Main menu

এডগার এলান পো’র ফিকশন: ইলিয়োনোরা

পো’র মাধ্যমেই কবিতার প্রতি ভালোবাসা জন্মাইসিল আমার। আরো ৭-৮ বছর আগে, প্রথম যখন ওর রেভেন কবিতাটা পড়লাম, তব্দা খায়া গেসিলাম। পরে যে মজার জিনিসটা খেয়াল করসিলাম, যে এরপরে মেজর যত লেখক বা কবির লেখাপত্রের সাথে পরিচয় হইতেসে তারা প্রায় সবাই-ই কোনো না কোনো পর্যায়ে পো’র লেখাপত্র দিয়া ভালোভাবেই প্রভাবিত হইয়া আসছে। জীবনানন্দের বেশকিছু কবিতা পো’র কবিতার ভাবানুবাদ এমন আলাপ তো পুরানোই। বোদলেয়ারেরও সাহিত্যজীবন শুরু হইসিল পো’র লেখা ফরাসিতে অনুবাদ কইরা। লাভক্র‍্যাফট আলাদা একটা ঘরানা তৈরি করসিল পো’র হররের টেকনিকের উপর দাঁড়ায়ে। এমনকি প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাসও লিখসিল এই ব্যাটা, যার থেকে ইন্সপিরেশন নিয়া পরে আর্থার কোনান ডয়েল শার্লক হোমস লিখলো। এরম আরো অনেক বলা যাবে। তো, আমার ধারণা হইলো ওই শতকে সাহিত্যের দুনিয়ায় সে ছিল একটা ইভেন্ট। মানে এডগার অ্যালান পো হইয়াই আসতে হইত লেখকদের।

এইটার কারণও আছে। ওর মত কনশাস লেখক সম্ভবত খুব কমই ছিল। গল্প-কবিতার পাশাপাশি পো ছিল একজন সাহিত্যসমালোচক। সমসাময়িক লেখকদের খুবই নির্মমভাবে ক্রিটিক করতো, যেই কারণে অনেকের অপছন্দেরও ছিল সে। তা যাইহোক, এই সাহিত্যসমালোচকের নজর সে নিজের লেখা হইতেও সরায় নাই সম্ভবত। গল্প লেখার বেলায়ও তার কিছু রুল ছিল। একটা রুল হইলো, গল্প হইতে হবে ছোট, এক বসায় পইড়া ফেলার মত। আরেকটা রুল হইলো, প্রত্যেকটা শব্দ হইতে হবে নিরেট। মানে এমন একটা শব্দও থাকা যাবে না যা সরায়ে ফেললে গল্পের ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। এইজন্যই দেখা যায় তার গল্পগুলা এত টানটান।

পো’র গল্পগুলার একটা কমন উপাদান হইলো হরর। কিন্তু ওর হরর একটু অন্যরকম লাগে আমার। কোনো অলীক হরর না ঠিক, যদিও তাও আছে। বরং আরো অনেক বাস্তবিক, দুনিয়াবি একটা আতংক। সবচাইতে কাছের বন্ধু, নিজের ঘরের মানুষ কেউই ভরসাযোগ্য না। এবং আরো মজার জিনিস হইসে, তাদের এই হঠাৎ মাথায় খুন চাপার কোনো কারণ আপাতভাবে খুইজাও পাওয়া যায় না, কোনো মোটিভই বলতে গেলে নাই। এই হররটা আমার কাছে ভূতপ্রেতের চাইতেও ভয়াবহ লাগে, কারণ এই হররটা অনেক বেশি বাস্তবিক, আমাদের যেকারো সাথে ঘটার সম্ভাবনা রাখে। আবার এই প্রচন্ড ভয়ানক সিনারিগুলারে পো বর্ণনা করে এত টানটান, কাব্যিক ভাষায় যে বলার মত না। ব্যাটা তো মূলত কবিই আসলে।

মাহীন হক
এপ্রিল, ২০২৪

আমি এমন এক জাতির সন্তান যারা তাদের কল্পনাশক্তি আর বাড়াবাড়ি রকমের আবেগের জন্য পরিচিত। বহু লোক আমারে পাগল বলসে; কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো মীমাংসা এখনো হয় নাই, পাগলামি আদতে সবচাইতে উঁচু পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তারই অপর নাম কিনা—যাকিছু মহৎ—যাকিছু গভীর—তার বিশাল এক অংশ চিরকালই উল্টাপথের চিন্তা থেকে, সাধারণ মানুষের বুদ্ধির চেয়ে উপরের কারো মেজাজ থেকেই জন্মায় কিনা। যারা দিনের বেলায়ও স্বপ্ন দেখতে পারে তারা এমন অনেক জিনিস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, যার খবর কেবল রাতেই স্বপ্ন দেখনেওয়ালারা কখনো পায় না। তাদের আবছা নজরে তারা অনন্তের খানিক আভাস দেখতে পায়, এবং ওঠার পর তারা শিউরায়ে উঠে এই জাইনা যে কোনো এক মহান রহস্যের নাগাল তারা পাইসিল। খামচায়ে খামচায়ে তারা অর্জন করে কিছু জ্ঞান যা ভালো, এবং নিছক কিছু তথ্য যা মন্দ। তারা তবু ভেদ কইরা ঢুইকা যায়, কোনো হাল কিংবা কম্পাস ছাড়াই, সেই ‘না-দেখা আলোর’ সাগরে। সেই নুবিয়ান ভূগোলবিদের অভিযানের মত, “তারা এসে পৌঁছাইছিল ছায়ার সাগরে, এখানে কী আছে তা জানতে।”

আমরা তবে বলবো যে আমি পাগল। এইটুকু অন্তত স্বীকার করি যে আমার মানসিক অস্তিত্বের দুইটা আলাদা অবস্থা আছে। একটা হইলো স্পষ্ট যুক্তিবাদী অংশ, যারে বাতিল করা যায়, এবং আমার জীবনের পয়লা ভাগের অভিজ্ঞতা হইতে তার জন্ম। আর আছে আরেক অংশ, যেইটা ছায়া ও দ্বন্দ্বের, যা আমার বর্তমান, এবং আমার জীবনের দ্বিতীয় যুগের স্মৃতি হইতে পাওয়া। সুতরাং, আমার জীবনের শুরুর দিকের যে ঘটনা বলবো, তা বিশ্বাস করেন; আর পরের দিকের ব্যাপারে যা বলবো, তারে কেবল তার যোগ্য স্বীকৃতিটুকু দিয়েন; অথবা পুরাটারেই একবারে সন্দেহের কাতারে ফালান; আর যদি সন্দেহ করতেও না পারেন, তাইলে ঈডিপাসের এই ধাঁধায় মইজা থাকেন।

সে, যারে আমি ভালোবাসতাম আমার যৌবনে, আর যার নামে এখন শান্ত ও স্পষ্টভাবে লিখতেসি এই স্মৃতিগুলা, ছিল আমার মরা মায়ের একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়ে। ইলিয়োনোরা ছিল আমার খালাত বোনের নাম। আমরা একসাথেই থাকতাম, একই তপ্ত সূর্যের নিচে, যেই প্রান্তরে বহুরঙা ঘাস জন্মাইত। কোনো ইতস্তত পায়ের ছাপ কখনো সেইখানে পড়ে নাই, কেননা এইটা ছিল বিশাল বিশাল পাহাড়ের সারির মধ্যে দূর এক কোণায়, যেইখানে সূর্যের আলোও আসতো না। এর আশপাশ দিয়া কোনো পথ ছিল না; এবং নিজেদের সুখী ঘরে ফেরার জন্য জোর দিয়া আমাদের হাজারো গাছের ঝরাপাতা সরায়ে দিরতে হইত, এবং লক্ষ লক্ষ সুগন্ধী ফুলের দম্ভ মাড়ায়ে আসতে হইত। তো এমনই ছিল সবকিছু, আমরা একা থাকতাম আর ওই প্রান্তরটুকু ছাড়া দুনিয়ার কিছুই বুঝতাম না — আমি, আমার খালা আর তার মেয়ে।

এই পাহাড় পার হইয়া আমাদের ঘিরা রাখা এই অঞ্চলের বাইরের আবছা এলাকায় তিরতির কইরা বইতো একটা সরু আর গভীর নদী, যে ছিল সবকিছুর চাইতে উজ্জ্বল, কেবল ইলিয়োনোরার চোখ দুইটা বাদে। সেই নদী ধীরেধীরে আঁকাবাঁকা পথ ধইরা চইলা যাইত ছায়াঢাকা ঘাটে, যেইখানে পাহাড়গুলা আরো বেশি অন্ধকার। আমরা এরে ডাকতাম ‘নীরবতার নদী। কেননা তার স্রোতের মধ্যে যেন ছিল এক নীরব কইরা দেয়া জোর। এর বুক থেকে কোনো গুনগুন উঠতো না, এবং এতই কোমলভাবে সে বইয়া যাইত যে তার মধ্যকার শান্ত নুড়িপাথরগুলা, যাদের দিকে চাইয়া থাকতে আমরা ভালোবাসতাম, তারা একটুও নড়তো না, বরং এক অনড় সুখে পইড়া থাকতো, যে-যার জায়গায়, চিরকালের মত উজ্জ্বল।

এই নদীর প্রান্ত, আর তার অসংখ্য ঝকঝকে শাখানদী যারা আইসা একই স্রোতে মিলতো, ও তার চারপাশের সবটুকু অংশ ছিল নরম সবুজ ছোট্ট ঘন সুগন্ধী ঘাসের মাদুরে ঢাকা। কিন্তু সেইসাথে এইখানে-ওইখানে ছড়ানো-ছিটানো হলুদ বাটারকাপ ফুল, বা সাদা ডেইজি, বেগুনি ফুল বা রক্তের মত লাল অ্যাস্ফোডেল, এইসবকিছুর অস্বাভাবিক সৌন্দর্য আমাদের হৃদয়েরে উচাস্বরে বলতো আমাদের প্রভুর মহত্ত্বের কথা।

আর এই ঘাস ও ঝোপের মাঝেই কখনো কখনো সব ছাপায়ে উঠতো চমৎকার গাছেরা, স্বপ্নের মতই ওয়াইল্ড। তাদের পাতলা কাণ্ড সোজাসুজি খাড়াইত না, বরং খানিকটা হেইলা থাকতো দুপুরের আলোর দিকে। তাদের বাকলের উপর ছিল কালো আর রুপালির ছোপ, এবং তারা ছিল সবচাইতে মসৃণ, শুধু আমার ইলিয়েনোরার গাল বাদে। ফলে তাদের ডালের চূড়ার চমৎকার সবুজ রঙের বিশাল পাতারা যখন আঁকাবাঁকা রেখা টাইনা বাতাসের সাথে দুলতো, তখন যেকেউ ভুলে তাদের গুলায়ে ফেলতে পারতো সিরিয়ার বিশাল সাপগুলার সাথে, যেন তারা তাদের সূর্যরে সালাম করতেসে।

এই উপত্যকায়ই পনের বছর আমি হাঁটসি ইলিয়েনোরার হাত ধইরা, ভালোবাসা আমাদের বুকের মধ্যে ঢোকার আগেই। এরপর এক সন্ধ্যায়, যখন ওর বয়স পনেরোর ঘরে, আর আমার বয়স বিশের মতন, আমরা বইসা ছিলাম একে অপরের বাহুর মধ্যে, সেই সাপের মত গাছগুলার তলে, আর আমরা তাকাইয়া দেখতেসিলাম নীরবতার নদের উপরে পড়া আমাদের ছায়া। ওই মিষ্টি দিনটায় আমরা আর কোনো কথা বললাম না। এমনকি ভোরেও আমরা কথা বললাম খুবই অল্প, তাও কাঁপাকাঁপা স্বরে। সেই স্রোত হইতেই আমরা খুঁইজা নিসিলাম প্রেমের দেবতারে, এবং টের পাইতেসিলাম সে আমাদের বুকের মধ্যে জ্বালায়ে দিতেসিল আমাদেরই পূর্বপুরুষের আত্মা। বাসনার যে তীব্রতা আমাদের বংশরে অন্যদের চাইতে আলাদা কইরা রাখসিল, তা আমরা টের পাইতেসিলাম আমাদের রক্তে, আর একপ্রকার ঝিমধরা আনন্দের সাথে মিশা সে শ্বাস ফেলতেসিল এই বহুরঙা ঘাসের প্রান্তরে। সবকিছুর উপর একটা বদল দেখা দিলো। যেই গাছে কোনো ফুল ধরে না, সেইখানেও অদ্ভুত সুন্দর, তারা-আকৃতির ফুল ফুটতে শুরু করলো। আমাদের পায়ের তলার সবুজ মাদুর আরো গভীর রঙ নিলো। আর যখন একে একে সাদা ডেইজিফুলগুলা মিলায়ে যাইতে লাগলো, তাদের জায়গায় জন্মাইতে থাকলো রক্তলাল অ্যাসফোডেল। আমাদের পথে প্রাণ জাইগা উঠলো। লম্বা ফ্লামিঙ্গো, যাদের আগে কখনো দেখা যায় নাই, তারা আরো সব ফুরফুরা পাখিদের সামনে নিজের পেখম মেইলা ধরলো। সোনালি ও রুপালি মাছ জাঁইকা বসলো নদীর বুকে, যেইখান থেকে আস্তে আস্তে জাইগা উঠলো একটা গুনগুন, এবং ধীরে তা রূপ নিলো একটা ঘুমপাড়ানি গানে, যা ছিল এমনকি এয়োলাসের বীণার সুরের চাইতেও মিষ্টি—জগতের সব স্বরের চাইতে মিষ্টি, শুধু আমার ইলিয়োনোরার কণ্ঠ ছাড়া। আর তখনই ঘন এক মেঘ, যারে আমরা হেস্পার অঞ্চলের উপর ভাসতে দেখসিলাম, সে তার লাল আর সোনালি আভা নিয়া আমাদের এদিকে আসলো, শান্তিতে নুইয়া আসলো আমাদের মাথার উপর আর থামলো যেন পাহাড়চূড়ায়, আর আমাদের ঘিরা ধরলো এক অপূর্ব অন্ধকার, আর যেন আমাদের বন্দি কইরা রাখলো ঐশ্বর্য আর রোশনাইয়ের জাদুমাখা এক জেলঘরে।

ইলিয়োনোরা ছিল ফেরেশতাদের মতই মিষ্টি। কিন্তু এই কুমারীর মধ্যে ছিল না কোনো ছলনা, এই ফুলগুলার মধ্যে যে ছোট্ট জীবনটা ও কাটাইসে তা ছিল পুরাপুরি নিষ্পাপ। যে ভালোবাসা ওর বুকের ভেতর তোলপাড় তুলসিল তাতে কোনো খাদ ছিল না, এবং ওই বহুরঙা ঘাসের প্রান্তরে একসাথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা সেই হৃদয়ের আরো গভীরে ঢুইকা পড়সিলাম, আমরা কথা বলতেসিলাম এইখানে কতকিছু বদলায়ে গেসে তা নিয়া।

এরমধ্যে একদিন, কাঁদতে কাঁদতে ও বলতেসিল মানবজাতির সর্বশেষ করুণ বদলের কথা। আর তারপর ও স্রেফ একটা বিষয় নিয়াই কথা বলতে লাগলো, আমাদের সকল আলাপের মধ্যে শুধু এই কথাটাই ঢুকায়ে দিতে থাকলো, যেরকম শ্চিরাজের গায়েনের গানগুলায় কিছু ছবি বারবার ফিরা ফিরা আসে।

মৃত্যুর কালো আঙুল ও নিজের বুকের উপর পড়তে দেইখা ফেলসিল—যে, এফেমেরোনের মতই, ওরেও এত সুন্দর কইরা বানানো হইসে কেবলই মইরা যাওয়ার জন্য। কিন্তু কবরের মধ্যে ওর ভয়ের কারণ ছিল কেবল একটা ভাবনা, যা ও এক সন্ধ্যায় নীরবতার নদের ধারে বইসা আমার কাছে খোলাসা করসিল। ও এই ভাইবা কষ্ট পাইতেসিল যে, এই বহুরঙা ঘাসের প্রান্তরে ওরে কবর দিয়া ফেলার পর আমি এইখান থেকে চলে যাব আর ওর প্রতি আমার যে তীব্র ভালোবাসা তা দিয়া দিব বাইরের নিত্যকার দুনিয়ার কোনো মেয়েরে। আর ঠিক তখনই আমি হুড়মুড় কইরা লুটায়ে পড়লাম ইলিয়োনোরার পায়ে, আর ওয়াদা করলাম, ওরে আর বেহেশতরে সাক্ষী রাইখা, যে দুনিয়ার আর কোনো মেয়ের সাথে আমি বিয়ার বন্ধনে আটকাব না—কোনোদিন ওর স্মৃতির গোলামি করা আমি ছাড়বো না। এবং আমি এই মহাবিশ্বের মহান শাসকরে তলব করলাম যেন সে আমার এই ওয়াদার ভারটা মাইপা নেয়। আর আমি তার আর ওর কাছ থেকে চাইয়া নিলাম অভিশাপ, যদি আমি এই ওয়াদা ভাঙ্গি তাইলে এমন পরিণতি হবে আমার যা এইখানে লেখাও সম্ভব না আমার। আর আমার কথা শুইনা ইলিয়োনোরার উজ্জ্বল দুই চোখ আরো উজ্জ্বল হইয়া উঠলো; আর ও এমন এক দীর্ঘশ্বাস ফালাইলো যেনবা ভয়ানক কোনো ভার ওর বুক থিকা নাইমা গেসে। আর তারপর ও কাঁপতে কাঁপতে খুব তিক্ত এক কান্না শুরু করলো। তবু এই ওয়াদা ও মাইনা নিলো (কেননা ও তো স্রেফ একটা বাচ্চাই ছিল) আর এতে মরণশয্যা মাইনা নেয়াটা ওর জন্য আরেকটু সহজ হইলো। আর তার কিছুদিন পরেই ও আমারে বললো, শান্তিতে মরতে মরতে, যে ওর আত্মার শান্তির জন্য সেইদিন আমি যে ওয়াদা করসিলাম, তার জন্য মইরা যাওয়ার পরও ওর আত্মা আমার দেখভাল করবে। আর যদি অনুমতি পাওয়া যায়, তবে রাতের গহীনে ও আমারে দেখাও দিবে। কিন্তু যদি তা বেহেশতের আত্মাদের এখতিয়ারের বাইরে হয়, তাইলে অন্তত ও নিজের উপস্থিতির ইশারা দিবে আমারে। সন্ধ্যার বাতাসে নিজের শ্বাস মিশায়ে দিবে, অথবা আমার নিশ্বাসের বাতাসে বেহেশতি সুগন্ধি ছড়ায়ে দিবে। এই কথাগুলা ঠোঁটে নিয়া এই নিষ্পাপ জীবন ও ছাইড়া চইলা গেল, আমার জীবনের প্রথম যুগের ইতি টাইনা।

***

এতখানি আমি সত্যটাই বললাম। কিন্তু সময়ের পথে আমার প্রিয়ার মরণে যে বাধা জন্মাইলো, তা ডিঙায়ে জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে যাইতে যাইতে আমি টের পাইলাম আমার মগজে একটা ছায়া জমতেসে। যদিও যথাযথ সবটা বলতে পারতেসি কিনা তা আমি জানি না। তবু বলি। ভারি পায়ে বছরগুলা আগায়ে চললো, তবু আমি ওই বহুরঙা ঘাসের প্রান্তরটা ছাড়লাম না। কিন্তু আরো একটা বদল দেখা দিলো। তারা আকৃতির ফুলগুলা গাছের গোড়ার সাথে মিলায়ে গেল, আর দেখা দিলো না। ঘাসের সবুজ গালিচা ফ্যাকাশে হইতে থাকলো; আর এক এক কইরা অ্যাসফোডেলগুলাও ঝইরা পড়তে লাগলো, এবং তাদের জায়গায় জন্মাইতে থাকলো কালো চোখের মত ভায়োলেটফুল, যারা অস্বস্তিতে কুচকায়ে থাকতো আর সবসময় ঢাকা থাকতো শিশিরে। আমাদের পথ থেকে জীবন বিদায় নিলো। এখন আর কোনো লম্বা ফ্লামিঙ্গো নিজের টকটকে পেখম মেইলা ধরে না, বরং দুখী ডানায় ভর কইরা পাহাড়ের দিকে উইড়া বেড়ায়, সাথে কইরা নিয়া যায় তার সাথে আসা সুখী সব পাখিদের। আর যত সোনালি রুপালি মাছ ছিল তারা নিচুপানির দিকে চইলা গেল আর এই মিষ্টি নদীর দিকে কখনোই আসলো না। এবং যে ঘুমপাড়ানি গান ভাইসা উঠতো নদীর বুক দিয়া, ধীরে ধীরে তাও মইরা গেল, তার গুনগুন কমতে কমতে সে নদীর স্রোত শেষে ফিরা গেল নিজের আদিম নীরবতায়। আর সবশেষে, সেই ঘন মেঘ এই পাহাড়ে চূড়া ফেইলা ফিরা গেল হেসপার অঞ্চলে, নিজের সমস্ত সোনালি মহান আভা ফিরায়ে নিয়া গেল এই বহুরঙা ঘাসের প্রান্তর থেকে।

তবু ইলিয়োনার কাছে করা ওয়াদা আমি ভুলি নাই; কারণ ফেরেশতাদের হাতের ধুনুচির আওয়াজ আমি শুনসি, এবং একটা পবিত্র সুবাস সারাদিন বইতো এই প্রান্তরের উপর দিয়া। আর একলা যখন থাকতাম, আর আমার বুক ভারি হইয়া আসতো, আমার কপাল মুছায়ে দেয়া বাতাস আমারই দীর্ঘশ্বাসে নুইয়া পড়তো; আর একবার—হায়, স্রেফ একবারই! এক মরণঘুম থেকে উইঠা আমি টের পাইসিলাম আমার ঠোঁটের উপর যেন এক আত্মার ঠোঁট।

কিন্তু আমার বুকের শূণ্যতা কোনোভাবেই রাজি হইলো না ভরাট হইতে। যেই ভালোবাসায় আমার বুক উপচায়ে ছিল সেই ভালোবাসাটাই ফিরা পাইতে চাইসিলাম আমি। একটা সময় পুরা প্রান্তরটাই ইলিয়োনার স্মৃতি জাগায়ে তুইলা কষ্ট দিতে লাগলো আমারে, এবং আমি এই জায়গা ছাইড়া দিয়া চইলা গেলাম বেহুদা দুনিয়াবি কোলাহলের জগতে। নিজেরে আমি খুঁজে পাইলাম এক অদ্ভুত শহরে, যেইখানের সবকিছুই বহুরঙা ঘাসের সেই প্রান্তরে কাটানো মিষ্টির স্বপ্নের দিনগুলার স্মৃতি শুইষা নিতে লাগলো। সেইখানকার দরবারের ভুয়া জাকজমক, অস্ত্রশস্ত্রের ঝনঝনানি, আর মহিলাদের অসম্ভব রূপ আমার মগজ ভুলায়ে দিলো। কিন্তু তখনো আমার আত্মা ভোলে নাই তার ওয়াদা, আর প্রায়ই ইলিয়োনোরার হাজিরার ইশারা পাইতাম আমি রাতের নীরবতায়। কিন্তু হঠাৎ একসময় এই ইশারাগুলা থাইমা গেল, আর পুরা দুনিয়া আমার চোখের সামনে আন্ধার হইয়া গেল। আমারে চাইপা ধরা জ্বলন্ত ভাবনা, যত জঘন্য বাসনা আমারে ভিতর থেকে খুবলাইতেসিল তার সামনে আমি তব্দা খায়া দাঁড়ায়ে রইলাম। কেননা যেই রাজার সুখী দরবারে আমি কাজ করতাম, সেইখানে বহুদূরের অজানা কোনো দেশ হইতে আসলো এক কুমারী যার রূপের কাছে আমার হৃদয় নিজেরে বিলায়ে দিলো নিমেষে—যার পায়ের কাছে আমি মাথা নোয়ায়ে দিলাম কোনো চিন্তা ছাড়াই, ভালোবাসার সবচেয়ে জোরালো, স্পষ্ট বন্দেগিতে। আর সেই প্রান্তরের ছোট্ট মেয়েটার প্রতি আমার যে আবেগ ছিল, তার সাথে কী তুলনা হইতে পারে এই উত্তেজনা, এই ভ্রম, এই আত্মারে জাগায়ে তোলা ভালোবাসার, যা আমি নিজের চোখের পানির সাথে মিশায়ে ঢাইলা দিসিলাম চিরন্তন রাণী, আর্মেনগার্ডের পায়ে? আহা কী উজ্জ্বল এক ফেরেশতা ছিল এই আর্মেনগার্ড! আর তাতে মগ্ন হইয়া থাকায় আমার মনের মধ্যে আর কারো জন্য জায়গা রইলো না। আহা, কী স্বর্গীয় এক ফেরেশতা সেই আর্মেনগার্ড! আর যখন আমি ওর স্মৃতিভরা চোখের অতলে তাকাইতাম তখন স্রেফ সেই চোখ দুইটার কথাই ভাবতাম—আর ওর কথা।

আমি বিয়া কইরা ফেললাম—যেই অভিশাপ আমি নিজের উপর ডাইকা আনতেসি তার ভয় না কইরাই। এবং সেই অভিশাপের তিক্ততাও বর্ষাইলো না আমার উপর। আর একবার—এবং এইবারও রাতের নীরবতায়, আমার জানালার জাফরি থেকে ভিতরে ঢুকলো কিছু পাতলা দীর্ঘশ্বাস, যারা আমারে ছাইড়া চইলা গেসিল; এবং ধীরেধীরে তারা রূপ নিলো এক পরিচিত মিষ্টি কণ্ঠের, বললো:

“শান্তিতে ঘুমাও!—কেননা ভালোবাসার আত্মার শাসন কায়েম আছে। এবং যেহেতু নিজের হৃদয়ে তুমি জায়গা দিসো আর্মেনগার্ডরে, ফলে তোমারে আজাদ কইরা দেয়া হইলো ইলিয়োনোরার প্রতি করা তোমার ওয়াদা হইতে। এর কারণ তোমারে জানানো হবে বেহেশতে।”

The following two tabs change content below.
Avatar photo

মাহীন হক

মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →