Main menu

(বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৪

৯: অলৌকিক কান্ড

হালিমার গৃহে অবস্থানকালে হযরত মুহম্মদের জীবনে একটি অলৌকিক কান্ড ঘটিয়াছিল বলিয়া জানা যায়।

এই ঘটনা হাদিস শরীফে নিম্নরূপে উল্লিখিত হইয়াছে : “আনাস বলিতেছেন: একদা হযরত বালকদিগের সহিত খেলা করিতেছিলেন, এমন সময় জিব্রাইল ফিরিশতা তথায় উপস্থিত হইলেন। জিব্রাইল হযরতকে একটু আড়ালে লইয়া তাঁহাকে চিৎ করিয়া শোয়াইলেন; তারপর তাঁহার বুক চিরিয়া হৃৎপিণ্ডটিকে বাহিরে আনিয়া তাহার মধ্য হইতে খানিকটা জমা-রক্ত বাহির করিয়া ফেলিলেন এবং বলিলেন: শয়তানের অংশ যেটুকু তোমার মধ্যে ছিল তাহা এই। তারপর সেই হৃৎপিণ্ডটিকে একটি সোনার তশতরীতে রাখিয়া জমজমের পবিত্র পানি দ্বারা ধৌত করিলেন। অতঃপর সেটিকে জোড়া লাগাইয়া পুনরায় যথাস্থানে সংস্থাপন করিলেন। বালকেরা দৌড়াইয়া গিয়া হালিমাকে বলিল: ‘দেখ গিয়া, মুহম্মদ নিহত হইয়াছে।” তখন সকলে তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মুহম্মদ বিবর্ণ হইয়া পড়িয়া আছেন। আনাস বলিতেছেন: ‘আমি হযরতের বুকে সেলাইয়ের দাগ দেখিয়াছি।”

শুধু যে আনাসই এই হাদিসটি বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা নহে। ইবনে হিশাম এবং অন্যান্য ঐতিহাসিকগণও অনুরূপ হাদিস বর্ণনা করিয়াছেন। ইবনে হিশাম বলিতেছেন :

“হালিমা বলিয়াছেন: মুহম্মদ একদিন তাহার দুধভাইদের সহিত বাড়ীর নিকট মেষ চরাইতেছিল, এমন সময় বালকেরা ছুটিয়া আসিয়া আমার নিকট বলিল যে, দুইজন শ্বেতবাসপরিহিত লোক আসিয়া তাহাদের কোরেশ-ভাইকে ধরিয়া তাহার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া ফেলিয়াছে। আমি এবং আমার স্বামী তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম মুহম্মদ বিবর্ণ ও ভীত অবস্থায় পড়িয়া আছেন। আমরা বালকটিকে আলিংগন করিলাম এবং এরূপ হইবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলাম। তখন বালক উত্তর দিল: “দুইটি শ্বেতবাস-পরিহিত লোক আমার নিকট আসিযা আমাকে চিৎ করিয়া শোয়াইয়া আমার কলিজা বাহির কবিয়া লইল এবং উহার মধ্য হইতে একটা-কিছু বাহির করিয়া ফেলিল। সে যে কী জিনিস, আমি জানি না।”

অন্য আর একটি হাদিসে আছে :

“একদা কতিপয় লোক হযরতের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহার নিজের সম্বন্ধে কিছু, বলিতে অনুরোধ করিল। হযরত বলিতে লাগিলেন: “হযরত ইসমাইলের প্রতি খোদাতালা যে আশীর্বাদ প্রেরণ করিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, আমি সেই আশীর্বাদ এবং যিশু যাহার সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করিয়াছিলেন, আমি সেই ব্যক্তি। আমি যখন মায়ের পেটে ছিলাম, তখন আমার মা প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন যে তাঁহার মধ্য হইতে একটি দিব্যজ্যোতিঃ বিকীর্ণ হইয়া সিরিয়ার রাজপ্রাসাদকে আলোকিত করিয়া তুলিয়াছে। একদিন আমি আমার দুভাইদের সংগে মেষ চরাইতেছিলাম এমন সময় শুভ্রবেশধারী দুই ব্যক্তি আমার নিকট উপস্থিত হইযা আমাকে চিৎ করিয়া শোয়াইয়া ফেলিয়া হৃৎপন্ড বিদীর্ণ করিয়া উহার মধ্য হইতে এক ফোঁটা কালো রক্ত বাহির করিয়া ফেলিলেন। তারপর তাঁহাদের হস্তস্থিত তরীর পানিতে উহা ধৌত করিয়া দিলেন। তখন একজন ফিরিশতা আমাকে ওজন করিবার জন্য অপরকে বলিলেন। ওজনে আমি দশজনের চেয়েও ভারী প্রমাণিত হইলাম। তখন আমাকে একশত জনের বিরুদ্ধে ওজন করা হইল, এবারেও আমি সকলের চেয়ে ওজনে ভারী হইলাম। তখন একজন অপরজনকে বলিলেন: আর দরকার নাই, সমস্ত পৃথিবীর বিরুদ্ধে ওজন করিলেও ইহার ভার কম হইবে না।”

হযরতের বক্ষ-বিদারণ লইয়া অনেকেই অনেক প্রকার মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছে। ইউরোপীয় লেখকেরা এ-ঘটনা স্বীকার করিয়াছেন বটে, কিন্তু কেহ কেহ ইহাকে হযরতের (Epilepsy) বা (Falling disease) অর্থ ‘মূচ্ছা’ বা ‘মৃগীরোগ’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। কেহ কেহ বা possessed’ অর্থাৎ ‘ভূতে পাওয়া’ বলিতেও কুণ্ঠিত হন নাই।

আমাদের মতে দৈহিক বক্ষ-বিদারণের উপযুক্ত কোন নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা না পাওয়া পর্যন্ত আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাতেই সকলের সন্তুষ্ট থাকা উচিত।

১০: নবী এতিম হইলেন

পাঁচ বৎসর পর শিশুনবী জননীর কোলে ফিরিয়া আসিলেন।

কিন্তু যতদিন হালিমা জীবিত ছিলেন, ততদিন হযরত তাহাদের তত্ত্বাবধান করিয়া গিয়াছেন। হালিমা যখনই হযরতের সহিত দেখা করিতে আসিতেন, তখনই হযরত পরম শ্রদ্ধাভরে তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতেন এবং যথোপযুক্ত উপহারাদি দিয়া তাঁহাকে বিদায় দিতেন। একবার হযরত তাঁহার শিষ্যবৃন্দকে লইয়া বসিয়া আছেন, এমন সময় হালিমা হযরতের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিলেন। হযরত তাঁহাকে দেখিবামাত্র আসন হইতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং নিজের শিরস্ত্রাণ বিছাইয়া তাঁহাকে বসিতে দিয়া সকলের নিকট এই বলিয়া পরিচয় দিলেন “মা। আমার মা!”

বিবি খাদিজার সহিত হযরতের যখন বিবাহ হয়, তখন তিনি এই দুধ-মা ও দুধ-বোনকে আনিতে ভোলেন নাই। আবার যখন আরবে একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তখন হালিমা হযরতের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করিলে হযরত সন্তুষ্ট চিত্তে এক-উট বোঝাই খাদ্যদ্রব্য এবং চল্লিশটি মেষ তাহাকে পাঠাইয়া দেন।

শায়েমার স্মৃতিও হযরত কোনদিন ভুলিতে পারেন নাই। তায়েফ নগর অবরোধকালে শায়েমা বন্দিনী হন। হযরত তাঁহাকে চিনিতে পারিয়া তৎক্ষণাৎ তাঁহাকে মত্ত করিয়া দিয়া আপন পরিবারের লোকদিগের নিকট পৌঁছাইয়া দেন। শষ, তাই নয়, সমগ্র বনি সা’দ গোত্রের প্রতিই চিরদিন তিনি কৃতজ্ঞ ছিলেন।

বিবি হালিমা হযরতের নবুয়ত-প্রাপ্তি পর্যন্ত জীবিত ছিলেন কিনা, সে সম্বন্ধে মতভেদ আছে। কেহ কেহ বলেন, তিনি সে সময় পর্যন্ত জীবিত ছিলেন এবং ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। ইহার পরই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

বালক মুহম্মদ মক্কায় আসিলেন। নতুন করিয়া আবার তাঁহার জীবন-যাত্রা শুরু হইল। মরভূমির বেদুঈন-জীবন ছাড়িয়া এবার তিনি নাগরিক জীবন আরম্ভ করিলেন।

দীর্ঘ পাঁচ বৎসর পর আমিনা আপন দুলালকে বুকে পাইয়া অপার আনন্দ অনভব করিলেন। বৃদ্ধ আব্দুল মুতালিবও এই সুন্দর পৌত্রটির মাখশ্রী ও অসামান্য হাবভাব লক্ষ্য করিয়া মুগ্ধ হইলেন। স্নেহ দিয়া মমতা দিয়া তাঁহারা এই বালককে আচ্ছন্ন করিয়া রাখিলেন।

কিন্তু হায়! এ-সুখ মুহম্মদের ভাগ্যে বেশী দিন স্থায়ী হইল না।

আমিনার সাধ জাগিল, তাঁহার প্রাণের দুলালকে একবার মদিনায় লইয়া গিয়া পিতৃকূলের সকলকে দেখাইয়া আসেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি উম্মে আইমান নাম্নী একটি পরিচারিকা সংগে লইয়া মদিনা যাত্রা করেন।

একমাস আনন্দের মধ্যে কাটাইয়া আমিনা পুনরায় মুহম্মদকে লইয়া মক্কায় ফিরিয়া আসিবার জন্য যাত্রা করিলেন। কিন্তু যখন তিনি মক্কা এবং মদিনার মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছিলেন, তখন অকস্মাৎ তাঁহার এক সাংঘাতিক পীড়া জন্মিল। নিতান্ত অপ্রত্যাশিতরূপে তিনি সেইখানেই প্রাণত্যাগ করিলেন। শিশ‍ু মুহাম্মদ আমিনাকে কোন মতে সেইখানে কবর দিয়া উম্মে আইমান মুহম্মদকে লইয়া মক্কায় ফিরিয়া আসিলেন।

কিন্তু ইহাই চরম নয়। শিশুনবীর দঃখের পিয়ালা এখনও পূর্ণ হয় নাই। এ-পিয়ালা পূর্ণ হইল তখনই—যখন ইহার দুই বৎসর পরে বৃদ্ধ আব্দুল মুতালিবও মুহম্মদকে ছাড়িয়া দুনিয়া হইতে চিরবিদায় গ্রহণ করিলেন।

মুহম্মদ বুঝিলেন, এই দুস্তর প্রান্তর একাই তাঁহাকে পাড়ি দিতে হইবে।

১১: সিরিয়া ভ্রমণ

দিন যায়। বালক মুহম্মদ কৈশোরে পদার্পণ করিলেন। নবয়ত বা পয়গম্বরী লাভ করিবার জন্য হযরত মুহম্মদকে দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর কাল অপেক্ষা করিতে হইয়াছিল। এই দীর্ঘ সময় তাঁহার জীবনে ব্যর্থ যায় নাই। বিশ্বনবীর গুরুদায়িত্ব বহন করিবার জন্য এই দীর্ঘদিন ধরিয়া আল্লাহতালা তাঁহাকে প্রস্তুত করিয়া লইতেছিলেন—একে একে বিভিন্ন স্তরের মধ্য দিয়া ঘুরাইয়া আনিয়া তাঁহার পয়গম্বর জীবনের বুনিয়াদকে মজবুত করিয়া গড়িয়া তুলিতেছিলেন। হযরতের জীবনে যে- সমস্ত ঘটনা ঘটিবে, পাঠক দেখিতে পাইবেন, তাহাদের প্রত্যেকটির মধ্যেই একটা গড়ে উদ্দেশ্য নিহিত আছে।

মক্কায় প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হযরতের জীবনের এক নতন অধ্যায় আরম্ভ হইল। প্রকৃতির পাঠ শেষ করাইয়া আনিয়া আল্লাহ্ এবার মানব সমাজের রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার ও জীবনযাত্রা প্রণালীর দিকে হযরতের দৃষ্টি ফিরাইলেন। বাণিজ্য-ব্যপদেশে অথবা কা’বা মন্দিরের তীর্থ উপলক্ষে যখন নানাদেশ হইতে নানা জাতীয় লোক আসিয়া মক্কা নগরে সমবেত হইত, তখন বালক মুহম্মদ নীরবে তাহাদের গতিবিধি ও আচার-অনুষ্ঠান লক্ষ্য করিতেন। বাহিরের বিশ্ব যে কত বিরাট, কত বিপুল তখন হইতেই তিনি তাহা ভাবিতে শিখিলেন।

তৎকালে সিরিয়া ও এয়মন প্রদেশের সহিত আরবের বাণিজ্য চলিত। মুহম্মদের বয়স তখন বারো বৎসর। আবু তালিব অন্যান্য মক্কাবাসীদিগের সহিত মালপত্র বোঝাই করিয়া সিরিয়া যাত্রা করিতেছেন, এমন সময় মুহম্মদ আসিয়া বলিলেন, “চাচাজান, আমিও যাইব।” আবু তালিব মুহম্মদকে এতই স্নেহ করিতেন যে, তিনি তাঁহার এই অনুরোধ উপেক্ষা করিতে পারিলেন না।

কাফেলা ধীরে ধীরে গন্তব্য পথের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। বহু প্রাচীন নগরীর সহিত মুহম্মদের পরিচয় ঘটিল। হেজার নামক নির্জন পার্বত্য সহ-প্রান্তরে উপনীত হইলে মুহম্মদ জানিতে পারিলেন, এই সেই প্রাচীন নগরী—যেখানে ‘সমুদ’ জাতির বাসস্থান ছিল। হযরত ইব্রাহিমের আবির্ভাবেরও পূর্বে এই দুর্ধর্ষ জাতি এখানে বাস করিত। ইহারা ঘোর পৌত্তলিক ছিল. আল্লাকে কিছুতেই ইহারা স্বীকার করিত না। তখন আল্লাহ তালা ইহাদিগকে হেদায়েত করিবার জন্য হযরত সালেহ পয়গম্বরকে পাঠাইয়া দিলেন। সমুসগণ প্রথমতঃ তাঁহাকে কিছুতেই বিশ্বাস করিল না। নিকটবর্তী একটি পর্বতগুহার দিকে নির্দেশ করিয়া বলিল : “যদি ঐ গুহার মধ্য হইতে তুমি একটি গর্ভবর্তী উট আমাদের সম্মুখে বাহির করিয়া আনিতে পার, তবেই বুঝিব যে তুমি পয়গম্বর।” এ কথা শুনিয়া হযরত সালেহ আল্লাহ তালার নিকট প্রার্থনা করিলেন। আল্লাহ তাঁহার প্রার্থনা শনিলেন। শীঘ্রই পর্বতগুহা হইতে একটি উট বাহির হইয়া আসিল এবং অল্পক্ষণ পরেই একটি শাবক প্রসব করিল। সমুদদিগের অনেকেই এই অলৌকিক কান্ড দেখিয়া হযরত সালেহকে পয়গম্বর বলিয়া মানিয়া লইল এবং আল্লার দিকে প্রত্যাবর্তন করিল। তখন হযরত সালেহ সেই উটটিকে রাখিয়া চলিয়া গেলেন। বলিয়া গেলেন “সাবধান, তোমরা এই উটকে কখনও মারিয়া ফেলিও না। ইহা আল্লাহ তালার দান। যদি ইহার প্রতি কোনরূপ অত্যাচার কর, তবে আল্লার গজব তোমাদের উপর নামিয়া আসিবে।”

কিন্তু সমুদগণ ক্রমে ক্রমে আল্লাহকে ভুলিয়া গিয়া পুনরায় মূর্তিপূজো আরম্ভ করিল এবং অবশেষে একদিন উটটিকেও মারিয়া ফেলিল।

সংগে সংগে আকাশ পথে ভীষণ বজ্রধনি ও ভূমিকম্পের শব্দ উত্থিত হইল। নিমেষের মধ্যে রোজ-কিয়ামত ঘটিয়া গেল। পরদিন দেখা গেল, সমগ্র সমুদ জাতি নিশ্চিহ্ন হইয়া গিয়াছে এবং তাহাদের দেশ একটা বিজন মরু- ভূমিতে পরিণত হইয়াছে।

মরুভূমি পার হইয়া কাফেলা বোসরা-সীমান্তে আসিয়া পৌঁছিল। বোসরার তরুলতার কী শ্যামল শ্রী। ছায়াঢাকা পাখীভাকা কুঞ্জতল, শাখায় শাখায় ফল ও ফল, কোথাও বা উচ্ছল কলকল নদীজল ! আল্লাহ্- তালার অস্তিত্ব, একত্ এবং সজৃনলীলার চমৎকারিত্ব তাঁহার মনের উপর দাগ কাটিয়া বসিয়া গেল।

প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়া কাফেলা বোসরা নগরে উপনীত হইল। প্রতি বৎসর এখানে একটি প্রকাণ্ড মেলা বসিত নানা দূরদেশ হইতে সওদাগরগণ এখানে বাণিজ্য করিতে আসিত।

এইখানে আসিয়া আবু তালিব তাঁবু ফেলিলেন। নিকটেই ছিল একটি মঠ। বহিরা নামক জনৈক খৃষ্টান সন্ন্যাসী এই মঠে বাস করিতেন। বহিরা মঠ হইতে বাহির হইয়া আসিলেন এবং কাফেলার চারিপাশে ঘুরিতে ঘারিতে হঠাৎ মুহম্মদের হস্ত ধারণপূর্বক বলিতে লাগিলেন, “এই তো সেই বিশ্বমানবের পথপ্রদর্শক। এই তো সেই যিশুর প্রতিশ্রুত শান্তিদাতা! আল্লাহ ইহাকেই তো সকল জগতের আশীর্বাদস্বরূপ পাঠাইয়াছেন।” বাইবেল বর্ণিত অনাগত মহানবীর সমস্ত লক্ষণ তিনি মুহম্মদের মধ্যে লক্ষ্য করিয়া- ছিলেন, তাই তিনি মুহম্মদকে চিনিতে পারিয়া ছিলেন।

বহিরা ছিলেন নেষ্টবীয় খৃষ্টান। কিন্তু নেষ্টীরীয় সম্প্রদায় আদৌ কোন পৌত্তলিকতার প্রশ্রয় দিতেন না, এমন কি ক্রশচিহ্নকেও তাঁহারা পৌত্তলিকতার প্রতীক বলিয়া বর্জন করিতেন। সাধু বহিরা বাইবেলে বর্ণিত মিশরে পরবর্তী নবীর আগমন সবন্ধে অনুসন্ধিৎস, ছিলেন এবং সেই আবির্ভাব যে আসন্ন হইয়া উঠিয়াছে, তাহা তিনি জানিতেন। কাজেই বহিরার পক্ষে হযরত মুহম্মদকে চিনিতে পারা খুবে বিস্ময়কর ব্যাপার হয় নাই।

বহিরা হযরত মুহম্মদের সম্মানার্থে এক ভোজসভার আয়োজন করিয়া আবু তালিব ও তাঁহার সংগীদিগকে নিমন্ত্রণ করিলেন। এই উপলক্ষে হযরত মুহম্মদের সহিত তাঁহার নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হইল। বহিরা আবু তালিবকে মুহম্মদ সম্বন্ধে সতর্ক হইতে উপদেশ দিলেন। সিরিয়ার ইহুদীদিগের হস্তে যাহাতে এই বালক না পড়ে, সেজন্য তিনি বিশেষভাবে তাঁহাকে সাবধান করিয়া দিলেন, কারণ তাঁহার আশংকা হইল ইহুদীর এই মহাপুরুষের সন্ধান পায়, তবে নিশ্চয়ই ইহাকে মারিয়া ফেলিবে।

বহিবার সহিত আলাপ-আলোচনার ফলে মুহম্মদ খৃষ্টধর্ম সম্বন্ধে মোটামুটি একটা জ্ঞান লাভ করিলেন। এই জ্ঞান পরে তাঁহার কাজে লাগিয়াছিল।

আবু তালিব মুহম্মদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখিলেন। ইহুদীদিগের সম্পর্ক’ যথাসম্ভব এড়াইয়া সেবারকার মত তিনি বাণিজ্যযাত্রা শেষ করিলেন।

১২: আল-আমিন

আবু তালিব সিরিয়া হইতে ফিরিয়া আসিলেন। সেবার বাণিজ্যে তাঁহার প্রচুর লাভ হইল। ইহার পর আরও কয়েকবার হযরত মুহম্মদ বাণিজ্য উপলক্ষে বিদেশে গিয়াছিলেন। ইহুদী, খৃষ্টান, পারসিক প্রভৃতি তৎকালীন জাতিসমূহের ধর্ম, সংস্কার ও আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে এইরূপেই তিনি প্রত্যক্ষ জ্ঞানলাভ করিয়াছিলেন।

অবসর সময়ে হযরত মুহম্মদ মেষ চরাইতেন। মেষচারণের সহিত পয়গম্বর জীবনের এক আশ্চর্য সম্বন্ধ দেখিতে পাওয়া যায়। এই কারণে অনেক পয়গম্বরই মেষপালক ছিলেন। ইহার গূঢ় কার্যকারণসম্বন্ধ আছে। উন্মুক্ত নীল আকাশের তলে বিশাল প্রান্তরে এক পাল মেঘ আর তার একজন চালক। কোন মেষ যাহাতে বিপথগামী না হয়, অপরের শস্যক্ষেত্র নষ্ট না করে, হারাইয়া না যায়, বাঘে না ধরে, অথচ প্রত্যেকেই উপযুক্ত আহার পাইয়া হৃষ্টপষ্ট হইয়া সন্ধ্যাকালে প্রভুর গৃহে নির্বিঘ্নে ফিরিয়া আসে, ইহাই থাকে মেষ- চালকের প্রধান কর্তব্য ও লক্ষ্য। এই কর্তব্য ও লক্ষ্যের সহিত পয়গম্বর-জীবনের কর্তব্য ও লক্ষ্যের কত নিকট-সম্বন্ধ। পয়গম্বরও তো এক একটা জাতির এমনি পরিচালক মেষ-চালকের মত সেও ত নর-চালক। খোদার বান্দার পিছনে থাকিয়া তাহাদিগকে সুপথে চালনা করা এবং ইহলোকের ও পরলোকের খোরাক জোগাইয়া পরিপুষ্ট অবস্থায় সকলকে প্রভুর ঘরে পৌছিয়া দেওয়াই তো তাঁহার কর্তব্য।

ভিতরে-বাহিরে এমনি করিয়া হযরত মুহম্মদের পয়গম্বর-জীবনের গঠন কার্য চলিতেছিল। একদিকে বাহির হইতে তিনি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করিতেছিলেন, অপর দিকে ভিতর হইতে তাঁহার মন প্রস্তুত হইতেছিল।

এই সময়ে তিনি এক নতুন অভিজ্ঞতা লাভ করিলেন। বৎসরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হেজাজ প্রদেশের বিশেষ বিশেষ স্থানে তখনকার দিনে এক-একটি মেলা বসিত। ঐ সমস্ত মেলায় বিবিধ পণ্যদ্রব্যের ক্রয়-বিক্রয় তো হইতই, অধিকন্তু কাব্যযুদ্ধ, ঘোড়দৌড়, জুয়াখেলা ইত্যাদিও চলিত। দলে দলে লোক আসিয়া ঐ সব মেলায় যোগদান করিত। বিভিন্ন গোত্রের দলপতিরা উপস্থিত থাকিতেন। কখনও বা কোন বীর নিজের রণনৈপণ্যে ও বিজয়গাঁথার আবৃত্তি করিয়া এবং সংগে সংগে অপর গোত্রের কাপুরুষতা ও কুৎসা-কাহিনী বর্ণনা করিয়া উত্তেজনার সৃষ্টি করিত। এই সমস্ত ব্যাপার হইতেই বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি ও গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হইত।

একবার এইরূপে একটি দাবানল জ্বলিয়া উঠিল। তখন যতগুলি মেলা হইত, তাহাদের মধ্যে, ‘ওকাজ’ মেলাই ছিল সর্বপ্রধান। এই মেলা হইতেই একটি কলহের সৃষ্টি হইল এবং পরে সেই কলহই ভীষণ যুদ্ধে পরিণত হইযা আরবের সকল গোত্রের মধ্যে ছড়াইয়া পড়িল। একাধিক্রমে পাঁচ বৎসর ধরিয়া এই গৃহযুদ্ধ চলিয়াছিল এবং হাজার হাজার লোক ইহাতে মারা গিয়াছিল। ইতিহাসে এই দশ ‘হরবে-ফোজ্জার’ (অন্যায় সমর) নামে অভিহিত।

হাশিম বংশও এই যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল তাহাদের মধ্যে আবুতালিব ও তাঁহার আত্মীয়-স্বজনও ছিলেন। শেষদিকে হযরত মুহম্মদকেও পিতৃব্যের সহিত এই যুদ্ধে যোগদান করিতে হইয়াছিল। তবে তিনি কার্যতঃ যুদ্ধ করেন নাই, পিতৃব্যদের সংগে থাকিয় তাঁহাদের তীর কুড়াইয়া দিতেন।

হযরত মুহম্মদের যুদ্ধক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা ইহাই প্রথম। আরবদিগের মধ্যে যে নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা লুকাইয়া ছিল, তাহা যেন মূর্তি ধরিয়া তাঁহার চোখের সামনে ভাসিয়া উঠিল। এই অন্যায় জুলুমের কি কোন প্রতিকার নাই? মুহম্মদ বসিয়া বসিয়া ভাবেন।

সুখের বিষয়, এই চিন্তার তিনি একজন দোসর পাইলেন। ইনি মুহম্মদের কনিষ্ঠ পিতৃব্য জুবায়ের। এই তরুণ যুবক ছিলেন একজন নিশানধারী, আর একজন তীরসংগ্রহকারী। যুদ্ধে যাহারা লিপ্ত থাকে, তাহারা ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ বুঝিতে পারে না। যাহারা দর্শক, তাহারাই তাহা ভালরূপে বুঝিবার সযোগ পায়। হযরত মুহম্মদ ও জুবায়েরও এই কারণেই এই ভয়াবহ যুদ্ধের স্বরূপ দেখিতে পাইয়াছিলেন।

একটা সন্ধির দ্বারা এই আত্মঘাতী যুদ্ধের পরিসমাপ্তি করা হইল। কিন্তু হযরতের মন তখনও শান্ত হইল না। আর্ত পীড়িত, ব্যথিত, অত্যাচারিতকে রক্ষা করিবার জন্য সংগে সংগে অত্যাচারীকে বাধা দিবার জন্য তিনি বদ্ধপরিকর হইলেন। পূর্বে আরবের প্রথা ছিল যে গোত্রের কোন লোক কোন অন্যায় করিলেও তাহাকে দলগতভাবে সমর্থন করা হইত। হযরত দেখিলেন, এই কুৎসিত মনোবৃত্তিই সকল সর্বনাশের মূল। যে-কেহই অন্যায় করুক, তাহা অন্যায়ই এবং তাহাকে রোধ করিতেই হইবে—ইহাই হইল তাঁহার দৃঢ় পণ।

এতদুদ্দেশ্যে আরবের কতিপয় উৎসাহী যুবককে লইয়া তিনি একটি সেবাসংঘ গঠন করিলেন। সেবকগণ এই প্রতিজ্ঞা করিলেন:

(১) আমরা নিঃস্ব, অসহায় ও দূর্গতদিগকে সেবা করিব।
(২) অত্যাচারীকে প্রাণপণে বাধা দিব।
(৩) অত্যাচারিতকে সাহায্য করিব।
(৪) দেশের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করিব।
(৫) বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনের চেষ্টা করিব।

এই পবিত্র প্রতিজ্ঞা-বাণীর নাম হইল ‘হিলফ-উল-ফযুল।’

হযরতের প্রতিষ্ঠিত সেবাসংঘ বেশ ভালভাবেই চলিতে লাগিল। হযরত ইহার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। সত্যিকার কল্যাণপ্রচেষ্টা ও নিঃস্বার্থ সেবা মানুষ কতদিন অস্বীকার করিয়া চলিবে? আরবগণ তাই দিনে দিনে মুহম্মদের প্রতি আকৃষ্ট হইতে লাগিল। অবশেষে এমন হইল যে, আরবগণ একবাক্যে তাঁহাকে ‘আল-আমিন’- অর্থাৎ ‘বিশ্বাসী’ — এই উপাধি দান করিয়া ফেলিল। ‘মুহম্মদ’ নাম চাপা পড়িয়া গিয়া ‘আল-আমিন’ নামই ভাসিয়া উঠিল। দেখা হইলেই লোকেরা বলিয়া উঠিত: “এই যে আমাদের ‘আল-আমিন’ আসিতেছে।”

বস্তুতঃ হযরতের ‘আল-আমিন’ উপাধি লাভের মধ্যে এই সত্যই আমরা উপলব্ধি করিলাম যে, ভবিষ্যৎ জীবনের সমস্ত সার্থকতা নির্ভর করে বাল্যজীবনের সত্যবাদিতার উপরে। সত্যবাদিতাই চরিত্র গঠনের প্রথম উপকরণ। আমাদের অভিভাবকদিগকে এইখানে পাঠগ্রহণ করিতে অনুরোধ করি।

Series Navigation<< (বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৩(বাংলা-ক্লাসিক) বিশ্বনবী – গোলাম মোস্তফা [শর্ট ভার্সন।] পার্ট ৫ >>

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →