ইবনে আরাবীর “দুই চোখের দৃষ্টিতে” জ্যাক দেরিদার ডিকনস্ট্রাকশন দর্শন – ইবরাহিম কালীন

[জাঁ দেরিদাঁ ১৯৩০ সালের ১৫ই জুলাই তৎকালীন ফ্রান্স অধ্যুষিত আলজেরিয়ার আলজিয়ার্স নগরীর আল-বিয়ার শহরতলিতে একটা ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করছিলেন।তার শৈশব কাটছিল মুসলিম-প্রধান দেশ আলজিরিয়ায়।
জাঁ দেরিদাঁ হইতেছেন একজন ফরাসি দার্শনিক।বলা বাহুল্য বিংশশতাব্দীর সেকেন্ড ক্লাশ দার্শনিকদের মধ্যে দেরি নিজের জন্য গুরুত্বপূর্ন একটা অবস্থান নিশ্চিত করছেন।
উল্লেখযোগ্য দার্শনিক ফ্রিডরিখ হেগেল হইতে শুরু করে সিগমুন্ড ফ্রয়েড,এডমুন্ড হুরসাল,মিশেল ফুকো,রোলঁ বার্ত,এমনকি জঁ-জাক রুশো অব্ধি দেরি পারি দিছেন। জাঁ দেরি এদের প্রত্যেকের দাঁড়াই প্রভাবিত হইছেন।
জাঁ দেরিদাঁর ”অবিনির্মাণ” তত্ত্বটা দর্শন সারা দুনিয়া জুড়ে ব্যাপক সাড়া পাইছে।দেরিদাঁর চিন্তা ও বিশ্লেষণ উত্তরাধুনিক দর্শনের সাথে জোড়ালোভাবে পঠিত হয়ে আসতেছে।দর্শন জগতে দেরির অভিমুখ উত্তর কাঠামোবাদী (post-structuralist)গুরুত্বপুর্ন কাজ হিসেবে পরিগণিত হইছে।দেরিদা তার বিভিন্ন লেকচারে এবং লেখালেখিতে স্ট্রাকট্রালিজম কাঠামোবাদের (structuralism) নানা দুর্বলতা,অসঙ্গতি ও অপর্যাপ্ততা নিয়া আলাপ করছেন।দেরিদা এইসব অসঙ্গতিগুলি চিহ্নিত করছেন দর্শনের আলোকে।
অন্যদিকে এলিভেন সেঞ্চুরির দিকে প্রাচীন আন্দালুস বর্তমানে স্পেনের মুরসিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন একজন মুসলিম সূফি দার্শনিক। দা ফিনিক্স আরবী।এই সুফি ধর্মীয় সাধক হইলেও পুরোদস্তর একজন দার্শনিক ছিলেন।তাঁর মূল নাম হইতেছে মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবি আর টাইটেল হইতেছে শেখ আল আকবর মানে সব শেখের বড় শেখ মুহিউদ্দিন ইবনু আল আরাবী।
তাছাড়া আল আরাবী আইনশাস্ত্র,অতীন্দ্রিয়বাদ নিয়ে বিস্তর লেখালেখি করছেন।ইউরোপ হইতে এশিয়া মুটামুটি সারা জাহান জুড়েই আরাবীর দার্শনিক তত্ত্ব বিভিন্ন উপায়ে পঠিত হয়ে আসতেছে,
সেই পরিপ্রেক্ষিতেই তুরস্কের একজন দার্শনিক ও রাজনিতিবিদ ফরাসি দার্শনিক জাঁ দেরিদাঁর বহুল প্রচলিত “অবিনির্মাণ বা ডিকনস্ট্রাকশন”তত্ত্বকে প্রাচীন মুসলিম সুফি দার্শনিক মুহিউদ্দীন ইবনে আরাবীর দার্শনিক তত্ত্ব “দুই চোখের দৃষ্টি”র আলোকে বিশ্লেষণ করছেন।বিশ্লেষণ ও প্রবন্ধে লেখক প্রমাণ করতে চাইছেন দেরিদাঁর মাধ্যমে আমরা বহু প্রশ্নের মুখোমুখি হইলেও ইবনে আরাবীর মাধ্যমে আমরা সেইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাইতে সক্ষম হইতে পারি।
লেখক ইব্রাহিম কালীন ইসলামী ফিলোসফার হইলেও ওয়েস্টার্ন ফিলোসফির উপরে হেফজ করছেন।আধুনিকতা ও এস্তেতিক দুনিয়া নিয়া ইংরেজি এবং তুর্কিতে তাঁর বহু কাজবাজ আছে, কালীন উত্তর আধুনিক ফিলোসফিরে সভ্যতার প্রাচীন পূর্ব ফিলোসফির সঙ্গে সম্মিলন ঘটান।
ইস্তানবুল ইবনে খালদুন ইউনিভার্সিটিতে আমার একটা কোর্সের ইন্সট্রাক্টর হওয়ার সুবাদে ইব্রাহিম কালিনের দার্শনিক আলাপ শোনার তাওফিক হইসিলো। বিগত দিনে সুফি দর্শন নিয়ে একটা গবেষণা পত্র দাখিল করতে গিয়ে ইব্রাহিম কালীনের এই প্রবন্ধ পাই সেই সাথে বাঙলা ভাষায় তর্জমা করার রুখসত জাগলে তর্জমা করে ফেলি,এর আগে সরাসরি তুর্কী ভাষা থেকে কবিতা তর্জমা করা হইলেও প্রবন্ধে এইটাই প্রথম।
এই প্রবন্ধের বাঙলা তর্জমা সম্পর্কে মূল রাইটার ইব্রাহিম কালীনের সাথে যোগাযোগ করা হইছে,প্রবন্ধটা ভালো লাগলে বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে কালীনের দর্শন ও কেতাবাদী নিয়ে আরো অনেক তর্জমা করার কোশেশ রাখতেছি। ওমা তৌফিকি ইল্লা বিল্লাহ…
সুনান খান
ডিসেম্বর, ২০২৪]
***
বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা ২০০৪ সালে যখন মারা গেছেন,তখন তিনি এমন একটা চিন্তার ঐতিহ্য রাইখা গেছেন যা বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে অভূতপূর্ব বিভাজন সৃষ্টি করছিল।
কেউ তারে পাশ্চাত্য সভ্যতার শেষ বুদ্ধিজীবী মহীরূহ হিশাবে শ্রদ্ধা করছেন,কেউ আবার তারে এক নিষ্ফল চিন্তাবিদ বইলা প্রত্যাখ্যান করছেন,যেনো এই লোক দর্শন যুক্তিবোধরে দুর্বল কইরা গেছেন,মৃত্যুর পরও একটা এখতেলাফ তৈয়ার করছেন।
জ্যাক দেরিদার জন্ম হইতেছে ১৯৩০ সালে আলজেরিয়ায়। আলজেরিয়া তখন ফরাসি উপনিবেশ আছিল। ১২ বছর বয়সে জাক জীবনের প্রথম বিশাল একটা আঘাত পাইছিলেন।
ভিশি সরকারের ইহুদি-বিরোধী আইন অনুসারে তারে স্কুল থিকা থেকে বাইর কইরা দেওয়া হইছিল।ইহুদি হিশাবে চিহ্নিত হওয়ার সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা সারা জীবন তারে চইষা বেড়াইছে।এই বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিই হয়তো পরবর্তীকালে তার দর্শনের ভিত্তি রচনা করছে।
ডিকনস্ট্রাকশনের ধারণা
১৯৬০-এর দশকে দেরিদা একটা নয়া দর্শন চিন্তাধারা প্রবর্তন করেন,যেইটারে দেরিদা নিজেই “ডিকনস্ট্রাকশন” নামকরণ করছেন।এই ধারণাটা এতটাই জটিল যে একক সংজ্ঞায় এরে কাবু করা কঠিন।ডিকনস্ট্রাকশন কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি না;এইটা বরং ভাষা,বাস্তবতা এবং তাদের পারস্পরিক সম্পর্করে বিশ্লেষণ করার একধরনের পন্থা।
দেরিদা বিশ্বাস করেন,টেক্সট বা পাঠ্যের মধ্যে কিছু “অকথিত” (unsaid) আসলে থাইকা যায়,যা কখনোই সরাসরি ব্যক্ত হয় না।আর এই অকথিত অংশটাই টেক্সটের প্রকৃত অর্থের জগৎরে উন্মুক্ত করে।
Continue reading