ। সবশেষে, দুর্ভিক্ষের আন্ত:জেলা তীব্রতা ও কম এভেইলেবিলিটির সূচকের র‍্যাংক কোরিলেশন কোএফিশেন্ট মাইনাস ০.৭৩। এই সংখ্যাটা ফ্যাড (FAD) এর ব্যাখ্যা মোটেই সমর্থন করে না।

নি:সন্দেহে, দুর্ভিক্ষ পীড়িত জেলাগুলির বিশেষ গুরুত্ব সহকারে গভমেন্টের খাদ্য বরাদ্দ পাওয়ার ঘটনাই হয়তো এই উচ্চ ও উল্লেখযোগ্য নেগেটিভ র‍্যাংক কোরিলেশনরে প্রভাবিত করছে, কিন্তু সেইটাও তুলনামূলক ভালো এভেইলেবিলিটির মধ্যেও ক্যামনে চরম খাদ্য ঘাটতি তৈরি করছে তা ব্যাখ্যা করতে পারে না। আসলে, অলরেডি আমরা যেমন দেখছি, আউটপুটের চিত্র কিন্তু ফ্যাড দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যায় স্বস্তি দেয় না। ত্রাণ দেওয়ামূলক ডিস্ট্রিবিউশন কিন্তু পুরা খাদ্য ভোগের ছোট্ট একটা অংশ মাত্র এবং নি:স্ব মানুষপ্রতি দেয়া খাদ্যের পরিমাণ — আগেই দেখানো হইছে — ব্যাপকভাবে দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত জেলাগুলিতে খুবই সামান্য।১৫

বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ব্যাখ্যায় খাদ্য এভেইলেবিলিটি এপ্রোচ কাজে আসে না বললেই চলে। বাংলাদেশের মোট আউটপুট আর এভেইলেবিলিটির হিসাব, ঠিক উলটা ছবি তুলে ধরে; আন্ত:জেলা উৎপাদন ও এভেইলেবিলিটি র ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষে যেমনই হৌক না কেন, এইটা অন্তত খাদ্য এভেইলেবিলিটির ঘাটতির কারণে সৃষ্টি হওয়া দুর্ভিক্ষ না।

[১২. অবশ্য, বলা দরকার যে, মাথাপিছু আউটপুট হিসাবে নিলে, এইটা লোকাল সর্বোচ্চ, আর ১৯৬০-এর দশকের সর্বোচ্চ মাত্রার সাথে সত্তরের দশকের মাত্রায় তুলনা করা যায় না। যা-ই হোক, ১৯৭৪ সালরে গোনায় ধরলে, দুই-বছর ও তিন-বছর ব্যাপী মুভিং এভারেজও বাড়ছে (অন্যগুলার মধ্যে, এই মেথড ইউজ করা হইছে, ৬ নাম্বার চ্যাপ্টারে), এবং এইটা অস্বীকার করা কঠিন দুর্ভিক্ষের বছরেও আউটপুটের অবস্থা আগের বছরগুলার চাইতে ভালো ছিলো।

১৩. বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়ায় কী পরিমাণে খাদ্যশস্য পাচার হইছে সেইটা একটা অনিশ্চয়তার জায়গা। কিছু হিসাব অনুযায়ী এই পরিমাণ সামান্য (দেখেন রেড্ডাওয়ে ও রহমান, ১৯৭৫), আবার অনেকের মতে, পরিমাণটা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বড়। পরিমাণ বা মাত্রাটা যেমনই হৌক, দুর্ভিক্ষের বছর যেখানে ইন্ডিয়ার তুলনায় বাংলাদেশের চালের দাম বাড়ছে অনেক বেশি মাত্রায়, সেইখানে বাংলাদেশ থেকে ওই বছর চাউল পাচারের পরিমাণ বাড়ছে এমন ভাবার কোনো কারণ নাই।

১৪. জুলাই-অক্টোবরের হিসাবেও এই তিন অঞ্চলে ফুড সাপ্লাই মোটামুটি ভালো থাকা প্রমাণ দেয়; দেখেন আলমগির (১৯৮০) এর টেবিল ৬.৩৭

১৫. দেখেন আলমগির (১৯৮০) এর টেবিল ৫.১৫। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে দৈনিক যে গম রেশন দেওয়া হইছে তার ক্যালরি হিসাব ময়মনসিংহ রংপুরে ৪৫২ থেকে পাবনার মতো ‘দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত না’ এমন জেলা পাবনায় ২০৬৯ পর্যন্ত।]

The following two tabs change content below.

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →