হুমায়ুন অথবা সাহিত্য বিষয়ে একটা র্যান্ট
হুমায়ুন আহমেদ নিয়ে প্রতি বছরই কিছু না কিছু আলাপ হয়। এইসকল আলাপ দেখে বুঝতে পারি ভদ্রলোকের জন্ম অথবা মৃত্যুদিন উপস্থিত।
এখন যে আলাপ দিবো, মোট তিনটা টপিক, তা আনরিলেটেবল লাগতে পারে এই ইস্যুতে, পরে ব্যাখ্যা দিচ্ছি সব কিছুর।
আমরা এমন একটা সময়ে বসবাস করছি, যখন মানুষ হাতে অল্প সময় পেলেই ফেসবুক বা ইন্সটা ব্রাউজ করে (যদিও একটা ছোটগল্প পড়তে সময় লাগে মাত্র ১৫ মিনিট, নিউ ইয়র্কারের একটা প্রবন্ধ পড়তে সময় লাগে ১০ মিনিট) । যদি এর থেকে বেশি সময় থাকে তার হাতে, ঘন্টা ২, তবে সে সিনেমা দেখে। যদি সারাদিন হাতে সময় থাকে, তাহলে সিরিজ।
মানুষ এমন একটা প্রানী যে তার আইডেন্টিটি, ইতিহাস, তার পারসোনাল অতীত, দুনিয়া ব্যাখ্যা- প্রায় সবই ন্যারেটিভে সাজায়ে চিন্তা করে – আ সিম্পল এন্ড সিঙ্গেল- কজ এন্ড ইফেক্ট। গল্প কেবল বিনোদন না, এটা কাইন্ড অফ প্রবৃত্তির মতো মানব প্রজাতির কাছে। ন্যারেটিভ ও গল্পের খিদা তার আছে, থাকবে; সে এখন এ খিদা সিনেমা দিয়েই মিটায়। ছাপাখানা জনপ্রিয় হওয়ার পর যেমন গল্প এক্সজিকিউশনের কথক ভার্সন আস্তে আস্তে পিছনে পরে গিয়েছিলো লেখ্য উপন্যাস থেকে, গল্পের ভিজুয়াল ভার্সন আসার পর এখন লেখ্য ভার্সনের সেইম অবস্থা হয়েছে।
এই অঞ্চলের একটা গড়পড়তা পাঠকের পাঠের বয়স শুরু হয় স্কুল থেকে, আর শেষ হয় মোটাদাগে ভার্সিটি ফার্স্ট ইয়ারে গিয়ে। এরপর যারা “পড়াশুনার” মধ্যে থাকে, এরা ননফিকশনে শিফট করে। হয়ত এজন্যই এখানকার, এই বাঙাল মুলকের, সকল সাহিত্য মুলত “ইয়াং এডাল্ড” জনরার সাহিত্য। টেনে টুনে “নিউ এডাল্ড”। সুনীল, সমরেশ বলি অথবা হুমায়ুন, হক।
গল্পের ক্যারেকটার ডেভলপমেন্ট, ক্যারেকটারেজেশন, পার্সপেক্টিভ, প্রধান সংকট, সাবজেক্ট – প্রায় সবই একজন ইয়াং এডাল্ডের সংকট, চিন্তন রিপ্রেজেন্ট করে। নারীকে রহস্যময় করে উপস্থাপন করাই বলি, সব উপন্যাসের সাবপ্লট প্রেম, বা প্রতিবাদ হিসেবে কয়েক দূর্নীতিবাজকে খুন করে হিমালয়ে গিয়ে গর্ভধারিণী হওয়ার কথা বলি – এগুলোর সব আবেদন মূলত তরুন পাঠক সেন্ট্রিক। একজন মধ্যবয়স্ক বা বয়স্কের যাপন ও চিন্তার সংকট সে রিপ্রেজেন্ট করে না, মুলত করতে পারে না। সাটলিটি আর কমপ্লেক্সিটি এই দুইটা এখানে দূর্ভিক্ষ লাগার মতো অনুপস্থিত।
এমনকি এখানকার “লিটারেরি ফিকশন” খুব বেশি পরিমান কনফরমেটোরি, সে কেবল আইডলজি কনফার্ম ই করে তার লেখায়। গল্পের থিমে আইডোলজির কোন গ্রে অংশ সে আনতে পারে না। গল্পে গ্রে ক্যারেকটার আনার একটা চেষ্টা আছে এখানে, কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত সরাসরি বক্তব্যে পর্যবসিত হয়। আপনারা যারা ভালো সিনেমা টিনেমা দেখেন- যেভাবে সিনেমা/সিরিজে গ্রে ক্যারেকটার এক্সজিকিউট করা হয় – এরকম কোন এক্সজিকিউশন এখানের উপন্যাসে দেখেছেন কি আপনারা?
আর একটা টপিক। এটা বলেই আমি মূল প্রসঙ্গে চলে যাবো। তা হলো আমি একটু আগে যে বললাম পাঠক ভার্সিটিতে উঠে ননফিকশন পড়েন, এটা পুরাপুরি সত্য না। এদের মধ্যেও কিছু অংশ থাকে, যারা আসলেই উপন্যাস, গল্প এগুলো পড়েন। কেন? কারন তারা লিখতে চান। অনেকটা, কবিরাই কেবল কবিতা পড়েন – এই টাইপ। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে, যখন কোন চর্চায় সাধারনের ঢোকার ব্যবস্থা থাকে না, তার মৃত্যু হয়। অতো দূরে তাকাতে হয় না, এ অঞ্চলেই সংস্কৃত ভাষা ডেথ ল্যাঙ্গুয়েজ হয়ে গেসে কেননা তাতে সাধারনের সম্পর্ক কম ছিলো, কেবল ব্রাহ্মনরা চর্চা করতো। দেখা গেলো সাধারন তা সাইলেন্টলি রিজেক্ট করসে। আপনার লেখা কেবল আপনার পরিচিত লোকজন পড়েন, একদম অচেনা কোন পাঠক যাস্ট আনন্দের জন্য আপনার লেখা কেনেন না, পড়েন না; এটা খুবই ট্রাজিক একটা ঘটনা।
এ দেশে সাহিত্য করা গোষ্ঠি একটা পঞ্জি স্কিমের মতো, পূর্বক্ত সাহিত্য করা ব্যক্তি পরের সাহিত্য করা ব্যক্তিদের ভেঙে এখানে চলে থাকেন। “লেখকদের লেখক” টাইটেলটা সারকাস্টিকলি এখানে প্রযোজ্য। মজার ব্যাপার হলো, একজন ভোক্তা যেমন ধরে নিই সিনেমারই ভোক্তা, সে সময়ের রিস্ক নিয়ে হলেও নতুন সিনেমা ট্রাই করে। যে ভালো সিনেমা বানাতে চায়, তাকেও দেখবেন বানিজ্যিক সিনেমা দেখে ফেলতে। এখানে, এই সাহিত্য ফিল্ডে, এটা অত্যন্ত কম। সাহিত্য করতে চাওয়া একজনকে আমি জিজ্ঞেস করসিলাম লাস্ট দশ বছরে সে কয়টা পুলিৎজার প্রাইজ পাওয়া উপন্যাসের কথা বলতে পারবে। পুলিৎজার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেননা এই পুরস্কার টা কিছুটা সিনেমার অস্কার পুরস্কারের মতো। কম স্লো, এবং ইনজয়েবল; ডাবলিন লিটারেরি এওয়ার্ড কিংবা বুকারের মতো না। সে বলতে পারে নাই (তুমি লেখাটা পড়লে মাইন্ড কইরো না, এটা এখানকার টেন্ডেন্সি হিসেবে বলছি)। এমনকি যারা সাদাত হোসেনকে নিয়ে হাসাহাসি করেন যে তিনি হুমায়ুনের মতো- তাদের অধিকাংশরাই সাদাত হোসেন পড়েন নাই। ওপারের জনপ্রিয় সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্তের লেখায় সাদাতের চেয়েও বেশি হুমায়ুনের স্টাইল পাওয়া যায়, ন্যারেশনের ভঙ্গী পর্যন্ত। হিমু ক্যারেকটার পর্যন্ত নিয়েছেন উনি। এই নিয়ে এখনও একটা আলাপ উঠে নাই, সম্ভবত হাসাহাসি করা গোষ্ঠিটা এখনও কোন আড্ডায় ভদ্রলোকের নাম শুনেন নি।
রুশদী যখন দ্য এনচানট্রেস অফ ফ্লোরেন্স লিখছিলেন, তখন তিনি গুরুত্বপূর্ন সকল ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ে স্টাডি করেছিলেন। পড়ে দেখছিলেন, আর কী বাকি যা এখনও ঐতিহাসিক উপন্যাসে এচিভ করা হয় নাই। এনচানট্রেস অফ ফ্লোরেন্সের ক্যারেকটারের পারসপেক্টিভ আর মনোলোগ দেখবেন- তা একদম আনরিয়েলিস্টিক মনে হবে আপনার কাছে। কেননা তিনি এমন সময় নিয়ে লিখছেন যে সময় মানুষের ভ্যালুজ মডার্নিটির সময়ের ভ্যালুজ থেকে আলাদা। পনেরশো সালের ইস্ট -ওয়েস্ট, যখন “মানুষ মুলত সেল্ফ সেন্ট্রিক” এডাম স্মিথের এই এজাম্পশনের ভিত্তিতে ক্যাপিটালিজম সিস্টেম তখনও গড়ে উঠে নাই। এজন্য আপনার কাছে মনে হতে পারে ক্যারেকটারগুলো এমন আচরন করে কেন? এভাবে চিন্তা করে কেন? ক্যারেকটারগুলো এমন কারন তারা আপনার মতো মডার্নিটির রিয়ালিজমে বাস করে না।
যিনি ভালো লিখতে চান, তার কাজকে রিসার্চ ওয়ার্কের সাথে তুলনা করতে পারেন। একজন রিসার্চার যেমন পুর্বক্ত স্টাডি ঘেটে “গ্যাপ অফ নলেজ” বের করেন, ভালো সাহিত্যিক ও তা করেন। যে যেই টাইপ ফিকশন লিখতে চান, সে রকম সকল ফিকশন পড়ে একজন ভালো সাহিত্যিক চিন্তা করেন আর কোথায় গ্যাপ আছে, কোথায় কনট্রিবিউট করা যায়। এখন যারা লেখালেখি করতে চান, তাদের একদম কন্টেম্পরারি সাহিত্য দুনিয়ায় কী হচ্ছে এ খোঁজ নিতে দেখা যায় না। একজন থ্রিলার রাইটারও জানেন, আনরিলায়েবল ন্যারেটিভ অনেক বেশি ব্যবহার হয়েছে এখন এটা ইউজ করা যাবে না। এখানকার লিটারেরি ফিকশন রাইটার রা এখনও third person omnicient plural এর সম্ভাবনার কথা ভাবতে পারেন না, কেউ ইউজ করলে বলেন জহিরের মতো লিখেছে :3 অডিও বুক আসায় আবার কথক ভার্সন নতুন রূপে ফিরে আসছে, এখন অমনিসিয়েন্ট ন্যারেটিভের সম্ভাবনা স্ট্রং হচ্ছে কিনা এই চিন্তা তাদের কাছে দূর অস্ত।
একটা আলাপ হুমায়ুনের জন্মদিনে আসছে, প্রতি জন্মদিনেই আসে। আলাপটা হলো: তিনি কি টিকবেন? এটা একটা ফর্মুলা চিন্তা, যেখানে ব্যক্তি ভাবছেন কেউ টিকলেই তিনি বড় সাহিত্যিক। ইতিহাসে এর ব্যত্যয় দেখা যায়। অতো দূরে না, টু কিল আ মকিং বার্ড উপন্যাসটা নিয়ে স্টাডি দেখতে পারেন। আমার উত্তর হলো হুমায়ুন টিকবেন। এজন্য না যে তিনি বড় রাইটার তাই টিকবেন। যারা লেখালেখি নিয়ে জানেন তারা জানেন, এর একটা বড় অংশ মুলত স্কিল, বাকিটা ক্রিয়েটিভিটি। ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্সে স্কিলের জিনিসগুলো শেখানো হয়। হুমায়ুন অসাধারন স্কিলফুল রাইটার, এমন একটা সাহিত্য জগতে – যেখানে লিট ফিকশন করতে চাওয়া সবার রাইটিং স্কিল অত্যন্ত জঘন্য। এজন্যই উনি টিকবেন। এই হাজার বিনোদন মিডিয়ামের যুগে একজন সব ছেড়ে কেন পড়বে, তার জন্য যে স্কিলফুল হতে হয়,তা হুমায়ুনে আছে।
আরেকটা কারনে টিকবেন। কারনটা বলতে উপরের আলাপ তিনটা সাজাইসি। কারন হলো আমাদের লিটারেচার করতে চাওয়া লোকজনের আপডেটেড না থেকে একটা নিজস্ব কুয়ায় থাকা। ইরানী সিনেমা দেখলে, সত্যজিতের সিনেমার সাথে তুলনামূলক আলোচনা করা যায়। আপনি যদি তা নাই দেখেন, তাহলে হাজার এবং মুশেয়ারা টাইপ বুলশিট আলাপে এটা ক্লিয়ার হবে না। অ্যান টাইলার আর মেরিলিন রবিনসনের সাথে হুমায়ুনের একটা তুলনামূলক আলোচনা করা যেত, বোঝা যেত তার সীমাবদ্ধতা কোথায়, যদি লোকজন উপরের দুজনকে পড়তো। এই ভালো লাগার ভ্রম এত সহজে যাবে বলে মনে হচ্ছে না, যতক্ষন না আরেক স্কিলড রাইটার আসেন দেশে যেহেতু লোকজন ইংলিশ পড়বে না। কে জানে তদ্দিনে দেখা যাবে উপন্যাস কবিতার বইয়ের মতো টিকে আছে।
প্রিতম ঘুম
Latest posts by প্রিতম ঘুম (see all)
- হুমায়ুন অথবা সাহিত্য বিষয়ে একটা র্যান্ট - জুলাই 20, 2022
- কনসার্ট ডাকা এজ এন একটিভিজম – প্রসঙ্গে - অক্টোবর 21, 2021