বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ – অমর্ত্য সেন (পার্ট ২)
বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ – অমর্ত্য সেন (পার্ট ১)
…
বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ
বন্যা ও দুর্ভিক্ষ
প্রথমে বন্যা; তারপর দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের ক্যাপসুল কাহিনীটা মোটামুটি এমন। গিলবার্ট এটিয়েন ১৯৭৪ সালের বন্যার কথা বর্ণনা করছেন এইভাবে:
উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলিতে ১৯৭৪ সালের বন্যা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করছে। নরমাল বছরগুলাতে, বানের সময় ব্রহ্মপুত্র পশ্চিম তীররে সর্বোচ্চ ৩০-৬০ মিটার পর্যন্ত গ্রাস করে। ১৯৭৪ সালে, ১০০ কি.মি. পর্যন্ত, ৩০০ পর্যন্ত প্রশস্ত পানির তোড় এমন ভূমি গ্রাস করে যেখানে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি কিলোমিটারে ৮০০ জন। ২৪,০০০ মানুষ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। তাছাড়া পলিমাটিজাত হওয়ায়, কিছু জায়গায় জমি খুব উর্বর হইলেও, অন্যত্র বালুর পরিমাণ এত বেশি যে তা অনেকটা নিষ্ফলা…. জুনের শেষ দিকে ভয়াবহ কয়েকটা বন্যা হয়। এবং আউশের (জুলাই-আগস্টে চাষ করা ধান) ফসলের বড় অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আরও পনের দিন পরে আউশের ফসল তোলার সময়টাতে ব্রহ্মপুত্র আবার বিপদসীমা অতিক্রম করে। আরও ১৫ দিন পর, নদীর পানির মাত্রা আবার বাড়ে এবং ফলে আমনের (জুলাই-সেপ্টেম্বরে চাষ ও নভেম্বর জানুয়ারিতে তোলা ধান) বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপরে, আগস্টের মাঝামাঝি, বন্যা বছরের সবচাইতে ভয়াবহ অবস্থায় পৌছায়। ফলে সদ্যবোনা আমনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এইটাই শেষ না। সেপ্টেম্বরের শুরুতে ব্রহ্মপুত্রের পানি আবারও বিপদসীমার উপ্রে দিয়া যায়, আর আগের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় নাই এমন ধানক্ষেতও ভাসায়ে নিয়া যায়।
বন্যার সময় এবং বন্যার ঠিক পরেই চালের দাম দ্রুত বাড়তে থাকে। টেবিল ৯.১ -এ এইটা দেখানো হইছে। সবচাইতে বেশি আক্রান্ত জেলাগুলির কয়েকটাতে, জুলাই ও অক্টোবরের টাইমে, তিন মাসের মধ্যে চালের দাম দ্বিগুণ হয়া যায়। বন্যার পরপরই অনাহারের খবর আসতে থাকে, আর দিন দিন তার ভয়াবহতাও বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ গভমেন্ট বন্যার অফিশিয়াল ঘোষণা দেয় সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে। দুর্গত ঘরহীন মানুষদের জন্য রান্না করা খাবারের কিছু লঙ্গরখানা খোলা হয়। সেপ্টেম্বরের শুরুতেই এই লঙ্গরখানাগুলা চালানো হয় ব্যক্তি পর্যায়ের উদ্যোগে আর গভমেন্টের লঙ্গরখানা পুরাপুরি চালু হয় অক্টোবরের শুরুতে। এক পর্যায়ে প্রায় ছয় হাজার লঙ্গরখানা খাদ্য ত্রাণ দেয় প্রায় ৪.৩৫ মিলিয়ন মানুষরে — যা দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬ ভাগ। নভেম্বর আসতে আসতে দ্রব্যমূল্যের দাম কমতে শুরু করে, রিলিফের চাহিদার তীব্রতাও কিছুটা কমতে শুরু করে মনে হয়। নভেম্বরের শেষে লঙ্গরখানাগুলি বন্ধ কইরা দেওয়া হয়।
অঞ্চলভেদে দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা নানান মাত্রায় ছিলো। টেবিল ৯.২ লঙ্গরখানা থেকে ত্রাণ সংগ্রহ করা মানুষের জেলাভিত্তিক অনুপাত তুলে ধরছে। এই অনুপাত রংপুর জেলার ১৭% থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের ০% পর্যন্ত। এই হিসাবে সবচাইতে বেশি আক্রান্ত পাচঁটা জেলা হইতেছে রংপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, সিলেট ও বরিশাল। ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের জরিপে ময়মনসিংহ, রংপুর ও সিলেটরে বলা হইছে ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’। সর্বোচ্চ পরিমাণ প্লাবণ যা ‘তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে ৬ ফুটের বেশি উচ্চতার বন্যা’ ও ‘লঙ্গরখানা থেকে জনসংখ্যার শতকরা কতভাগ ত্রাণ নিছে’ — এই দুইয়ের ভিত্তিতে ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’ ঠিক করা হইছে। আগ্রাসী ব্রহ্মপুত্র ও অন্যান্য নদী থেকে বেশ দূরের জেলা দিনাজপুর কিন্তু ‘দুর্ভিক্ষের জেলা’ নামের এই তালিকায় পড়ে নাই অথচ এই জেলার ত্রাণ চাওয়া মানুষের সংখ্যার অনুপাত ছিলো সিলেটের চাইতে বেশি। আবার দেখা গেছে, ‘দিনাজপুরের লঙ্গরখানায় আসা মানুষের একটা বড় অংশ আসছে পাশের জেলা রংপুর থেকে।’ Continue reading