তর্ক: “আসল কোরান কোথায়?” (১৮৯২) – মুনশি মোহাম্মদ মেহেরুল্লা ও পাদ্রী জমিরউদ্দিন
[১৮ শতকের শুরুর দিকে বাংলা ভাষায় বই ছাপানো শুরু হইলেও, শেষের দিকে আইসা এইটা ছড়াইতে থাকে; তো, বই হিসাবে ধর্মিয় পুস্তকই বেশি ছাপা হইতো পত্রিকার বাইরে, স্পেশালি খ্রিষ্টধর্মের উপদেশ বানী… এর ফলে ব্রাহ্মণদের (এবং অন্য জাতের হিন্দুদের) খ্রিষ্টান হওয়ার ঘটনা যে বাড়তেছিল – তা না, মুসলমানদের ভিতরেও খ্রিষ্টান হওয়ার ট্রেন্ড শুরু হইতেছিল…
অই সময়ের একজন খ্রিষ্টান, পাদ্রী জমিরউদ্দিন শেখ (যিনি মুসলমান থিকা খ্রিষ্টান হইছিলেন) “ খ্রীস্টীয় বান্ধব” নামের মাসিক পত্রিকায় কোরানের বিষয়ে লেখেন যে, কোরান তো আসল না! তখন মুন্সি মেহেরুল্লাহ এর জবাব দেন মাসিক “ সুধাকর” পত্রিকায়; এর পরে আরো এক দফা উনাদের তর্ক চলে, এবং জমিরউদ্দিন (১৮৭০ – ১৯৩৭) খ্রিষ্ট-ধর্ম বাদ দিয়া ইসলাম ধর্মে ফিরা আসেন, কিছু বইও লেখেন… এরপরে মুন্সি মেহেরুল্লাহ (১৮৬১ – ১৯০৭) কাল্ট ফিগারে পরিনত হন, বেশ কিছু বই উনি লেখেন এবং ইসলাম ধর্ম বিষয়ে এক্টিভিজমও করেন
এই তর্কের টেক্সট’টা শেখ হবিবর রহমানের লেখা “ কর্ম্মবীর মুনশী মেহেরুল্লা” (১৯৩৪) থিকা নেয়া হইছে; তর্কের বাইরেও বাংলা-ভাষার হিস্ট্রিকাল রেফারেন্স হিসাবেও এইটা পড়া যাইতে পারে]
…
এক.
১৮৯২ সালের জুন মাসের “খ্রীষ্টীয় বান্ধব” নামের মাসিক পত্রিকায় এই লেখাটা ছাপা হয়:
“আসল কোরান কোথায়?”
আমরা যখন মুসলমানদের নিকট সুসমাচার প্রচার করি, তখন অনেক মুসলমানেই কহিয়া থাকেন যে, ‘আপনাদের ধর্মশাস্ত্র পরিবর্তিত হইয়াছে। কিন্তু আমাদের কোরান কখনই পরিবর্তিত হয় নাই। খোদাতা’লা মোহাম্মদ (দঃ) এর উপর যাহা নাজেল করিয়াছিলেন অদ্যাপি অবিকল তাহাই রহিয়াছে।” আমাদের ধর্মশাস্ত্র যে কখন পরিবর্তিত হয় ‘নাই, একথা মুসলমানদিগকে অনেক পুস্তকে লিখিয়াছি। ……… যিনি মুসলমান শাস্ত্রে অজ্ঞ, তিনিই বলেন যে, কোরান কখনই পরিবর্তিত হয় নাই। আমরা মুসলমানদিগের হাদিছ এবং অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ হইতে প্রমাণ দিতেছি যে, আসল কোরান বিকৃত ও পরিবর্তিত হইয়াছে। সুতরাং
মুসলমানদিগের হস্তে এখন আসল কোরান নাই।
(১) কোরান মোহাম্মদ (দঃ) এর সময় একত্র সংগৃহীত হয় নাই। দেখ – “তিমিক্তি” – সুন্নী মুসলমানদিগের হাদিছ।
(২) মোহাম্মদ (দঃ) এর মৃত্যুর পর খলিফা আবুবকর (রাজিঃ) জয়েদ দ্বারা কোরান শরিফের সুরাগুলি একত্র এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছিলেন। দেখ – “বোখারী” গ্রন্থে।
(৩) ওসমান (রাজিঃ) দুইবার কোরান দগ্ধ করেন। দেখ – “মেশ কাত উল মশাবী”।
(৪) শিয়া সম্প্রদায় কহিতেছেন যে, কোরানে আলীর (রাজিঃ) এবং তাঁহার বংশের মাহাত্ম্যের বিষয় অনেক কথা লেখা ছিল। কিন্তু কাফের ওসমান (রাজিঃ) তাহা কোরান শরিফ হইতে উদ্ধৃত করিয়া দগ্ধ করিয়া ফেলিয়া দিলেন। দেখ – “নহল আলবালাগত” এবং শিয়াদিগের হাদিছ। কলিকাতা, দিল্লী, এলাহাবাদ প্রভৃতি ভারতের নানা নগরে শিয়াগণ বাস করিতেছেন, তাঁহাদিগকে একবার জিজ্ঞাসা কর।
(৫) এমাম জাফর কহিতেছেন যে, – সুরা আহজাবে কোরেশের স্ত্রী ও পুরুষের ভ্রষ্টতার বিষয় বর্ণিত ছিল; ঐ সুরাটি সুরা বকর হইতে বড়। দেখ – “আইনুল হক” গ্রন্থের দুই শত আট ওরকের দ্বিতীয় পৃষ্ঠা। আনিস এবনে মালিক কহিতেছেন, যখন আর্মিনিয়ায় সুরীয় দেশের লোকদিগের সহিত আজার মিজান ইরাফ লোকদিগের যুদ্ধ হইতেছিল, তখন হাফিজা এবনে ইমাম ওসমানের (রাজিঃ) নিকট আসিয়া কোরান পাঠকের পাঠে অমিল হইবে এইরূপ ভয় করিয়া কহিল, – হে বিশ্বাসী লোকের পথ- প্রদর্শক, শিষ্যদিগের তথ্য লউন। পাছে তাহারা ইহুদী ও নাছারাদিগের নায় শাস্ত্রে গোলযোগ উৎপন্ন করে। তাহাতে ওসমান (রাজিঃ) হাফিজার (মোহাম্মদ (দঃ) এর স্ত্রী) নিকট লোক প্রেরণ করিয়া কহিলেন যে, তুমি কোরানের হস্তলিপিখানি আমার নিকট পাঠাইয়া দাও। আমরা নকল করিয়া ইহা তোমার নিকট পুনরায় পাঠাইয়া দিব। তখন ওসমান (রাজিঃ) জৈয়দ এবনে শাবিৎ, ‘আবদুল্লা এবনে জবির এবং হারিৎ এবনে ইমাম এই তিনজনকে আদেশ দিলেন যে, তোমরা উহা নকল কর। তাহারা উহা নকল করিলেন। আর ওসমান (রাজিঃ) উক্ত তিনজনকে কহিলেন, – যখন তোমাদের এবং জায়েদের কোরানের সঙ্গে পরস্পর অমিল হইবে, তখন তাহা কোরেশের ভাষায় লিখিও। কারণ কোরান এই ভাষায় নাজেল হইয়াছে। তাঁহারা ঠিক সেইরূপ করিলেন। খাতাটা নকল হইয়া গেলে, ওসমান (রাজিঃ) পুনরায় তাহা জয়েদের নিকট পাঠাইয়া দিলেন। আর যাহা লেখা হইল, তাহার এক একখানি প্রতিলিপি নানা প্রদেশে পাঠাইয়া দেওয়া হইল এবং পূর্ব্বকার যত খাতা ছিল, তাহা দগ্ধ কবিবার আদেশ দিলেন। দেখ, -বোখারী-সুন্নিদিগের হাদিছ গ্রন্থ। Continue reading