তর্ক: মুসলমান-লেখকদের বাংলা সাহিত্য – বুদ্ধদেব বসু ও আবুল মনসুর আহমেদ (১৯৪২)

১৯৪২ সালে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮ – ১৯৭৪) একটা কলাম লেখছিলেন “সাহিত্যে পাকিস্তান অসম্ভব” নামে, যে পলিটিকালি পাকিস্তান আন্দোলন হইলেও সাহিত্যে মুসলমানি-সাহিত্য হওয়া ঠিক না, বাংলা-সাহিত্যই হইতে হবে! নাইলে উর্দু সাহিত্য করেন আপনারা!
তো, এর জবাব দেন আবুল মনসুর আহমেদ ১লা নভেম্বর, ১৯৪২ সালে পাকিস্তান রেনেসা নামে একটা সংগঠনের সভায় একটা লেখা পড়ার ভিতর দিয়া যেইটা পরে “সাহিত্যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য” নামে মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় ছাপা হয়।
বুদ্ধদেব বসুর আরগুমেন্ট ছিল মেইনলি তিনটা –
১. নারী-সাহিত্যের মতোই মুসলমানি-সাহিত্য একটা সাব-সেট হয়া আছে বাংলা-সাহিত্যের, এর থিকা বাংলার মুসলমান সাহিত্যিকদের বাইর হইতে হবে!
২. অনেকে অভিযোগ করেন যে হিন্দু-সাহিত্যিকরা কেন মুসলমানদের নিয়া লেখেন না? কারন হিন্দুরা তো মুসলমানদের তেমন কিছু জানেন না! এই কারনে মুসলমান সাহিত্যিকদেরই মুসলামানি সমাজ থিকা বাইর হয়া সবার জন্য সাহিত্য করা লাগবে
৩. আর উনারা যদি সবার জন্য না লেখতে পারেন তাইলে বাংলা-সাহিত্য বাদ দিয়া উর্দু সাহিত্যই করা দরকার!
আবুল মনসুর আহমেদের জবাবগুলা অনেকটা এইরকম:
১. মুসলমান-লেখক যে একটা সাব-কেটাগরি হয়া আছে – এইটা বানাইছে কারা? কিভাবে তৈরি হইছে?
২. একই সমাজে থাকার পরেও হিন্দু-লেখকরা মুসলমান-সমাজ নিয়া জানে না কেন? নাকি না-জানাটারেই তাদের বাহাদুরি মনে করে?
৩. তো, মুসলমান সাহিত্যিকরা তাদের স্বাতন্ত্র্য ধইরা রাইখাই বাংলা-সাহিত্য করবে, আর সেইটা থিকা মাওলানা বা পন্ডিতদের থ্রেটে সইরা যাবে না!
এইখানে, আবুল মনসুর আহমেদ ইন্টারেস্টিং একটা জায়গা কিছুটা এড়ায়া গেছেন বইলা দেখি আমি, যে বাংলা-সাহিত্যের যেই ডিফল্ট বা ‘সাধারন পাঠক’ আছেন, তারা হইতেছেন মেইনলি – শিকখিত হিন্দু! বাংলা-ভাষা বইলাও যেইটা আছে সেইটা হইতেছে ‘সংস্কৃত বাংলা’ বা এখনকার ‘প্রমিত বাংলা’! এর বাইরে যা কিছু আছে, সবই হইতেছে – ব্যতিক্রম, অ-শুদ্ধ ও ভুল!
এবং খেয়াল কইরা দেখবেন অইসব ‘মুসলমান রাইটারদেরকেই’ (যেমন, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দিন) হিন্দু সাহিত্য-সমাজ ‘সাহিত্যিক’ বইলা মাইনা নিতেছেন যারা উনাদের লগে যোগাযোগ রাখেন, মিনিমাম রিলেশন রাখেন এবং তাদের সাহিত্যিক-সুপিরিয়রিটি মাইনা নিতে রাজি আছেন; তার আগেও মীর মোশাররফ হোসেনরে যে মুসলমান-সাহিত্যিক হিসাবে একসেপ্ট করছেন তার কারন উনার ‘মুসলমানি-সাহিত্য’ না বরং ‘সংস্কৃত বাংলা’য় লেখতে রাজি হওয়ার ঘটনা! যেই কারনে দেখবেন ফররুখ আহমেদ অই লিস্টে নাই! ভালো-বাংলা মানে হইতেছে অই ট্রাডিশনটা, আর এখনো এইটা সেলিব্রেটেড ঘটনা… আপনি ‘মুসলমান-রাইটার’ হয়াও ‘বাঙালি লেখক হইতে পারবেন যদি ‘পরমিত বাংলায়’ লেখেন!
তো, এই যে এটিটুড বুদ্ধদেব বসুর, সেইটা এখনো কন্টিনিউ হইতেছে আসলে, যেই কারনে তর্কের এই প্রিমাইজটা এখনো রেলিভেন্ট।
লেখা দুইটা পূর্ব বাঙলার ভাষা বইয়ে রিপ্রিন্ট করা হইছিল
…
বুদ্ধদেব বসু
সাহিত্যে পাকিস্তান অসম্ভব
শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী (এবং সহযোগী) স্বরূপ একটি অদ্ভুতস্তানের কল্পনা ভারত ভাগ্যবিধাতার দপ্তরে অচিরেই পেশ করা হবে এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে একটি জেনানাস্তান (কিংবা পাকিস্তান)-এর দাবী যদি বিংশতি কোটি ভারতীয় ললনার কণ্ঠে কল কলম্বরে ধ্বনিত হয়ে ওঠে তাহলেও অবাক হবার কিছু নেই। আমি রাজনীতিক নই, বিশাল ভারতকে অনেকগুলি খণ্ড ক্ষুদ্র স্থান কিংবা স্থান-এ বিভক্ত করবার প্রস্তাবে বিমূঢ় মৌনই আমার একমাত্র মন্তব্য। কিন্তু এই স্বাতন্ত্র্যকামী মনোভাব যখন সাহিত্য ক্ষেত্রেও সংক্রামিত হতে দেখি তখন আমার পক্ষে চুপ করে থাকা শক্ত হয়। যখন দেখি একজন লেখক, যিনি দৈবক্রমে মুসলমান হয়ে জন্মেছেন, কিংবা অন্য একজন লেখক, যিনি প্রকৃতির খেয়ালে স্ত্রীলোকের দেহ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন, তিনি লেখকের বৃহৎ ও বহমানকর পদবী অগ্রাহ্য করে মুসলমান লেখক কিংবা মহিলা লেখক-এর সংকীর্ণ আখ্যার জন্য লালায়িত তখন প্রতিবাদ না করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। কতদিন আমি মনে মনে ভেবিছি যে আমাদের মেয়েদের মধ্যে যারা সাহিত্য চর্চা করেন তাঁরা কি চিরকালই লেখিকা থাকবেন, কোনোদিন লেখক হবেন না? সাময়িক পত্রে, সমালোচনায় কিংবা পণ্ডিতজন রচিত সাহিত্যের ইতিহাসে যখন বঙ্গীয় মহিলা কবি কি মহিলা ঔপন্যাসিকদের বিবরণ পড়ি, তখন ক্ষুব্ধচিত্তে এ প্রশ্নই বার বার জাগে, যে মেয়েদের আমরা আর কতকাল নাবালক করে রাখবো, তাঁরাই বা এই পিঠ চাপড়ানো আর কতকাল সইবেন? অথচ সবচেয়ে আশ্চর্য এই যে, এই অপমানকর ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মেয়েরা নিজেরা কখনো প্রতিবাদ করেন না, নিজেদের ‘লেখিকা’ বলে পরিচয় দিতে কদাচ তাঁরা লজ্জিত নন, বরং সেই আখ্যাই যেন তাঁরা কামনা করেন। অর্থাৎ সাহিত্যিক জেনানাস্তানের মাইনরিটি প্রিভিলেজেস-এর প্রতি তাঁদের লোলুপ দৃষ্টি। তাঁরা কি কখনো, ভেবেছেন যে এ ব্যবস্থায় তাঁদের যে আদপে আমলে আনা হচ্ছে তা তাঁরা ভালো লেখেন বলে নয়; তাঁরা মেয়ে হয়ে জন্মেছেন বলেই। মহিলা লেখকদের ফিরিস্তি যখন কোথাও প্রকাশিত হয় তার মধ্যে এমন অনেকেরই নাম পাওয়া যায় যাদের লেখক বলাই ভুল, প্রজাতিশ্রেষ্ঠ মহিলা কবি বলে সম্মান জানাচ্ছি বাংলার কবি-সভায় হয়তো তাঁর কোনো স্থানই হতে পারে না। এই নির্বোধ ব্যবস্থার ফলে মেয়েদের মনে সাহিত্যের আদর্শা ক্রমেই নেমে যেতে থাকে, কোনো রকমে দুচার লাইন মেলাতে পারলেই মহিলা কবি আখ্যা পাওয়া যায়, কোনো একটি উন্মত্ত প্রলাপ ছাপার অক্ষরে বের করতে পারলেই মহিলা-ঔপন্যাসিক হিসেবে মাল্যলাভের সম্ভাবনা থাকে, অপরপক্ষে যে দুচারটি মেয়ে সত্যি ভালো লেখেন, অর্থ্যৎ যারা লেখিকা মাত্র নন, যাঁরা লেখক, তাঁদেরও ঐ মহিলা-লেখকদের গড্ডলিকার ভিড়িয়ে দেওয়া হয়, যথাযোগ্য সমাদর তাঁরা পান, যতই তারা ভালো লিখুন, মেয়েদের মধ্যে ভালো লেখেন এই কলংকময় অপবাদ কাটিয়ে উঠতে তাঁরা পারেন না। এ সবই দুঃখের কথা, কিন্তু সবচেয়ে দুঃখের কথা এই যে, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মেয়েদের তরফ থেকে কখনো আসেনি, প্রতিবাদ করতে হচ্ছে আমাকে – যে মেয়ে নয়। Continue reading