(বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ১
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ২
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৩
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৪
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫
১৩. শাদী মুবারক
এই সময়ে মক্কানগরে কোরেশ গোত্রে এক সম্ভ্রান্ত বিধবা মহিলা বাস করিতেন। নাম তাঁহার খাদিজা। এমন সতীসাধ্বী পূণ্যময়ী নারী তখনকার দিনে আরবে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। অন্তরের শুচিতায় ও শুভ্রতায় এতই তিনি যশস্বিনী হইয়াছিলেন যে, লোকে তাঁহাকে খাদিজা না বলিয়া ‘তাহিরা’ (পবিত্রা) বলিয়া ডাকিত।
খাদিজার দুইবার বিবাহ হইয়াছিল; কয়েকটি পুত্রকন্যাও জন্মিয়াছিল। দ্বিতীয় স্বামী মৃত্যুকালে অগাধ ধন- সম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছিলেন; সেই সূত্রেই তিনি সম্পদশালিনী হইয়াছিলেন। তাঁহার বিস্তৃত বাণিজ্য ছিল। কর্মচারী দ্বারা তিনি নানাদেশে বাণিজ্য চালাইতেন এবং নিজেই সমস্ত বিষয়ের তত্ত্বাবধান করিতেন।
এদিকে আল-আমিনের গুণগরিমাও আরবের সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছে। ত্যাগ, সেবা, সততা ও চরিত্র-মাধুর্য দ্বারা তিনি সারা আরবের হৃদয় জয় করিয়া ফেলিয়াছেন। যতবারই তিনি বাণিজ্য করিতে গিয়াছেন, ততবারই তিনি প্রচুর লাভ করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন।
এই ধীশক্তিসম্পন্ন প্রতিভাবান যুবকটির কীর্তিকথা বিবি খাদিজার কর্ণে পৌঁছিতে বিলম্ব ঘটে নাই।
এই উদ্দেশ্যে খাদিজা একদিন মুহম্মদকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। দূর সম্পর্কে মুহম্মদ তাঁহার চাচাতো ভাই হইতেন। মুহম্মদ আসিলে খাদিজা বলিলেন: “আমার একটি অনুরোধ আপনি রাখিবেন কি?”
মুহম্মদ বিনীতভাবে উত্তর দিলেন “কী অনুরোধ, বলেন?”
“আমার এই তেজারতির ভার আপনাকে লইতে হইবে। ইহার জন্য আপনাকে আমি দ্বিগুণ পারিশ্রমিক দিব।” হযরত বললেন “আমার চাচাজীর মতামত লইয়া আপনাকে জানাইব।”
মুহম্মদ আসিয়া আবুতালিবকে এ কথা বলিলেন। এ প্রস্তাব তিনি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করিলেন।
কাফেলা প্রস্তুত হইল। মুহম্মদ বাণিজ্যে চলিলেন। এবার দামেশক অভিমুখে। ইয়াস্রেল, হাইফা, জেরুজালেম প্রভৃতি প্রসিদ্ধ বাণিজ্য-কেন্দ্রের মধ্য দিয়া পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করিতে করিতে মুহম্মদ দামেশকে পৌছিলেন। সর্বত্রই তাঁহার প্রভূত লাভ হইল।
দীর্ঘদিন অতিবাহিত হইয়াছে। বিবি খাদিজা মুহম্মদের আসা-পথ চাহিয়া আছেন। বিধবা হইবার পর বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি খাদিজাকে বিবাহ করিবার জন্য পয়গাম পাঠাইয়াছেন, কিন্তু তিনি কাহারও প্রস্তাব গ্রহণ করেন নাই। আজ এ কী নতন অনভূতি তাঁহার অন্তর-তলে দেখা দিল। খাদিজা কিছুই বুঝিতে পারিলেন না।
একদিন অপরাহে খাদিজা আপন গৃহের চত্বরে দাঁড়াইয়া দিগন্তের পানে চাহিয়া আছেন, এমন সময় দেখিতে পাইলেন: মরুভূমির ওপার হইতে উটের পিঠে চড়িয়া ফিরিয়া আসিতেছেন। একদৃষ্টে তিনি সেইদিকে চাহিয়া রহিলেন। মনে হইতে লাগিল, একটি বিহিশতী রঙিন স্বপ্ন যেন ধীরে ধীরে তাঁহার নয়ন-পথে রূপায়িত হইয়া উঠিতেছে।
মুহম্মদ আসিয়া সমস্ত হিসাবপত্র ও টাকাকড়ি বুঝাইয়া দিলেন। প্রচুর লাভ হইয়াছে দেখিয়া খাদিজা মুহম্মদের উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন। তাঁহার সততা ও বিশ্বস্ততা দেখিয়াও তিনি মুগ্ধ হইলেন।
দিন যায়। খাদিজার অন্তর ক্রমেই উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে তিনি সত্যই বুঝিতে পারিলেন, মুহম্মদকে তিনি ভালবাসিয়া ফেলিয়াছেন। মুহম্মদকে বিবাহ করিবার জন্য তাই তিনি ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন।
নাফিসা নাম্নী খাদিজার এক সহচরী ছিলেন। তিনি উভয় পক্ষেরই আত্মীয়া। খাদিজা তাঁহার নিকটে আপন প্রাণের গোপন কথা ব্যক্ত করলেন। মুহম্মদের মতামত জানিবার জন্য তিনি তাঁহাকে নিযুক্ত করিলেন। নাফিসা মুহম্মদের নিকট পৌছিয়া প্রসংগটি অতি সুন্দরভাবে উত্থাপন করিলেন।
মুহম্মদের প্রাণ দুলিয়া উঠিল। মুহম্মদ বলিলেন “তিনি যদি রাজী হন, আমিও রাজী।”
উভয়পক্ষই সম্মত হইলেন। বিপুল উৎসাহ ও আনন্দ-কোলাহলের মধ্য দিয়া মুহম্মদ ও খাদিজার শুভ পরিণয় সম্পন্ন হইয়া গেল। মুহম্মদের পক্ষে তাঁহার চাচা আবুতালিব এবং খাদিজার পক্ষে তাঁহার চাচা আমর-বিন-আসাদ অভিভাবকত্ব করিলেন। মাত্র সাড়ে বারো ‘উকিয়া’ (তৎকালীন মুদ্রা) পণ নির্ধারণে এই শুভ শাদী সুসম্পন্ন হইল ।
কী অপূর্ব এই মিলন! দেহের অন্তরালে অর্ন্তলোকের যে গোপন সুষমা মুহম্মদ ছিলেন তাহারই পিয়াসী। সেই সৌন্দর্য্য খাদিজার ভিতরে পরিপূর্ণ মাত্রায় ছিল বলিয়াই তিনি তাঁহার প্রতি এতদূর আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। বস্তুতঃ এ বিবাহের ঘটক স্বয়ং আল্লাহ এবং প্রকৃতপক্ষে এ বিবাহ সংঘটিত হইয়াছিল ‘আল-আমিন’ ও ‘তাহিরা-র মধ্যে – সত্য ও পবিত্রতার মধ্যে। একদিকে বিশ্বাসের জ্বলন্ত প্রতীক মুহম্মদ অপরদিকে পূণ্য ও পবিত্রতার শুভ্র প্রতিমূর্তি খাদিজা কেন তবে পরস্পর পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট না হইবে! সত্য ও পবিত্রতার আকর্ষণ এমনই সুন্দর ও স্বাভাবিক।
বলা বাহুল্য, এই বিবাহও হযরতের পয়গম্বর জীবনের আয়োজন মাত্র। ইহার মধ্যে এক অপার্থিব সম্পদ নিহিত ছিল। একদিনের জন্য নয়, দুদিনের জন্য নয়, দীর্ঘ পচিশ বৎসরকাল মুহম্মদ এই স্ত্রীর সহিত হাসি মুখে কাল কাটাইয়াছেন। খাদিজা যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন মুহম্মদ দ্বিতীয় কোন বিবাহ করেন নাই। ৬৫ বৎসর বয়সে বিবি খাদিজার মৃত্যু হয়, তখন মুহম্মদের বয়স ৫০ বৎসর। খাদিজার মৃত্যুতে হযরত গভীর মর্মবেদনা অনুভব করিয়াছিলেন। এবং আজীবন তিনি খাদিজার স্মৃতিকে পরম শ্রদ্ধাভরে বহন করিয়া চলিতেছিলেন। বিবি খাদিজার মৃত্যুর পর প্রয়োজনবোধে তিনি আরও কয়েকটি বিবাহ করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সকল স্ত্রীর ঊর্ধ্বে ছিল খাদিজার আসন। পরবর্তীকালে তরুণ-বয়স্কা বিবি আয়েষা হযরতকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন: “হে রসূলল্লাহ আপনি সর্বদা বিবি খাদিজার প্রশংসাই কেন করেন? আমি কী খাদিজার চেয়েও রূপে-গুণে শ্রেয়ঃ নহি?” তদুত্তরে হযরত বলিয়াছিলেন: “আয়েষা বিবি খাদিজা যাহা ছিলেন, তুমি তাহা নও।” ইহা দ্বারাই বুঝা যায়, খাদিজার মধ্যে মুহম্মদ কী অপরিসীম বিহিশতী সওগাত লাভ করিয়াছিলেন।
এই বিবাহ দ্বারাই আল্লার রসুল সত্যিকারভাবে মাটির মানুষ সাজিলেন, মানবীয় আবেষ্টনের মধ্যে এইবার তিনি সম্পূর্ণরূপে ধরা দিলেন। আকাশচারী নন্দন-পাখী মাটির পৃথিবীতে যেন নীড় রচনা করিল।
১৪. কা’বা-গৃহের সংস্কার
মক্কার কা’বা গৃহ চির-প্রসিদ্ধ। কোরেশগণ এই পবিত্র গৃহে বহু দেবদেবীর বিগ্রহ স্থাপন করিলেও মনে মনে তাহারা এ কথা জানিত যে, ইহা সতাই আল্লার ঘর এবং ইহার রক্ষক স্বয়ং আল্লাহ।
একটি প্রসিদ্ধ ঘটনায় তাহা সপ্রকট হইয়া আছে। ঘটনাটি এই:
হযরত মুহম্মদ যে বৎসর ভূমিষ্ঠ হন, সেই বৎসর (অনেকের মতে তাঁহার জন্মদিনেই) কা’বা গৃহের উপর এক ভীষণ বিপদ আপতিত হয়। এয়মনের খৃষ্টান শাসনকর্তা আবরাহা এক বিপল হস্তিসেনাবাহিনী লইয়া মক্কার বিরুদ্ধে অভিযান করেন। স্বীয় রাজধানীতে তিনি এক বিরাট গির্জা নির্মাণ করিয়াছিলেন এবং ইহাকে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভজনালয় ও তীর্থক্ষেত্রে পরি গত করিবার জন্য তাঁহার সাধ জাগিয়াছিল। কিন্তু মক্কায় কা’বা গৃহেই তাঁহার অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায়, কারণ পৃথিবীর প্রাচীনতম ধর্মগৃহ বলিয়া তখন ইহার খাতি দেশে হুড়াইয়া পড়িয়াছিল। এজন্য মনে মনে তিনি কাবা-মন্দিরের প্রতি ঈর্ষা পোষণ করিতে থাকেন এবং উহাকে ধ্বংস করিবার জন্য বদ্ধপরিকর হন।
তখন আব্দুল মুতালিব ছিলেন কা’বা গৃহের সংরক্ষক এবং কোরেশদিগের দলপতি। আবরাহা যখন মক্কার উপকণ্ঠে আসিয়া শিবির করিলেন, তখন ঘটনাচক্রে আব্দুল মুতালিবের দই শত উট আবরাহার সৈন্যদিগের কবলে পতিত হয়। আব্দুল মতালিব এই সংবাদ পাইয়া আবরাহার শিবিরে উপস্থিত হন এবং তাঁহার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেন। আবরাহা ভাবিলেন, আব্দুল মুতালিব নিশ্চয়ই ভীত হইয়া সন্ধির প্রস্তাব করিতে আসিয়াছেন। ইহাই ভাবিয়া তিনি তাঁহাকে সাক্ষাৎ মঞ্জুর করিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, আব্দুল মুতালিব আবরাহার নিকট উপস্থিত হইয়াই বলিতে লাগিলেন: “দয়া করিয়া আমার উটগুলি ফিরাইয়া দিন।” আবরাহা আশ্চর্যান্বিত হইয়া বলিলেন: “বেশ তো মজার লোক আপনি একটু পরেই যে আমি আপনার কা’বা মন্দিরকেই ধূলিসাৎ করিয়া দিব সে সম্বন্ধে কোন কথা না বলিয়া আপনি শুধু, আপনার কয়েকটি উটের জন্যই ব্যগ্র হইয়া উঠিয়াছেন দেখিতেছি!” এই বলিয়া তিনি একট, বিদ্রূপের হাসি হাসিলেন। তখন আব্দুল মাতালিব দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দিলেন, “কা’বা গৃহের জন্য আমার মাথা ব্যথা নাই। কাবার মালিক আল্লাহ। আল্লাই উহা রক্ষা করিবেন। উটের মালিক আমি, তাই উটগুলি রক্ষা করিতে আসিয়াছি।”
আবরাহা হো-হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
যথাসময়ে তিনি কাবা আক্রমণ করিতে চলিলেন। অগণিত শত্রুসেনার বিরুদ্ধে বাধা দেওয়া নিরর্থক মনে করিয়া কোরেশগণ মক্কা ছাড়িয়া পর্বতগুহায় আশ্রয় লইল। তখন আব্দুল মুতালিব কাবাগৃহের আঙিনায় দাঁড়াইয়া এই বলিয়া প্রার্থনা করিলেন: “হে আল্লাহ, আমরা দুর্বল, তোমার ঘর তুমি রক্ষা কর।”
আব্দুল মুতালিবের এই প্রার্থনা আল্লাহ সত্যই কবুল করিয়াছিলেন। আবরাহার সৈন্যদল যখন কা’বা মন্দির আক্রমণ করিতে অগ্রসর হইল, তখন এক অদ্ভুত কান্ড ঘটিয়া বসিল। আবরাহার হস্তী কিছুতেই আর কা’বার দিকে অগ্রসর হইতে চাহে না, কা’বার উদ্দেশে মাথা নোয়াইয়া সে শুইয়া পড়ে। কত মারধর করা হইল, কিন্তু কিছুতেই কোন ফল হইল না। অন্য যে কোন দিকে মুখ ফিরিইয়া দিলে সে উঠিয়া হাঁটা দেয়, কিন্তু কাবা’র দিকে মুখ ফিরাইলেই শুইয়া পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আর এক বিপদ দেখা দিল। হঠাৎ কোথা হইতে ঝাঁকে ঝাঁকে লাখে লাখে আবাবিল পাখী উড়িয়া আসিতে লাগিল। তাহাদের প্রত্যেকের মুখে এক একটি কঠিন প্রস্তর-খণ্ড। প্রস্তরখণ্ডগুলি তাহারা বৃষ্টিধারার মত আবরাহা সৈন্যদিগের মস্তকে অবিরত নিক্ষেপ করিতে লাগিল। সেনাদল দিশেহারা হইয়া ফিরিয়া চলিল। কিন্তু কেহই রেহাই পাইল না, যে যেখানে ছিল, সেইখানেই মৃত্যুমুখে পতিত হইল। এইরূপে নিমেষের মধ্যেই আবরাহা ও তাঁহার বিপুল বাহিনী নিশ্চহ্ন হইয়া গেল।*
[*ইবনে ইসহাক (ইংরাজী হইতে)]
কুরআন শরীফে এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া আল্লাহ বলিতেছেন:
“তুমি কি দেখ নাই তোমার প্রভু কেমন করিয়া গজপতির সহিত ব্যবহার করিলেন? তিনি কি তাহার যুদ্ধ-প্রচেষ্টাকে ছিন্নভিন্ন করিয়া দেন নাই? ঝাঁকে ঝাঁকে ‘আবাবিল’ পক্ষীকে তাহাদের উপর পাঠান নাই- যাহারা তাহাদিগকে শক্ত পাথর ঠুকিয়া মারিয়া ফেলিয়াছিল? এইরূপে তিনি তাহাদিগকে ভক্ষিত তৃণের ন্যায় নিশ্চিহ্ন করিয়া ছাড়িয়াছেন।”
(সূরা ফিল)
এমনই ছিল কা’বা গৃহের মাহাত্ম্য।
হযরত মুহম্মদের আবির্ভাবকালে কাবা গৃহের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় হইয়া পড়িয়াছিল। ইহার চতুষ্পার্শ্ব প্রাচীর বেষ্টিত না থাকায় বর্ষার সময় ভিতরে পানি ঢুকিয়া পড়িত। তা ছাড়া উপরে কোন ছাদ ছিল না বলিয়া সময়ে সময়ে ইহার আসবাবপত্রও চুরি যাইত। এই সব কারণে কোরেশগণ বহুদিন হইতে কা’বা গৃহের মেরামতের জল্পনা-কল্পনা করিতেছিলেন।
এই সময়ে জেদ্দা-বন্দরে হঠাৎ একখানি জাহাজ বানচাল হইয়া যাওয়ায় কোরেশদিগের কা’বা মেরামতের আগ্রহ আরও বাড়িয়া গেল। জাহাজখানির তক্তাগুলি তাঁহারা সস্তাদরে কিনিয়া আনিলেন এবং তাহাই দিয়া মেরামত কার্য আরম্ভ করিলেন।
কোরেশ দলপতিগণ সকলেই বেশ মিলিয়া মিশিয়া কাজ করিতেছিলেন, কিন্তু হঠাৎ একটি বিভ্রাট ঘটিল। কা’বা গৃহের প্রাংগণে যে কৃষ্ণপ্রস্তরখান ছিল, তাহা তুলিয়া আনিয়া নির্দিষ্ট স্থানে কাহারা স্থাপন করিবে, ইহাই লইয়া দলপতিদিগের মধ্যে বিরোধ উপস্থিত হইল। প্রস্তরখানির সহিত সামাজিক মর্যাদা ও কুলগত প্রাধান্যের সম্বন্ধ ছিল। কাজেই প্রত্যেক গোত্রই উহা তুলিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিল। প্রথমে বচসা, তারপর তুম কোলাহল আরম্ভ হইল। চারিটি দিন এইভাবে কাটিয়া গেল, কিন্তু কোনই মীমাংসা হইল না। তখন চিরাচরিত প্রথানুসারে সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইল। যুদ্ধ যখন একেবারে অনিবার্য হইয়া উঠিল, তখন জ্ঞানবৃদ্ধ আবু উমাইয়া সকলকে আহ্বান করিয়া বলিলেন: “ক্ষান্ত হও, আমার কথা শোন। সামান্য কারণে কেন রক্তপাত করিবে? ধৈর্য্য ধরিয়া অপেক্ষা কর। আমার প্রস্তাব যে ব্যক্তি আজ সর্বপ্রথম কা’বা মন্দিরে প্রবেশ করিবে, তাহার উপরেই বিবাদের ফয়সালার ভার অর্পণ করা যাউক। সে যে সিদ্ধান্ত করিবে, তাহাই আমরা মানিয়া লইব। ইহাতে তোমরা রাজী আছ?”
বৃদ্ধের এই প্রস্তাবে সকলেই সম্মত হইলেন। প্রত্যেকের মনে কত চিন্তার উদ্রেক হইতে লাগিল। যে আসিবে, সে কেমন লোক হইবে, কোন পক্ষে সে রায় দিবে, তাহার সিদ্ধান্ত যদি সকলের মনঃপুত না হয় তখন কী ঘটিবে।
এমন সময় সমবেত কণ্ঠে ধ্বনি উঠিল: “এই যে আমাদের আল-আমিন, আসিতেছেন। আমরা তাঁহার সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই মানিয়া লইব।” মুহম্মদ তখন তরুণ যুবকমাত্র। কিন্তু মক্কাবাসীদের কী অগাধ বিশ্বাস তাঁহার উপর।
মুহম্মদ আসিলে সকলে তাঁহাকে সমস্ত ব্যাপার বুঝাইয়া দিলেন। তখন তিনি বলিলেন: “বেশ ভাল কথা। যে-সকল গোত্র কৃষ্ণপ্রস্তর তুলিবার দাবী করিতেছেন, তাঁহাদের প্রত্যেকে নিজেদের মধ্য হইতে এক-একজন প্রতিনিধি নির্বাচিত করুন।”
ঠিক তাহাই করা হইল। তখন হযরত সেই প্রতিনিধিদিগের সংগে লইয়া কৃষ্ণপ্রস্তরের নিকট উপস্থিত হইলেন। একখানি চাদর বিছাইয়া নিজে সেই প্রস্তরখানিকে উহার মধ্যস্থলে স্থাপন করিলেন। তারপর প্রতিনিধি-গণকে বলিলেন: “এইবার আপনারা প্রত্যেকেই এই চাদরখানির এক এক প্রান্ত ধরিয়া পাথরখানিকে যথাস্থানে লইয়া চলুন।”
সকলে তাহাই করিলেন। গন্তব্য স্থানে উপনীত হইলে মুহম্মদ পনরায় প্রস্তরখানি নিজহস্তে তুলিয়া যথাস্থানে স্থাপন করিলেন। এই বিচারে সকলেই সন্তুষ্ট হইলেন। মুহম্মদের বিচক্ষণতায় একটা আসন্ন সমরানল হইতে আরব-ভূমি রক্ষা পাইল।
এই ব্যাপারটার মধ্যে একটা গূঢ় তাৎপর্য নিহিত আছে। ‘হযরে আসওয়াদ’ বা কৃষপ্রস্তরখানি ইসলামের এক অতি পবিত্র বস্তু। ‘হযরত আদমের স্পর্শ, ফিরিশতাদিগের স্পর্শ ও হযরত ইব্রাহিমের স্পর্শ উহাতে জড়িত রহিয়াছে। ঐ প্রস্তরখানি হইতেছে ‘আল্লার ঘরের’ ভিত্তিপ্রস্তর। কাজেই, সেই ‘আল্লার ঘরের নবপ্রতিষ্ঠার দিনে এই পবিত্র প্রস্তর কি হযরত মুহম্মদের হস্তেই স্থাপিত হওয়া সঙ্গত হয় নাই? পক্ষান্তরে ইসলামের ভবিষ্যতের একখানি উজ্জ্বল চিত্রও ইহার মধ্যে ফুটিয়া উঠিয়াছে। ধর্ম লইয়া জগতে বিভিন্ন মতাবলম্বীদিগের মধ্যে যে বিরোধ উপস্থিত হইবে এবং সে বিরোধের মীমাংসা না করিতে পারিয়া অবশেষে সকলেই যে একজন আগন্তুকের প্রতীক্ষা করিবে এবং বিবদমান সকল পক্ষই যে তাঁহারই সিদ্ধান্ত মানিয়া লইবে, সমস্ত বিরোধ ও বৈষম্য দূর করিয়া তিনিই যে সাম্য, মৈত্রী ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত করিবেন এই মহাসত্যই যেন এই ক্ষুদ্র ঘটনার মধ্য রূপায়িত হইয়া উঠিল।
অনেকে এই প্রস্তর চুম্বনের মধ্যে পৌত্তলিকতার গন্ধ পান, কিন্তু এর নাম পৌত্তলিকতা নয়। ইসলামের মূল সুরই হইতেছে সংস্কার বা শুদ্ধিকরণ— সংহার বা মূলোৎপাটন নয়। কৃষ্ণপ্রস্তরের ব্যাপারে এই সত্যই প্রতিপন্ন হয়। প্রত্যেক কার্যের দোষগুণে তার নিয়তের উপর নির্ভর করে। মূর্তি-অংকিত মুদ্রা অহরহ ব্যবহার করিলেও যেমন তাহা মূর্তি পূজা হয় না, বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে কৃষ্ণপ্রস্তরকে চুম্বন করিলেও তেমনি তাহাকে মূর্তিপূজা বলা যায় না। মানবজাতির অতীত কাহিনীর এ যেন এক প্রস্তরীভূত ইতিহাস। ইসলামের ঐতিহাসিক চেতনার এ এক সুন্দর নিদর্শন।
বাছবিচার
Latest posts by বাছবিচার (see all)
- (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫ - মার্চ 17, 2024
- বাংলা প্রচলিত হবে যে সময় শিক্ষকরা প্রথম প্রথম একটু ইনকমপিটেনটলি (incompetently) কিন্তু পারসিসটেনটলি (persistently) বাংলায় বলা অভ্যাস করবেন (১৯৮৫) – আবদুর রাজ্জাক - ফেব্রুয়ারি 26, 2024
- ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি বা ছুৎমার্গের কোন স্থান নেই – মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ - ফেব্রুয়ারি 21, 2024