কবিতা ও গান: স্বর্ণকুমারী দেবী
স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫ – ১৯৩২) হইতেছেন কলোনিয়াল বাংলা-ভাষার শুরুর দিকের একজন কবি, নভেলিস্ট এবং মিউজিশিয়ান। ১৩টা নভেল এবং ৭টা নাটক বাদেও অনেক কবিতা ও গান উনি লেখছেন। ১৮৯৫ থিকা ১৯০৬ সাল পর্যন্ত “ভারতী” পত্রিকার এডিটরও ছিলেন উনি।
১৮৭৬ সালে ছাপানো উনার “দীপনির্বাণ” নভেলের কারণে উনারে ফার্স্ট বাঙালি মহিলা-নভেলিস্ট বলা হয়। [এর আগে ১৮৫২ সালে ছাপানো “ফুলমণি ও করুণার বৃত্তান্ত”-এর রাইটার হানা ক্যাথরিন মুলনেস ছিলেন সুইস।]
১৮৭৯ সালে উনার লেখা “বসন্ত উৎসব”রে “ফার্স্ট বাংলা গীতিনাট্য” হিসাবে বলা হয়। যেই ফর্মটাতে উনার ছোটভাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১ – ১৯৪৫) পরে আরো কিছু “গীতিনাট্য” লেখেন।
উনার বাপের নাম দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭ – ১৯০৫), জামাই ছিলেন ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের শুরুর দিকে নেতা জানকীনাথ ঘোষাল। উনার মেয়ে সরলা দেবী চৌধুরানী (১৮৭২ – ১৯৪৫) ইন্টেলেকচুয়াল-এক্টিভিস্ট হিসাবে পরিচিত।
আজকে থিকা আরো একশ বছরের বেশি সময় আগে, বাংলা ১৩০২ সনের কার্ত্তিক মাসে ছাপানো উনার “কবিতা ও গান” বই থিকা এই বইয়ের কবিতা ও গানগুলা বাছাই করা হইছে।
এডিটর, বাছবিচার
…
জানিনাত
জানিনাত ভালবাসি কিনা, শুধু এই জানি,
একটি অব্যক্তভাবে রুদ্ধ যত বাণী।
একটি পরশে দেখি অনন্ত স্বপন,
একটি পরাণে দেখি বিশ্ব নিমগন।
স্বর্গের সৌন্দৰ্য আলাে বিকাশে নয়ানে,
ঈশ্বরের প্রেমরূপ একটি বয়ানে!
আত্মায় আত্মায় হেরি মহিমা তাহার,
মঙ্গল সুন্দর সত্য অনন্দ অপার।।
দেহের সীমাতে এ যে অনন্তের বাসা,
জন্ম জন্মান্তের পুণ্য ভবিষ্যের আশা।
এই যদি ভালবাসা ভাল বাসি তবে;
অনাদরে আদরে এ চিরদিন রবে।
বলি শােন খুলে
হেলে বিলে, বলি শােন খুলে,
ননদী বলেছে আর আসিতে দেবে না কুলে।
গৃহেতে রাখিৰে বন্ধ,
নয়ন করিবে অন্ধ,
কালােরূপ-নিধি আর দেখিতে পাব না মূলে।
হৃদি হতে প্রেমলতা শুকায়ে ফেলিবে তুলে!
সজনি লাে, মিছে কহিছি না,
কঁদিব কি – কথা শুনে হাসিয়ে বাঁচি না !
বিশ্বে যা আনন্দ পুণ্য,
যাহা বিনা সব শূন্য,
যে নারী সে প্রেমমৰ্ম্ম না জানে, সে অতি দীনা!
আহা মরি কি বুদ্ধি ধারালাে!
দেহই বাঁধিল যেন, কেমনে বাঁধিবে মন, হ্যাঁ লাে !
হৃদয়ে হৃদয়ে আঁকা,
যে মধু মতি বাকা,
প্রাণের পরাণে পূর্ণ যে অরুপ রুপ কালাে
আহা মরি বড় ফন্দী
‘শরীর করিয়ে বন্দী
হরিবে সে জীবন-জীবন্ত প্রেম-আলাে।
ভাল সই ভাল খুব ভালাে!
জানে না কি এই দীনা রাধা,
ভুবন ঈষ্পিত রূপ শ্যামেরি হৃদয় আধা?
মুদিলেও এ নয়ান
অলে আঁখে সে বয়ান,
সে মূর্তি দর্শনে তবে কেমনে কে দিবে বাধা?
হিংসুকে সখি রে হায় !
এ প্রেম ঘুচাতে চায়;
দু মুটো বালুকা দিয়ে এ বুঝি সমুদ্র বাঁধা!
কঁদিব কি হাসি তাই, বিষাদ বিস্ময়-ধাঁধা।
কেমনে ভুলি
সে ভুলেছে, আমি কেমনে ভুলি।
নূতন বসন্তে নূতন হাওয়া,
মধু নয়নে মধুর চাও,
ফুলে ফুলে পরাইয়ে দেওয়া,
থাকিয়া থাকিয়া পাপিয়া বুলি, –
হায়! সে ভুলেছে বলে কেমনে ভুলি।
গাছের তলায় খেলা ভাণ,
প্রাণের মাঝারে প্রেমের টান,
কথায় কথায় মান অভিমান
ভাল বাসে কি না এই আকুলি,
হায়! সে ভুলেছে তাই কেমনে ভুলি
ধীরে ধীরে বলা মনের কথা,
নয়নের নীরে প্রেম-আকুলতা,
পুরাতন চুলে নূতন ব্যথা
আবেগে দেখান হৃদয় খুলি
হায়! সে ভুলেছে বলে কেমনে ভুলি!
স্বপনেতে যেন আত্ম-বিনিময়,
সুখের সাগরে মগন হৃদয়,
মুহূর্তের মাঝে অনন্ত ঝিলয়,
স্বপ্নে পরিণত মত ধূলি।
ওগাে? সে কি ভােলা যায়! কেমনে ভুলি!
কি যেন নেই
তেমনি রয়েছে সব তবুও কি যেন নেই!
সেই স্নেহ, সেই প্রীতি,
সেই মধুমাখা স্মৃতি,
তেমনি ফুটিয়া ফুল প্রাণ ভরা হাসিতেই;
সকলি রয়েছে যেন কি জানি তবু কি নেই।
বাঁশি সেই ওঠে তান,
তেমনি উথলে প্রাণ,
সমুখে মুখানি সেই বাসন্তী জোছনা রাতে;
অধরে মােহন হাসি,
পরাণে স্বপন-রাশি,
চোখে চোখে চাওয়া চাওয়ি, বাঁধাবাঁধি হাতে হাতে।
তেমনি রয়েছে তবু কি যেন নাহিক তাতে!
তেমনি সকলি আছে,
শুধু সে দিনটি গেছে,
নবীন, মুহুর্ত শুধু পিছাইয়া পড়িয়াছে;
সেই সুখ, সেই হাসি,
সেই ভাল বাসা বাসি,
কথায় কথায় শুধু অশ্রুধারা থামিয়াছে।
কিছুই নাহিক তাই যদি ও সে সবি আছে!
নহে তিরস্কার
এ অশ্রু তােমার প্রতি নহে তিরস্কার,
ভুল ভাল বেসেছিলে, কি দোষ তোমার?
এখন ভেঙ্গেছে মােহ, ফুরায়ে গিয়েছে স্নেহ,
তোমার কি হাত তাহে, কপাল আমার!
কে কারে কাঁদাতে পারে এ নিখিল ভবে?
আপনার কৰ্ম্ম ফলে কেঁদে মরি সবে।
নিজ দোষে কঁদি আমি, তুমি কি করিবে, স্বামি?
ভয় নাই, এ অশ্রু না চির দিন রবে !
২.
আমি কাঁদি রাগ করে আপনার প্রতি,
ভুলিতে পারিনে বলে পুরাতন স্মৃতি।
মঙ্গল আগার ধরা, নবীন সৌন্দৰ্য্য ভরা,
তার মাঝে কেন জাগে শবের মূরতি?
আমি কাঁদি দুজনের কেন হােল দেখা,
তাই ত এ ভুল তুমি করিয়াছ, সথা!
বিশ্বাস কর হে, নাথ, তাই এই অশ্রুপাত,
ভুলিয়াছ বলে নহে তিরস্কার বাঁকা।
ভুলে যেতে গিয়াছি ভুলিয়া
মনে যেন পড়িছে এখন,
এক দিন ছিল সে আপন!
উঃ ! সে কি যুগ যুগান্তর-
জ্যোৎস্নায় মগল চরাচর,
মরমর তরুর পাতায়।
বিহগের মধুর গাথায়
উথলিত সন্ধ্যা উপবন,
উল্লসিত হৃদি প্রাণ মন,
বাহুপাশে বাঁধা দুইজনে,
চুপে কথা চুম্বনে চুম্বনে।
না জানি সে কত কাল গত!
স্মৃতি তার স্বপনের মত,
প্রাণপণে করিয়া যতন
জাগে যদি বিদ্যুত মতন,
তখনি মিলায় ধীরে ধীরে;
যে আঁধার সে আঁধারে ঘিরে।
সমুখে সেই সে অমানিশি,
স্তম্ভিত নীরব দশদিশি,
দু-জনে বসিয়া কাছাকাছি;
তবু দুরে–অতি দূরে আছি।
নক্ষত্রের ক্ষীণলােক ফুটি
দেখাইছে বিরাগ জকুটি;
অশ্রুজলে উথলিত প্রাণ,
অভিমানে বিশুষ্ক নয়ান ;
সহসা চাহিয়া নভপ্রতি
কি দেখি এ ভীম দৃশ্য অতি
অনলের বর্ষি শতধারা
চারিদিকে খসিতেছে তারা;
ক্রোধে বিশ্ব উঠেছে বাঙ্গিয়া,
সৃষ্টি বুঝি পড়ে বা ভাঙ্গিয়া!
শিহরি চকিতে মুদি আঁখি
সকাতরে ‘নাথ’ বলি ডাকি
আলিঙ্গিতে বাহু প্রসারিয়া
ভূমিতলে পড়িনু লুটিয়া।
পুনঃ যবে দেখিলাম চাহি,
চারিদিকে কোথা কেহ নাহি;
আঁধারে স্তম্ভিত চরাচর,
আমি শুধু পড়ে ভূমিপর;
কোথায় সে গিয়াছে চলিয়া,
নিতান্তই একেলা ফেলিয়া!
এই মাের প্রণয়ের স্মৃতি,
এই মোর জীবনের মায়া,
এই মাের হৃদয়ের গান,
ভুলে যেতে গিয়াছি ভুলিয়া!
পিলুবারেয়া-কাওয়ালি
এ হৃদয় বুঝিল না কেহ!
অনাদরে উপেক্ষায় সেই ফিরাইল,
হায়, যাহারে সঁপিতে গেনু এত প্রেম এত স্নেহ!
এ মরু পাষাণ ভার বহিতে পারিনে আর,
কোথায়, মরণ, তুমি চরণে শরণ দেই।
মৃত্যু না জীবন তুমি, শূন্য না আশ্রয়ভূমি?
তাপিততারণ ওহে! নিরাশ্রয়ে দাও গেহ।
তুমিও না দিলে ঠাই, তােমারো সাড়া না পাই,
পেরু দুখী বলে তােমারাে করুণ লেহ!
ঝিঁঝিটখাম্বাজ—কাওয়ালি
সখি, মাের বিরহ ভাল!
মিলনেতে পূরে সাধ, আছে তাহে অবসাদ;
কে জানে উচ্ছ্বাস স্রোত বহে কি মিললাে!
সখি, মাের বিরহ ভাল।
তীব্র সুখময় স্মৃতি, তৃষাভরা ব্যথা অতি,
চির সচেতনপ্রীতি—চির দীপ্ত আলাে :
সখি, মাের বিরহ ভালাে।
কাঁটার ব্যথা
ওগো, এ ভবে তোমরা সবে
জনি কাঁটারি ব্যথা!
তাহার হিয়াতলে কি ব্যথা জ্বলে –
কিছুই জাননা তা!
চির অভিশাপে, মহা পাপে
জীবন ধরি;
যেই ভালবেসে কাছে আসে –
শত্রু বরি!
ওগো, সেই দুরপর নিরন্তর
যারেই ভাল বাসি;
যদি, কোন মোহে ভুলি হৃদে তুলি-
অমনি প্রাণ নাশি।
ওগো, তােমরা ত দুঃখ কত
হৃদয়ে বহ –
এ মহা নিখিলে কোথা মিলে
এমন দুখী কহ!
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫ - মার্চ 17, 2024
- বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক - ফেব্রুয়ারি 26, 2024
- ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুৎমার্গের কোন স্থান নেই – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ - ফেব্রুয়ারি 21, 2024