Main menu

বায়েজিদ বোস্তামী

হযরত শায়েখ ফরিদুদ্দীন আত্তার ১২’শ ২১ সালে মোঙ্গলদের হাতে নিহত হন। নিশাপুরে হামলার পর মোঙ্গলরা আরও অনেকের সাথে উনারেও কয়েদ করে নিয়া যাইতেছিল। পথে এক লোক তাদের বললো, এই আল্লার ওলিরে এই কবিরে মুক্ত কইরা দাও, তোমাদের জন্য এক হাজার দিনারের বন্দোবস্ত করতেছি।

কিন্তু আত্তার তাতারদের বললেন, এই দাম আমার উপযুক্ত না। এই কথায় তারা ভাবলো, হয়তো উনার দাম আরও বেশি। তো পায়ে শিকল দিয়া আত্তাররে নিয়া তারা আগায়তে থাকলো। কিছু সময় পর এক গরিব লোক আইসা মিনতি জানাইলো, উনারে তোমরা ছাইড়া দাও। বিনিময়ে আমি তোমাদের ওই যে খড়ের পালাটা দেখতেছ, পুরাটাই দিয়া দিবো। তার এই কথায় আত্তার তাতারদের বললেন, আমার দাম আসলে এর চাইতেও কম। তোমরা বিবেচনা কর কী করবা।

তখন হাজার আশরাফি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ক্ষোভে এক তাতার আত্তারের গলায় তলোয়ার চালায় দেয়। আর আত্তার মারা যান, এমন অবস্থায় যে, নিজের জীবনের জন্য তুচ্ছ দামটাও উনি নির্ধারণ করতে পারেন নাই।

তো এই আত্তার যখন কিছু লেখেন বা বলেন, শুধু উনি বেটার লেখক বইলাই যে তা উমদা হয়া উঠে, ব্যাপারটা অমন না। উনার বড় সামান হইলো রুহানিয়্যাত।

ভাষা পরবর্তনশীল হইলেও মানুষের আত্মার পুরান চাওয়া প্রায় একই। তাই হাজার বছর পরও উনি তর্জমা হন। একটা ভাষা থিকা আরেকটা ভাষায় আত্তার কই কই কতদূর মানুষের মনে চইলা যান।
আমি উনার মশহুর কিতাব ‘তাজকিরাতুল আউলিয়া’র দুইটা অংশ – হযরত বায়েজিদ বোস্তামী আর রাবেয়া বসরীর জীবনীটুকু তরজমা করছি। রাবেয়া বসরীর ভূমিকায় তরজমার প্রাসঙ্গিকতা নিয়া দরকারি আলাপ করা হইছে। তাই এইখানে শুধু হযরত বায়েজিদ বিষয়ে সামান্য বলতেছি।

হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (১৩১-২৬১ হিজরী/৭৪৮-৮৭৪ ঈসায়ী) হইলেন সুফিদের সুফি। পুরা নাম আবু ইয়াজিদ তাইফুর ইবনে ঈসা ইবনে আদম সরুশান বোস্তামী। উপাধি সুলতানুল আরেফিন। হযরত বায়েজিদের জন্ম-মৃত্যু সাল নিয়া এখতেলাফ বা মতভেদ আছে। এছাড়া উনার জিন্দেগি নিয়া ধারাবাহিক কোনো বর্ণনা নাই। টুকরা টুকরা অংশ, যা সমসাময়িক এবং পরবর্তী সুফি ও কবিদের লেখায় আসছে, বেশিরভাগই উনার শাগরেদ আর ভক্তদের বয়ান। ফলে ইতিহাসের কোনো ভাঙা বা মসৃণ কাচ দিয়া এইগুলা বিবেচনার না। এইগুলা হইলো অনুভবের ব্যাপার।

হযরত বায়েজিদ বড় ঘরের সন্তান আছিলেন। উনার দাদা বিশাল কুমিস প্রদেশের গর্ভনর আর বড় দৌলতমন্দ ছিলেন। কিন্তু বায়েজিদের জন্ম হইছিল বোস্তামের সুফি মহল্লায়, তার বুজুর্গ বাপ তাইফুরের ঘরে। উনার মা-বা দুইজনেই ছিলেন খোদার দেওয়ানা। আলমে আরওয়াহ থিকা নিয়া আসা তাদের সন্তানও তাগো মতোন হইলো আর দুনিয়ার আবেগী হিস্ট্রিগুলার মধ্যে শীর্ষ হয়া থাকলো।

বাংলাদেশের চট্টগ্রামে হযরত বায়েজিদ বোস্তামীর (রহ.) নামে যেই দরগাহ বা মাজার আছে, এইরকম পৃথিবীর আরও অনেক দেশেই আছে। ভক্ত-আশেকানরা নানা সময়ে হযরতের নামে এই খানকাগুলা করছেন। তবে উনার আসল মাজারটা ইরানের বোস্তামে। বায়েজিদের কবরের মর্মর পাথরে হযরত আলীর (রাযি.) কবিতা লেইখা দিছেন কেউ। এইটা খুবই মিলছে। উনাদের দুইজনের ব্যক্তিত্ব আর বলাগুলার উৎস তো একই।

তাজকিরাতুল আউলিয়ার বাংলা অনুবাদ যা হইছে এ পর্যন্ত, ভালো তো না-ই, বরং আত্তারের লেখারে মাইরা ফেলছেন অনুবাদকরা। মূল থিকা তরজমা না হওয়ায় ওইসব অনুবাদ ভাসা ভাসা পানার মতোই কিছু লাগে যেন। তাই যখন ইমরুল ভাই তাজকিরাতুল আউলিয়ার দারুণ একটা ফার্সি এডিশন, যা কিনা ১৯০৫ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের অধ্যাপক রেইনল্ড এ. নিকলসনের সম্পাদনায় লন্ডন থিকা বের হইছে, জোগাড় কইরা দিলেন, কাজটায় হাত দিলাম আমি।

তো উনারে শুকরিয়া জানায়া খতম করলাম। আর শুকরিয়া, বইটা প্রকাশে যারা মন দিয়া মেহনত করছেন – সাদ্দু ভাই আর যুবা ভাই, উনাদেরও।

হাসসান আতিক
মগবাজার, ঢাকা

 

……………………………………………………….

ফরিদ উদ্দীন আত্তারের
বায়েজিদ বোস্তামী
কিছু জিব্বা তো এমন, কান যার ভাষা জানে না
……………………………………………………….
খোদার খলিফা, আরেফদের সম্রাট, সৃষ্টির দলিল, রহস্য আর হাকিকতের চাবিওলায়া, সীমাহীন হিম্মতওয়ালা, প্রেম আর আবেগের দরিয়া, আলা-দরজার মুহাদ্দেস, মুজাহাদায় বিলীন – হযরত বায়েজিদ বোস্তামী; যার হাতে মারেফত আর তরিকতের রাস্তা নতুন কইরা বিস্তারিত হইছে।
হযরত জোনায়েদ বাগদাদী বলেন, ফেরেশতাদের মধ্যে যেমন জিব্রাইল, সুফিদের মধ্যে তেমন বায়েজিদ। তাওহিদের মাকামে সকল বুজুর্গদের শেষটা হইলো বায়েজিদের শুরু।

হযরত বায়েজিদ বলেন, মারেফতের বাগানে বছরের পর বছর থাকার পরেই কেউ একটা ফুল ফুটাইতে পারে। কিন্তু কোনোভাবে আমার তা মিলা গেছে বাচ্চা বয়সেই। শায়েখ আবু সাঈদ বলেন, আমি পুরা দুনিয়ারে বায়েজিদের সিফাতের নিচে রাইখাও উনার শুরু-শেষ পাই নাই।

বায়েজিদের দাদা ছিলেন আগুনপুজারী। আর বাপ ছিলেন পারস্যের বড় বুজুর্গ। উনার মা বলেন, বায়েজিদ যখন পেটে ছিল, আমি কোনো সন্দেহযুক্ত খাবার খাইতে পারতাম না। মানে ওই খাবার কীভাবে কার কাছ থেকে আসছে, কোন দেরহামে তা খরিদ করা হইছে, এইসব না জাইনা যা-ই খাইতাম, হজম করতে পারতাম না। অসহ্য এক ব্যথা আর অস্থিরতা কাজ করতো। আমি মুখে আঙুল দিয়া ওই খাবার বের কইরা ফেলতে বাধ্য হইতাম। আমার বায়েজিদ পেটে থাকতেই খোদার ওলি ছিল।

বায়েজিদ বলেন, মারেফত-তরিকতের রাস্তায় সবচেয়ে বড় সামানটা মানুষ পায় জন্মগতভাবেই। এরপর হাসিল করা লাগে আন্ধা চোখ আর জাগনা কান। যদি এই তিনটা জিনিস একসাথে না পাওয়া যায়, তাইলে হুট কইরা একদিন মইরা যাওয়াই বেটার।

বায়েজিদরে যখন বাচ্চাকালে মকতবে ভর্তি করা হইলো, তিনি সুরা লুকমানের এই আয়াতটা – আনিশকুর-লি ওয়ালি-ওয়ালিদাইকা (তুমি আমার শুকরিয়া আদায় করো, আর তোমার মা-বাপের) যখন পড়লেন, বাড়িতে ফিরা আসলেন। আর মায়েরে বললেন, আপনি আমারে খোদার কাছ থেকে চেয়ে নেন, যেন আপনার খেদমত কইরা শুকরিয়া জানাইতে পারি। অথবা আমারে খোদার জন্য দান কইরা দেন, যেন তার শোকরে মশগুল হইতে পারি। কারণ একটা জীবন দুইখানে কোরবান করা পসিবল না।মা বললেন, আমি খোদার কাছে তোমারে সোপর্দ করলাম। আর নিজের হক থিকা দুই হাত তুইলা নিলাম।

এরপর বায়েজিদ সিরায়ার পথে বের হইলেন আর লম্বা সময় এলেম হাসিলে রত রইলেন। এই সময়ে উনি প্রায় ১৭০ জন বুজুর্গের সোহবত নেন। তাদের মধ্যে হযরত ইমাম জাফর সাদেকের মতো উঁচা মাকামের মানুষও ছিলেন। বায়েজিদ তাদের সবার ফয়েজগুলা এক কইরা নিজেরে নিয়া যান এমন মাকামে, যার না আছে আদি, না আছে অন্ত।

 

কিছু জিব্বা তো এমন, কান যার ভাষা জানে না 

বায়েজিদ বোস্তামী সেই সময়টায় ইমাম জাফর সাদেকের খেদমতে ছিলেন। উনার ফয়েজ লাভের আশায় দিনরাত এক কইরা দিছিলেন। বছর তিনেক পর জাফর সাদেক বললেন, বায়েজিদ, বুকসেল্ফ থিকা অই কিতাবটা নিয়া আসো তো। বায়েজিদ জিজ্ঞাসা করলেন, ওই তাক কোথায়। এই প্রশ্নে জাফর সাদেক আশ্চর্য হইলেন। বললেন, এই এতগুলা বছরে তুমি লাইব্রেরির তাকগুলাও ঘাইটা দেখ নাই! বায়েজিদ গলা নিচা কইরা বললেন, আসলে আমি তো এখনো আপনার মুখের দিকে চোখ তুলি নাই। এই শুইনা উস্তাদ কিছুক্ষণ চুপ রইলেন। তারপর বললেন, বায়েজিদ, তোমার মাঝে পূর্ণতা আসছে। তুমি এইবার বোস্তামে চইলা যাও।
একবার বায়েজিদ এক বুজুর্গের কাছে আসছেন ফয়েজ লাভের আশায়। তো দূর থেকে খেয়াল করলেন – ওই বুজুর্গ লোকদের সাথে কথা বলতেছেন আর ফাঁকে ফাঁকে পশ্চিমদিকে থুতু ফেলতেছেন। এইটাতে বায়েজিদ আর তার সাথে দেখা করলেন না, ঘরে ফিরা আসলেন। ঘরের সবাই ওই বুজুর্গের ব্যাপারে জানতে চাইলো। বায়েজিদ বললেন, উনি যদি তরিকতের দরজাগুলার ব্যাপারে জানতেন, তাইলে খোদার ঘরের দিকে থুতু ফেলতেন না।
হযরত বায়েজিদ বোস্তামির আদব-লেহাজ এমন ছিল যে, উনি মসজিদের রাস্তাতেও কখনো থুতু ফেলতেন না। হাঁটতেন খুব মিহি কইরা। যেন স্যান্ডেলের শব্দ বাতাসে না উড়ে, যেন উনি প্রত্যাশিত কারো কাছে যাইতেছেন, যে তার অপেক্ষা করতেছে।
উনি সম্মান করাটারে খুব গুরুত্ব দিতেন, আর নিজের জন্য বরাদ্দ সম্মান থেকে এমনভাবে পালাইতেন, যেমন মরুসিহং দেইখা লোকে ভাগে।
হজের পয়লা সফরে উনি কিছু দূর আগানোর পরই বলেন, বায়তুল্লাহ দুনিয়ার কোনো রাজা-বাদশার দরবার না যে, মানুষ সেইখানে হুট কইরা হাজির হবে। উনি কিছুদূর পর পর নামাজ আদায় করতে থাকলেন। এইভাবে অসংখ্য দীর্ঘ রুকু সেজদাসহ মক্কায় পৌঁছতে পুরা বারো বছর লাইগা যায় বায়েজিদের। উনি হজ পালন করেন। কিন্তু মদিনায় যান না। বলেন, এইটা মানুষের কেমন মনে করা যে, মক্কায় আসছি, এখন মদিনায় না গেলে কেমন দেখায়। এইটা তো শরমের কথা। আমি মদিনায় যাবো অন্য কোনো বারে, অন্য কোনো দীর্ঘ সফরসহ হাজির হবো ওই শহরে; আমার রাসুলের হৃদয় আর সাহাবীদের ভালোবাসা যার ধুলায় আলোর গাছ বুনছিল, যার পুরান পাথরগুলায় উনাদের কান্না জইমা আছে আজও। আমি সেই কণ্ঠগুলার জন্য দূর সমুদ্রে উইড়া যাওয়া সাদা পাখির মতো ফিরা আসবো, হয়তো ঝিরিঝিরি এক মরুসন্ধ্যায়, যখন আগামী দিনের এন্তেজারে বেলা ডুইবা যাবে।
এর পরের বছর বায়েজিদ মদিনার উদ্দেশ্যে বের হন। তখন তার সাথে হাজারো লোক শামিল হয় এবং কাফেলা যত সামনে আগাইতে থাকে, মানুষের ভিড় তত বাড়তে থাকে। বায়েজিদ বোস্তামি এই ভিড় এড়াইতে বেশি বেশি দোয়া করতেছিলেন। তো এক ফজরে উনি বলা শুরু করলেন, ‘হে লোক সকল তোমরা কি টের পাইতেছ না যে, আমি হইলাম তোমাদের খোদা। তারপরও তোমরা আমার ইবাদত করতেছ না! হইলো কী তোমাদের!’

এই কথায় লোকেরা একে একে তার থেকে বিদায় নিলো। আর বলতে থাকলো, বায়েজিদ শেষ, সে ফেরাউনের মতো নিজেরে খোদা দাবি কইরা বসলো ফাইনালি। তারা সেই প্রবাদও উল্লেখ করলো – ‘অতি মিষ্টি ভালো না।’তো হযরত বায়েজিদ এইভাবে সঙ্গমুক্ত হইলেন। আসলে উনি যা বলছেন তা বলানো হইছে। এইটা বুঝতে পারাই মারেফত। কিছু জিব্বা তো এমন, কান যার ভাষা জানে না।

সত্য মাঝে মাঝে বাতাসে ঝইরা পরে
একবার এক শীতের সকালে রাস্তার পাশে মানুষের একটা পুরানা খুলি পাইলেন বায়েজিদ। তাতে কিছু লেখা দেখা যাইতেছিল। তিনি খুলিটা হাতে নিয়া ধুলামাটি মুছলেন। লেখাটা তখন স্পষ্ট হইলো – ‘ছুমমুন বুকমুন উম্য়ুন, ফাহুম লা ইয়াকিলুন (তারা বোবা, বধির, আন্ধা। তাই তারা বোঝে না)  – কোরানের এই আয়াতটা। এইটা পইড়া বায়েজিদ চিৎকার দিয়া কাইন্দা উঠলেন আর জ্ঞান হারায় ফেললেন। কিছুক্ষণের মধ্যে লোকজন জড়ো হয়া গেল। তারা ব্যাপারটার কিছুই বুঝতে পারতেছিল না। এইভাবে কিছুক্ষণ গেলে বায়েজিদ জ্ঞান ফিরা পাইলেন আর ওই খুলিটায় চুমা খাইতে লাগলেন। বললেন, এই বুজুর্গ খোদার মাঝে এতটা হারায় গেছিলেন যে, তার কান বাইরের কিছুই শুনতো না, চোখ দেখতো না, মুখ কথা বলতো না। উনি নিজেরে সব কিছু থিকা বিচ্ছিন্ন করছিলেন। খুলির এই লেখা তার আক্ষরিক স্বীকৃতি। এইভাবে সত্য মাঝে মাঝে বাতাসে ঝইরা পরে, হে ভায়েরা।
হযরত জুন্নুন মিসরী বায়েজিদের কাছে চিঠি পাঠাইলেন এই লেইখা – আপনি সারা রাত আরাম কইরা কাফেলার পিছে থাইকা যান। উনি উত্তর লেখলেন – যে রাতভর শান্তির ঘুম দিয়া মঞ্জিলে চইলা আসে, আর কাফেলা পিছনে থাইকা যায়, উনিই কামেল। জুন্নুন মিসরী বললেন, এইবারের সফরে খোদা আপনারে যেন আরও বরকত দেন। আপনার মাকাম আমাদের সবার ঊর্ধে।
মদিনা থেকে ফেরার পথে লোকেরা দেখল, বায়েজিদ তার উটের পিঠে একপাহাড় সামানপাতি বাইন্ধা দিছে। তারা বললো, এই উটের উপর আপনি জুলুম করতেছেন। এইটা আপনে কেমনে করেন হজরত। তো বায়েজিদ বললেন, আপনারা হয়তো খেয়াল করেন নাই, ভালো কইরা দেখেন বোঝা উটের পিঠে কিনা। লোকেরা এইবার কাছে গিয়া দেখলো বিশাল বোঝাটা পিঠের চার আঙুল উপরে ভাইসা আছে। এইটা দেইখা সবাই পেরেশান হয়া গেল। তারা প্রবল জিজ্ঞাসার গোল গোল চোখ নিয়া তার দিকে তাকাইলো। তখন বায়েজিদ বললেন, এই জন্যই আমি সঙ্গ এড়ায় চলি। এইখানে অবস্থা হইছে – আমি যদি নিজের ব্যাপারগুলা লুকায় রাখি তো লোকে প্রশ্ন করে, যখন উত্তর দেই তারা বোকা বইনা যায়, আর পরে এই নিয়া নানা রকম শোরগোল করে। বায়েজিদ বললেন, জিয়ারতে-মদিনা যেহেতু শেষ, আমরা জুদা হয়া গেলেও পারি। আমি ভাবতেছি, বোস্তামে মায়ের কাছে যাবো।
তো লোকদের থেকে আলাদা হয়ে বায়েজিদ বোস্তামের পথে রওনা দিলেন। শহরে পৌঁছতে আরও অনেকটা পথই বাকি, উনি দেখলেন – বোস্তামবাসী তারে অভিনন্দন জানাইতে আগায় আসছে। তাদের সংখ্যাও অনেক। উনি এই সঙ্গ এড়াইতে চাইলেন। রোজার দিন ছিল, বায়েজিদ কিছু খাবার কিনলেন আর সবার সামনে খাইতে থাকলেন। এতে লোকজন সেই আগেরবার যেমন বলছিল যে – বায়েজিদ শেষ, তার সব গেছে, অতি অহংকারে যা হয় আরকি – এইসব বলতে বলতে হাতের ফুল হাতে নিয়া তারা ফিরা গেল। দূর থেকে তাদের কমতে থাকা দেখতে দেখতে খাবার মুখে হাসতে ছিলেন মুসাফির বায়েজিদ। উনি সরাইখানার ম্যানেজাররে বললেন, এই লোকরা আমারে মুসাফির মনে করতে পারল না, অথচ তারা সবাই জানে আমি কতদূর থিকা সফর কইরা আসছি। আর তাদের এইরকম ব্যাপারটা নিয়া খুব কম লোকই ভাববে। আর ভাববে না, কেন সঙ্গ থিকা দূরে থাকা জরুরি।
এইভাবে বায়েজিদ যখন আড়ালে আড়ালে বাড়িতে পৌঁছাইলেন, মায়ের গলা শোনা যাইতেছিল। বায়েজিদ দরজায় কান দিয়া শুনলেন, ওজু করতে করতে তার মা বলতেছেন – হে খোদা, আমার মুসাফিররে তুমি শান্তিতে রাইখো আর বুজুর্গদের চোখের মনি বানায়ো। এই দোয়া শুইনা বায়েজিদ কাইন্দা ফেললেন এবং দরোজায় নক করলেন। মা বললেন, কে? বায়েজিদ উত্তর করলেন, আপনার মুসাফির। উনি দরোজা খুললেন আর জড়ায় ধরে অনেক্ষণ পর বললেন, তুমি এত দীর্ঘ সফরের পথ বাইছা নিছ যে, এই দেখো, কানতে কানতে আমার চোখের আলো নিভা গেছে, পেরেশানিতে কোমর বাঁইকা গেছে। তবে আমি জানতাম লম্বা পথেই তুমি যাত্রা দিবা।
বায়েজিদ বলেন, যেই কাজ পরে হাসিল করবো বইলা রাইখা দিছি, ওইটা দেখি আগেই হাসিল হয়া আছে – আমার মায়ের ভালবাসা, আমার জন্য তার চাওয়া আর হাসিগুলা।

 

পানি হাতে গাছের মতো দাঁড়ায় থাকা

মায়ের বরকত : বায়েজিদ বলতেন, আমি যা কিছু পাইছি, সবই মায়ের অনুগত হওয়ার কারণে। একবার রাতের বেলা মা পানি খাইতে চাইলেন। ওইসময় ঘরে সামান্য পানিও ছিল না। আমি মশক নিয়া দূরের নহর থিকা পানি আনতে বের হইলাম। ওই রাতে পথ তেমন ভালো দেখা যাইতেছিল না, ভরা মশক নিয়া ফিরতে বেশ দেরিই হয়া যায়। তো ভরা পানির গ্লাস নিয়া যখন শিয়রে গেলাম, দেখি মা ঘুমায় গেছেন। তখন ওই পানি হাতে একটা গাছের মতো দাঁড়ায় থাকলাম। দীর্ঘ সময় পর মা যখন জাগলেন, আমারে এইভাবে পানি হাতে খাড়া দেইখা অবাক হইলেন। বললেন, তুমি কেন এইভাবে দাঁড়ায় আছ। পানি তো আমার লাগতেছিল না, তাই কখন ঘুমায় গেছি, জানিও না। তুমি এতটা না করলেও পারতা। আমি বললাম, মা, ঘুম থেকে জাইগা পানি খাইতে যেন আপনার কোনো কষ্ট না হয়, সেইজন্য দাঁড়ায় আছি।
আমার এই কথায় মা আমারে দোয়া দিলেন। তার ওইদিনের চোখ থিকা যেই কান্নাগুলা বের হইছিল, সেইসব ছিল তার আত্মায় জমানো অনেক দিনের আবেগ, গোপন দুঃখ আর আনন্দগুলা; আমার মা কৈশোরেই আমারে ওইসবের মালিক বানায় দিছেন। এইজন্য আমি মায়ের খুব লেহাজ করতাম।
একবার মা ঘুমানোর আগে বলছিলেন, বায়েজিদ, জানালার একটা পাট বন্ধ কইরা দাও বাবা। তখন আমি বুঝতে পারতেছিলাম না – কোনটা বন্ধ করলে মায়ের বেশি সুবিধা হবে। তাই আমি সারারাত একবার বাঁয়ের পাট একবার ডানের পাট বন্ধ করতেছিলাম আর খুলতেছিলাম। আমি নিজেরে মায়ের জন্য এইভাবে সঁইপা দিছিলাম।

 

সবকিছুর জানাজা পইড়া ফেলা

রিয়াজত, মুজাহাদা : বায়েজিদ বলেন, আমি বারো বছর নফসরে রিয়াজতের চুলায় মুজাহাদার আগুন দিয়া পুড়াইছি। তারপর ভৎর্সনা-মালামতের হাতুড়ি দিয়া দিনের পর দিন পিটাইছি। পরে আমার নফস শান্ত আর নিরাপদ হইলো। পরে আরও পাঁচ বছর নানান ইবাদত দিয়া তারে বার্নিশ করলাম। এরপর যখন বছরখানেক নিজেরে নিজেই ঘুরায় ঘুরায় দেখলাম, অহং আর তাকাব্বুরের নিশানা পাইলাম। ফের পাঁচ বছর মেহানতের পর আমার নফসরে মুসলমান বানাইতে পারলাম। আর যখন তাতে সৃষ্টির নজর দিলাম, সমস্ত কিছুরে দেখলাম মরা, ভাসমান। তখন আমি সবকিছুর জানাজা পইড়া ফেললাম। আর ফিরা আসলাম, যেমন লোকেরা কাউরে কবর দিয়া ফিরা আসে এবং দুনিয়ায় তার সাথে দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের ব্যাপারটা রাখে না। এইভাবে খোদাতালার দিকে চইলা যাওয়া রাস্তায় ওঠি।
হযরত বায়েজিদ মসজিদে ঢোকার আগে দরজা ধইরা প্রায়ই কানতেন। লোকেরা একবার এইরকম কান্না বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলো। বায়েজিদ বললেন, মসজিদে ঢোকার আগে নিজেরে আমার ঋতুবতী মহিলা মনে হয়। মনে হয়, আমি ঢুকলে মসজিদ পাক থাকবে তো!
একবার হজের এরাদায় সফরে বের হয়ে বায়েজিদ ফিরা আসলেন। লোকেরা বললো, আপনি ইচ্ছারে কেন ভাইঙ্গা ফেললেন। বায়েজিদ বললেন, কয়েক মনজিল যাওয়ার পর এক হাবশি লোকের সাথে দেখা হইলো। উনি আমারে বললেন, খোদারে বোস্তামে রাইখা কই যাইতেছেন বায়েজিদ। তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে, আমারে শহরে ফিরা আসতে হইলো।
আরেকবার এইরকম হজের সফরে বের হইছেন। তো এক লোক আইসা জিজ্ঞাসা করলোÑ বায়েজিদ, আপনি কই যাইতেছেন। বললেন, হজ করার এরাদায় বের হইছি। ওই লোক বললো, আপনার কাছে তো তাইলে টাকাপয়সা কিছু আছে। হ্যাঁ, দুইশ দিনার। তখন ওই লোকটা বললো, দেখেন, আমি খুব গরিব আর আমার ঘরে ছোট-বাচ্চারা খাবারের অপেক্ষায় আছে। আপনি সাতবার আমারেই তওয়াফ করেন আর দিনারগুলা দিয়া যান। আপনি হজের চেয়ে বেশি পাবেন। বায়েজিদ তার কথা মতো আমল করলেন আর বোস্তামে ফিরা আসলেন।
যখন এইভাবে উনি মারেফতের নানাস্তর পার হইতেছিলেন, তখন সাধারণ মানুষ উনারে আর বুঝতে পারতেছিল না, উনার কথাগুলা ধরতে পারতেছিল না। তারা হযরত বায়েজিদরে সাতবার বোস্তাম থেকে বের কইরা দেয়।তো যখনই উনারে বের কইরা দেওয়ার প্রস্তুতি চলতো, উনি কারণ জানতে চাইতেন। তখন লোকেরা বলতো, আপনি ভ্রান্ত, আপনি খুব বদ লোক। এই কথায় বায়েজিদ বলতেন – যেই শহরে বায়েজিদ সবচেয়ে খারাপ লোক, ওইটা পৃথিবীর সেরা শহর।

………………………………….

বইটা কিনতে ক্লিক করতে পারেন, এই লিংকে:

https://www.facebook.com/104569201433393/photos/a.107784791111834/110756810814632/?type=3&__tn__=-R

 

The following two tabs change content below.
Avatar photo

হাসসান আতিক

কবি, অনুবাদক। আরবি, ফার্সি, উর্দু এই তিন ভাষা থেকে অনুবাদ করেন। পেশায় সাংবাদিক। জন্ম আর বাড়ি টাংগাইলের বাসাইলে ।
Avatar photo

Latest posts by হাসসান আতিক (see all)

এডিটর, বাছবিচার।
View Posts →
কবি, গল্প-লেখক, ক্রিটিক এবং অনুবাদক। জন্ম, ঊনিশো পচাত্তরে। থাকেন ঢাকায়, বাংলাদেশে।
View Posts →
কবি। লেখক। চিন্তক। সমালোচক। নিউ মিডিয়া এক্সপ্লোরার। নৃবিজ্ঞানী। ওয়েব ডেভলপার। ছেলে।
View Posts →
মাহীন হক: কলেজপড়ুয়া, মিরপুরনিবাসী, অনুবাদক, লেখক। ভালোলাগে: মিউজিক, হিউমর, আর অক্ষর।
View Posts →
দর্শন নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা, চাকরি সংবাদপত্রের ডেস্কে। প্রকাশিত বই ‘উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে’ ও ‘এই সব গল্প থাকবে না’। বাংলাদেশি সিনেমার তথ্যভাণ্ডার ‘বাংলা মুভি ডেটাবেজ- বিএমডিবি’র সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সমন্বয়ক। ভালো লাগে ভ্রমণ, বই, সিনেমা ও চুপচাপ থাকতে। ব্যক্তিগত ব্লগ ‘ইচ্ছেশূন্য মানুষ’। https://wahedsujan.com/
View Posts →
কবি। লেখক। কম্পিউটার সায়েন্সের স্টুডেন্ট। রাজনীতি এবং বিবিধ বিষয়ে আগ্রহী।
View Posts →
গল্পকার। অনুবাদক।আপাতত অর্থনীতির ছাত্র। ঢাবিতে। টিউশনি কইরা খাই।
View Posts →
জন্ম ২০ ডিসেম্বরে, শীতকালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অপরাধবিজ্ঞান বিভাগে পড়তেছেন। রোমান্টিক ও হরর জনরার ইপাব পড়তে এবং মিম বানাইতে পছন্দ করেন। বড় মিনি, পাপোশ মিনি, ব্লুজ— এই তিন বিড়ালের মা।
View Posts →
জন্ম ১০ নভেম্বর, ১৯৯৮। চট্টগ্রামে বেড়ে ওঠা, সেখানেই পড়াশোনা। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে অধ্যয়নরত। লেখালেখি করেন বিভিন্ন মাধ্যমে। ফিলোসফি, পলিটিক্স, পপ-কালচারেই সাধারণত মনোযোগ দেখা যায়।
View Posts →
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করেন। সংঘাত-সহিংসতা-অসাম্যময় জনসমাজে মিডিয়া, ধর্ম, আধুনিকতা ও রাষ্ট্রের বহুমুখি সক্রিয়তার মানে বুঝতে কাজ করেন। বহুমত ও বিশ্বাসের প্রতি সহনশীল গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের বাসনা থেকে বিশেষত লেখেন ও অনুবাদ করেন। বর্তমানে সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোস্যাল সায়েন্সেস, ক্যালকাটায় (সিএসএসসি) পিএইচডি গবেষণা করছেন। যোগাযোগ নামের একটি পত্রিকা যৌথভাবে সম্পাদনা করেন ফাহমিদুল হকের সাথে। অনূদিত গ্রন্থ: মানবপ্রকৃতি: ন্যায়নিষ্ঠা বনাম ক্ষমতা (২০০৬), নোম চমস্কি ও এডওয়ার্ড এস হারম্যানের সম্মতি উৎপাদন: গণমাধম্যের রাজনৈতিক অর্থনীতি (২০০৮)। ফাহমিদুল হকের সাথে যৌথসম্পাদনায় প্রকাশ করেছেন মিডিয়া সমাজ সংস্কৃতি (২০১৩) গ্রন্থটি।
View Posts →
তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, তবে কোন বিষয়েই অরুচি নাই।
View Posts →
পড়ালেখাঃ রাজনীতি বিজ্ঞানে অনার্স, মাস্টার্স। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে সংসার সামলাই।
View Posts →
মাইক্রোবায়োলজিস্ট; জন্ম ১৯৮৯ সালে, চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে। লেখেন কবিতা ও গল্প। থাকছেন চট্টগ্রামে।
View Posts →
জন্ম: টাঙ্গাইল, পড়াশোনা করেন, টিউশনি করেন, থাকেন চিটাগাংয়ে।
View Posts →
বিনোদিনী দাসী (১৮৬২/৩ - ১৯৪১): থিয়েটার অভিনেত্রী, রাইটার। ১৮৭৪ থেকে ১৮৮৬ এই ১২ বছর তিনি কলকাতার বিভিন্ন থিয়েটারে অভিনয় করেন। কবিতার বই – বাসনা এবং কনক ও নলিনী। আত্মজীবনী - ‘আমার কথা’ (১৯২০)।
View Posts →