কলকাতার পুরস্কার—কীভাবে নিব?
[এডিটর’স নোট: লেখাটা পুব বাংলার কথা ও কালচার লইয়া কলিকাতার দেখনভঙ্গির বেশ পুরানা কিছু নজির আমাদের শামনে আনছে। এগুলি তো আমরা বহুদিন ধইরাই বলতেছি, আমরা ও অনেকেই, কিন্তু এই দেশি কিছু ভাবুক সেগুলি একরকম আমাদের আবিষ্কার বইলাই গনেনাই আর। কিন্তু ওই দেখনভঙ্গির পিছনে যে শচেতন বর্নবাদি পজিশন আছে, শেইটা হইলো আমাদের কনছার্নের জায়গা। এই লেখায় ওই জায়গাটা আশছে।
এছারাও আরও কিছু জায়গা কলিকাতার ওই অবস্থানের শুতা ধইরা কাভার করতে চাইছে রাইটার, শেইটা অনেক শময় মনে হইছে এই লেখার অংশ না হইলেও পারতো। তবে লেখকের লেখার গরনগারন কেমন হবে তা লেখকের অভিরুচি মোতাবেক নির্ধারিত হওয়াই ভালো এবং তাতে যে কোন ধরনের উপদেশনা এক ধরনের অযাচিত মাতবরিই আশলে। আমরা বরং এইটাও মনে করি, যে কোন লেখাই পরার খেত্রে রিডাররেও দায়িত্ত নিতে হবে, লেখারে নিতে হবে উইথ মডারেশনস। পরারে একটা প্যাসিভ ঘটনা বানায় রাখা কাজের কথা না।]
বাংলাদেশি শিল্পীরা ঘনঘন কলকাতায় পুরস্কার পাচ্ছেন। আজকেও দেখলাম জয়া আহসান, সোহেল মণ্ডল আরো কে কে যেন পুরস্কার পাইলেন। ফিল্মফেয়ার পুরস্কার। সেরা অভিনেতার পুরস্কার। চমৎকার দৃশ্য। পুরস্কার পাওয়া তো ভালো ঘটনা। তার উপর যদি হয় বিদেশে, তাইলে তো গর্ব করাই যায়!
থামেন, অল্পতেই গর্বিত হওয়ার রোগটা কিন্তু মারাত্মক লেভেলে চলে গেছে আমাদের। অমুকে গুগলে চাকরি পাইছে, একই দেশের লোক তাই আপনি গর্বিত হলেন, তমুকে ইউটিউবের হেডঅফিসে গেছে, একই জাতি বলে আপনি গর্বিত হলেন, কয়দিন পর তো এমন অবস্থা হবে যে অমুক সেলিব্রেটি পাদ মারছে, আপনি তাতেও গর্বিত হবেন!
কলকাতায় বাংলাদেশি অভিনেতা অভিনেত্রী পুরস্কার পাইছে এইটাতে খুশী হবেন না বেজার হবেন সেইটা ঠিক করে দেওয়ার আমি কেউ না। তবে পুরস্কার যেহেতু খুশীই হবেন, যেহেতু খুশী হওয়ার অভ্যাস আপনাদের আছে, এইটাই স্বাভাবিক। কিন্তু খুশী হওয়ার কারণ যদি খাসি বানানোর কারণও হয়? তাইলে তো সমস্যা। খুশী হওয়া যাইতো, যদি উদ্দেশ্য ভালো হইতো। তারা যে পুরস্কার দিছে তা খালি চোখে পুরস্কার মনে হইলেও এইটা নিয়া একটু ভাবলেই বুঝবেন যে এইটার পেছনের উদ্দেশ্য খুবই সমস্যাজনক। আজ যারা কলকাতায় গিয়া পুরস্কার আনতেছে তারা মূলত খাল কাইটা কুমির আনতেছে।
অনেক দিন ধরেই কলকাতার লোকেরা হায়হুতাশ করতেছে বাংলা ভাষা গেল গেল বলে। এই কান্নাকাটির বয়স অনেক হইলেও তীব্রতা পাইছে ২০১৯ সালে। ব্যাপকভাবে প্রতিবাদ শুরু হয় তখন থেকে। মাঝখানে একটু থামছিল। ২০২২ সাল থেকে আবারও বাড়ছে।
২০১৯ সালের নিউজ দেখেন বিবিসি বাংলা আর ডয়েচে ভেলে শিরোনাম করছে “পশ্চিমবঙ্গে প্রবল হচ্ছে ‘হিন্দির আগ্রাসন’ বিরোধী প্রচারণা, রাজ্যে থাকার শর্ত ‘বাংলা জানা’ (বিবিসি বাংলা)”, “পশ্চিমবঙ্গে হিন্দির আগ্রাসনের অভিযোগ (ডয়েচে ভেলে)”।
যখন কিনা কলকাতাই স্ট্রাগল করতেছে তাদের ভাষার ওপর হিন্দি ভাষার আধিপত্য ঠেকাইতে নিজের ভাষা আর বাঙালিত্ব বাঁচাইতে, সেই একই সময়ে তারা বাংলাদেশের বাংলা ভাষাভাষী লোকদের পুরস্কার দিতেছে! ইন্টারেস্টিং না?
পুরস্কার কারা দিল? কলকাতার বাঙালি হিন্দুরা, যারা কিনা এক সময় মুসলমানকে বাঙালি বলতেই রাজি ছিল না (এখনও মন থেকে রাজি আছে তো?)।
রাজি আছে কিনা তা বুঝতে হলে দেখতে হবে কলকাতার সাধারণ পাবলিক আমাদের কোন চোখে দেখে। বাংলাদেশিদের কলকাতার লোকেরা যে ব্যাঙ্গ করে কাঙালি বা কাংলু বলে। সামান্য কিছুতেই বাংলাদেশিরা যে ছোট জাতের বলে। এই মনোভাবই কিন্তু তাদের মনের আসল অবস্থা। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশিদের প্রতি ভারতীয় বাঙালিদের ঘৃণা জানানোর তথ্যের ভিত্তিতে এই দাবি করতেছি না, ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতেই এই দাবি। তাদের যারা পূর্বপুরুষ—নীরদচন্দ্র চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, সজনীকান্ত দাস, তারাও আমাদের প্রতি (পূর্ববঙ্গের মুসলমান ও হিন্দু) যে ঘৃণা পোষণ করতেন তা আরও ভয়াবহ আরও জঘন্য।
আমরা সবাই মূলত জানি শনিবারের চিঠি সাহিত্যিক দলাদলি থেকে বের হইছিল। কিন্তু তাদের মূল টার্গেট ছিল পূর্ববঙ্গের লোকদের, আরো ভালো করে বললে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের বাংলা সাহিত্যে আগমন ঠেকানো। এ কথার সাক্ষ্য দিয়া গেছেন স্বয়ং সজনীকান্ত দাস তাঁর ‘আত্মস্মৃতি’তে। স্বীকার করে গেছেন : ‘সাহিত্যক্ষেত্রে কাজি নজরুল ইসলাম… সাপ্তাহিক ‘শনিবারের চিঠি’র প্রত্যক্ষ লক্ষ্য ছিলেন।’
আত্মস্মৃতির দ্বিতীয় খণ্ডে শনিবারের চিঠির সাথে নজরুলের সম্পর্ক-সম্বন্ধটি উপভোগ্য ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে: ‘সত্য কথা বলিতে গেলে শনিবারের চিঠি’র জন্মকাল হইতেই সাহিত্যের ব্যাপারে একমাত্র নজরুলকে লক্ষ্য করিয়াই প্রথম উদ্যোক্তারা তাক করিতেন। তখন আমি আসিয়া জুটি নাই। অশোক-যোগানন্দ-হেমন্ত এলাইয়া পড়িলে ওই নজরুলী রন্ধ্র-পথেই আমি শনিবারের চিঠি’তে প্রবেশাধিকার পাইয়াছিলাম। প্রকৃতপক্ষে ‘শনিবারের চিঠি’র একমাত্র প্রধান লক্ষ্য ছিল নজরুল এবং ব্যঙ্গ বিদ্রুপে তাকে ধরাশায়ী করাই ছিল সে লক্ষ্যের সঞ্চরণক্ষেত্র।’
Continue reading