এডগার এলান পো’র ফিকশন: ইলিয়োনোরা
পো’র মাধ্যমেই কবিতার প্রতি ভালোবাসা জন্মাইসিল আমার। আরো ৭-৮ বছর আগে, প্রথম যখন ওর রেভেন কবিতাটা পড়লাম, তব্দা খায়া গেসিলাম। পরে যে মজার জিনিসটা খেয়াল করসিলাম, যে এরপরে মেজর যত লেখক বা কবির লেখাপত্রের সাথে পরিচয় হইতেসে তারা প্রায় সবাই-ই কোনো না কোনো পর্যায়ে পো’র লেখাপত্র দিয়া ভালোভাবেই প্রভাবিত হইয়া আসছে। জীবনানন্দের বেশকিছু কবিতা পো’র কবিতার ভাবানুবাদ এমন আলাপ তো পুরানোই। বোদলেয়ারেরও সাহিত্যজীবন শুরু হইসিল পো’র লেখা ফরাসিতে অনুবাদ কইরা। লাভক্র্যাফট আলাদা একটা ঘরানা তৈরি করসিল পো’র হররের টেকনিকের উপর দাঁড়ায়ে। এমনকি প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাসও লিখসিল এই ব্যাটা, যার থেকে ইন্সপিরেশন নিয়া পরে আর্থার কোনান ডয়েল শার্লক হোমস লিখলো। এরম আরো অনেক বলা যাবে। তো, আমার ধারণা হইলো ওই শতকে সাহিত্যের দুনিয়ায় সে ছিল একটা ইভেন্ট। মানে এডগার অ্যালান পো হইয়াই আসতে হইত লেখকদের।
এইটার কারণও আছে। ওর মত কনশাস লেখক সম্ভবত খুব কমই ছিল। গল্প-কবিতার পাশাপাশি পো ছিল একজন সাহিত্যসমালোচক। সমসাময়িক লেখকদের খুবই নির্মমভাবে ক্রিটিক করতো, যেই কারণে অনেকের অপছন্দেরও ছিল সে। তা যাইহোক, এই সাহিত্যসমালোচকের নজর সে নিজের লেখা হইতেও সরায় নাই সম্ভবত। গল্প লেখার বেলায়ও তার কিছু রুল ছিল। একটা রুল হইলো, গল্প হইতে হবে ছোট, এক বসায় পইড়া ফেলার মত। আরেকটা রুল হইলো, প্রত্যেকটা শব্দ হইতে হবে নিরেট। মানে এমন একটা শব্দও থাকা যাবে না যা সরায়ে ফেললে গল্পের ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। এইজন্যই দেখা যায় তার গল্পগুলা এত টানটান।
পো’র গল্পগুলার একটা কমন উপাদান হইলো হরর। কিন্তু ওর হরর একটু অন্যরকম লাগে আমার। কোনো অলীক হরর না ঠিক, যদিও তাও আছে। বরং আরো অনেক বাস্তবিক, দুনিয়াবি একটা আতংক। সবচাইতে কাছের বন্ধু, নিজের ঘরের মানুষ কেউই ভরসাযোগ্য না। এবং আরো মজার জিনিস হইসে, তাদের এই হঠাৎ মাথায় খুন চাপার কোনো কারণ আপাতভাবে খুইজাও পাওয়া যায় না, কোনো মোটিভই বলতে গেলে নাই। এই হররটা আমার কাছে ভূতপ্রেতের চাইতেও ভয়াবহ লাগে, কারণ এই হররটা অনেক বেশি বাস্তবিক, আমাদের যেকারো সাথে ঘটার সম্ভাবনা রাখে। আবার এই প্রচন্ড ভয়ানক সিনারিগুলারে পো বর্ণনা করে এত টানটান, কাব্যিক ভাষায় যে বলার মত না। ব্যাটা তো মূলত কবিই আসলে।
মাহীন হক
এপ্রিল, ২০২৪
…
আমি এমন এক জাতির সন্তান যারা তাদের কল্পনাশক্তি আর বাড়াবাড়ি রকমের আবেগের জন্য পরিচিত। বহু লোক আমারে পাগল বলসে; কিন্তু এই প্রশ্নের কোনো মীমাংসা এখনো হয় নাই, পাগলামি আদতে সবচাইতে উঁচু পর্যায়ের বুদ্ধিমত্তারই অপর নাম কিনা—যাকিছু মহৎ—যাকিছু গভীর—তার বিশাল এক অংশ চিরকালই উল্টাপথের চিন্তা থেকে, সাধারণ মানুষের বুদ্ধির চেয়ে উপরের কারো মেজাজ থেকেই জন্মায় কিনা। যারা দিনের বেলায়ও স্বপ্ন দেখতে পারে তারা এমন অনেক জিনিস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, যার খবর কেবল রাতেই স্বপ্ন দেখনেওয়ালারা কখনো পায় না। তাদের আবছা নজরে তারা অনন্তের খানিক আভাস দেখতে পায়, এবং ওঠার পর তারা শিউরায়ে উঠে এই জাইনা যে কোনো এক মহান রহস্যের নাগাল তারা পাইসিল। খামচায়ে খামচায়ে তারা অর্জন করে কিছু জ্ঞান যা ভালো, এবং নিছক কিছু তথ্য যা মন্দ। তারা তবু ভেদ কইরা ঢুইকা যায়, কোনো হাল কিংবা কম্পাস ছাড়াই, সেই ‘না-দেখা আলোর’ সাগরে। সেই নুবিয়ান ভূগোলবিদের অভিযানের মত, “তারা এসে পৌঁছাইছিল ছায়ার সাগরে, এখানে কী আছে তা জানতে।”
আমরা তবে বলবো যে আমি পাগল। এইটুকু অন্তত স্বীকার করি যে আমার মানসিক অস্তিত্বের দুইটা আলাদা অবস্থা আছে। একটা হইলো স্পষ্ট যুক্তিবাদী অংশ, যারে বাতিল করা যায়, এবং আমার জীবনের পয়লা ভাগের অভিজ্ঞতা হইতে তার জন্ম। আর আছে আরেক অংশ, যেইটা ছায়া ও দ্বন্দ্বের, যা আমার বর্তমান, এবং আমার জীবনের দ্বিতীয় যুগের স্মৃতি হইতে পাওয়া। সুতরাং, আমার জীবনের শুরুর দিকের যে ঘটনা বলবো, তা বিশ্বাস করেন; আর পরের দিকের ব্যাপারে যা বলবো, তারে কেবল তার যোগ্য স্বীকৃতিটুকু দিয়েন; অথবা পুরাটারেই একবারে সন্দেহের কাতারে ফালান; আর যদি সন্দেহ করতেও না পারেন, তাইলে ঈডিপাসের এই ধাঁধায় মইজা থাকেন।
সে, যারে আমি ভালোবাসতাম আমার যৌবনে, আর যার নামে এখন শান্ত ও স্পষ্টভাবে লিখতেসি এই স্মৃতিগুলা, ছিল আমার মরা মায়ের একমাত্র বোনের একমাত্র মেয়ে। ইলিয়োনোরা ছিল আমার খালাত বোনের নাম। আমরা একসাথেই থাকতাম, একই তপ্ত সূর্যের নিচে, যেই প্রান্তরে বহুরঙা ঘাস জন্মাইত। কোনো ইতস্তত পায়ের ছাপ কখনো সেইখানে পড়ে নাই, কেননা এইটা ছিল বিশাল বিশাল পাহাড়ের সারির মধ্যে দূর এক কোণায়, যেইখানে সূর্যের আলোও আসতো না। এর আশপাশ দিয়া কোনো পথ ছিল না; এবং নিজেদের সুখী ঘরে ফেরার জন্য জোর দিয়া আমাদের হাজারো গাছের ঝরাপাতা সরায়ে দিরতে হইত, এবং লক্ষ লক্ষ সুগন্ধী ফুলের দম্ভ মাড়ায়ে আসতে হইত। তো এমনই ছিল সবকিছু, আমরা একা থাকতাম আর ওই প্রান্তরটুকু ছাড়া দুনিয়ার কিছুই বুঝতাম না — আমি, আমার খালা আর তার মেয়ে। Continue reading