Main menu

শ্রীংলার প্রজেক্ট: হিন্দি ১ নম্বর, বাংলা ২, ইংরাজি ৩

মোগল বা মুর্শিদাবাদের এলিটদের বদলে নয়া, ফ্রেন্ডলি এলিট বানাবার প্রজেক্টে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ভালো কামে দিছে ইংরাজের জন্য। কিন্তু এইটা দরকারের পুরাটা দিতে পারে নাই। বড়ো আরেকটা বান আছিল ফার্সি। ফার্সি কয়েকশো বছরের রাজ-বুলি, জনতা ডাইরেক্ট ফার্সি না লইলেও উর্দু/হিন্দি আর্ট-কালচার হইলো এলিট আর্ট-কালচার; বাংলা বা অহমিয়া বা উড়িয়া ভাষারাও ফার্সি ছোয়ায় ফলতেছে।

মোগল বা পুরানা নবাবী এলিটরা ফার্সি জানেন, কন, উর্দু-হিন্দি আর্ট-কালচার করেন। তারা যদি এমনকি ইংরাজের ব্যাপারে ফ্রেন্ডলিও হন, তবু ইংরাজকে ফার্সি শিখতে হইতেছে! ওদিকে ফার্সির লগে দুশমনি তো গ্রিক-পারসি যুদ্ধ থিকা, আলেকজান্ডার হইয়া ক্রুসেড তক লম্বা! ফার্সি তো আরবিও বাইরের লোকের কাছে![pullquote][AWD_comments][/pullquote]

ফার্সির বদলে ইংরাজি চালু হইলো তাই ১৮৩৫ সালে। ফার্সি এলিট আর আর্ট-কালচারের ইজ্জত কমতে থাকলো। টিকতে হইলে ইংরাজি শেখো, বা ছোটলোক হইয়া যাও। সেই প্রজেক্ট কামিয়াব হইছিল, সেই কারণেই আজকের বাংলাদেশে চোর-চোট্টার নাম নাটকে হয় রমজান, মফিজ-আবুল হইলো বেকুবের চালু নাম, বান্দির নাম নুরজাহান-মমতাজ-লুৎফা।

আসল বেকুবরা কেউ কেউ মনে করে ফার্সি তো মোসলমানী, হিন্দুরা খুব পিছাইয়া আছিল সেই জমানায়, মানে মোগল-নবাবী আমলে। এই বেকুবেরা রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, উঁমিচাদ মনে রাখে না; সত্যজিৎ রায়ের দাদার বাপে কেন মুন্সি, মধুসূদণ দত্ত কেন যশোরের বাড়ির পাশের মসজিদে ফার্সি শিখতো, দুনিয়ার পয়লা ফার্সি নিউজপেপার আখবার কেন রামমোহন রায় ছাপাইলেন, সেই সব নজরে কেমনে পড়বে এদের!

রাজ-বুলি বানানো তাই কামে দেয় ভালো। মনে রাখা দরকার, তখন কিন্তু এখনকার মতো অনেকটা অটোনোমাস রাজ্য, ভাষার/বুলির ইজ্জত বাড়ানিয়া সিনেমা হবার যুগ আছিল না! ইউটিউবের মতো মওকা আছিল না গ্লোবাল হবার। এই যুগেই আমরা যখন ধনীর আর দুনিয়ার সর্দারদের বুলির লগে পারি না, তখন কেমনে পারবে!

বাংলাদেশে হিন্দির ফিউচার ভালো–এমন একখান কথা কইছেন হর্ষবর্ধণ শ্রীংলা। অমনি বাংলাপ্রেম উতলাইয়া উঠছে আমাদের; এর মানে হইলো, আমরা শ্রীংলা-ইন্ডিয়ার প্রজেক্টটাই বুঝি নাই!

বাংলাদেশের ক্রিকেট দলে ক্যাপ্টেন হিসাবে ইংরাজি না জানা কাউকে ভাবতে পারেন? সাকিব ইন্ডিয়ার এক জার্নালিস্টকে কইছিলেন না–হিন্দি না, ইংরাজি প্লিজ? ইন্ডিয়ার ডোমেস্টিক এয়ার লাইন্সের ফ্লাইটে এক হোস্টেজকে আমারো কইতে হইছে–হিন্দি না, ইংরাজি। ভারতের ইন্টার্নাল পলিটিক্সে হিন্দি ১ নম্বর বুলি হইয়া উঠতে চায়, ইংরাজিরে সরাইয়া। ইংরাজি তারা এমনিতেই শেখে, স্কুলের মিডিয়াম হিসাবেই, গ্লোবাল দুয়ার খোলাই রইলো তাতে, হিন্দিটা নেশনালি ১ নম্বর। হিন্দি ঠেকাইতে চাইতেছে ইন্ডিয়ার তামিল বা বাংলা। কিন্তু বাংলাদেশ আরেকটা দেশ, ওয়েস্ট বেঙ্গলে হিন্দির তুলনায় ইংরাজির ইজ্জত কমলে অতো অসুবিধা নাই, বাংলাদেশের আছে। কেন?

আমাদের ক্রিকেট টিম থিকা যেকোন মাঝারি/বড়ো চাকরিতে ইংরাজি লাগবেই। আমরা এইটা পারতাম না অনেকদিনই। ২১ ফেব্রুয়ারির আলগা পিরিতে আমরা ইংরাজি মিডিয়াম উঠাইয়া দিছিলাম, কিন্তু ইংরাজির দরকার দিনে দিনে কমানো তো দূর, আরো বাড়াইছি আমরা। আমাদের ইংরাজি না পারায় মওকা পাইছে ইন্ডিয়া-পাকিস্তান-শ্রীলংকার ইংরাজি জানারা। কয়েক লাখ তেমন লোক বাংলাদেশের সব কর্পোরেটে বইসা আছে শোনা যায়; ইন্টারনেশনাল এনজিওতেও তাই।

কিন্তু গত ২০ বছরে ইংরাজি মিডিয়াম স্কুল আর প্রাইভেট ভার্সিটি, পাবলিক ভার্সিটির মিডিয়াম চেঞ্জ হইতে থাকায় নিচ থিকা ইন্ডিয়ানদের ঠেলা দিতে পারতেছি আমরা! দেশি লোকেরাই সেই সব কাম পারতেছে, ইংরাজি ফ্লুয়েন্ট লাখ লাখ। বাস্তবে বাংলাদেশিদের তুলনায় ইন্ডিয়ার লোকজনের ইংরাজি বিশ্রী মনে হইছে আমার!

এখন ভাবেন, বাংলাদেশে যদি ইংরাজির ইজ্জত হিন্দির তুলনায় কমাইয়া দেওয়া যায়, কত লাভ ইন্ডিয়ার! বাংলাদেশে ইন্ডিয়ার লোকজনের চাকরিগুলা সিকিউর হয় এক চালে!

শ্রীংলার প্রজেক্টটা এইখানে। বাংলা কোন প্রোবলেম না হিন্দির, ইংরাজিরও আছিল না। ইতিহাসে দেখেন, ইংরাজি বরং বাংলারে খাড়া করতে চাইছে কলোনিয়াল কোলকাতায়! হিন্দি বরং বাংলাদেশে বাংলারে সেকেন্ড বানাইয়া রাখতেই চাইবে, ইংরাজিরে ৩ নম্বর; যাতে বিদেশে কনফারেন্সে যাবার কালে বাংলাদেশী মন্ত্রী ইন্ডিয়ান সেক্রেটারি লইয়া যায়!

শ্রীংলার প্রজেক্ট হইলো, ইংরাজিতে আমাদের হাজার হাজার কোটি টাকার ইনভেস্টমেন্ট যেন পানিতে যায়, আমরা যেন আরো বেশি বাংলা মিডিয়াম হইয়া ইংরাজির দায়িত্ব ইন্ডিয়ার হাতে দেই। গ্লোবাল আর্ট-কালচার আমরা যেন বলিউডের বরাতে খাই, সেই দায়িত্ব নিতে চায় হিন্দি। ফার্সির বদলে ইংরাজি কইরা আগের এলিটদের যেমনে ছোটলোক বানাইয়া ফেলছিল, তেমন একটা ফান্দেই পড়তে যাইতেছি আমরা, ইংরাজির বদলে হিন্দি লইয়া।

হিন্দিরে এই স্পেস দেওয়ায় আমাদের বিরাট লোকসান। কিন্তু হিন্দির এই হিম্মত কেমনে হইলো, সেইটা বুঝতে হবে আমাদের। আমাদের হিসাব মিলাইতে হবে, ইন্ডিয়ার মিডিয়াম ইংরাজি হবার পরেও হিন্দি কিভাবে আরো পাওয়ারফুল হইয়া উঠতে থাকলো!

খেয়াল করলে দেখবেন, কলোনিয়াল কোলকাতায় যেই ‘স্ট্যান্ডার্ড বাংলা’ পয়দা হইছে, তারচে অনেক বেশি ডেমোক্রেটিক হিন্দি। বিজেপির হিন্দিতেও ফার্সি শব্দ কতো? বাংলায় যেইগুলা খেদানো হইছে সেক্যুলার এজেন্ডাতেই যেন! হিন্দিতে আপনে সংস্কৃতের সন্ধি-সমাস-প্রত্যয় কতটা পাইতেছেন (হিন্দিতে কয় সামনেওয়ালা, আমাদের কইতে হয় সম্মুখস্থ!)? মোগল নাচ-গানই বলিউডের পুঁজি না? হিন্দি আমজনতার ভাব-বুলি-রুচি লইয়াই আগাইতেছে, আর বাংলা?

কোলকাতার বাংলা যে পারলো না হিন্দির লগে–বৃটিশ ভারতের পয়লা ক্যাপিটাল হইয়াও, মডার্ন ইন্ডিয়ার মা হবার পরেও, তামিল যেমন পারলো তার গোড়ায় আছে কোলকাতার ডেমোক্রেটিক না হওয়া। আমজনতার বুলিতে ফার্সি আছে, সংস্কৃত সন্ধি-প্রত্যয় নাই; কোলকাতা গায়ের জোরে এইগুলা ঢুকাইলো, ফার্সি খেদাইলো। ফল? এই বাংলার চাইতে জনতার ভাবের আর অভ্যাসের কাছের হিন্দি ঢুকতে পারলো ১৪ আনা।

আমাদের তাই হুশিয়ার হইতে হবে। আমরা যদি ডেমোক্রেটিক না হই, জনতার বুলি-ভঙ্গিমা না লই, হিন্দি আরো ঢুকতে থাকবে। আর ইংরাজি তো ছাড়তে পারবোই না আমরা, তাই বাংলা হবে ৩ নম্বর, ১ নম্বর হিন্দি।

 

২১ জানুয়ারি ২০১৮

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

রক মনু

কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →