আমি আর কার্ল জনসন
ভিডিও গেমস নিয়া মৃদুল শাওনের এই গদ্য প্রকৃতির বর্ণনার একটা নতুন ভার্সন; যেইখানে ভিডিও গেমস খালি টাইম-পাস এর একটা ঘটনা হিসাবেই আইডেন্টিফাইড না। একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ধরণের গেমস কোন লাইফ-স্টাইলরে প্রমোট করতে চায়, তার একটা ডকুমেন্ট হিসাবেও রিড করা সম্ভব, পপুলার কালচারের ভিতর।
– ই. হা.।
___________________________________________________________
গেমটার নাম ছিল জিটিএ সান-অ্যান্ড্রিয়াস। কম্পিউটারে খেলতে হইত। জিটিএ এর পূর্ণ রূপ হইল- গ্র্যান্ড থেফট অটো। জিটিএ সিরিজের আরো অনেক গেম ছিল, যেমন ভাইস সিটি বা জিটিএ থ্রি। ওইগুলা তেমন ভালো লাগে নাই। আমি যখন খেলতাম তখন সান-অ্যান্ড্রিয়াসই আধুনিক অর্থে সর্বশেষ। পরে আরো ‘উন্নত’ জিটিএ আসছে, কিন্তু গেম খেলিনা বইলা মনোযোগ দেওয়া হয় নাই।
[pullquote]একসময় কার্লরে দিয়া ভায়োলেন্স আমি আর করাইতাম না। চ্যাপেলের সামনের বেঞ্চে বইসা থাকত সে। মানুষ দেখত। মাঝে মাঝে লোনলি কেউ আইসা বেঞ্চের অন্য কোণায় বসত। কখনো কখনো কার্ল চ্যাপেলের ছাদে যাইত। তখন অলরেডি সে গ্রে কালারের ফুলপ্যান্ট আর ফুলস্লিভ চেক শার্ট পরা। ক্যাপ নাই।[/pullquote]
সান-অ্যান্ড্রিয়াস খেলা শুরু করি ২০০৭ সালে, এসএসসি পরীক্ষা দিয়া ফালাইছি তখন। আর সব কিছু বাদ দিয়াই গেমটার গ্রাফিক্স, ভিজ্যুয়াল আর সাউন্ড এমন ছিল যে, এইটারে বাদ দিয়া মনোযোগ কাইড়া নিতে পারবে এমন কিছু আর ছিলনা। গেমের ভিতরে একটা শহরের নাম সান-অ্যান্ড্রিয়াস। সম্ভবত আমেরিকার লস এঞ্জেলসরে অনুকরণ কইরা ডিজাইন করা। হলিউডের মত একটা জায়গা ছিল ওই শহরে, সবুজ পাহাড়ের উপর বড় বড় সাদা অক্ষরে লেখা V I N E W O O D। আমার কোনো কোনো কাজিন সান-অ্যান্ড্রিয়াস বলত না, বলত স্যানানড্রিয়াস। সান-অ্যান্ড্রিয়াস গেমের নায়কের নাম ছিল কার্ল জনসন। সংক্ষেপে সিজে, ইংরেজীতে লেখা থাকত CJ. অনেকগুলা মিশন কমপ্লিট করতে হবে এমন দায়িত্ব নিয়া সে সান-অ্যান্ড্রিয়াসে পৌছায় গেমের শুরুতে। তার চেহারা বইলা দিত সে আফ্রো-আমেরিকান। সে গ্যাংস্টার। তার গ্রুপের অন্যদের সাথে সে দেখা করে। শহরে আরো অনেক এন্টি গ্রুপ ছিল। তারা সবসময় কার্লরে মাইরা ফেলতে চাইত।
আমি কার্ল জনসনরে দিয়া মিশন কমপ্লিট করানো শুরু করলাম। কোনো কোনোটা শেষ করতে পাঁচ-ছয়বার চেষ্টা করতে হইত। একটা শেষ হইলে আরেকটা। এক মাসের মত সময়ে বারোটার মত মিশন শেষ করলাম। একদিন দূর সম্পর্কের এক ভাই জানাইল তার কাছে নাকি ‘স্যানানড্রিয়াসের’ সব চীট-কোড আছে। আমি চাইলাম, সে দিল আমারে। এরপর খেলা সহজ হইয়া গেল। কোনো বাঁধা পাইলেই দরকার মত চীট-কোড টাইপ করি। লাইফ শর্ট হইলেই আনলিমিটেড লাইফ, অস্ত্রের দরকার হইলেই প্রচুর রকমের আনলিমিটেড অস্ত্র। যেকোনো জায়গায় যাওয়াও সহজ হইয়া গেছে। হইলো কি! দুই তিনটা মিশন কমপ্লিট করার পরে মিশনগুলা আমারে আর টানলো না। কারণ আমি জানি, আমি শুরু করলেই পারবো। আমি মিশন কমপ্লিট করা ছাইড়া দিলাম। সান-অ্যান্ড্রিয়াসের ভৌগলিক মাল্টিপ্লিসিটি ছিল দারুণ। আমেরিকার একটা স্টেটের সম্পূর্ণ অনুকরণে ডিজাইন করা। আমি কার্ল জনসনরে দিয়া ইচ্ছামত ঘোরাঘুরি আর যা খুশি তাই করতে শুরু করলাম।
আমার ইচ্ছায় কার্ল আমেরিকার র্যাপারগো মতন কাপড় পরা শুরু করলো। ঢোলা থ্রি-কোয়ার্টারের সাথে ঢোলা টি-শার্ট বা হুডি। পায়ে লাল অথবা কমলা স্নিকার্স বা কেডস, শর্ট মোজার সাথে। গলায় আফ্রিকান লকেটওয়ালা চেইন। কালো সানগ্লাস আর মাথায় উল্টা বা ডান-বাম সাইড কইরা পরা ক্যাপ, কখনো বা ব্যান্ডেনা। যেহেতু চীট-কোড দিয়া আনলিমিটেড ডলারের ব্যবস্থা ছিল তাই প্রচুর বাড়ি কেনা হইত। সব জায়গায় বাড়ি হইতে থাকলো কার্লের। রেসিডেন্সিয়াল এরিয়ায় লাক্সারিয়াস বাড়ি, ডকইয়ার্ডের দিকে, সী-বিচে, সাব-আরবান এরিয়ায়, পাহাড়ের ওপরে সব জায়গায়। প্রত্যেকটা বাড়িতে গেমের কারেন্ট পজিশন লোড কইরা রাখার ব্যবস্থা ছিল। এইটুকুই। র্যাপারগো মত ড্রেসে কার্ল হাঁটতো রাস্তায় রাস্তায়। সান-অ্যান্ড্রিয়াসে গাড়ি বা বাইক কেনার ব্যবস্থা ছিলনা কিন্তু রাস্তায় প্রচুর গাড়ি বা বাইক থাকত। ইচ্ছা হইলেই কাউরে গাড়ি থিকা নামাইয়া ড্রাইভে যাওয়াইতাম। বা কাউরে বাইক থিকা ফালাইয়া বাইক চালাইত। পুলিশ মাঝে মাঝে ঝামেলা করত। ওইটা কেয়ার করার মত ছিলনা। হাইওয়ে দিয়া বেশি যাইতাম গ্রামের দিকে। গ্রামগুলা ছোট ছোট ছিল। বিচ্ছিন্ন। অল্প দোকানপাট ছিল। রাস্তায় মানুষও কম থাকত। গ্রামের রাস্তায় প্রায়ই ট্রাক্টর আর ট্রাক চলত। ওইদিকে একধরনের বাইক দেখা যাইত রাস্তায়। হাল্কা ধরনের। চাকাগুলা চিকন ছিল। তিনটা বিশেষ রঙে ওইগুলা দেখা যাইত- লাল, হলুদ, নীল। সব ধরনের রাস্তায় ওগুলা ভালো চলত। পাহাড়েও ওঠা যাইত ওইগুলা নিয়া। কার্ল ওই রেসিং বাইক নিয়া গ্রাম ছাইড়া উপত্যকা ঘুইরা নির্জন নদীর পাড় দিয়া আইসা উল্টাদিক দিয়া শহরে ঢুকত। রাস্তা থিকা নদী অনেক নিচে ছিল, ওই এলাকাটা নির্জন থাকত। রাস্তার ডান পাশে নিচে নদী আর বাম পাশে শাখা-প্রশাখা ছাড়া বড় বড় গাছের বন। নদীতে নৌকা বা স্পীডবোট চালানো যাইত। নদীর সাথে খালের লিঙ্ক ছিল আবার নদী দিয়া সমুদ্রের দিকেও বাইর হওয়া যাইত। ফিশিং বোট গুলা খুব আস্তে চলত। পানিতে চলাচলে সীমানা আন্দাজ করা যাইত না। অন্য স্টেটের সীমানায়, নির্দিষ্ট সংখ্যক মিশন কমপ্লিট না করলে একসেস নাই যেখানে, সেখানে ঢুইকা পড়লে পুলিশ তাড়া করত। [pullquote][AWD_comments][/pullquote]
আমার গাড়ি ভালো লাগতোনা। হাইওয়েতেও খুব ভালোভাবে চালানো যাইত না। অল্প ধাক্কা লাগলেই নষ্ট হইয়া যাইত। তবে মাঝে মধ্যে ট্যাক্সি চালাইতাম। একটা ট্যাক্সি কাইড়া নিয়া কী-বোর্ডে টু চাপলেই হইত। প্যাসেঞ্জার কই আছে তা স্ক্রীনে ডাইনে নিচের কোণায় দেখা যাইত। প্যাসেঞ্জার উঠলে গন্তব্যও ম্যাপে দেখা যাইত, সাথে টাইম লিমিট। টাকা অল্প ছিল এই কাজে। যেহেতু চীট-কোডের কারণে টাকা আনলমিটেড ছিল তাই এইটা শখ কইরা করতাম। ভালো না লাগলে প্যাসেঞ্জার সহ ট্যাক্সি ফালাইয়া অন্যদিকে যাইতাম। পুরা ভূগোল মুখস্থ হইয়া গেছিল। মাঝে মাঝে বিমান চালাইতাম। কিন্তু বিরক্তিকর অথবা আমি এইটা ভালো পারতাম না। কার্ল অনেক উপর থিকা প্যারাসুট নিয়া লাফ দিত। কিছুদূর পড়লে আমি প্যারাসুট অন কইরা দিতাম।
ঘোরাঘুরি বা ড্রাইভ করতে করতে একটা সময় বোরিং লাগত। তখন রাস্তার পাশের কোনো মাঝারি বিল্ডিং এর ছাদে চইলা যাইতাম। তারপর দ্বিতীয় আর তৃতীয় চীট-কোড দিয়া অস্ত্র নিতাম অনেক। প্রথমটা ব্যবহার করতাম না। ওইটায় প্রাইমারী লেভেলের অস্ত্র থাকত। চীট-কোড দুইটা মনে থাকতে পারে- KJKSZPJ আর UZUMYMW। স্ক্রল ঘুরাইলে আর্মস চেঞ্জ হইত। আমি ছাদ থিকা রকেট লাঞ্চার দিয়া রাস্তায় গাড়ি টার্গেট করতাম। একটার পর একটা গাড়ি ব্লাস্ট হইত। এইটা তো ক্রাইম! ওয়ান্টেড লেভেল বাড়তে থাকত আর পুলিশ আসত। ওয়ান্টেড লেভেল যখন পাঁচ বা সর্বোচ্চ ছয় স্টারে চইলা যাইত তখন পুলিশ ছাড়াও রাষ্ট্রের অন্য বাহিনীরাও আসতে শুরু করত। একটার পর একটা হেলিকপ্টার আসত। আর নিচে ট্যাংক। হেলিকপ্টার থিকা প্যারাট্রুপার নামত। আমি রকেট লাঞ্চার দিয়া দূরে থাকতেই হেলিকপ্টার শেষ কইরা দিতাম। নীচে রাস্তায় যারা থাকত তারা তেমন কিছু করতে পারত না আমারে। তবে দ্রুত মাউস ঘুরাইয়া তিনদিকে ব্যালেন্স রাখতে ঝামেলা হইত। অন্যদিকের গুলি আইসা লাগত। লাইফ বার একটু কমলেই আমি HESOYAM টাইপ করতাম। পরে আমি নিচে নাইমা একটা বাইক জোগাড় করতাম, বেশিরভাগ সময় আগে থিকাই রেডি রাখতাম। ওয়ান্টেড লেভেল তখন ছয়। নিচে নামার সাথে সাথে পুলিশ, ট্যাংক, প্রিজন ভ্যান, মিলিশিয়া সব দিক থিকা আমারে তাড়া করত। সামনের দিক থিকাও আসত। আর আমি বাইক নিয়া পাহাড়, গ্রাম, উপত্যকা, কারখানা, সিমেট্রির ভিতর দিয়া, হাইওয়ে আর গলি দিয়া যাইতে থাকতাম; যেন ধরা না পড়ি।
উত্তেজনা বেশি হইত যেসব সিটিতে একসেস নাই বা অপরিচিত জায়গায় গেলে। সীমানায় পা দেওয়া মাত্রই ওয়ান্টেড লেভেল চাইরে চইলা যাইত। আরো ভিতরের দিকে গেলে ক্রমে পাঁচ আর ছয়। আমি তখন আর উলটা আক্রমণ করতাম না। চেষ্টা করতাম যত বেশিক্ষণ সম্ভব সারভাইব কইরা ওই ভূখন্ডে বিচরণ করতে। মাঝে মাঝে চীট-কোড দিয়া আকাশ থিকা তুষার ঝরাইতাম। বিভিন্ন বাহিনীর যন্ত্রণায় ওইসব জায়গা ভালো কইরা চিনা উঠতে পারি নাই। তবে ওই জায়গাগুলা আমারে টানত। একবার একটা পাহাড়ের ভিতরে কি একটা খনির মত জায়গায় আটকা পড়লাম আমি। বাইরে আমারে খুঁজতেছে। শব্দ পাইতেছি। কিন্তু দেখতেছেনা। আমিও বাইর হওয়ার রাস্তা পাইতেছিনা। বেশ পরে যখন পাইলাম তখন দেখি সামনে ধূ ধূ পাথুরে অঞ্চল। একটা মিনি ট্রাক নিয়া কার্ল জনসন ছুটতে শুরু করল। আর তারে তাড়া করতেছে, ওপরে হেলিকপ্টার, নীচে বিবিধ বাহন…
আরেকবার উঁচা একটা পাহাড়ের ওপর ফিলিং স্টেশনে আটকা পড়ছিলাম। ছোট ফিলিং স্টেশন। তিন দিকে খাদ। আর সামনে রাস্তা ঢালু হইয়া নাইমা গেছে। সবুজ পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় ছোট বড় কালো শিলাখন্ড পইড়া ছিল। মেঘ আইসা লাগতেছে। ওইখানে একটা যুদ্ধমতন হইছিল।
একসময় কার্লরে দিয়া ভায়োলেন্স আমি আর করাইতাম না। চ্যাপেলের সামনের বেঞ্চে বইসা থাকত সে। মানুষ দেখত। মাঝে মাঝে লোনলি কেউ আইসা বেঞ্চের অন্য কোণায় বসত। কখনো কখনো কার্ল চ্যাপেলের ছাদে যাইত। তখন অলরেডি সে গ্রে কালারের ফুলপ্যান্ট আর ফুলস্লিভ চেক শার্ট পরা। ক্যাপ নাই।
গ্যাং এর অন্যদের সাথে কার্ল জনসনের প্রফেশনাল সম্পর্ক ছিল বইলা মনে হইত। দলের মধ্যে সুইট, বিগ স্মোক, রাইডার এই তিনজনের সাথে তার মোটামুটি বন্ধুত্ব ছিল। শুরুর দিকে, একটা মিশনের নাম ছিল সুইট’স গার্লফ্রেন্ড। সুইট আর তার গার্লফ্রেন্ড একটা বাড়িতে আটকা পড়ছে। বাড়িটা ঘিরা আছে অন্য গ্যাং এর মেম্বাররা। তারা গুলি করতেছে বাইরে থিকা। কার্ল যাইয়া বন্ধু আর তার গার্লফ্রেন্ডরে উদ্ধার কইরা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছাইয়া দেয়। আরেক মিশনে বিগ স্মোক আর তার গার্লফ্রেন্ডের একটা ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাইয়া সম্পর্ক ঠিক কইরা দেয় কার্ল। এখন বুঝি, বাস্তবে এইটার কোনো অ্যাপ্লিকেশন নাই।
কার্লরে অনেক নিস্পৃহ লাগত। ম্রিয়মান দেখাইত। তারে একাকীত্বের কারণে এত অসহায় মনে হইত যে তারে আর গ্যাংস্টার ভাবতাম না। আমি, তখন শীতের দিন, বিকালের দিকে বাদামী রঙের ব্লেজারের মত জ্যাকেট পইরা বাইরে হাঁটতে যাইতাম। তখনকার সেই নার্ভাসনেস আমারে কই যে নিয়া গেল! টাইমিংটা মিস হইছিল। এখন আমি জানি, কার্লের কোনো প্রেমিকা ছিল না।
GTA SAN-ANDREAS বিষয়ক লিঙ্ক- http://www.rockstargames.com/sanandreas/
মৃদুল শাওন
Latest posts by মৃদুল শাওন (see all)
- জেলিফিশের জগত/হারুকি মুরাকামি - অক্টোবর 5, 2013
- কেউ একজন গোলাপগুলো এলোমেলো করছে - সেপ্টেম্বর 19, 2013
- আমি আর কার্ল জনসন - আগস্ট 21, 2013