আমেরিকা ইজরাইলের সাথে এত গা ঘষাঘষি করে কেন? – নোম চমস্কি (২০২৩) Featured

যদি জিজ্ঞাসা করেন, আমেরিকা কেন ইসরাইলের সাথে এত গা ঘষাঘষি করে? তাহলে বইলা রাখি, এইটার পিছনে ইতিহাস আছে। পুরান দিনের হাওয়ায় গড়া এক কাহিনি। আশলে ইহুদি জায়োনিজম পয়দা হওয়ার অনেক আগেই খ্রিষ্টানি জায়োনিজমের বীজ পোঁতা হইছিল। ইংল্যান্ডের এলিট ঘরানার কাছে এই খ্রিষ্টানি জায়োনিজম ছিল ঈমানের জ্বলন্ত আগুন। বালফুর ডিক্লারেশন*i ছিল সেই ঈমানেরই একটা সাচ্চা আমল। ব্রিটিশ সরকার ইহুদিপল্লী বানানোর জন্য ফিলিস্তিনের জমিনই বাইছা নিছে কেন? আশলে বাইবেলের কথা স্মরণে আছিল তাদের—বাইবেলের ইশারাই সত্য বইলা মাইনা নিছে তারা। ব্রিটিশ এলিটদের মনমগজ ভরাই ছিল বাইবেল দিয়া। যার কারণে ইহুদি কলোনি বানাইতে সাপোর্ট করছিল ব্রিটিশরা।
আমেরিকায়ও ঠিক এইরকম। উড্রো উইলসন আছিলেন একজন ইমানদার নাসারা, প্রতিদিন বাইবেল পড়তেন তিনি। হ্যারি ট্রুমানেরও জীবন আছিল বাইবেল। রুজভেল্টের আমলে হারল্ড ইকিস নামে এক বড় সরকারি এক হোমচোমড়া লোক আছিলেন, তিনি একবার বলছিলেন, ইহুদিরা যে ফিলিস্তিনে ফিরা আসছে—এইটাই নাকি দুনিয়ার ইতিহাসে সবচাইতে বড় ঘটনা। এইটারে বাইবেলের খোয়াবের বাস্তব রূপ বইলা মনে করছিলেন হারল্ড ইকিস। আমেরিকা, ইংল্যান্ড নিজেরাই এক ধরনের ধর্ম মাইনা চলা দেশ। বাইবেলের হুকুমগুলারে তারা বেশিরভাগ সময় খালি কথায় না কাজেও হুবহু মাইনা চলে। এইটা খালি ধর্মের আলাপ না, এইটা কলোনি বানানোরও পায়তারা। এইটা আছিল ইউরোপীয় কলোনির আখেরি মঞ্জিল। খেয়াল কইরা দেখবেন ইজরাইলের সবচাইতে বড় সাপোর্টার খালি আমেরিকা না—অস্ট্রেলিয়া, কানাডা—মানে সবগুলাই ইংল্যান্ডের ইশারায় গইড়া উঠছে । অনেক সময় এইটারে ‘অ্যাংলো-স্ফিয়ার’ বা ইংরেজি সালতানাতের বাকশো বইলাও ডাকা হয়। এইসব আছিল আজব টাইপের জুলুমের দখলদারি (যেইটারে কেতাবি ভাষায় সাম্রাজ্যবাদ বলে)। বৃটিশরা ভারতে যেমন কলোনি বানাইছিল ফিলিস্তিনের ব্যাপারটা কিন্তু ওই রকম না। বরং এইসব ছিল, সরাসরি দখল কইরা ইহুদিদের জন্য রাষ্ট্র বানানো। যেইখানে দখলদাররা আইসা নিজেরা পাড়া, মহল্লা, রাষ্ট্র বানাইছে আর লোকাল মানুষদের একরকম হটায়া দিছে। দক্ষিণ আফ্রিকা বা আলজেরিয়ায় ফরাসিরা যা করছিল কিছুটা তেমন। আশলে খ্রিষ্টানি জায়োনিজমের চিন্তা দিয়া প্রভাবিত মানুষেরাই এইসব দেশ বানাইছিল—যারা ধর্মের নামে আইসা দেশ বানাইতো। এইগুলাই ছিল বড় ধরণের ধর্মীয় কালচারাল ব্যাপার- স্যাপার।
মিডিলইস্টের মানচিত্রে এই অঞ্চলের যে অবস্থান সেইটাও বড়ো একটা কারণ ছিল ফিলিস্তিন দখলের পিছনে। ১৯৪৮ সালে যখন ইজরাইল কায়েম হলো তখন আমেরিকার ভেতরেই নানান মতের ফারাক দেখা দেয়। একদিকে পেন্টাগন যারা হিম্মতের খেলায় ইসরাইলের পাশে দাঁড়াইতে চাইছিল; আরেকদিকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট যারা সরাসরি দখলের খেলায় শরিক হইতে রাজি আছিল না। তাদের নজর ছিল সেই লাখ লাখ মুহাজির মানুষের দিকে যাদের ঘরবাড়ি তছনছ হয়ে গিয়েছিল। তারা চাইছিল এই জুলুমের পরে নিজেদের জমিন থেইকা উৎখাত হওয়া মজলুমদের অন্তত একটা ন্যায্য ফয়সালা হোক।
@commietrashh Why Does The U.S. Support Israel? | feat. Noam Chomsky | #chomsky #noamchomsky #liberal #democrat #leftist #leftisttiktok #libertarian #viral #trending #foryoupage
পেন্টাগন আবার ইজরাইলের সামরিক শক্তি আর তাদের যুদ্ধজয়ের খামখেয়ালিতে বেশ মজে ছিল। যদি আপনি যদি সেই সময়ের গোপন দলিল-দস্তাবেজ দেখেন তাহলে খেয়াল করবেন, আমেরিকার জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ তুরস্কের পরেই ইজরাইলরে ওই অঞ্চলের দুসরা বৃহত্তম আর্মি পাওয়ার হিসেবে বর্ণনা করছিল। ভবিষ্যতে আমেরিকা এই অঞ্চলরে তাদের পাওয়ারের জন্য সম্ভাব্য ঘাঁটি হিসেবেও ভাবছিল । যেইটা চলমান ছিল। আমি এখন পুরা ইতিহাস বয়ান করতেছি না কিন্তু ১৯৫৮ সালে যখন এই অঞ্চলে ভয়ঙ্কর এক মসিবত শুরু হয় তখন ইজরাইলই ছিল একমাত্র রাষ্ট্র ছিল যে ব্রিটেন আর আমেরিকারে পুরাদমে মদদ দেয়। আর এই খোলাখুলি মদদের জন্যই ইজরাইল তখন পশ্চিম ও আমেরিকার সরকার আর মিলিটারি মহল থেইকা বহু সমর্থন পাইছিল।
ইজরাইলের সাথে আমেরিকার আজকের দোস্তি আশলে পাকাপাকি হয় ১৯৬৭ সনে। সেই সময়ে ইজরাইল আমেরিকার জন্য একটা বড়ো খেদমত করে—তারা আমেরিকার দুশমন সেকুলার আরব জাতীয়তাবাদরে ধ্বংস কইরা দেয়। এর বদলে ইজরাইল শরিয়তপন্থী (পশ্চিমা মিডিয়ায় Radical Islam এর অর্থ করে ‘উগ্র ইসলাম’ তবে আমি মনে করি পশ্চিমা বয়ানের বাইরে এই শব্দের অর্থ হতে পারে ‘ইসলামি শরিয়তপন্থী’) শক্তিগুলারে মদদ করতে থাকে, আমেরিকা আবার নিজের ফায়দা লাভের জন্য শরিয়তপন্থীদের সাথেই তাল মিলায়া চলত। এই খেলাটা আজও চলতেছে। এই তো সেদিনের গাজা হামলার সময়ও আমরা তার একটা ঝলক দেখলাম। মনে আছে না! এক সময় ইজরাইলের গোলাবারুদ ফুরায়া যাইতেছিল যদি তারা আগে থেইকাই একেবারে মাথা থেইকা পা পর্যন্ত অস্ত্রে ঠাঁসা ছিল। তখন আমেরিকা পেন্টাগনের হাত ধইরা ইজরাইলরে নতুন কইরা গোলাবারুদ পাঠায়ছিল। আর খেয়াল কইরা দেইখো— এগুলা কিন্তু হাওয়ায় ভাইসা আসে নাই। এইসব গোলাবারুদ আগে থেইকাই ইজরাইলের মাটিতে রাখার বন্দোবস্ত ছিল, যাতে দরকার হইলেই আমেরিকার নিজের বাহিনী এই গোলাবারুদ ব্যবহার করতে পারে। এইরকম বন্দোবস্ত কেবল একটা কথাই বলে— ইসরাইলরে আমেরিকা অনেকটা নিজেদের এক অফিসারের মতো দেখে। দুই দেশের মধ্যে এই রিশতা শুধু অস্ত্রের লেনদেনেই না, গোপন খবর আদান-প্রদান, ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিঙসহ এই সম্পর্কের গিঁট আরও গভীরে বান্ধা।
মিডিয়াও আশলে সরকারের নীতির সাথে তাল মিলায়াই চলে। মাঝেমধ্যে এদিক-ওদিক সামান্য প্রশ্ন তোলে কিন্তু সরকারের মূলনীতি তারা মাইনাই নেয়। আরেকটা ঘটনা দেখা যাক—ইরাকে আমেরিকার হামলা নিয়া। তুমি বাতি লাগাইয়া খুঁজলেও আমেরিকার কোনো বড় মিডিয়ায় ‘ইরাকে আমেরিকার হামলা’ এই বাক্য পাবেনই না। অথচ ঘটনা একদম সাফসাফ ঘটছিল— সরাসরি ইরাকে হামলা করছিল আমেরিকা, সবার চোখের সামনে জবরদস্তি তাণ্ডব চালাইছিল আমেরিকা, এক তরফা যুদ্ধের ময়দানে নিরীহ মানুষের উপর ক্লাসিক পাপের উদারহণ, যেই রকম ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালে বলা হইছিল ‘দুনিয়ার সবচে বড় জালেমি, সবচে বড় জুলুম’। কিন্তু এই কথা আবার বলাও যাবে না। এইটা বইলা ওবামা প্রেসিডেন্টের তারিফ করা হয়, তিনি নাকি ইরাকে হামলার বিরোধিতা করছিলেন। বাস্তবে তিনি কী বলছিলেন? বলছিলেন, এটা ভুল ছিল, একটা হেকমতি ভুল। আমরা এর ফায়দা তুলতে পারবো না। ব্যাস এইটুকুই! এই টাইপের বিরোধিতার নমুনা আপনারা জার্মানির মিলিটারি অফিসারদের মধ্যে পাইবেন, হিটলার যখন রাশিয়ায় হামলা চালাইছিলেন তখন। তারা বলছিল, এইটা ভুল হইতেছে, আগে ইংল্যান্ডরে দমাইতে হইতো। ঐটাও নাকি বিরোধিতা! তাই, ঠিকঠাক বিরোধিতা বা ইনসাফের কথা বলার জায়গা মিডিয়ার ভিতর বড়জোর এত টুকুই ছিল।
ভিয়েতনামের ক্ষেত্রেও কাহিনি একই। ‘আমেরিকা ভিয়েতনামে কী কী কোরবানি দিলো!’ এই আলাপ নিয়া বিরাট বিরাট স্মরণসভা, স্মৃতির জলসা, দোয়া-মজলিস। বিশাল আয়োজন! কিন্তু আপনি চাইলেও ‘দক্ষিণ ভিয়েতনামে আমেরিকার হামলা’ বাক্য খুঁজে পাবেন না কোনো বড় মিডিয়ায়। ১৯৬১ সালে যখন এই হামলা হইছিল তার পর থেইকা আজ পর্যন্ত মূলধারার কোথাও এইভাবে বলা হয় নাই। হয়তো ‘ডেমোক্রেসি নাউ’ টাইপের কোনো বিকল্প মিডিয়ায় কিছু পাইতে পারেন বা আমি যা লিখি সেখানে এক আধটু আসে, কিন্তু মেইন্সট্রিমে কিছু নাই। আর এইটা খালি আমেরিকার কাহিনী না। ধরেন, ব্রিটেনের কথা। ব্রিটেনের ‘Times Literary Supplement’ এর মতো সাহিত্য পত্রিকাগুলায়, যেমন টাইমস লিটারারি সাপ্লিমেন্টে, এক ধরণের একটা আলাপ চলতেছে— ব্রিটেন কি অবশেষে মাইনা নিবে যে তার শত শত বছরের কলোনি বানানোর মধ্যে জেনোসাইডের চরিত্র ছিল? ব্রিটেন কি এখন নিজের অতীত কাজের দিকে তাকাবে? এই প্রশ্ন তো বহু জায়গায় তোলাই যায়! কিন্তু যতবারই প্রশ্ন তোলা হয় বুদ্ধিজীবীদের মিছিল ঢুইকা যায় একটা পরিচিত খাঁচার মধ্যেই। রাষ্ট্রের ক্ষমতা আর পুঁজির ইশারার পাশে পাল ধইরা হাঁইটা যায় বুদ্ধিজীবীরা।
মানুষেরা, খাস কইরা আমরা যারা বুদ্ধিজীবী, সবসময় ক্ষমতার খেলাফে থাকি বইলা মনে করি, যে কোনো চিন্তারে সাচ্চা নজর দিয়া ভাবি, নিজেদেরকে বাহাদুর ভাইবা সুখ পাই। আমরা ক্ষমতার মুখের ওপর কথা বলি, জুলুমের সামনে দাঁড়ায়া থাকি। বাস্তবে এই কথা ঠিক না। ইতিহাসের পাতায় যদি নজর দেন তাহলে দেখবেন এই রকম মানুষের সংখ্যা খুব কমই আছিলো। যারাও এমন ছিলেন তারাও আবার দলের বাইরে একলা থাকা লোক। বেশিরভাগ সময়ই সরকারের জুলুমের শিকার হইছিলেন তারা।
মেইনস্ট্রিম বরাবরই সেই দল যাদেরকে এক সময় বলা হইতো ‘ভেড়ার পালে একেক জন স্বাধীন আতেল’—অথচ তারা রাষ্ট্রের ক্ষমতার সাথে তাল মিলায়া চলত। এইটা নয়া কিছু না। কপাল মন্দ, কিন্তু কথা ঐটাই, এইসব নতুন কিছু না। এইসবের বিরুদ্ধে লড়াই জারি রাখতে হয়। লড়াইটা চিরকালেরই।
…
*বালফুর ডিক্লারেশন হইলো একটা চিঠি যেইটা ব্রিটিশ ইহুদি নেতা রথ চাইল্ডরে লিখছিলেন ইংল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রী আর্থার জেমস বালফুর, ১৯১৭ সালে। এই চিঠির আলাপ ছিল ব্রিটেন ফিলিস্তিনের মাটিতে ইহুদিদের জন্য একটা আলাদা রাষ্ট্র বানানোর পক্ষে যেকোনোভাবে ইহুদিদের পাশে আছে। এইটাই ছিল শুরু। ফিলিস্তিনের জমিনে, ফিলিস্তিনীদের মতামতের তোয়াক্কা না কইরা, বাইরের লোকদের জন্য একখান রাষ্ট্রের ভিত গড়া হইলো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হাতে লেখা হইল ফিলিস্তিনের তকদির।

হাসান রোবায়েত

Latest posts by হাসান রোবায়েত (see all)
- আমেরিকা ইজরাইলের সাথে এত গা ঘষাঘষি করে কেন? – নোম চমস্কি (২০২৩) - এপ্রিল 23, 2025
- রেড মওলানার(?) হুদাই হুশিয়ারি - ফেব্রুয়ারি 12, 2025
- হাসান রোবায়েতের কবিতা - জানুয়ারি 5, 2023