Main menu

(বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ১

কবি গোলাম মোস্তফার (১৮৯৭ – ১৯৬৪) এই বইটা ফার্স্ট ছাপা হয় ১৯৪২ সালে। এরপরে বইটার অনেকগুলা পাবলিকেশন্স থিকা অনেকগুলা এডিশনই ছাপা হইছে। ১৯৫৬ সালে ছাপানো ভার্সন ফলো করা হইছে এইখানে।

গোলাম মোস্তফার লেখা কোন অংশ এইখানে বদলানো হয় নাই; বরং কিছু অংশ স্কিপ করা হইতেছে, যেইটা বাদ দিলে বা উহ্য রাখলেও একটা কমপ্লিট টেক্সট হিসাবে পড়তে কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না। এমনিতে পুরা বই যদি কেউ পড়তে চান, ই-বুক, পিডিএফ এবং ছাপানো-বই হিসাবে তো অনেক জায়গাতেই এভেইলেবল আছে।  

তো, শর্ট-ভার্সনটাও পড়তে পারেন।

নতুন ভারতীয় সংস্করণের ভূমিকা

‘বিশ্বনবী’র নতুন ভারতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখিতে বসিয়া আজ শুধু বারে বারে আল্লাতালার করুণার কথাই মনে পড়িতেছে। কোন পুস্তকের আটটি সংস্করণের ভূমিকা লিখিবার সৌভাগ্য খুব কম লেখকের ভাগ্যেই ঘটিয়া থাকে।

এই সংস্করণের আগাগোড়া এবার আমি দেখিয়া দিয়াছি, স্থানে স্থানে কিছু কিছ সংশোধন, পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করিয়াছি। কিছ কিছু নতুন তথ্যও সংযোজিত হইয়াছে।

গতবার পুস্তকের জ্যাকেট না দেওয়ায় অনেকেই ক্ষুন্ন হইয়াছিলেন। এবার সে অভাব পূর্ণ করা হইল। মুদ্রণ-পারিপাট্যও পূর্বাপেক্ষা এবার উন্নত হইয়াছে।

বিশ্বনবীর অনেক স্থানে কোরান শরীফের আয়াত উদ্ধৃত করা হইয়াছে। মূল আরবী আয়াত না দিয়া শুধু বাংলা তর্জমা দিয়াছি। সেই সব তর্জমার কোন কোন স্থানে আল্লা সম্বন্ধে ‘আমরা’ (বহুবচন) ব্যবহৃত হইয়াছে। যেমন :

“এবং যে কেহ এই দুনিয়ার পুরস্কার চায়, তাহাকে আমরা তাহাই দেই এবং যে কেহই পরকালের পুরস্কার চায়, তাহাকেও আমরা তাহাই দেই। আমরা কৃতজ্ঞদিগকে পুরুস্কৃত করিব।” – (৩:১৪৫)

এখানে আল্লার পরিবর্তে ‘আমরা’ শব্দের ব্যবহার দেখিয়া অনেক পাঠকের মনেই প্রশ্ন জাগে। তাঁহারা ভাবেন : আল্লা এক, অদ্বিতীয় ও লা-শরীক; কাজেই তাঁহার সম্বন্ধে ‘আমরা’ (বহুবচন) ব্যবহার করা যাইতে পারে না। তাই অনেকের ধারণা ইহা তর্জমার ভুল। কিন্তু তর্জমায় কোন ভুল হয় নাই। তজমা ঠিকই আছে। অন্য একটি গূঢ় কারণে ‘আমি’ স্থলে ‘আমরা’ লিখিতে হইয়াছে। আরবী ভাষায় সম্মানীয় ব্যক্তিদিগের বেলায় বহুবচন ব্যবহৃত হয়। ইহাকে সম্মানার্থে বহুবচন বলে। অন্যান্য ভাষাতেও এ বাক্-রীতি প্রচলিত আছে। কোন রাজকীয় ঘোষণায় সম্রাট, সম্রাজ্ঞী বা রাষ্ট্রপতি উত্তম পুরুষের বহুবচন (আমরা) ব্যবহার করেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ মহারাণী ভিক্টোরিয়ার ঘোষণাপত্রের (Queen’s Proclamation) উল্লেখ করা যাইতে পারে। সেখানে ‘We’ (আমরা) ব্যবহৃত হইয়াছে। বলা বাহুল্য, এই রীতি কোরান শরীফের নিজস্ব। আল্লা নিজেই এই বাচন-ভঙ্গী শিক্ষা দিয়াছেন। ‘আমি’ না বলিয়া ‘আমরা’ বলিয়াছেন। কাজেই তর্জমার ভুল হইয়াছে—পাঠক যেন সেরূপ মনে না করেন। মূলে বহুবচন আছে বলিয়াই তর্জমাতেও বহুবচন আসিয়াছে। উপরের আয়াতের ইংরাজী তর্জমাতেও ‘We’ শব্দ আছে :

“And whoever desires the reward of this world We will give him of it and whoever desires the reward of the hereafter, We will give him of it, and We will reward the grateful.” – Moulana Muhammad Ali

আল্লামা ইউসুফ আলি একই রীতি অনুসরণ করিয়াছেন। উপরোক্ত আয়াতের অনুবাদে তিনি লিখিতেছেন: “If any do desire a reward in this life, We shall give it to him….”.

বস্তুতঃ অনুবাদ ঠিক রাখিতে হইলে মূলের সহিত তাহার মিল রাখিতেই হইবে। বলা বাহুল্য, এই কারণেই বাংলা তর্জমায় আল্লার স্থানে বহুবচন ব্যবহার করা হইয়াছে।

বহু সতর্কতা সত্ত্বেও এবারেও কিছ, কিছু, ছাপার ভুল রহিয়া গেল। তবে সেগুলি বিশেষ মারাত্মক নয়। পাঠক-পাঠিকা সেগুলি নিজেরই সংশোধন করিয়া লইবেন।

আরয ইতি-

বিনীত
গোলাম মোস্তফা

১: আর্বিভাব

রবিউল-আউয়াল মাসের মাসের বারো তারিখ।
সোমবার।

শ্লুকা-দ্বাদশীর অপূর্ণ-চাঁদ সবেমাত্র অস্ত গিয়াছে। সুবহে-সাদিকের সূর্য নূরে পুব-আসমান রাঙা হইয়া উঠিতেছে। আলো-আঁধারের দোল খাইয়া ঘুমন্ত প্রকৃতি আঁখি মেলিতেছে।

আরবের মরু-দিগন্তে মক্কা-নগরীর এক নিভৃত কুটীরে একটি নারী ঠিক এই সময়ে সুখস্বপ্ন দেখিতেছিলেন।

তাঁহার নাম আমিনা।

এই সুন্দর মুহূর্তে আমিনা এক পুত্ররত্ন প্রসব করিলেন। আঁখি মেলিয়া চাহিয়া দেখিলেন: কোলে তাঁহার পূর্ণিমার চাঁদ হাসিতেছে।

কে এই নব অতিথি – কে এই বেহেশতী নূর – যাহার আর্বিভাবে আজ দ্যুলোক-ভুলোকে এমন পুলক শিহরণ লাগিল?

এই মহামানবশিশুই আল্লার প্রেরিত সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বশেষ পয়গম্বর – নিখিল বিশ্বের অনন্ত কল্যাণ ও মূর্ত আর্শীবাদ – মানবজাতির চরম এবং পরম আদর্শ – স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি – বিশ্বনবী –

– হযরত মুহম্মদ –
(সাল্লাল্লাহু আলায়া হি অ-সাল্লাম)

২: কোন আলোকে?

কে এই মুহম্মদ?* তাঁহার প্রকৃত স্বরূপ কী? সত্য পরিচয় কী?

হযরত মুহম্মদের জীবনালোচনা করিতে হইলে আমাদের দৃষ্টিকোণ সম্বন্ধে প্রথমেই সর্তক হইতে হবে; অন্যথায় আমরা তাঁহাকে সম্যকরূপে চিনিতে ও বুঝিতে পারিব না – তাঁহার জীবনের অনেক ঘটনাই আমাদের কাছে হয়ত বিসদৃশ বোধ হইবে।
হযরত মুহম্মদকে যারা কেবলমাত্র ‘অতিমানুষ’ রূপে মানব-গন্ডীর ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিবেন, তাহারাও যেমন ভুল করিবেন, যাহারা তাঁহাকে আমাদেরই মতো ‘মাটির মানুষ’ বলিয়া ধরার ধূলায় টানিয়া রাখিবেন, তাহারাও ঠিক তেমনই ভুল করিবেন।

হযরত মুহম্মদ ছিলেন মানুষ ও অতিমানুষের মিলিত রূপ। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে তিনি ছিলেন যোগসূত্র।

আল্লাহ্ নিরাকার। তিনি কাহাকেও জন্ম দেন না, কাহারও দ্বারা তিনি জাতও নহেন। তিনি এক, অথচ সৃষ্টি বহু ও বিচিত্র। স্রষ্টা নিরাকার, অথচ সৃষ্টি সাকার।

কেমন করিয়া অরূপ হইতে রূপে, নিরাকার হইতে সাকারে পৌঁছা যায়? এপারে-ওপারে কি করিয়া সংযোগ রাখা সম্ভব হয়?

একজন বাহন বা medium-এর এখানে নিতান্ত প্রয়োজন। এই মাধ্যমই হইতেছেন হযরত মুহাম্মদ। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মাঝে তিনি মিলনসূত্র। একদিকে যেমন তিনি আল্লার প্রতিনিধি, অপরদিকে তেমনই তিনি আমাদেরও প্রতিনিধি। একদিকে তিনি আল্লার বাণী বহন বহন করিয়া আনিয়া সৃষ্টির প্রাণের দুয়ারে পৌঁছাইয়া দেন, অপরদিকে তেমনই সৃষ্টির ব্যথা-বেদনা ও অভাব-অভিযোগ আল্লার দরবারে পেশ করেন। কাজেই তাঁহাকে লইয়া স্রষ্টা ও সৃষ্টি – উভয়েরই এত প্রয়োজন।

আল্লার তরফ হইতে তিনি তাঁহার প্রেরিত রসুল। আবার মানুষের তরফ হইতে তিনি অহি-নাজিল হওয়া মানুষ।

হযরত মুহম্মদকে দেখিতে ও চিনিতে হইলে আমাদের দৃষ্টিকোণকে প্রথম হইতে এই ভঙ্গিতে বাঁধিয়া লইতে হইবে অন্যথায় আমরা তাঁহার সাচ্চা চেহারা দেখিতে পাইব না।


*হযরত মুহম্মদের নামোল্লোখের সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার উপর দরুদ পাঠ করা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য। আশা করি পাঠক-পাঠিকা নিষ্ঠার সহিত সে কর্তব্য পালন করিবেন।

৩: প্রতিশ্রুত পয়গম্বর (Promised Prophet)

হযরত মুহম্মদ ছিলেন “প্রতিশ্রুত পয়গম্বর” অর্থাৎ আল্লাহ্ যে তাঁহাকে দুনিয়ায় পাঠাইবেন, একথা পূর্বেি্ তিনি বিঘোষিত করিয়া রাখিয়াছিলেন। একটি হাদিসে তাই আসিয়াছে: “(হযরত মুহম্মদ বলিতেছেন) সর্বপ্রথমেই আল্লাহ্ যাহা সৃষ্টি করেন তাহা আমার নূর।”

এই নূরে-মুহম্মদীই হইতেছেন প্রথম সৃষ্টি। সারা সৃষ্টি তাঁহার নূরে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল। চাঁদে-চাঁদে তারায়-তারায় গ্রহে-গ্রহে লোকে-লোকে তাঁহার ধ্যানমূর্তি একটা জ্যোর্তিময় ছায়া ফেলিয়াছিল।

প্রতিশ্রুত পয়গম্বরকে (promised prophet) এই অর্থেই গ্রহণ করিতে হইবে। প্রতিশ্রুত পয়গম্বর তিনি – যাঁর আর্বিভাব সৃষ্টির নীতি হিসাবেই অংগীকৃত হইয়া থাকে। সৃষ্টিতত্ত্বের স্বাভাবিক নিয়মে যাহা অনিবার্য, আর্বিভাবের পূর্বে তাহাই প্রতিশ্রুত। ‘মুহম্মদ’ আসিবেন একথা তাই বিশ্ব-নিখিলের অবিদিত ছিল না। বেদ-পুরাণ, জিন্দাবেস্তা দিঘা-নিকায়া, তাওরাৎ, জবুর, বাইবেল প্রভৃতি পুরাকালীন প্রধান প্রধান ধর্মগ্রন্থেই তাই মুহম্মদের গুণগান ও তাঁহার আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী বিঘোষিত হইয়াছে।

বেদ-পুরাণে

বেদ-পুরাণ এবং উপনিষদ হিন্দুদিগের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এইসব প্রাচীন ধর্ম-শাস্ত্রে ‘আল্লা’ ‘রসুল’ ‘মহম্মদ’ ইত্যাদি শব্দ কিরূপভাবে উল্লিখিত হইয়াছে দেখুন:

অথর্ববেদীয় উপনিষদে আছে:
অস্য ইল্ললে মিত্রাবরণো রাজা
তস্মাৎ তানি দিব্যানি পুনস্তং দুধ্যু
হবয়ামি মিলং কবর ইল্ললাং
অল্লোরহসুলমহমদরকং
বরস্য অল্লো অল্লাম ইল্লল্লেতি ইল্লল্লা ॥ ৯॥

ভবিষ্য পুরাণে আছে :
এতস্মিন্নস্তরে ম্লেচ্ছ আচার্যেন সমন্বিতঃ।
মহামদ ইতি খ্যাতঃ শিষ্যশাখাসমন্বিতঃ ॥ ৫ ॥
নৃপশ্চৈব মহাদেবং মরুস্থলনিবাসিনম
গঙ্গাজলৈশ্চ সংস্পাপ্য পঞ্চগবাসমবিতৈঃ
চন্দনাদিভিরভার্চ তুষ্টাব মনসা হরম ॥ ৬ ॥
নমস্তে গিরিজানাথ মরুস্থলনিবাসিনে
ত্রিপুরাসূরেনাশায় বহুমায়াপ্রবর্তিনে ॥ ৭॥

‘অল্লোপনিষদের’ একটি স্থানে দেখিতে পাওয়া যায় :

হোতারমিন্দ্রো হোতারমিন্দ্রো মহাসুরিন্দ্রাঃ।
অল্লো জ্যেষ্ঠং শ্রেষ্ঠং পরমং পূর্ণং ব্রহ্মাণ অল্লাম ॥
আল্লাহ রসুলমহমদরকং বরস্য অল্লো অল্লাম ।
আদল্লাবুকমে ঝকম অজ্ঞাবুক নিখাতকম ॥ ৩॥

উপরোক্ত উদ্ধৃতিসমূহে হইতে পাঠক নিশ্চয়ই অনুমান করিতে পারিতেছেন যে, আর্য ঋষিগণ ধ্যানবলে বহু শতাব্দী পূর্বেই মহম্মদের স্বরূপ ও আবির্ভাব সম্বন্ধে অনেক তথ্য অবগত ছিলেন।

বৌদ্ধ শাস্ত্রে

বৌদ্ধদিগের প্রামাণ্য গ্রন্থ ‘দিঘা-নিকায়ায়’ উল্লিখিত হইয়াছে:

“মানুষ যখন গৌতম বুদ্ধের ধর্ম ভূলিয়া যাইবে, তখন আর একজন বৃদ্ধ আসিবে, তাঁহার নাম ‘মৈত্রিয়’ (সংস্কৃত মৈত্রেয়) অর্থাৎ শান্তি ও করুণার বুদ্ধ।”

আমরা নিম্নে সিংহল হইতে প্রাপ্ত (from Ceylonese sources) একটি প্রমাণের উল্লেখ করিতেছি। তাহাতেও উপরোক্ত কথার সমর্থন আছে:

“আনন্দ বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনার মৃত্যুর পর কে আমাদিগকে উপদেশ দিবে?
বুদ্ধ বলিলেন: আমিই একমাত্র বুদ্ধ বা শেষ বুদ্ধ নই। যথাসময়ে আর একজন বুদ্ধ আসিবেন – আমার চেয়েও তিনি পবিত্র ও অধিকতর আলোকপ্রাপ্ত— তিনি একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্মমত প্রচার করিবেন – ।
আনন্দ জিজ্ঞাসা করিলেন, তাঁহাকে আমরা চিনিৰ কি করিয়া?
বুদ্ধ বলিলেন তাঁর নাম হইবে মৈত্রেয়।
এই ‘শান্তি ও করানোর বুদ্ধ’ (মৈত্রেয়) যে মুহম্মদ, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই; কুরআন শরীফে মুহম্মদের বিশেষণও অবিকল এইরূপই আছে। মুহম্মদ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে। তিনি ‘রহমতুল্লিল আলামিন” অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের জন্য মূর্ত করুণা ও আশীর্বাদ।

পাশী ধর্মশাস্ত্রে

পার্শী জাতির ধর্মগ্রন্থের নাম ‘জিন্দাবিস্তা’ ও ‘দসাতির’। জিন্দাবিস্তায় হযরত মুহম্মদের আবির্ভাবের সুস্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী রহিয়াছে। এমন কি ‘আহম্মদ’ নামটি পর্যন্ত উল্লিখিত রহিয়াছে। আমরা মূল শ্লোক ও তাহার অনুবাদ দিলাম—

“Noid te Ahmad dragoyeitim fram-raomi
Spetama Zarathustra yam dahmam vangnim afritim.
Yunad haka hahi humananghad hvakanghad
Hushyanthnad hudaenad.”
(Zend-Avesta, Part 1, Translated by Max Muller, p. 260)

অর্থাৎ : “আমি ঘোষণা করিতেছি, হে স্পিতাম জরাথুষ্ঠ পবিত্র আহমদ (ন্যায়বানদিগের আশীর্বাদ) নিশ্চয়ই আসিবেন যাঁহার নিকট হইতে তোমরা সৎ চিন্তা, সৎ বাক্য, সৎ কার্য এবং বিশুদ্ধ ধর্ম লাভ করিবে।”

‘দসাভির’ গ্রন্থেও অনুরূপ আর একটি ভবিষ্যদ্বাণী আছে। উহার সারমর্ম এইরূপ:

“যখন পার্শীরা নিজেদের ধর্ম ভুলিয়া গিয়া নৈতিক অধঃপতনের চরম সীমায় উপনীত হইবে, তখন আরবদেশে এক মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করিবেন—যাঁহার শিষ্যেরা পারশ্যদেশ এর দুর্ধর্ষ পারশিক জাতিকে পরাজিত করিবে। নিজেদের মন্দিরে অগ্নিপূজা না করিয়া তাহারা ইব্রাহিমের কা’বা-ঘরের দিকে মুখ করিয়া প্রার্থনা করিবে; সেই কা’বা প্রতিমা-মুক্ত হইবে। সেই মহাপরুষের শিষ্যেরা বিশ্ববাসীর পক্ষে আশীর্বাদস্বরূপে হইবে।”

“তাঁহারা পারশ্য, মাদায়েন, তুস, বলখ প্রভৃতি পারশিকদের যাবতীয় পবিত্র স্থান অধিকার করিবে। তাহাদের পয়গম্বর একজন বাগ্মী পুরুষ হইবেন এবং তিনি অনেক অদ্ভুত কথা বলিবেন।”
-Muhammad in World Scriptures. (by A. Huq Vidyarthi, p. 47)

তাওরাতে

ইহুদীদিগের ধর্মশালা ‘তাওরাতে নিম্নলিখিত ভবিষ্যবাণী আছে:
“তোমাদের প্রভু ঈশ্বর তোমাদের ভ্রাতৃদিগের মধ্য হইতে আমার (মুসার) মতই একজন পয়গম্বর উত্থিত করিবেন; তাঁহার কথা তোমরা মনোযোগ দিয়া শ্রবণ করিবে।” (Duet, 15: 18)

অন্যত্র আছে :
“(ঈশ্বর বলিতেছেন) আমি তোমাদের ভ্রাতৃদিগের মধ্য হইতে তোমার (মুসার) মতই একজন পয়গম্বর উত্থিত করিব এবং তাঁহার মুখে আমার বাণী প্রকাশ করিব। তিনি তোমাদিগকে আমি যাহা আদেশ করিব তাহাই শুনাইবেন। এবং ইহা অবশ্য ঘটিবে যে তাঁহার মুখ-নিঃসৃত আমার সেই বাণী যাহারা শুনিবে না, তাহাদিগকে আমি নিতে বাধ্য করিব।” (Duet, 18: 18-19)

আরও একটি দৃষ্টান্ত দেখুন:
“এবং ঈশ্বরের মনোনীত পরুষ মুসা মৃত্যুর পূর্বে এই বলিয়া বনি- ঈসরাইলদিগকে আশীর্বাদ করিলেন:
এবং তিনি বললেন: প্রভু (মুসা) সিনাই পর্বত হইতে আসিলেন এবং সিয়ের (Seir) পর্বত হইতে উঠিলেন, কিন্তু তাঁহার (অর্থাৎ যিনি আসিবেন) জ্যোতিঃ ফারাণ পর্বত হইতে বিকীর্ণ হইল; তিনি দশ হাজার ভক্ত সঙ্গে আনিলেন এবং তাহার দক্ষিণ হস্ত হইতে এক জীবন্ত আইনগ্রন্থ বাহির হইল।” (Duet, 33 : 1-2 )

এই সমস্ত উক্তি যে একমাত্র হযরত মুহম্মদ সম্বন্ধেই প্রযোজ্য, বিদগ্ধ ব্যক্তিমাত্রেই তাহা স্বীকার করিবেন।

বাইবেলে

হযরত মহম্মদের আবির্ভাব সম্বন্ধে বাইবেল হইতেও বহু প্রমাণ দেওয়া যায়। আমরা নিম্নে কয়েকটি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করিতেছি :

যিশুখৃষ্টের সমসময়ে সাধু যোহন (St. John) আবির্ভূত হইয়াছিলেন। তিনি যখন সকলকে বাপ্তাইজ করিয়া বেড়াইতেছিলেন, তখন জেরুজালেম হইতে ইহুদীরা কতিপয় পাদ্রীকে তাঁহার পরিচয় লইবার জন্য পাঠাইয়া দেন। তাঁহারা আসিয়া যোহনকে যে কয়টি প্রশ্ন করেন এবং যোহন তাহার যে উত্তর দেন, তাহাতেই হযরত মুহম্মদের আবির্ভাবের খবর পাওয়া যায়। বাইবেলে এইরূপ উল্লিখিত হইয়াছে :

“যোহান সম্বন্ধে এইরূপে লিখিত হইয়াছে যে, যখন জেরুজালেম হইতে ইহুদীদের দ্বারা প্রেরিত কতিপয় পাদ্রী যোহানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি কে? তখন যোহান স্বীকার করিলেন, আমি যিশুখৃষ্টে নহি। তখন তাঁহারা জিজ্ঞাসা করিলেন, তবে আপনি কে? আপনি কি ইলিয়াস? তিনি বলিলেন, আমি ইলিয়াস নহি। আপনি তবে কি সেই নবী? যোহান উত্তর দিলেন, না।
তখন তাঁহারা আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, যদি আপনি যিশুখৃষ্ট, ইলিয়াস, অথবা সেই নবী না হন, তবে কেন বাপ্তাইজ করিতেছেন?
যোহান উত্তর দিলেন, আমি পানি দ্বারা বাপ্তাইজ করি, কিন্তু তোমাদের মধ্যে এমন একজন আসিবেন যাহাকে, তোমরা জান না।
তিনিই সেইজন যিনি আমার পরে আসিয়াও আমা অপেক্ষা সম্মানের অধিকারী হইবেন এবং আমি যাহার জুতার ফিতা খুলিবারও যোগ্য নহি।”
(John. Chap. 1: 19-27)

এখানে স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে যে যিশুখৃষ্ট এবং ইলিয়াস ছাড়া তৃতীয় আর একজন নবী যে আসিবেন, সে কথা ইহুদীরা জানিত।

এই ‘সেই নবী’ যে একমাত্র হযরত মুহম্মদই, সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই; কারণ যিশুখৃষ্টের পরবর্তী পয়গম্বর (এবং সর্বশেষ পয়গম্বর)-ই হইতেছেন – হযরত মুহম্মদ।

যিশুখৃষ্টে নিজেও বলিয়াছেন: “যদি তোমরা আমাকে ভালবাস, তবে আমার উপদেশ মত কার্য করিও ; আমি স্বর্গীয় পিতার নিকট প্রার্থনা করিব যাহাতে তিনি তোমাদিগকে আর একজন শান্তিদাতা প্রেরণ করেন—যিনি চিরদিন তোমাদের সঙ্গে থাকিতে পারেন।” (John, Chap. 14: 15-16)

“যাহাই হউক, আমার উচিত যে তোমাদের মঙ্গলের জন্য আমি চলিয়া যাই, কারণ আমি না গেলে সেই শান্তিদাতা আসিবেন না; কিন্তু আমি যদি যাই, তবে তাঁহাকে পাঠাইয়া দিব।”(John: 17: 7-8)

“যাহাই হউক, যখন সেই সত্য-আত্মা আসিবেন, তখন তিনি তোমাদিগকে সর্বপ্রকার সত্য পথে চালিত করিবেন, কারণ তিনি নিজের কথা কিছু বলিবেন না, কিন্তু যাহা তিনি (ঈশ্বরের নিকট হইতে) শুনিবেন, তাহাই বলিবেন; এবং তিনি ভবিষ্যতে কি ঘটিবে তাহা দেখাইবেন।” (John: 16: 13)

এই শান্তিদাতা” (paraclete) কে? হযরত মুহম্মদকেই কি স্পষ্টাক্ষরে এখানে ইংগিত করা হইতেছে না? যিশখৃস্টের পরে এক হযরত মহম্মদ ছাড়া আর অন্য কোন পয়গম্বর অবির্ভূত হন নাই। তা ছাড়া paraclete শব্দের অর্থও হইতেছে ‘শান্তিদাতা’ অথবা ‘চরম প্রশংসিত’। এই দুইটি বিশেষণই হযরত মুহম্মদের জন্য নির্দিষ্ট। কাজেই এ সম্বন্ধে আর কোনই সন্দেহের অবকাশ নাই।

কুরআন শরীফের বহু স্থানেও এই সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে নানা প্রসংগে উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ এই আয়াতের উল্লেখ করা যায় :

‘এবং যখন আল্লাহ সমস্ত পয়গম্বরদিগের সমক্ষে এই চুক্তি করিলেন যে, নিশ্চয়ই যে সমস্ত বাণী তোমাদিগকে দিয়াছি তাহা সত্য, অতঃপর একজন রসুল আসিবেন এবং তিনি আসিয়া তোমাদের নিকট যাহা আছে তাহার সত্যতা প্রমাণ করিবেন; তোমরা তাঁহার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করিবে এবং তাঁহাকে সাহায্য করিবে। তিনি বলিলেন: তোমরা এই ব্যাপারে আমার কথা স্বীকার করিলে ত? তাঁহারা বলিল: আমরা স্বীকার করিলাম। তখন তিনি বলিলেন: তাহা হইলে সাক্ষী থাকো। আমিও তোমাদের সহিত সাক্ষী থাকিলাম।”
– (৩:৮০)

এই সমস্ত ভবিষ্যদ্বাণী হইতে কী বুঝা যায়? যাঁহার প্রশংসা এবং আগমনবার্তা বহু পূর্ব হইতেই যুগে যুগে দেশে দেশে বিঘোষিত হইয়া আসিতেছে, আল্লাহ্, যাঁহাকে সর্বশ্রেষ্ঠ পয়গম্বর ও সর্বোত্তম আদর্শরূপে দুনিয়ায় পাঠাইয়াছেন, তিনি কি সাধারণ মানুষ? কখনই নয়।

অতএব হযরত মুহম্মদকে আমরা যেন সাধারণ মানুষের পর্যায়ভুক্ত করিয়া বিচার না করি। তাঁহার জীবনে আমরা অনেক সময় অনেক অলৌকিক মহিমার প্রকাশ দেখিতে পাইব; তাঁহার অনেক কার্য হয়ত আমাদের কাছে বিসদৃশ বলিয়া মনে হইবে, কিন্তু সেগুলিকে আমরা যেন ধীরভাবে বুঝিতে চেষ্টা করি। আমরা যেন ভুলিয়া না যাই যে, এক মহান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তিনি এ দুনিয়ায় আসিয়াছিলেন।

[টু বি কন্টিনিউ…]

 

Series Navigation(বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ২ >>

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →